সুবাসের দ্বিতীয় পক্ষ

সুবাস কিংবা তার মৃতদেহকে ভ্যানে তোলার দৃশ্য
বিশ-পঁচিশ হাত দূর থেকে অবলোকন করে অনিমেষ বেশ দ্রম্নতই বাড়ির পথ ধরল। কয়েক পা এগিয়ে একবার কবজির ঘড়িতে সময় দেখল, রাত দুটো বিয়ালিস্নশ। ও মরে গিয়ে থাকলে নিশ্চিত একটা পুলিশি ঝামেলা হবে। তাই অনিমেষ আগে থাকতেই মানে মানে ওই জায়গাটা ত্যাগ করে। ওর শরীরটা ঠান্ডা হয়ে একেবারে নিথর মেরে গিয়েছে, বিবর্ণ জিভ আটকে আছে দুপাটি অপরিচ্ছন্ন দাঁতের ফাঁকে। হয়তো বাঁচবে না, কিংবা এতোক্ষণে মনোবাঞ্ছা পূরণ করে পৃথিবীর পাততাড়ি গুটিয়েই ফেলেছে।
আজ এদেশে বাইশে রমজানের রাত, ব্যবসার মোক্ষম সময়। শহরের প্রধান রেডিমেড কাপড়ের জমজমাট এয়ারকন্ডিশন্ড দোকানটার বিকম পাশ ম্যানেজার একসময়কার নাট্যকর্মী অনিমেষ রায়। হিসাবপত্তর মিলিয়ে কলাপসিবল গেট বন্ধ করতে করতে রাত দুটো দশের মতো বেজে গেল। দোতলা থেকে নিচে নেমে রাস্তার পাশের দোকানে দড়ির আগুন থেকে একটা স্টার সিগারেট ধরানোর সময় বিদ্যুৎ চলে গিয়ে চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে দেয়। অবশ্য দু-এক মিনিটের মধ্যে খোলা-থাকা দু-তিনটি দোকানের চার্জার বাতি জ্বলে ওঠায় আলো-আঁধারির ভেতর ধীরপায়েই বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল ক্লান্ত অনিমেষ। সে-সময় সে খেয়াল করে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, ঠান্ডা বাতাস ছেড়েছে, বৃষ্টি নামতে পারে। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় রাস্তার ধুলোবালি উড়ে ওর চোখেমুখে পড়ল। ঠিক তখনই কেমন একটা গোঙানির মতো আওয়াজ আসে কানে। প্রথমে সে ভাবল রাস্তার ছালাপরা আধবুড়ো পাগলটা কিংবা রুগ্ণ কুকুরের আওয়াজ হয়তো। তখন দুহাতে চোখ কচলে ডানদিকে রাস্তার পাশে বন্ধ লন্ড্রিতে দৃষ্টি গেলে হঠাৎ মনে হয় টিনের বারান্দার আড়ার সঙ্গে কী যেন ঝুলে আছে। মানুষ নয় তো – আরে ওই গোঙানির মতো আর্তনাদের উৎস তো ওটাই! দুপা এগিয়ে জিনিসটার ওপর মোবাইল ফোনের টর্চের আলো ফেলে দেখে লোহার আড়ার সঙ্গে দিব্যি একটা মানুষ ঝুলে আছে, তার গলায় নাইলনের কমলা রঙের রশি। অনিমেষ ছোটবেলায় শুনেছিল রাতবিরেতে এমনসব কা- করে ভূত-প্রেত মানুষকে ভয় দেখায়। ভূতেরা নাকি নিজের মাথা কেটে রক্তাক্ত মুণ্ড‍ু নিয়ে ফুটবল খেলতে পারে, খেলা শেষ হলে মাথাটা আবার জুড়ে নেয়। কিন্তু এখন কোনো ভয়টয় পেল না সে, বিশেষ করে খোঁচা খোঁচা দাড়িবিশিষ্ট শ্যামবর্ণ লোকটার মুখ তার খুব চেনা, যদিও এ-মুহূর্তে ওর সঠিক পরিচয় মনে