সেবার যখন মৌসুমি বায়ু এসেছিল

দেবেশ রায়

দুই

নতুন জলে মরণ সব জায়গাতেই ঘটতে পারে যেখানে বছরের দুটো-একটা ঋতু জুড়ে নতুন জলই নামতে থাকে, ঝরতে থাকে, পুরনো চেনাজলে ঘটে যায় নতুন বদল আর স্থলদেশ ও জলদেশের চোখ-সওয়া অবস্থান শুধু বদলায়ই তা নয়, বদলাতেই থাকে, একটা দেশের (স্পেস) ভিতর থেকে দেশমালা গুঁতিয়ে ওঠে, তলিয়ে যায়, ছিঁড়ে যায়, ভেসে যায়।  আমাদের, বাঙালিদের, বাঁচার অপার রহস্য তো এখানেই। এখানেই। এখানেই যদি কেউ রহস্য খুঁজে পান, তবে তিনি যে খুব বেশি রহস্য ভেদ করলেন তাও

নয়? যা সত্য, তার ওপর পলেস্তারার পর পলেস্তারা সত্ত্বেও তিনি সেই সত্যটাই দেখলেন – এইমাত্র। সত্য তো আর গ্রাহক-সাপেক্ষ নয়, অন্তত এমন পরীক্ষাযোগ্য সত্য। গ্রাহক না থাকলেও সত্য তো  সত্যই থাকবে।

যেমন,  কোনো-কোনো দেশের লোক বলে – আমাদের দেশে রাতে সূর্যোদয় ঘটে, যেমন কোনো কোনো দেশের লোক  বলে – আমরা অধোদেশ থেকে কথা বলছি, আমরা দুই নদীর মাঝের চরের লোক, আমাদের দেশে দুই জায়গায় মানুষ হারায়  না – এক সমুদ্রের মাঝখানে, আর এক মরুভূমির মাঝখানে, আমাদের দেশের মাটি সব সময়ই কাঁপছে, আমরা আঠারো রকম বরফ চিনি, তেমনি আমরা বাঙালিরা বলতে পারি – আমরা হাঁটতে দুই পা একতলে ফেলি না, আমরা বছরের বেশিরভাগ সময়ই মাটির ভিতরের মাটির ওপর দিয়ে হাঁটি। আমরা সেই দেশের লোক যে-দেশের মাটি থেকে-থেকে গলে যায়, আমরা সেই দেশের মানুষ যে-দেশে মাটির কোনো তল নেই, মানে, অতল? না, ঠিক অতলও নয়। তুমি একতল মেপে খুঁটি গাড়লে আর পরদিন দেখলে খুঁটি আরও গেড়ে গেছে বা নতুন জল একতল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা দেশের সীমানা মাপি জলের স্বাদ নিয়ে। যতদূর মিষ্টিজল, ততদূর আমাদের দেশ। আমরা মিষ্টি জলের দেশের লোক।

জলের ঢেউয়ের ওঠাপড়া মেপে আমরা নৌকোর তল তৈরি করি। বিরাট বিস্তারের নদীর এক ঘরোয়া ঘাট থেকে আমরা একা একটা ছিপছিপে ছিপ নিয়ে বিরাটতর বিস্তারে চলে যাই, যেন সেই অতলও আমাদের ঘরোয়া। বৃষ্টির ছাঁট বুঝে আমরা চারচালা ঘর তুলি। হাওয়ার বেগ বুঝে আমরা পশ্চিম দিক জুড়ে নারকেল গাছ লাগাই – তার আওয়াজে আমরা বুঝি, ঘুমের ভিতরে হাওয়া দিক বদলাচ্ছে।

আমরা সেই জল ভুলে নগরবাস করছি। অথচ স্মৃতির ভিতরে জল, স্মৃতি থেকে বয়ে আসে যে-সংস্কার তার ভিতরে জল। ফলে জল আমাদের টানে। আমাদের শিক্ষায় তো সে জলকে আমাদের জীবনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়নি। আমরা আয়ত্ত করে নিয়েছি     এক নগর – জল যেখানে বিলাস। আমাদের চষা-ক্ষেত ও প্রান্তর জলকে ধারণ করে রাখে – সে-ই জলে জলে তৈরি স্ফটিকবিস্তারের ভিতর দিয়ে আলপথে চলা আমাদের পুরুষানুক্রমিক। আমাদের হাঁটা – জলের দেশের হাঁটা। আমাদের মেয়েদের পায়ের নখগুলো থেকে আলো পিছলে যায় – ওরা জলের দেশের মেয়ে। বর্ষায় টানা বৃষ্টিতে জল যখন ফুলেফেঁপে উঠে  নতুন-নতুন খাতে বয়ে যায় তখন কত উঁচু বাঁধ থেকে, উঁচু আল থেকে, উঁচু পুকুর থেকে ছোট-বড় কত জলপাত দিয়ে আমাদের চলতে হয়। তাই আমাদের চুল জলকণায় ভরা, আমাদের  মুখের ওপর যে-আচ্ছদ তা জলে বোনা। আমাদের মেয়েদের মুখ থেকে সে-আচ্ছদ সরাই যখন হাতের পাতা ভিজে ওঠে। কত কত জল ভেঙে ভেঙে সেই সব মেয়ের মুখ ভেসে ওঠে।

নতুন জলে তাই মরণ থাকে।

আমরা সে-ই মরণ ভুলে আর-এক মরণে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছি। কলকাতা শহরজোড়া কত খাল, কত খাল পুবে, উত্তরে, দক্ষিণে। পশ্চিমে, বজবজের কাছে গঙ্গা যেখানে ডাইনে বেঁকে আরো পশ্চিমে চলে গেছে, সেখানেও – কত খাল, কত খাল। এ খালগুলি দিয়ে পশ্চিম-নদীর জোয়ার পুব-নদী দিয়ে বয়ে যেত। নদী খাত বদলায়। তেমনি কোনো শুকনো খটখটে খাতে এখনো চিনে নেওয়া যায় বেহলার ভাসানযাত্রার কিছু নাম।

