সে আমাদের বাংলাদেশ! সে আমাদের বাংলাদেশ?

সনৎকুমার সাহা

বইটি পড়ার কোনো তাগিদ আমার ছিল না। দশ বছর আগেও বাধ্য হয়ে বইমুখো হতে হতো। নেহাত রুটি-রুজির ধান্দায়। তারপর থেকে ছুটি। কিছুই করি না। আলসেমি আমার মজ্জাগত। এখন তো যেন এঁড়ে গরু। যেখানে যেমন পাই, নাক ডুবিয়ে ঘাস খাই। নয়তো বড় কোনো গাছের ছায়ায় বসে লেজ নাড়ি, আর ঝিমুই। অথবা জাবর কাটি। দিনগত পাপক্ষয়। পুণ্যের আশা করি না।
বেশ ছিলাম। কেন যে মেধাবী লেখক আহমাদ মাযহারের মাথায় হঠাৎ দুর্মতি গজাল। আমার বিশেষ স্নেহের দিগন্তর, লেখালেখি তার মুহিত হাসান নামে – বাচ্চা ছেলে, তার হাত দিয়ে অশেষ করুণা করে বইটি আমাকে পড়তে পাঠালেন। আমার বিশ্বাস, একেবারে নিঃশর্ত। অন্তত সেই রকমই আমি ধরে নিই। তাতেই এই বিপাকের শুরু। দুর্বিপাক অবশ্য অন্যদের, যাদের মাথায় এখন কাঁঠাল ভাঙতে বসেছি। আমার অজুহাত, কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙার দায় কুম্ভকর্ণের নয়।
বইটি পেয়ে যে দারুণ খুশি হয়েছি, এ-কথা কিন্তু অস্বীকার করি না। যখন প্রথম প্রকাশ, ২০১২-এর অমর একুশে বইমেলায়, তখনই এর কথা শুনি। আমার স্যার, প্রফেসর মুশাররফ হোসেন একদিন চোখেমুখে আনন্দের হিল্লোল তুলে বললেন, ‘জানো, নজরুল ওর বই আগামী দিনের বাংলাদেশ আমাকে উৎসর্গ করেছে।’ এক মুহূর্ত থমকে ছিলাম। কিন্তু তখনই মাথায় খেলে গেল কোন নজরুল। এঁর কথা আগেও অনেকবার স্যার আমাকে বলেছেন। তাঁর বিবেচনায় এই সময়ে আমাদের এ-অঞ্চলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মেধাবী অর্থনীতিবিদ। মস্কো ও পরে হার্ভার্ডের সর্বোচ্চ মানের বলেই নয়, তাঁর কাজের স্বীকৃতি পৃথিবীজোড়া। বলেছিলেন, ‘দেখো, এর কথা একদিন সবাই বলবে।’
সেদিন স্যারের তাড়া ছিল। বইটি চেয়ে নিয়ে দেখার ফুরসত হয়নি। তারপর তো তাঁর অসুস্থতা ক্রমে বাড়ল। আবার পরে যখন তাঁর কাছে গেছি, বইটির কথা আমার মাথাতেও আসেনি। পরের একুশে ফেব্রুয়ারি পার হওয়ার পরপরই স্যার বিদায় নিলেন। এখন বইটির উৎসর্গ-পাতায় চোখ কিছুক্ষণ আটকে থাকে। বড় ফাঁকা লাগে। তবু আক্ষেপ কিছু কমে, স্যার বইটি হাতে পেয়েছিলেন। আমাকেও এর কথা জানিয়েছিলেন। আমি অবশ্য যথারীতি নিরুদ্যম বসে থাকি। জীবনকে অর্থবহ করার বিদ্যা আমার জানা নেই। তবে একটা কথা এখানে বলে রাখি। এই ডক্টর নজরুল ইসলামকে আমি যে কখনো দেখিনি, তা নয়। গত শতকে আশির দশকের প্রথমভাগে তিনি মস্কো থেকে ফিরে, যদ্দূর মনে পড়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দিয়েছিলেন। স্যারও তখন ওখানে। স্যারের বাসায় তাঁকে দেখেছিলাম। কিছু কথাও হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। তেমন মনে রাখার মতো কিছু নয়।
তবে তাঁদের পারস্পরিক ভালো লাগার, সম্মানের ও আস্থার একটা কারণ বোধহয় ছিল মেধার অভিযানে বিশেষ এক লক্ষ্যে উভয়ের দৃষ্টির সমীকরণ। দৃষ্টির সমীকরণ মানে কিন্তু দুজনের একই উপায় বাতলে দেওয়া নয়। যদিও চোখ তাঁদের পড়ে অনেকটা জুড়ে এক জায়গাতেই, তা হলো, আমাদের গ্রামজীবনের বাস্তবতা। স্যারকে দেখেছি, শরীর যতক্ষণ বশে থেকেছে ততক্ষণ কী করে গ্রামীণ দারিদ্র্যের পাপচক্র থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়, কী করে সম্পদ-সৃজন ও কর্মসংস্থান উৎপাদন-কা-েই সচল ও বহুমুখী করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, এসব নিয়ে বাস্তব তথ্যনিষ্ঠ গবেষণায় নিরলস ব্যস্ত থাকতেন। কোনো আপ্তবাক্যে তাঁর আস্থা ছিল না। সঠিক তথ্য ব্যবহারে তিনি ছিলেন অতিমাত্রায় খুঁতখুঁতে। গোঁজামিল বরদাশ্ত করতেন না এতটুকু। সরেজমিন যাচাই করে এতটুকু গরমিল ধরা পড়লেই আবার নতুন করে শুরু করতেন। তাঁর অসমাপ্ত কাজ হয়তো অনেক আগেই শেষ হতো। কিন্তু এই বুনো জিদ তা হতে দেয় না। যত দিন যায়, গ্রামীণ বাস্তবতাও কিছু-না-কিছু ভোল পালটায়। তার সঙ্গে তাল মেলাতে মেলাতে দিন ফুরোয়। শেষের কাজ তাঁর অসমাপ্তই থেকে যায়। অবশ্য আগের যা কাজ, তা তাঁকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য যথেষ্ট।
আমি যতটুকু বুঝেছি, তিনি গ্রামবাংলার উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় এক মৌলিক পরিবর্তন আনার প্রস্তাব খাড়া করতে চাইছিলেন। ধানের ফলনের জন্যে তিনি নির্দিষ্ট করে আউশ ও আমন মরশুমের ওপর নির্ভর করার জোর দিচ্ছিলেন। বোরো মরশুমে ডাল, গম, তেলবীজ, এসবের ওপর। এতে তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন প্রয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জাতীয় উৎপাদনে যেমন ভারসাম্য আসবে, তেমনি উৎপাদন ব্যয়ে সর্বোত্তম সাশ্রয় ঘটবে, পারিপার্শ্বিক কাজ বাড়বে, মরিয়া হয়ে মানুষের শহরমুখো ছোটা কমবে। শুধু বলা তো নয়, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তাকে যথার্থ বলে প্রতিষ্ঠা করা এবং তাতে যে পরিবেশ-বিপর্যয় কম হবে, তাও দেখানো। হলো না। তাঁর নিষ্ঠা কিন্তু তাঁর মনীষার অহংকারকে অমøান করে রাখল।
এর ভেতরেই ডক্টর নজরুল ইসলামের কাজের পরিধি বিশাল। প্রতিষ্ঠা বিদ্বৎসমাজে, বিশ্বজুড়ে। তবু এই বাংলার গ্রামীণ বাস্তবতা তাঁকেও ভাবায়; এবং এই ভাবনা, আমার অনুমান, তাঁর কাছে স্যারের ব্যক্তিত্বকে আরো স্পষ্ট করে চেনায়। এখানে বুঝি সে-কারণেই তাঁর কৃতজ্ঞ উৎসর্গ।
পাতা ওলটাতেই সূচিপত্র পেরিয়ে চোখ পড়ে বইয়ের মুখবন্ধে। আর-একজন দিকপাল প্রফেসর আনিসুর রহমানের লেখা। আমরা যখন ছাত্র, তখনই শুনি তাঁর নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল রতœ। খ্যাতির প্রসাদ তিনিও কম পাননি। তবে চার কীর্তিমান Ñ প্রফেসর নূরুল ইসলাম, মুশাররফ হোসেন, রেহমান সোবহান ও আনিসুর রহমানের নাম একত্রে কিংবদন্তি হয়ে আছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার রূপকার হিসেবে।
এখানে অপ্রাসঙ্গিক, তবু একটা বিষয়ের উল্লেখ করি। প্রফেসর আনিসুর রহমান ছিলেন বাফার (বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টসের) প্রথম যুগের তালিম নেওয়া রবীন্দ্রসংগীতের সফল গায়ক। ইকবাল বাহার চৌধুরীর লেখায় তাঁর কথা আছে। (কালি ও কলম, ভাদ্র, ১৪২৩)। কোনো জিনিস আধ খেঁচড়া করে ফেলে রাখা প্রফেসর রহমানের স্বভাব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পৃথিবীর সেরা-সেরা অর্থনীতির জার্নালে তাঁর যেসব লেখা পড়ে আমরা মুগ্ধ ও শিহরিত হতাম, সেগুলোয় থাকত নিও-ক্লাসিক্যাল তত্ত্বভূমিতে গাণিতিক পদ্ধতির সর্বোচ্চ মানের নিপুণ প্রয়োগ। তাঁর অর্জন নিয়ে আমরা গর্ববোধ করতাম। অনেক পরে রবীন্দ্রসংগীতের গায়কি নিয়ে কথায় ও অনুভবে মিলিয়ে সুরকাঠামো অক্ষুণœ রেখেও যে স্বাধীনতা নেওয়া যায়, এ-নিয়ে নিজে গেয়ে ও নানা লেখায় তিনি
অতিমনোগ্রাহী করে আপন ভাবনার কথা শুনিয়েছেন। এঁদের উপেক্ষা করা যায় না। অর্থনীতির চর্চায় অবশ্য নিও-ক্লাসিক্যাল ছকের ভেতর তিনি বেশিদিন বাঁধা থাকেননি। শোষণহীন সমাজ গড়ার তত্ত্ব কল্পনা তাঁর মনোযোগ কেড়ে নেয়। সেই মানসভূমি থেকেই তাঁর এই আগামী দিনের বাংলাদেশ পড়া। মুখবন্ধে তাঁর উদগ্রীব আশার উৎফুল্ল প্রকাশ ধরা পড়ে। আমরা এখানে পড়ি : ‘…এদেশের সমাজের কল্যাণ সুবিধাবঞ্চিত জনগণের যৌথ উদ্যোগের পথেই হতে হবে, তা মার্কসীয় বিপ্লবের পথে হোক বা না হোক, এ বক্তব্য অত্যন্ত জোরালোভাবে এসেছে।… বাংলাদেশে এটা কী রূপ নিতে পারে, সে সম্বন্ধে কিছু মূল্যবান ভাবনাচিন্তা নজরুল ইসলামের গ্রন্থে রয়েছে।… ’ বিপুল আগ্রহ নিয়ে আমি বইটি পড়ি এবং হতাশ হই না। সত্যিকারে’র মানবকল্যাণে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিরাসক্ত মন নিয়ে আমাদের চিন্তাবিদ জনগোষ্ঠী যদি এখানে উত্থাপিত বিষয়গুলো নিয়ে ভাবেন, কথা বলেন, তবেই এই প্রকাশনা সার্থক হয়।
বইটিতে কী আছে, পরিচ্ছেদগুলোর ধারাবাহিক শিরোনাম দিয়ে তার একটা ইঙ্গিত দিই : ১. ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’ বনাম অর্থনীতি, ২. পুঁজিবাদের পৌনঃপুনিক সংকট ও বাংলাদেশ, ৩. ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদ ও বাংলাদেশ, ৪. বাংলাদেশে সামাজিক পরিবর্তন ও সামাজিক বিজ্ঞানচর্চা, ৫. ভূমি সংস্কার ও গ্রামের রূপান্তর, ৬. বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা : সমস্যা ও সমাধান, ৭. আগামী দিনের বাংলাদেশ।
আমি কিন্তু এখানে এই বই নিয়ে কোনো আলোচনায় বসিনি। প্রায় পাঁচ বছর আগে এর প্রথম প্রকাশ। ঢাকার ‘প্রথমা প্রকাশন’ থেকে ছাপা। অনুমান করি এতে মেধার যে দীপ্তি, চিন্তার গভীরতা ও আন্তরিক কল্যাণ-এষণা, তা উপযুক্ত সাড়া জাগিয়েছে। তাঁর পড়াশোনার বিস্তারও বিস্ময়কর। ভাষার নির্মাণ-শৃঙ্খলা বিশ্বমানের। এতদিনে বইটি নিয়ে যাঁর যা বলার তা নিশ্চয় বলে ফেলেছেন। অহেতুক পুনরুক্তি বা বাসি কথার বেসাতি মানায় না। আমি তাই এতে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের কথা হাবিজাবি কিছু বলি। তা কোনোক্রমে বইটির মূল্যবিচার হবে না। তেমন করার যোগ্যতা আমি দাবি করি না। একটু-আধটু আঁচড়-পাচড় করে একসময় যা পড়েছি, অনভ্যাসে এখন সব ভুলে বসে আছি। তবে ডক্টর নজরুল ইসলামের বইটি পড়ে মাথার ভেতরে কিছু পোকা কিলবিল করে ওঠে। এটুকু যা অজুহাত।

