সেবার যখন মৌসুমি বায়ু এসেছিল

দেবেশ রায়

সামান্য অপ্রাসঙ্গিক

[এক-একটা লেখার সঙ্গে লেখকের এক-এক রকম সম্পর্ক তৈরি হয়। কখনো একটি বড় লেখা শুরু হওয়ার আগে দশ-বিশ বছর ধরে লেখকের সঙ্গে থেকে যায়, খায়দায়, ঘুমোয়, ঘোরেফেরে, ভুলে থাকে, চলে যায়, ফিরে আসে। তারপর কোনো একসময় আসে যখন গল্পটাকে নিজের ভিতর থেকে বের করে না-দিলে নিস্তার জোটে না। তখন শাদা কাগজ কালো হতে শুরু করে, চলল বছর দু-চার। গল্পটার সঙ্গে আর সম্পর্ক

থাকে না। দশ-বিশ বছর ধরে যে আমার ভিতরের সব কিছুতে আমার শরীরের রসায়নের মতোই স্রোতপ্রোত ছিল, তা তার মনেও পড়ে না। এক জন্ম কাটে গল্পটাকে আপন করতে। এক জন্ম কাটে গল্পটাকে পর করতে।

আবার এক-একটা লেখা, লেখা হয়ে গেল কী না তা বুঝেই উঠতে পারি না। দু-চার বছর পর হঠাৎ একদিন দেখে, এত অচেনা ঠেকে যে মনে হয়, এ আর আমার নেই। আমার এমনও হয়েছে – বছর পাঁচ কেটে গেলে বুঝেছি আমি কী লিখছিলাম, গল্প না উপন্যাস। একটা গল্প তো গল্প হয়ে উঠতে উঠতেই তার আকার পায়। লেখক তাকে আকার দেয় না। লেখক উপন্যাস লিখতে চাইলেও গল্পটা হয়তো কিছুতেই উপন্যাস হলো না। লেখক একটা ছোটগল্প লিখতে চাইলেও গল্পটা হয়তো উপন্যাসই হয়ে গেছে।

কথাটা তোলার কারণ : এই লেখাটি। প্রায় বছর দশ-বারো তো বটেই, এই লেখাটির টুকরো-টুকরা নানা চেহারায়, নানা নামে ছড়িয়ে-ছিটিয়েই ছিল। সেই টুকরোগুলির সঙ্গে এই সম্পূর্ণ লেখাটির কোনো সম্পর্কই নেই। নামে ও স্বভাবে এটা আলাদা একটি সম্পূর্ণ লেখা। তবু কোনো পাঠক দু-একটি ঘটনা, বা এমনকি, দু-একটি বাক্যও, আগে আমার কোনো লেখায় যেন পড়েছেন এমন অস্বস্তিতে ভুগতে পারেন। তাঁদের ভোগান্তি যাতে না বাড়ে সেজন্য এটুকু বলে রাখলাম।

এই লেখাটি আর ছড়াবে না। আর বাড়বে না। আর আমার সঙ্গে লেপ্টে থাকবে না। লেখাটি আমার পর হয়ে গেল।]

 

\ এক \

সেবার মৌসুমি বায়ু বাংলায় ঢুকল হাসিনীর ভূকম্পনতুল্য অর্গ্যাজম ঘটিয়ে। হাসিনী তখন তার ঘরের খাট আর দেয়ালের মাঝখানের মেঝেটুকুতে দাঁড়িয়ে, মেঝে থেকে খাড়া ছ-ফুটি জানলার সামনে। বাইরে বৃষ্টিবাদলের নিঃশব্দ জালের দিকে তাকিয়েছিল কী না, মনে সেই। তাকাতে তো পারেই। তাকানোটা তো স্বাভাবিকও। নইলে সে ঠিক ওই জায়গাটুকুতেই দাঁড়াবে কেন, যেন দাঁড়ানোটা তার রতিশয়ন? হাসিনীর পাঁচ-আট শরীরে কি রতি এসে গিয়েছিল সেই মুহূর্তেই? তার মাথার ওপরে ধ্বনিলোড়হীন, দৃশ্যহীন, বিদ্যুৎহীন

এক দূর বজ্রপাতে?

তেমনই অবিশ্যি ঠিক ছিল – ১৪ জুন, শনিবার, সকাল-দুপুরে, ওই দু-হাজার কিছু সালে। ঘড়ির সময়টা ঠিক ছিল না। কোন বাতাস কোথা দিয়ে কী করে কোন দেশের আকাশে ঢুকবে তা কি ঘড়ি মেপে বলা যায়? শেষ পর্যন্ত সময়টা বেজেছিল সকাল ১১টা ২৩ মিনিট। না, হাসিনীর অর্গ্যাজমের নয়, যদিও তার অর্গ্যাজম ঐ সময়েই ঘটেছিল, ওই ১৪ জুন, শনিবার, সকালে। মৌসুমি বায়ুর আসার তারিখ সময় ঠিকই ছিল। হাসিনীর অর্গ্যাজমের নয়।

 

শনিবার, ঐ ১৪ জুন, ঐ শেষ সকালে – যাঁরা  সময় রেকর্ড করেন তাঁরা পরে মিডিয়ায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, ১১টা ২৩ মিনিট – রোদ যেন গড়িয়ে যাওয়ার পথ পেয়ে গেছে –  কলকাতার রাস্তায় বৃষ্টিজমা জল যেমন পেয়ে যায়। আকাশটা শুকনো ও ভেজা হয়ে উঠছিল। তারপর, সেই পাঁশুটে আকাশ অদৃশ্য বৃষ্টিকণার ওপরে  অদৃশ্যতায় চলে গেল। আর, অদৃশ্য বৃষ্টিকণারাজি ঘিরে ধরল এক-একজন মানুষকে। সেই অনচ্ছ, জলতরল, ঘেরাটোপ কলকাতার ছাদে-অলিন্দে ঘরে-পথে যতই নামছি ততই রঙিন হচ্ছিল। কলকাতার রঙ বৃষ্টিতে দেখা যায় যেন, সারা কলকাতাজুড়ে আকাশপ্রদীপ পাতালে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

