সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র কাঁদো নদী কাঁদো এবং বাংলা কথাসাহিত্যে নতুন ধারা   

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এমন এক প্রতিভাবান কথাশিল্পী যিনি যুগপৎ বিষয় ও আঙ্গিকে তাঁর সমকালীন তথা প্রচলিত বৈশিষ্ট্যকে অতিক্রম করে এমন এক শিল্পরীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি সমৃদ্ধ মাত্রার সংযোজন করেছেন যা অভিনব ও স্বতন্ত্র, সর্বোপরি তা বাংলা কথাসাহিত্যে নতুন ধারা হিসেবে গৃহীত এবং বলিষ্ঠ ধারায় বহমান। দীর্ঘ কুড়ি বছরে তিনি মূলত তিনটি উপন্যাস লিখেছেন (লালসালু ১৯৪৮, চাঁদের অমাবস্যা ১৯৬২, কাঁদো নদী কাঁদো ১৯৬৮। এছাড়া অবশ্য প্রবাসের সংকট নিয়ে তাঁর How does one cook Beans নামে একটি ইংরেজি উপন্যাসও রয়েছে)। তিনি তাঁর প্রতিটি উপন্যাসে প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে যেমন নতুন ভাষাভঙ্গিতে অভিনব বিষয় উপস্থাপন করেছেন, তেমনি প্রতি ক্ষেত্রেই নিজেকে অতিক্রম করে গেছেন। তাঁর সব উপন্যাসে যা কমন বা বহমান তা হচ্ছে অস্তিত্ববাদ। কিন্তু এই অস্তিত্ববাদী চেতনাও একেক উপন্যাসে একেকভাবে, নানা বৈশিষ্ট্যে তার নানা দিক নিয়ে উপস্থিত। তবে তাঁর যে-উপন্যাসটি বাংলা কথাসাহিত্যের (গল্প ও উপন্যাস উভয়) ধারাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে এবং অনন্য বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল তা কাঁদো নদী কাঁদো। বক্ষ্যমাণ সন্দর্ভ মূলত কাঁদো নদী কাঁদোর এসব বিষয়ে আলোকপাতের প্রয়াস। কাঁদো নদী কাঁদো নিয়ে আলোচনার আগে প্রাসঙ্গিকভাবে আসে তাঁর লালসালু ও চাঁদের অমাবস্যার বিষয়।

লালসালুর কেন্দ্রীয় চরিত্র দরিদ্র, অনাহারী ভাগ্যান্বেষী মজিদ মহববতপুরে এসে মানুষের অন্ধ ধর্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে অশিক্ষিত, ধর্মভীরু, কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকজনের কাছে মিথ্যা গল্প ফেঁদে এক অনাদৃত কবরে মাজারের পত্তন করে প্রতিষ্ঠা পায়। তবে এই প্রতিষ্ঠা তার জীবনের প্রকৃত সাফল্য বা সুখ বয়ে আনে না। সন্তান না লাভের অতৃপ্তি থেকে দ্বিতীয় বিয়ে করে সে জমিলাকে ঘরে আনে আর এই জমিলাই তার প্রতিপক্ষ তথা চ্যালেঞ্জ হয়ে উপন্যাসে অস্তিত্ববাদী চেতনার মূল ধারক হয়ে ওঠে।

চাঁদের অমাবস্যার নায়ক আরেফ আলীও আসে একটি দরিদ্র পরিবার থেকে। পাশের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও অর্থের অভাবে তার বিএ পড়া হয় না। সামান্য আয়ের শিক্ষকতা নিয়ে বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে বড়বাড়ির আশ্রয়ে তাকে থাকতে হয় আর এখানেই পরোক্ষভাবে একটি খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে তার জীবন ও চেতনালোক প্রবলভাবে আলোড়িত হয়, যা প্রকাশের বাহন হিসেবে ওয়ালীউল্লাহ্ চেতনাপ্রবাহরীতিকে ব্যবহার করেন। এখানে তার বিবেকতাড়িত মনোজগতের দ্বন্দ্ব, তা থেকে সত্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে অস্তিত্ববাদী চিন্তা-চেতনা মূর্ত হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে লালসালু ও চাঁদের অমাবস্যা দুটি উপন্যাসেরই মূল বাণী ধর্মীয় বিশ্বাস (ধর্মীয় কুসংস্কার তো বটেই) বা মূল্যবোধের ঊর্ধেব উঠে স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্য, মহিমায় অস্তিত্ববাদী চেতনাকে বিকশিত করে।

এভাবে নিজেকে অতিক্রমের ধারাবাহিকতায় তাঁর শেষ এবং চূড়ান্ত ফসল কাঁদো নদী কাঁদো। এখানে তিনি তাঁর পূর্বরচিত উপন্যাস যথাক্রমে লালসালু, চাঁদের অমাবস্যাকে আঙ্গিক ও চিন্তা-চেতনা উভয় দিক থেকে অভিনব দক্ষতায় অতিক্রম করে গেছেন। এই উপন্যাসের একটি উল্লেখযোগ্য দিক চেতনাপ্রবাহরীতির সার্থক প্রয়োগ। যদিও চাঁদের অমাবস্যায়ও ওয়ালীউল্লাহ্ চেতনাপ্রবাহরীতিকে সার্থকভাবে প্রয়োগ করেছেন, কিন্তু এক্ষেত্রে তার প্রয়োগ বিশিষ্টতার দাবিদার এবং তা বাংলা কথাসাহিত্যকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে।

বিষয় ও শিল্প বিচারে বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে এক ব্যতিক্রমধর্মী, অভিনব ও গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস কাঁদো নদী কাঁদো। এ-উপন্যাসে ব্যক্তি ও সমাজজীবন, তার সংকটকে রহস্য ও প্রশ্নের মধ্য দিয়ে এক সমৃদ্ধ শৈল্পিক জটিলতায় উপস্থাপন করা হয়েছে। এখানে কুমুরডাঙ্গা নামের দরিদ্র মহকুমা শহরের জনজীবন, স্টিমারঘাট উদ্বোধনকালে স্থানীয় হিন্দু জমিদারকে আমন্ত্রণ না জানানোর ফলে তার লেলানো লাঠিয়ালদের দৌরাত্ম্য তথা প্রতিশোধস্পৃহা বা পেশিশক্তির আধিপত্য, বাকাল নদীতে চর পড়ায় অনিশ্চিতকালের জন্য তার স্টিমারঘাট বন্ধ হওয়া, তাতে চাকরি হারানো কর্মচারী খতিব মিঞার অসহায়ত্ব, বন্ধ ঘাট নিয়ে উকিল কফিল উদ্দিনের ধারণা, তা চালুর জন্য তাঁর তথাকথিত সংগ্রাম বা প্রচেষ্টা, নতুন হাকিম মুহাম্মদ মুস্তফা ও তাঁর বাগদত্তা খোদেজার মৃত্যু বা আত্মহত্যা রহস্য, তাৎপর্যপূর্ণ এক নির্মোহতায় আক্রান্ত ডাক্তার বোরহানউদ্দিন – সমাজের রোগগ্রস্ত মানুষ সম্পর্কে তার ধারণা-বিশ্বাস, মানুষের নদীর কান্না শোনা প্রভৃতি বিষয় যে শুধু এক নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হয়েছে তা নয়, এসব এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশেস্নষণ করে তাতে অভিনব মাত্রা দেওয়া হয়েছে।