দুই
বিষয়-পরিসীমা বোঝানো নিয়ে একটা নামকরণ সমস্যা আজকাল সংশ্লিষ্ট বিদ্বৎসমাজে মাঝে-সাজে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেখি। প্রশ্ন হলো, যা বলতে চাই তাকে কোন সংজ্ঞায় চিনে নেব : ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’, না শুধুই ‘অর্থনীতি’? এই নামকরণের পেছনে কি কোনো মতলব কাজ করে? শুধু ‘অর্থনীতি’ বললে কি মানবসমাজে সম্পদের, অথবা উৎপাদন-প্রবাহের ভাগবাটোয়ারার জায়গাটা বাইরে চলে যায়? কথাটা ওঠে, কারণ, কার্ল মার্কসের তত্ত্ব জিজ্ঞাসার প্রেক্ষাপট ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি’ বা ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’। এটা তিনিই প্রথম চালু করেননি। ক্লাসিক্যাল বা ধ্রুপদী অর্থনীতির পুরোধা যাঁরা যেমন রিকার্ডো বা তাঁর বিপরীতে ম্যালথাস অথবা কিছু পরে জন স্টুয়ার্ট মিল, এঁরা প্রত্যেকেই ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি’, এই শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন। যাঁকে বলা হয় এই শাস্ত্রের জনক (অবশ্য সময়-সাপেক্ষে) সেই অ্যাডাম স্মিথের আকর গ্রন্থের নাম : : An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations (১৭৭৬)। তিনি ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি’ শিরোনামে আনেননি, কিন্তু স্পষ্টই বোঝা যায় Inquiry এবং Wealth of Nations তাঁকে এককে ও বিভিন্নতায় দেশে-দেশে জনগণের দেওয়া-নেওয়ার ভেতর দিয়ে যে-সম্পদ সৃষ্টির ও শ্রীবৃদ্ধির সূত্রবদ্ধ রূপ নির্মাণে প্ররোচিত করেছে, তা প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক সম্পর্ক-সম্বন্ধের বাস্তবতা মেনে নিয়েই। উৎপাদনে শ্রম-বিভাজনে সম্পর্কের বিস্তার এবং প্রাপ্ত সম্পদের প্রকৃতি স্থির করে দেয় কী হবে শ্রম-বিভাজনের স্বরূপ, কীভাবে আসে তাতে বৈচিত্র। তবে শ্রমজীবীর মজুরি নিয়ে আলাদা করে তিনি কিছু বলেননি। রিকার্ডো ধরে নিয়েছিলেন, তা হবে শ্রমজীবীর টিকে থাকার ন্যূনতম ব্যয় মেটানোর পরিণামের সমান। এখানে তিনি ম্যালথাসের যৌক্তিক সিদ্ধান্তকেই অনুসরণ করেন। সমাজবাস্তবতাতেও এর সমর্থন মেলে। মার্কস এই পটভূমিতে দাঁড়িয়েই, অর্থাৎ ধ্রুপদী বৃত্তের ভেতর থেকেই তাঁর পুঁজি (Capital) বইতে দেখালেন, শ্রমজীবী যা পায়, তার চেয়ে বেশি তার উৎপাদন। মালিকপক্ষ ওই উদ্বৃত্ত শোষণ করে। পুঁজি পণ্যের উৎপাদনের ভেতর দিয়ে তা অতীত থেকে বর্তমান প্রক্রিয়ায় প্রসারিত হয়। তিনি তাঁর ক্যাপিটাল গ্রন্থের শিরোনামে জুড়ে দিয়েছিলেন : A Critique of Political Economy তবে এ থেকে এমন মনে করার কোনো কারণ নেই, উদ্বৃত্ত মূল্য ও শ্রমশোষণের প্রসঙ্গ থাকলেই তা political economy হবে, তার বিবেচনা এড়িয়ে গেলেই তা হবে onomics বা অর্থনীতি। ম্যালথাস ও রিকার্ডো পলিটিক্যাল ইকোনমির চর্চাই করেছেন। শ্রমের প্রচলিত মজুরি হার তাঁদের কাছে যৌক্তিক ও অনিবার্য মনে হয়েছে। মূল্যবিচারে চাহিদার, বিশেষ করে শ্রমজীবীর চাহিদার ভূমিকা ছিল অপ্রাসঙ্গিক। নিও-ক্লাসিক্যাল, বা নব্যধ্রুপদী তত্ত্বে অন্তত তার গুরুত্ব মেনে নেওয়া হয়। এর পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা হাজির করেন আলফ্রেড মার্শাল। এবং তিনিই সম্ভবত প্রথম, পলিটিক্যাল ইকোনমির জায়গায় ইকোনমিকস অভিধা চালু করেন। তাঁর বইয়ের নাম : Principles of Economics (১৮৯০)। রাজনৈতিক অর্থনীতি স্থানচ্যুত হলো বলে শ্রমের মূল্য উপেক্ষিত হলো, এমন নয়। অবশ্য সেটিই উৎপাদনের একমাত্র মানবিক কারণ, এ-কথা ওই তত্ত্ব-কাঠামোয় স্বীকৃত হয় না।
এখানে একবার আরো পেছনে তাকাই। ধ্রুপদী রাজনৈতিক অর্থনীতিতে বিষয়টির প্রথম অনুশীলন, এ-কথা মনে হয়, সত্য নয়। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে ভারতবর্ষে প্রথম মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের প্রধান অমাত্য কৌটীল্য রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ অর্থশাস্ত্র। রাষ্ট্র পরিচালনায় অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মে শৃঙ্খলা রক্ষা ও বিধি-বিধান নিয়ে এর প্রধান কারবার। বইয়ের নাম কিন্তু শুধুই অর্থশাস্ত্র। এতে তাঁর একটি বিখ্যাত পর্যবেক্ষণ এখনো প্রবাদতুল্য। তিনি বলেন, মূল্যসৃষ্টির প্রধান উৎস বাণিজ্য, অর্ধেক তার কৃষিকাজ থেকে, তার অর্ধাংশ লাভ রাষ্ট্রীয় কাজে আর ভিক্ষা থেকে প্রাপ্তি শূন্য। ইঙ্গিত এখানে অকর্মণ্য ব্রাহ্মণদের যজমানির দিকে। পরে আকবরের (রাজত্বকাল
১৫৫৬-১৬০৫) সভাসদ আবুল ফজল লেখেন অতিগুরুত্বপূর্ণ বই, আইন-ই-আকবরী। তাতে তৎকালীন কৃষিব্যবস্থা ও রাজস্ব আদায় প্রণালির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ মেলে। বইয়ের নাম কিন্তু রাজনৈতিক অর্থনীতি, বা অর্থনীতি, কোনোটাই নয়। ইতালিতে রেনেসাঁস পর্বের বিতর্কিত দার্শনিক মেকিয়াভেল্লি (১৪৬৯-১৫২৭)। তাঁর সম্পর্কে মার্কসের মন্তব্য, তিনি প্রথমদিকের চিন্তাবিদদের অন্যতম, যিনি রাষ্ট্রব্যবস্থাকে মানুষের বাস্তব দৃষ্টিতে দেখেছেন এবং এর বিধিবিধানকে অতিপ্রাকৃত লীলার ওপর ছেড়ে না দিয়ে যুক্তি ও অভিজ্ঞতা দিয়ে নির্মাণ করেছেন। অবশ্য গত শতকে ফ্যাসিস্ট উত্থানের তত্ত্বভূমি তাঁর সিদ্ধান্তে মেলে। শাসকগোষ্ঠীর অপ্রতিহত শক্তিকে তিনি সমর্থন করেন। এর প্রয়োজনে উচ্ছৃঙ্খল জনগণের বিদ্রোহ দমনে সব নির্মমতা তাঁর প্রশ্রয় পায়। তাঁর প্রধান বই, দ্য প্রিন্স (The Prince)। রাজনৈতিক অর্থনীতিতে এর প্রভাব যত তাৎপর্যপূর্ণই হোক, একে কিন্তু তার বৃত্তে গণ্য করা হয় না। ধ্রুপদী ও নয়া ধ্রুপদী অর্থনীতির কাঠামোগত বিন্যাসে মূল তফাৎটা হলো, ধ্রুপদী অর্থনীতিতে একক গুরুত্ব পায় কোনো পণ্যের সরবরাহের দিক। সেখানে শ্রমের মজুরি পূর্বনির্ধারিত (Iron Law ev Subsistence Theory) প্রযুক্তি প্রাগাধুনিক। জমির উৎপাদিকা শক্তির তারতম্যও জানা। শ্রমের মজুরি যদি বাড়ে, তবে জনসংখ্যাও বাড়বে। শ্রমের জোগান বেড়ে গেলে তার ফলে মজুরি আবার আগের জায়গায় নেমে আসবে। অতএব বাজারে চাহিদা বলতে তা উৎপাদনের জন্যে উপকরণের চাহিদা। তা মালিক বা পুঁজিপতির। তার ওপর নির্ভর করে সরবরাহ। সরবরাহ নিজেই তার চাহিদার পরিমাণ নির্ধারণ করে। (জে. বি. সে-র সরবরাহের বাজার নির্ধারণী বিধি)। নব্যধ্রুপদী তত্ত্ব কিন্তু জোগানের সঙ্গে চাহিদাকেও তুল্যমূল্য জ্ঞান করে। বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম স্থির হয় চাহিদা ও জোগানের সমতায়। পূর্ণ প্রতিযোগিতা বজায় থাকলে এই দামে নড়চড় হয় না। অবশ্য এমন সময়সীমায়, যখন বাজারের ক্রিয়াকর্মে অন্য কোনো পরিবর্তন নেই। নব্যধ্রুপদীরা আরো আনেন প্রান্তিক আয় ও প্রান্তিক ব্যয়ের ধারণা। তাঁরা দেখান, পূর্ণপ্রতিযোগিতায় প্রতিটি কারবারে সর্বোত্তম অবস্থা, যখন প্রান্তিক ব্যয় ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় প্রান্তিক আয়ের সমান হয়। গোটা বাজারব্যবস্থায় সমতা আসে, যখন প্রতিটি কারবারে ও প্রতিটি উৎপাদক উপাদানের কেনাবেচায় গড় আয়-গড় ব্যয় প্রান্তিক আয়-প্রান্তিক ব্যয় আগের যুক্তি মেনে সমবিন্দু হয়। এ হলো ওয়ালরার বিখ্যাত সার্বিক ভারসাম্য। বাজার নিজেই নিজের সমাধান ঘটায়। বাইরের হস্তক্ষেপ তাকে দূষিত ও বিপর্যস্ত করে। পরে অ্যারো ও ডেব্রো প্রমাণ করেন, পূর্ণ প্রতিযোগিতার সব শর্ত পূরণ হলে এবং উৎপাদনে ও ক্রেতার কাছে তা থেকে প্রাপ্ত পরিতৃপ্তিতে ক্রমহ্রাসমান বিধি চালু থাকলে এবং বাজারের বিস্তার সীমাবদ্ধ হলে যে-কোনো নির্দিষ্ট সময়ে এই সার্বিক ভারসাম্য বিন্দুর অস্তিত্বে আমরা নিঃসংশয় হতে পারি (১৯৫৪)।
নিও-ক্লাসিক্যাল তত্ত্বকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বাস্তব নীতিমালা প্রণয়নে এটিই সবচেয়ে জোরের জায়গা। সরকার বা অন্য কোনো প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানকে বাজারের স্বয়ংক্রিয়তাকে বিপর্যস্ত করা থেকে যারা আপন-আপন খুঁটির জোরে হাত গোটাতে বলেন, তারা যুক্তি দেখান এটিই Ñ তাঁদের পক্ষে প্রমাণ তো অভ্রান্ত। তাহলে আর কথা কী? কিন্তু একটু থেমে খুঁটিয়ে দেখলে হাত-সাফাইটা ধরা পড়ে ভালোই। পূর্ণ প্রতিযোগিতা একটা আদর্শতাত্ত্বিক পৃষ্ঠভূমি। কালের মাত্রা সবার কাছে সমান নয়। তার সঙ্গে বদলায় হওয়া-না-হওয়ার মানচিত্র। এখানে বাজারের সমাধান অবশ্যই অনন্য ও সর্বোত্তম, এটা কোনোক্রমেই প্রমাণ হয় না। চিন্তার ছক অপরিবর্তিত রেখে পূর্ণ প্রতিযোগিতার শর্ত একটু এদিক-ওদিক করলেই বাজারের সমাধান আর দক্ষ ও ন্যায্য থাকে না। সমাধান অবশ্য মেলে। এটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, বিশেষ করে জোন রবিনসন (The Economics of Imperfect Competition, 1934),এডওয়ার্ড চেম্বারলিন (The Theory of Monopolistic Competition, 1947)ও জন কেনেথ গ্যলব্রেথ (The Affluent Society, 1958)|। বাস্তবে অর্থনৈতিক শক্তির পুঞ্জীভবন ও বিস্তার অনেক অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে সম্ভাবনার কোনো একটা পথ ধরে চলে। যখন যা ঘটে, তখন তা-ই কাম্য, এ-কথা কি বলা যায়?

