সৈয়দ শামসুল হক : সাহিত্যের দিব্যরথে

সেলিনা হোসেন

প্রণীত জীবনের কথাকার সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে সামনাসামনি পরিচয় হওয়ার আগে তাঁকে চিনতে শুরু করি তাঁর সাহিত্যের মাধ্যমে। তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। নিজে কবিতা-গল্প লিখছি। নানা বই সংগ্রহ করে পড়ি। নেশার মতো পড়া। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ছিল প্রিয় জায়গা। হাতে পাই কবি হাসান হাফিজুর রহমান-সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারি নামের একুশের সংকলন। প্রকাশকাল ১৯৫৩।
এই সংকলনের কবিতাগুলোর কোনো শিরোনাম ছিল না। প্রতিটি কবিতার ওপরে বড় অক্ষরে লেখা ছিল কবির নাম। কবিতাটি এভাবে ছাপা হয় :

সৈয়দ শামসুল হক

সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি
শিশুর জন্ম থেকে জরাদেহ ক্ষীণশ্বাস মানবের অবলুপ্তির সীমারেখায়
বলে গেল সেই কথা। সেই কথা বলে গেল অনর্গল –
তপ্তশ্বাস হাহুতাশ পাতাঝরা বিদীর্ণ বৈশাখীর জ্বালাকর দিনের
দিগন্তে
আষাঢ়ের পুঞ্জীভূত কালো মেঘ আসবেই ঠিক।
সাগরের লোনাজলে স্নিগ্ধ মাটির দ্বীপ
শ্যামলী স্বপ্নের গান বুকে পুষে
নবীন সূর্যেরে তার দৃঢ় অঙ্গীকার জানাবেই।
সংখ্যাহীন প্রতিবাদ ঢেউয়েরা আসুক, তুমি স্থির থেকো।

প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝাবাত অবহেলা করি
সঞ্চয় করে যাও মুঠো মুঠো গৈরিক মাটি ঃ
সবুজ গন্ধবাহী সোনালী সূর্যের দিশা
অকস্মাৎ উদ্ভাসিত কোরে দেবে তোমার চলার পথ।

সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি
শিশুর জন্ম থেকে জরাদেহ ক্ষীণশ্বাস মানবের অবলুপ্তির
সীমারেখায়
বলে গেল সেই কথা। সেই কথা বলে গেল অনর্গল
পৃথিবীর জিজীবিষু আত্মার কাছে। ঘনীভূত জনতার হৃদয়ে
হৃদয়ে
উজ্জ্বল শিখা সেই অমর সংবাদ ঢেউ তুলে দিয়ে গেল।
সৈয়দ শামসুল হক সতেরো বছর বয়সে এই কবিতা লিখেছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনাগত দিকটি প্রবল সাংস্কৃতিক বোধে বিশ্লেষিত হয়েছে। একইসঙ্গে তাঁর শিল্পকর্মের মানসচেতনার সবটুকু বিধৃত হয়েছে এই কবিতায়। তিনি একুশকে বলেছেন ‘সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি।’ তিনি স্বদেশকে দেখেছেন ‘সাগরের লোনাজলে স্নিগ্ধ মাটির দ্বীপ’ হিসেবে। স্বদেশকে বলেছেন ‘সংখ্যাহীন প্রতিবাদ ঢেউয়েরা আসুক, তুমি স্থির থেকো।’ একুশকে দেখেছেন এভাবে ‘শিশুর জন্ম থেকে জরাদেহ ক্ষীণশ্বাস মানবের অবলুপ্তির সীমারেখায় বলে গেল সেই কথা।’ বলেছেন ‘ঘনীভূত জনতার হৃদয়ে হৃদয়ে উজ্জ্বল শিখা সেই অমর সংবাদ ঢেউ তুলে দিয়ে গেল।’ স্বদেশ, গণমানুষ, ‘শ্যামলী স্বপ্নের গান’ মিলিয়ে সাহিত্যের উপাদান নিয়েছেন বৃহত্তর পরিসর থেকে। তৈরি করেছেন সাহিত্যের স্রোত। দুহাত ভরে লিখেছেন সাহিত্যের বিভিন্ন আঙ্গিকে। ভরিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের সাহিত্যের ভা-ার। এখানেই সৈয়দ শামসুল হকের বিশেষত্ব। সাতচল্লিশ-পরবর্তী বাংলাদেশের সাহিত্য যে-তরুণ লেখকরা পঞ্চাশের দশকে সূচনা করেছিলেন তিনি তাঁদের একজন। বর্তমান সাহিত্যকর্মীরা তাঁদেরই উত্তরসূরি। তিনি তো সেই লেখক যিনি জীবনকে দেখেছেন বোধের মগ্নতায়, দেখেছেন মননের শস্যক্ষেত্রে, দেখেছেন প্রেমের কল্পনায়, দেখেছেন ঔজ্জ্বল্যে, বিবর্ণতায়, ধ্বংসে, যুদ্ধে, প্রতিরোধে, ভালোবাসায়, সংকটে এবং সামগ্রিক সত্যে।