কাঁদো নদী কাঁদো মূলত চেতনাপ্রবাহরীতিতে (stream of consciousness) রচিত। এতে চেতনায় প্রবহমান ধারার মাধ্যমে চরিত্র, আখ্যান ও তার অন্তর্গত বাণী রূপায়িত হতে থাকে। ভাবনার প্রবাহ (ইনটেরিয়র মনোলগ), ফ্ল্যাশব্যাক, ফ্ল্যাশফরোয়ার্ড তথা চেতনাপ্রবাহরীতির মাধ্যমে তা প্রকাশ করতে গিয়ে যে-কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে তা উপন্যাসটিকে জটিল করে তুলেছে। বস্ত্তত চেতনাপ্রবাহরীতির জটিলতম কৌশলই এখানে প্রয়োগ করা হয়েছে। কিংবা লেখক এক্ষেত্রে চেতনাপ্রবাহরীতি এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যে, তা এমন জটিল হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই জটিলতা আসলে শৈল্পিক ঘোর নির্মাণ এবং তা এই উপন্যাসের বহুকৌণিক বিষয় বা তার আবেদনের দাবি। চেতনাপ্রবাহের শৈল্পিক ঘোরে নদীর সর্পিল, পাক-ধরানো ঊর্মিমালায় কাঁদো নদী কাঁদো আশ্চর্য গতি পায়। উপন্যাসটি সম্পর্কে মিরন মহিউদ্দীন বলেন, ‘জীবনের গতিধারা নদীর মতো চঞ্চল, কল্লে­vলময়, কখনও বিক্ষুব্ধ, কখনও  হতচেতন, কখনও লাবণ্যময়, কখনো নিরুৎসাহ ও বিশুষ্ক।’ জীবনকে এ-নদীর সঙ্গে তুলনা করে জীবনের আক্ষেপ ও অসহায়তাকে, অহমিকা ও চাতুর্যকে, বিশ্বাস ও মিথ্যাচারকে একটি চিরকালীন সময়ের বিন্দুতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসে। এতে আমরা সময়কে অনমেত্মর বিস্তারের মধ্যে সর্বসময়ের একটি আকুল বিন্যাস হিসেবে পাই।

উপন্যাসটির পরিকল্পনা, প্রকরণ ও শৈলীগত অভিনবত্ব সত্ত্বেও এবং কাহিনি বর্ণনার এক বিশেষ ধরন ও বাঁকানো ধাপ অতিক্রম করার পদ্ধতি গ্রহণের পরও উপন্যাসের কাহিনিগত মৌল কাঠামো একেবারেই বঙ্গজ এবং পূর্ববঙ্গীয় মুসলিম বাঙালি পরিবারের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনার মতোই আটপৌরে।

কাহিনি পট ও পটভূমি নির্মাণে ওয়ালীউল্লাহ্ বাংলাদেশের, বিশেষ করে বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের সামাজিক আবহকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে ধারণ করেছেন। তবে এ-কাহিনির যুক্তিসংগত অথচ নিরীক্ষাধর্মী উপস্থাপনার স্থাপত্যটি তাঁর নব-নব উদ্ভাবনা ও একটি রচনা থেকে অন্য রচনায় ভিন্ন প্রকরণ ও প্রযুক্তি গ্রহণের সুন্দর নজির।’১  বস্ত্তত এভাবে এক অসাধারণ দক্ষতায় তিনি বাংলা

কথাসাহিত্যে এক নতুনতর আঙ্গিক সংযোজন করেন।

কাঁদো নদী কাঁদো শুরু হয়েছে একেবারে শেষ থেকে অর্থাৎ সবকিছু ঘটে যাওয়ার পর। এক্ষেত্রে চেতনাপ্রবাহরীতিতে ফ্ল্যাশব্যাক করে সুকৌশলে সমগ্র বিষয়টি তুলে আনা হয়েছে। উপন্যাসটি তার প্রধান কোনো চরিত্রের চেতনায় বাঙ্ময় হয় না, তেমন কোনো চরিত্রের বয়ানে তো নয়ই, যার (তবারক ভুইঞা)

স্মৃতি-অনুষঙ্গবাহী আত্মসংলাপে এর বিভিন্ন বিষয় বা ঘটনা বর্ণিত হয় সেও আসলে কাঁদো নদী কাঁদোর মূল উপস্থাপক নয়, যার মাধ্যমে চেতনাপ্রবাহরীতিতে তা বাঙ্ময় হয়ে ওঠে বস্ত্তত তিনি এক সর্বজ্ঞ। পাঠককে প্রথমত সর্বজ্ঞ এই ঔপন্যাসিক, পরে তবারক ভুইঞার আত্মসংলাপকে অবলম্বন করে মূল ঘটনা বা বিষয়ে পৌঁছতে হয়। এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বর্ণনা উপেক্ষা করে বিষয়কে এভাবে তৃতীয় পর্যায় বা স্তরে নিয়ে লেখক এক অসাধারণ দক্ষতায় শৈল্পিক জটিলতা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তা উপস্থাপন করেন, যার ফলে তা আশ্চর্য শিল্পসমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এভাবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ভাষা ও আঙ্গিক তথা উপস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলা কথাসাহিত্যে এক নতুন ধারারও প্রবর্তন করেন। নতুনতর যে-ভাষা তথা প্রকাশরীতি তিনি এক্ষেত্রে ব্যবহার করেন তা অন্যতম এক প্রকাশরীতি হিসেবে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে বহমান।

কাঁদো নদী কাঁদোর শিল্পরীতি সম্পর্কে জীনাত ইমতিয়াজ আলী বলেন, ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসের অন্তর্ময় স্বগতকথনরীতির (interior monologue) বহুবিধ (multiple) ব্যবহার অনেকাংশে স্যামুয়েল বেকেটের Malone Dies উপন্যাসের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। একাধিক দৃষ্টিকোণের ব্যবহার, অতীত ও বর্তমানের অন্তর্বয়নের মধ্য দিয়ে ঘটনার অগ্রগতি, চরিত্র-ভূমিকার অবস্থান বদল প্রভৃতি বিচারে কাঁদো নদী কাঁদো বেকেটের শিল্পরীতির সন্নিকটবর্তী। বিশেষ করে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষমাণ মালোন চরিত্রের সঙ্গে মুহাম্মদ মুস্তফার পরিণতির সাদৃশ্য উল্লেখযোগ্য। কিন্তু মালোনের বর্তমান উপস্থাপনের ক্ষেত্রেই কেবল অন্তর্ময়