আরো একটা বিষয় কোনোক্রমেই উপেক্ষা করা চলে না। অর্থনীতির ধ্রুপদী বা নব্যধ্রুপদী ছকে বাজারই সমগ্রের পরিচয়। রাষ্ট্রের জন্যে কোনো জায়গা বরাদ্দ নেই। কৌটীল্য বা মেকিয়াভেল্লি, ভালোমন্দ যা-ই হোক, জোর দিয়েছিলেন কিন্তু ওই জায়গাতেই। মৌলিকভাবে ধ্রুপদী ও নব্যধ্রুপদী চিন্তা-কাঠামো এ-কারণে কি অপূর্ণ থেকে যায় না? রাষ্ট্র কিন্তু গণবিচ্ছিন্ন কোনো সত্তা নয়। জনগণের অর্থায়নের ওপর তার অস্তিত্ব নির্ভরশীল। রাষ্ট্রক্ষমতা এটা জবরদস্তি করে কেড়ে নিতে পারে। কিন্তু এটা কোনো আদর্শ হতে পারে না। জনগণের কল্যাণ সাধনে রাষ্ট্রেরও একটা দায়িত্ব থাকে। তা পালিত হচ্ছে কিনা, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে জনগণেরও তা দেখার অধিকার থাকে। কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তা এড়িয়ে যেতে পারে না। বিদ্যাচর্চাতেও তা জায়গা করে নেয়। জনগণের ভেতর সম্পদের সুষ্ঠু পরিচালন, আয়ের যথোচিত বণ্টন ও অর্থ এবং উৎপাদনব্যবস্থায় স্থিতিশীলতার ধারাবাহিক সংরক্ষণ, এগুলো এই বিদ্যাচর্চার আওতায় এসে পড়ে। মতে বিভিন্নতা থাকতেই পারে। থাকাটাই বোধহয় বাঞ্ছনীয়। দায় এড়াতে অতিপ্রাকৃতের অথবা অতিপরাক্রমশালীর শরণ নেওয়া মানবিক দায়িত্বজ্ঞানহীনতা।
তবে বাজার অর্থনীতিকে চালু রেখে তাকে যদি বহুমুখী করা হয়, তবে পণ্যতালিকা শুধু বস্তুগত দ্রব্যরাশিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না; সেবাপণ্যও তার আওতায় আসে। এমনকি বিনিময় মাধ্যম যে-মুদ্রা, তারও স্থান থেকে স্থানান্তরে এবং কাল থেকে কালান্তরে কেনাবেচা চলে। দাম ধরা হয় সুদের হারে। মুদ্রাসমেত সব পণ্যের কেনাবেচা যত দ্রুততার সঙ্গে ঘটে, তত বাজারের কর্মকা- জটিল ও বিস্তৃত হয়। প্রত্যাশামূল্য তাৎক্ষণিক মূল্যকে প্রভাবিত করে। উলটোটাও ঘটে। চঞ্চলতা বাড়া মানে ঝুঁকির পরিমাণও বাড়া। তাকে মোকাবেলা করার জন্য চাই উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, পারস্পরিক বিশ্বাস ও ঝুঁকি প্রতিরোধক বিধিনিষেধ। সবকিছু নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনায় রাষ্ট্রের ভূমিকাও এখানে জরুরি। ভুলভ্রান্তির অথবা কায়েমি স্বার্থের সচেতন হাতসাফাইয়ের পরিণাম হতে পারে ভয়াবহ। বিপরীতে অতিসতর্কতায় বাজার স্থবির হয়ে পড়তে পারে। কর্মের প্রসার তাতে আটকে যায়। সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি আসে না। এই বাস্তবতা মেনেই বাজারকে চালু রাখা। প্রলয়কা-ের আশঙ্কা অবাস্তব নয়। অর্থনৈতিক কর্মকা-ের ব্যাপ্তির সঙ্গে প্রত্যাশার তাল না মিললে বিপর্যয় অনিবার্য। এমনটি ঘটেছে বারবার। বহুমুখী স্বার্থের বহুমাত্রিক সংযোগ-সংঘাত প্রতিমুহূর্তে ঘটে চলে। শৃঙ্খলা সব সময় বজায় থাকবে, এটা নিশ্চিত বলা যায় না। বিপরীতে সবটাই যদি নির্দেশনামূলক হয়, তবে তাতেও ঝুঁকি থেকে যায়। অবশ্য ভিন্ন দিক থেকে, ভিন্ন মাত্রার। জনসমুদয়ের চাওয়া-পাওয়ার সমীকরণ কোনো একক কর্তৃপক্ষের নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব। উদ্দেশ্য যদি নৈর্ব্যক্তিক ও মহৎ হয়, তবু। বাস্তবতার এই টানাপড়েনের ভেতর মানুষের টিকে থাকার সংগ্রাম। এগিয়ে যাওয়ার পথেরও অন্বেষণ। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ঐতিহ্যলালিত মানুষের বিভিন্ন অভিজ্ঞতায় জন্ম-মৃত্যুর,
মৃত্যু-জীবনের ধারাবাহিকতায়।
ধ্রুপদী অর্থনীতির পরিম-লে তার ধ্যান-ধারণায় পুষ্ট হয়েই সেখান থেকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণে গোটা সমাজের দ্বান্দ্বিক বাস্তবতাকে তার সম্পূর্ণতায় বিকশিত হওয়ার প্রক্রিয়ার এক জোরালো তত্ত্ব নিয়ে আবির্ভাব ঘটে কার্ল মার্কসের (১৮১৮-৮৩)। বাজারের ক্রিয়াকর্ম তিনি প্রত্যক্ষ করেন, কিন্তু তার সামঞ্জস্য খোঁজেন না। বরং তাতে যে-দ্বন্দ্বের স্বার্থতাড়িত শ্রেণিসত্তানির্ভর প্রকাশ, তার যৌক্তিক অবসানে দেখেন সমাজের রূপান্তর, তার সম্ভাবনার অগ্রাভিযান। পুঁজি-সম্পদের মালিক ও উৎপাদনে নিয়োজিত শ্রমিক, এই দুপক্ষে শিল্পায়িত সমাজের বিভক্তি। মজুরির ‘আয়রন-ল’ অনুসরণ করে মালিক শ্রমলব্ধ উৎপাদনের উদ্বৃত্ত সবটুকু হরণ করে। কিন্তু তা সংকটেরও কারণ হয়। উদ্বৃত্ত অলস পড়ে থাকলে উৎপাদন বাড়ানোর আগ্রহ আর থাকে না। শ্রমিক কাজ পায় না। তার দুর্ভোগ বাড়ে এবং তা সমষ্টিগতভাবে। প্রযুক্তির নবায়ন ঘটিয়ে মালিকপক্ষ সাময়িক সমস্যা আড়াল করার চেষ্টা করতে পারে। তাতে দ্বন্দ্বের নিরসন হয় না। আরো গভীরে তা ছড়ায়। জমাট বাঁধে। পরিণাম বিস্ফোরণ। শ্রমিকশ্রেণির প্রকৃত উৎপাদিকা শক্তির-বিপ্লব। যেহেতু তারাই অতীত ও বর্তমান সব নিয়োজিত শ্রমের কর্তা এবং সেটি কেবল
রূপান্তর-প্রক্রিয়ায় অবিরাম সৃষ্টিশীল, তাই ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারায় জয় তাদের অনিবার্য। পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থার জায়গায় উদ্ভব হবে শ্রমিকশ্রেণির কর্তৃত্বে সমাজবাদের। মানববিশ্বে উন্নয়নের সর্বোচ্চ ধাপ, সাম্যবাদ। মার্কসের সমাজতন্ত্রের বাণী পৃথিবীজুড়ে গণমানুষের কথা যাঁরা ভেবেছেন, এখনো ভাবেন, তাঁদের অনুপ্রাণিত করেছে। বিশ শতকে এই ব্যবস্থায় সমাজ রূপান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে রাশিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, কিউবা, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া ও কিছুটা তাঞ্জানিয়ায়। তবে গত শতকের শেষে এসে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে। চীনে কমিউনিস্ট পার্টি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বহাল আছে, কিন্তু কর্মকা-ে আগ্রাসী পুঁজিবাদী ঝোঁক সেখানে প্রকাশমান। ভিয়েতনাম আরো নমনীয়। সম্প্রতি কিউবাও। এক উত্তর কোরিয়া সমাজতান্ত্রিক প্রচারে এখনো উচ্চকণ্ঠ। তবে কাউকে তার পথ অনুসরণে আগ্রহী করে না। তাঞ্জানিয়ায় সমাজতন্ত্রের সংস্কার-প্রক্রিয়া বেশিদূর এগোয়নি।
উন্নত পুঁজিবাদী বিশ্বও কিন্তু বদলেছে। সমাজতন্ত্র কায়েম হয়নি। গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার বিকল্প হিসেবে শ্রমিকশ্রেণির একচ্ছত্র কর্তৃত্ব গণমানসে স্বীকৃতি পায়নি। তত্ত্বের বাস্তব গ্রহণযোগ্য রূপ একটা এখনো অনায়ত্তই রয়ে গেছে। চিন্তাতেও তাকে কল্যাণময় করে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়নি। তাই বলে সমাজতান্ত্রিক ভাবনা পুরোপুরি বৃথা গেছে, বলা যাবে না। তার লক্ষ্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রও আত্মস্থ করতে বাধ্য হয়েছে। হয়তো কোথাও বেশি, কোথাও কম। কিন্তু
শিল্প-বিপ্লবের প্রথম যুগের বল্গাহীন শোষণ কোনোখানেই আর অনুমোদন পায় না। কোনো দেশে দারিদ্র্য যত দূরে সরে, তত কিন্তু জনগণের মনোজগতেও কেতাবি সমাজতন্ত্রের আকর্ষণ কমে। যদিও শোষণহীন সমাজ গড়ার সংকল্প মরে যায় না। আর, বাস্তবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সংশোধন আনায় সোচ্চার ওই বিশ্বের বাসিন্দা অনেক প্রধান মনীষী। তাঁদের বার্তা একেবারে বৃথা যায় না। গোটা বিশ্বেই তা গুরুত্ব পায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ দুজনের কথা এখানে বলি। প্রথম জন, ভেবলেন (১৮৫৭-১৯২৯)। তিনি পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক সংঘাতের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এই সংঘাত মার্কসীয় নয়, বরং অর্থ-বিত্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রযুক্তি-প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক সংঘশক্তির অর্থ-বিত্তের মুনাফা বাড়ানোর লোভ উদ্ভাবনী জ্ঞানের বিকাশ ও ব্যবস্থাপনায় সৃষ্টিশীলতার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তিনি মনে করেন, প্রযুক্তির সৃষ্টিশীল বিকাশ মালিকানার কর্তৃত্ব হ্রাস করে উৎপাদনব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটাবে। ÔConspicuous consumption’, ‘Ostentatious display’, ÔTheory of the leisure class’ – এই ধারণাগুলো তিনিই চালু করেন। পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থায় ভেতর থেকে রূপান্তর-প্রক্রিয়ায় এদের ভূমিকা খাটো করে দেখা যায় না। দ্বিতীয় জন, জোসেফ শুমপিটার (১৮৮৩-১৯৫০)। তিনিও মালিকানার সঙ্গে উদ্যোগকাণ্ডের (Entrepreneurship)  তফাত দেখান। মালিক আবশ্যিকভাবে উদ্যোক্তা নয়। প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনায় নতুন-নতুন উদ্ভাবন উৎপাদনে নতুন সৃষ্টির, অথবা নতুন উপস্থাপনার মাধ্যমে গতি সঞ্চার করে। তাতে তেজিভাব আসে। যখন তা থিতিয়ে যায়, তখনই দেখা দেয় মন্দা। উদ্যোক্তার ভূমিকায় ক্রমাগত নবায়নে ও পণ্যসামগ্রীর বৈচিত্রে এবং বিস্তারে তিনি দেখেন এই ব্যবস্থার সমৃদ্ধি। অন্যথায় খুলে যায় তলিয়ে যাওয়ার পথ। এখনো তা অনিবার্য হয়ে ওঠেনি। তবে মানুষী সৃষ্টির সম্ভাবনা অসীম নয়, এ-কথাটাও মনে রাখতে হয়।
