সুর ও পুষ্প বিকাশে রঙের আত্মাভিজ্ঞতা

জাফরিন গুলশান

ইফ্ফাত আরা দেওয়ানকে আমি যদি শুধুই একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে দেখার চেষ্টা করি, দর্শক হিসেবে আমার জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ, দেশের শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হিসেবে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দীর্ঘ সময় ধরে খ্যাত। এই খ্যাতির শক্তি আমার দীর্ঘদিনের অভ্যস্ত স্মৃতির সঙ্গে বর্তমানে নেওয়া চ্যালেঞ্জ বেশ দ্বন্দ্ব তৈরি করে। দ্বন্দ্ব-অভিজ্ঞতাই জীবনের চালিকাশক্তি রূপে মার্কসবাদীরা বহুকাল পূর্বেই তত্ত্ব দিয়েছেন।

শিল্পী বলেন, ‘ফুলদানিতে রাখা ফুলের ছবি অাঁকা অনেক পুরনো একটি বিষয়। বিখ্যাত প্রায় সব শিল্পীই এঁকেছেন। আমিও খানিকটা উৎসাহিত হলাম। আর আমি আমার অভিজ্ঞতাকে এঁকেছি। সব শিল্পীই তাই করেন। আমার ভেতর থেকে যেভাবে ইচ্ছে করেছে, সেভাবেই এঁকেছি।’ ‘লাস্ট সামার’ শিরোনামে নিজের একক প্রদর্শনী সম্পর্কে সহজ স্বীকারোক্তি শিল্পীর।

যখন ঢাকা শহর বছরের উষ্ণতম সময় অতিক্রান্ত করছে, যখন এ-শহরের মানুষ অসহনীয় তাপমাত্রায় হাঁসফাঁস করছে, সে-সময়ে ইফ্ফাত আরা দেওয়ান তাঁর ছবিতে গ্রীষ্মশেষের সময়ের কথা মনে করিয়ে দেন। প্রশান্তি এনে দেন দর্শক-হৃদয়ে।

