সুরগুলি চায় চরণ

শুচিশ্রী রায়

 ফ্ল্যাশব্যাকের মতো কিছু ঘটনা হঠাৎই ঝলসে ওঠে মাথায়। আজকাল। যেমন হঠাৎই কিছু গান, কিছু সুর, সেই কোন ছেলেবেলায় শোনা, দপ করে জ্বলে ওঠে কানের পাশে। অদ্ভুতভাবে মনেও পড়তে থাকে পরের পর গানের কলি, সুরের চলন। চোখ বুজলেই একফালি সবুজ লন, বড় বড় গাছ, লম্বা নারকেলগাছের পাতায় বাদলদার ডানাভাঙা চিলটা বসে আছে। ইট-বাঁধানো ড্রাইভ-ওয়ে দিয়ে সামান্য এগিয়ে বাঁ-দিকে ঘুরলেই আমার সেই চেনা বারান্দার সিঁড়ি। গ্রিলের গেটের ভেতর প্রশস্ত ঘর। সাহেবি আসবাব। মেহগনি রঙের আলমারি-ঠাসা বইপত্তর আর বেতের চেয়ারে আলগোছে বসে আছেন তিনি। বাঁ-পায়ের ওপর ডান পা তোলা, পায়ে হাওয়াই চপ্পল, বাঁ-হাতের দুই আঙুলের মাঝে আগুন, মাথায় ফাইভ-ফিফটি-ফাইভ। জলদগম্ভীর ডাক – ‘আয়, বোস।’ সন্ধের দিকে দোতলার বাড়িওয়ালা প্রায়ই বিদেশি সংগীতের রেকর্ড চালাতেন। হয়তো সদ্য তিলক কামোদ নিয়ে ঘণ্টাখানেকের ধস্তাধস্তির পর বিহবল হয়ে চায়ে মুখ দিয়েছি, অবিকৃত কণ্ঠে বলে যেতেন, ‘এটা শুবার্ট, এটা মোৎসার্ট।’ পরক্ষণেই চোখ তুলে বলতেন – ‘বাদলের কাছে তোর জন্যে আনা একটা প্যাকেট রেখেছি, চিকেন স্যান্ডউইচ আছে, বাসে যেতে যেতে খেয়ে নিস।’ শ্যামনগরের অপূর্বদা আবদার করে বলেছিলেন, ‘আমি আপনাকে মামাবাবু বলে ডাকতে পারি?’ উত্তরে বলেছিলেন, ‘না। ওটা কেবল শুচির জন্য।’ গান শেখার জন্য একটা পাগলামি আমার বরাবরের ছিল। এখন মনে হয় বাড়াবাড়িই হয়তো। গান গান করে যা আদিখ্যেতা করেছি, প্রেমে পড়ে তেমনটা করেছি বলে মনে হয় না। হয়তো সেজন্যই এমন কিছু প্রাপ্তিযোগ জুটেছে আমার কপালে, যা হয়তো অনেক ভাগ্যবানেরও জোটে না। আমার কেমন মনে হয় জাগতিক সমস্ত কিছুকেই এক অদ্ভুত সুর-ছন্দে বেঁধে দিয়েছেন কোনো মহাশক্তি। ছেলেবেলার ধাঁধায় যেমন প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর লুকিয়ে থাকত, শামুকের খোলের ভেতর লুকিয়ে রাখা শুঁড়ের মতো, আর নাজেহাল হয়ে উত্তর খুঁজতে খুঁজতে বারবার বোকা বনতাম, এও সেই ধাঁধার মতোই। সুর এক বোধ, উপলব্ধি, জীবন দর্শন। সে প্রকৃতই ভেঙেচুরে নিজের মতো করেই গড়ে নিতে পারে যে-কাউকে। শুধু অনুঘটকটির অপেক্ষা। এমন এক মাহেন্দ্রক্ষণ, এমন এক সৌভাগ্যের মুহূর্ত, যখন সেই স্বপ্নের চাবিওয়ালা এসে হাজির হবেন আর অজান্তেই হাতে তুলে দেবেন গোপন জানালা খোলার এক মোহময় অদৃশ্য সোনার চাবি, যে-জানালা খুললেই তার রংচটা গরাদের ওপারে আদিগন্ত বাসন্তী সর্ষেক্ষেতের