বাজার-অর্থনীতির কাঠামো অক্ষুন্ন রেখে কার্যত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগকে তার সঙ্গে শুধু সংযুক্ত করে নয়, তাকেই প্রধান নিয়ন্তা করে পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে গভীর খাদের কিনারা থেকে টেনে তোলার মন্ত্র শেখান জন মেইনার্ড কেইনস (John Maynard Keynes) (১৮৮৩-১৯৪৬) তাঁর বিখ্যাত বই The General Theory of Employment, Interest and Money-তে (১৯৩৬)। বাজারের স্বয়ংক্রিয়, যা প্রতিফলিত খধরংংবু-ভধরৎব-এ, এবং যা পুঁজিবাদী অর্থনীতির চর্চায় কী ধ্রুপদী, কী নব্যধ্রুপদী তত্ত্বকাঠামোয় অপ্রতর্ক্য বলে গণ্য, তাকেই তিনি এক ধাক্কায় রসাতলে পাঠালেন। পটভূমি ছিল গত শতকে তিরিশের দশকে বাজার-অর্থব্যবস্থায় মহামন্দা। প্রচলিত কোনো উপায়েই তাকে চাঙ্গা করা যায় না। যেখানে বাজার বিনিয়োগবিমুখ, অথচ উৎপাদনে উপকরণ সবই সক্ষম থেকেও বেকার এবং এই বেকারত্বে বাজারের চাহিদা ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকায় ক্রমাগত নিম্নমুখী, সেখানে কেইনস বোঝালেন, রাষ্ট্র এগিয়ে এসে স্বয়ংক্রিয় বিনিয়োগ-উদ্যোগ গ্রহণ করলে তাতেই মিলবে উদ্ধারের পথ। বেকার উপকরণগুলোর চাহিদা তৈরি হবে। সেই সূত্রে কর্মহীন মানুষের কাজ জুটবে। তাদের হাতে ক্রয়ক্ষমতা ফিরে আসতে থাকবে। পণ্যবাজারেও চাহিদা তৈরি হবে। এই প্রক্রিয়া তখন-তখনই শেষ হয়ে যায় না। প্রান্তিক ভোগস্পৃহা যত বেশি হয়, তত পৌনঃপুনিকভাবে বাজারে তার প্রভাব পড়ে। একসময়ে প্রথম স্বয়ংক্রিয় বিনিয়োগের প্রতিক্রিয়ায় উৎপাদন-বৃদ্ধি থিতিয়ে যায়। কিন্তু তার আগে প্রান্তিক ভোগ চাহিদার টানে উৎপাদন ওই বিনিয়োগের কয়েকগুণ বেশি বেড়ে যায়। তখনো যদি উৎপাদিকা শক্তি উদ্বৃত্ত থাকে, তবে স্বয়ংক্রিয় বিনিয়োগ আর-এক কিস্তি বাড়িয়ে একইভাবে বাজারকে আরো চাঙ্গা করার উদ্যোগ নেওয়া যায়। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে কিছু জমা না থাকলেও ক্ষতি নেই। ঘাটতি বাজেটে নোট ছাপিয়ে গণমানুষের হাতে উদ্যোগনির্ভর ক্রয়ক্ষমতা পৌঁছে দেওয়া চলে। মুদ্রাবাজারেও সাড়া জাগে। সুদের হারে আবার ঊর্ধ্বগতির আশা করা যায়। মন্দা কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবলতর হয়। তবে উৎপাদনের উপকরণগুলো পূর্ণ নিয়োগে (কেইনস মনে করেন, স্বেচ্ছা-বেকারত্ব সামান্য কিছু থাকলেও কার্যত তাকে পূর্ণ নিয়োগ মনে করা যায়) পৌঁছে গেলে আর অর্থ বিনিয়োগে সুফল আসবে না। অহেতুক পণ্যসামাগ্রীর দাম বেড়ে যাবে। মুদ্রাস্ফীতির বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করবে। অবশ্য স্বয়ংক্রিয় বিনিয়োগের প্রথম পর্যায়ে ঢালাওভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়া অকল্যাণের নয়। তা গোটা বাজারব্যবস্থায় ক্রয়ক্ষমতা ছড়ায়।
কেইনসের ব্যবস্থাপত্র অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম পুঁজিবাদী বিশ্বে শুধু সাময়িকভাবে নয়, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব বাড়িয়ে তাতে মৌলিক পরিবর্তন ও কিছু সংযোজন করে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ভাবনা শুধু কথার কথা থাকে না। তার অনেক আদর্শ বাস্তবায়িত হয়। কর্তব্য বলেও স্বীকৃতি পায়। গত শতকে সত্তরের দশকে এসে কেইনসীয় তত্ত্ব যখন আগের মতো আর কাজ করে না, যখন মুক্তবাজারের প্রবক্তারা গণকল্যাণকে আবার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার ওকালতিতে উচ্চকণ্ঠ এমনকি বিপরীতে নব্বই দশকের গোড়ায় সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব যখন পতনোন্মুখ, তখনো তারা বাজারের প্রভাব-বলয় বাড়ালেও গণকল্যাণের কর্তব্য একেবারে ঝেড়ে ফেলতে পারে না। বিশেষ করে স্বাস্থ্য বীমা ও মৌলিক শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই অলঙ্ঘনীয় দায়িত্ব বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। অবশ্য বীমা-ব্যবসায় দায়িত্ব পালনে বেসরকারি উদ্যোগও চালু আছে। প্রত্যাশিত প্রাপ্তির তত্ত্ব এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে যে, বীমা-ব্যবসায় বেসরকারি খাতেও অলাভজনক হওয়ার কারণ নেই। আমরা জানি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসানে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান শুরু হয়। ষাট দশকে এসে তাকে বিলুপ্তই বলা চলে। তাই বলে সদ্যস্বাধীন দেশগুলো যে অর্থনৈতিক মুক্তিও অর্জন করে, এ-কথা বলা যায় না। তাদের প্রাথমিক দারিদ্র্য ও অনুন্নয়নের জন্য অনেক বিষয় দায়ী। ঔপনিবেশিক শাসনে তাদের শ্রীবৃদ্ধি অবহেলিত হয়েছে, এ-কথা অবশ্যই সত্য। তবে অভ্যন্তরীণ বাধাও কম ছিল না। এখনো আছে। তা সত্ত্বেও উন্নয়নের উদ্যোগ উপেক্ষিত নয়। এতে কিন্তু বেশিরভাগ নবীন রাষ্ট্রে গুরুত্ব পেয়েছে কেইনসীয় চিন্তা-পদ্ধতি। তাতে মিশ্র অর্থনীতি ও ঘাটতি বাজেটের ওপর সরকারি নির্ভরতা প্রায় সব জায়গাতে উন্নয়ন কৌশলে প্রধান হয়ে উঠেছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে পাওয়া পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রায়োগিক ধারণা। বিশ্ববাজার থেকে বিচ্ছিন্ন তারা হতে চায়নি। শ্রম ছাড়া উৎপাদনের অন্য প্রায় সব উপাদানেই তাদের ঘাটতি ছিল। এবং শ্রমও অধিকাংশ নিম্নমানের। উদ্যোগ পরিচালনায় ঐতিহ্য ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতাও অনুরূপ। কেইনসের সামনে কিন্তু ছিল পরিপক্ব দক্ষ-অভিজ্ঞ বিনিয়োগযোগ্য উৎপাদনের অলস উপাদানের সমস্যা। সেখানে প্রবৃদ্ধিতে তাঁর গুণক ও তার অনুসরণে হ্যারড-ডোমারের ত্বরণের ধারণা কার্যকরভাবে প্রয়োগের কথা ভাবা যৌক্তিক। কিন্তু অনুন্নত বিশ্বে জ্ঞান ও সম্পদ দুই-ই দুষ্প্রাপ্য। এখানে উন্নয়নের অনুরূপ উদ্যোগ শুধু আপনশক্তির বাস্তবতায় উচ্চাভিলাষী হয়ে পড়ারই আশঙ্কা। এখানে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্বন্ধে ঝুঁকি থাকলেও তা ভরসা জোগায়। গাফিলতি বা হিসাবে ভুলত্রুটি থাকে অবশ্যই। তেমন থাকে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বেও। তবু প্রায় দুই দশক কেইনসীয় অর্থনীতির তত্ত্ব ও কর্মকাঠামো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সহায়কের ভূমিকাই পালন করে।
পরিস্থিতি পালটে যেতে শুরু করে সত্তরের দশকে এসে। মধ্যপ্রাচ্যে আর্থ-রাজনৈতিক সংঘাতের এই সংকটজনক পর্যায়ে তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর কার্টেল তাদের উৎপাদিত পণ্যের দাম একতরফা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। রাতারাতি বহু পণ্যের দাম বাড়ে। তার ঊর্ধ্বমুখী গতি সামলানো যায় না। পণ্যবাজারে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। গোটা পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় আনুপাতিক বৃদ্ধি ঘটে না। চাহিদার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কেইনসীয় ধারণা মেনে অর্থলগ্নি করে মুশকিল আসান হয় না। অর্থনীতিতে স্থবিরতা ও মুদ্রাস্ফীতি একই সঙ্গে জাঁকিয়ে বসে। পাশ্চাত্য উন্নত বিশ্বে রক্ষণশীলতা আগ্রাসী আকার নেয়। রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনকল্যাণমুখী কর্মকা-, যা তিন দশক ধরে চালু থেকে প্রায় স্বতঃসিদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, তাদের ওপর খড়্গ এসে পড়ে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ বাড়ে। অপ্রয়োজনীয় বলে অনেকের চাকরি যায়। চাহিদা নয়, খরচের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জোগান নির্ধারণ, যা কিনা ছিল ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির প্রধান লক্ষ্য, তা-ই আবার ফিরে আসে। তলে পড়ে যান কেইন্্স। খোলাবাজারে লগ্নি পুঁজি দাঁও মারার আশায় চিলের মতো আকাশে ওড়ে। সুযোগ পেলে ছোঁ মারে। অনুন্নত বিশ্বও বাজার খুলে দিতে বাধ্য হয়। এনজিও নামে এক ধরনের চালাক-চতুর দোআঁশলাবাজ ভদ্র সন্তান চক্র সেসব দেশে আসর জাঁকিয়ে বসতে থাকে এবং সবটাই মুক্তবাজারে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির অথবা বেসরকারি ব্যবসায় কোম্পানির সঙ্গে কোম্পানির গাঁটছড়া বাঁধার ফিকিরে। বিষয়টি যে শক্ত মাটির ওপর দাঁড়িয়ে তা বলা যায় না। অনেকটা সতেরো শতকে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে বাণিজ্য করতে এলে (১৬১০ সালে জব চার্নক সুতানুটি, গোবিন্দপুর, কলকাতা এই তিনটি গ্রাম স্থানীয় এক জমিদারের কাছ থেকে কিনে সেখানে কুঠি স্থাপন করে স্থানীয় সুতো ও কাপড়ের ব্যবসায়ীদের বসতি গড়ার সুযোগ করে দেন। ক্রমে দালাল, বানিয়ান, মুৎসুদ্দিরা সাহেব ধরার প্রতিযোগিতায় ঘাটে জাহাজ ভিড়লেই তাদের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে শুরু করে। তখন অবশ্য জল আরো অনেক দূর গড়িয়েছে। আঠারো শতকে সাহেবরা শুধু কোম্পানির নামে নয়, ব্যক্তিগত দাঁও মারার জন্যও বঙ্গভূমির গ্রামেগঞ্জে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। সবই কিন্তু ব্যবসার নামে) যে-পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, চরিত্রগতভাবে প্রায় সেই রকম। ওই অবস্থা থেকে কোম্পানির শাসন অনিবার্য ছিল না। কিন্তু তার সম্ভাবনা তো তৈরি হয়েছিল।