তিনি সময়কে ধরেছেন – সময়ের জীবনকে ক্যানভাসে এঁকেছেন – জনজীবনের ছাপচিত্রে উঠে এসেছে একজন কবি। ১৯৬২ সালে লেখা হয়েছিল তাঁর ‘কবি’ গল্প। তখন দেশে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন চলছে। গল্পের নায়ক কবি আবদুর রব মুনশী। কবিতা লেখেন। সবাই তাঁর কবিতা শুনতে ভালোবাসে। হাটের দিনে তিনি ছোট-ছোট পুস্তিকা বিক্রি করেন। এগিয়ে আসে নির্বাচনের সময়। গ্রামের প্রভাবশালী জোতদার নির্বাচনে প্রার্থী হন। একদিন তিনি কবিকে ডেকে বলেন, আপনি আমার পক্ষে কবিতা লিখবেন। আমার গুণগান গাইবেন। তা হাটে-বাজারে গেয়ে বেড়াবেন। কবি আবদুর রব মুনশী তাঁর কবিতার খাতা বুকে জড়িয়ে বলেন, আমি তো সাধারণ মানুষের জন্য লিখি। আপনি সাধারণ মানুষের জন্য কোনো কাজ করেন না। আমি আপনার গুণগান গেয়ে কবিতা লিখতে পারব না।
কবির এই অনমনীয় দৃঢ়তার সামনে পরাজিত হয় আধিপত্যশীল মানুষের দাপট। কিন্তু তাঁর পক্ষে এই দৃঢ়তা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই শুরু হয় কবির ওপর নির্যাতন। তাঁর হালের গরু কেড়ে নেওয়া হয়, তাঁর ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কবিতার খাতা ভাসিয়ে দেওয়া হয় খালের পানিতে। তারপরও নতি স্বীকার করেন না কবি।
গল্পের শেষে আবদুর রব মুনশী উত্তম পুরুষে লেখা আমি চরিত্রকে বলে, ‘তালুকদার সাবে আমার ক্ষতি করতে পারে নাই। এখন কইতে আর ভয় নাই আমার, আমি রচনা থামাই নাই। কথা না কইয়া মানুষ বাঁচিতে পারে? আমি কতো কবিতা গান রচনা করছি তারপরে। সব ল্যাখা আছে। লেইখা তোরঙ্গে বন্ধ কইরা থুইছি। আইজ না হউক কাইল তো লোকে জানতে পাইরবে। আপনেরে আমি ডাকছি, আমার কবিতাগুলো একখানা বই কইরা ছাপাইয়া দিয়েন। আপনে পারবেন। দিবেন? একটা আশ্চর্য শিহরণ বোধ করলাম, সমস্ত অন্তরের মধ্যে অপূর্ব একটা আনন্দ হলো। কবি আবদুর রব মুনশী মরে যাননি। সেই খররৌদ্রে সারাদিন লাঙ্গল চষে বাড়ি ফিরে রাতের অন্ধকারে গোপনে গোপনে তিনি রচনা করে গেছেন।
তাঁর বড় ছেলেকে বললেন, তোরঙ্গ খুলে কবিতাগুলো দিতে। সে পুরনো একখ- কাপড়ে যতœ করে বাঁধা লেখার পুঁটুলি এনে দিলো। মুনশী সাহেব ইশারা করলেন আমাকে পুঁটুলিটা তুলে দিতে। একমুহূর্তে ভারি নিরাসক্ত নির্লিপ্ত মনে হলো তাঁকে। এতো যে আগ্রহ, এতো যে মমতা, লেখাগুলো স্পর্শ পর্যন্ত করলেন না তিনি। তাকিয়ে দেখলেন না আর। চোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল শুধু। মুখ ফিরিয়ে বিকৃত কণ্ঠে বললেন, কতদিন ভাবছি, এক দ্যাশ ছাইড়া যে দিক দুই চোখ যায় চইলা যামু। আবার ভাবছি, কোথায় যামু এই মাটি ফালাইয়া। এই চান-সূর্য, গাছ-গাছালি, ম্যাঘ-মাদল, আর কোনো দ্যাশে আছে? আমি চইলা গেলে অন্যায় তো আর আমার সাথে সাথে যাবি না। এই দেশেই রয়্যা যাবি। তো আমার চইলা যাওয়ার লাভ? তাই মাটি ধইরা পইড়া ছিলাম। মাটির সাথে কতো কথা কইছি। কইছি, মাটিরে তুই আমার মা, কত দুঃখে তুই কালাবরণ হইছাস রে তা আমি জানি না? তুই তো আমারে পর করস নাই, আমি তরে ছাইড়া যামু কোন দুঃখে। তুই আছস, আমার সব আছে।