মধ্যে লাল-নীল ফড়িঙের মতো ছড়িয়ে আছে নন্দলাল, যামিনী রায়, বিভূতিভূষণ… রঁদ্যা কিংবা ভ্যান গঘ, বেগম আখতার, সিদ্ধেশ্বরী… নকশিকাঁথা, ইলিশভাপা, কলেজ স্কোয়ারের বেগুনি… প্রমথনাথ বিশী, রবীন্দ্রনাথ… লক্ষ্ণৌ, জয়পুর… আল্লাদিয়া খান, বিসমিল্লা আরো কত সহস্র নাম, ঠিকানা, সুর যা আমি আজীবন গুনেও শেষ করতে পারব না। আজ আমি ঠিক অটোবায়োগ্রাফি লিখতে বসিনি আর কেন জানি না, সাধারণ মানুষের জীবনচরিত নিয়ে কারো বিশেষ আগ্রহও থাকে না অথচ কত সাধারণ মানুষের জীবনেই যে কত অবিস্মরণীয় মুহূর্ত আর মানুষ দু-একটা তুলির অাঁচড় কেটে যায়, যা কিনা বহু অসাধারণের নজর ও সৌভাগ্য দুই-ই এড়িয়ে যায়। ঠাকুমার পানের বাটা নিয়ে দুপা লম্বা ছড়িয়ে মেঝেতে বসার কথা মনে পড়ে। একটু পানের বোঁটার আশায়, জিভের ডগা আপ্রাণ বের করে নাকের ডগার দিকে তাকিয়ে দেখা, তা যথাসম্ভব লাল হয়েছে কিনা আর নতুন কিছু অজানা কাহিনি শোনার নেশায় বসে থাকার কথা মনে হচ্ছে। তেমনি কিছু ঘটনা যা গানের রুপোলি সিল্কের সুতোর সঙ্গে বিনুনি বেঁধে এক অপূর্ব পশমিনা বুনে গেছে আমার জীবনে, এই অকিঞ্চিৎকর সামান্য জীবনেই, সেসব আমার বলতে ইচ্ছে করে, ঠিক যেমন আমার গাইতে ইচ্ছে করে – ‘বালম আন মিলো একবার… আ… আন… মিলো একবার।’ পারি না। পারা হয়ে উঠল না এ-জীবনে। কুদরত রঙ্গিবিরঙ্গী পড়ার সময় প্রথম ঘোর লাগে। শাস্ত্রীয় গান, যাকে সমীহ করে মানুষ উচ্চাঙ্গসংগীত বলে, যা কিনা ঘোরতরো ন্যায়-অন্যায়, ঠিক ভুল, আচার-বিচার আর কড়া নিয়মনিষ্ঠার মোড়কে মোড়া। একটু ডানে-বাঁয়ে বেশি দুলে উঠলেই লাল লাল চোখ কটমট করে তাকায়, তাচ্ছিল্য করে, তার পেছনের গল্পগুলি কি সত্যি এত সুডৌল? এত মোহময়? অন্য আরেক আকর্ষণ ছিল গল্পের সঙ্গে থাকা বিমল দাশের ছবি, যেন এক্ষুনি গান গেয়ে উঠবেন পালুস্কার, হীরাবাই। গোগ্রাসে পড়েছি বইটি, কতবার মনে নেই। ভাস্কর বুয়াকে স্বপ্নে দেখতাম। লক্ষ্ণৌ-বেনারসের বাইজিপাড়া দেখতাম আর তার সঙ্গে রং মেলাত পাকিজার মীনা কুমারীর চাউনি, মেঘে ঢাকা তারা, জলসাঘর। আমার অাঁকার গুরু ছিলেন মুকুল দের ছাত্র। প্রথম যখন শিখতে শুরু করি, ওনার এঁকে দেওয়া গরু, পাতা, কলসির ওপর হাত বুলোতে হতো। মন দিয়েই করতাম কারণ আমার বেশ ভালোই লাগত। গানের আশায় সা-রে-গা-মা-র ওপরও এভাবেই গলা বুলিয়ে চলছি। বাবা-মা কোনোদিনই ভাবেননি, আমি গান গাইব খেয়ে-পরে বাঁচার তাগিদে। মানুষের মতো মানুষ হতে গেলে নাকি এগুলো শিখতে হয়, জানতে হয়। তাই গান; তাই কবিতা, ছবি, বই, গাছ, মানুষ সব। একসময় যখন রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না, প্রায় দিশেহারা, একটি জ্যান্ত গানের আশায় ছুটে মরছি, মাথা কুটছি, একমাত্র যৌবনকাল হেলায় হারাচ্ছি, সে-সময়ে দীপকই বলল, ‘কুমারপ্রসাদের কাছেই যাও, আর উপায় কী?’ সত্তর-পেরোনো এক প্রবীণ, মাখনের মতো গায়ের রং, হাসিতে প্রজ্ঞা, মেধা আর দুষ্টুমির ছটা, যে-মানুষের বাবা ধূর্জটিপ্রসাদ, রবিঠাকুরের সঙ্গে যার কত না গান নিয়ে চিঠি দেওয়া-নেওয়া, যে-মানুষ রাধাকৃষ্ণাণের ছাত্র, যাকে বৃষ্টির দিনের সন্ধেবেলায় ভূতের গপ্পো বলতেন শরৎ চাটুজ্যে, আগ্রা ঘরের আসলি ওস্তাদের কাছে যার খেয়াল গানের তালিম, যে-মানুষ কলম ধরলেই একটি কুদরত, তার সামনে আমি কে? স্পর্ধা কী  আমার যে, চোখ তুলে কথা বলি? তবু অকুতোভয় মূর্খের মতোই সাহস নিয়ে হাজির হলাম। আমার বাহারি নাম শুনে প্রথমেই বললেন, ‘মেয়ের নাম, না সাবানের?’ বহু বড়মাপের মানুষের সান্নিধ্য পেয়ে আসছি ভাগ্যক্রমে, যাদের বলতে শুনেছি যে – সেন্স অফ হিউমার হলো এমন এক বিশেষ গুণ, যা না থাকলে চরিত্র পানসা। কুমারমামার সঙ্গ করে এই অসামান্য গুণটি আন্দাজ করতে শিখেছি। প্রগাঢ় পান্ডিত্য, মেধা আর রুচির একটা দ্যুতি মিশে থাকত ওনার রসিকতায়। সহজ-সারল্যেরও অভাব ছিল না। মাথায় ছিল পন্ডিতের মতোই মস্ত টাক আর তা ঘিরে কাশফুলের মতো হালকা চুলের বেড়া। সাধু বাংলায় একে কী বলে জানি না। গাড়িতে উঠে পেছনের সিটে বসেই গম্ভীর মুখে সামনের সিটে বসা মানুষটিকে বলতেন – ‘কাচ তুলে দাও, হাওয়ায় আমার চুল এলোমেলো হয়ে যাবে।’ যে-কোনো কিছু ঘটে ওঠার পেছনে একটা রসায়ন কাজ করে। সে উত্তম-সুচিত্রা জুটি হোক কিংবা রবিশঙ্কর-আলি আকবর           জুটিই হোক বা রবীন্দ্রনাথ-নন্দলাল। তেলে-জলে যেমন মেশে না, গুরু-শিষ্যের মধ্যেও তেমনি কোনো রসায়ন কাজ করে, অন্তত আমার ক্ষেত্রে তো বটেই। একটা কাছের জায়গাই জুটেছিল আমার সেখানে। শুধু কি গানই শিখলাম মাত্র ওনার কাছে গান্ডা বেঁধে? তাহলে কি এই সামান্য অাঁচড়টুকু কেটে ওঠা সম্ভব ছিল সাদা কাগজে? ১৯২৭-এ জন্ম যার, একটি দেশের, একটি জাতির স্বমহিমায়, স্বতঃস্ফূর্ততায় স্বাভিমানে বেড়ে ওঠার, নিজেকে মেলে ধরার সময়ের সাক্ষী, অংশীদার যে-মানুষটি তাঁর যে ব্যাপ্তি তা কি শুধু সংগীতশাস্ত্রের নিয়মনিষ্ঠায় আটকে থাকতে পারে কখনো? সম্ভব? ওনার বইয়ের আলমারি ঝাড়পোছ করার দায়িত্ব ছিল আমার। আলমারি শব্দটা এক্ষেত্রে একাই