গত শতকে এসে মুক্তবাজার অর্থনীতি, সবচেয়ে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রাভা-ারের অবাধ প্রশ্রয় পায়। বিশ্বব্যাংক অপচয় রোধের নামে দাওয়াই বাতলায়, কাঠামোগত সমঝোতায় এসো। অর্থাৎ সব পণ্যেই খরচের সঙ্গে সমঝোতা করে দাম স্থির করো। সামাজিক দায়িত্ব থেকে ভর্তুকি দেওয়া অথবা প্রগতিশীল করকাঠামো চালু রেখে উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহ করা থেকে বিরত থাকো। বিদেশি পুঁজির বিনিয়োগ প্রণোদনা বাড়াও, আর সরকারি অর্থব্যবস্থায় ঘাটতি বাজেটের আওতায় আয় পুনর্বণ্টনের প্রয়াস বন্ধ করো। নিট ফল আন্তর্জাতিক পুঁজির অনুকূলে যায়।
বিশ শতকের শেষে বিস্ময়কর প্রযুক্তি বিপ্লবও এর সহায় হয়। মূলত তথ্যপ্রযুক্তিতে ও ইলেকট্রনিক সরঞ্জামে অকল্পনীয় অগ্রগতিতে একটি বৃহৎ উৎপাদন কারখানার পক্ষে খ–খ- করে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দিয়ে সর্বনিম্ন খরচে চূড়ান্ত পণ্য সর্বোত্তম দক্ষতায় হাজির করা আজ অসম্ভব নয়, বরং অতিমাত্রায় বাস্তব। মূল উদ্যোক্তা থাকতে পারে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তথ্যপ্রযুক্তির দক্ষ ব্যবহারে বিশ্বপরিবারে তার উদ্যোগকা- নিখুঁত পরিচালিত হতে পারে। অ্যাডাম স্মিথের শ্রমবিভাজন আন্তর্জাতিক মাত্রা পায়। এনজিও মার্কা উদ্যোগ সব, অথবা বাইরের দাদন খেয়ে দোকান, কলকারখানা ইত্যাদি খুলে বসা উন্নয়নশীল কোনো দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় হয়তো খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় চলে আসে। উপদেশ বা পরামর্শ বেচাও তার সঙ্গে যোগ হয়। উৎপাদনব্যবস্থা বিশ্ববাজারে স্বেচ্ছায় হুমড়ি খেয়ে ঢুকতে চায়। উত্তমর্ণ হয়ে নয়, ‘বিনীত জোড় কর’ অধমর্ণ হয়ে। তেমন হতে পারার সফলতাই বুঝি কাম্য হয়ে দাঁড়ায়।
সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের ভেঙে পড়ার ধাক্কাও কম পড়ে না। সত্তরের দশক থেকেই ওই ভূবিশ্বে স্থবিরতার লক্ষণ ফুটে ওঠা শুরু করে। সঞ্চিত জ্ঞানভা-ার সর্বোত্তম উৎপাদনে যাওয়ার জন্য যতটা সহায় হতে পারে, ততটা তারা যে পৌঁছতে পারে না, তা নয়। কোথাও-কোথাও তো সফলতা চমকপ্রদ। কিন্তু জ্ঞানের অগ্রাভিযান বারবার হোঁচট খায়। প্রাচীনতা সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার মৌরসিপাট্টা বজায় রাখে। গণমানুষের প্রত্যাশা থেকে কিন্তু তা ক্রমশ দূরে সরে। কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কেবল গতানুগতিক শুদ্ধতা বজায় রেখে চলে। বইরের প্ররোচনা যে-প্রলোভন দেখায় তা-ও অস্বীকার করা যায় না। ভেতরে-ভেতরে ‘অসার বিরাগ’ নিশ্চয় জমে চলে। ধ্রুপদী অর্থনীতির বলয়ে মার্কসীয় অর্থনীতিও চাহিদাকে গুরুত্ব দেয়নি। সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনাতে তা কেবল বিশেষজ্ঞদের হিসাবের ব্যাপার মাত্র হয়ে ছিল। পরিণামে পৌনঃপুনিক নামতা পাঠের ছাপ তাতে পড়ে। গণমানুষ আর উৎসাহ পায় না। হাঙ্গেরি, চেকোসেøাভাকিয়া ও পোল্যান্ডে প্রত্যাখ্যানের সুর বেজে উঠেছিল আগেই। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় এসে সোভিয়েত ইউনিয়নও আর সমাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে পারে না। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রও আর থাকে না। অঙ্গরাজ্যগুলো রাশিয়া থেকে আলাদা হয়ে যায়। প্রভাব পড়ে দূরে ভিয়েতনাম ও কিউবার ওপরেও। ভিয়েতনাম শুরু থেকেই ছিল নমনীয়। বৃহত্তম পরাশক্তির সঙ্গে দীর্ঘ-দীর্ঘ সংগ্রামে নতিস্বীকার না করেও কোনো কঠোর সমাজতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতার পথে সে যায় না। তুলনায় অর্থনৈতিক সফলতাও তার চোখে পড়ার মতো। হয়তো সততা ও নিষ্ঠাই এর বড় কারণ। কিউবাও বদলে যাচ্ছে। গত শতকের প্রযুক্তি-বিপ্লব কাউকেই উন্নয়নের পথে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে দিচ্ছে না। সংশয় বাসা বাঁধছে উন্নত বিশ্ববাজার অর্থনীতিতেও। তবে যেহেতু তাতে ভুল করা ও ভুল শোধরানো, দুটোই প্রকাশ্যে ঘটে, তাই তার পরিবর্তনশীলতা পদ্ধতিগতভাবেই স্বীকৃতি পায়। প্রতিষ্ঠানগুলোর নৈর্ব্যক্তিক শক্তি-সামর্থ্য ও বিশ্বাসযোগ্যতা তাকে রক্ষা করে। মন্দার সংকট বারবার দুর্ভাবনায় ফেলে ঠিকই, কিন্তু এখন পর্যন্ত বিধ্বস্ত করার মতো অবস্থা তৈরি হয়নি। তার আগেই জনগণের অর্থনৈতিক কর্মকা-ে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় অথবা কোনো সুচিন্তিত নীতিমালার প্রয়োগে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়। তবে বহু মানব-মানবী যে বিপুল দুর্ভোগের মুখে পড়ে, অনেকে উচ্ছন্নে যায়, এটা অস্বীকার করা যায় না।
এখানে এই শাস্ত্রের বিষয়-ভাবনার দিকে আর-একবার নজর দিই। এতক্ষণ যা আলোচনা করলাম তার প্রেক্ষাপট প্রাসঙ্গিক কিনা, এবং তা কোন দিক থেকে, তা নিয়ে তা হলে প্রশ্ন তোলা অসংগত হবে না। নব্যধ্রুপদী ধারার অর্থনীতির অন্যতম প্রধান পুরুষ মার্শাল বিধান দেন,Economics is a study of human behaviour in the ordinary business of life। এই ধারণা কিন্তু নব্যধ্রুপদী তত্ত্ব-ভাবনার জালে সীমাবদ্ধ হয় না, যদিও ওই ছককেও তার ভেতরে ফেলা যায়। ‘Human behaviour’ অবশ্যই নারী-পুরুষ উভয়ের আচরণকেই বিবেচনায় নেয়। আর, Ordinary  business of life  বলতে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে সমুদয় কর্মকা-ই আসে। তা অর্থবহ হতে পারে কেবল তার উপায়ের অন্বেষণে ও তার যথাযথ সর্বোত্তম ব্যবহারে। এখানেও কোনো আপত্তি তোলার কারণ আছে বলে মনে হয় না। তবে অনুমান করি, আয়, চাহিদা ও জোগান, এই বিষয়গুলো এখানে প্রচ্ছন্ন আছে। নব্যধ্রুপদী ধারায় চাহিদার পেছনে তৃপ্তি বা উপযোগের কথা তুমুলভাবে আসে। তা পরিমাপযোগ্য কিনা, একজনের তৃপ্তির সঙ্গে অন্যজনের তৃপ্তির তুলনা চলে কিনা, এসব প্রশ্নের সামনে আমরা আটকে যাই। সদুত্তর মেলে না। তবে তাতে বিষয়ের সীমা নির্ধারণ অযৌক্তিক হয় না।
প্রত্যক্ষবাদী চিন্তাবিদ লায়নেল রবিন্স কিন্তু অর্থনীতি চর্চার ধরনটাকেই এক বিশেষ খাতে প্রবাহিত করতে চান। তিনি সংজ্ঞা বাতলান, ‘Economics is a science, which studies human behaviour as a relationship between ends and scarce means which have alternative uses.’ মনে হতে পারে, খুবই পরিমিত ও যথেষ্ট। কিন্তু মাথা ঘামাতে হয় ঝপরবহপব শব্দটি নিয়ে। তাতে নৈর্ব্যক্তিক প্রত্যয় উপপাদ্য, যুক্তিক্রম ও সিদ্ধান্ত এই ধাপগুলো অপরিহার্য। এখানেই শেষ নয়। সিদ্ধান্ত পরীক্ষণ বা প্রত্যক্ষণে যথার্থ প্রমাণিত হলে তবেই তা গ্রহণযোগ্যতা পায়। নইলে খারিজ হয়ে যাওয়াই তার নিয়তি।
সন্দেহ নেই, রবিনসের এই দৃষ্টিভঙ্গি অনেক প্রতিভাবান গণিতজ্ঞকে এই বিষয় চর্চায় আকৃষ্ট করে। অর্থনীতিও তাঁদের হাতে অতি উচ্চমানের মেধার কসরত হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু দেখার বিষয় তো মানব-আচরণ! সংগতি, একৈকান্তিক ধারাবাহিকতা, অনন্যনির্ভরতা ও যৌক্তিক সম্পূর্ণতা, এই শর্তগুলো কি তার ওপর আরোপ করা যায়? যদি না যায়, তবে অর্থনীতির চর্চা কি নীরক্ত ও নিষ্প্রাণ হয়ে যায় না? হাততালি মেলে হয়তো অনেক। কিন্তু মানুষ ক্রমশ দূরে সরে। মানুষের স্বাভাবিক মুখে দুষ্পাঠ্য অসংখ্য রেখার জটাজালে চোখ রেখে অর্থ খোঁজাই অর্থনীতির নিয়তি। শেষ কথা নেই। কারণ একটি সম্ভাবনা অসংখ্য নতুন সম্ভাবনার জন্ম দেয়।
পরিকল্পিত অর্থনীতিকে আরাধ্য মেনে অস্কার ল্যাঙ্গ (Oscar Lange) প্রস্তাব রাখেন, ‘ÔEconomics studies the administration of scarce resources in human society.’ পরিকল্পনার বিষয় বোঝানোয় একে অবশ্যই যথার্থ মনে করা যায়। কিন্তু মানুষের চাওয়া-পাওয়া বহুমাত্রিক। জীবনযাপন
তৃপ্তি-অতৃপ্তিতে মেশানো। তাকে একমুখো উত্তমায়নের ছকে ফেললেই তা যথার্থ হবে, এ কি নিশ্চিত বলা যায়? একইভাবে রাজনৈতিক অর্থনীতিতে ফিরে যাওয়াও কি বিষয়কে সীমিত করে না? তার মানে এ নয়, রাজনৈতিক অর্থনীতি পরিত্যাজ্য। তার গুরুত্ব কম নয়। তবে সেইটুকুই সব নয়, একক ও সব মানব-মানবীর হওয়া-না-হওয়া, প্রত্যাশা-অচরিতার্থতা, এ সবকিছুতেই অর্থনীতিকে চোখ রাখতে হয়। এটি মনে রেখে এবার আমাদের এই বাংলাদেশের দিকে দৃষ্টি দিই। তবে শুরু করি আরো একটু আগে থেকে।

তিন