ইফ্ফাত আরা দেওয়ানকে বলা যেতে পারে খুব পরিমিতিজ্ঞানসম্পন্ন পরিশীলিত রুচির চিত্রশিল্পী। অত্যধিক স্বল্প রং ও কর্তৃত্বপরায়ণ রেখাচিত্রকে নির্ভর করে তৈরি হয়েছে তাঁর ছবির বিষয় – গল্পবলা। যেন ছোটগল্প। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ।’ অধিকাংশ ছবিতে অ্যাক্রিলিক ও ড্রাই প্যাস্টেল রং হিসেবে ব্যবহার করেছেন। শিল্পী চিত্রকলা বিষয়ে স্বশিক্ষিত। এবং তিনি মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করেন। তাই দ্বিধাহীনভাবে স্পষ্ট প্রস্ফুটিত ফুল ও ল্যান্ডস্কেপের সঙ্গে তাঁর আত্মিক যোগাযোগ। এরূপ যোগাযোগে পুনরায় কর্তৃত্বপরায়ণ রূপে ফিরে আসে ইফ্ফাত আরা দেওয়ানের সংগীতসাধনার দীর্ঘ প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছরের অতিবাহিত সময়ের সমৃদ্ধ শিল্পীসত্তা। ‘লাস্ট সামার’ ছবিটিতে দেখা যায় একেবারে হালকা সবুজ, হলুদাভ, গোলাপি, নীলাভ বর্ণচ্ছটা একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে। ছোট ছোট স্ট্রোক, ক্যানভাসে প্রায় মিলিয়ে যাওয়া পরিমাণ রঙের খেলা। কিছু হলুদাভ বৃক্ষসারি, রাস্তা কিংবা সবুজ মাঠ। ‘অন অ্যা সামার ডে’তে দেখা মেলে ধূসর, ধূসর নীল, অনুজ্জ্বল হলুদাভ রেখা, দুটো লাল চায়ের কাপ, খোলা জানালার ওপাশে লাল ফুল দুলুনির ভঙ্গিমায়। ঘরে একটি খাবার টেবিল, দুটো চেয়ার, দুটো কাপ, দেয়ালে ঝোলানো একটি পেইন্টিং আর মেঝেতে রয়েছে সেতার। একটি গ্রীষ্মের দিনে শিল্পীর অটোবায়োগ্রাফি। এই পুরো ছবির বিভিন্ন বস্ত্ততে ধূসরের যে-আধিক্য, সেখানে লাল চায়ের কাপ আর খোলা জানালার ওপাশে লাল ফুলের দুলে ওঠার ভেতরে কি কোনো সম্পর্ক বিদ্যমান? শিল্পীই এর সঠিক জবাব দিতে পারবেন। আসলে শিল্প তো এমনই। শিল্পী তাঁর চিত্রকর্মের সঙ্গে যেভাবে যাত্রা করেন, দর্শক সেভাবে রস গ্রহণ করতে পারেন বা না-ও পারতে পারেন। কারণ, শিল্পীর শিক্ষা অভিজ্ঞতা, সংগ্রাম, জীবনকে দেখা-বোঝার একটি প্রদর্শনীতে একটি বা একগুচ্ছ শিল্পকর্ম থেকে রসাস্বাদন ভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনাই সর্বোচ্চ। কিন্তু, তবু দর্শক, শিল্পী যে যার মতো করে শিল্পকর্মের দ্বারস্থ হন। মানুষ একজন আরেকজনের ভাষা বুঝতে চায়। কারণ, মানুষের যৌথ জীবনের স্মৃতির জিনগত আকার সবসময়ই শক্তিশালী। শিল্পী ইফ্ফাত আরা দেওয়ানের প্রায় পঞ্চাশটি শিল্পকর্ম নিয়ে বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে চলেছে একাদশতম একক প্রদর্শনী। শিল্পী বলেন, তিনি ছবি অাঁকেন তাঁর ভালোবাসা থেকে। যেভাবে তিনি গান করে নিজেকে প্রকাশ করেন, তেমনি ছবি অাঁকার মাধ্যমেও তিনি নিজেকে প্রকাশ করেন। দর্শক প্রশংসা করেন। ফলে তিনি উৎসাহ পান আরো ছবি আঁকার।

নিজেকে প্রকাশ করে সমগ্রের সঙ্গে একাত্মতা হওয়ার প্রবণতা যে-মিথস্ক্রিয়া তৈরি করে সেটি সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এসব অনুশীলন মানুষের সামাজিক অনুশীলন। অর্থাৎ শিল্প একটি সমাজ প্রগতির হাতিয়ার।

ইফ্ফাত আরা দেওয়ান দেশের বাইরেও অনেক প্রদর্শনী করেছেন। ২০০৪ ও ২০১০ সালে প্যারিসে তাঁর চিত্র-প্রদর্শনী হয়েছিল। ২০১১ সালে ‘খেলে যায় রৌদ্র ছায়া’ শীর্ষক তাঁর একটি একক প্রদর্শনী হয়েছিল বেঙ্গল গ্যালারিতে। চিত্রকলাযাত্রায় তাঁর এই একনিষ্ঠতা তাঁকে দিয়েছে নিজস্ব মুন্শিয়ানা। খুব ডিটেইলিং নয়, বরঞ্চ ঘন রেখা, পরিপ্রেক্ষিতের নির্মাণ, রঙের ব্যবহার হয়েছে প্রয়োজনানুসারে। যতটুকু দরকার শিল্পীর গল্পের দৃশ্য চিত্রায়ণে। কিন্তু ইফ্ফাত আরা দেওয়ানের রবীন্দ্রসংগীত-সুধা পান না করে হয়তোবা কেউ এ-প্রদর্শনী দেখতে এসে সংগীতের ধ্বনি-প্রতিধ্বনির ব্যঞ্জনা শুনতেই পেয়েছেন। সহজ, সাধারণ ও গভীর অনুভূতির নান্দনিক মিথস্ক্রিয়া ঘটেছে ‘লাস্ট সামারে’। প্রদর্শনীটি ১৩ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত চলেছে।