বহুবচন। গানের ঘরের বাঁপাশের জানালার নিচের লম্বা শেল্ফ থেকে যেদিন বই নামালাম, নামল একের পর এক যুগের পেইন্টিংয়ের সংগ্রহ। রোমান্টিক, ভিক্টোরিয়ান, মডার্ন। সোনার জলে তাদের ভূমিকা লেখা। এত যত্নে পাতা ওলটাচ্ছিলাম, যেন একটু আঘাত পেলেই গলে যাবে রেমব্র্যান্ট, মিকেলেঞ্জেলো, পিকাসো। আমি এসব করছি যখন, তিনি চেয়ারে বসে বারোয়া গুনগুন করছেন। আমার এক চোখ বইয়ে আটকায় আর এক কান ‘কাসে কহুঁ আপনি বিথা’র বেদনাতুর মীড়টিতে আটকে থাকে। এভাবেই কেটেছে তাঁর সান্নিধ্যের দিনগুলি। আবার রাতে খাবার পর মার্ডার ইন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস দেখতে দেখতে বললাম ‘শিন কনরিকে বেশ ভালো লাগে আমার।’ উত্তর এলো ‘ওটা শন কনরি বলবি।’ এভাবেও শিখেছি। এভাবেও। এভাবেই। যখন আমার আগে আগে হেঁটে যেতেন, অবাক হয়ে দেখতাম আর লজ্জায় ছোট হয়ে থাকতাম, যেন দেশ-কাল-মানুষ, আপামর সংস্কৃতি বয়ে নিয়ে হেঁটে চলেছেন আস্ত একটি ইতিহাস। এই যে বিরাটের সঙ্গে থাকা, বসবাস, এতে নিজের কুটিরটিও বেড়া ভেঙে মাঠের ভেতর ঢুকে পড়ে। তার ভেতর সুদূর রাজপুতনার গরম হাওয়া আসে, বেনারসের ঘুঙুর বাজে, এলাহাবাদের ঘিয়ের গন্ধ ভাসে। ক্ষুদ্র স্বার্থ, তুচ্ছতা, লোভ আর হীনমন্যতার আলপথ টপকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সবুজ ধানক্ষেতে। সেখানে কত হাওয়া, কত গান, প্রেম, কত যে মন কেমন। উনি বলেছিলেন, ‘এ গান যদি তোর ভালোলাগে তবে তুই শিখে উঠতে পারবি। ভালোই যদি না লাগে ভালোবাসবি কী করে?’ ভালোবাসতে পারাও এক মস্ত ব্যাপার। আমরা যেটাকে ভালোবাসা বলে ভাবি, বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় তার রং আসলের থেকে অনেক ফিকে। ভালোবাসা এক নেশায় পাওয়া। ভূতে ধরা। কেন বাসা, কিসের বাসা, এসব জল্পনা-কল্পনার বাইরের কিছু। এমন এক পেঁচোয় পাওয়া ঘোর লাগা যেমন, এক গান্ধারের রামদাসীর পেছনে ছুটতে ছুটতে শ্বাস ওঠে ওঠে। কবে একবার শুনে ফেলেছিলাম এক গান্ধারের রামদাসী, যার গান্ধার লাগবে নায়েকি কানাড়ার মতো, ব্যস তার ভালোবাসায় পড়ে গেলাম। একঘর ছাত্রছাত্রী যারা সবাই প্রায় বয়সে আমার বড়, আমাকেই শিখন্ডীটি করে এগিয়ে দিত। এটা শিখব, সেটা শিখব সেই আবদার রাখতে। আমার প্রাণ চাইত ইমন কল্যাণ হোক আরেকবার, আরো পাঁচবার হোক ঝিঞ্ঝোটির আলাপ, শ্রীর বিস্তার। এই যে প্রত্যেকবার এক নতুন ভালোবাসায় পড়া, প্রতিবার আচমকা দাঁড়িয়ে-পড়া এক সীমাহীন আকাশের সামনে আর দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই অজস্র ক্রিপার, সবুজ লতাগুলো ডালপালা মেলতে মেলতে ঘিরে ফেলে সব। তার ভেতর দিয়ে কোন সুদূরের আলো আসে, কোন অদেখার বাঁশি বাজে, কত না জানা ব্যথায় বুক টনটন করে। এই ওয়ান্ডারল্যান্ডের সামনে আমায় পৌঁছে দিলেন তিনিই। বেহাগকে কোনোদিন ভালো লাগত না। খুব মুখ গোমড়া রংচটা কাপড়পরা মহিলার মতো লাগত। নতুন করে বেহাগ শিখতে শুরু করলাম যখন সে যেন এক ট্রান্সফরমেশন। আচমকা আমূল বদলে গেল তার চেহারা, চরিত্র। এত অভিমান কোথায় রাখত সে লুকিয়ে! নাকি কেবল আমার কাছেই গোপন করতো! ‘বরজো না মানে’, সে অনুযোগের যে কতো বাহার! কত এমন-তেমন। আর ওই বয়স, ওই অসুস্থতা বয়ে বেড়ানো একজনের গলা থেকে যে কত যুগের মায়া আর সমর্পণ মেখে বেরিয়ে আসছে সে, তা আজো আমার কল্পনার অতীত। কথায় বলে – লাইফ ইস নেভার অ্যা বেড অফ রোজেস। তাহলে গানই বা কেবল সুন্দর, সুরেলা, ছিমছাম কেন হবে? কেন তার মধ্যে হাজারো ওঠাপড়া, আলো-অন্ধকার, পাওয়া-না-পাওয়ার দোটানা থাকবে না? মেঘলা দিনে মন যেমন এককোণে চোখ নামিয়ে বসে থাকে, রোদের দিনে কাশের বনে লুটোপুটি খেলে, গানই বা তা কেন করবে না? আমার ভেতরের যে-আমি, আমার ভালো-খারাপ সব মেশানো আমি, সেই তো বাইরে আসবে আমার গান হয়ে! তবে তার মধ্যেও থাকবে না কেন সাদা-কালোর বৈপরীত্য? এই গানের খোঁজ করতে করতেই ওনার কাছে পৌঁছে যাওয়া। একেই উনি বলতেন জ্যান্ত গান। গান শুনতে শেখাও শুরু হলো সেখান থেকেই। কাকে শুনবো, কেন শুনবো? একই তোড়ি শুনলাম আগ্রা, গোয়ালিয়র, জয়পুর, কিরানা, আত্রউলির শিল্পীদের গলায়। চিনলাম কে জি গিন্ডে, শরৎচন্দ্র আরোলকর, যশবন্ত বুয়া জোশী, শ্রীকৃষ্ণ হালদানকরের মতো অসাধারণ গুণীদের। গিন্ডেজীকে এতই ভালোবেসে ফেললাম যে, যে-কোনো রাগ একটিবার ওনার গলায় না শুনে নিলেই নয়। বাহার শেখার সময় গিন্ডেজীর গাওয়া বাহার শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। কত রাগের যে ছায়া আসছে-যাচ্ছে তাতে, আর মধ্যমের সে কি রূপ! মধ্যম লাগাবার কী আশ্চর্য শিল্প। গানেরও একটা বিজ্ঞান আছে আর তাকে শিখে নিয়ে বেশ কাজে লাগানো যায়। ওনার চিন্তা-ভাবনা অনুযায়ী শিখতে শিখতে বুঝেছি আসলে এই গান কিন্তু সহজ-সরল আবেগের কথাই বলে। সাধারণের দৈনন্দিন চাওয়া-পাওয়া, দুঃখ-সুখের কথা, তা সে যতই রাজদরবারের গান হোক না কেন। আমিও একটা সময় এই গানকে ভয় পেয়েছি অনেক। এই অজানা ভয়ের থেকেই দূরত্ব বাড়তে থাকে। মামাবাবুর