পড়ে না। রাত যতই গভীর হোক শহরের এই জায়গাটি একেবারে নির্জন তো হয় না কখনো। আচ্ছা পৃথিবীটা না-হয় আর সহ্য হচ্ছিল না, অনিমেষও মানে এ-জগৎ বিশেষ সুখের স্থান নয়; কিন্তু এর কি মাথা খারাপ হয়েছিল যে, এখানেই এই রাস্তার ধারে কাজটা সারতে হবে। একটু আড়াল-আবডালও খুঁজে পেল না হারামজাদাটা! অনিমেষ এ-কথা ভাবতে-ভাবতে এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না-করে মৃত্যুতাড়িত লোকটার দু-হাঁটুর খানিকটা ওপরে পাঁজা করে তুলে ধরার চেষ্টা করলে লোকটা ডান হাত গলার রশির ভেতর চালিয়ে দিয়ে যথাসাধ্য কষ্ট লাঘবে এবং মরণ রুখে দিতে সচেষ্ট হয়। নিরুপায় অনিমেষ চিৎকার করে লোক ডাকতে যাবে এমন সময় ‘হায় হায় এ কী কা-’ – পেছন থেকে কারো আওয়াজ পাওয়া গেল। অনিমেষ চিনতে পারল লোকটা নাইটগার্ড আক্কাস। ভয়ে-উত্তেজনায় ফ্যাঁসফেঁসে কণ্ঠে সে বলল, ‘তাড়াতাড়ি ধরেন, আমি একা পারছি নে।’
‘আর ইট্টু কষ্ট করেন, আমি ওদের বাড়ির ভেতরতে বঁটি-টটি এট্টা কিছু নিয়ে আসি।’ আক্কাস ঊর্ধ্বশ^াসে আলো-আঁধারিতে উত্তর দিকের গলি বরাবর দৌড়ে যায়।
সাতচলিস্নশে দেশভাগের সময় সুবাসের ঠাকুরদা নিরঞ্জন অধিকারী ওপারের কৃষ্ণনগর শহর থেকে এসে অদলবদল করে এই শহরের ভেতর রাস্তার ধারে ষোলো শতক জমি পেয়েছিল। শহরের মাঝখানে থেকেও নিরঞ্জনের দুই ছেলের কোনো সন্তানই, অর্থাৎ নাতিপুতিদের কেউই, তেমন একটা লেখাপড়া শেখেনি। একজন কেবল বিএ পাশ করে স্কুলমাস্টার, একজন সিঙ্গাপুরে শ্রমিকের কাজ করে, বাকি তিনজন বাড়ির সামনে স্বল্পপুঁজির আলাদা তিনটে দোকান চালায়, দুটি মেয়ের বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়িতে। সুবাসের দোকানটায় শিঙাড়া-চা, পান-সিগারেট বিক্রি হয়। নেশা করত বলে বিয়ের এক বছরের মাথায় ওর নিঃসন্তান সুন্দরী বউটা কার হাত ধরে যেন ঢাকায় পালিয়ে যায়। বউটা চলে যাওয়ার পর সুবাসের নেশার ঘোড়া আরো লাগামছাড়া হয়, ও হয়ে ওঠে পুরো এলোমেলো।
নাইটগার্ড আক্কাস দৌড়ে দুই দোকানের মাঝে ইট-বিছানো সরু স্যাঁতসেঁতে পথ পেরিয়ে গলির শেষ মাথায় গিয়ে সুবাসদের টিনের চাল টিনের বেড়ার ঘরের দরজা ধাক্কায়, ‘ও সনজের দা, দরজা খোলেন, আপনাগের সুবাস গলায় দড়ি নিয়েছে। ও সনজের দা!’
সনজেরের ঘুম বরাবরই পাতলা, এক ডাকেই সে সজাগ হয়। কিন্তু এখন সজাগ হলেও আক্কাসের কথাগুলো তার ঠিক বোধগম্য হয় না। অন্ধকার হাতড়ে দরজার কপাটা খুলে সনজের আক্কাসের সামনে দাঁড়াতেই শুনতে পায়, ‘দাদা, তাড়াতাড়ি এট্টা বঁটি দেন। ওদিক অবস্থা খারাপ!’