না, এতটা আর হাসিনী ঘরে-দাঁড়িয়ে দেখবে কী করে? দৃশ্যের অন্তর্গত না হয়ে এ-দৃশ্য দেখা যায় না।

তবে, তার জানলাগুলো  অত বড় ও ফাঁকা বলে বেশ লম্বা একটা চিলতে হাসিনীর চোখের আওতায় ছিল এমন, যে, সে দেখে ফেলতে পারেও-বা ঠিক তখনই তার মাথার অদৃশ্য কোনো    অভ্যন্তর থেকে গমগমিয়ে তার অর্গ্যাজম ঘটে যেতে শুরু করে।

রতিক্রিয়ার জন্য তৈরি হয়ে ওঠার সময়-অসময়, দিনক্ষণ নেই হাসিনীর শরীরের। একেবারে পুরোপুরি রতি নিষ্পত্তি ছাড়া সেই তৈরি হয়ে ওঠার কোনও বিকল্প মীমাংসা নেই – তার অর্গ্যাজম ঘটতেই হবে, আর তা ঘটতে হবে শরীরময়। পিঠে, শিরদাঁড়ার খাত ভিজে উঠবে, বুকের মাঝখানের খাত ভিজে উঠবে, চোখের তারা বড় হয়ে উঠবে, দুই ভুরুর ওপর বিন্দু-বিন্দু ঘাম ফুটে উঠবে, স্তনের বোঁটা শক্ত হয়ে যাবে, শরীরের ভিতরের তরলে ক্ষরণ-আলোড়ন টের পাওয়া যাবে। শরীর তার সবটুকু প্রস্ত্ততি নিঃশেষ করতে পারলে আপাতত একটা নিরসন ঘটে। তবে সেই নিরসন কতটা বা কতটুকু সময়ের জন্য তার কোনও ঠিক নেই, আন্দাজও নেই।

হাসিনীর শরীরের এই তৈরি হয়ে ওঠার সঙ্গে ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনও সম্পর্ক নেই। শরীরের চমকে ওঠা, ঘাম দেওয়া, শিহর লাগা, কুঁচকে যাওয়ার সঙ্গে যেমন ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনও যোগ নেই। শরীরের রতি-চাওয়ার এই প্রক্রিয়ার কোনও কার্যকারণ নেই। এখন না-হয় হাসিনীর তেইশ বছর বয়সে হওয়া ছেলেরই বয়স তেইশ ও ছাবিবশ বছর বয়সে হওয়া মেয়ের বয়স কুড়ি, তাদেরই ছেলেপিলে হওয়ার সময় চলছে, সেই কারণে তো হাসিনীর নিজের শরীরের সঙ্গে বোঝাবুঝির ইতিহাস-ভূগোল বাতিল হয়ে যায়নি। বিয়ের আগে হাসিনী নিজের শরীরের জেগে ওঠা নিয়ে মনে করত বিয়ে হলেই সব মিটে যাবে। কিন্তু বিয়ের পর এই প্রায় বছর তিরিশের দাম্পত্যে হাসিনী নির্ভুল বুঝে আছে যে, বিয়ের ফলে নিয়মিত সঙ্গমের সুযোগ তার রতিজোয়ার বয়ে যাওয়ার খাত নয়।

হাসিনী তার শরীরের রতিপ্রস্ত্ততি জীবনভর জেনেচিনে ফেলেছে, তার  অনন্যোপায়তাও বুঝে গেছে বয়স-বাড়া হাড়েমজ্জায়, কিন্তু একদিন তো ছিল, যখন হাসিনীকে ভূতগ্রস্ত হতে হতো এই শরীর নিয়ে, আর নিজেকে অস্বাভাবিক ভাবতে হতো, অথচ তেমন ভাবতে ভয়ও করত, তখন রতিক্রিয়ার জন্য প্রথাগত গোপনতা ভাঙতে হাসিনীর নিজেকে অপরাধীই লাগত অথচ তার শরীরের কোনও সীমাই ছিল না যা ভেঙে অপরাধ করা যায়।