১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এক অভিনব ঘটনা। অতীতে আমাদের ইতিহাসে এর তুল্য কিছু নেই। অনেকে প্রাক্-পলাশী যুদ্ধের দৃষ্টান্ত টেনে তার সঙ্গে একে জুড়ে দেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলাহর ভাগ্যলিপির সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিণতির মিল খুঁজে পান। সেই সূত্রে আমাদের পরিচয়ে ধারাবাহিকতা টানেন। এতে গালগল্পের রসদ আছে। ইতিহাসের অনাসক্ত পাঠ নেই। এও বলে রাখি, অতীতে যা ঘটে এসেছে কার্য-কারণ সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা একটা আমরা খাড়া করতে পারি। কিন্তু সেটিই অনিবার্য ছিল, এমন নির্ধারণবাদী নির্দেশ দেওয়ার আগে বারবার ঢোক গিলতে বাধ্য হই। মুর্শিদাবাদের নবাবরা কেউ বাঙালি ছিলেন না। সবাই বাইরে থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা এবং কেউই কাগজে-কলমে স্বাধীন ছিলেন না। তবে মোগল সাম্রাজ্য যখন ভাঙনের মুখে, তখন তাঁরা অনেকখানি স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন। জনসমুদয়ের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আশা-আকাক্সক্ষা, এগুলো কখনই তাঁদের বিবেচনায় আসেনি। সাধারণ মানুষেরাও তাঁদের ব্যাপারে চূড়ান্ত উদাসীন থেকেছেন। তার আগে যাঁরা বাংলার সুবেদার হয়ে এসেছেন, যেমন মান সিংহ, শাহ সুজা, ইসলাম খান, শায়েস্তা খান, ইব্রাহিম খান, আজিমউশ্শান, এঁরা সবাই ছিলেন মোগল রাজপুরুষ অথবা প্রশাসনিক কর্মকর্তা। আরো আগে ইলিয়াস শাহী (১৩৫২-১৪১০) বা হুসেন শাহী (১৪৯৪-১৫৩৮) পর্বে বাংলার রাজশক্তি অবশ্য দিল্লির প্রভাব থেকে প্রায় পুরোপুরি মুক্ত ছিল। সুলতানরা বহিরাগত হলেও বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে তোলায় তাঁদের অবদান কম ছিল না। তুলনায় দুই সেন রাজা বল্লাল সেন ও লক্ষ্মণ সেন দ্বাদশ শতকের শেষ ভাগে দক্ষিণ ভারত থেকে এসে এখানে বর্ণপ্রথা জোরেশোরে চালু করায় প্রয়াসী হন। দীর্ঘস্থায়ী পরিণাম তার ভালো হয়নি। পাল রাজাদের আমলেই (সপ্তম থেকে দশম শতাব্দী) বরং বাঙালি জীবনে উদারতা ও পরমতসহিষ্ণুতা গভীরভাবে মিশে গিয়েছিল। তার ধারাই প্রধান হয়ে এখনো বহমান। তবে গণচেতনা, স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ও সাংগঠনিক নেতৃত্বের যে অবিকল্প সমন্বয় একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামকে সফলতায় উত্তীর্ণ করেছিল, গোটা
পৃথিবীর ঘটনাপ্রবাহেই তা অতিবিশিষ্ট। নেতৃত্ব জনগণের মুখাপেক্ষী থেকেছে। জনগণ তাদের পূর্ণ আস্থা জানিয়ে আরো একধাপ এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে।
পাকিস্তানি মানসিকতারও একটা ধারা আছে। যদিও তা কেবল ওপর-কাঠামোয় এবং পুরোপুরি তুর্কো-আফগান-মোগল-আরব দখল-শাসনের স্মৃতির সঞ্চয়ের অনুসারী। হুকুমদখলের অতীত কীর্তির বিকারও তাতে মেশে। একে উপেক্ষা করা যায়, এমনকি ছুড়ে ফেলা যায়, যদি সমূহ কল্যাণের আন্তরিক প্রয়াসে গণমানুষের আস্থা অটুটু থাকে, বিচ্যুতির নৈরাশ্য যদি তাদের গ্রাস না করে। এ ছাড়া গভীরতর অনিবার্যতা একটা আছে। Ends and scarce means, যা নিয়ে অর্থনীতির অবিরাম কারবার, তাতে যে-সিদ্ধান্তই নিই না কেন, সবাইকে একসঙ্গে খুশি করা অসম্ভব। কাউকে না কাউকে ত্যাগ স্বীকারে বাধ্য করতেই হয়। সাধারণত দুর্বল যারা, মূক-মূঢ়-ম্লান যারা, তাদের ওপরই বোঝা চাপে বেশি। নতুন নতুন প্রশ্ন খাড়া হতে শুরু করে। সংশয়ের আবর্ত নিচে টানে। অনাকাক্সিক্ষত স্বার্থবাহী চক্র জন্ম নেয়। স্বাধীনতা মূল্য হারায়। সুযোগ বুঝে আঘাত হানে তার শত্রুরা। তেমনটিই ঘটে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট। ওই অপশক্তির সঙ্গে লড়াই করে-করে তারপর এদেশের শক্তি সঞ্চয় করা। আর এই দেশ কোনো একক বিচ্ছিন্ন সত্তা নয়। অর্থনীতির পাশা খেলা একের সঙ্গে একের নয়, একের সঙ্গে অনেকের। এই কথাগুলো মাথায় রেখে এগোনোর পথ কোথাও আছে কিনা খুঁজি।
একাত্তরের প্রেক্ষাপট একবার বোঝার চেষ্টা করি। পাকিস্তানের পূর্বখ- আমরা। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ কতটা নির্মম হতে পারে, তা হাড়ে-হাড়ে টের পাই। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার স্মৃতি আমাদের ছিল তবে খোলামনে বিচার করলে এটা অস্বীকার করা যায় না, তার ইতিবাচক ফলও কিছু ফলেছে। অন্তত ষোড়শ শতক থেকে য়োরোপীয় জ্ঞানকা-ে যে মুক্তচিন্তার সূত্রপাত, যার ধারাবাহিক বিকাশের পরিণামে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে সৃষ্টির অফুরন্ত বিস্ময়, আঠারো শতকের শেষভাগে অন্য গোলার্ধে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা, ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব, ফ্রান্সে রাষ্ট্রবিপ্লব, বিশ শতকে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, এসবের শিহরণ ওই ঔপনিবেশিক সংযোগের সূত্র ধরেই এখানে উৎসুক মানব-চেতনাকে গ্রাস করে। আমাদের শোষণ করে ব্রিটেন সুবিধা ভোগ করেছে অবশ্যই। তবে যতটা বলি, তাতে আতিশয্য আছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মার্কেন্টাইল ধাঁচে একচেটিয়া ব্যবসা করতেই এসেছিল। উপনিবেশ স্থাপন গোলে-হরিবোলের পরিণাম। কোম্পানির স্বার্থ ও তার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বার্থ প্রায়ই ভিন্নমুখী হতো। মুক্তবাণিজ্যের পক্ষপাতী যারা, তাদের সঙ্গেই ভাব হয় আমাদের উনিশ শতকের প্রাগ্রসর চিন্তাবিদদের। ১৭৯৩-তে বাংলায় ভূমি রাজস্বব্যবস্থায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিষময় ফল ফলিয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু নীতিপ্রণেতাদের ফিজিওক্র্যাটিক সদিচ্ছার অভাব ছিল না। অন্তত অনেক বিজ্ঞ ঐতিহাসিক এমনটি বলেন (যেমন, রণজিৎ গুহ)। হঠাৎ জমিদার বনে যাওয়া বঙ্গ-সন্তানরা যে উৎপাদন বাড়িয়ে পুঁজি সৃষ্টি না করে কৃষকের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে মনের সুখে বিলাসিতায় মাতবেন, এটা সম্ভবত তাঁদের পুরোপুরি হিসাবের ভেতরে ছিল না। এটাও মনে রাখি, ভাস্কো-দা-গামার জলপথ আবিষ্কারের পর য়োরোপ থেকে বোম্বেটে থেকে ব্যবসায়ী ভাগ্যান্বেষী যারাই সমুদ্রযাত্রার ঝুঁকি নিক, তারা তা করে অসহনীয় দারিদ্র্য থেকে পালানোর পথ খুঁজতে, রাজ্যপ্রতিষ্ঠার তাগিদে নয়। এটা দুই আমেরিকায় ও অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে বসতি গড়ার বেলাতেও সত্য। এখানে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ততদূর যায়নি।
তবে তা পুষিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসক চক্র। যতভাবে পারা যায়, তারা পূর্ববাংলাকে শোষণ করেছে। একথা বারবার বলা, বারবার শোনা এবং তাতে অতিশয়োক্তি বিন্দুমাত্র নেই। তৈমুর লং, নাদির শাহ, আহমদ শাহ আবদালি, এদের ঐতিহ্যই বোধহয় ছিল তাদের প্রেরণা। একাত্তরে তাদের বীভৎসতা ওই ধারাতেই পড়ে। তবু বাঙালি সুযোগসন্ধানী ও বিকৃতমনাদের ভেতর এখনো তাদের অনুসারী মেলে এবং তারাও বাস্তবের এক সর্বনাশা উপাদান। ভবিষ্যতের কথা ভাবতে গিয়ে তাদের উপেক্ষা করলে কিন্তু আত্মঘাতী হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে।
একাত্তরে যে-বাংলাদেশের উদ্ভব, তা ছিল বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি। কিসিঞ্জার মনের ঝাল মিটিয়েছেন একে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে। শতকরা আশি ভাগের বেশি মানুষ গ্রামবাসী। তার প্রায় কাছাকাছি হার কৃষিজীবী পরিবারের। জাতীয় আয়ের শতকরা ষাট ভাগের মতো আসে কৃষি থেকে। প্রায় একশ চল্লিশ বছর আগে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘…দেশের মঙ্গল? দেশের মঙ্গল, কাহার মঙ্গল? তোমার আমার মঙ্গল দেখিতেছি, কিন্তু তুমি আমি কি দেশ? তুমি আমি দেশের কয়জন? আর এই কৃষিজীবী কয়জন? তাহাদের ত্যাগ করিলে দেশে কয়জন থাকে? হিসাব করিলে তাহারাই দেশ Ñ দেশের অধিকাংশ লোকই কৃষিজীবী।… ’ উনিশশো একাত্তরে এই দৃশ্যের মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয় না। আরো যোগ হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য,
ব্যাংক-ব্যবসা ও আমলাতন্ত্রে পরিকল্পিত অথবা নিজস্ব ঐতিহ্যপুষ্ট চারিত্রিক প্রবণতাসঞ্জাত শোষণ। পাকিস্তানের প্রধান রফতানি পণ্য তখন পাট ও পাটজাত দ্রব্য। দেশীয় মুদ্রার বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে রেখে পাটচাষিকে ঠকানো হয়। ব্যাংক-বীমা ব্যবসায়ে মালিকানা প্রায় একচেটিয়া ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি উদ্যোক্তাদের। তার মাধ্যমে এ-অঞ্চলের সঞ্চয় স্থানান্তরিত হয়ে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করে ওই ভূখ-ে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দখল সেনাবাহিনী, বিরাট ভূস্বামী ও ওপরতলার আমলা চক্রের হাতে। সামাজিক সম্পর্ক-সম্বন্ধে সবাই একই বনভূমির Ñ একই বিচরণক্ষেত্রের। সোনায় সোহাগা হয়ে সঙ্গে যোগ হয় আমেরিকার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা রানিস ও ফেই (১৯৬১)-এর উন্নয়ন তত্ত্ব, যাতে বোঝানো হয়, নতুন শিল্পখাত ছাড়া কৃষিখাতেও পুঁজি সৃষ্টির জন্য সেখানে সমর্থ বড়-বড় সামন্ত প্রভুকে বাড়তি প্রণোদনা দেওয়া জরুরি, যার অর্থ, তাদের দখলদারির সীমা বাড়ানো এবং তাকে নিষ্কণ্টক করা। তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানি সমাজব্যবস্থায় নতুন গজিয়ে ওঠা উঠতি পুঁজিপতিদের যুক্ত করে কায়েমি স্বার্থের শীর্ষস্থানীয় চতুর্ভুজকে প্রবল থেকে প্রবলতর করা। আরো একটু যোগ করি, এই তত্ত্ব বিখ্যাত লিউইস মডেলের সম্প্রসারণ এবং ওই মডেলের ভিত্তিভূমিতে আছে ধ্রুপদী অর্থনীতির তাত্ত্বিক ধ্যান-ধারণা।