চোখে ঘুমের ঘোর, ঝাপসা দৃষ্টি নিয়ে সনজের বলে, ‘বঁটি দিয়ে কী করবা ভাই?’
‘আরে জ্বালা, কলাম তো এট্টা বঁটি নিয়ে ধুপার দুকানের কাছে তাড়াতাড়ি আসেন, আপনার ভাই গলায় দড়ি নিয়ে মরে যাচ্ছে।’ সে আবার গলি ধরে দৌড়ে রাস্তার দিকে যায়।
বুকের ধড়ফড়ানি নিয়ে সনজের রান্নাঘরের আলো জ্বেলে পা দিয়ে পিঁড়ি ঠেলে, জলের কলস আর তরকারির ঝুড়ি সরিয়ে কোথাও বঁটির হদিস না পেয়ে দ্রম্নত ঘরে এসে বউকে ধাক্কা দিয়ে বলে, ‘এই মাগি, বঁটি কনে রাখিছিস?’
সুলেখা শুয়ে থেকেই ঘুমমাখা লালচোখ বড় বড় করে বলে, ‘ক্যা, এই রাত্রি বঁটি কী হবে?’
‘ওরে মাগি তাড়াতাড়ি ক, আমাগের সুবাস গলায় দড়ি নিয়েচে।’
স্বাস্থ্যবতী সুলেখা ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে এবার এক ঝটকায় উঠে বসে, এলোমেলো কাপড়েই ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে কাঠের ঘুণধরা পুরনো র‌্যাকটার নিচ থেকে বঁটি বের করে দেয়, ‘এই নেও তাড়াতাড়ি যাও। হায় ভগবান, এ কী কথা – কনে ও, ও ভাই সুবাস – তুই এ কত্তি গেলি ক্যান!’ চুলের খোঁপা বেঁধে, বুকের কাছের কাপড় আড়াআড়ি করে দুহাতে টানতে টানতে সেও স্বামীর পেছন-পেছন বড় রাস্তার দিকে ছুটতে থাকে।
আক্কাস ফিরে এলে অনিমেষ বলে, ‘কই বঁটি কই? তাড়িতাড়ি কাটেন, আমি আর পারচি নে।’
‘আরে বঁটি তো পাইনি, আনচে সনজের। আপনি ছাড়েন এবার আমি ধরি।’
অনিমেষ ঝুলন্ত দেহটাকে আক্কাসের হাতে ছেড়ে দুবার হাত ঝাড়া দিয়ে একবার সুবাসের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এখন তো কেমন নিসেত্মজ, জান কি আছে আক্কাসভাই?’ বলতে বলতে সে আবার হাত লাগায়।
‘আমাগের কাজ আমরা তো করি, বাকি আল্লাহর ইচ্ছে।’
তখন বঁটি আর একটা পস্নাস্টিকের টুল হাতে করে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে সনজের। চোখের নিমিষে টুলের ওপর উঠে সর্বশক্তি দিয়ে দড়িটায় পোচ দিতে দিতে বলে, ‘ভালো করে ধরেন, পড়ে যাবে কিন্তু।’ ততক্ষণে সনজেরের বউ সুলেখাও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সে চিৎকার করে ওঠে, ‘হায় ভগবান এ কী অবস্থা, বউডা পাশে থাকলি কি আইজ এই কা- কত্তি পাইরতো?’