হাসিনী তখন ভেবেওছে, বিশ্বাসও করেছে, নিজেকে প্রকৃতিস্থ একটি মেয়ে স্বীকার করার জন্য তাকে তেমন ভাবতে ও বিশ্বাস করতে হয়েছে যে, ছাপার হরফে তার শরীরের ব্যাখ্যা কোথাও না কোথাও আছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান এত কিছু জেনে ফেলেছে আর হাসিনীর শরীর জানেনি, এ কখনো হতে পারে? হাসিনী চিন্তাভাবনায় ইংরেজিনির্ভর ও ইংরেজিবিশ্বাসী। তাদের বাড়িঘরে মা, মায়ের মা,  কাকাজ্যেঠা, তাদের ছেলেমেয়েরা থাকায় সে অভ্যেসে বাঙালি। তার নিজের বাঙালি শরীরের এমন বেখাপ্পা এক স্বভাব নিশ্চয়ই সাহেবরা জেনে রেখেছে। বা, বাঙালি মেয়েদের গড় মাপজোখের তুলনায় তার পাঁচ-আট মাথা, ছড়ানো মুখ, একটু খাড়া হনু ও ছোট-ছোট চোখ হয়তো ভিতরে-ভিতরে ততো, বা একেবারেই, বাঙালি নয় – এটাও সাহেবরা নিশ্চয়ই মেপে রেখেছে। সে এক বর্বরতা ও আদিমতার কল্পনার সঙ্গে জুড়তে চাইছিল, তার শরীরের রতিপ্রস্ত্ততির অন্যোন্যতা। তার শরীর এত লম্বা-চওড়া, তার চারদিকের সব মেয়ের চাইতে এত আলাদা, বাড়িতে-স্কুলে-কলেজে এ-কথা তাকে এতবার শুনতে হতো যে নিজেকে তার আধুনিক মনে হতো না, আদিমতা ও বর্বরতার সঙ্গে রতির জন্য সদাপ্রস্ত্তত শরীরের কল্পনা জড়িয়ে গেছে। আধুনিক শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের একটা স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন নিশ্চয় সাহেবরা করেছে। গোপনে, খুঁজে-খুঁজে, বেছে-বেছে, পড়ে-পড়ে হাসিনীকে সেই স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন জানতে হয়েছে ও নিজের শরীর মেপে-মেপে নিজে তার চিনতে হয়েছে। যেমন করে প্রত্নতাত্ত্বিকরা খুঁড়ে-খুঁড়ে খুঁজে-খুঁজে বের করে মাইক্রোস্কোপের নিচে ফেলে পাথরের বয়স জানতে চান। তারও পরে তো হাসিনী নিজের শরীরকে একেবারে আধুনিক বানিয়ে ফেলে। হাসিনী যা পড়েছে তা ভুলে যায় এই জেনে যে, শুধু তার শরীর নয়, কোনো মেয়ের শরীরের কথাই ছাপা-হরফে নেই, সেসবই তো পুরুষের লেখা, তাই সেসব লেখাই পুরুষদের জানা মেয়েশরীরের কথা। মেয়েদের জানা মেয়ে-শরীরের কথা যখন লেখা শুরু হলো, তখনও মেয়েদের শরীর নিয়ে যেসব কথা তৈরি হয়ে আছে, সেগুলো মেনে নিয়েই লেখা হলো। ততদিনে হাসিনী বুঝে ফেলেছে, মেয়েরাও মেয়েদের শরীর জানে না। জানার দরকারই নেই। অন্য কেউ তাকে মেয়ে জানলেই, মেয়ে-হওয়া হলো। যেন, যে দেখছে, চিনছে, ভাবছে তার দেখা-চেনা-ভাবার ওপর নির্ভর করে কে মেয়ে, কে পুরুষ। যোনি ও স্তন থাকলেও সে পুরুষ হতে পারে যদি কেউ তাকে পুরুষ ভাবে, যেমন উলটোভাবে কেউ মেয়ে হতে পারে পুরুষাঙ্গ ও নিস্তনতা সত্ত্বেও।

এরকম সব কথাতে হাসিনী বেশ মজা পেয়েছে, অনেকটা ঠিকও ঠেকেছে, তারপরই ঠেকে গিয়ে পেছিয়ে এসেছে। কে পুরুষ আর কে মেয়ে – এটা তো বইয়ে জানার বিষয় নয়। তাছাড়া, হাসিনী তার শরীরের রতিবেগের রহস্য, পূর্বাভাসহীন রতিপ্রস্ত্ততি ও অর্গ্যাজমের দিকে, ভিতর-বাহিরসহ তার শরীরের ধেয়ে যাওয়া – এসব একসময় পর্যন্ত বুঝতে চাইছিল মেয়ে বলেই।

হাসিনী কী করে তার শরীরের এমন দিনক্ষণহীন রতিপ্রস্ত্ততি সামাল দিত – তা নিয়ে অনেক মজা ও রসের ঘটনা বলা যায়। না বললেও কল্পনা করে নেওয়া যায়। মেয়েদের কামুকতা ও গোপন সঙ্গম নিয়ে কত গল্পই তো ছড়ানো আছে। সেগুলো হাসিনীকে নিয়েও ভেবে নেওয়া যায়। আবার, অসমর্থ পুরুষ নিয়েও তো কত গল্প আছে। হাসিনীর পুরুষদের নিয়ে ও তার স্বামীকে নিয়েও সেসব গল্পে চলে যাওয়া যায়।  তার পুরুষরা এবং অথবা তার স্বামী পাঁঠার অন্ডকোষ সেদ্ধ, শিলাজিৎ গন্ডারের খড়্গচূর্ণ এইসব খেয়ে-খেয়ে কী কী কান্ড করেছে, তাও বলা যায়। সেসব বলার জন্য তো ভাবতে হয় না। মেয়েটিকে তৃপ্ত করেও কিছু বাড়তি থাকছে তো – পুরুষের এ এক অনন্ত আকাঙ্ক্ষা। এখন তো ভায়াগ্রাই বেরিয়ে গেছে। তাতে হাসিনীর সমস্যা মিটবে কী করে।

সে যখন প্রথম গর্ভবতী হয়েছিল, তখন তো ব্যাপার এমন দাঁড়িয়েছিল যেন রতি থেকে গর্ভ হয় না, গর্ভ থেকেই রতি হয়।

হাসিনীর স্ফুরিত শক্ত উদরের ওপর কখনো-বা নিচে, হাসিনীর পুরুষকে তার পেটের বাচ্চাটার সঙ্গে লড়তে হতো। আর পেটের বাচ্চার প্রতিদিনে, প্রতিমাসে বড় হয়ে ওঠা যেন হাসিনীর শরীরের রতিবত্তার চাক্ষুষ প্রমাণ। গোপনতা ভেঙে যাক, রতির। ইচ্ছা-অনিচ্ছা থেকে মুক্তি পাক, রতি। পেটের বাচ্চাও হাসিনীর রতির শরীর হয়ে উঠেছিল।

তার দ্বিতীয় গর্ভে, বছর তিনেক পর, তেমনটা ঘটেনি, বরং কখনো-কখনো শরীর যেন রতি ভুলে থাকত। একটা স্বস্তি পেত  হাসিনী – তার এত বড় শরীরের দোটানায় যেন সে আর পেরে উঠছে না। একটু অস্বস্তিও পেত হাসিনী – তার শরীর যেন তার শরীর থাকছে না। সেসময় দু-একবার যে রতি-ইচ্ছা তৈরি করে শরীরে আসতে চেয়েছে, পারেনি। তার শরীর, ইচ্ছা থেকে রতির জন্য তৈরি হয়ে উঠতে পারেনি। কখনো-বা গুমোট শ্রাবণ রাত্রির শেষ যামের ঝড় উঠবার মতো অতর্কিতে শরীরের ভিতর থেকে রতি ফুঁড়ে উঠে হাসিনীকে আশ্বস্ত করেছে, তার শরীর শরীরেই আছে।

