সোনালি কৈ-এর জীবন

বদরুন নাহার

লাক্কাতুরায় চা-বাগানের কাঠুরিয়ার মেয়ের নাম আমরা জানতে পারি নাই, তবে ছোলেজা বেগমের মেয়ের নাম যে রামেছা সে-বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। মেয়েটির নাম স্থানীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে। শহরের মানুষ দ্যাখে, ছোলেজা বেগমের চোখ মাছের চোখের মতো পলকহীন। সেই চোখ কোনোদিন বন্ধ হতো কি-না তা নিয়ে কানাঘুষা হয়, কেউ তাকে সে-বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারে না। প্রশ্ন করে থানার ওসি আর তা থেকে জানা যায়, ছোলেজা বেগম একদিন স্বপ্ন দেখেছিলেন, তখন আমাদের চোখের সামনে পলকহীন চোখ পুনরায় ভেসে ওঠে এবং আমরা ধরে নিই স্বপ্নভঙ্গের কষ্টে তার চোখদুটো পাথর হয়ে গেছে। কিন্তু খাবার টেবিলে জীবনের অভ্যাসমতো খাদ্য খেতে খেতে পত্রিকার পাতায় যখন পড়ি যে, ছোলেজা বেগমের কপালে স্বামীর ভাত বেশিদিন জোটে নাই, তখন তা বাস্তব জীবনের মতো লাগে। আমরা মূলত গল্প পড়তে চাই, তখন মধ্যবয়স্ক ছোলেজা বেগমকে নিয়ে আমাদের আগ্রহ থাকে না বরং আমরা রামেছার কথাই জানতে চাই। তাই দু-এক লাইন অমনোযোগে ডিঙিয়ে চলে যাই, যেখানে তার প্রথম স্বপ্নভঙ্গের কথা লেখা থাকে।

দরগা মহল্লায় লন্ডনি বাড়িতে কাজ নেওয়ার পর ছোলেজা বেগম যে-স্বপ্ন দেখেন তা তার কন্যাকে নিয়ে, তিনি লন্ডনি বাড়ির মোটা সেগুন কাঠের পালঙ্ক থেকে অযাচিত ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তেই স্বপ্ন দেখেন যে, একদিন তার রামেছার বিবাহ এক লন্ডনির সঙ্গে সম্পন্ন হবে। এমন সুন্দর মেয়ে দেখলে কারো মাথা ঠিক থাকবে না, তা সে ধরে নিয়েছিল। আমরা একথাও তেমন কোনো মজা পায় না, কেননা তখন যে রামেছা আমাদের দৃষ্টিতে ধরা দেয়, সে সুন্দর হলেও তা একটা শিশুর অবয়বই থাকে। বরং তখন পর্যন্ত আমাদের ছোলেজা বেগমের পলকহীন চোখ ভেসে থাকে, তখন ধরে নিই, তার এ-স্বপ্ন ঘুমের মধ্যে দেখা নয়। হয়তো সে চোখের পাতা না ফেলে জেগে জেগেই স্বপ্নটা দেখেছিল।

 

দুই

প্রবাসী  লুলু মিয়ার স্বপ্নের বাড়ি লন্ডন হাউস। বিলেতে হাড়ভাঙা খাটুনির পর দু-তিন বছর বাদে দেশে ফিরে একটু আরাম-আয়েশ করার জন্য এই বিশাল আলিশান বাড়িটা তিনি করে রেখেছেন, এছাড়াও দুটি বাড়ি শহরে আছে, তা এমন ভিক্টোরিয়ান কলামসমৃদ্ধ আর আলিশান নয়। তা যে কোনো ভাড়াবাড়ির মতো দেখতে। মৌলভীবাজারের পৈতৃক ভিটায় একখানা ঘর তিনি তুলেছেন, কিন্তু লন্ডন থেকে এসে সিলেট শহরের এই বাড়িটাই তার অবকাশযাপনের প্রধান জায়গা। এসিসহ আধুনিক গৃহব্যবস্থাপনা না থাকলে নিজের ছেলেমেয়ে কেন বউকেও দেশে আনা কষ্টের ছিল। এখন আর ছেলেমেয়েরা তেমন একটা আসে না। অনেক কষ্টে মেয়েটাকে এর আগে এনে একটা দেশি পাত্রের হাতে তুলে দিতে পেরেছেন, ছেলেটাকে তাও পারবেন কি-না সন্দেহ। তবে সারাবছর লন্ডন হাউসে আরাম-আয়েশে কাটান তার ভাতিজা লেছু মিয়া। এমনই ব্যাপার-স্যাপারের মধ্যে শিশুকন্যাসহ উপস্থিত হয়েছিল ছোলেজা বেগম।