তিনজন ধরাধরি করে ঠান্ডা হয়ে-আসা শরীরটাকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে অনিমেষ ভাবছিল আমার কাজ আপাতত শেষ। এরপর বেশি সময় এখানে থাকলে ঝামেলায় পড়তে হতে পারে। পুলিশকে সে বড় ভয় পায়, একবার ওদের জালে আটকে গেলে সহজে ছাড়া পাবে না।
‘এই ভ্যান এই, এই -’ বলে একটা ভ্যানওয়ালাকে ডাক দিয়ে সে উলটো দিকে হাঁটতে শুরু করে। ততক্ষণে সেহেরি খাওয়ার জন্য কিছু কিছু লোক জাগতে শুরু করেছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে অনিমেষ বিছানায় শুয়েই ঘরে হলদে রোদ দেখে অনুমান করে, বেলা হয়ে গিয়েছে, ঘাড় ঘুরিয়ে দেয়ালঘড়িতে দেখে নয়টা চলিস্নশ। দোকানে যেতে-যেতে আজ অনেক দেরি হয়ে যাবে। কম-সে-কম সাড়ে দশটা। ঈদের সামনে, মালিক জানলে খবর আছে। দ্রম্নত স্নান সেরে আলুভর্তা, ডালভাত খেতে-খেতে গত রাতের বিষয়টা মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে। সুবাস কি মরে গিয়েছে – ঈশ্বর মালুম। আমার কাছে আবার পুলিশ-টুলিশ না আসে। আচ্ছা ওরা যদি বলে বসে, তুমিই ওকে গলায় রশি দিয়ে ঝুলিয়েছিলে! এই বাহিনীতে বজ্জাত লোকের অভাব নেই।
হঠাৎ অনিমেষের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে, খাবার গলাধঃকরণ সম্ভব হয় না। সে আধপেস্নট ডালভাতের মধ্যে গস্নাস থেকে জল ঢেলে হাত ধুয়ে উঠে পড়ে।
বড় পরিসর দোকানের একটা দিকে কাচঘেরা ছোট্ট কামরায় অনিমেষের অফিস। সেখানে কম্পিউটার মনিটরে সে আটজন সেলসম্যানকে পর্যবেক্ষণ করে। বিক্রির সব হিসাব-নিকাশ তাৎক্ষণিকভাবে কম্পিউটারে উঠে যায়। অনিমেষ বাড়ি থেকে এসে সরেজমিনে একবার সবাইকে তদারকি করে নিজের চেয়ারে গিয়ে যখন বসল, তখন বেলা পৌনে এগারোটা। আর খানিক বাদেই ভিড় বাড়তে শুরু করবে। তখন আবার তার মনে হয় – আচ্ছা, সুবাসের কী অবস্থা একবার খোঁজ নিতে পারলে ভালো হতো। বিষয়টা নিয়ে সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে বুকের ভেতর ভয় আরো জমাটবদ্ধ হচ্ছে – পুলিশ টাকার জন্য সত্যি-সত্যি ওকে খুনের মামলায় ফাঁসিয়ে দেবে না তো? হে ভগবান, তুমি সর্বশক্তিমান, তোমার ইচ্ছা ছাড়া এ-জগতে কিছুই ঘটে না, তুমি দয়া করে সুবাসকে বাঁচিয়ে রেখো। পরক্ষণেই মনে হয়, আমি কেবল নিজে পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ওর আয়ু কামনা করছি? আমি তো তাহলে ভালো মানুষ নই, নিছক আত্মকেন্দ্রিক একটা ভেতো জীব। এর পরপরই আবার মনে হয়, বেশি খারাপ হলে তো ওকে বাঁচাতেই যেতাম না। যাই হোক, এখন এসব ভাবার সময় নয়, এ নিয়ে পরে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করা যাবে। বরং এক্ষুনি জানা দরকার সুবাসের প্রকৃত অবস্থা। তখন মনে পড়ে ওর এক বাল্যবন্ধু আছে সাজাহান, সদর হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়। তাকে ডায়াল করলে ফোন রিসিভ হয়, ওপাশ থেকে কথা আসে, ‘দোসত্ম অনিমেষ, কী খবর?’
‘আচ্ছা, তোদের ওখানে গলায় দড়ি নিয়া এক রুগি গিছিল, কী খবর জানিস?’ কথা বলতে-বলতে অনিমেষের বুক ধুকপুক করতে থাকে।
‘কখন?’