স্বগতকথনমূলক পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে। তাঁর বহুমুখী স্মৃতিলোক মূলত বর্ণনাত্মক।’২ তার এই বক্তব্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বৈবাহিক ও চাকরিসূত্রেই হয়তো ফরাসি সাহিত্য বিশেষভাবে পাঠে আগ্রহী হন এবং তা তাঁর সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে। স্যামুয়েল বেকেট, আলবেয়ার ক্যামু, আয়েনেস্কো ফরাসি সাহিত্যের প্রমুখ প্রধান আধুনিক লেখকের রচনা পাঠ তাঁর ভেতরের সৃষ্টিশীল ক্ষমতাকে এক নতুনতর আঙ্গিক ছাঁচে ফেলে। স্যামুয়েল বেকেটের পাশাপাশি আলবেয়ার ক্যামুও তাঁকে প্রভাবিত করে বলে মনে হয়। বিশেষত বর্ণনার ডিটেইলিংয়ে। কাঁদো নদী কাঁদোর ডিটেইলিংয়ের সঙ্গে সাযুজ্য আছে দি ফলের, এমনকি তাঁর আউটসাইডার ও পস্ন্যাগের। উপন্যাসটির সঙ্গে পস্ন্যাগের ঘটনাবিন্যাস, ঘটনা বা বিষয়ের মাধ্যাকর্ষণ বা কেন্দ্রিকতা তথা আঙ্গিকগত মিল লক্ষণীয়। এক্ষেত্রে পস্ন্যাগ বা পস্ন্যাগের প্রতীকে বিশ্বযুদ্ধের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শহরবাসীর যার যার অবস্থান থেকে জড়িয়ে পড়া কাঁদো নদী কাঁদোর স্টিমারঘাট বন্ধ ও নদীর কান্নার সঙ্গে কুমুরডাঙ্গা নামের মহুকুমা শহরের জনজীবনের জড়িয়ে পড়া বিশেষ সাদৃশ্যপূর্ণ। পস্ন্যাগ থেকে উদাহরণ দেওয়া যাক –

শহরবাসী প্রতিদিন যা স্বচক্ষে দেখেছিল এ সংখ্যাটা যেন আরও স্পষ্ট আরও পরিষ্কার করে তার তাৎপর্য তাদের সামনে  মেলে ধরল, বিপদের সঙ্কট যেন আরও প্রকট হয়ে উঠল। সমস্ত ব্যাপারটা এতদিন পর্যন্ত একটা ঘৃণ্য দুর্ঘটনা বলে লোকে আক্ষেপ প্রকাশ করত। এবার সকলে বুঝল যদিও ব্যাপারটার যথার্থ প্রকৃতি আর উৎস তখনও তাদের অজানা, তবুও তার মধ্যে যেন কোন একটা বিপদের সূচনা উঁকি দিচ্ছে। শুধু সেই বুড়ো হেঁপো রুগীটা হাত-পা নেড়ে বার বার বলতে লাগল, ‘ওরা বেরুচ্ছে! ওরা বের শুরু করেছে!’ লোকটার কথায় কেমন যেন একটা অদ্ভুত ভীমরতির আনন্দ!৩

তবে জীনাত ইমতিয়াজ আলী যাকে ‘অন্তর্ময় স্বগতকথনরীতি (interior monologue)’ বলেন তা কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসের জন্য যথার্থ নয়। কারণ তিনি আসলে স্বগতকথনরীতি ও চেতনাপ্রবাহরীতিকে সমার্থক করে ফেলেছেন। কিন্তু

প্রকৃতপক্ষে এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট। যদিও অনেকেই stream of consciousness ও interior monologue এই দুই টার্মকে সমার্থকভাবে কিন্তু Oxford dictionary of Literary Terms-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী ‘They can also be distinguished psychologically and literarily. In a Psychological sense, stream of consciousness is the subject-matter, while interior monologue is the technique for presenting it.’ And for Literature … ‘while an interior monologue always presents a character’s thoughts ‘directly’, without the apparent intervention of a summarizing and selecting narrator, it does not necessarily mingle them with impressions and perceptions, nor does it necessarily violate the norms of grammar, or logic but the stream-of-consciousness technique also does one or both of these things.’

Encyclopedia Britannica উলিস্নখিত ব্যাখ্যার সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেও বলে these terms are often used interchangeably, তবে এক্ষেত্রে Encyclopedia Britannica-র সিদ্ধান্ত হচ্ছে, ‘While an interior monologue may mirror all the half thoughts, impressions, and associations that impinge upon the character’s consciousness, it may also be restricted to an organized presentation of that character’s rational thoughts.’

অন্তর্ময় স্বগতকথনরীতি নয়, আসলে পূর্বেই যা বলা হয়েছে, কাঁদো নদী কাঁদোর শিল্প-কৌশলের মূল ভিত্তি চেতনাপ্রবাহরীতি। এক্ষেত্রে চেতনাপ্রবাহরীতি কী বা এই রীতির স্বরূপ কী এবং কীভাবে, কতটা সার্থকভাবে কাঁদো নদী কাঁদোতে তার প্রয়োগ হয়েছে তা অন্বেষণ করা যেতে পারে। চেতনাপ্রবাহরীতি বলতে এমন এক বর্ণনাত্মক কৌশলকে বোঝায় যা ব্যক্তিক বা সমন্বিত চেতনায় বহমান বিচিত্র চিন্তা ও অনুভবকে কথাসাহিত্যে রূপ দেয়। যদি সরাসরি ডরশরঢ়বফরধ থেকে এর সংজ্ঞা দাঁড় করানোর প্রয়াস নেওয়া যায় তবে তা দাঁড়ায়, ‘Stream of consciousness is a narrative device used in literature ‘to depict the multitudinous thoughts and feelings which pass through the mind.

In-literary criticism, Stream of consciousness is a narrative mode that seeks to portray an individual’s point of view by giving the written equivalent of the character’s thought processes.

It is primarily a fictional device.’

