সেইন্ট লুসিয়ান কবি ডেরেক ওয়ালকট

কামরুল ইসলাম

 The English language is nobody’s special property. It is the property of the imagination; it is the property of the language itself. -Walcott

ভাষার অহংকারই কবিতার মৌলিকতাকে জাগিয়ে তোলে। যুগপরম্পরায় ভাষাই বহন করে চলে যুগমানসের নৃতাত্ত্বিক-ঐতিহাসিক প্রপঞ্চ। ভাষার অন্ধকারেই লুকিয়ে থাকে রক্তাক্ত সময়গুলোর অঙ্গীকার ও আলো। ভাষার ভিন্নতাই কোনো কবিকে স্বতন্ত্র করে তোলে। তবে মনে রাখতে হবে, ভাষাই কবিতা নয়। একজন কবির কাজ হলো ‘টু এমপ্লয় ল্যাংগুয়েজ টু কনজিয়র আপ দ্য গডস দ্যাট কন্ট্রোল আওয়ার বিয়িং’। কবির সত্তার গহিনে খেলা করে ভাষা, কবিকে তা খুঁজে নিতে হয়। যে কবিসত্তার বিপুল আধারে কোনো কিছু খুঁজে পায় না, সে কখনো বড়মাপের কবি হতে পারে না। আধুনিক মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, সে তার ভেতরের অমিত শক্তিকে জানতে চায় না। কবির ভেতরে কবির যে নিজস্ব ঈশ্বর বাস করে, তাকে জাগাতে না পারলে কবিতা অর্থহীন হয়ে পড়তে বাধ্য। ভাষার আছে অলৌকিক গুণ। ভাষাই মন্ত্র, এই মন্ত্রই কবিকে সাহায্য করে বৃহত্তর পাঠকের হৃদয় জয় করতে। ভাষাই সর্বোপরি এক সৌন্দর্য-শৌধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে কবিতার অঙ্গে রেখে যায় চিরকালীন মৌলিক স্বাক্ষর। কবিতা যে-উদ্দেশ্যেই লেখা হোক না কেন , তার সৌন্দর্যকে বাদ দিয়ে তার কোনো ব্যাখ্যা চলে না। মার্কসবাদী নন্দনতাত্ত্বিকদের মধ্যে অনেকেই বলেছেন, যা কিছু ভালো লাগে তাই-ই সুন্দর কিংবা যা কিছু মানুষের মঙ্গলের জন্য অথবা ভালো কিছুর ইঙ্গিত করে তাই-ই সুন্দর। কিট্স বলেছিলেন, ‘উইথ অ্যা গ্রেট পোয়েট দ্য সেন্স অব বিউটি ওভারকামস এভরি আদার কনসিডারেশন, অর রাদার অব্লিটারেটস অল কনসিডারেশনস’। যে-বিষয় নিয়েই কবিতা লেখা হোক না কেন, এই বোধ থেকে সরে দাঁড়ানোর কোনো উপায় প্রকৃত কবির থাকে না।

কবি ডেরেক ওয়ালকট একজন মৌলিক বহুমাত্রিক কবি, যার কবিতা নির্মাণের কৃৎকৌশল এবং অপার সৌন্দর্য আমাদের টেনে নিয়ে যায় অন্য এক ভালো লাগার জগতে। তিনি জীবন ও শিল্পের আন্তরসম্পর্কের মৌল দিগন্তের সন্ধান পেয়েছিলেন বাল্যে ও কৈশোরে। জীবনকে তিনি কতভাবেই না চেনেন! এই চিনতে পারার ক্ষমতা সব শিল্পীর সমান থাকে না। বড়মাপের শিল্পী হতে হলে ঘাসের ডগা থেকে কৃষ্ণগহবরের অতল গভীরতা পর্যন্ত দেখতে পারার ক্ষমতা থাকতে হবে। ডেরেক ওয়ালকটের চোখ দুটো ছিল বিস্তীর্ণ সমুদ্রের মতো অতলান্তিক। একজন শিল্পী যেসব গুণের কারণে স্পর্শ করেন আকাশের নীল কিংবা চারপাশের অনন্ত তিমির, সেসব গুণের অধিকারী ওয়ালকটের কবিতায় দেখা যায় বিশ্ববিক্ষণের বহুবর্ণিল গুঞ্জন। সময়কে ধারণ করে অনন্ত সময়ের দিকে ধাবমান তাঁর কবিতাবিহঙ্গ।এই শব্দকারিগর শব্দ ও বাক্যের নতুন সম্ভাবনাকে নানাভাবে নিরীক্ষা করেছেন। সময় ও শব্দ  কখনো-কখনো এক হয়ে জেগে ওঠে তাঁর কবিতা কিংবা নাটকে। বাংলা কবিতার মহাকারিগর জীবনানন্দ দাশ যেমন নক্ষত্রশাসিত কবি ছিলেন, ডেরেক ওয়ালকট ছিলেন সমুদ্রশাসিত। খুব ছোটবেলা থেকেই একজন লেখক হওয়ার সচেতন প্রয়াস তাঁর মধ্যে কাজ করেছে। ‘Midsummer’ (1984) কবিতায় আমরা তাকে বলতে শুনি :