সেই সব খাল মজে গেছে, বুজে গেছে, পচে গেছে, তবু  খালই আছে। সেসব খালের জল পুরনো হতে-হতে এখন শুধু পাঁক। সেই পাঁকের মরণও আছে। নতুন জল আর খালের এই পুরনো জলের ভিতর দ্বন্দ্বে, স্রোত ও পাঁকের ভিতরের  অসহাবস্থানে মরণ  আসে।

এত যে জলমরণের বৈচিত্র্য সেগুলিকে এত ছড়িয়ে রাখলে প্রশাসন ও পুরশাসন চলবে কী করে। তাই মরণের শ্রেণিভাগ, কালভাগ ও ঋতুভাগ আছে।

ছোট মাছের  ঝাঁক উঠলেই যে জলে ডুবে মানুষজন মরতে শুরু করে, তা নয়। বা শেষ কালবৈশাখী ও প্রথম মৌসুমির টানা বৃষ্টি খুব কয়েকদিন হওয়ার পর রোদ উঠলেই যে লোকজন মরতে শুরু করে, তাও নয়। বছরের অন্য সময়ও খালে-দিঘিতে-গঙ্গায়- স্কোয়ারে টুপটাপ লোক ডুবে মারা যায়। কিন্তু যখন তাপপ্রবাহে বা শৈত্যপ্রবাহে মৃত্যুর শুমারি চলে তখন তো কেউ জলে মারা গেলে, তাকে ‘সিজন্যাল ডেথ’ বলা যাবে না।

১৮ জুন, বুধবার বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ সাদ্দাম হোসেন  (৭) তার  দাদা শেখ সুলতান হোসেনের হাত ধরে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। হাঁটছিল, মানে যাচ্ছিল। দাদার বয়স এগারো। ওদের হাত ধরাধরির ভিতর কোনো নির্ভরতাও ছিল না, দায়িত্ববোধও ছিল না। কয়েকদিন তো শুকনোই যাচ্ছে – সাদ্দাম ও সুলতানের বর্ষা আর শুখার হিসেব খুব পাকা হতে হয়। তাদের সেদিনের জীবিকা কী হবে, তা নির্ভর করে রোদ আর বৃষ্টির ওপর। ওরা একটা বাঁক নিতেই সাদ্দাম পাড় দিয়ে পিছলে খালে পড়ে গেল। খালে জল প্রায় ছিলই না – কালো থিকথিকে কাদা ছিল। পার্কে যেমন স্লিপ খায় বাচ্চারা, সাদ্দাম-সুলতানের বয়েসি বাচ্চারাও, পড়ে গিয়ে তেমনি করে স্লিপ খেয়ে সাদ্দাম থিকথিকে কালো কাদার ভিতরে ঢুকে গেল।  ঢুকে যাওয়ার আগে এই এই এই করে যে হেঁকে উঠেছিল সুলতান, তার প্রথমটি, সম্ভবত দ্বিতীয়টিও, সাদ্দাম শুনতে পেয়েছিল, নিশ্চিত। বল কুড়োবার মতো করে ছোট ভাইয়ের জন্য সুলতান মাটি আঁচড়াচ্ছিল। ডুবুরি এসেছিল – পায়নি। পাড়ার এক ছেলে বিকেল পাঁচটা নাগাদ সাদ্দামকে তুলে এনেছিল থিকথিকে কাদার অনেকটা তল থেকে।

সে-বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে খালের ঢালের লোকজনকে তুলে দিয়ে খাল কাটা হচ্ছিল। খালের কাদা ও মাটি খালের ধার ধরে সারি দেওয়া টিলার মতো থাকল – রাস্তায়  ‘নো এন্ট্রি’সহ। শীত-বসন্তের রোদে কাদামাটি জল শুকিয়ে গেল আর হাওয়ায় সেই ধুলো রাস্তার পাশের বাড়িগুলির ভিতর থেকে ঢুকে যেতে লাগল। পেটের, চামড়ার আর শ্বাসের অসুখ ঘটতে লাগল, ছড়াতে লাগল।

এসব বাড়ি তো নিয়মিত ট্যাক্স দেওয়া বাড়ি, ভোট দেওয়া বাড়ি, পুরনো ভাড়া দেওয়া বাড়ি, রোয়াক ও দেউরিঅলা বাড়ি, রক পেরিয়ে দু-দিকে দুই ঘরঅলা বাড়ি, চারদিকে ঘর মাঝখানটা ফাঁকা বাড়ি, উঠোনের পাশে বড় চৌবাচ্চাঅলা বাড়ি। জোড়া শিবমন্দির পর্যন্ত আছে – বাড়ির সীমানায়। এসব বাড়ির অনেক শরিক। বাড়িগুলোর সামনে দিয়ে পেছন দিয়ে অনেক অলিগলি বেরিয়ে, এ ওর সঙ্গে পেঁচিয়ে, রেললাইনের তলা দিয়ে ঘুরে আবার ফিরে এসেছে। কোনো কোনো বড় বাড়ির বাইরের মাঠজুড়ে যে বস্তি সেগুলো এত পুরনো যে অমন করিন্থিয়ান থামওয়ালা বড় বাড়ির ছাদ-বারান্দাকে মনে হয় মাটির চড়াইয়ের ওপর বস্তি। কোনো কোনো বাড়ির একটা কোনাচে দিক ভেঙে গ্রিল কাচ এসব দিয়ে নতুন একটা টুকরো উঠেছে।