বলতে বলতে তার ফেরানো মুখটি তিনি নামিয়ে নিলেন আরো; মেঝের ওপর মুখ রেখে ক্রন্দন-কম্পিত শব্দগুলোকে বুকের ভেতর থেকে বের করে চলেছেন; তাঁর দুঃখ-দিনের নিঃসঙ্গ সাধনার পুষ্পগুলো আমার হাতে তুলে দিয়েছেন। মাথার কাছে লোকটা বসে আছে অবোধ চোখে; কবি আবদুর রব মুনশীর সঙ্গে সেই আমার শেষ সাক্ষাৎ।
আমার একমাত্র শোক এই জন্যে যে, তাঁর এ কাব্যসংগ্রহ তিনি দেখে যেতে পারলেন না।’
এই গল্পের মধ্যে আছে প্রতিরোধের সাহিত্যের চরিত্র। সময়কেও প্রতিফলিত করে। সামরিক শাসনের জাঁতাকলের নিচে বাস করেও মানুষ তার মর্যাদার জায়গাটা হারায় না – গল্পের এই বোধ পাঠক-হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়। মানুষ নিজেরা ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেরণার জায়গা খুঁজে পায়। একসময় গণসাহিত্যের ধারা সূচিত হয়েছিল সুকান্ত-সোমেন চন্দ্রের হাতে। সৈয়দ শামসুল হকের ‘কবি’ গল্প সেই ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করে, তবে তার ডিপারচার আছে। এখানেই সাহিত্যের সময়ের বিবর্তনের ভিন্ন চরিত্র অনুধাবন করা যায়। গল্প স্লোগান হয় না, শিল্পের যাত্রাকে অক্ষুণœ রেখে সাহিত্যই হয়, যে-সাহিত্য মানবসভ্যতার সম্পদ।
‘কবি’ গল্পের একত্রিশ বছর পরে পাওয়া যায় সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাটক নূরলদীনের সারাজীবন। রচিত হয় ১৯৮৩ সালে। অবশ্য প্রাসঙ্গিকভাবে এটা বলে রাখা দরকার যে, এই সময়ের মাঝে তাঁর আরো অনেক লেখা আছে আমি মাত্র কয়েকটি লেখা নির্বাচন করেছি আজকের এই লেখাটির জন্য। ‘কবি’ গল্পের ধারাবাহিকতায় আবার আমার সামনে এসে দাঁড়ান একজন নূরলদীন, যিনি চিৎকার করে বলেন, ‘জাগো বাহে’। নূরলদীন ইতিহাসের মানুষ, নূরলদীন গ্রামীণ জনপদের মানুষ। নূরলদীন কবি আবদুর রব মুনশীর মতো প্রতিরোধের মানুষ। বিদ্রোহের মানুষ। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকার মানুষ। সব্যসাচী লেখকের কলম আশ্চর্য দক্ষতায় উঠে এসেছে সমকালের বাংলাদেশে। তাঁর উঠে আসার শিল্পমাধ্যম কাব্যনাটক। দেশের মঞ্চে অভিনয়শিল্পীর কণ্ঠে উঠে আসে নূরলদীনের অবিনাশী উচ্চারণ – ‘জাগো বাহে’। আঞ্চলিক ভাষার একটি সম্বোধন (বাহে) ছড়িয়ে যায় সাহিত্যের ভূখ-ে।
তাঁর যে কবিতাটি আমার স্মৃতিতে গেঁথে আছে তার নাম ‘আমার পরিচয়’। বারবারই পড়ি। কবিতায় ইতিহাসের বিন্যাস,