Forty years gone, in my island childhood,

                                                I felt that
the gift of poetry had made me one of the chosen,
that all experience was kindling to the fire of the Muse.

ক্যারিবীয় এই কবি ও নাট্যকার ডেরেক অলটন ওয়ালকট জন্মেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের একটি ছোট্ট দ্বীপ সেইন্ট লুসিয়ার ক্যাস্ট্রিজ শহরে, ১৯৩০ সালে। তাঁর আফ্রিকান এবং ইংলিশ বংশসূত্রের উল্লেখ করে তিনি তাঁর বাল্যকালকে ‘সিজোফ্রেনিক’ হিসেবে বিশেষায়িত করেছেন। তিনি একালের সবচেয়ে সম্মানিত লেখক যাঁর কবিতা ও নাটকে উপনিবেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজের ঐতিহ্যের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী আফ্রিকান ও ইউরোপিয়ান কালচারবিরোধী মনোভাব ফুটে উঠেছে। যখন তিনি ইংল্যান্ডের সাহিত্যরীতি মেনে চলছেন তখনও তিনি প্রায়শই ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের ক্যারিবীয় সংস্কৃতির গ্রাসকে নিন্দা করেছেন। তাঁর কবিতার ভাষায় ইংরেজির সঙ্গে সেইন্ট লুসিয়া দ্বীপের আদিবাসীদের বিচিত্র ডায়েলেক্টের উপস্থিতিও লক্ষ করা যায়। তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘A far cry from Africa’-তে তিনি তাঁর অনিশ্চিত আইডেন্টিটির কথা তুলে ধরেছেন, যা তাঁর কবিতার একটি অন্যতম সুর। ‘I who am poisoned with the blood of both/ where shall I turn, divided to the vein?’ তাঁর মা ছিলেন মেথোডিস্ট স্কুলের একজন  শিক্ষিকা। তিনি ভালো কবিতা আবৃত্তি করতেন এবং মায়ের কবিতা আবৃত্তির সৌন্দর্যে বালক বয়সেই ওয়ালকট মুগ্ধ হয়েছিলেন। একটি স্থানীয় থিয়েটারের সঙ্গে ছিল তাঁর মায়ের সম্পৃক্ততা। ওয়ালকটের হয়ে ওঠায় তাঁর মা ও বাবা উভয়েরই অবদান ছিল অপরিসীম। তাঁর বাবা কবিতা লিখতেন এবং ছবি অাঁকতেন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন তাঁর পিতার প্রভাবের কথা এবং এও বলেছেন যে, পিতার শিল্পকর্ম তাঁর জন্যে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছে এবং তাঁর কাজ সেই কাজেরই বিস্তৃতি। ওয়ালকটের বাল্যকালের ইচ্ছে ছিল অাঁকিয়ে হওয়ার। তাঁর আত্মজীবনীমূলক কবিতা ‘Another Life’ (1973)-এ তিনি ও তার বন্ধু দাস্টান সেইন্ট ওমের প্রতিজ্ঞা করছেন যে, শিল্পের মধ্য দিয়ে তাঁরা তুলে ধরবেন সমস্ত ক্যারিবীয় অঞ্চলের দৃশ্যাবলি।

মাত্র ৩১ বছর বয়সে তাঁর বাবা যখন মারা যান তখন ওয়ালকট এবং তাঁর যমজ ভাই রডরিকের পৃথিবীর আলো দেখা হয়নি। তাঁর পরিবার ছিল ক্ষুদ্র মেথোডিস্ট সম্প্রদায়ভুক্ত। ওয়ালকটের লেখার মধ্যে মেথোডিজম এবং স্পিরিচুয়ালিজমের প্রভাব।  তিনি কবিতা লেখার কাজকে প্রার্থনার সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং তিনি বলেছেন, এটি একটি পবিত্র কাজ, অনেকটা ধর্মীয় উপাসনার মতো। লেখকের দায়িত্ব-কর্তব্য বিষয়ে তিনি প্রথম থেকেই সচেতন ছিলেন। খুব অল্প বয়সেই তিনি ইউরোপ-আমেরিকার আধুনিক কবিতার সঙ্গে পরিচিত হন।