পুব আর দক্ষিণের দিক ঘিরে খাল, তিন-চার-পাঁচ বছরের পুরনো খাল – সেই খালের  ঢালে মানুষজনের টানা বসতি, বেশ জমজমাট। সেই জবরদখল বাড়িঘরের কিছু কিছু বুলডোজার দিয়ে ধুলো করে দিতেই যেন, অন্তত পঞ্চাশ-ষাট বছরের পুরনো কথা যাদের মনে আছে তারা চমকে উঠে দেখে, দিকগুলো যেন পঞ্চাশ-ষাট বছরেরই পুরনো, খোলামেলা, ঝলমলে হয়ে উঠল। খাল খোঁড়া শুরু হতেই দু-তিনশো বছরের পুরনো সব গল্প যাদের পড়া ও কিছু কিছু ম্যাপ ও সাহেবদের অাঁকা ছবি যাদের দেখা তারা ভাবতে পারল – কেমন হতে পারে নতুন খালে নতুন জল। একটা খালের দু-তিনশো বছরের পুরনো পাঁক যখন কালো পাথরের টিলার মতো খাড়া হতে ও ছড়িয়ে পড়তে লাগল তখনো তারা বেয়াক্কেলের মতো সন্দেহ করেনি – এ তো কাদামাটির পাহাড় হয়ে উঠল! খাল খুঁড়ে দু-তিন শতকের পাঁকের যে-পাহাড় তোলা হলো, সে কি খালের ধারের রাস্তাতেই গাদা দেওয়ার জন্যে। সেই পাঁক শুকিয়ে গেল জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির রোদে আর উড়তে লাগল মার্চ-এপ্রিলের হাওয়ায় আর পেট-লাঙস-চামড়ার অসুখ ছড়াতে শুরু করল। তখন মেইন রোডে একদিন পথ-অবরোধ করায় জানা গেল, তাও গুজব, যে-বিদেশি সংস্থার টাকায় খালের পাঁক তোলা হচ্ছে, তারা এগ্রিমেন্টে ‘রিমুভ্যাল অব সিল্ট’ বলতে বুঝিয়েছে, যথাস্থানে সেই মাটি-ফেলা পর্যন্ত আর এখানকার সরকার বুঝিয়েছে খাল থেকে পাঁক তোলা পর্যন্ত। এরা রিমুভ্যালের জন্য নতুন টাকা চাইতেই সাহেবরা বলেছে, রিমুভ্যালের জন্যই তো টাকা দেওয়া হয়েছিল। এসব গুজব তালমাত্রা না রেখেই, অদৃশ্য ভাইরাসের বেগে জন্মান্তরিত হতে থাকে ও হতে হতে শেষ পর্যন্ত এমনকী সাক্ষ্যের বাইরে চলে যায়। তাতেই এমন পর্যন্তও শোনা গিয়েছিল, ‘রিমুভ্যাল’ কথাটির মানে ঠিক না-হওয়া পর্যন্ত  রাস্তা থেকে পাঁকের পাহাড় সরছে না।

ইতিমধ্যে এবার ১৩ এপ্রিলেই প্রথম কালবৈশাখী এসে গেল ও ১১ জুনের ঝড়বৃষ্টিই নাকি এ বছরের শেষ ও অষ্টম কালবৈশাখী ছিল। তিন মাসে আটটা কালবৈশাখীর ঝড়জলে, কিছু স্থানীয় নিম্নচাপের ও কিছু সামুদ্রিক নিম্নচাপের ঝড়জলে, শুকনো পাঁক আবার পাঁক হয়ে খালে গাড়ি যেতে লাগল। হয়তো মৌসুমি বাতাস ফিরে যাওয়ার সময় পাঁকগুলো পাঁক হয়ে খালেই চলে যাবে তবে তার আগে ওই খালপাড়ের  দু-দিকের ঢালই গড়ানো পাঁকে পিছল হয়ে ছিল। খালের পুবদিকের রাস্তা ক্যানাল ইস্ট রোড আর পশ্চিম  দিকের রাস্তা ক্যানাল ওয়েস্ট রোড, যদিও খালটা সেভাবে দু-পারে পুব-পশ্চিম নিয়ে যায়নি, তবু ওইটাই রাস্তার নাম। ক্যানাল ইস্ট রোড থেকে ২১ জুন সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ সাদ্দাম আর সুলতান হাত ধরাধরি করে লোহার পুল পেরিয়েই ক্যানাল ওয়েস্ট রোডে পড়েছিল। এখন যানবাহন যাওয়ার যোগ্য চওড়া কংক্রিটের ব্রিজ হলেও পুরনো নামটাই থেকে গেছে। ডানদিকে ছিল সাদ্দাম। এ তাদের ঘরবাড়ি শোয়া-বসার রাস্তা। তাদের পায়ের এতই চেনা যে চোখে পড়ার আগে পা গর্ত টপকে যায়। ওরা আন্দাজ করতেও পারেনি নাকি, পাঁক, গলে রাস্তাটা কত অচেনা হয়ে গেছে? ডানদিকে মোড় নিতেই ডান পা পিছলে গেল সাদ্দামের আর দাদার হাত বা পা কিছু একটা আঁকড়াবার জন্য হাত তুলতে-না-তুলতেই ঢালের গায়ে লেগে থাকা পাঁক পিছলে সে খালের পাঁকে ডুবে গেল।

তখন থেকেই বডি খোঁজা শুরু। ওই খালের পাঁক যারা চেনে জন্ম থেকে তারাই খালে নেমে খুঁজছিল, ডুবছিল, উঠে আসছিল। যাদের জবরদখল তুলে খাল খালি করা হয়েছিল, তাদের কমবয়েসিরাও ছিল। তারাই খুঁজে পেয়ে তুলে নিয়ে এলো সাদ্দামকে বিকেল পাঁচটার পরে।