একটি মেয়ের শরীর যদি এতটাই উর্বর হয় যে, তার যখন তখন রতি তৈরি হয় আর তৈরি হতে-না-হতেই তার রতি নিষ্পত্তি চাই – তাহলে তাকে নিয়ে কত ঘটনাই যে ঘটতে পারে, বিশেষ করে কলকাতায়। না, হাসিনীর রতি-ইচ্ছা তো শুধুই শরীরের ব্যাপার। কেউ যদি হোঁচট খায়, তাহলে সে তো হোঁচটই খায়। তার হোঁচট খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে অথচ সে সুযোগ-সুবিধের জন্য হোঁচট-খাওয়াটা পিছিয়ে দিচ্ছে, এমন কী হয়।  হলে হতে পারে আমেরিকায়। বাইসাইকল চালিয়ে থামার ইচ্ছে হলে, একটু হালকা থাকলে আলো-হাওয়া গাড়ির পেছনে বা মাথায় সাইকল বেঁধে কাছাকাছি লেক বা ফরেস্টে গিয়ে ‘সাইক্লিং রোডে’ সাইকেল চালানো।

যারা সেই সাইক্লিং রোড বানিয়েছে, তারা কত নির্ভুল জেনে নিয়েছে সাইক্লিংয়ের মজা। এক সরলরেখার দু-প্রান্তে দু-চাকা নিজেরা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সেই চক্রমান সরলরেখাটির ওপর নিজেকে চাপিয়ে, প্যাডলিংয়ে তৈরি গাড়িটা দিয়ে সরলরেখাটিকে স্বনির্ভর ও ভারবহক্ষম করে তোলা, সেই গাড়ি কমিয়ে বাড়িয়ে সাইকলটাকে শরীরের দুটো পায়ের মতো শরীরের দুটো চাকা  করে তোলা, চালাতে-চালাতে হঠাৎ একটা চাকা বেয়ে নেমে যাওয়া, আবার উলটো চড়াই বেয়ে ওঠা, কখনো একটা নালির মতো গর্তের মাঝখানের দু-আঙুল আল বেয়ে যাওয়া। পাহাড়ি নদীর মতো ঘন ঘন ঘন বাঁকে বেঁকে বেঁকে বেঁকে যাওয়া। তবু এসবই তো ওরা জেনেবুঝে রাস্তা বানিয়েছে, নিজে চালাতে চালাতে তো জানা যায়।

হাসিনীর শরীরের ব্যাপারটা তো এমন নয় যে, তার একটি বিশেষ লোককে দেখে তার সঙ্গে সঙ্গমের ইচ্ছে হয়েছে বা তার বিয়ে না হওয়া সত্ত্বেও সঙ্গমের বাঁধা লোক ও জায়গা আছে। তেমন তো যে-কারোরই হতে পারে বা থাকতে পারে।

হাসিনীর বিপদটা হলো – তার শরীরে যদি রতি জেগে ওঠে ও সে যদি তখন ট্রামে বসে থাকে, তাহলে সে তার হাতের কাছের পুরুষযাত্রীটিকে নিজের ওপর টেনে নিতে পারে। বা, ট্যাক্সিতে একা যাচ্ছে। বা, মেট্রো রেলের চলমান সিঁড়িতে। বা, দুই স্টেশনের মাঝখানে। বা, হাতিবাগানের রবিবারের বাজারে। বা, বরিশার সাবর্ণ চৌধুরীদের দ্বাদশ শিবমন্দিরে। বা, টাটা হাউসের লিফটের  লাইনে। আরও মজার ও অসম্ভব সব জায়গাও ভাবা যায়। কুইন্স রোড আর ক্যাথিড্রাল রোডের ট্রাফিক পুলিশের প্লাটফর্মের ওপরে। প্ল্যানেটোরিয়ামের চওড়া দেয়ালের ওপর…। ভেবেই যাওয়া যায়। পুরনো কবরখানা, বা মন্দির-টন্দির চলবে না। এসব তো জানা জায়গা। এসব জায়গায় যেতে হলে তো অ্যাপয়েন্টমেন্ট দরকার। হাসিনীর রতিজাগরণ ও অর্গ্যাজম ঘটা কোনও সম্ভোগের গোপন কর্মসূচি নয়। একেবারেই সূচি নয়। একেবারেই নয়।

এ এক অদ্ভুত দায়। মানুষকে তার প্রাগৈতিহাসে বাঁচতে হবে কেন। এবারের, এই ২০…, বিশ শ…, সালের  বর্ষাঋতু শুরু হওয়ার ঘটনার সঙ্গে হাসিনীর রতিবতী শরীরের আকৈশোর ইতিহাস জানতে হবে কেন।