মাত্র আট বছর বয়সেই তিনি লেখা শুরু করেন। স্কুলে পড়াকালেই ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি তাঁর আগ্রহ সৃষ্টি হয়। কবিতা লেখার প্রারম্ভে তিনি ডব্লিউ এইচ অডেন, টিএস এলিয়েট এবং ডিলান টমাসকে অনুকরণ  করেন। ১৪ বছর বয়সে তাঁর প্রথম কবিতা ‘The Voice of St. Lucia’ প্রকাশিত হয়। ১৮ বছর বয়সে বের হয় তাঁর প্রথম কবিতার বই 25 Poems (1948) এবং পরের বছরে Epitaph for the Young : XII Cantos (1949)। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন ওয়ালকট এভাবে  : ‘একদিন আমি আমার মাকে আমার কবিতার বই প্রকাশের কথা বললাম এবং আরো বললাম যে, এতে প্রায় দুশো ডলার খরচ হবে। আমার মা তখন সেলাই ও স্কুলশিক্ষকতার আয় দিয়ে সংসার চালাচ্ছিলেন। মা এতে খুশিই হয়েছিলেন এবং অনেক কষ্ট করে আমাকে বই প্রকাশের টাকা জোগাড় করে দিয়েছিলেন।  সেই টাকায়  ত্রিনিদাদ থেকে বইটি মুদ্রিত হয়ে এলে আমি আমার বন্ধুদের কাছে বিক্রি করে খরচের টাকা ফিরে এনেছিলাম।’ মায়ের সেদিনের সেই উৎসাহ-ই ওয়ালকটকে কবিতার দীর্ঘ সড়কে অবিচলভাবে হাঁটার প্রণোদনা জুগিয়েছিল। প্রকৃত কবিকে দীর্ঘ পথের পথিক হতে হয়; ওয়ালকট সেই পথিক যাঁর পরিব্রাজক-মন ছুঁয়ে চলেছে বিশ্বসভ্যতার আলো ও অন্ধকার, বিচিত্র প্রান্তর ও কাল-মহাকালের অজস্র সংগীতমালা, যাকে ঘিরে তাঁর শিল্পচৈতন্য নির্ভার আনন্দের মধ্যে আবর্তন করে চলেছে।

সেইন্ট লুসিয়ার সেইন্ট মেরি কলেজে এবং জ্যামাইকার ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে তিনি আরো দুটি কাব্যসংকলন সম্পন্ন করেছিলেন এবং এ-সময়ে কবিতাকারে লেখা ঐতিহাসিক নাটক Henri Christope (1950) রচনা করেন। পরের নাটক Drums and colours (1958) লেখার পর ওয়ালকটের প্রতি সমালোচকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এবং সে-সময়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার জন্য রকফেলার ফেলোশিপ পান। যুক্তরাষ্ট্রে পড়ালেখা শেষ করে তিনি ক্যারিবিয়ায় ফিরে আসেন এবং ত্রিনিদাদ থিয়েটার ওয়ার্কশপ নিয়ে কাজ আরম্ভ করেন। উল্লেখ্য, সে-সময়ে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিনি বেশকিছু ভালো নাটক উপহার দেন।

১৯৬২ সালে In a Green Night কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলে কবি হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত লিখিত কবিতাগুলোই এই কাব্যগ্রন্থে স্থান পায়। ক্যারিবীয় ভূদৃশ্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে তাঁর সৃজনীপ্রতিভার মৌলিকত্ব প্রতিভাত হয়। তাঁর সমসাময়িক কবি, যাঁরা তাঁর বন্ধুও বটে, কবি রবার্ট লাওয়েল এবং এলিজাবেথ বিশপের  প্রভাব রয়েছে তাঁর কবিতায় – এ-কথা বলতে তিনি কোনো দ্বিধা করেননি। বড়মাপের কবি কিংবা শিল্পী যা নির্দ্বিধায় বলতে পারেন, মিডিওকাররা তা পারেন না, মিডিওকারদের সেই সাহস থাকে না বলেই তাঁরা মিডিওকার। তাঁর ওপর কবি এজরা পাউন্ডের কবিতার প্রভাবের কথাও অনেকে বলেছেন। তবে এতসব সত্ত্বেও এক অভাবনীয় ভাষাসত্তার ভেতরে তিনি তাঁর কবিতার ঘর এমনভাবে বেঁধেছেন যে, তাঁকে আলাদাভাবে চেনা যায়, তাঁর মৌলিকত্বকে সহজেই শনাক্ত করা যায়। কবিতা ও ভাষার এক ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে তিনি যে বাস্তবতা তৈরি করেন, তা শিল্পের অসীমতাকে স্পর্শ করে।