‘গতরাত তিনটের দিকি হবে।’
‘আমার ডিউটি তো সকাল আটটা থেকে ছিল, আমি ঠিক জানিনে।’
‘ইট্টু খোঁজ নিয়ে জানা তো দোসত্ম, সুবাস নাম।’
সাত-আট মিনিট পর সাজাহানের রিং আসে। ততক্ষণে অনিমেষের বুকের ধুকপুকানিটা আরো বেড়ে গিয়েছে। হায় ভগবান কী-যে খবর শুনব, ও যেন বেঁচে থাকে।
‘হ্যাঁ শোন ও পুরুষ ওয়ার্ডে ১০৮ নম্বরে ভর্তি আছে। স্যালাইন চলছে।’ মুহূর্তেই অনিমেষের ভেতরটাতে স্বস্তি আসে।
একদিন পরেই ওকে রিলিজ করে দেয়। তারপর বেশ কয়েকবার আসা-যাওয়ার পথে সুবাসকে দেখা গিয়েছে। কখনো রাস্তার ধারের টিউবওয়েল চেপে স্নান করছে, কখনো কাস্টমারের জন্য চা বানাতে ব্যসত্ম, কখনো শিঙাড়ার পেস্নটটা এগিয়ে দিচ্ছে, কিংবা কখনো খরিদ্দার না থাকায় নিজেই বসে বিড়ি ফুঁকছে।
অনিমেষের একাধিকবার মনে হয়েছে ওর সঙ্গে কথা বলে আসি। বলি, তুমি কেন মরতে চেয়েছিলে? দড়িতে ঝোলা অবস্থায় কেমন লাগছিল তোমার? খুব কষ্ট হচ্ছিল? তুমি কি যমদূত কিংবা আজরাইলকে দেখতে পেয়েছিলে? ওই অবস্থায় নতুন কোনো সত্য জেনেছ, যা আমরা জানতে পারিনি? তোমার মনে আছে কিছু – কে প্রথম ধরেছিল, কারা কীভাবে রশি কেটে তোমাকে নামাল, হাসপাতালে নিল? কিন্তু এই কৌতূহল নানা কারণে সংবরণ করেছে সে। প্রথমত, ওকে বাঁচানোর কৃতিত্ব নিতে তার সামনে যেতে ইচ্ছে করেনি। দ্বিতীয়ত, মনে হয়েছে বেচারাকে বিব্রত করা ঠিক হবে না। তৃতীয়ত, ফিরে আসা জীবনও হয়তো সে উপভোগ করছে না, যে তাকে বাঁচিয়েছে ভেতরে ভেতরে তাকে শাপ-শাপান্ত করে রাখছে না কিছু। সামনে পেলে কিল-ঘুসি দিতে পারে, গলা টিপে ধরাও বিচিত্র নয়।
এর মধ্যে একদিন শোনা গেল সুবাসের মা আর বড়দা পরামর্শ করে ওকে আবার বিয়ে করিয়েছে। মেয়ের বয়স কম, উপরন্তু সুন্দরী। মেয়েটির একবার নাকি বিয়ে হয়েছিল, বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই বজ্রপাতে ওর ব্যাংক-ক্যাশিয়ার স্বামী মারা যায়। এর দেড় বছর পর অন্য স্বামীর ঘরে এলো সে। আগের ঘরটা বেশ ভালো ছিল; বিধবা বলে নিতান্ত চায়ের দোকানদারের সঙ্গে এই বিয়ে। খবরটা শুনে অনিমেষের মনে হয়েছিল ওর বউটাকে একবার গিয়ে দেখে আসবে। কিন্তু ওদের সঙ্গে পরিচয়ের গভীরতা এমন নয় যে এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে বউটা দেখতে যাবে। অনিমেষ ভাবে, তার নিজের বউকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেই হলো, একজন মেয়েমানুষ সঙ্গে থাকলে কারো বাড়িতে যাওয়া সহজ হয়। কিন্তু রঞ্জনা আবার কী মনে করে তাই ভেবে ইচ্ছেটা চাপাই পড়ে থাকে।
সুবাসের দ্বিতীয় বিয়ে তিন মাস পেরিয়েছে কি পেরোয়নি, একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অনিমেষ বউয়ের মুখটা ভার দেখে বলল, ‘কী হয়েছে তোমার, এমন হয়ে আছো যে?’