বিশ শতকের প্রথমভাগে আধুনিক ঔপন্যাসিকরা সাধারণভাবে বর্ণনাত্মক এই কৌশল চেতনাপ্রবাহরীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তবে আঠারো শতকে লেওরেন্স স্টিমের মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস Tristram Shandy, Edgar Allan poe-র ছোটগল্প ‘The Tell-Tale Heart’সহ এর বেশকিছু পূর্ব-নজির লক্ষ করা যায়। উনিশ শতকের শেষদিকে চেতনাপ্রবাহরীতির তাৎপর্যপূর্ণ নজির Henry James-Gi Portrait of a lady (১৮৮১)। তবে চেতনাপ্রবাহরীতির পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে বিশ শতকের আধুনিক ঔপন্যাসিকদের হাতে যার শুরুর উদাহরণ হিসেবে Marcel Proust-এর In search of lost Time উলিস্নখিত হয়। তবে রবার্ট হামপেরি তা এই বলে নাকচ করে দেন যে, প্রউস্ট শুধু অতীত তুলে আনতে চেতনাকে ব্যবহার করেছেন যাকে চেতনাপ্রবাহরীতি বলা যায় না। ইংরেজি ভাষার লেখক Dorothy Richardson (১৮৭৩-৫৭) প্রথম তাঁর উপন্যাস Pilgrimage-এ চেতনাপ্রবাহরীতির সফল প্রয়োগ করেন এবং দ্য ইগোয়িস্টে তাঁর আলোচনাসূত্রে মে সিনক্লিয়ার সাহিত্যক্ষেত্রে প্রথম টার্মটি প্রয়োগ করেন। তবে চেতনাপ্রবাহরীতির প্রধান উপন্যাস হিসেবে উলিস্নখিত হয় James Joyce-এর Ulysses (first edition, 1922)। পরবর্তীকালেও চেতনাপ্রবাহরীতির চর্চা অব্যাহত থাকে এবং তাতে নানা বৈচিত্র্য যেমন আসে, তেমনি রচিত হয় অভিনব বিষয়ের সমৃদ্ধ উপন্যাস। উদাহরণস্বরূপ Virginia Woolf-Gi Mrs Dalloway (১৯২৫) ও To the Lighthouse (1927), William Faulkner-এর The Sound and the Fury-র কথা উল্লেখ করা যায়। বলা বাহুল্য, অদ্যাবধি এই চর্চা ব্যাপকভাবে অব্যাহত আছে। তবে ডরোথি রিচার্ডসন থেকে জেমস জয়েস (বিশেষত তাঁর Ulysses) পর্যন্ত চেতনাপ্রবাহরীতির যে-চর্চা হয়েছে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ মূলত তার বিষয় অনুযায়ী, প্রয়োজন অনুযায়ী তা ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত দক্ষতায় এবং তা তার সৃজন ক্ষমতায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র মহিমায়। তবে কাঁদো নদী কাঁদোর স্টাইলটি স্যামুয়েল বেকেটের সাহিত্যগুরু জয়েসের ইউলিসিসের কথাই বিশেষভাবে মনে করিয়ে দেয়। জয়েস সুকৌশলে একটি দিন বা ২৪ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে চেতনাপ্রবাহরীতিতে বিসত্মৃত পটভূমির অবতারণা করেছেন। এই সময়ে নায়ক লিওপল্ড বস্নুম ডাবলিন শহরে ঘুরছে, ভাবছে, নানান কিছিমের লোকের সঙ্গে (স্ত্রী মলি বস্নুম, সন্তানতুল্য যুবক স্টিফান ডেডালসসহ) তার দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে, চেতনায় ঘাই লাগছে, ঢেউ জাগছে আর চেতনা-চেতনের দেয়াল গলে সেখানে উদ্ভাসিত হচ্ছে তার মহাদেশের আড়াই-তিন হাজার বছরের সমন্বিত অতীত বা ইউরোপের যাবতীয় অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ও সৃষ্টি। এদিকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এক স্টিমারের যাত্রা থেকে গন্তব্যে পৌঁছার মধ্য সময়ে চেতনাপ্রবাহরীতিকে অবলম্বন করে এক বিসত্মৃত পটভূমির কুমুরডাঙ্গার সমাজ ও মানুষকে তুলে ধরেছেন, বস্ত্তত যা কিনা নদীনালা শৃঙ্খলিত পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের এক সামাজিক ইতিহাস। ব্যক্তি থেকে পরিবার ও সমাজ, ব্যক্তিচেতনা থেকে সমন্বিত গোষ্ঠী বা সমাজচেতনা এখানে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে যা কিনা ইউলিসিসের মতো মহাদেশ না হলেও এক উপমহাদেশের মানুষের সমন্বিত চেতনার দর্পণ। বস্ত্তত কুমুরডাঙ্গার অর্ধশতাব্দীর আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবনের মধ্যে কলোনিশাসিত, শ্রেণিবিভক্ত, শোষিত, ভীতিবিহবল, অনিশ্চয়তা আক্রান্ত মানুষের ইতিহাস বিনির্মিত হয়েছে।

আর ইউলিসিসে যেমন সামাজিক কারণে ব্যক্তিজীবন অনিশ্চয়তা, নিরাবলম্বতা, পরিচয় সংকট, সংখ্যালঘু বলে একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতাবোধ সামাজিক ও মানসিক চাপে আক্রান্ত, তাড়িত তেমনি একটু ভিন্ন রূপে হলেও কাঁদো নদী কাঁদোতেও তা আছে। অনাথ খোদেজার সঙ্গে লিওপল্ড বস্নুম চরিত্রটির শেকড়-উপড়ানো বোধের মিল খোঁজা যেতে পারে। আর জেমস জয়েস নিশ্চয়ই আয়ারল্যান্ডে সংখ্যালঘু বলেই চিরদিনের জন্য ‘ফ্ল্যাড ফ্রম আয়ারল্যান্ড অ্যান্ড রোট অ্যাবাউট আয়ারল্যান্ড ওনলি’! প্রতারক, দুর্বৃত্ত প্রকৃতির বাবার (জীবনের একপর্যায়ে খুন হওয়া লোকটির) কঠোরতার মধ্যে বেড়ে ওঠা সন্তান মুহাম্মদ মুস্তফার মৃত্যুরহস্যের মধ্যেও তেমনি এক একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতাবোধ উঁকি দেয় বটে।

তবে এক্ষেত্রে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, কাঁদো নদী কাঁদোর চরিত্ররা বিশেষভাবেই দেশজ। তাদের

চলন-বলন-আচার-আচরণ বাংলার আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বাতাবরণজাত। প্রসঙ্গত, নাট্যকার সাঈদ আহমদের কথা বলা যায়। তিনি স্যামুয়েল বেকেটসহ প্রাগ্রসর বিশ্বনাটক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন; কিন্তু তাঁর চরিত্র বা ঘটনা তথা আখ্যান বাংলার বাস্তব জনজীবন থেকে আহরিত। এক্ষেত্রে সাঈদ আহমদ তাঁর রচিত কালবেলা, মাইলপোস্ট, তৃষ্ণায় নাটকের মধ্য দিয়ে একদিকে বাংলা নাটকে নতুনতর আঙ্গিকের সংযোজন করেছেন, অন্যদিকে তাতে বাংলার জনজীবন যেভাবে চিত্রিত করেছেন তা তুলনারহিত। তার কালবেলার প্রসঙ্গে বলা যাক – নাটকটির কৌশল বা বিন্যাসগত দিক ও সংলাপরীতি স্যামুয়েল বেকেটের সঙ্গে মেলে যা কিনা অধিবাস্তববাদী নাটকের এক গৃহীত পদ্ধতি। পাশ্চাত্য তথা বিশ্বনাটকের প্রাগ্রসর এই রীতি প্রয়োগের পটভূমি হিসেবে সাঈদ আহমদ কিন্তু বেছে নিয়েছেন তার স্বদেশকেই। কালবেলার পটভূমি ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম অঞ্চলের একটি ছোট দ্বীপে গোর্কির ভয়াবহ পরিস্থিতি। গোর্কির সংকেত পেয়ে দ্বীপবাসী তার অপেক্ষায় সময় কাটায়। একসময় এর প্রলয়ংকরী তা-বে দ্বীপের সব তছনছ হয়ে যায়। এই নাটকের উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর অপেক্ষার মধ্যে সমৃদ্ধ অতীতের স্মৃতিকথায় সময় কাটিয়ে মানুষ যেন মরণেরই মরণ ঘটায়। এখানে অধিবাস্তববাদী নাট্যধারায় অস্তিত্ববাদী চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটেছে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, বাংলা নাটকে সাঈদ আহমদই এ-ধারার প্রথম স্রষ্টা। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র কাঁদো নদী কাঁদোর বিষয়টিও মূলত তাই। তিনি বাংলাদেশের মুসলমানদের ব্যক্তি ও সামাজিক অবস্থাকে বাস্তবতার ভিতে দাঁড় করিয়ে অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিকোণ বা অঙ্গীকার থেকে শৈল্পিক বিশিষ্টতা দিয়েছেন। ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর এই উপন্যাসে কোনো চরিত্রের অন্তর ও বহির্জগৎ এমনভাবে ব্যবচ্ছেদ বা চিত্রিত করেছেন যে, তারা কোনো সমাজ বা সামাজিক অবস্থার জাতক তা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে এবং তার জন্য তিনি যেসব ঘটনা বা বর্ণনার আশ্রয় নেন তাতে তার শৈল্পিক প্রকৌশলের অসাধারণত্ব ধরা পড়ে। যেমন – ‘নীরবতা ভঙ্গ করে ডাক্তার বোরহানউদ্দিন অবশেষে সরল কণ্ঠে প্রশ্ন করে, ‘এমন ধোঁকা কী সম্ভব?’