বৈঠকি মেজাজ, আড্ডার রসদ, গল্পে লুকনো অনেক সত্যি-মিথ্যে আস্তে আস্তে সে-ভয় কাটিয়ে দেয়। এ কেবল আমার কথাই নয়, বিশ্বাস। তবু কিছু মানুষ ভাবেন, উনি কেবল গপ্পো দিয়েই সবটুকু জিতে নিয়েছেন। আমরা আসলেই একটা মলিন কাঁটাতারের বেড়ার ভেতরে আটকে আছি। নিরন্তর ডানা ঝাপটে আর একে অপরকে ঠুক্রে ঠুক্রেই রক্তাক্ত। পক্ষপাতিত্ব কমবেশি কে-ই বা না করেন? এমনকি এমন যে ভগবান, তিনিও আপামর প্রাণিকুলকে একই ছাঁচে ঢালতে পারেননি! মানুষ নামক জীবটির দিকে সুনজর কি একটু বেশিই দেননি? বিশেষ কারো গান, লেখা, ভাবনা, একজনের আলাদা করে ভালো লাগতেই পারে; কিন্তু সেই দিয়েই মাত্র একজন চিন্তাশীলকে কেমন করে মেপে ফেলা যায়! আমাকে উনি কিছুতেই আগ্রাঘরের ভয়েস প্রোডাকশনে অভ্যস্ত করতে চাননি। বারবার  বলতেন ‘আবদুল করিমকে শোন। ওনার স্বরোচ্চার খেয়াল করো।’ বলেছিলেন, ‘আগ্রা গায়কি পুরুষোচিত। মেয়েদের ওই গায়কিতে মানায় না।’ কিন্তু, ছন্দোবদ্ধ অনবদ্য বন্দিশ গায়ন, যা আগ্রার একান্তই নিজস্ব শৈলী, তা আমাকে শিখিয়েছিলেন। বোল বানানো, বোল বাঁটের মজা। বলতেন, ‘গানে একটু পেঁয়াজ-রসুন চাই। নিরামিষ গানে সে-মজা নেই।’ মস্ত শিরীষ গাছের মাথায় কত লাল লাল ফুল বিছিয়ে থাকে তা দেখতে চাইবার মন, ইচ্ছা আর তাগিদটাই মুখ্য আর আমি তো এমনি একটা জগৎই খুঁজে পেতে চেয়েছি! এই যে গাছ আপ্রাণ মেলে ধরে তার পাতা, তাতে রোদ্দুর, মেঘ, বৃষ্টি সব ধরা পড়ে আর সেই স্বপ্ন আর ইচ্ছেই তাকে আরো আকাশমুখী করে তোলে। গানের ব্যাপারে ওনার খুঁতখুঁতানি একটু বেশিই ছিল। তা কারই বা নেই? মা যেমন নিজের কোলের ছেলেটিকে একটু বেশি নজর আর প্রশ্রয় দেন, তেমনি ঘরানাদার গুণীরা নিজের ঘরকে বেশিই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এতে অসুবিধা বা আপত্তির সত্যিই কি কিছু থাকে? এখনকার এই পাঁচমিশেলি গায়কির যুগেও লোকে ঘর ঘর করে মাথা খারাপ করে ফেলে। আসলে ওনার মতো বুদ্ধিজীবী মানুষের দেখার দৃষ্টি একটু ভিন্নই হয়। উনি আনন্দের সঙ্গেই নিজেকে ইন্টেলেকচুয়াল বলতেন আর ঠিক এইখানটাতেই আমার বেশ সুবিধে হয়েছিল। উনি সব ঘরানার গায়কির বিশ্লেষণ করেছিলেন, যেটি ওনার রিসার্চের কাজ ছিল আর আমার অধিকার ছিল তার প্রতিটি শোনার আর শেখার চেষ্টা করার। আমীর খাঁ সাহেবের গায়কির যে কী অনবদ্য বিশ্লেষণ ছিল তার কোনো তুলনাই হয় না। ওইসব শুনতে শুনতে, ওনার সঙ্গ করতে করতে, ওনার নতুন বইয়ের পান্ডুলিপির কাজ করতে করতে আমি এক আশ্চর্য জগতের সঙ্গে