সেদিন আকাশে পূর্ণিমা ছিল না

নুরুল করিম নাসিম

সাবের রাতে আর বাড়ি ফিরলো না।
আমরা সবাই খুব উদ্বিগ্ন। বাবা চিন্তিত। মা ডুকরে কাঁদতে লাগলেন। আমি সবার বড়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। মন শক্ত ও কঠিন না হলে ডাক্তার হওয়া যায় না। মন শক্ত করে অনড় হয়ে রইলাম। ভাবলাম, সাবের রাতে এই তুমুল ঝঞ্ঝাটের ভেতর বাড়ি না ফিরে ভালোই করেছে। মা বোঝেন না, বুঝতে চান না। সাবেরের প্রতি মায়ের একটু বেশি পক্ষপাত। বেশি ভালোবাসা কি? আমার আরো দুভাই আছে। ওরাও মাকে বোঝাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। বাবা ডাক্তার। তিনিও বোঝাতে চেয়ে ব্যর্থ হলেন।
কাল সারারাত প্রচুর গোলাগুলির শব্দে আমাদের আজিমপুর এলাকাটা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। মধ্যরাত থেকে সৈনিকদের কার্যক্রম শুরু হয়েছে তুমুলভাবে। হঠাৎ মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে জেগে উঠে
দেখি পিলখানায় সৈন্যদের ব্যারাকে, আমাদের বাসা থেকে খুব কাছে, যুদ্ধ হচ্ছে। আকাশ রক্ত-লাল। গোলাগুলির আওয়াজে কান ঝালাপালা। আর আর্ত মানুষের চিৎকার, হাহাকার। সন্ধ্যা থেকেই সবার মুখে মুখে কথাটা রটে গিয়েছিল। দেশে একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু তা যে এত ভয়াবহ হবে তা কেউ ভাবেনি।
রাতটা কাটলো এক ভয়ানক ভয়, দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তার ভেতর। পরদিন সকাল-সন্ধ্যা কারফিউ ঢাকা শহরে। মাঝখানে কয়েক ঘণ্টা বিরতি।
সাবের কোনোদিন এরকম করে না। যত রাতই হোক না কেন, বাড়ি ফেরে। মাঝখানে কিছুদিন বুয়েট হোস্টেলে থাকতো। পড়াশোনার নাকি সুবিধা তাতে। মা কিছুতেই রাজি নন। বাবা এবং আমি ব্যাপারটা উপলব্ধি করে মাকে বোঝালাম। রাত জেগে লাইব্রেরি ওয়ার্ক করতে হয়, গ্র“প স্টাডি আছে, খুব সকালে ক্লাস ধরতে হয়। তাছাড়া বুয়েটে ছাত্ররা এতটা ব্যস্ত যে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে সময় অপব্যয় করে না। এদের জগৎ পড়াশোনার ভেতরই ব্যাপৃত। তবে এরা রাজনীতিসচেতন এবং শিল্প-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী। কেউ কেউ গল্প-কবিতা-নাটক লেখে। নাটকে অভিনয় করে। সাবের কবিতা লেখে। বলা যায়, ভালো কবিতা লেখে। আমার পিঠাপিঠি ভাই বলে বলছি না। আর ক্রিকেটপাগল।
ইদানীং সাবের বাসায় থাকতো, বুয়েট হোস্টেলে নয়। কেবল খুব জরুরি কিছু হলে হোস্টেলে থেকে যেতো। সেটা টেলিফোনে জানিয়ে দিতো।
কিন্তু গতকাল সে কিছুই জানায়নি।
এমন হতে পারে হোস্টেলে থেকে গেছে। কিন্তু সেখানেও তো সৈন্যরা আক্রমণ করেছে। সমস্ত শহর গত মধ্যরাতে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
কারফিউ কয়েক ঘণ্টা উঠিয়ে নেওয়ার পর আমি সাবেরকে খুঁজতে বের হলাম। প্রথমে ওর হোস্টেলে গেলাম। ওর বন্ধুরা বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে দ্রুত চলে যাচ্ছে গ্রামে। শহরে কোনো যুবকের থাকা নিরাপদ নয়। ওরা আমাকে চেনে। ওরা বললো, সাবের রাতে ছিল না হোস্টেলে।
চিন্তায় পড়ে গেলাম। একথাটা কোনোভাবেই মাকে জানানো যাবে না। এমনিতে মায়ের হাই ব্লাড প্রেশার। ডায়াবেটিসও আছে। মনমেজাজ প্রায় সবসময়ই তাঁর ভালো থাকে না। হঠাৎ-হঠাৎ খুব তুচ্ছ কারণে রেগে ওঠেন।
বাবা এখনো শক্ত আছেন। ডাক্তার বলেই হয়তো-বা মনটাও বেশ দৃঢ় ও কঠিন। যে-কোনো সংকটে ঘাবড়ে যান না। আমিও বাবার মতো শক্ত মনের অনেকটা।
দুটো জায়গায় খোঁজ নেওয়া খুব জরুরি। একটা পুলিশ স্টেশন, অন্যটা হাসপাতালের মর্গ। এ দুজায়গায় অনেক সময় আসল তথ্য পাওয়া যায়। প্রথমে পুলিশ স্টেশনে গেলাম। সেখানে কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। দ্রুত মেডিক্যালের মর্গে গেলাম। এটা আমার এলাকা। প্র্যাকটিকাল ক্লাস করতে এখানে অনেকবার আসতে হয়েছে। আমি মর্গে যেতে পারি, তেমন কোনো বাধা নেই। গত পরশু রাতে অসংখ্য মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে। কামান ব্যবহার করা হয়েছে জগন্নাথ হলসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য আবাসিক হলে। প্রচুর ছাত্র মারা গেছে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষও মারা গেছে। কে জানে, হয়তো সাবেরও সেই লাশের ভেতর আছে। তা না হলে সে টেলিফোন করছে না কেন? এখন তো কারফিউ নেই। এখন তো সে আজিমপুরের বাসায় ফিরে আসতে পারে। মায়ের অবস্থা সে জানে। খুব ভালো জানে। মা তাকে ভীষণ ভালোবাসে। এখনো মুখে তুলে ভাত খাইয়ে দেয়। সাবের সবার ছোট। আসলেই কি সাবের বেঁচে আছে!