ডাক্তার বোরহানউদ্দিন অকালবৃদ্ধ। চলিস্নশে পৌঁছেই তার শিরদাঁড়া বাঁকা হয়ে পড়েছিল, মাথার চুলও অর্ধেক সাদা হয়ে গিয়েছিল। বেশভূষার দিকে তেমন খেয়াল নেই, মুখে সদাসর্বদা নিরানন্দ ভাব, অকালে বার্ধক্যের আক্রমণ সমন্ধে তাকে সচেতনও মনে হয় না; যে-বার্ধক্য একদিন অনিবার্য, জীবনপরিক্রমা অসময়ে শেষ না হলে যা এড়ানো যায় না, সে-বার্ধক্য কিছু আগে এসে উপস্থিত হয়েছে বলে আফসোস-আক্ষেপ করা তার কাছে হয়তো অহেতুক মনে হয়। তার মনে কোনো কুটিলতা নেই, এবং সে যখন রোগীর পরীক্ষা শেষ করে কেমন একদৃষ্টিতে রোগীর দিকে তাকিয়ে পারিপার্শ্বিক সমন্ধে বিস্মৃত হয়ে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকে, তখন সে যে নিতান্ত ভালোমানুষ সে-ধারণাটি আপনা থেকেই মানুষের মনে জেগে ওঠে। তবে রোগীর পরীক্ষা শেষ হলে একদিন যেসব কথা ভাবতো সেসব কথা আর ভাবে না; রোগীর অবস্থা যে বড় গুরুতর তা তাকে বা তার আত্মীয়স্বজনকে কী করে বলে, রোগীর ওষুধপথ্য করার সামর্থ্য আছে কিনা, বা চিকিৎসার উত্তম উপায়টি কী। সেসব আর ভাবে না, কারণ ক্ষুদ্র মফস্বল শহরের চিকিৎসক অনেক কিছু ভাবা ছেড়ে দেয় একদিন। সেসব ভেবে লাভ কী? ক্রমশ একদিন রোগীর আয়ু কিছু বৃদ্ধি করার চেষ্টাও তার কাছে বৃথা মনে হয়। তাতে কেবল দুঃখ-যন্ত্রণা বাড়ানো হয়, কষ্টের জীবনকে বিলম্বিত করা হয়, শান্তির দিনটি পিছিয়ে দেওয়া হয়। আরেকটি কথাও সে বোঝে। চিকিৎসার অর্থ আজরাইলের সঙ্গে একপক্ষীয় যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া, যে-যুদ্ধের শেষে পরাজয় নিশ্চিত; রোগীর অবস্থা চিকিৎসার বাইরে চলে গেলেই সচরাচর চিকিৎসকের তলব পড়ে। কোনো চিকিৎসক সাফল্য বা

কৃতিত্বের প্রত্যাশাও করতে পারে না, এবং যে-কাজে সাফল্য বা

কৃতিত্বের সম্ভাবনা নেই সে-কাজে মানুষের আনন্দও নেই। অতএব  ডাক্তার বোরহানউদ্দিন যখন স্টেথোস্কোপ যন্ত্রটি গলায় ঝুলিয়ে ক্ষিপ্রপদে কোনো রোগীর বাড়ি-অভিমুখে রওনা হয় তখন তার পদক্ষেপে একটি বেসুরো ধ্বনি ধরা পড়ে, তার কপালের চিন্তাসূচক রেখাগুলিতে ঈষৎ অসামঞ্জস্য প্রকাশ পায়। তবে সে-বেসুরো ধ্বনি অসামঞ্জস্য কেউ লক্ষ করে না; গভীর নিরাশাচ্ছন্ন মনে ডাক্তার রোগী দেখতে চলেছে, তেমন কথা কে বিশ্বাস করতে চায়?’৪

উপন্যাসটি সম্পর্কে রফিকউল্লাহ খান বলেন, ‘ব্যক্তি ও সমষ্টি, অন্তর্জীবন ও বহির্জীবন, অনস্তিত্ব ও অস্তিত্বের সমগ্রতায় নির্মিত হয়েছে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ (১৯৬৮) উপন্যাসের অবয়ব। সমাজ বিবর্তন ও মানুষের অস্তিত্ব জিজ্ঞাসার রূপ-রূপান্তরের যে নিগূঢ় সাক্ষ্য তাঁর ‘লালসালু’ এবং ‘চাঁদের অমাবস্যা’-য় বিধৃত, তাঁরই পূর্ণতর অভিব্যক্তি ঘটেছে ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে। এ-উপন্যাসের জটিল আঙ্গিকে তিনি ধারণ করেছেন সময়, সমাজ ও জীবনের জটিলতর স্বভাবধর্ম এবং মানুষের অস্তিত্ব-সংগ্রামের টানাপড়েন ও রূপবৈচিত্র্য।’৫