জাতি-পরিচয়ের মৌলভূমি এবং ছন্দের অনুরণন তাড়িত করে। মনে হয়, আমিই তো সেই জাতির মানুষ, যে জাতি শেকড়হীন। ঐতিহ্যের পথে হেঁটে পৌঁছে যায় বর্তমানে – চলতে থাকবে আগামীর পথে। কবিতাটির শুরু এমন : ‘আমি জন্মেছি বাংলায়, আমি বাংলায় কথা বলি,/ আমি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর চলি।/ চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।/ তেরোশত নদী সুধায় আমাকে কোথা থেকে তুমি এলে?/… আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে।/ আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।/ আমি তা এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে।/ আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।’ এভাবে আরো অনেক পথ পার হয়েছে এই কবিতা। তিনি শেষ করেছেন এভাবে :
পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের –
কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;
অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;
একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;
আপোষ করিনি কখনোই আমি – এই হলো ইতিহাস।

এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান? –
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলার পথ চলি –
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস, পায়ে উর্বর পলি।
ইতিহাসের একটি বড় প্রবন্ধ পড়ে তরুণ প্রজন্ম যা জানবে, এই কবিতাটি চুম্বক আকারে সেই ইতিহাস তুলে ধরে। প্রবল আবেগ এবং অনুপ্রেরণার বোধে। কবিতাটি লেখা হয়েছে ১৯৯২ সালে।
সৈয়দ শামসুল হকের একটি উপন্যাসের নাম বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ। উপন্যাসটি তিনি দীর্ঘ সময় ধরে লিখেছেন। তাঁর
কথায়, ‘মনে পড়ছে, উপন্যাসটি লিখতে শুরু করেছিলাম লন্ডনে, সেই এক সন্ধ্যায় প্রবল তুষারপাত ও তুন্দ্রা বাতাসের ১৯৭৯ সালের চৌঠা জানুয়ারি, আর আজ লেখাটি শেষ হলো আমার এখনকার বসবাস ঢাকায় এবারের শৈত্যপ্রবাহিত কাঁপন এবং ঘোর কুয়াশার ভেতরে ১৯৯৮ সালের দশই জানুয়ারি।’
নাটকের আঙ্গিকে সূচিত হয়েছে এই উপন্যাস। কারণ অদৃশ্য কণ্ঠে শোনা গেছে উপন্যাসের সূচনার বয়ান। সে-বয়ানে শহীদ মিনারে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার কথা আছে। দুজন তরুণের যোদ্ধা হওয়ার কথা আছে। উপন্যাসের পটভূমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। বকচর গ্রামে ডেরা স্থাপন করেছে মুক্তিযোদ্ধার দল। এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে জলেশ্বরী কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক মহিউদ্দিন। লেখক বলছেন : ‘…এবং আমরা প্রবেশ করি প্রাচীন একটি কিংবদন্তীর ভেতরে – এবং আমরা প্রত্যক্ষ করি নতুন একটি কিংবদন্তীর জন্ম।’ মহিউদ্দিন নকশা এঁকে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখিয়ে দেন কীভাবে আধকোশা নদী বর্ষাকালে ফুলেফেঁপে উঠবে এবং তারা কীভাবে পাকিস্তানি সেনাদের পরাজিত করবে। ‘চারদিকে খলখল করে বইবে শুধু পানি আর পানি, পাহাড়ী পানি, ঢল, ঘূর্ণি; সেই দ্বীপের ভেতরে তখন আটকে পড়বে পাকিস্তান তার পুরো বাহিনী নিয়ে’। যোদ্ধাদের নানা পরিকল্পনা তৈরি হয় নদী, বৃষ্টি এবং বর্ষাকাল নিয়ে।