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে, এসব কিছু ভাবতে ভাবতে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমরা দুজন পিঠাপিঠি ভাই। কত সব স্মৃতি রয়েছে আমাদের দুজনের। প্রথমে আমরা দুজনই তো ছিলাম। পরে আমার অন্য ভাই ও বোনটি এই পৃথিবীতে এসেছে। আমরা দুই ভাই বন্ধুর মতো, সবসময় সবকিছু দুজন মিলে করেছি। কোথাও যাওয়া কিংবা কোনোকিছু করা, সব একসঙ্গে করেছি।
সেদিন কেমন করে কী যেন হয়ে গেল। সাবেরের বাসায়ই থাকার কথা ছিল। একসঙ্গে একটা প্রোগ্রাম ছিল আমাদের। আমি ভেবেছিলাম রাত দশটার আগে সে ফিরে আসবে। আমরা দুজন মিলে কয়েক বাসা পরে আবেদ আলী ভাইয়ের বাসায় যাবো। তিনি একসময় কমিউনিস্টদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখতেন। বাম আন্দোলনে জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ’৫৬ সালে। খুব সাদামাটা ছিমছাম সৎ জীবনযাপন করেন তিনি। ঢাকার একটি বেসরকারি কলেজে পড়ান। একা মানুষ। বৃদ্ধ মা আছেন। ভাইবোনরা সব মার্কিন মুল্লুকে ভালো চাকরি করেন। আবেদ ভাইকে বহু অনুরোধ, বহু চেষ্টা করেও সেদেশে নেওয়া যায়নি। কাজের লোক রান্নাবান্না করে, মাকে দেখাশোনা করে। তিনি কলেজ থেকে মোটামুটি ভালো টাকা-পয়সা পান। সবটাই ব্যয় করেন বই, মায়ের চিকিৎসা এবং গরিব ছাত্রছাত্রীদের জন্য। ভাইবোনরাও প্রতি মাসে মায়ের জন্য টাকা পাঠান। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে আবেদ ভাইয়ের জুড়ি নেই।
আমি আর সাবের দেশের উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিষয়ে একটি সঠিক বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন জানার জন্য তাঁর কাছে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম। আমি অপেক্ষা করছিলাম। তিনিও আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমরা জানতে চাচ্ছিলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কী ভুল করছেন? ঠিক সেই রাতেই ঘটনাটা ঘটে গেল।
আমরা সবেমাত্র ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। শুরু হয়ে গেল গোলাগুলির ভয়ংকর শব্দ। আকাশ রক্তবর্ণ হয়ে উঠলো। সেই রাতে সাবের আর বাড়ি ফিরলো না।
আমরাও বাক্সপ্যাঁটরা বাঁধাছাদা করে দেশের বাড়িতে চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিলাম। মা-বাবা দেশের মাটিকে আঁকড়ে ধরে রয়ে গেলেন। আমি সীমান্তে চলে গেলাম। সাবের আমাদের স্মৃতি ও চেতনা থেকে ক্রমশ হারিয়ে গেল।
অনেক কষ্টে কয়েকজনের সঙ্গে সীমান্তের এক ফাঁড়িতে এসে পৌঁছলাম। ঢাকায় থাকতে বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে এরা যুক্ত ছিল। আমিও।
কোথায় যাবো, কী করবো, কিছুই জানি না। ঢাকা বেতারে আমি একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান সকালে উপহার দিতাম। স্ক্রিপ্ট, সাক্ষাৎকার ও উপস্থাপনা ছিল আমার। যুদ্ধক্ষেত্র আমার নয়, মিডিয়ার মাধ্যমে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে পারি। সেটাই হবে আমার আসল যুদ্ধক্ষেত্র।
একদিন ফাঁড়িতে অলস সময় কাটাচ্ছি। পকেটে তেমন একটা পয়সাকড়ি নেই। অনেক কষ্টে দুর্গম পথ পার হয়ে সীমান্তে এসেছি। আমাদের ভেতর দুজন কলকাতায় খোঁজখবর নিতে গেছে। দেশের হোমরাচোমরা কাউকে পাওয়া গেলে ওদের কাছে সঠিক দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে। আমরা দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু উৎসর্গ করতে চাই। জীবন বিসর্জন দিয়েও দেশকে শত্র“মুক্ত করতে চাই। এদেশের আকাশ, শস্য-শ্যামল সবুজ প্রান্তর আমার। এদেশে আমি জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি, এদেশের সার্বভৌম স্বাধীন মাটিতে আমি মরতে চাই। আপাতত অনন্যোপায় হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছি, কিন্তু এটা আমাদের গন্তব্য নয়।