‘শহরে খুব মর্মামিত্মক একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে।’
‘কী রকম?’
‘পায়রা চত্বরের কাছে ট্রাকে চাপা পড়ে একটা লোক মরে গিয়েছে। একেবারে ভোরবেলা, ফজরের আজানের খানিক পরে।’
‘কী বলো? ওখানে তো সহজে দুর্ঘটনা ঘটে না। গাড়ি তো আসেত্ম চলে।’
‘আসেত্মই নাকি চলছিল। ও বাড়ির আমান ভাই নামাজ পড়ে হাঁটতে গিয়ে লাশ দেখে এসেছে। মাথাটা পুরো থেঁতলানো। স্পট ডেড!’
‘কী নাম জানো লোকটার?’
‘উম-ম সুভাষ বা সুবাস হবে, মোড়ে চায়ের দোকান।’
কথা শুনে অনিমেষের হাত-পা ঝিমঝিম করে কেমন অবশ বোধ হতে থাকে। খানিক চুপ মেরে বসে থেকে গায়ে জামা চড়িয়ে বলে, ‘আমি যাচ্ছি, দরজা লাগাও।’ রঞ্জনার কোলে এক বছরের শিশুটি পিতার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
‘কোথায় চললে, নাস্তা করবা না?’
‘ওকে দেখতে, নাস্তা পরে।’
রিকশা, অটো আর মানুষের ভিড় ঠেলে হাঁটতে-হাঁটতে অনিমেষ পায়রা চত্বরে এসে জায়গাটা সন্ধান করে। খুঁজতে হলো না। একটা জায়গায় লোকের জটলা দেখে বোঝা গেল ওটাই সেই স্পট হবে। ‘দেখি ভাই একটু’ বলে একটা লোকের কাঁধে হাত রেখে সামনের দিকে গিয়ে দেখে পুরনো ইট দিয়ে বানানো একটা বৃত্তের ভেতর চাপ-চাপ জমাট রক্ত, পিষ্ট মাংস আর থেঁতলানো মগজ। এসবের ওপর কালো মাছি ভনভন করছে। অনিমেষের ভেতর থেকে কেমন ওয়াক আসে। বমিটমি করে দেবে না তো? তাহলে পাবলিক বলবে, মানুষের টাটকা রক্তমাংস দেখে মানুষ হয়ে বমি আসে? আপনি কেমন লোক?
সমবেত জনতার একজন বলে, ‘মরতি ভাই সবারই হবে, কার কপালে কেমন মরণ আছে তা কি কেউ জানে?’
অন্য একজন বলে, ‘একবার নাকি যে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে, শয়তান তার পিছু ছাড়ে না। এ তো আগে একবার গলায় দড়ি নিছিল। এবার ইচ্ছে করেই ট্রাকের নিচে চাপা পড়েচে।’
জনতার কথায় অনিমেষ মনে মনে সায় দেয় – কথা সত্যিই হয়তো। তারপর সে আবার ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এসে ফুটপাতে বসে পড়ে। ঠিক বমি নয়, গালভর্তি টক-নোনতা জল ওঠে। তখন মনে হয় খালি পেট বলে এমন হচ্ছে। কিছু মুখে দেওয়া দরকার। খানিক পর উঠে দাঁড়ালে সুবাসের বন্ধ দোকানের ‘সুবাস টি স্টল’ সাইনবোর্ডটায় চোখ পড়ে। তার ঠিক পাশের দোকান থেকে এক গস্নাস জল নিয়ে দুবার কুলি করে বাকিটা খেয়ে ফেলে সে। দোকানদারের সাজানো বয়ামের সারি থেকে একটা টোস্ট বিস্কুট নিয়ে চিবোতে চিবোতে বলে, ‘এট্টা চা দেও, লাল চা।’