তখন আইয়ুব শাহী জামানা। এর অভিঘাত আমাদের ভূখ-েও পড়ে। শোষণের চোরাপথ তো আছেই। তার সঙ্গে আরো যোগ হয় কৃষিতে বৈষম্য বাড়ানোর এই নিনাদ। এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই শেখ মুজিব-তাজউদ্দীন নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচির ঘোষণা (১৯৬৬)। তারই চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ১৯৭০-এ অখ- পাকিস্তানে একমাত্র সাধারণ নির্বাচন, যার যৌক্তিক পরিণাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রক্তাক্ত অভ্যুদয়।
কথাগুলো বলা, আমরা এর বিপরীতে কী চেয়েছিলাম, তা বোঝানোর জন্য। ১৯৭২-এ রচিত হয় আমাদের সংবিধান। রাষ্ট্রের চার মূলনীতি নির্দিষ্ট হয় Ñ বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। এই সমাজতন্ত্র অবশ্য কেতাবি শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্বের ভিত্তিতে নয়, তা বাজারের কর্মকা- চালু রেখেও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় শোষণহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে। এতে যা প্রথমেই চোখে পড়ে, তা হলো, যে-কোনো কর্মকা-ে কারো বেতনের ঊর্ধ্বসীমা ওই সময়ে পাঁচশো টাকায় বেঁধে দেওয়া ও সর্বোচ্চ দশটা ধাপের ভেতর বেতন-কাঠামো নির্ধারণ করা। পারিপার্শ্বিক চাপে এই নির্দেশ বজায় রাখা যায়নি। পর্যায়ক্রমে প্লাবন ও অনাবৃষ্টির কারণে কোনো কৃষি-সংস্কার সম্ভব হয়নি। ক্ষুদ্র কিন্তু প্রভাবশালী এক সচ্ছল জনগোষ্ঠীর আচরণে পাকিস্তানি প্রতিপত্তির বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার অচরিতার্থতায় যোগ হয় চুয়াত্তরে দুর্ভিক্ষের কশাঘাত। বঙ্গবন্ধুর কাছে এ মর্মান্তিক। তিনি এবার তুলনায় সক্রিয় সমাজবাদের পথে অগ্রসর হওয়ার নীতিমালা ঘোষণা করেন। তার প্রধান দুটো বৈশিষ্ট্য হলো, বাংলাদেশের আদর্শে বিশ্বাসী সব জনগণকে নিয়ে একদলীয় (বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ Ñ বাকশাল) গণতন্ত্র ও কৃষিতে বাধ্যতামূলক সমবায় ব্যবস্থা। কোনোটিরই কার্যকারিতা পরীক্ষিত হয়নি। সামরিক ও রাজনৈতিক এক দুষ্টচক্রের অভ্যুত্থানে সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। বাইরে থাকায় দুই কন্যার পরিবার শুধু রক্ষা পায়। তারপর থেকে একুশ বছর চলে প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে পাকিস্তানি ভাবধারাপুষ্ট সমর শাসন। এবং সেই আত্মস্বার্থতাড়িত আচরণের অভ্যাস বাসা বেঁধেছে বেশ কিছু মানুষের মনে। তার পরেও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসে ১৯৯৬ সালে। কিন্তু নিজেদের সংহত করতে পারে না। ২০০১-এ আবার এক প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে ক্ষমতার দখল নেয় প্রতিক্রিয়াশীল-মুক্তিসংগ্রামবিরোধী চক্র। অনেক জল ঘোলা করার পর অবশ্য আওয়ামী লীগ আবার জয়ী হয় ২০০৯-এ জনগণের রায়ে। এখনো তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। যদিও দুষ্কৃতি-চক্র কোনো সময়েই নিষ্ক্রিয় নয়।
এই পশ্চাৎপট মাথায় রেখে এবার আমরা বাংলাদেশের কৃষিতে সমবায় নীতি চালু করার বিষয়টি নিয়ে ভাবি। তবে তার আগে এখনকার বাস্তব অবস্থাটার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিই। এটা ১৯৭১ নয়। ১৯৭৫-ও নয়। পদ্মা-যমুনা-মেঘনা বেয়ে অনেক জল গড়িয়ে সাগরে পড়েছে। পঁচাত্তরে আমাদের অস্তিত্ব হেলে পড়েছিল আত্মবিনাশী ঘাতক চক্রের দিকে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় যারা চায়নি, তারাই তার মাথার ওপর চেপে বসে ছড়ি ঘুরিয়েছে। সমাজ আবার পাকিস্তানি ভাবধারায়, পাকিস্তানি বিন্যাসে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে। অতীতের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে যায়নি। সুবিধাবাদী-সুবিধাভোগী পুরনো মত্ততা আবার ফিরে আসে। অভ্যাসে বিকার জমে। কিন্তু তার দখল পুরো হয় না। বাঙালির সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক উজ্জীবনের সাধনা একেবারে বৃথা যায় না। দ্বান্দ্বিক বাস্তবতা সমানতালে চালু থাকে। তবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পঁচাত্তরের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা আর ভাবা যায় না। বিশ্ব অর্থব্যবস্থাতেও ঘটে চলে অপ্রত্যাশিত সব ঘটনা। ষাটের দশকেই
কৃষিবিজ্ঞানী বোরলোগ জমির পৌনঃপুনিক ব্যবহারের ও উৎপাদিকা শক্তি বাড়ানোর নতুন কৌশল তুলে ধরেন। উপাদান সমন্বয়ে চাই সার, উচ্চফলনশীল বীজ, উপযুক্ত সেচ ও কীটনাশক। যথাযথ প্রয়োগে প্রতিটির মাত্রায় কম-বেশি যেন না হয়। গরিব চাষির জন্য আর-একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঋণ। শুধু অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের জন্য নয়, উৎপাদনের উপকরণগুলো ব্যবহারের জন্যও। কৃষি আর শ্রম-নিবিড় মাত্র থাকে না। পুঁজির ঘনত্বও বাড়ে। তবে তা জমির আয়তন-নিরপেক্ষ। ছোট খামার বড় খাবার, উভয়ের বেলাতে এর অনুপাতে তারতম্য তেমন ঘটে না। বাংলার কৃষক নিজের গরজেই এতে রপ্ত হতে শুরু করে। গোটা দেশই কিন্তু তাতে টিকে থাকার একটা অবলম্বন পায়।
আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যে রিগ্যান-থ্যাচার নির্দেশিকা মূলত ধ্রুপদী জোগানতাড়িত ব্যবস্থাপনাকে দাপটের সঙ্গে চালু করে। বিশেষ মদদ পায় তথ্যপ্রযুক্তিতে অভাবনীয় বিপ্লবে, অর্থনীতিতে বিশ্বায়ন যার অনিবার্য পরিণাম। উন্নয়নকামী গরিব দেশগুলো বাজার খুলে দিতে যে বাধ্য হয়, তাতে বিশ্বায়িত পুুঁজির উদ্যোগ পরিকল্পনা আপেক্ষিকভাবে অদক্ষ শ্রমনির্ভর টুকিটাকির বেশ কিছুর ভাগ তাদের কপালে জোটে। হতে পারে তা রফতানিমুখী হালকা পণ্যের সস্তা উৎপাদন, যেমন কাটা কাপড়ের ব্যবসা, বিশ্ববাজারে বরাত পেয়ে জাতে উঠে হয় পোশাকশিল্প অথবা উন্নত প্রযুক্তির ভগ্নাংশ সব যান্ত্রিক নিয়মানুবর্তিতায় অল্প বিদ্যার শ্রম নিয়োগে তৈরি করে কেন্দ্রাভিমুখে পাঠানো, যেমন কম্পিউটার-ইলেকট্রনিক চূড়ান্ত পণ্যের যন্ত্রাংশ বানিয়ে মূল খরিদ্দারের চাহিদা মেটানো। বিকল্প কিছু খোলা থাকে না। কারণ সত্তরের দশক থেকে নড়বড় করতে-করতে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় এসে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। একচেটিয়া দক্ষ জোগানে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার নিদর্শন হয়ে ওঠে গণচীন। সমুদ্রপথে পরিবহনকা-েও বিস্ময়কর উন্নতি ঘটে। ডক্টর নজরুল ইসলামও বারবার সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এর সঙ্গে যদি তুলনা করি কোম্পানি আমলের প্রথমদিকে সমুদ্র-বাণিজ্যের ঝুঁকির, তবে তফাতটা খুব প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। তখন ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ থেকে ভারতবর্ষে এক-একটি বাণিজ্য-অভিযান শেষ করে দেশে ফিরতে আনুমানিক এক বছর সময় পেরিয়ে যেত। কখনো-কখনো তারও বেশি। সামুদ্রিক ঝড়ে জাহাজডুবির আশঙ্কাও কম ছিল না। প্রায়ই অভিযাত্রী দলের অর্ধেকেরও বেশি অসুখ-বিসুখে, বোম্বেটে আক্রমণে অথবা জাহাজ বিকল হওয়ায় ফৌত হয়ে অবশিষ্টরা ঘরে ফিরত।
এই প্রেক্ষাপটে আজ আবার বাংলাদেশে কৃষি সমবায়ের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন আছে কিনা, তা ভাবতে হয়। সত্য কথা, রবীন্দ্রনাথ একে শুধু উৎসাহই দেননি, এই বাংলায় নিজের জমিদারিতে, পরে শ্রীনিকেতনে এর প্রাতিষ্ঠানিক রূপও গড়ে তুলেছিলেন। সবাই ধন্য-ধন্য করেছে, এখনো করে। কিন্তু কেউ তাঁকে অনুসরণ করেনি। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’ Ñ অতিমহৎ প্রেরণামন্ত্র। তবে ব্যর্থ হলে তার দায় কিন্তু তুলনায় অনেক বেশি ভারি। গান্ধীজির শিষ্য আচার্য বিনোবা ভাবে অহিংস বিপ্লব করার ব্রতে স্বেচ্ছায় ভূদান যজ্ঞের আহ্বান দিয়ে সারাদেশ চষে বেড়ান। নিট ফল শূন্য। পরিশেষে ব্যর্থ আচার্য প্রায়োপবেশনে (স্বেচ্ছায় অনশনে) দেহত্যাগ করেন। বিশ্ব রঙ্গমঞ্চেও তার উদাহরণ উৎসাহ বাড়ায় না। সোভিয়েত ইউনিয়নে কৃষি-সমবায় ছিল পরিকল্পিত অর্থনীতির দুর্বলতম অংশ। চীনে ১৯৫৮-৬১-তে বৃহৎ উল্লম্ফন উদ্যোগে (great feap forward) বা দুপায়ে হাঁটা(walking on two legs) কর্মকাণ্ডে দুর্ভিক্ষে তিন কোটির ওপর প্রাণ যায়। নীতি পালটাতে মাও জে দং বাধ্য হন। তবে শোধ নিতে চান সাংস্কৃতিক বিপ্লবের উৎকট কর্মধারায়। তারও কোনো সুফল ফলেনি। অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু অনুমান, কোনো কৃষকই স্বেচ্ছায় আপন জমিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার হারাতে চায় না। বিভিন্ন মাপের জমির সমবায়ে পারস্পরিক অবিশ্বাস হানা দেয়। জমির মালিকানায় সমজাতীয়তা না থাকলে ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো মজবুত না হলে স্বতঃস্ফূর্ত হলেও সমবায় দাঁড়ায় না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঝুঁকি। কৃষি উৎপাদনে তা থাকবেই। সেখানে ক্ষতির ভাগাভাগি নিয়ে টানাপড়েন এড়ানো মুশকিলই।