এখন তো সূর্যাস্ত একটু পরে হয়।

১৯ জুন, বৃহস্পতিবারও যখন শুকনো থাকল সকাল থেকে, তাপসী বেলা দুটো নাগাদ বগাকে বলল, ‘বেরোব।’ বলে তৈরি হতে শুরু করে দিলো। তিন-চারদিন  প্রায় বেরই হয়নি। প্রায় কেন, সেই যে সপ্তাহখানেক আগে বৃষ্টি হয়েছে, বেরোবে কী করে। ওদের এই জায়গাতে জল জমে না কিন্তু বেরোবার পর মোড়টাতে বিখ্যাত জল জমে, এতই যে, তেমন দু-চারদিনের বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরও দু-চারদিন, ওই জমা জল দেখে ভুলে যাওয়া বৃষ্টির কথা মনে পড়ে।

গাড়ি বের করে দরজা খুলে দিয়ে বগা জিজ্ঞেস করল, বা খুলে দিতে দিতেই, ‘কোথায় যাবে?’

ভিতরে না ঢুকে তাপসী বলে উঠল, ‘তোমাকে কি কৈফিয়ত দিয়ে গাড়িতে উঠতে হবে নাকি?’

‘না-বললে গাড়ি ডাইনে ঘোরাব না বাঁয়ে ঘোরাব জানব কী করে -’

‘যেদিকে ইচ্ছে ঘোরাও। হাতে-পায়ে মরচে ধরে গেল’, বগা    বাঁ-দিকেই গাড়ি ঘোরাল, ‘বাড়ি যা করে রেখেছ তাতে চবিবশ ঘণ্টাই বাড়ির বাইরে থাকতে পারলে শান্তি। ওই এক ওল্ড হোর নিজেকে বিউটিকুইন ভেবে পোজ দিয়ে যাচ্ছে। আর এক সান অব এ-বিচ বসে-বসে চুলকোচ্ছে।’

‘আমি আর ওঁদের দিয়ে এসব করাব কী করে। ওঁরাই তো আমাকে করেছেন, বাড়িটাও ওঁদেরই।’

‘হোয়াই ডোন্চ ইউ হ্যাভ ইয়োর ওন হোম?’

‘সে তো বাবা তিন বছর ধরে বলে আসছেন। উনিই তৈরি করে বা কিনে দেবেন ফ্ল্যাট – তুমিই তো রাজি হও না।’

‘ফ্ল্যাট? আমি ফ্ল্যাটে থাকার জন্য তোমাকে বিয়ে করেছিলাম রে? আমি ফ্ল্যাটে থাকব আর ওঁরা থাকবেন ওঁদের তিনতলা বাড়িতে?’

‘আমরাও তো থাকি। ওই বাড়িতে।’

‘ওরা মরে না কেন? কদ্দিন বাঁচবে?’

‘সে তোমাকে অবলাইজ করার জন্য তো আর মরতে পারেন না। আমার ঠাকুরদা বেঁচে ছিলেন নাইনটি থ্রি আর ঠাকুমা তো এইটটি নাইনেও স্টিল গোয়িং স্ট্রং চোখদুটো না থাকলেও।’

‘সেটা তোমাকে বলতে হবে না -’

‘কী বলতে হবে না।’

‘তোমাদের গুষ্টির বাঁচার কথা।’

‘বলছি – ওই লাইনে কিছু এক্সপেক্ট কর না।’

‘কেন? গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট হয় না নাকি?’

‘সে তো তোমার-আমারও হতে পারে -’

‘ওদেরটাই যাতে হয় সে ব্যবস্থা করব।’

‘তুমি কোনো খুনি হ্যায়ার করছ নাকি? কে কনট্যাক্ট করে  দিলো?  অত টাকা আছে তোমার? ওদের রেট তো শুনেছি, প্রপার্টির ওপর -’

‘তুমি এত জানলে কী করে? তুমি কি আমাকে মারার জন্যে খুঁজছ?’

‘তোমাকে মারার জন্য কিলার লাগে নাকি? ও তো দেড় মিনিটের ব্যাপার। আমি মারি না, তাই বেঁচে থাকো।’

‘তোমাকে ছেড়ে দেবে পুলিশ? বধূহত্যা -’

‘ছাড় তো, বধূহত্যা? বাথরুমের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে তোমাকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিলে -’

‘আমাদের বাথরুমের ফ্যান দেয়ালে।’

‘শোবার ঘরেই করব।’

‘তুমি বেরোবে কোথা দিয়ে?’

‘আমি থাকবই না ঘরে।  লক সিস্টেম সে রকম করে নেব – আমি বেরিয়ে গেলেও তুমি ভিতরে নিজেকে লক করে সুইসাইড করবে। তোমার অ্যাপ্রক্সিমেট ডেথ টাইমের সময় আমি কলকাতার বাইরে, কোথাও, হোটেলের রসিদ-সাক্ষী  সব আছে। একটা লোক একই সঙ্গে দু জায়গায় থাকতে পারে না।’

‘তোমার ওপর আমার যদি এটুকু বিশ্বাসও থাকত যে তুমি আমাকে সাকসেসফুলি খুন করেও ধরা পড়বে না, তাহলে আমি রাজি হতাম খুন হতে।’

‘কেন, রাজি হতে কেন?’

‘অন্তত এইটুকু স্যাটিসফ্যাকশন পেতে যে, যে-বেটাছেলেটাকে আমি বিয়ে করেছিলাম, তার অন্তত এইটুকু মুরোদ আছে?’