লেছু মিয়া ভাড়াবাড়ির তদারকি করে আর ভাড়া তুলে দিনযাপন করত এই আলিশান বাড়িতেই। পাড়ায় নতুন কেউ এলে বুঝতেই পারতো না যে লেছু মিয়া বাড়ির মালিক না, সে মূলত বাড়িটির কেয়ারটেকার। তার ওপর কেয়ার নেওয়ার কেউ ছিল না বিধায় সে মোটামুটি সুখী জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল। লেছু মিয়া শিক্ষা-দীক্ষা তেমন না  জানলেও বাড়িওয়ালাসুলভ ভাবভঙ্গিতে বেশ দক্ষ, ফলে ভাড়া বা ভাড়াটে নিয়ে লুলু মিয়ার চিন্তা তেমন একটা করতে হতো না। কিন্তু ছোলেজা বেগমকে যখন এই আলিশান বাড়ির চিলেকোঠায় স্থায়ী থাকার ব্যবস্থা করলেন লুলু মিয়া, তখন লেছু মিয়ার বাড়িময় একক স্বাধীনতায় ওপর এক ধরনের বাধা তৈরি হলো বলে এলাকাবাসীর ধারণা। চাচা-চাচির সুখের জোগান দিতে লেছু মিয়াই এনেছিল ছোলেজা বেগমকে, কিন্তু পরবর্তীকালে তার মনে হয়, খাল কেটে কুমির এনেছে সে। এইসব পুরনো ঘটনা হলেও বর্তমানে তা শহরে প্রচার পায়। আমরা ছাপা হয়ে আসা সেই গল্পগুলোর অলিগলি ঘুরে আসল কথা খুঁজে দেখি।

তিন

বছর চার আগে যখন লুলু মিয়া সপরিবারে দেশে এসেছিলেন, তখন রামেছার বয়স কত হবে? বারো-তেরো। মামা মামা করে রামেছা যেমন পাগল ছিল, তেমনি লুলু মিয়া আর তার বউ রামেছাকে ভাগনি জ্ঞানে কত আদর করত। ছোলেজা বেগমকে নিজের বোন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে লুলু মিয়া প্রতিবেশী কয়েস উদ্দিনকে বলছিল, কিবা কইতামরে বাই, আমার এই বুনে থাকলে আমি ঘরবাড়ি নিয়া মাথা ঘামাইতাম না। প্রচন্ড ভরসার সম্পর্কে তারা আবদ্ধ হয়েছিল, আর তা থেকে লেছু মিয়ার গুরুত্ব যেন খানিকটা কমে এক দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। বিষয়-সম্পত্তির হিসাবে দেখা দেয় গরমিল, ছোলেজা বেগম বিষয়-আশয় নিয়ে মাথা না ঘামালেও লেছু মিয়ার অযাচিত অপচয় বিষয়ে সে ছিল সজাগ, নিজে থেকে লুলু মিয়াকে সে কিছু বলে না। তার নিজে থেকে বলার দরকারই বা কি? সে চায় আশ্রয় আর মেয়ে রামেছাকে নিয়ে দেখা স্বপ্নের পথে যাত্রা করতে।

ছোলেজা বেগম দিনরাত ভাই-ভাবির জন্য, বাইম মাছের ভুনা করে, বিরন চালের খিচুড়ি রাঁধে, খাসির মাংসে আখনি আর টক চাটনি বানিয়ে বানিয়ে মনোরমভাবে টেবিল সাজায়। ঝাল-মশলা আর টক-টক ঘ্রাণ বাড়িটা মৌ-মৌ করে। লুলু মিয়ার পরিতৃপ্তিতে জেগে ওঠে – আ-হা, লন্ডনত তো এমুন ভূজ পাতার বরা মিলত না!