লেখক এই উপন্যাসে আঙ্গিকের নাটকীয় প্রতীক ব্যবহার করেছেন। মহিউদ্দিনের কথায় উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিদেশিদের ভাবনার কথা। সে মনে করে, সে নিজেও কিউবা বা ভিয়েতনামের যোদ্ধার মতো একজন যোদ্ধা। তার ভাবনায় উঠে আসে : ‘বৃটেনের শ্রমিক দলের একজন নেতা ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ অচিরেই বলবেন, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে কেউ রুখতে পারবে না। পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে একটাই কাজ করতে পেরেছে – রাতারাতি তারা গেরিলাদের জন্ম দিয়েছে, মানুষকে যোদ্ধা করে তুলেছে।’
দীর্ঘ পরিসরে অনেক বড় উপন্যাস এটি। বৃষ্টি এবং বিদ্রোহীদের নানা আচরণ উপন্যাসের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ফিরে ফিরে এসেছে। উপন্যাস শেষ হয়েছে মানবজীবনের মৌল সত্য উচ্চারণ করে। মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিনের অবৈধ সন্তানকে তিনি দেখিয়েছেন মানবধর্মের প্রকৃত মর্যাদায়। উচ্চারণ করেছেন ধর্মের প্রকৃত সত্য। শেষ লাইনটি এমন : ‘সামসুদ্দীন মানে দ্বীনের যে শামস, ধর্মের যে সূর্য। আর ধর্ম তো আর কিছুই নয়, ধর্ম হচ্ছে প্রকৃত অর্থে তাই – যা আমাদের ধারণ করে।’ উপন্যাসটি বাংলাদেশের সাহিত্যভা-ারে একটি অমূল্য সম্পদ।
যে-কটি রচনার কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে তা সময়ের বেশ বড় ব্যবধানে রচিত। তিনি সময়ের রশির গিঁটগুলো যথাসময়ে দিয়েছেন, তা বুঝতেই হবে। সাহিত্যের মূল্যায়ন কাল-পরিধিতে নান্দনিক ভাষ্যে বিবেচিত হয়। শিল্পের দায় থেকে কোনো লেখকই মুক্ত নন। সৈয়দ শামসুল হক সেই দায় সঙ্গে নিয়েই সময়ের যাত্রাপথে এগিয়েছেন। তিনি অত্যন্ত সচেতন দীর্ঘ মাপের শিল্পী।

শেষ বিকেলে শেষ দেখা
১৬ সেপ্টেম্বরের শেষ বিকেলে হকভাইকে দেখতে গিয়েছিলাম ইউনাইটেড হাসপাতালে। এদিন সকাল থেকে আমার কেমন অস্থির লাগছিল। বারবারই মনে হচ্ছিল হকভাইকে দেখতে যাব। আমার কথা শুনে আনোয়ার বলল, আমিও যাব। কত দিন হকভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়নি। আনোয়ারা আপাকে ফোন করো।
আমি মোবাইল হাতে নিয়েও ফোন করতে পারি না। সাহস হচ্ছিল না। কেমন আছেন হকভাই? যাওয়া কি ঠিক হবে? ডাক্তারের নিষেধ আছে কি? নানা ভাবনায় চুপ করে বসে থাকি। আনোয়ারা আপাকে ফোন করলে এত কিছুর উত্তর পাব। তারপরও কেন সাহস হচ্ছিল না বুঝতে পারছিলাম না।
দুপুরের দিকে পিয়াস মজিদ আসে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, হকভাইকে দেখতে গিয়েছিলে? ও মাথা নেড়ে জানাল, কয়েকবারই গিয়েছি।
আমি যাব ভাবছিলাম। আজই।
চলেন, আপা, আমিও আপনাদের সঙ্গে যাব। হাসপাতালের ছয় তলায়। ৬০৪ নম্বর রুম।
ওর কথায় সাহস এলো। আনোয়ারা আপাকে ফোন দিলাম। আপা ফোন ধরলেন। বললেন, কখন আসতে চাও? বললাম, চারটা বা পাঁচটা?