প্রচলিত বা প্রথাবদ্ধ উপন্যাসের মতো কাঁদো নদী কাঁদোতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি কাহিনি বা আখ্যান যেমন বর্ণিত হয় না, তেমনই নেই কোনো প্রোটাগনিস্ট (Protagonist), অর্থাৎ এমন কোনো চরিত্র এখানে নেই যাকে কেন্দ্র করে তথাকথিত আখ্যান অবতরণিকা যা সূচনা থেকে পরিণতি পর্যন্ত পৌঁছে। আবার তা আখ্যানবর্জিত তথাকথিত নিরীক্ষাধর্মী ফিকশনও নয়। এতে একাধিক পূর্ণাঙ্গ আখ্যান বা কোলাজধর্মী বিচ্ছিন্ন আখ্যানের সমন্বয় যেমন আছে, তেমনি তার পরিপূরক হিসেবে বা একটি আধুনিক রীতির উপন্যাসকে পূর্ণতা দিতে আছে অগণিত চরিত্র, ঘটনা আর গল্পগাথার সমাহার। এদিকে প্রোটাগনিস্ট না হয়েও মুহাম্মদ মুস্তফা প্রধানতম এক চরিত্র। কিন্তু সমগ্র উপন্যাস পাঠের পরও পাঠক যেমন তাকে বুঝে উঠতে পারে না, উপরন্তু মুহাম্মদ মুস্তফা নিজেই নিজেকে বুঝে উঠতে পারে বলে মনে হয় না – তা যুগপৎ বিষয় ও শৈল্পিক রহস্যময়তার মধ্যে থাকে। তার বাবা প্রতারক বা পেশাদার মিথ্যাবাদী, দুর্বৃত্ত প্রকৃতির, সে ছোটবেলা থেকে তার বাবা দ্বারা নির্যাতিত। একপর্যায়ে তার বাবা তার বৈমাত্রেয় ভাই দ্বারা (হয়তো) খুন হয়। এরপর বৈমাত্রেয় ভাইটি পরোক্ষভাবে এমন একজনকে হাজির করে যে কিনা তাদের বাবার এক ক্ষুদে সংস্করণ এবং এমন দাবি করা হয় যে, এ মুহাম্মদ মুস্তফার ঔরসজাত। অন্যদিকে দেখা যায় মুস্তফার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয় গ্রামের এতিম মেয়ে খোদেজার। কিন্তু তার সঙ্গে যখন খন্দকার আশরাফ হোসেনের মেয়ের বিয়ে পাকাপাকি হয় তখনই শ্যাওলা-আবৃত ক্ষুদ্র পুকুরে পড়ে মারা যায় তার বাগদত্তা এই খোদেজা খাতুন; কিন্তু মেয়েটি কেন এভাবে মরে গেল তার তা বোধগম্য হয় না। তবে নিজেকে সে এই আত্মহত্যার কারণ বলে মনে করে এবং ক্রমশ আত্মবিনাশের দিকে এগোয়। তার বাবার চরিত্র, তার প্রতি লোকটির কঠোর আচরণ, তার খুন হওয়া, খুন হওয়ার পর তারই চেহারার একজনের আবির্ভাব ইত্যাদি ঘটনা হয়তো মুহাম্মদ মুস্তফার মনে এক ধরনের ডিপ্রেশন বা নৈরাশ্য তৈরি করে, যা তার আত্মহত্যার পটভূমি তৈরিতে সহায়ক হয়। তবে উপন্যাসটিতে তার আত্মহত্যার বিষয়ে তেমন কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত নেই। এদিকে খোদেজা কেন মরে গেল এটুকু পাঠক শুধু নয়, এই মুহাম্মদ মুস্তফাও বুঝে উঠতে পারে না। খোদেজার সঙ্গে তার দৈহিক বা মানসিক সম্পর্কের কথা নেই উপন্যাসে। বরং মুস্তফার চাচাতো ভাইয়ের প্রতি তার একধরনের মানসিক, কল্পনাশ্রিত টান ছিল। তবে কিনা এর মধ্যেও খোদেজার মানসিক প্রস্ত্ততি বা সিদ্ধান্ত ছিল যে মুস্তফা তাকেই বিয়ে করবে – যদিও তার প্রতি মেয়েটির একধরনের ভয়ও ছিল। সমাজের বঞ্চিত, অসহায় অবস্থান ও মানসিকতা এখানে চমৎকারভাবে ধরা পড়েছে। তবে কিনা খোদেজা, এমনকি মুহাম্মদ মুস্তফার মৃত্যুরহস্য সুস্পষ্টভাবে ভেদ করা যায় না। এক্ষেত্রে পাঠক শুধু সম্ভাবিত বা নানা অনুমানের মুখোমুখি হন। বস্ত্তত কাঁদো নদী কাঁদোর বড় দিক হচ্ছে, কোনো ঘটনা বা বিষয়ের বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা। এই দুই মৃত্যু এবং নদীর কান্না সম্পর্কে নানা প্রশ্ন। খোদেজা কেন মরল এ নিয়ে অনুমানের কোনো শেষ নেই। সত্যিই সে মুহাম্মদ মুস্তফার জন্য মরল, নাকি এ-সমাজে তার আর বেঁচে থাকার কোনো অবস্থা ছিল না। তো সে কি নারীর অবহেলিত জীবনের প্রতিভূ হয়ে থাকে! জীবন কি সত্যি এত ক্ষুদ্র আর সম্ভাবনাহীন! রীতিমতো ভয়জাগানিয়া উপলব্ধি তৈরি হয় খোদেজার জন্য।

মুহাম্মদ মুস্তফার মৃত্যু কি অপরিহার্য ছিল? কেন মরবে সে। এও কি ঔপন্যাসিকের বানানো বিষয় মনে হয়? … নদীটির কান্না তবে কার? নদী কেন কাঁদে? তবারক ভুইঞার কথাই কি ঠিক, – কুমুরডাঙ্গার অসহায় মানুষের জন্যই কেঁদেছিল?

কুমুরডাঙ্গা নামের অতি দরিদ্র মহুকুমা শহরটিকে কেউ কি চেনে? বাঁকাল নদীটি তবে কোথায়? খোদেজা যে শ্যাওলা-পড়া পানিতে ডুবে মরল, কিংবা মোক্তার কফিলউদ্দীনের কন্যা, কিংবা স্টিমারঘাটের জন্যই কি নদী কাঁদে? নাকি একটি ইতিহাসকে খুঁজে খুঁজে ব্যাকুল হয়ে কাঁদে? নারীর কান্না বা ব্যাকুলতা কি নদী স্মরণ করাতে পারে না? নদী কি নদীর জন্য কাঁদতে পারে না? নদীতে কেন এতো চড়া পড়ে? এই চড়া কেন অবহেলিত? নাকি উচ্চৈঃস্বরে

কথা না-বলা মানুষগুলোর কথাকেই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় এই নদী? নাকি এ এক জনপদের ‘সমন্বিত বিভ্রান্তি’ (mass illusion)? তবে এ স্বীকার করতেই হবে, নদীর কান্নাই এ-উপন্যাসের বড় চরিত্র। গুমরে গুমরে কেঁদে-কেঁদে জাদুর অচিন স্পর্শে মানুষের কান্না জমজমাট করার জন্যই যেন নদীর এই আয়োজন।

নদীর এই কান্না, যে কান্না এক জাদুবাস্তবতা, বিষয়ে কুমুরডাঙ্গার মানুষ নানা রকম ব্যাখ্যা দেয়। এই ব্যাখ্যা-বিশেস্নষণের মধ্য দিয়ে তৎকালের একটি মহুকুমা শহরের সমাজ, মানুষ ও মানুষের শ্রেণি বৈশিষ্ট্য, বিদ্যা-বুদ্ধি, সংস্কার, বিশ্বাসও অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। যেমন মোল্লা-মৌলবিরা বলে যে কান্নাটি শয়তানের কারসাজি।