‘বিয়ের মুরোদ এই তিন বছরে টের পাওনি? বিয়ের আগেই তো টেস্ট করে নিয়েছ।’

‘বিয়ের  আগে তো জানাই ছিল না কী হতে পারে। তখন তো দুজন দুজনের ন্যাংটো দেখেই চিৎ। তোমার কোনো ভ্যারাইটি নেই, ধরে রাখতেই পার না, তোমার যন্ত্রে গোলমাল আছে, সাইজ ছোট। হাজারবার বলেছি লেফটেন্যান্ট-জেনারেল চক্রবর্তীকে দেখাতে। এখন আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই।’

‘তুমি এত সাইজ মাপলে কার-কার?’ বগা একটা বাঁক নিচ্ছিল। তাপসী বলল, ‘না। ভবানীপুরের ঠাকুরমশায়ের কাছে যাব। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে বলেছিলেন একদিন।’ বাঁক না নিয়ে গাড়ি সোজা  করতে করতে বগা বলল, ‘কী, সাইজ  বড় করে দেবেন?’

‘ডেডবডি হ্যাঙ করতে যেও না। নিজের গলায় দড়ি দিলে দড়ির পাক, নট, এসব অন্যরকম হয়। ধরা পড়বেই।’

‘ধরা পড়ব না। হয়তো সন্দেহে পড়ব। তার জন্যই তো অ্যালিবাই। কলকাতার বাইরে। হোটেলের রসিদ, সাক্ষী, রুম সার্ভিসের বিলে সই।

আরে, একটা  সন্দেহ থেকে যদি বাঁচাতে না পারে, তাহলে আমার বাবার এত টাকা আছে কেন। আমি বাবার একমাত্র ছেলে।’

‘পাবলিকলি। প্রাইভেট ছেলে কত আছে সে কে জানে?’

‘এটা বেশ ভালো কায়দা। ছেলেকে ইমপোটেন্ট বলা আর ছেলের বাপকে লম্পট বলা। তোমার স্বভাব তো আর বদলাবে না। কিন্তু এই স্বভাবেও তো একটু সফি আনতে পারতে, একটু মড হতে পারতে।’

‘যা সফি আর মড ছিলাম তাতেই তো তোমার জিভ দিয়ে লালা ঝরত।’

‘হ্যাঁ তা তো কখনো অস্বীকার করিনি। তুমি তো আমার প্রেমে পড়নি। বিয়ের ইচ্ছেও তোমার ছিল না -’

‘ছিলই না তো। অত কম বয়সে কেউ বিয়ে করে ফেলে?’

‘একেবারে করেও না, তা নয় – যদি এত বড়লোকের একমাত্র ছেলে ফসকে যায়, এই ভয় থাকলে করে ফেলে। তুমি নিশ্চয়ই তা করনি, তুমি আমার জেদাজেদিতেই করেছ। তাহলে, এবার তুমি আমাকে ডিভোর্স দাও।’

‘ওইটি হবে না বগা। তোমাকে ওই সুবিধেটা দেব না।’

তাপসী আর বগার কথাবার্তা এখন এ-রকমই হয়। এটা কোনো ঝগড়াঝাটির ব্যাপার নয়। প্রতিদিনের কথাবার্তা – নিজেদের ঘরে শুয়ে-বসে, শুয়ে-শুয়ে, বসে-বসে, নিজেদের ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিতে বেশি রাতে দাঁড়িয়ে। এ-রকম দুটি-তিনটিই মাত্র ধরন আছে। কোনোদিন, কী নিয়ে কথাটা শুরু হলো, কখন শুরু হলো – সে-সবের ওপর নির্ভর করে কোন ধরনটায় ওরা কথা বলবে, স্বাভাবিক স্বরে বলবে, না চিৎকারে পাড়া মাথায় করবে। এই একধরনের কথাবার্তাতেই ওদের অবসরের আলাপ বা তারস্বরে ঝগড়া বা তাপসীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া বা মায়ের বাড়িতে বা দিদির বাড়িতে থাকা, সেখানেও এই কথাগুলিই  আবার একই রকম নানা স্বরে বলা। তাপসী এক রাতে দুটো নাগাদ ব্যালকনিতে গিয়ে চিৎকার করেছিল, ‘এরা আমাকে আটকে রেখে মেরে ফেলছে।’ বগা বলেছিল, ‘ও, সাক্ষী তৈরি করছ, পাড়া-প্রতিবেশী যাতে পুলিশকে বলে যে, হ্যাঁ, ও-বাড়ি থেকে মাঝরাতে বউটির কান্নাকাটি শোনা যেত। বৃথা পরিশ্রম করছ কেন? তুমি নিজে না-করলে আমরা কেউ তোমাকে মারব না।’

ওদের দুজনেরই বয়স এখন পঁচিশের মতো – বছর বাইশেই ওদের মা-বাবা ওদের বিয়ে দিয়ে দেয়। বাইরের কারণ ছিল – ওর বাবার, তাপসীর বাবার, ক্যানসার সন্দেহ করা হচ্ছে আর বগার ঠাকুরদাদা তখন নববই পেরিয়েছেন – তিনি একমাত্র  নাতবউয়ের মুখ দেখবেন না? বাধা কিছু ছিল দুদিকেই, সে যদি বাধা মনে করা যায়। বগারা সাবেকি ঘটি, খাস কলকাতার আর তাপসীরা বাঙাল। বগারা এখনো কমোডে বসতে পারে না আর গামছা পরে স্নানের পর বাথরুম থেকে বেরোয়। পয়সায় দু-পক্ষের কোনো তুলনাই হয় না। খাস কলকাতায় ভূসম্পত্তি ব্যবসা-ট্যাবসা মিলিয়ে বগাদের টাকা-পয়সার কোনো শেষ নেই – তিন পুরুষেও ভাগ হয়নি। তাপসীর বাবা বড় চাকরিই  করেন – কো-অপারেটিভে ফ্ল্যাটে থাকেন। তবে, বগারা জাতে বেশ ছোট, বামুন-কায়েতের দিকে তাদের একটা টান আছে – তাপসীরা কুলীন কায়েত।