বৃষ্টি তো হচ্ছিলই বেশ কদিন ধরে, ঝড়ো আচমকা হাওয়ার সঙ্গে। কোনওদিন হাওয়া-রোদ আকাশ ঢেকে বইত। কোনওদিন আচমকা উঠে ধেয়ে যেত। ১১ আর ১২ জুন, বুধ আর বৃহস্পতিতে বর্ষার তো আর কিছু বাকি ছিল না। দিনের বেলাতেও মাঝে-মাঝে অন্ধকার ঘনিয়েছে ও বিদ্যুৎ একেবারে মধ্য-আকাশকে ফেঁড়ে দিয়েছে। হাসিনীদের ঘরের জানলাগুলো সেকেলে, একেবারে মেঝে থেকে সিধে ছ-ফুট উঠে গেছে। শীতে রোদ পোহানো যায়। সে জানলাগুলো তো ঐ দুদিন বন্ধই রাখতে হলো – নইলে বৃষ্টির ছাঁটে মেঝে ভিজে যায় ও হাওয়া ঢুকে যায় ভিতরের ঘরগুলিতেও। হাসিনী কাগজে পড়েছে – এ নাকি বর্ষা নয়। মজাও করেছে হাসিনী  – বর্ষা কি একটা তারিখ না পুজো? বৃষ্টির চোটে ঘরের বার হওয়া যাচ্ছে না, তবু বর্ষা নয়। আবার, হাসিনীর মজাও লেগেছিল বেশি রাতের খবরে, যখন অ্যানিমেশনে বে অফ বেঙ্গলের ওপরের ঘনীভূত নিম্নচাপ তারিখ-মেপে গুটি-গুটি এগোচ্ছিল পারের দিকে। সত্যি, যা হয়েছে না! বাতাস, মানে হাওয়া, যা দেখে যায় না – তারও অ্যানিমেশন, টিভিতে। ১৩ জুন শুক্রবার একেবারে চিটপিট-ধরানো রোদে এত ভ্যাপসা বাড়ল, বৃষ্টি যেন কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বহুদিন আগের ঘটনা হয়ে গেল। ঐ, শুক্রবার, ১৩ জুন। বর্ষার সঙ্গে হাসিনীর এমন কিছু কাজকর্মের সম্পর্ক নয় যে, সে একেবারে দিন-তারিখ মনে করে রাখবে, কবে কতটা বৃষ্টি হয়েছে। তবে ১৩ তারিখটা মনে থেকে গেছে, ঐ শুক্রবার তার দিদির একটা ইকো-কার্ডিওগ্রাম হওয়ার অ্যাপয়েন্টমেন্ট – ইকোতেই, নেহরু মিউজিয়ামের উলটোফুটে। হাসিনীর সেখানে থাকার কথা। কিন্তু ১২ তারিখ রাতেও যা বৃষ্টি, তাতে দিদিকে সে ফোন করে রাখল, এর মধ্যেই নাকি সুবোধ মল্লিকের বাড়ির সামনে এত জল জমেছে যে, আজ রাতভর বৃষ্টি হলে নিচু একতলায় ঢুকে যাবে জল। তাহলে হাসিনী বেরুবে কী করে?

হাসিনীর দিদির বাড়ি ভবানীপুরে, রমেশ মিত্র রোডে। সেখান থেকে ইকোতে পৌঁছানো কোনো সমস্যা নয়, কোথাও জল জমে না। তবে হাসিনী না এলে দিদির ভয়-ভয় করবে। তাকে যদি ছবিতে হার্ট খারাপ দেখায়।

১৩ জুন, শুক্রবার, রোড ওঠায় হাসিনী যেতে পেরেছিল। ভেবেছিল মিনিতে গিয়ে ট্যাক্সিতে ফিরবে – ফেরার সময় রোজ চড়বে। কিন্তু মিনিগুলিরও হিসাব মেলেনি, তারা তখনো রুটে আসেনি, তাই হাসিনীকে যাওয়ার সময়ও ট্যাক্সি নিতে হলো – ট্যাক্সির রেট যা হয়েছে, তার  তাল রাখা অসম্ভব, তার পর, সেদিন এক  কাগজে বেশ বড় করে লিখেছে – কী কী উপায়ে মিটার রিডিং বাড়ানো যায় ও বাড়ানো হয়। আর, তা ধরতে হয়, কী করে। ট্যাক্সিচড়া যেন পলিক্লিনিকে স্পেশালিস্ট দেখাতে লাইন দিয়ে বসে দেয়ালের বড় বড় রঙিন পোস্টার পড়া – আপনার বয়স কি চল্লিশ পেরিয়েছে তাহলে…। আপনার কি সিঁড়ি ভাঙতে হাঁপ করে, তাহলে…। আপনার… পড়ে সব অসুখের  লক্ষণের সঙ্গে নিজের শরীর মেলানো।

শনিবার, ১৪ জুন, সকালে রোদটা একটু আবছা ছিল, খুব ধীরে ধীরে মুছেও যাচ্ছিল রোদ। সেটা বোঝা যাচ্ছিল ঘরের আলো কমে যাওয়ায়, ঐ মেঝে থেকে খাড়া ছ-ফুটি জানলা দুটো খোলা থাকা সত্ত্বেও। তারপর, প্রায় বোঝাই যায়নি, কখন থেকে সেই নিরালো এক ঝাপসা জলকণায় ছেয়ে যাচ্ছে।

হাসিনী দাঁড়িয়েছিল, তাদের শোয়ার খাট ও ঘরের দেয়ালের মাঝখানের শূন্যতায়। সে খোলা জানলা দিয়ে তাকায়নি। তার দৃষ্টির ও দৃষ্টিপাতের বাইরে সেই আকাশে, একেবারে তার মাথার ওপর থেকে এক গূঢ়, গাঢ় অন্ধকার বজ্রপাত নেমে আসতে লাগল ক্রমেই এমন বেগে, যেন সেই আকাশ অনন্ত দূরে নয়। অপ্রস্ত্তত হাসিনী টের পায় সেই দীর্ঘ বজ্র-গর্জনে তার শিরদাঁড়া, স্তনখাত ও দুই ভুরু ভিজে উঠছে, তার শরীরের ভেতরের তরলের গতিতে পেশি ঝরে যাচ্ছে – পাড়ে ভেঙে গিয়ে ঢেউ সমুদ্রে ফিরে যাওয়ার পর ভেজা বালি যেমন গতি পায়।