ঠিক আছে আস। হাসপাতালে এসে নিচে থেকে আমাকে ফোন দিও।
ঈদের ছুটি চলছে। ঢাকা শহরে যানজট নেই। চারটার সময় পৌঁছে যাই আমরা। আপাকে ফোন দিলে আপা বললেন, ও তো ঘুমিয়ে আছে। তোমরা একটু অপেক্ষা করো।
আমরা হাসপাতালের লবিতে অপেক্ষা করি। দেখতে পাই বাইরে দিনের আলো কমে আসছে। শেষ বিকেলের মায়াবী আলো ছড়িয়ে আছে চারদিকে। ঘড়িতে পাঁচটা বাজে। আনোয়ারা আপাকে ফোন করলে তিনি ওপরে যেতে বলেন।
ঘরের সামনে দেখা হয় কবি তারিক সুজাতের সঙ্গে। মুখের মাস্ক নিয়ে হাত পরিষ্কার করে আমরা ঘরে ঢুকি। প্রথমে আমি গিয়ে হকভাইয়ের বেডের পাশে দাঁড়াই। তিনি আমার হাত ধরেন। তাঁর নিজের অনুবাদে হাফিজের কয়েক লাইন কবিতা বলেন :
কেনান থেকে আসবে ফিরে – কোরো না শোক ইউসুফের।
নিরুদ্দেশের মাত্র ক’দিন! চোখের পানি ফেলো না ফের।
কেঁদো না আর। কাঁদবে কেন? দুঃখশোকের খরাতেই
গোলাপকুঁড়ি উঠবে ফুটে সুগন্ধ তার ছড়াতেই।
বুকে তোমার গোপন ব্যথা, বিষণœতায় মলিন মুখ –
আবার হয়ে উঠবে আলো, আসবে ফিরে মিলন সুখ,
শান্ত হবে দগ্ধ হৃদয়।
চোখের পানি ফেলো না ফের।
আমি কথা বলতে পারছিলাম না। আমাদের সঙ্গে কথা বলে আনোয়ারা আপা সামনের সোফায় গিয়ে বসেন। আনোয়ার হকভাইয়ের সঙ্গে কুশলবিনিময় করে অন্য সোফায় বসে।
হকভাই কবিতা বলা থামিয়ে আমাকে বলেন, তোমার কী খবর সেলিনা? ঘাড় নেড়ে ভালো বোঝাই। তখন সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আমি জানি তোমার অনেক শোক। কিন্তু জীবন তো চরৈবতি চরৈবতি। সব গিয়ে মেশে যমুনা নদীর মুশায়রায়।’ আমার ভেতরটা তোলপাড় করে। মির্জা গালিবকে নিয়ে লেখা আমার উপন্যাস যমুনা নদীর মুশায়রা আমি আরো কয়েকজনের সঙ্গে হকভাইকে উৎসর্গ করেছিলাম। তখন আমি অনুভব করলাম, হকভাই কত অনায়াস তীক্ষèতায় শোককে নদীর সঙ্গে মেশালেন। ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আমার মেয়ে লারা যখন প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় মারা যায়, সেদিন হকভাই আমার বাড়িতে এসেছিলেন। সেদিন তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। দেখা হওয়ার পরিস্থিতি ছিল না। বাড়িতে অসংখ্য মানুষ। পোস্তগোলায় বিধ্বস্ত হওয়া বিমান শহরজুড়ে মানুষকে কাঁদিয়েছিল। সাংবাদিক মঞ্জুর আহমদ ২.১০.১৯৯৮ তারিখের দৈনিক জনকণ্ঠে লিখেছিলেন, ‘রাস্তার পাশে প্রধান ও প্রশস্ত সড়কের গা ঘেঁষে একটা চেয়ার পেতে নিশ্চুপ বসে ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক।’ এমন আরো অনেকের কাছে হকভাই সেদিন আমার বাড়িতে এসেছিলেন সে-কথা শুনেছি।
একটু পরে হকভাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি শ্যামলীর বাসাতেই আছ?’