সত্তরের দশক থেকে তিনি সময়কে ভাগ করে নিয়েছেন – কখনো ওয়েস্ট ইন্ডিজ, কখনো যুক্তরাষ্ট্রে চলে তাঁর বিচরণ। তাঁর শিল্পকর্মে ঘুরেফিরে এসেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিছোঁয়া মানুষ, সংস্কৃতি ও সমূহ জীবনবোধ। তাঁর অনেক নাটকেই, যেগুলোকে ‘লোকনাট্য’ বলা হয়, রয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাধারণ মানুষের জীবন ও ভাষা এবং মূর্তমান হয়েছে ক্যারিবীয় আঞ্চলিক ভাষা এবং উপকথা।

তার নাটক Ti- Jean and His Brother (1958)-এ তিনি আফ্রিকান গল্প বলার টেকনিক ব্যবহার করেছেন। ওয়ালকটের সবচেয়ে সার্থক নাট্যকর্ম Dream on Monkey Mountain (1967)। এ-নাটকের জন্য তিনি ওবাই পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৭১-এ। এটি তাঁর একটি রূপক নাট্যকর্ম। সমালোচকরা বলেছেন, এই নাটকে তিনি নিম্নবর্গীয় (সাব-অলর্টান) মানুষের ঔপনিবেশিক চেতনাকে ম্যামাকের হ্যালুসিনেশনের মধ্য দিয়ে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় রূপায়িত করেছেন। এই নাটকের প্রধান চরিত্র ম্যামাককে বর্ণনা করতে গিয়ে ওয়ালকট বলেছেন, ‘ম্যামাক উঠে এসেছে আমার বাল্যস্মৃতি থেকে। একজন মাতাল, যে শনিবারে, যখন হাতে টাকা পেত, রাস্তায় এমনভাবে চিৎকার করতো যে তা ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের ভীতসন্ত্রস্ত করতো; এরকম মানুষের ছবি আমি আজও দেখি, যে ছিল একজন অধঃপতিত মানুষ, তবে তার মধ্যে কিছু প্রকৃতিদত্ত শক্তি ছিল যা এখনো ভীতিপ্রদ, হয়তো অন্য সোসাইটিতে সে একজন যোদ্ধাও হতে পারতো।’

অনেক সমালোচকই ওয়ালকটের ক্যারিবীয় চিত্রাঙ্কনকে একটি অনিশ্চিত ঐতিহ্যের সমাজ – A New World হিসেব চিহ্নিত করেছেন। তাঁর আত্মজীবনীমূলক দীর্ঘ কবিতা ‘Another Life’-এ একজন শিল্পীর সুযোগ্য অভিনিবেশে তৈরি এক অস্পষ্ট সংস্কৃতি-ভাবনার রূপায়ণ লক্ষ করা যায়। ‘we were the light of the world/ We are blest with a virginal, unpainted world’ ওয়ালকটের কবিতায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিচিত্র আত্মপরিচয়ের চমৎকার সম্ভাবনার সূত্রগুলো উজ্জ্বলভাবে দৃশ্যমান, যেখানে একটি ভয়ের দিকও ফুটে ওঠে যে, একদিন হয়ত এই দ্বীপ-সংস্কৃতি ব্রিটিশ আধিপত্য এবং পর্যটকদের ঘনঘন আগমনে ম্লান হয়ে যাবে। তাঁর কবিতা ‘St. Lucia’-তে আমরা দেখি ক্যারিবীয় আদি ভাষাগুলোর জন্যে তাঁর আকুতি : ‘Come back to me/ my language/ Come back/ cacao/ grigri/ solitaire/ oiseau.’ ওয়ালকটের পরবর্তীকালের অনেক কবিতায় দেখা যায়, তিনি নিজেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সম্প্রদায় থেকে – এমনকি ইউরো-আফ্রিকান উত্তরাধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন একজন শিল্পী হিসেবে ভাবছেন। ‘The light of the world’ কবিতায় সেই বিচ্ছিন্নতা ও নৈঃসঙ্গ্যবোধের অনুরণন শোনা যায়। ‘There was nothing they wanted, nothing I could give/ but this thing I have called ‘The Light of the World’. কলোনিয়াল সময়ের অন্যায়-অত্যাচার, অসংগতি এবং তা থেকে উদ্ভূত ক্ষোভ, ঘৃণা ও বিরক্তি ওয়ালকটের কবিতার অন্যতম ‘মোটিফ’। সমালোচকরা তাঁর ‘The Schooner Flight’ কবিতার উচ্চ প্রশংসা করেছেন, যেখানে সেবাইন, একজন শংকর জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, একইসঙ্গে একজন চোরাকারবারি নাবিক। কবি এখানে তাঁর নিজ অতীতের আলোকে নিজেকে একজন নির্বাসিত মানুষ হিসেবে ভাবছেন এবং এই কবিতায় সেবাইনের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ও ভাসমান অস্তিত্বের অস্থির আলো-ছায়া আমাদের মনোলোকেও আছড়ে পড়ে। ‘I met history once, he aint recognize me/ a parchment Creole, with warts/ like an old sea bottle, crawling like a crab/ through the holes of shadow cast by the net…’