তবে সমবায় সেভাবে পরীক্ষিত না হলেও বাংলাদেশে কৃষিকে কিন্তু ব্যর্থ বলা যাবে না। একাত্তরে মোট শস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল দশ মিলিয়ন টনের মতো। তা বেড়ে এখন চল্লিশ মিলিয়ন টন ছুঁইছুঁই। এদিক থেকে দেশকে স্বয়ম্ভরই বলা যায়। উৎপাদন বাড়ানোর কৃৎ-কৌশল ছোট কৃষকেরও জানা। সমীক্ষায় ধরা পড়ে, বড় কৃষকের তুলনায় ছোট কৃষকের দক্ষতাই বেশি। অবশ্য খামারের নিট গড় আয়তন ছোট হতে হতে এখন দাঁড়িয়েছে ১.২৫ একরের মতো। জনসংখ্যা বাড়ার ফলে নিট চাষযোগ্য জমির পরিমাণ গত পঁয়তাল্লিশ বছরে মোট ১ মিলিয়ন একরের মতো কমেছে। তবে অধিকাংশ জমি অন্তত দো-ফসলি। মোট চাষের নিবিড়তার পরিমাপ প্রায় ২০০। এতে একদিকে যেমন তিন ফসলি জমি আছে, অন্যদিকে তেমন আছে জলাবদ্ধতা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক কারণে এক ফসলি জমি। ১৯৭৪-এ এখানে দুর্ভিক্ষ হওয়ার একটা বড় কারণ ছিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পি.এল. ৪৮০ সূত্রে খাদ্য সহায়তা ঠিক ক্রান্তিলগ্নে প্রত্যাহার করা। উদ্বৃত্ত কৃষি পরিবারও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায় ফসল বাজারে না ছেড়ে ধরে রাখে। বিপদ যা ঘটার ঘটে যায়। তেমন আশঙ্কা এখন কিন্তু চোখ রাঙায় না। যদিও জনসংখ্যা তখনকার সাত কোটি তেষট্টি লাখ (১৯৭৪-এর ১ মার্চ) থেকে বেড়ে এখন ষোলো কোটি ছাড়িয়েছে। গত দশ বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শতকরা বার্ষিক আনুমানিক ১.৪ থেকে ১.২-এ এসে ঠেকেছে। খাদ্যশস্য বৃদ্ধির হার কিন্তু দু-একটা ব্যতিক্রম বাদে মোটামুটি শতকরা ৪-এর ওপরে থেকেছে।
উৎপাদন কাঠামোও কিন্তু আগের জায়গায় নেই। যে-প্রেক্ষাপটে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে নামতে বাধ্য হয়েছিলাম, যেখানে ভূখ-ের পরিচয় ছিল অনুন্নত কৃষিনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতি, সেখানে আজ বাংলাদেশে মোট জাতীয় আয়ে কৃষির অনুপাত প্রায় ১৮ শতাংশ, যেখানে শিল্পখাত থেকে আসে শতকরা প্রায় ৩২ ভাগ ও সেবাপণ্য থেকে আনুমানিক শতকরা পঞ্চাশ ভাগের মতো। জনসংখ্যার নিবেশনও পালটেছে। এখন শতকরা প্রায় চল্লিশভাগের মতো মানব-মানবী শহরবাসী। এর নিচে অবশ্য অন্য একটা পরিবর্তন ক্রিয়াশীল। আগে উপজেলা বা থানা সদর অধিকাংশ ছিল গ্রামাঞ্চল। এখন তারা সবাই শহর বলে গণ্য। তবে তার চেয়ে বড় কথা, বিদ্যুৎব্যবস্থা পৌঁছে গেছে শতকরা ৭০ ভাগের ওপর গ্রামে। সেচব্যবস্থার উন্নতিতে এর ভূমিকা কম নয়। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার চোখে পড়ে হতদরিদ্র গ্রামীণ পরিবারেও। গ্রাম-শহরের ব্যবধান যে শুধু কমেছে তা-ই নয়, টেলিভিশন ও মোবাইল ফোন প্রত্যন্ত গ্রামকেও যুক্ত করেছে বহির্বিশ্বের সঙ্গে। আমাদের অজান্তেই আমরা কিন্তু বদলে যাচ্ছি। সবটা যে হজম হচ্ছে, তা বলি না। কিন্তু অনিশ্চয়তাকে না মেনে নিলে উন্নয়নও তো সম্ভব নয়। এখন শতভাগ ছেলেমেয়ে প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ নেয়। সবাই টেকে না। কিন্তু প্রায় পনেরো লাখ ছেলেমেয়ে বছরে মাধ্যমিক স্তর অতিক্রম করছে, একে খাটো করে দেখার উপায় নেই। শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে ছেলেমেয়ের ব্যবধান ক্রমহ্রাসমান। প্রাথমিক স্তরে মেয়েদের অনুপাতই কিঞ্চিত বেশি। অনুমান করি, গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রয়োজনের তাগিদে ছেলেরাই তুলনায় বেশি ঝরে পড়ে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অবদানও একটা আছে। তখন যে অধিকাংশ পরিবারের নিরাপত্তার জন্য ছোটাছুটি, দেশান্তরি হয়ে, দেশের ভেতরেও Ñ পাড়া থেকে পাড়ায়, গ্রাম থেকে গ্রামে মাথা গুঁজে পালিয়ে থাকা তার অনিবার্য পরিণাম, মেয়েদের সচলতা বাড়া, বাইরের কাজেও তাদের দৃশ্যমান করা। ভালো বা মন্দ বলে এতে তকমা আঁটা যাবে না। এটা ঘটমান। আমরা পরিবর্তনের পথে। একে ঠেকাতে চাওয়া মানে সজ্ঞানে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া। আজ আমরা এও জানতে পাই, এদেশে একজনের গড় প্রত্যাশিত আয়ু ৭১ বছরের কিছু বেশি। এবং সেখানে তুলনায় বেশিদিন বাঁচার সম্ভাবনা মেয়েদেরই। এই তথ্য আমাদের উৎফুল্ল করে।
তাই বলে কি দুর্ভাবনার কোনো কারণ ঘটে না? অবশ্যই ঘটে। অন্তত আমি তা এড়াতে পারি না। আগেই বলেছি, আমাদের জনসংখ্যা ষোলো কোটির ওপর। সম্ভবত ঘনত্বের দিক থেকে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি। অবশ্য সিঙ্গাপুরের মতো নগররাষ্ট্রের কথা ভাবছি না। বৃদ্ধির হার যথেষ্ট কমেছে। কিন্তু তার পরেও দুশ্চিন্তা থাকে। বালতি ভরে গেলে কলের মুখ থেকে টিপ-টিপ করে জল পড়লেও তা উপচে পড়ে। যেমন খুশি ছড়ায়। চারপাশ নষ্ট করে। নষ্ট হয়। আমাদের জনসংখ্যা এখন উপচেপড়া অবস্থাতেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধি মানে বাড়তি শ্রমের জোগান। শ্রম মানে মৌলিক উৎপাদিকা শক্তি। এমন যুক্তি ততক্ষণই খাটে, যতক্ষণ ওই শ্রমের সুনিযুক্তির সম্ভাবনা থাকে, এবং সবার খাওয়া-পরা-বাসস্থানের এবং প্রকৃতির ও অন্যান্য মানুষের সঙ্গে আনন্দময় সংযোগের স্বাভাবিকতা ও স্বাচ্ছন্দ্য বজায় থাকে। বলা যায়, মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর বিকাশ এতদিন এ-সমস্যার মোকাবিলা করে এসেছে। কিন্তু আরো কতদূর তা সম্ভব? ম্যালথাসের মতো করে নয়, বিশ্বপরিবেশকে যেভাবে বিকৃত ও ধ্বংস করে চলছি, সেদিকে তাকিয়েই আদৌ নিশ্চিন্ত বোধ করতে পারি না। বিশ্ব জনসংখ্যা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ছিল দুশো কোটি। এখন তা ৭০০ কোটি পেরিয়ে ৮০০ কোটির দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। মানুষের অধিকার বাড়ানো মানে প্রকৃতিকে বিনষ্ট করা। তা থেকে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা যেসব ভূখ-ে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। এবং যতদূর জানি, ডক্টর নজরুল ইসলাম এ-সমস্যা নিয়ে গোটা পৃথিবীতে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের ভেতরে অগ্রগণ্য। সমগ্র বিশ্বের প্রেক্ষাপটে সম্পদের ন্যায়সম্মত বণ্টন কীভাবে করা যায়, সেটি দেখার।
আরো একটি বিষয় ভাবায়, তা হলো আমাদের শিল্পায়নের ধরন। শ্রমঘন অদক্ষ প্রযুক্তিনির্ভর ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এই কারবার বিশ্বমন্দার সময়েও, বলা চলে তাঁর কারণেই, ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তির বিন্যাসেও স্বদেশে তার প্রভাব পড়েছে। কোনো মূল্যবোধ আরোপ না করেও অনুমান করি, এতে মুদ্রার পুরনো আচরণবিধি ‘গ্রেশামস ল’ চালু হওয়ার আশঙ্কা।
একই রকম প্রতিক্রিয়া ঘটে চলেছে আমাদের জনসংখ্যা রফতানি কার্যক্রমের অনুসরণে। বাস্তব এই, যেসব অঞ্চলে তাদের রফতানি, সেগুলো প্রাকৃতিক সম্পদে ধনী, কিন্তু জীবন-ভাবনায় দীন। আমাদের অর্ধশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন দরিদ্র রফতানিকৃত মানবসম্পদ কোনো মুক্ত মন নিয়ে দেশে ফেরে না। এদিকে তাদের পাঠানো উপার্জনে গ্রামে তাদের পরিবারের জৌলুস বাড়ে। উচ্চাভিলাষী যারা, তারা শহরে বসতি গড়ে। জনসংখ্যার নিবেশনে এখানেও একই গ্রেশামস ল বিকৃতি ঘটিয়ে চলেছে। আগামী দিনের বাংলাদেশে এর কি কোনো প্রভাব পড়বে না?
এরই বিপরীতমুখী আর-একটা স্রোত একাত্তরের পর থেকেই বইতে শুরু করে। জনসংখ্যা রফতানি নীতির মতো তেমন চোখে পড়ে না, কিন্তু আমার বিবেচনায় তাতে আর-এক ধরনের বিপর্যয় নিঃশব্দে আমাদের গ্রাস করছে। আমাদের মেধাবী ছেলেমেয়েরা পাশ্চাত্যের উন্নত বিশ্বে নিজেদের যোগ্যতার উপযুক্ত স্বীকৃতি পেলে আর ফিরে আসে না। সেসব জায়গাতে আমাদের ডায়াস্পোরা গড়ে উঠতে থাকে। দেশে মেধার তুলনামূলক ঘাটতি বাড়ে। ব্যাপারটার সংক্রমণ চোখে পড়ার মতো। বঙ্কিম যাদের বলেছিলেন ‘চশমা নাকে বাবু’ আমাদের সে শিক্ষিত বাঙালি সম্প্রদায়ের আজকের ধ্যান-জ্ঞান, তাঁরা অভিবাসী হবেন, তাঁদের বাবা-মা বছরে-দুবছরে অন্তত একবার তাঁদের ‘ভিজিট’ করে আসবেন। এমনটি পঞ্চাশের দশকে ছিল না। তাই ভাষা-আন্দোলন হয়েছে। বাংলাদেশের ভিত্তি রচিত হয়েছে। ষাটের দশকে সিএসপি ছেলে বা জামাইয়ের জন্য অনেকের জিভে লালা ঝরেছে। কিন্তু সেরা মেধাই পেয়েছি। এখন বোধহয় সেকেন্ড বেস্ট ছাড়িয়ে থার্ড বেস্টের তত্ত্ব আমরা খাড়া করছি। আগামী দিনের বাংলাদেশে তার প্রভাব কি কিছু পড়বে না?
সত্তর বছর আগে প্রথম স্কুলে ভর্তি হই। ক্লাস টুতে। বাংলা পাঠ্যবইতে একটা কবিতা পড়েছিলাম। (সত্যেন দত্তের কি?) প্রথম কটি চরণ আবছা মনে পড়ে : ‘কোন দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল?/ কোন দেশেতে চলতে গেলে দলতে হয়রে দূর্বা কোমল?/ কোথায় ফলে সোনার ফসল, সোনার কমল ফোটেরে?/ সে আমাদের বাংলাদেশ! আমাদেরই বাংলা রে!’… কবিতাটি আজ থেকে নিশ্চয় শতাধিক বছর আগের লেখা। যখন ক্লাস টুতে পড়ি, তখন একে অবিসংবাদিত বলে মনে হয়েছে। কিন্তু আজ মনে সংশয় জাগে। ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে একা-একা। মাঠ নেই, গাছপালা নেই আশপাশে। কার্টুন আর কম্পিউটার গেম, এই তার জগৎ। নইলে শূন্যস্থান পূরণে মাদ্রাসা-মক্তব। আমার বাংলাদেশের সঙ্গে আগামী দিনের বাংলাদেশ মিলবে না। তেমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভালো হবে কি? পরিবেশ দূষণ ও জনসংখ্যার চাপ কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলবে? 