বললাম, হ্যাঁ আছি। অনেকে আমাকে বলেছে এই বাড়িটা বিক্রি করে গুলশানে ফ্ল্যাট কিনতে। কিন্তু আমি তা করতে পারিনি। লারাকে এখানে রেখে আমি কোথাও যেতে পারব না। তিনি আমার হাত মুঠিতে ধরে রেখেই বললেন, ‘একটা কথা মনে রাখবে, হকভাই বলছি, এটা বলবে সবাইকে ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। আমি বলি – বিশ্বাসের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। চারদিকে মানুষ দেখি না।’
আমি নিশ্চুপ তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার মনে হয় না আমি একজন অসুস্থ মানুষকে দেখতে এসেছি। তিনি তো আমার সামনে সেই মানুষ, যাঁকে আমি ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানে বটতলার মঞ্চের সামনে দেখেছিলাম। সেদিন বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন একুশে ফেব্রুয়ারির ৭ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করতে। মনে হচ্ছে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটি অবিকল তেমনই আছেন। তাঁকে সরাসরি দেখার আগে তাঁর বইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। এখনো আমার সামনে তিনি সতেজ, প্রাণবন্ত মানুষ। কোথাও তাঁর কোনো অসুখ নেই।
তিনি আবার বললেন, ‘একটা আশ্চর্যের ব্যাপার খেয়াল করেছ? কথাসাহিত্যে আমরা সবাই উত্তরবঙ্গের। আমি, ইলিয়াস, হাসান, শওকত আলী, তুমি।’
আমি অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার ভাবনায় কখনো এটা আসেনি। আমার বড়ো হওয়া উত্তরবঙ্গে। শিক্ষাদীক্ষা বগুড়া-রাজশাহীতে। এখনো আমার একটি প্রিয় জায়গা চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্ত এলাকা পোলাডাঙা। মহানন্দা নদীর পাড়ে। হকভাই হেসে বললেন, ‘অবাক হয়েছ?’ আমি মৃদুস্বরে বললাম, হ্যাঁ।
পিয়াস ওর মোবাইলে ছবি ওঠায়। তারিক সুজাতও ছবি তোলেন। হকভাই সবাইকে ছবি তোলার জন্য তাঁর বিছানার পাশে ডাকেন। আনোয়ার কাছে এসে দাঁড়ালে বলেন, ‘ও খুব ভালো মানুষ। ও শান্তিনিকেতনে আমার যে খেয়াল রেখেছিল তা আমি ভুলব না।’ তারপর সঙ্গে-সঙ্গে কাজী নজরুলের কবিতা থেকে দুই-তিনটে লাইন বললেন জোরে জোরে – ‘আনোয়ার। আনোয়ার। দিলাওয়ার তুমি… মারো যত জানোয়ার।’ তিনি কত সহজে তাঁর স্মৃতি থেকে এসব কথা তুলে আনলেন তা আমাকে অবাক করে। আমি আবারো ভাবি, হকভাই অসুস্থ নন। তাঁর বিছানার পাশে বসে আমি তখনো মনে করতে পারছিলাম না যে, কোন সালে আমরা গিয়েছিলাম। একটি সাহিত্য সম্মেলনে কলকাতায় গিয়েছিলাম আমরা। শান্তিনিকেতনে যাওয়ার জন্য একটি মাইক্রোবাস জোগাড় করেছিল কবি কামাল চৌধুরী। পথে এবং শান্তিনিকেতনে খাওয়ার জন্য রেস্টুরেন্টে ঢুকলে আনোয়ার হকভাই কী খাবেন জিজ্ঞেস করে খাওয়ার প্লেট তাঁকে দিয়ে আসত। হকভাই ভোলেননি।
বিদায় নেওয়ার সময় হকভাই আবার আমার হাত ধরে বললেন, ‘আবার এসো।’ আমরা যখন বারান্দাটা পার হচ্ছিলাম, তখন আনোয়ার বারবার বলছিল, হকভাই নিশ্চয় অনেক দিন বাঁচবেন। তাঁকে একটুও অসুস্থ মনে হয়নি। এত প্রাণবন্ত, এত সজীব।
আমি বললাম, হকভাইকে দেখতে আবার আসব। তিনি আসতে বলেছেন। হাসপাতালের লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে তখনো ভাবতে পারিনি যে, তাঁকে দেখতে যেতে হবে বাংলা একাডেমিতে কিংবা শহীদ মিনারে। দুদিন পরে পিয়াস ফোন করে বলল, হকভাই তাঁর একটি ইংরেজি গল্পের কপি খুঁজছেন। তিনি বলেছেন, সেলিনা কিংবা রশীদ হায়দারের কাছে পেতে পারো। হকভাইয়ের লেখার একটি ইংরেজি সংকলন সম্পাদিত হবে।
আমি জিজ্ঞেস করি, কোন গল্প পিয়াস? কোথায় ছাপা হয়েছিল?