ক্যারিবীয় আইডেনটিটি নিরূপণের জন্য ঔপনিবেশিক ইতিহাসের ভূমিকা বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘অনেকটা পথ হেঁটে এবং অনেক সমালোচনার আলোকে আমি যেটা বলতে চাই সেটা হলো, ঐতিহাসিক ভাবালুতার মধ্যে রয়েছে বড় রকমের বিপদ… ক্যারিবীয় সমস্ত কিছুর মধ্যে রয়েছে একধরনের অবৈধতা। যদি আমরা প্রথম থেকেই স্বীকার করে নিই যে, এই ঐতিহাসিক জারজতার মধ্যে কোনো লজ্জা নেই, তাহলে ঠিক আছে, কিন্তু যদি আমরা সর্বদাই দাসপ্রভুর কর্মকান্ড ও অন্যান্য সব তর্জনী উঁচিয়ে দেখাতেই ব্যস্ত থাকি, তাহলে আমরা কখনই সাবালক হতে পারবো না।’

ওয়ালকটের সবচেয়ে প্রশংসিত এপিকধর্মী কবিতা ‘Omeros’ (১৯৯০)। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির প্রাক্কালে সুইডিশ অ্যাকাডেমি উল্লেখ করেছিল, এটি মূলত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ইতিহাসের মধ্যে পরিভ্রমণ, একধরনের তীর্থযাত্রা। হোমারের ওডেসির সমান্তরালে ক্ল্যাসিক্যাল চরিত্র একিলিস, হেলেন এবং হেক্টরের বিপরীতে তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান জেলে, বেশ্যা এবং জমিদারদের চরিত্র হিসেবে এনেছেন। ওয়ালকট মূলত সারা পৃথিবীর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আবিষ্কারে ব্রতী হয়েছেন এখানে এবং বর্তমান ক্যারিবীয় জনগণের আইডেন্টিটিতে এদের কতখানি প্রভাব রয়েছে তা সন্ধান করেছেন। ‘Omeros’-এ তিনি বলেছেন, ‘Art is history’s nostalgia.’ এই কবিতা বিষয়ে অলিভার তাপলিনের মন্তব্য : ‘কবিতার সর্বাঙ্গ ঘিরে রয়েছে ঐতিহাসিক ঘটনাবলির পুনঃপুন অনুরণন যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চরিত্রগুলোর জীবন-গড়নে নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। একিলিসের আফ্রিকান পূর্বপুরুষদের ওপর ক্রীতদাসদের পাশবিক আক্রমণ, নেটিভ আমেরিকানদের ওপর ইউরোপিয়ানদের আক্রমণ, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের যুদ্ধজাহাজ এবং বাতাসপ্রবাহের দিকের দ্বীপগুলোতে প্রথম উপনিবেশ স্থাপন… কিন্তু মি. ওয়ালকট এইসব মৃত্যু ও দুর্ভোগের দৃশ্যাবলি একজন হোমারের বস্ত্তনিষ্ঠ সহানুভূতির আলোকে স্মরণ করেছেন, যিনি বলেছেন কী ঘটেছিলো ট্রোজান এবং গ্রিকে।’

ক্রিটিকরা দীর্ঘদিন ধরেই ওয়ালকটকে ‘ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান পোয়েট’ অথবা ‘অ্যা ব্ল্যাক পোয়েট ফ্রম দ্য ক্যারিবিয়ান’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছেন। রাশিয়ায় জন্মগ্রহণকারী নোবেল বিজয়ী আমেরিকান কবি, ওয়ালকটের ব্যক্তিগত বন্ধু, ব্রডস্কি ওয়ালকটের এইসব খন্ডিত পরিচয়কে সমালোচকদের দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ওয়ালকটকে ইংরেজি ভাষার একজন বিখ্যাত কবি হিসেবে দেখা উচিত, আঞ্চলিক কবি হিসেবে নয়। তিনি আরো বলেছেন, He gives us more than himself or ‘a world’; he gives us a sense of infinity embodied in the language as well as in the ocean, which is always present in his poems as their background or foreground as their subject, or as their meter.’