সখ্য পাতিয়ে ফেলেছিলাম। তাই মামাবাবু শুধুই আমার সংগীতগুরু এটুকুই আমি বলতে পারি না। পৃথিবীর বেশিরভাগ আত্মীয়তারই কোনো নাম হয় না। দেয়াল বেয়ে উঠেছে যে বোগেনভেলিয়া, দেয়ালের সঙ্গে যে তার কী সম্পর্ক কে তা ঠিক করে দেবে? এ যে গানের বোধ, রঙের টান, এমন কত মানুষই আছে যাঁদের এই থেকে বিচ্ছিন্ন করলে তাঁরা উন্মাদ হয়ে যাবেন। কী নাম এই সম্পর্কের? সবই কি মানুষের আয়ত্তাধীন! এসব ছাড়িয়ে অনেক অনেক দূর অবধি বিস্তৃত যা, সে হলো হৃদয়, মন, মনন। সে বশ হয় না। তার আজন্ম মুক্তি আলোয় আলোয় আর সেখানেই হাজারো ইত্যাদির অবসান আর গানের শুরু। এক নিরবচ্ছিন্ন, একটানা সুর। কত যুগ যুগ ধরে ভেসে বেড়ানো গান, ‘মোরা মন হর লিনু রে… বটইয়া যাত’ কে যে পথ দিয়ে গেল আর অগোচরেই আমার মন নিয়ে গেল… আবার সেই অধরা মনের পেছনেই ছুট। অনন্ত। মন ভিজে আসে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়। ঢাকা গিয়েছিলাম প্রথমবার মামাবাবুর সঙ্গেই। উনি বলবেন আর আমি গাইবো এই শর্তে। সে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। বর্ষার বুড়িগঙ্গায় ছিপছিপে কাঠের শৌখিন নৌকার গলুইয়ে বসে আছি আর উনি জোগের গান্ধারের আন্দাজ বোঝাচ্ছেন। আবার চেন্নাই অ্যাপোলোতেও গেলাম ওনার সঙ্গেই, প্রথমবার। ওনার পরিবারের একমাত্র প্রতিনিধি আর অভিভাবক হয়ে। রেডিওলজিস্ট ডক্টর শেখরকে বললেন, ‘সবকিছুই এর সামনে বলতে পারেন। ও আমার ভাগ্নি।’ আমি জীবনে প্রথমবার এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি, আতঙ্কে চেয়ারের হাতল দুহাতে চেপে ধরে বসে আছি। ডাক্তারের কাছে জানতে চাইলেন কতদিন হাতে আছে আর। কত কাজই বাকি আছে, সেগুলো সব সেরে ফেলতে হবে এই সময়ের মধ্যেই। এই মানুষটির ক্যান্সার। গলায়। খাদ্যনালিতে। অথচ তিনি হাসপাতালের চারতলা থেকে হেঁটে আসবেন লিফট অবধি আমায় মীড়খন্ডের আলাপ বোঝাতে বোঝাতে, হুইল চেয়ার নেবেন না। কেয়ারটেকারও না। রোগীর পোশাক পরবেন না নিজের ইস্ত্রি করা সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি বাদ দিয়ে। অ্যাপোলোর কেবিনেও রাত্রি আটটায় আমাকে তাঁর আহ্নিকের জন্যে টিচার্স স্কচের পেগ বানিয়ে দিতে হতো কারণ বাঁহাতে কেমো চলত আর ডান হাতে শেষ বইয়ের স্ক্রিপ্ট কারেকশন। এও আমার তালিমের অঙ্গ। যদিও এই দিনগুলি আমি মনে করতে চাই না। মনে করতে চাই না, কেমন করে চোখের সামনে ক্ষয়ে যেতে দেখেছি আমার শ্রদ্ধার মহীরুহটিকে। বলতেন, প্রিয় বন্ধু বিলায়েত খানের মতোই একই অবস্থা হবে, শখের কোনো খাবারই আর গলা দিয়ে নামবে না। খাবার কই আমি তো তুলো বরফে ভিজিয়ে মামাবাবুর ঠোঁটে দিয়ে রাখতাম, যদি সামান্য তেষ্টাও মেটে। কতদিন এমন হয়েছে যে, কলকাতায় দুদিনের কেমো শেষে হাসপাতালের বিল মেটাতে মেটাতে আমায় বলেছেন, ‘বাড়িতে সবাইকে আসতে বলে দে, গান শেখাব।’ গান তো কেবল গান নিয়েই নয়, গোটা কয়েক স্থায়ী অন্তরা নিয়েই নয়। গান একটা সম্পূর্ণ জীবন আর তা থেকে কুড়িয়ে নেওয়া নুড়ি পাথর। আমি তুচ্ছ মানুষ। কোনো হিসাবের মধ্যেই পড়ি না। গান শিখে উঠতে পারলাম না আজো; কিন্তু গান ভালোবাসতে শিখেছি। সুরের ভেতরের যে-মন তাকে দেখতে-চিনতে শিখেছি। পুরিয়া ধানেশ্রীর কোমল ধৈবতের গাল দিয়ে কেমন জল চুইয়ে পড়ে, শঙ্করার নিষাদের কপালে চাঁদের আলো চক্চক্ করে, পূরবীর শুদ্ধ মধ্যমের চোখদুটি কেমন ভেজা-ভেজা তা আমি দেখতে পাই। সংগীত যেন আমায় তুচ্ছতা থেকে মুক্ত  করে। যে অনির্বচনীয়ের স্বাদ আমি পেলাম, তা যেন আমার দক্ষিণের বারান্দা হয়। আমার চেতনে-অবচেতনে বেঁচে থাকায় সুর যেন আমার দুটি হাত ধরে থাকে। গান যেন হয় আমার থইথই দিঘি। তাতে চাঁদনি রাতে ছায়া পড়বে কুমার গন্ধর্বের, আলি আকবরের, পান্নালালের। সেই জলে ঢেউ তুলবে ভীষ্মদেব, তারাপদ চক্রবর্তী, বড়ে গুলাম, আজমত হুসেন। আমার এই অভিভাবকহীন অবসাদের দিনগুলোয় অনেকদূর থেকে আলো দেখাবেন তিনি। হাত নেড়ে হয়তো বলবেন, ‘আসার পথে খোয়াব থেকে ভেটকি ফ্রাই নিয়ে আসিস তো!’ বলবেন ‘ছায়ানটের মীড় আরও লম্বা হবে। রে তে এসে তবে তার শান্তি। বড়, মেজো, ছোটো সব মীড় অভ্যাস করতে হবে।’ থুতনিতে তর্জনী ছুঁইয়ে বলবেন, ‘মুখটা এতো শুকনো কেন রে? খেয়ে আসিসনি?’ ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ঝলসে ওঠে সেই চেহারা। নিটোল, ভরাট, ওজনদার আবার যন্ত্রণায় কালো হয়ে আসা কপাল। তারপরও উত্তর দিতেন, ‘আমি বেশ ভালোই আছি শুধু শরীরটা তেমন ভালো নেই।’ আমার কতখানি দিতে পারলে তবে তা আমার প্রকৃত গুরুদক্ষিণা হবে আমার জানা নেই। আমার আপাতনাস্তিক গুরুমশাইটির কষ্টের কতটুকু উপশমই বা আমি করতে পারলাম! শুধু এক একটা সুর দপ করে বেজে ওঠে কানের পাশে – ইমন কল্যাণ, তিলক কামোদ, মলুহা কেদার। নরম হলদে আলোয় আলগোছে বসে আছেন। বলছেন ‘কাল একটু আগে আগে আসিস।’ যতবার গান গাইবার চেষ্টা করি ততবার আপ্রাণ বলি সুরগুলি যেন চরণ পায়। অনন্তের। অসীমের। অমলিন চেয়ে থাকার, অপেক্ষার।… ভালো থাকবেন, মামাবাবু…