প্রকৃতপক্ষে, এমন কান্না বিষয়ে যেমন, উপন্যাসের অনেক ঘটনা, চরিত্র বা চরিত্রের আচরণ বা কার্যকারণ বিষয়ে লেখক কোনো সিদ্ধামেত্ম যান না, এতে ঘটনা বা চরিত্রের বহুমাত্রিক দিক যেমন উন্মোচিত হয় তেমনি তা কারো চাপানো ব্যাখ্যার সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত থাকে। আর এভাবে কিনা সমগ্র উপন্যাসটিই পরাবাস্তব ব্যাখ্যার মতো নানামুখী ব্যাখ্যার অবকাশ তৈরি করে এবং যে-ব্যাখ্যা কোনো সিদ্ধামেত্ম পৌঁছতে দেয় না, তাতে কাঁদো নদী কাঁদোর সমৃদ্ধি, শৈল্পিক ঘোর থাকে অশেষ। এর পেছনের অনুপ্রেরণা বা শিক্ষাভূমি হিসেবে আয়েনেস্কোর নাটক, কাফকার উপন্যাসের কথা ভাবা যায়। কোরোসাওয়ার চলচ্চিত্রেও এ-ধরনের ট্রিটমেন্ট দেখা যায়। আয়েনেস্কো তাঁর নাটকে প্রশ্নোত্তরকে বারবার নাকচ বা প্রশ্নবিদ্ধ করে নতুন নতুন ব্যাখ্যার অবতারণা করেন কিংবা এমন সংলাপের মধ্যে দিয়ে তা অ্যাবসার্ডিটি বা অধিবাস্ততার ঘোরে দুর্ভেদ্য কিন্তু অভিনব মাত্রা পায়। জীবন বা বাস্তবে সবকিছুর যে মীমাংসিত বা চূড়ান্ত অর্থ বা সিদ্ধান্ত হয় না এ তারই শৈল্পিক রূপায়ণ। যেমন –

মি. মার্টিন \ ওর মৃত্যুর জন্য সে দায়ী নয়, আপনিও নন।

অধিনায়ক \ তাহলে বলুন আপনারা কি নিয়ে তর্ক করছিলেন?

মিসেস স্মিথ \ আমার স্বামী দাবি করছিলেন –

মি. স্মিথ \ না না, আপনিই দাবি করছিলেন –

মি. মার্টিন \ ও হ্যাঁ, মহিলাই দাবি করছিলেন –

মিসেস মার্টিন \ না, ওর স্বামী দাবি করছিলেন –

 

২. মি. স্মিথ \ পোপ মহিলা নিয়ে পালিয়েছে। পোপ সাবান নয়। সাবান নেশা নয়। বাজার! বেইসবল। বাঁশি।

মি. মার্টিন \ বিজনেস। বসনিয়া। বাস্টার!

মি. স্মিথ \ ক খ গ ঘ ঙ,

মিসেস মার্টিন \ প ফ ব ভ ম …

মি. মার্টিন \ সা রে গা মা পা ধা নি সা।

মিসেস মার্টিন \ কলা মুলাকে বললো, মুলা চুলাকে বললো।

মিসেস মার্টিন \ (ট্রেনের অনুকরণে) ঝিক ঝিক! ঝিক! ঝিক! ঝিক ঝিক ধিক ধিক।

মি. স্মিথ \ এটা।

মিসেস মার্টিন \ ওই।

মি. মার্টিন \ দিকে।

মিসেস স্মিথ \ নয়।

মি. স্মিথ \ এটা।

মিসেস মার্টিন \ এই।

মি. মার্টিন \ দিকে।

[সবাই একসঙ্গে গলা ফাটিয়ে একে অন্যের কানের সামনে চেঁচিয়ে বলছে। আস্তে আস্তে অন্ধকার নেমে আসে, খুব হালকা শোনা যায় যদিও ওরা খুব তাড়াতাড়ি করে বলছে।]

সবাই \ এটা এদিকে নয়, ওটা ওদিকে, ওদিকে নয়, এদিকে, দিকে দিকে, বাঁদিকে, ডানদিকে, দিকে দিকে।

[অন্ধকার। একটু শান্তি এবং পরে আলো জ্বলবে]

[মি. এবং মিসেস মার্টিন (অথবা মি. এবং মিসেস স্মিথ)। প্রথম দৃশ্যে দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি]৬

ফ্রানৎস কাফকা তাঁর দি ট্রায়াল-এ অপরাধ এবং বিচার বিষয়ে কোনো রায় বা সিদ্ধামেত্ম না পৌঁছে সব এক অনিশ্চয়তায় ঝুলিয়ে জীবনের অর্থ খোঁজেন। কুরোসাওয়া তাঁর চলচ্চিত্র রসোমনে একটি ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য বা ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে সত্যের মায়াবী রূপ (রসোমন লাইক) উন্মোচনের প্রয়াস পান। আয়েনেস্কোর নাটক, কাফকার উপন্যাস, কুরোসাওয়ার চলচ্চিত্রের এইসব কৌশলের এক দক্ষ সংশেস্নষ যেন ওয়ালীউল্লাহ্র কাঁদো নদী কাঁদোকে বিশেষ সমৃদ্ধি দিয়েছে। কাঁদো নদী কাঁদোর চরিত্র বা ঘটনা নিয়ে লেখকের সিদ্ধান্তহীনতা বা প্রশ্নের পর প্রশ্নের অবতারণা এই সত্যকেই তুলে ধরে যে, এসব বিষয়ে স্বতঃসিদ্ধ বা চূড়ান্ত কোনো উত্তর নেই বরং এমনই দ্বিধা বা প্রশ্নের পর প্রশ্নে তার মর্ম নিহিত। তার বিষয়ের এমন ট্রিটমেন্টে বা তার চিন্তার প্রকাশে তার ভাষা তথা আঙ্গিক বিশেষ এক পরিপূরক ভূমিকা রেখেছে। বলা যায়, এমন এক ভাষা তথা আঙ্গিক আয়ত্তে থাকার কারণেই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে একটি ঘটনা, চরিত্র বা বিষয়ের মধ্য নতুনতর ব্যাখ্যা বা তা থেকে নতুন নতুন মর্ম উন্মোচন বা অভিনব সব তাৎপর্য সংস্থাপন।

কাঁদো নদী কাঁদোর চেয়ে ভাষাগতভাবে জটিল বা প্রকরণগতভাবে দুরূহ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে আছে। প্রসঙ্গত কমলকুমার মজুমদারের গোলাপ সুন্দরী বাদে তাঁর বাকি সাতটি উপন্যাস যথাক্রমে অন্তর্জলী যাত্রা, অনিলা স্মরণে, শ্যাম-নৌকা, সুহাসিনী পমেটম, পিঞ্জরে বসিয়া সুখ, খেলার প্রতিভা, শবরীমঙ্গলের কথা উল্লেখ করা যায়। এসব উপন্যাস বাক্যের নতুন ডিকশন বা গদ্যের সিনটেঙে গীতিময়, চিত্রময় ভাষার ঐশ্বর্যে অনন্য, এমনকি এর মধ্যে আছে নতুন বিষয়, সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাস। তাছাড়া আছে মনস্তাত্ত্বিকভাবে জটিল ও মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বসহ চিন্তা-চেতনার দিক থেকে নানা বাঁক বদল সংবলিত বিভিন্ন লেখকের উপন্যাস। এক্ষেত্রে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চতুষ্কোণ, পদ্মানদীর  মাঝি, ননী ভৌমিকের ধুলোমাটি (১৯৫৭)। কিন্তু তারপরও কাঁদো নদী কাঁদো বিশেষভাবে উল্লেখের দাবিদার বিষয় ও আঙ্গিক উভয় দিক থেকে তার প্রাগ্রসর বৈশিষ্ট্যের কারণে। কাঁদো নদী কাঁদোর চেতনাপ্রবাহরীতিসহ বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে যেমন আঙ্গিকগতভাবে এগিয়ে, তেমনি অধিবাস্তবতা, অস্তিত্ববাদসহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর চেতনাকে ধারণ করে তা অনন্য বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর।