বগা-তাপসীর সম্পর্ক এতটা বিষিয়ে উঠল কবে থেকে ও কেন – সেসব খোঁজাখুঁজি করে কোনও লাভ নেই। বগার কিছু               করার দরকার নেই, তাই করে না। বিয়ের পর তার বাবা তাকে যে-হাতখরচ দেন, তাতে একটা পুরো সংসার বড়লোকি করে চলতে পারে। ওদের তো আর কোনও খরচা নেই – ফুর্তি ছাড়া।

ওদের দুটো বাড়ি ও একজন ড্রাইভার ছিল। বিয়ের পর নতুন এক ড্রাইভার এলো। বগার বাবা বউমাকে আমেরিকান এক্সপ্রেসের একটা অ্যাসোসিয়েট কার্ডও করে দিয়েছিলেন। খরচা করবে বউমা, শুধবেন শ্বশুরমশাই। বগাকে, কাজকর্মও একটু বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। বগা বউকে নিয়ে তার বন্ধুদের ঠেকে, রেস্তোরাঁয় পাক দিতে লাগল। সেসব কোনও খারাপ  জায়গা নয়, তারাও অনেকেই স্বামী-স্ত্রীই ঘোরে, কম বয়েসিদের মস্তি – সব ঠিকঠাক রেখে যতটা মস্তি করা যায় ততটুকু মস্তিই তারা করত। দলটা বা ভিড়টা ছিল প্রধানত অবাঙালি, তারা নানা ধরনের ব্যবসাপাতিতে ঢুকছে, নতুন ধরনের সব ব্যবসা – এই যেমন কম্পিউটারে গাড়ির অ্যালাইনমেন্ট ও ইঞ্জিনের  ফাংশনালিটি চেক করা। শুধুই চেক করা – ডায়াগনস্টিক ল্যাবরেটরির মতো সারিয়ে নাও নিজের গ্যারাজে। যেমন, বিদেশি কোম্পানির ব্যাক-অফিস করা। যেমন – অটো হেল্প ক্লাব, যেখানে গাড়ি খারাপ হবে বা অ্যাক্সিডেন্ট হবে, ফোন করলেই হেল্প  চলে যাবে, এর জন্য মাসে বা একবারে একটা টাকা দিতে হবে। সার্ভিস সেক্টরে আরো কত রকম ব্যবসা শুরু হয়েছে।

এ থেকেই, হতে পারে, তাপসীর ও বগারও ফালতু টাকার বড়লোকির একটা নেশা ধরে যায়, তাদের মিশবার দলও ছড়াতে থাকে – সকালে একদল তো সন্ধেয় আর-একদল, তো রাতে একদল। দলগুলি কিছু খারাপ না, তবে পরস্পরের সম্পর্ক শুধুই ফুর্তির, গাড়ি থাকতেও বাইক চালানোর মতো।

তাতেও বাড়িতে কোনো গোলমাল ছিল না। তাপসীর যে একটু ছোট লোভ আচমকা ধরা পড়ত, হতেও পারে সেটা বগার মায়েরই খুঁত-কাড়া স্বভাব। দোকান থেকে সারামাসের সাবান এসেছে – এগুলো বাথরুমে-বাথরুমে যথাসময়ে দেওয়া তো কাজের লোকের কাজ। তাপসী নাকি অনেকগুলি সাবান নিয়ে তার ঘরের  কাবার্ডে ঢুকিয়ে রাখে। এসবই কাজের লোকদের চুরি ও কানে-লাগানো হতে পারে। ড্রাইভার নিয়ে ওরা বেরিয়ে যেত সকালের দিকেই, ফিরত রাতে।

বগার বাবা একদিন জানিয়ে দিলেন – ওই ড্রাইভারটা ছুটি নিয়েছে। আর ব্যাংকের কার্ডটার সময় পেরিয়ে গেলে তিনি আর রিনিউ করে দিলেন না। তিনি কাউকে কিছু বলেননি। এর ফলে, এখন বগা ছাড়া তাপসী বেরোতে পারে না, সে গাড়ি চালাতে জানে না। আর তার কেনাকাটা যথেচ্ছ থাকল না। বগার বাবা বোধহয় এটুকুই সামলাতে চেয়েছিলেন – একা গাড়ি নিয়ে ঘোরা আর এমনকী একদিনে, সত্যি একদিনেই, ৪০ হাজার টাকার জিনিস কেনা।

সবকিছু বুঝে নেওয়ার ঝোঁক থাকলে, এরকম করে সাজানো যায় – তাপসী হঠাৎ করে যেন গাড্ডায়  পড়ল। এমন কারণে নয় যে, সে যা ভেবে বিয়ে করেছিল তা ভুল প্রমাণ হলো। এটা তো আর ভুল নয় যে, সে-ই একমাত্র উত্তরাধিকারীর স্ত্রী। গাড্ডায় পড়লে মানুষ তো অনেক রকমের অপ্রস্ত্তত হয় – আরে, এখানে যে গাড্ডা আছে তা জানি না, বা তার আন্দাজ পেলাম না, শরীরের অদ্ভুত অচেনা সব জায়গা ছড়ে গেল, ব্যথা হলো – হাঁটুর তলার হাড়টা যদি ছড়ে যায় তাহলে  ডান কানের পেছনটা চেপ্টে গিয়ে লাল হয়ে যাবে কেন? ওদের বিয়ের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তির আগেই বগা-তাপসীর সম্পর্ক বদলে গেছে। এখন, এই ১৯ জুন যে কথাবার্তা, তাকে বলা যায় ওদের সম্পর্কের হার্ডডিস্ক। ওরা এই রকম কথা বলতে বলতে বাড়ি ফিরবে, ফিরেও এই কথাগুলি বলবে। এ-রকম করে ভাবলে খুব সহজ করে নেওয়া হবে যে গাড়ি-টাকা এসবে তাপসীর মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। এরকম ভাবলেও সহজ করে নেওয়া হবে যে, বগার বাবা যে এরকম একটা প্রভুত্ব খাটাতে পারেন, তার জন্য সে প্রস্ত্তত ছিল না। এমনও তো হতে পারে, সে নিজেকে নিয়ে অপ্রস্ত্তত হচ্ছে।