সমুদ্র তাঁর ভাষা ও কবিতাকে প্রভাবিত করেছে ঐতিহাসিকভাবে। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের মতো তাঁর ইংরেজি ভাষার সাবলীল শক্তিমত্তা তাঁকে বহুমাত্রিক কাব্যবলয়ের উত্তুঙ্গ শিখরে আরোহণ করিয়েছে। ভাষা ও সমুদ্র মিশে গেছে অসীম কালপরিক্রমায়। তাঁর কবিতার বিবর্তনিক ছায়ায় জড়িয়ে আছে আটলান্টিকের উত্তাল ঢেউ এবং ইংরেজি ভাষার মহাসড়ক। তাঁর কবিতার গতি ও বৈভব, বিশালত্ব এবং প্রসারণ সবই সমুদ্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান। ওয়ালকটের শিল্পকর্মকে ক্যারিবীয় দ্বীপ, সমুদ্র এবং এই অঞ্চলের জনগণের অনুভূতি এবং তাঁর সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতার আলোকে দেখতে হবে। ব্রডস্কি আরো বলেছেন, তিনি যা কিছু স্পর্শ করেছেন সবই চৌম্বকীয় তরঙ্গের মতো প্রতিধ্বনিত হয়েছে।

কেউ মানুক না মানুক এ কথা সত্য যে, কলোনিয়াল ঐতিহ্যের এক সম্মোহনী উপস্থিতি ওয়েস্ট ইন্ডিজের আকাশে-বাতাসে বহমান। ওয়ালকট এই কুহকী বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, ভাষা তার প্রভু অথবা চাকরদের চেয়ে বড়। কবিতা সেই মোক্ষম  অস্ত্র যার মাধ্যমে শ্রেণি, জাতি এবং অহংয়ের চৌহদ্দি পেরিয়ে লাভ করা সম্ভব নিজস্ব পরিচয়। একইভাবে তিনি ক্যারিবীয় জনগণের একটি নিজস্ব আইডেন্টিটির খোঁজে বিশ্বসংস্কৃতির মহাস্রোতে নিজেকে অন্বিষ্ট রেখেছেন প্রতিভার ঔদ্ধত্যে। তাঁকে একজন ট্রাডিশনালিস্ট, মডার্নিস্ট অথবা কোনো ইজমে বাঁধা যাবে না। কোনো স্কুলের নন তিনি। তাঁকে বলা যেতে পারে ন্যাচারালিস্টিক, এক্সপ্রেশনিস্টিক, সুররিয়ালিস্টিক, ইমেজিস্টিক, হারমেটিক অথবা কনফেশনাল। কেউ কেউ তাঁকে মেটাফিজিক্যাল রিয়ালিস্টও বলে থাকেন। Paris Review-তে ১৯৮৬ সালের শীতসংখ্যায় প্রকাশিত তাঁর একটি সাক্ষাৎকারভিত্তিক আলোচনা The Art of Poetry No.37-এ তিনি যেভাবে কবির অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা করেছেন তা চমকপ্রদ : the body feels it is melting into what it has seen… the ‘I’ not being important. That is the ecstasy…Ultimately, it’s what Yeats says: ‘Such a sweetness flows into the breast that we laugh at everything and everything we look upon is blessed.’

তিনি আরো বলেছেন, যদি কেউ বুঝেন যে তার দিকে কাব্যদেবী এগিয়ে আসছে, তাহলে তাকে পিছিয়ে আসতে হবে, নিজেকে গুটিয়ে নিতে হবে নৈঃশব্দ্যের ইন্দ্রজালে আর মনে করতে হবে যে, তার চারপাশে আর কিছু নেই।

শেমাস হিনি ওয়ালকটের  ‘Deep and sonorous possession of the English language’-এর ব্যাপারে যেমন বলেছেন, তেমনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ইংরেজিভাষী কবিদের সঙ্গে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বকেও তুলে ধরেছেন। রবার্ট গ্রেভস লিখেছেন, তাঁর সমসাময়িকদের তুলনায় ওয়ালকট একটু বেশিই ইংরেজি ভাষাকে তাঁর ভেতরের সৌন্দর্যের সূক্ষ্ম অনুধাবনে ব্যবহার করতে জানেন। ইংরেজি ভাষার ক্যারিশমা এবং তাঁর ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতার রহস্য তিনি সুচারুভাইে বোঝেন বলে অনেকের ধারণা।  প্রকৃতপক্ষেই তিনি ‘an elated, exuberant poet madly in love with English.’