ছাদভর্তি শৈল, বোয়ালসহ নানা মাছের শুঁটকিটাকে মশারির কাপড়ে ঠিকঠাক ঢেকে দেয় ছোলেজা বেগম। এতকিছু সামলেও  তার  নজর ছিল লুলু মিয়ার ছেলে রাইয়ানের দিকে। ফর্সা টুকুটুকা ছেলেটার মুখে যে মায়া! চোখ মেলে ছেলেটিকে দেখে নিত্য ছোলেজা বেগমের মনে যে-কথাটি আসা-যাওয়া করে – ইশ্ বাবা জালালে চায় তো পুয়ার লগে রামেছার একটা ভাবকায়দা হয়…। যেন তাইলে তার আর লন্ডনি জামাই পাইতে চিন্তা থাকে না। সে রাইয়ানকে দরদমাখা কণ্ঠে পুত পুত বলে আদর করে। আর রোজ রামেছাকে স্নো-পাউডার দিয়ে সাজিয়ে রাখে, যদিও ছেলেটা সেদিকে মোটেই তাকায় না। রাত-দিন টিভিতে ফিল্ম দেখে, নতুন নতুন গেম খেলে, আত্মীয়স্বজন এলে আদবের সালাম দিয়ে ভাঙা ভাঙা সিলেটি বাংলায় কথা বলে। তবে লুলু মিয়ার বউ মমিনা বেগম খুব প্রশংসা করে – ও মাই আল্লা আমারার রামেছা যে সৌন্দর হইচ্ছে!

রামেছা লজ্জা পেয়ে ঘরের পর্দা ধরে একপাক মোচড় খায়, ছোলেজা বেগম মেয়েকে ধাক্কা দেয় – দেখুইক না, তর মামানির কিতা লাগে, যে আদোরডা তোরে করছে না।

মমিনা বেগম চানও, পাটা টিপে দিতে, মাথার পাকা চুল কামড়াইলে রামেছার সরু হাতের টানে তার ক্লান্ত শরীরটা আরাম পান বলেই না মেয়েটাকে তার এত পছন্দ। এমনকি লুলু মিয়ার  পা-টেপা, চুল তোলার কাজেও এ-বাড়িতে রামেছার দরকার। রামেছারও মামানিরে পছন্দ, সে যে সৌন্দর পাথর-বসানো শিপন শাড়ি কিনে দিছে! বিদেশি ব্যাগ আর যাওয়ার সময় তো কত্ত কী দিয়া যাবে!

ছোলেজা বেগম মেয়েকে তাড়া দিয়ে মামা-মামির সেবায় পাঠায়, তারা চাইলে রাইয়ানের নজর আসতে কতক্ষণ! এমন স্বপ্নে নানা ঘরসংসারি ভেসে বেড়ায় ছোলেজা বেগমের চোখে। সে সেবাদানে চাকর থেকে আরো চাকর হয়ে যেতে থাকে মনিবের সন্তুষ্টির জন্য। মমিনা বেগম যাওয়ার সময় বলে যায় – বোইন, রামেছার বিয়ার টাইমে দ্যাশে আইমু… ওর সকল খরচাপাতি আমারার।

ছোলেজা বেগম লজ্জা পায়, বিগলিত হয়, বলে – পুরিডা তো তোমাগোই দিচ্ছি না, তুমারার না দিলে হের বিয়া তো আমি দিতাম না।

 

চার

ছোলেজা বেগম জীবনেও ভাবে নাই এমন একদিন আসবে! কিন্তু তাই ঘটে। বছর দুই হলো মমিনা বেগমের অকালমৃত্যুতে ভেঙে পড়েছে লুলু মিয়া। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে যার যার মতো ব্যস্ত হলে একা দেশে এসে মনমরা লুলু মিয়ার কণ্ঠে খালি একাকিত্বের দীর্ঘশ্বাস। সেই লুলু মিয়ার কাছ থেকে যখন ষোলো বছরের রামেছাকে বিয়ে করার প্রস্তাব আসে তখন ছোলেজা বেগম কিছু ঠাওর করতে পারে না, তার কেমন জব বন্ধ হয়ে যায়। স্বপ্নভঙ্গের ভয়ে সে আচমকা কেঁপে ওঠে।