হরিশ মুখার্জি রোড থেকে কালীঘাট রোডের দিকে বেঁকে প্রথম ডানদিকের গলিতে সেই তান্ত্রিক থাকেন। সে-গলির শেষ অংশ থেকে বৃষ্টির জমা জল সম্পূর্ণ সরেনি।

তান্ত্রিক বগাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওঁর সম্পত্তিলাভে রিষ্টি আছে। উনি সেটা দূর করতে চান। স্ত্রীর একার নামেও সে-পূজা হতে পারে কিন্তু স্বামী-স্ত্রী একত্রে করলে সিদ্ধি দ্রুত হয়।’ বগা এসব পরিস্থিতি ঠিক সামাল দিতে পারে না – সে ঠাকুর-দেবতাকে বিশ্বাসই করে, তবে, তান্ত্রিক-পুরোহিত এসবে একটু ভয়ই পায়।

বগা তোতলিয়ে কিছু অর্থহীন শব্দ অস্পষ্টস্বরে বলে, ‘সে আপনি জানেন। যা খারাপ তো। পুজো তো -’

বগার বোঝাবুঝির এই অস্পষ্টতাই তাপসী ধরে ফেলেছে। সে বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠাকুরমশায়, ও রাজি না থাকলে কী আর সঙ্গে করে নিয়ে আসে? ও কিছু করতে পারবে না, যা করার আমিই করব। তবে ওই স্বামী-স্ত্রী মিলেই করবেন -।’

তান্ত্রিক বললেন, ‘আমি একটা মন্ত্র লিখে কবচ তৈরি করে দিচ্ছি। এইটি আপনার মায়ের বালিশের তলায় রাখবেন উনি যাতে ফেলে না দেন, সেটা খেয়াল করবেন। আর, আপনার মায়ের কয়েক টুকরো কাটা নখ আর একগুছি চুল নিয়ে আপনারা আমার কাছে আসবেন – বালিশের তলায় কবচ নিয়ে ওঁর পরপর তিনরাত্রি ঘুমানোর পর। পরপর তিনরাত্রি। ছেদ থাকলে ফল হবে না।’

১৭ জুন মঙ্গলবার বৃষ্টি ধরতেই খটখটে রোদে এসব ঘটে যেতে লাগল ২১ জুন শনিবার পর্যন্ত। ২১ জুনের কেষ্টপুর খালের খবরটা জানাজানি হলো অবিশ্যি ওই ২৪ জুন সকালে। শনি-রবি কাগজ ও চ্যানেলগুলিতে স্কেলিটন স্টাফ থাকে, তাই সাধারণত রবি-সোমে কোনো বড় ঘটনা ঘটে না। উলটোডাঙা খালে নিমাই ঢালির ডুবে যাওয়া, মরে যাওয়া ঐ দুদিনে বেশ পাকিয়ে উঠতে পেরেছিল।

চন্দ্র সাঁতরা আর নিমাই ঢালি মোটামুটি একই জায়গার লোক – ঐ দক্ষিণদাঁড়ি – গোলাঘাটা। পুরনো লোকও হতে পারে, পুরনো জায়গায় আসা নতুন লোকও হতে পারে। তবে ঐদিকে যে সারি-সারি ফ্ল্যাটবাড়িতে পুরনো জায়গা ‘নিউ’ হয়ে যাচ্ছে, ওরা কেউই সেখানকার লোক নয়। চন্দ্র সাঁতরার ব্যবসা আছে – সাপ্লাইয়ের, ঐ কোথাও সাইকেল-ভ্যানে একশ ইট, কোথাও দশ স্কোয়ার ফিট ঢালাইয়ের জন্য পুরনো শাটারিঙের কাঠ, কোথাও রাতে চুরি হয়ে যাওয়া আট ফুট পাইপ – মানে দেয়াল থেকে কেটে তুলে নিয়ে গেছে, কোথাও চারতলায় জানলার কাচ, কোথাও খোলা নালার ওপর একটা ঢালাই পাথর ফেলে কালভার্ট করে দেওয়া।

নিমাই ঢালির সঙ্গে চন্দ্র সাঁতরার চেনাজানা ঐ কাজকর্মেই। চেনাজানা বললেও ঠিক হবে না। চেনা পর্যন্ত বলা যায়, বা চেনার একটু বেশি।

হঠাৎই রাস্তায় দেখা হয়ে গেল, সাঁতরা বলল, ‘এ নিমাই, একটা সিমেন্টের চাঙাড় জোগাড় করতে পারবি?’

নিমাই বলল, ‘মাপ কী?’ সাঁতরা একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘ধর দুই বাই দুই।’

নিমাই বলল, একটু ভেবে, ‘দুই বাই একের হয় না?’

সাঁতরা বলল, ‘না, না, আজকাল তো সবারই বাইক, এক ফুটের ওপর দিয়ে বাইক বেরোবে, কী করে?’

নিমাই বলল, ‘বাইক? সিমেন্টের চাঙাড় দিয়ে হবেটা কী?’