পিয়াস জানাল, বইটি রাধা চক্রবর্তী অনূদিত ও সম্পাদিত CROSSINGS, দিল্লি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। আমি বললাম, বইটি আমার কাছে আছে। আমি ফটোকপি করে রাখছি। তুমি আমার কাছ থেকে নিয়ে যেও।
পরদিন পিয়াস গল্পটি নিয়ে যায়। হকভাইয়ের গল্পের নাম ‘গুপ্ত জীবন, প্রকাশ্য মৃত্যু।’ অনুবাদের নাম ঝSecret Life, Public Death. মাঝে দুদিন পার হয়।
সেদিন ছিল ২৭শে সেপ্টেম্বর। লারার মৃত্যুবার্ষিকী। আমার বুকের ভেতর স্তব্ধ শূন্যতা। দুপুরের পরে ফোন পাই কবি ওবায়েদ আকাশের।
আপা হকভাই আইসিইউতে। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি ডাক্তাররা আশাবাদী নন। আজই একটা কিছু হতে পারে।
আমার কণ্ঠে আর্তনাদ ছড়ায়। কী বলছ! বিকেলে আবার ২৭শে সেপ্টেম্বর ঘনীভূত হয় আমার জীবনে। চারদিক থেকে খবর পাই হকভাই নেই।
২৮ তারিখ সকালে আবার ফোন বাজে। হকভাইকে বাংলা একাডেমিতে আনা হবে। আমি জানি, আমি কোথাও যাব না। ১৯৯৮ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বরের পরে আমি আর কাউকে শেষ দেখা দেখতে শহীদ মিনারে যাইনি। আমি কোনো কুলখানিতে যাই না। এসব অনুষ্ঠানে গেলে আমার বুকের ভেতরে ২৭শে সেপ্টেম্বর স্তব্ধ হয়ে থাকে। আমি নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করি। জন্ম এবং মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়ের বেঁচে থাকার যুদ্ধ।
হকভাই আপনিও ২৭শে সেপ্টেম্বরে যুক্ত হয়ে গেলেন। আপনি বলেছিলেন, ‘তোমার অনেক শোক, সেলিনা।’ আপনি আমাকে আরো শোকাতুর করলেন। তারপরও বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে হলে, আমাকে বলতে হবে আপনার গল্প-উপন্যাস-কবিতা-নাটক-প্রবন্ধের কথা। আর এভাবে আপনাকে আমার দেখা হবে। আমি জানি আপনার মৃত্যু নেই।
‘রোগশয্যায় রচিত পঙ্ক্তিমালা’ আপনি মুখে মুখে বলেছেন হকভাই। লিখেছেন আনোয়ারা আপা। আপনার ষোলোটি কবিতায় আমরা আপনার অমিত শক্তি দেখেছি। পড়ার সময় চোখ ভিজে যায়। দশ নম্বর কবিতাটি লিখেছেন ১১ই সেপ্টেম্বর, বিকেল ৪ : ১৫ মিনিটে।
উদ্ধৃতি : দশ

শাদা এ্যাপ্রন, সবুজ
ইউনিফরম, হলুদ দেয়াল
এ হচ্ছে হাসপাতাল।
আমার গায়ে শাদা চাদর
কিন্তু এ কারও কাফন নয়
এই শাদার ভেতরে
সাতটি রং অপেক্ষায় রয়েছে
কখন আমাকে তারা রঞ্জিত করে
উত্তোলিত করবে নূতন কবিতায়।
আমাদের সামনে আপনি রঞ্জিত হয়ে আছেন কবি। আপনার রং মুছে যাবে না। নবীন পাঠকের কাছে নতুন হয়ে ফিরবে আপনার কবিতা। 