সে-ই সময়ই সে-বছরের মৌসুমি বাতাস পশ্চিমবঙ্গে ঢুকল।

দু-হাজার… খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন সোমবার সারাদিন ধরে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হচ্ছিল – তেমন বৃষ্টি যার আওয়াজ নেই কিন্তু ভিজিয়ে দেয়। বেলা দুটো-আড়াইটের পর থেকে ভেজানো বৃষ্টিও ছিল না, ভেজা বাতাসও ছিল না। সন্ধের মুখে আকাশ ক্রমেই নীল হয়ে উঠছিল। আকাশে মেঘের গমনাগমন ঘটছিল – ভরা বর্ষায় যেমনটি ঘটে না। ঘরের ভিতরের গরম লাগতে শুরু করে। রাতে সব জানলা খুলে দিতে হবে। ২৩ জুন সোমবারটাকে ধরলে গোনা যায় শনিবার থেকেই রোদবৃষ্টি ও গরমঠান্ডা এমন হতে শুরু করেছে। এই ২৩ জুনই সকাল ৫টা নাগাদ ঝড়ের বেগে বাতাস উঠেছিল, খোলা দরজা-জানলার কপাট আছড়ে পড়ছিল ও কিছু কিছু শার্সি নানা উচ্চতা থেকে ভেঙে পড়ার বিষম আওয়াজ উঠছিল। সে আওয়াজগুলি হাওয়ার আঘাত ও জলসাপটার সঙ্গে মিলছিল না। ঠিক ১০ দিন আগে ১৪ জুন বেলা ১১টা ২৩ মিনিটে মৌসুমি বাতাস পশ্চিমবঙ্গে ঢোকে।

তার আগের একদিন, ১৩ জুন, বাদ দিলে ১১ ও ১২ জুন, বুধ ও বৃহস্পতিবার মেঘ ঘন হয়ে উঠছিল ও আকাশের যেসব দিক মেঘশূন্য ছিল, সেসব দিকেও মেঘ ছড়িয়ে ও ঢুকে পড়ছিল। এতটাই নিরালো ঘনিয়েছিল যে মেঘের ভিতরে-ভিতরে চমকানো নীরব ছোট-ছোট বিদ্যুৎ বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল – দিনের বেলায় যতটা দেখতে পাওয়ার কথা নয়। এতটা প্রস্ত্ততির পর ঝড় উঠেছিল ও আধঘণ্টারও বেশি ঝড়ের প্রথম ঝাপটার বেগ একইরকম ছিল। তারপর, সেই বেগ ভেঙে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ও বেশ মোটা ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়, এমন বৃষ্টি যা দেখা যায় ও শোনা যায়। এমনকি কোথাও-কোথাও জল জমে ঢাল বেয়ে বেরুতে শুরু করলে নানারকম জলস্রোতের তরলধ্বনিও উঠতে শুরু করে।

১১ ও ১২, বুধ ও বৃহস্পতিবার জুড়ে থেকে-থেকে এমনই ঘটছিল যে, এটা যে বর্ষাই তা নিয়ে আর কোনও দ্বিধাই তৈরি হয়নি। দ্বিধা তৈরি হওয়ার কোনো ফাঁকই ছিল না। বুধবার রাত থেকেই ঐ বৃষ্টিবাদলের মধ্যেই দ্বিধা বা সন্দেহ শুরু হয়ে গেল বা সঠিক বৈজ্ঞানিক তথ্য জানা গেল যে, এ-বৃষ্টি বর্ষার বৃষ্টি নয়, মৌসুমি বাতাস তখনো বঙ্গোপসাগরের মাঝ-বরাবর, সবই সময়মতো ঠিকঠাক চলছে।

এর মধ্যে দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব বা সংশয় বা সিদ্ধান্তের কথা ওঠে না বটে, তবু আজকাল সবকিছু জানারই একটা তথ্যভিত্তিক দরকার হয়ে পড়ছে।

বুধবার রাতের খবরে রঙিন ম্যাপসহ সবাই সচক্ষে দেখতেই পেল মৌসুমি বাতাস তটরেখা থেকে কতদূরে, বৃহস্পতিবারের দৃশ্যে সে-দূরত্ব কমল বটে তবে সে-কথা চোখে দেখে ঠাহর হলো না, যিনি দেখাচ্ছিলেন তিনি চৌখুপি এঁকে-এঁকে লাইন টেনে-টেনে দেখালেন বলে  জানা গেল। বৃহস্পতিবার সকালে সব কাগজেই ওই রঙিন ছবিই ছাপা হলো বটে, তাতে এটাও জানা গেল, আগের দিনের যে-বৃষ্টি ও অন্ধকার পরের দিনেও চলছে ও ভিজিয়ে চুপসে দিচ্ছে, সে-বৃষ্টি এসেছে উত্তর-পশ্চিম থেকে, সুতরাং কালবৈশাখী, এ-বছরের অষ্টম ও সম্ভবত শেষ কালবৈশাখী। কোনো-কোনো কাগজে ম্যাপের রং বৃষ্টিতে ভিজে ও গলে মিশে গিয়েছিল, তাতে আকাশে সমুদ্রের রং লেগে গিয়েছিল আর এখন সব কাগজেরই প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম কলামের মাথায় ৬ x ৪ সেমি মাপেরই যে একটু ছোট্ট নগ্নিকা বিদেশিনী থাকে – তলা থেকে বা মাথা থেকে – তার শরীরটা ঢেকে গিয়েছিল ছোপ-ছোপ রঙে। তাতে এই খবর ঢাকা পড়েনি, খবরও নয় – তথ্য, এই তথ্য ঢাকা পড়েনি যে,  যে-বৃষ্টিতে ভিজছ সেটা সে-বৃষ্টি নয়। তথ্যবিজ্ঞান ব্যাপারটাই আলাদা।