রাত হয়ে এলো। ওরা দুজন কলকাতা থেকে ফিরলো না। কাছাকাছি কোনো টেলিফোনও নেই। জায়গাটা অনেকটা অজপাড়াগাঁর মতো। অরণ্য আছে। বিশাল গাছপালা ঘিরে রেখেছে বিশাল ধু-ধু প্রান্তর। একটা বিবর্ণ একতলা বিল্ডিংয়ে আমরা অবস্থান করছি। হঠাৎ মধ্যরাতে বুটের আওয়াজ পাওয়া গেল। খাকি পোশাকের সৈন্য। আমরা চমকে উঠলাম। এখানে সৈন্য কোথা থেকে এলো? তবে কি আমাদের খোঁজ পেয়ে ওরা এখানে এসেছে! একটা জলপাই রঙের জিপ আলো জ্বেলে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকটি রাতজাগা পাখি চিৎকার করে আসন্ন বিপদের কথা ঘোষণা করলো। কয়েকটা শেয়াল দূরে কোথাও যেন লাফিয়ে চলে গেল। আকাশে আজ পূর্ণিমা নেই। বিশ্বচরাচর নিকষ আঁধারে ঢেকে আছে। এখানে আমরা তিনজন ঢাকা থেকে এসেছি। আমরা বললাম, আমরা মুক্তিযোদ্ধা, আমরা দেশকে স্বাধীন করার জন্য সীমান্তে এসেছি।
বুটে খুব জোরে একটি শব্দ করে একজন দীর্ঘকায় সৈনিক ভিনদেশি ভাষায় বললো, তুমলগ মুক্তি নেহি। তুমলোগ কমিউনিস্ট হায়। ইধারসে নিকাল যাও।
আমরা তিনজন ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। তারপর অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে হাঁটতে লাগলাম। হায় জীবন! হায় বিপ্লব!
ক্লান্তিতে শরীর অবসন্ন। বাবার কথা মনে পড়লো। মায়ের জন্য খারাপ লাগলো। পেছনে ফেলে আসা দেশ এখন শত্র“দের হাতে বন্দি হয়ে আছে। শুধু স্মৃতি ও চেতনায় দেশ আছে, বাস্তবে নেই। মনটা ভিজে উঠলো। ক্ষুধায় পেট চোঁ-চোঁ করছে। গতরাতে কেউ কিছু তেমন একটা খাইনি। একজনের কাছে মুড়ি ও এক বোতল পানি ছিল। সবাই ভাগ করে খেয়েছি।
ভোরের আলোয় কলকাতা থেকে অন্য দুজন ফিরে এলো। সেখানকার খবর ভালো নয়। নেতাকর্মী সব যে যার মতো থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে নিয়েছে। বেতারযন্ত্র স্থাপন হচ্ছে। পত্রিকা ছাপার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বেশকিছু সৃজনশীল যুবক দরকার হবে।
আমার মনটাই ভেঙে গেছে। আমরা দেশকে স্বাধীন করতে এসেছি। আমরা মুক্তিযোদ্ধা। সৈন্যরা আমাদের ‘কমিউনিস্ট’ তকমা লাগিয়ে দিয়েছে। আমরা প্রাগ্রসর চিন্তাচেতনার তরুণ প্রজন্ম। আমরা কমিউনিজম বুঝি না, আমরা গণতন্ত্র বুঝি না। আমরা মানুষ বুঝি। মানুষের বসবাসের জন্য সমাজকে বদলাতে চাই। আমরা এরকম রাষ্ট্র চাই না যেখানে ধর্মের নামে, গণতন্ত্রের নামে, কমিউনিজমের নামে শোষণ চলবে। শোষণহীন কল্যাণময় একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন ও তার রূপরেখা আমরা হৃদয়ে লালন করছি।
আমি ওদের বললাম, আমি দেশে ফিরে যেতে চাই।
ওরা সমস্বরে অট্টহাসিতে ভেঙে পড়লো। আর সেই হাসিতে প্রশান্ত ভোর বিশ্বাস ভঙ্গের মতো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। ওরা বললো, কার দেশ? কোন দেশ? দেশ তো আর দেশ নেই। সোনার বাংলা এখন শ্মশান হয়ে গেছে। শত্রু সৈন্য আর তাদের তাঁবেদাররা দেশ দখল করে রেখেছে।
মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। মনে হলো, তবুও আমার দেশ। সেখানে আমি জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি। সেখানেই আমি মরতে চাই।