ত্রিনিদাদ থিয়েটার ওয়ার্কশপ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে একদা শিক্ষকতার জন্য তিনি আমেরিকার পথে পাড়ি জমান। ১৯৮১ সাল থেকে তিনি বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ের ওপর পড়াতে থাকেন এবং মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে ছুটে আসেন ক্যারিবিয়ায়। তাঁর সে-সময়ের কবিতার মধ্যে যাকে বলে ‘দ্বৈততা’ দেখা যায়, যে-কারণে তাঁকে তখন ‘নর্থ’ এবং ‘সাউথ’-এর কবিই বলা হতো। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত The Fortunate Traveller এবং ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত The Arkansas Testament-এ এ-সময়ের এক্সপেরিমেন্টগুলোর পরিচয় মেলে। তাঁর The Fortunate Traveller কাব্যের ‘The Spoilers Return’ কবিতাটি কেবল তাঁর ‘ত্রিনিদাদ ক্যালিপসো  কালচারে’র বর্ণনার নৈপুণ্যেই শুধু নয়, এর উৎকর্ষ ফুটে ওঠে তাঁর আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের শক্তিমত্তায়। তাঁর ‘Schooner Flight’ কবিতাকে শেমাস হিনি শুধু epoch making বলেই ক্ষান্ত হননি, এ-প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেছেন, Walcot has discovered a language woven out of dialect and literature neither folksy nor condescending… evolved out of one man’s inherited divisions and obsessions.’

তাঁর ‘The Arkansas Testament’ কবিতায় আমরা দেখতে পাই তাঁর জন্মভূমি এবং স্বদেশবাসীর জন্য অপরিসীম ভালোবাসার আকরসমূহ। এই কবিতা আমাদের টেনে নিয়ে যায় তাঁর চতুর্দশ বর্ষ বয়সের ‘অগাস্ট এপিফ্যানি’র সময়ে কিংবা দ্বীপের জন্য স্যাবাইনের কান্না অথবা ‘স্পয়লারে’র প্রিয় জন্মভূমি ত্রিনিদাদ রক্ষার জন্যে নরক থেকে ফিরে আসার সুদৃঢ় প্রত্যয়ে। ওয়ালকট ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কালচারে তাঁর বেড়ে ওঠার বর্ণনা দিয়েছেন চমৎকারভাবে : What we were deprived of was also our privilege. There was a great joy in making a world that so far, up to then, had been undefined… My generation of West Indian writers has felt such a powerful elation at having the privilege of writing about places and people for the first time and, simultaneously, having behind them the tradition of knowing how well it can be done — by a Defoe, a Dickens, a Richardson.

১৯৯২ সালে তাঁকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। নোবেল কমিটি তাঁকে এই পুরস্কার দিয়েছিল ‘…for a poetic oeuvre of great luminosity, sustained by a historical vision, the outcome of a multicultural commitment’. তাঁর পরবর্তী সময়ের কাব্যগ্রন্থগুলো হলো Tiepolo’s Hound (2000), The Prodigal (2004) এবং White Egrets (2010); শেষের এই কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি ২০১১ সালে T.S. Eliot Prize এবং OCM Bocas Prize পান। ২০০৮ সালে ইসেক্স ইউনিভার্সিটি তাঁকে অনারারি ডক্টরেট প্রদান করে। ২০০৯ সালে ওয়ালকট আলবের্তা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছরের জন্যে আবাসিক অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্তি পান এবং ২০১০ সালে এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতার অধ্যাপক পদে অভিষিক্ত হন। এখন পর্যন্ত ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। অশীতিপর এই কবি অনেকটা তারুণ্যে উজ্জ্বল বৃদ্ধ, যিনি এখনো কবিতার পালে হাওয়া লাগিয়ে রয়ে গেছেন কাব্যচর্চার নিরন্তর যাত্রায়। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতার অধ্যাপক পদের প্রার্থিতা তিনি স্বেচ্ছায় প্রত্যাহার করে নেন, কারণ সে-সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে যৌন-হয়রানির মিথ্যে মামলাসহ মিডিয়াগুলোতে বেশ লেখালেখি চলছিল।  তাঁর এ-দুঃসময়ে  তাঁর খুব কাছের বন্ধু শেমাস হিনিসহ অনেক বিখ্যাত কবিই তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন এবং তাঁর পক্ষে লেখালেখিও করেছেন। এসময়ে তাঁর প্রতিপক্ষ প্রার্থী রুথ প্যাডেল ওই পদে নির্বাচিত হলে কয়েকদিনের মধ্যেই দ্য টেলিগ্রাফে একটি প্রতিবেদন ছাপানো হয় এই মর্মে যে, রুথ প্যাডেল সাংবাদিকদের প্ররোচিত করে ওয়ালকটকে ওই ধরনের মানহানিকর মামলায় জড়িয়ে ফেলে। অতঃপর মিডিয়া ও অ্যাকাডেমিক চাপের মুখে রুথ প্যাডেল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কবিতার অধ্যাপক পদ থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য হন। পৃথিবীর সভ্য দেশেও এ-ধরনের ব্যাপার ঘটে থাকে এবং এতে অবাক হওয়ারও কিছু নেই।