তথ্য যে কত নির্ভুল তা প্রমাণ করতেই যেন ১৩ জুন শুক্রবার একেবারে খটখটে রগরগে জলহীন রোদ উঠল আর সে-রোদ বহাল থাকল ১৪ জুন শনিবারের প্রথম বেলা পর্যন্ত – শুক্রবারের রাতের অন্ধকারেও যেন সে-রোদ মাখানো ছিল। ঐ বেলা ১০টা সাড়ে ১০টা নাগাদ সেই রোদ একটু-একটু করে মুছতে-মুছতে আয়োজনহীন মেঘ আকাশ ঘিরছিল যেন অন্যমনে। ভাইরাস যেমন এক জীবাণু থেকে আরেক জীবাণুতে সপ্রাণ ঢুকে যেতে পারে ও আরো এক জীবাণুর সঙ্গে মিশে যেতে পারে কিন্তু কখনোই নিঃশেষ হয়ে যায় না, প্রাণ, শুধু প্রাণ থেকে প্রাণান্তর ঘটে যেতে থাকে, চক্র নয়, শৃঙ্খল নয়, তরঙ্গ নয়, শুধু প্রাণান্তর, অনন্ত প্রাণান্তর, যে-প্রাণান্তরণে মানুষ মানুষ, সেই প্রাণান্তর।

সেই প্রাণান্তরণে কত মৃত্যু ঘটে যায়, ঘটে যেতে পারে, মানুষের – তবু সেই জীবাণু, সেই ভাইরাস প্রাণ বহন করে চলেই। আর এই প্রাণান্তরণ ক্রিয়ার চিহ্ন থেকে যায় কোনো ব্যাধির সংক্রমণে যে-ব্যাধি চেনাজানা নয়, যে-ব্যাধি রাষ্ট্রসীমা পেরিয়ে যায়, যে-ব্যাধির নিরাময় জানতে-জানতেই ব্যাধিগ্রস্তদের মৃত্যুহার বেড়ে যেতে থাকে। এই পৃথিবীর কতটা-কতটা মাটি জুড়ে প্রাণাণু শুধু মৃত্যু দিয়ে নিজের অস্তি জানাতে থাকে নিঃশব্দ, নিরায়োজন, নিশ্চিত। ১৪ জুন শনিবার শেষ সকালে আকাশে মেঘসঞ্চার ঘটে যাচ্ছিল। তারপর কখন একসময় বৃষ্টি ঝরতে শুরু করে  – এমন বৃষ্টি যা দেখা যায় না। জলকণার এক বিস্তার ঘিরে ধরে, চেপে আসে।

পরে, সন্ধ্যা নাগাদই, আবার সেই রঙিন ম্যাপে তো দেখাই গেল, সেদিনের সকাল ১১টা ২৩ মিনিটে এ-বছরের মৌসুমি বাতাস কী করে পশ্চিম বাংলায় ঢুকল। দেখা গেল, দেখা তো গেলই। আজকাল এমন অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে যে, দেখা না গেলে কেউ খেয়ালই করে না। ১৫ জুন সকালে সব কাগজেও আবার রঙিন ম্যাপ তীরচিহ্ন নিয়ে সমুদ্র ও আকাশসহ ছাপা হলো। তখনও সেই জলকণা-ঘের চলছেই।

সন্ধ্যায় যে দেখা গেল ও পরের সকালে যে পড়া গেল – তাতেও বেশ একটু অাঁচ ছিল। দেখায় ও পড়ায় বিশেষজ্ঞরা একটু প্রয়োজনমাফিক মতপার্থক্য ঘটাতে পেরেছিলেন। কেউ-কেউ বললেন ও লিখলেন – যে-কোনও সৈকত থেকে ১২ মাইল পর্যন্ত সেই রাষ্ট্রের সমুদ্রসীমা, তাহলে তো মৌসুমি বাতাস আগেই পশ্চিমবাংলায়, মানে ভারতে, ঢুকে গেছে, সমুদ্রের ১২ মাইল ভিতরের আকাশে। কেউ-কেউ  বললেন ও লিখলেন – কতরকম সমুদ্রবায়ু কতদিকে দিনরাত বয়ে চলেছে, সমুদ্রগুলির ওপরের আকাশরাশিতে কত নিম্নচাপ তৈরি হচ্ছে, জমাট হচ্ছে, হতে-হতে মিলিয়ে যাচ্ছে, মানুষ জানতেই পারে না, যতক্ষণ সে-বাতাস মাটির আকাশে না আসছে, ততক্ষণ সে-বাতাস এসেছে বলা যায় না। মত যখন ভিসুয়াল হয়ে যায় ও সেই ভিসুয়াল দেখে নিজের মত ঠিক করতে হয় তখন শার্টের রং, কথা বলার ঢং ও কথা পৌঁছে দেওয়ার তাগ এগুলো মতের সক্রিয় অনুপান। যে-মত পড়ে জানতে হয়, কী-কী মত থাকতে পারে – সে-মত নিজের করে নেওয়ার কোনো দায় থাকে না। সবার মতই জানতে হয়।

এখন হিসাবই করা যায়। বুধ-বৃহস্পতি একেবারে টানা ৪৮ ঘণ্টা বৃষ্টিতে কলকাতার খালগুলোতে, পুকুরগুলোতে, আদিগঙ্গায়, নিচু জায়গাগুলোতে, রাস্তাগুলোতে যে-জল জমল তা শুধু শুক্রবারের শুকাতে নেমে যাওয়া সম্ভব হতো হয়তো-বা, যদি শনিবার সকাল ১১টা ২৩-এই মৌসুমি বাতাস এসে না-পড়ত। ঐ বুধ-বৃহস্পতি অষ্টম বা শেষ কালবৈশাখীর মতো অঝোরে না হলেও শনিবার থেকে মৌসুমি জলকণার যে-জাল নেমে আসছেই, নেমে আসছেই, সে-জালও তো জল হয়েই বয়ে যাচ্ছিল কলকাতায় সোমবার তক। সোমবার, মানে ১৬ জুন।