অবশ্য এক্ষেত্রে এটাও লক্ষণীয় যে, কাঁদো নদী কাঁদোতে সুকৌশলে অজস্র চরিত্র, ঘটনা, সংলাপ, ব্যাখ্যা-বিশেস্নষণের অবতারণা যেমন

করা হয়েছে তার সঙ্গে পরিমিতিবোধের অভাবও লক্ষণীয়।

ওয়ালীউল্লাহ্ খরস্রোতা একটি ভাষা তথা গতিময় ভাষা যেমন অর্জন করেছেন, অনেক ক্ষেত্রে সেই ভাষায় তিনি আত্মমগ্ন হয়ে নিজেই ভেসে গেছেন, সচেতন হয়ে উঠতে পারেননি, সংযমী হতে পারেননি, যেন তিনি তার পাঁকে পড়ে ঘুরপাক খাচ্ছেন। তাছাড়া উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্র সবাই মুসলমান, যদিও হিন্দু এক জমিদার আছেন কিন্তু তার ভূমিকা নেতিবাচক। এই বৈষম্য হয়তো লেখক সচেতনভাবে করেননি। কিংবা ক্রমশ আরো সংখ্যালঘু হতে থাকা হিন্দু সমাজ নয়, জেগে ওঠার প্রয়াসী পূর্ববাংলার পশ্চাৎপদ মুসলমানই এখানে তার কাছে মুখ্য। আর নদী যে কাঁদে তা পূর্ববাংলার পশ্চাৎপদ মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশায় কাঁদে!

এসব দুর্বলতা সত্ত্বেও বিষয়, জীবনজিজ্ঞাসা বা দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনাপ্রবাহরীতিসহ আঙ্গিকের নানা সমৃদ্ধির কারণে সৈয়দ

ওয়ালীউল্লাহ্র কাঁদো নদী কাঁদো বাংলা কথাসাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এই উপন্যাস জীবন ও সমাজকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি যেমন পালটেছে, তেমনি ভাষা তথা কথাশিল্পের উপস্থাপনার ক্ষেত্রে তা যেন এক ঐতিহাসিক উত্তরণ। বস্ত্তত এ-কারণে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের গল্পকার, ঔপন্যাসিক তথা প্রজন্ম পরম্পরার কথাসাহিত্যিকরা তাঁর এই ধারায় বিশেষভাবে ঋদ্ধ বা প্রভাবিত হয়েছেন। যেমন সৈয়দ শামসুল হক, শহীদুল জহীর প্রমুখ এ-ধারায় কথাসাহিত্য চর্চা করেন। সমসাময়িক অনেক গল্পকার-ঔপন্যাসিক হয় এই ধারায় প্রভাবিত হয়েছেন, না-হয় প্রাথমিক ভিত তৈরিতে এই ধারায় ঋদ্ধ হয়েছেন। বস্ত্তত কাঁদো নদী কাঁদোর কথনভঙ্গি বাংলা কথাসাহিত্যে উপস্থাপনার ক্ষেত্রে নতুন এক ধারা হিসেবে গৃহীত বা স্বীকৃত।

উপন্যাসটির দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা হিসেবে আবদুল কাদির খান বলেন, ‘শিল্পচেতনা ও জীবনভাবনার বিচারে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ আন্তর্জাতিক; কিন্তু ঐতিহ্যবোধ ও বাস্তবতাজ্ঞানে অকৃতিমরূপে স্বদেশীয়। এই স্বাদেশিক পটভূমিই তাঁর রচনার অনন্য পরিচয়, এই আন্তর্জাতিক জীবনভাবনাই তাঁর প্রগতিশীল শিল্পী মনের দ্যোতক। এই দুইয়ে মিলেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র শিল্প সার্থকতা।’৭

বস্ত্তত তিনি বিশ্বসাহিত্যের মূলধারার প্রাগ্রসর আঙ্গিক,

চিন্তা-চেতনা ও দর্শনের আধুনিকতর বিকাশ দ্বারা ঋদ্ধ হয়ে এক আধুনিকতম আঙ্গিক ও দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বাংলার সমাজ ও মানুষকে তাঁর কাঁদো নদী কাঁদোতে অনন্য এক দক্ষতায় রূপায়িত করেছেন এবং বাংলা কথাসাহিত্যে সংযোজন করেছেন সমৃদ্ধ এক নতুন ধারা। এই ধারায় চেতনাপ্রবাহরীতির অভূতপূর্ব ও বিস্ময়কর প্রয়োগ মুখ্য এক ভূমিকা রেখেছে। এভাবে এই একটি মাত্র উপন্যাস, কাঁদো নদী কাঁদো বাংলা কথাসাহিত্যে প্রভাবশালী, অনুসরণযোগ্য ও শিক্ষণীয় এক ধারা সৃষ্টি করে তাৎপর্যপূর্ণ আসন অলংকৃত করে আছে।

 

 

তথ্যনির্দেশ ও টীকা

১. মিরন মহিউদ্দীন, ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র উপন্যাসের জগৎ’, জনতা সাহিত্য, দৈনিক জনতা, ঢাকা, ২ ভাদ্র ১৩৯৮, দ্বাদশ বর্ষ, দশম সংখ্যা।

২. জীনাত ইমতিয়াজ আলী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ : জীবনদর্শন ও সাহিত্যকর্ম, ১৯৯২, ঢাকা, শিল্পতরু প্রকাশনী, পৃ ১৪৮-১৫১।

৩. আলব্যের ক্যামু, উপন্যাস ত্রয়ী (দ্য ফল, অনুবাদ পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়), ২০০৬, ঢাকা, নালন্দা, পৃ ৩৮২।

৪. সৈয়দ আকরম হোসেন-সম্পাদিত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ রচনাবলী-১, ১৯৯৩, ঢাকা, বাংলা একাডেমি, পৃ ২৩৮-২৩৯।

৫. রফিকউল্লাহ খান, বাংলাদেশের উপন্যাস : বিষয় ও শিল্পরূপ ১৯৪৭-১৯৮৭, ১৯৯৭, ঢাকা, বাংলা একাডেমি, পৃ ৪০৬।

৬. সাঈদ আহমদ-অনূদিত, এয়োনেস্কোর দুটি নাটক (টেকো অভিনেত্রী), ঢাকা, বাংলা একাডেমি, ১৯৯০, পৃ ৭৬, ৭৭, ৯৮, ৯৯।

৭. সৈয়দ আকরম হোসেন-সম্পাদিত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ রচনাবলী-১, পূর্বোক্ত, পৃ ৩৭৪।