সেতুপুরুষের মৃত্যু  

কী দেখলে তুমি রৌদ্রকঠিন হাওয়ার অট্টহাসি

দুহাতে ছড়িয়ে দিয়ে নিষ্ঠুর মৃত্যুর প্রেতসেনা

মাঠে মাঠে বুঝি ফিরছে? ফিরুক, তবু তার পাশাপাশি

কৃষ্ণচূড়ার লাবণ্য তুমি একবারও দেখলে না?

 

এক লহমায় ঠাহর করা যায় উত্তরগর্ভ এই প্রশ্নের প্রণেতা নীরেন্দ্রনাথ এক সপ্রতিভ স্বরায়ণে আমাদের মেসমেরাইজ করে দিতে জানেন। সত্যের সৌজন্যে কবুল করতেই হয়, একই অনুষঙ্গে ‘কৃষ্ণচূড়া কৃষ্ণচূড়া এখনও তুমি আছো?’ আরো পেলব, স্পর্শভীরু এবং লিরিকধর্মী। কিন্তু আমাদের ঝিমিয়ে-পড়া প্রহরে প্রহরে এক ঝটকায় অন্ধকার ঘর থেকে নিষ্ক্রমণের আমন্ত্রণ, প্রথমোক্ত উদাত্ত দ্যোতনায়, জানাতে গিয়ে কুণ্ঠিত যেন।

আকৈশোর নীরেনদা এই ঘরানায় আমাদের ডাক দিয়ে গিয়েছেন। বিবিক্ত আম্পায়ারের নিরপেক্ষ মুদ্রায় নয়, সরাসরি কৃত্তিবাসের ভাটিয়ালি দলবলের হয়ে মাঠে নেমে প্রতিপন্ন করেছেন তিনি সুদূর প্রজন্মের জাদুঘর আগলে থাকার মানুষ নন। বইমেলার মুখে হাইডেলবার্গে ভারততাত্ত্বিক লোথার লুৎসেকে টেব্লটেনিস খেলায় হারিয়ে দিয়ে নীরেনদার চোখেমুখে স্বর্গীয় আনন্দের বিচ্ছুরণ লক্ষ করে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা দিশাহারা হয়ে গিয়েছিল।

সেই খেলার শেষে পড়ুয়াদের সঙ্গে নীরেনদার প্রাণিক বিনিময়ের আগ্রহ ও নৈপুণ্য সে এক নান্দনিক সংঘটন। শেষ পর্যন্ত তিনি যে-খেলায় অনবদ্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করলেন বঙ্গসংস্কৃতির পরিসরে তাকে বলা হয় আড্ডা। স্মার্টফোনের দৌলতে নিঃশর্ত সৃজনী সংলাপের সেই ঐতিহ্য অধুনা পরিলুপ্ত। আসরের শেষে স্বযাচিত গরজে একের পর এক গান গেয়ে চলেছিলেন : ‘মা আমাকে দয়া করে শিশুর মতন, করে রাখো’, ‘প্রথমে বন্দিনু আমি গুরুর চরণ’, কিংবা ‘বন্দর ছাড়ো যাত্রীরা সবে জোয়ার এসেছে আজ।’

কাল ও কালান্তরের ব্যবধান ঘুচিয়ে দেবার ক্ষেত্রে যেমন, জন্মভূমি ও কলকাতার মধ্যে যোগসাধনের বেলাতেও ঠিক তেমনি সামঞ্জস্যের সাধনায় সজাগ ছিলেন নীরেনদা। শেষোক্ত প্রবর্তনার ধ্রম্নপদী উদাহরণ কালি ও কলমের সঙ্গে ওতপ্রোত তাঁর জড়িয়ে-থাকা। দুই বাংলার অগ্রণী এই সেতুপুরুষের মৃত্যুতে তাই আমরা শোকাহত।