নতুন জলের টানে মরণ থাকে। টানা বৃষ্টির পর হঠাৎ একটা শুকনো দিনে। ১৭ জুন মঙ্গলবার রোদ দিতেই সাত-সকাল থেকে পুকুরগুলিতে নতুন জলের মাছের ঝাঁক ছেঁকে তুলতে ও জলে তলিয়ে যাওয়া কাজকর্মের জিনিসপত্র উদ্ধার করতে যাদের নামার, তারা নেমে পড়ল। মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি এই তিন শুখা-দিনে বৃষ্টিতে লোকজন মরতেই লাগল। সোমবার ঐ ২৩ জুন পর্যন্ত পাঁচজন। সাতজনও হতে পারত – কিন্তু ‘নন্দন’-সিনেমাহলের খাড়া ঢাল পিছলে রাজু আর সন্দীপ মল্লিক দুই ভাইয়ের মধ্যে সন্দীপকে পুকুর থেকে তোলা গিয়েছিল – মেয়েরা যে-ক্যান্টিন চালান, তার এক মেয়ে নিজের পরনের শাড়ি খুলে দড়ির মতো ছুড়ে দিয়েছিল। গোলদিঘি ওরফে কলেজ স্কোয়্যার ওরফে বিদ্যাসাগর উদ্যানে রেলিং টপকে ঝাঁপ দিয়েছিল গুলাব গোয়ালা, বছর তেরো বয়স। সে ঝাঁপ দিতে যাবে কেন, যদি-না তার প্রতিদিনই অমন ঝাঁপ দিয়ে স্নানের অভ্যেস না থাকে। এ নিয়ে বেশ ছবি দেখা গিয়েছিল ও পড়াও গিয়েছিল যে-সে এসে এই সব করপোরেশনের দিঘিগুলিতে স্নান করে যাবে কেন, বিনানুমতিতে জলে নামা নিষিদ্ধ করা হোক, রেলিং উঁচু করা হোক ও গার্ড রাখা হোক-এ রকম মত খুব জোর দিয়ে বলা হচ্ছে। ‘নন্দন’-এর পুকুরে এ সবই ছিল, অথচ রাজু আর সন্দীপ দুজনই যে মরেনি সে তো ক্যান্টিনের ঐ মেয়েটির তৎপরতায়। গুলাব গোয়ালার বডি গোলদিঘি থেকে তোলা হয়েছিল, তাকে মেডিকেল কলেজেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু সে কে, কোথায় থাকত, তার মা-বাবার খবর কী এ – সব আর জানা যায়নি।

সেদিনই বা পরদিনই গঙ্গায় স্নান করতে নেমে রহিত গুনের সংক্ষিপ্ত মৃত্যু। নতুন জলের মরণ এ-রকমই হয় – আচমকা যত্রতত্র ও সংক্ষিপ্ত। সুন্দরবনের বাঘের  হাতের মরণের মতো। কিন্তু সেখানেও তো মারকই, মারতে আসে। নতুন জলে, যে-মরবে সে নিজেই জলে আসে। এতই ছোট্ট মৃত্যু যে সুখের খবরে ও ছাপার খবরে – সে এসে গঙ্গায় ঝাঁপ দেয় ও আর ওঠে না। পরে তার মৃতদেহ ভেসে ওঠে ও এস এস কে এম হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করে হয়। খবরে চেষ্টা ছিল খবর-তৈরির, তবে ঐ ছেলেটি তেমন খবর হয়ে ওঠার কোনও ইশারাই রেখে যায়নি – কেউ কি আর তেমন ইশারা রাখে যে রোজই গঙ্গায় স্নান করে। নিশ্চয়ই তার খোঁজখবরও নেওয়া হয়েছে, পুলিশ পর্যন্ত গিয়েছিল কী না জানা যায়নি। তবে জলে ডুবে মরে গিয়ে ভেসে ওঠায় যাকে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে মৃত বলে ঘোষণা শুনতে হয় – সে ততটা আত্মীয়পরিজনহীন নয় যে নদীর স্রোতে ভেসে চলে যাবে। যত চ্যানেলই হোক আর যত সংস্করণই হোক – আগে থেকে খবর না না পেলে ক্যামেরা বা রিপোর্টাররা যাবেন কী করে, ঝাঁপ দেওয়ারও খবর নেই, ভেসে ওঠারও খবর নেই। ‘নন্দন’-এর পুকুরে সেই দশ বছরের ছেলেটি যে বেঁচে উঠেছিল, নাকি দশ বছরে ছেলেটি ডুবে গিয়েছিল আর তার বারো বছরের দাদাকে বাঁচানো গিয়েছিল? ভাই বা দাদা যেই বাঁচুক, একজন তো বেঁচে গিয়েছিল। তাকেও আর খুঁজে পাওয়া গেল না ডাঙায়।

দু-দিনের টানা বৃষ্টিতে ছোট মাছের ঝাঁক হাতের নাগালে উঠে আসে – এমন বিশদ করে যারা কলকাতার বৃষ্টি ও পুকুর চেনে, তারা পুকুরের জলে ডুবে যেতে পারে বটে, আবার বেঁচে গেলে তারা রাস্তায় বস্তিতে ভিড়ে একেবারে কোনও চিহ্ন না রেখে মিশে যেতেও পারে। যে বেঁচে গেছে, সে তো বেঁচেই আছে – সে তো আর খবর নেই। এমনকি যদি তাকে খুঁজে বের করাও যেত আর সে যদি ক্যামেরায় লম্বা মাইকের সামনে – ‘যখন তুমি ঝুঝলে তুমি ডুবে যাচ্ছ, তখন তোমার মনের অবস্থা কীরকম ছিল’। এমন প্রশ্নের মানে বুঝবার চেষ্টা করত, তাহলেও তো পাঁচ সেকেন্ডের বেশি ছবি পাওয়া যেত না। সে পাঁচ সেকেন্ডের বা পাঁচ সেন্টিমিটারের কোনও গ্রাহক-প্রতিক্রিয়া ঘটত না। যারা খবর  দেখে ও দেখে ফেলে, পড়ে ও জেনে যায়, তারা জানে না যে  দুদিন টানা বৃষ্টিতে ‘নন্দন’-এও ছোট মাছের ঝাঁক ওপরে উঠে আসে। r (চলবে)