‘ঐ যে বিচালি কলের পেছনে জোড়া ফ্ল্যাট উঠেছে না, তাতে তো লোক আসতে শুরু করেছে। ওদের ফেসিং তো দক্ষিণে। সেখান দিয়ে বেরোলে প্রায় মিনিট দশ-বারোর ঘুর হয়। পেছনে ছোট একটা নালা, তার ওপর একটা চাঙাড় ফেলে দিলে ওখান দিয়ে যাতায়াত করতে পারবে।’

নিমাই ঢালিকে আর জিজ্ঞাসা করতে হয় না – সে বুঝে গেছে।

এই এমন বোঝাবুঝি সাঁতরা আর নিমাইয়ের মধ্যে ছিল। নিমাই বলল, ‘ও তো ইট ফেললেই হয়। দুই বাই একে হবে না কেন?’

এই জায়গাটা তো একেবারে হালে টাউন হচ্ছে। নিজের বাড়ি করার জন্য লোকজন খেপে উঠেছে। নইলে এই দমদম খালের পচা জলের ধারে লাখ-লাখ টাকা খরচা করে বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনে কেউ। ফ্ল্যাটের দর বাড়ছে যেন খালের জল বুড়বুড়ি কাটছে। ষাট-সত্তর লাখ তো কথার কথা, মুখ থেকে খসার আগে বুকিং হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ফ্ল্যাট কেনার পর তো থাকা শুরু হয়, কেউ তো আর থেকে দেখে ফ্ল্যাট কেনে না। থাকতে এসে দেখে মাথার ওপরের তলায় বাথরুমের কমোডের জল সুয়ারেজ পাইপ দিয়ে গলে না, নিচের তলার কমোডে যে বসে আছে, তার মাথার ওপর টপটপ করে পড়ে। তখন ছাতি খুলে কমোডে বসতে হয়। প্রমোটারকে তখন কোথায় পাওয়া যাবে? পাওয়া হয়তো যাবে কিন্তু কোষ্ট আটকে থাকা যায় না কি? সে যখন প্রমোটার মেরামত করবে, তখন ছাতি বন্ধ হবে।

বা, জানলার ছিটকিনি, ফুটোর মধ্যে পুরোটা ঢোকে না। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে একটা বাতাসের ধাক্কা এলো – ব্যস, ঘরের ভিতর ঝড় বয়ে গেল। কোনো মিস্তিরি কি পাওয়া যায়।

চন্দ্র সাঁতরা আর নিমাই ঢালি এই সার্ভিসটা দেয়। ফ্ল্যাটের দখল পাওয়ার পর যেসব তুচ্ছের চাইতেও তুচ্ছ ঘটনা রোজকার খাওয়া-বসা পর্যন্ত অসম্ভব করে তোলে, সেগুলো সার্ভিস দেওয়ার আসল লোকদের কাছে যাওয়ার আগে এক্কেবারে তাপ্পি-মারার সার্ভিসটুকু এরা দিয়ে দিতে পারে। চন্দ্র সাঁতরাই এসব সবচেয়ে আগে জানতে পারে, এক্ষুণি সে একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারে। সেজন্য ঘেঁটে শেখা প্লাম্বার, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, ছুতোর, পাইপ মিস্ত্রি, জমাদার – এমন সব রকমের লোক সে হাতের নাগালে রাখে। লোকজনের হাত আজকাল দরাজ। অফিস বা কাজ থেকে ফিরে যদি দেখে জানলার ভাঙা কাচ লেগে গেছে, তাহলে খুশি হয়ে বেশি টাকাই দেয়। চন্দ্রও খোলা হাতেই তার কাজের লোকদের দেয়। নিমাই ঢালি চন্দ্র সাঁতরার ঘেঁটেশেখা চোর। এতটাই নিরীহ যে নিমাইকে চোর বললে চোররা আপত্তি করতে পারে।

চন্দ্র সাঁতরার সঙ্গে নিমাই ঢালির এমন হিসেব-নিকেশ, খোঁজখাঁজ, মাপজোখ, গছানো-গাছানো চলে। সাঁতরা মুখ ফসকেও বলবে না – তোর কাছে দুই বাই এক স্ল্যাব থাকতেই পারে না। এমন কথা শেষ হয় হয়তো নিমাইয়েরই পরামর্শে, ‘সব দিকই তো দেখতে হবে। এখন সিঙ্গল পাটা ফেলে দি। কয়েক মাস পর না হয় আর-এক পাটা ফেলে দেওয়া যাবে।’

‘তো দে। তাই দে। চিনলি তো?’

দু-এক রাতের মধ্যেই নিমাই ঢালি অলিগলিপথে কাছাকাছি ‘সাঁতরা’ (সাতারা হাইটস) ফ্ল্যাটবাড়ির পেছনের গেটে ঢোকার দুটো স্ল্যাব থেকে একটা স্ল্যাব মাথায় করে এনে চন্দ্র সাঁতরার নির্ধারিত জায়গায় ফেলে দিলো।

সব দিকই দেখা হলো – ওদের একটা স্ল্যাব থাকল, এদেরও একটা হলো। চন্দ্র সাঁতরা খবরও নিল না।

একদিন নিমাই, চন্দ্র সাঁতরার বাড়িতে গিয়ে বলল, ‘ঐ স্ল্যাবের টাকাটা -’।

তবে ঐ পর্যন্তই, যে-পর্যন্ত গেলে চুরি হয় না সেই পর্যন্তই যায় নিমাই, নিজের গা-গতরে যতদূর পর্যন্ত যাওয়া যায়। সে কখনো যন্ত্র ধরে না, পাইপ-কাটার বা কাচকাটার। r (চলবে)