গালের ভেতরটা শুষ্ক বলে টোস্টটা অর্ধেকের বেশি চিবানো সম্ভব হয় না। বাকি অর্ধেকটা একটা ছালওঠা কুকুরকে উদ্দেশ করে ছুড়ে ফেললে কুকুরটা দুবার জিভ দিয়ে চেটে তারপর চিবানোর চেষ্টা করে। তিতকুটে চা শেষ করে আবার অনিমেষের চলা শুরু। সুবাস তো সেই মরলই। অহেতুক দু-দুবার তাকে মৃত্যুকষ্ট সইতে হলো। আর এ-বিষয়টার সঙ্গে তো সে নিজেও জড়িত। তাহলে সেদিন ওকে রক্ষা করতে যাওয়াটা কি অন্যায় হয়েছে? ভুল হয়েছে? তখন আবারো মনে পড়ে সুবাসের দ্বিতীয় বিয়ের কথা –
মনে-মনে সে লাল বেনারসি-পরা ফুটফুটে সুন্দর এক নববধূকে দেখতে পায়। তার শরীর দিয়ে ভুরভুর করে সুগন্ধ বেরুচ্ছে, কাচের চুড়ির রিনিঝিনিও যেন শুনতে পায় অনিমেষ। খানিক পথ হেঁটে তার মনে হয় কোথায় যাচ্ছে সে? হাসপাতালে? ওর লাশ তো এখন মর্গে। কিন্তু কী হবে অমন ছিন্নভিন্ন থেঁতলানো-ভর্তা শরীর দেখে? এর চেয়ে সুবাসের আগের মৃত্যুটাই বরং ভালো ছিল। অন্তত অঙ্গগুলো তো অক্ষত থাকত। জীবনের দুঃসহ ভার সইতে না পেরে বেচারাকে শেষে চলন্ত ট্রাকের নিচে মাথা দিয়ে মরতে হলো। চলতে-চলতে রাস্তার পাশে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় অনিমেষ। না হাসপাতালে যাবে না সে। শেষে ওই থেঁতলানো, খ–ত, কাটাছেঁড়া দেহটা দেখলে অপরাধবোধ ভেতরে-ভেতরে আরো তীক্ষন ও তীব্র হয়ে দংশন করতে থাকবে। ওকে প্রথমবার না বাঁচালে এমন মৃত্যু ঘটার কথা ছিল না, এই ছিন্নভিন্ন দেহের দায় সে কীভাবে এড়াবে? বুকের ভেতরটা ভীষণ দাপিয়ে উঠলে তখন আবার মনে পড়ে সুবাসের দ্বিতীয় বউয়ের
কথা। অল্প কদিনের মধ্যেই দ্বিতীয়বারের মতো বেচারার সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল; কিন্তু সুবাস যদি সেদিনই মরে যেত তাহলে এই মেয়েটির এমন পরিণতি হতো না। হয়তো অন্য কোথাও এর চেয়ে ভালো বিয়ে হতে পারত। এবার সত্যি-সত্যিই নিজেকে ভয়ংকর অপরাধী মনে হতে থাকে অনিমেষের। ওর কি আর বিয়ে হবে? এই সমাজে দু-দুবার বিধবা-হওয়া মেয়ের বিয়ে হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। ওকে হয়তো সমাজে স্বামীখেকো কিংবা আরো অশস্নীল করে ‘ভাতারখাগী’ নাম দেওয়াও বিচিত্র নয়। বিবিধ যুক্তিতে নিজেকে গঞ্জনা দিতে দিতে অনিমেষ ঘুরে দাঁড়ায়। ওই অষ্টাদশী গৌরবর্ণা মেয়েটির এখন কী দশা? সদ্য মুছে ফেলা লেপ্টানো সিঁদুরে কেমন দেখাচ্ছে ওকে? এতোক্ষণে ওর শাঁখাচুড়ি সব গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে? সে দ্রম্নত পা চালায় সুবাসের বাড়ির উদ্দেশে। আলুথালু বেশে মেয়েটি কি বিলাপ করে কাঁদছে এখন? দুষছে তার ভাগ্যকে – ঈশ্বরকে কিংবা
মা-কালীকে – ‘তুই কেন নিলি’ বলে?
আজ অনিমেষ একবার দেখবেই মেয়েটিকে। এক্ষুনি যাবে সে।