ক্যারিবিয়া, তাঁর জনগণ এবং তাঁদের পরিচয়, সমুদ্র ও দ্বীপের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য – এসবের মৌলিক পরিচয় তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর ব্যাপক সৃষ্টিকর্মে। শেকড়সন্ধানী এই কবি ক্যারিবিয়ানদের মধ্যেই নিজের অস্তিত্বের সন্ধান করেছেন। ক্যারিবিয়ানদের জন্য তাঁর ভালোবাসা ছিল গভীর ও সুদূরপ্রসারী। তিনি লিখেছেন, ‘I felt a great love that could  bring me to tears.’ ইংরেজ শাসক তথা উপনিবেশবাদীদের তিনি ঘৃণার চোখে দেখতেন। ওয়ালকট ‘What the Twilight Says : An Overture’ (১৯৭০) প্রবন্ধে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কলোনাইজড অবস্থার আলোচনায় আক্ষেপ করে বলেছেন, একজন শিল্পীর সংকট ঘনীভূত হয় তখনই যখন তাঁর জাতীয় পরিচয়ের সংকট রয়ে যায় । তিনি লিখেছেন : ‘We are all strangers here… Our bodies think in one language and move in another’. বিচ্ছিন্ন ক্যারিবিয়ান দ্বীপের আলোহীন অবহেলিত নির্যাতিত মানুষের তলানি থেকে তিনি খুঁজেছেন শিল্পের আকর। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর চরম দুর্বলতা তাঁকে ইউরোপিয়ান কিংবা আমেরিকান করে তোলেনি, তিনি তাঁর কবিতায় বলেছেনও এই দ্বীপ ছেড়ে তিনি কোথাও যাবেন না। উপনিবেশবাদীর ভাষায় সাহিত্য করে তিনি শাসকদের বিকৃত অবয়বকে চিত্রিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার ইংরেজি ভাষায় লেখালেখি নিয়ে যেসব আলোচনা-সমালোচনার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে তা সবই অমূলক। অনেক সংকীর্ণ, একপেশে সমালোচনার মধ্যে আমাকে পড়তে হয়েছে। ক্যারিবীয় ক্রিটিকরা বলতে পারেন, আমি হয়তো ইংরেজ হয়ে যাচ্ছি। আবার ইংরেজ ক্রিটিকরা বলতে পারেন, আমাদের দলে আপনাকে সাদর আমন্ত্রণ। এধরনের একপেশে সমালোচনা বা মন্তব্যের কোনো মূল্যই নেই আমার কাছে। ইংরেজি ভাষায় লেখা মানেই ইংরেজ হওয়ার কোনো প্রচেষ্টা নয়। আমি স্পষ্টতই একজন ক্যারিবিয়ান কবি।’ ক্যারিবিয়া দ্বীপপুঞ্জের শ্বাসনালিতে শক্তি জুগিয়ে তিনি তাকে বিশ্বপরিসরে দাঁড় করিয়েছেন স্বমর্যাদায়। তাই জোসেফ ব্রডস্কির সঙ্গে এ ব্যাপারে আমরাও একমত যে, কলম্বাস ওয়েস্ট ইন্ডিজ আবিষ্কার করেছিল, আমেরিকা গড়েছিল উপনিবেশ আর একে অমরত্ব দিয়েছে, এর আইডেন্টিটির ব্যাপকতা দিয়েছেন ওয়ালকট। কবিতা ও নাটক – উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর শ্রমের স্বাক্ষর ও সফলতা তাঁকে আলাদা সম্মানের জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে। কবিতার নন্দনবনে ওয়ালকটের স্বতন্ত্র ছায়াপুষ্পের দীপ্তিময় গন্ধ যে আমাদের বহুকাল বিমোহিত করবে, এ-ব্যাপারে আমরা নিঃসনেদহ।