দিন কয় কেমন উদাস হয়ে ঘুরে বেড়ায় ছোলেজা বেগম, যেন আদারে-বাদারে বিলাই খোঁজে। সেই ছোট্টবেলায় একবার তার গলায় কৈ মাছের কাঁটা ফুটলে বিড়ালের পা ধরে মাপ চাইতে যেমন বিলাইয়ের খোঁজ পড়েছিল, তেমনি যেন সে বিলাই খোঁজে! গলার কাঁটা নামেও না, গলা আটকে ধরে। সে দরগায় যায় ফুপুর খোঁজে, বুড়ি অন্ধ, ফকির মানুষ, দরগা গেটে ভিক্ষা করে। শেষে সে-ই গলার কাঁটাটা নামাতে পারে। অন্ধ ফকির যেন দিব্য চোখে দেখতে পায় অনেক কিছু, তার কণ্ঠে তিরস্কার ঝরে – বিটা মাইনষের আবার বয়স কী। তারপর অন্ধ জবেদা বেগম ছড়া কেটে বলে –

লন্ডনি দামান্দা মিঞা গুণের কি দরকার

ধর কড়ি থাকলেই অইলো জাতের নাই বিচার

টেকার নাম চধরী খনকার টেকায় কিনা করে

টেকার জোরে, মেকুরেও বাঘের খাপ ধরে।

তোরে কইলাম ছোলেজা এমুন দামান্দ ফিরাইস না। ছোলেজা বেগমও বোঝে এইসব মাত অভিজ্ঞতার, ফেলনা নয়। তারপর পুরুষ মানুষের বয়স বিষয়ক ছবক আর লন্ডনি জামাই পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মিলেমিশে লুলু মিয়ার সঙ্গে রামেছার বিয়েটা হয়ে যায়।

আর বিয়েটা ঘটে যাওয়ার পর লুলু মিয়া যখন ছোলেজা বেগমকে আম্মা আম্মা করে ডাকা শুরু করে, তখন ছোলেজা বেগম খুব সুখ পায়। যদিও রামেছা কেমন কুঁকড়ে থাকে, সে কি আর মামুরে বিয়া করতে চাইছে? মায় তাকে বলে-কয়ে রাজি করায়, আপনা মামু তো না।

এমন কান্ডে লেছু মিয়াসহ লুলু মিয়ার ভাই-ভাতিজার জ্ঞাতিগোষ্ঠী  গোসা করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। লন্ডন থেকে মেয়ের ফোন আসে, – আববা তুমি ইতা কিতা করলা? ছেলেটার এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। সেই সময় ছোলেজা বেগমের ওপর সংসারের ভার আরো প্রকট হয়, ছোলেজা বেগম নিজে নতুন কাজের মেয়ে ময়নাকে নিয়োগ দেয়। সবকিছু এখন তার নিয়ন্ত্রণে। লুলু মিয়ার হারানো বউয়ের শোক ভুলে বালিকাবধূর মন পেতেই চায়। বাড়িতে একটা উৎসব-আয়োজনের ব্যাপার-স্যাপার ঘটলে বাড়ির কারো কারো বেশ যেন মান ভেঙে যায়। একদল আত্মীয়-স্বজন লুলু মিয়ার বাড়ি ফিরে আসে। কেবল আসে না লেছু মিয়া। এইসব কথা কি আর শহরের সকলে জানতো? জানতো না,  কিন্তু যখন জানতে পারে তখন শহরের অনেক লোকের ভিড়।

ছয়

তখন আষাঢ়-শ্রাবণ মাস। হজরত শাহজালালের ওফাতের দিন মাত্র তিন সপ্তাহ বাকি। এ-সময় শহর সরগরম। লাকড়ি তোলা উৎসবকে কেন্দ্র করে। ছোলেজা বেগমের কাছে এই লাকড়ি তোলা পদযাত্রা বিশেষ ভক্তির বিষয়, তা আজ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। একদিন এই পদযাত্রা তাঁকে নতুন স্বপ্নের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। বিগত দশ বছর সে এ-পদযাত্রার অংশ হয়ে মিশে গিয়েছিল লাল পতাকা মিছিলে। আজ যখন তার রামেছা এক লন্ডনি স্বামী পেয়েছে, সংসার পেয়েছে, তা তো এ জালাল বাবারই আশীর্বাদ।

বাড়িতে আজ কোনো মেহমান ছিল না, নতুন রাঁধুনি ময়নাও বায়না ধরেছে, সঙ্গে যাবে। সকাল সকাল সকল কাজ শেষ, কিন্তু দুপুর নাগাদ তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। তাতে কি!  বাবার দোয়ায়  মেঘ-বৃষ্টি কোনো ব্যাপার না। ছোলেজা বেগম ময়নাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। লুলু মিয়ার কল্যাণে আজ সে সিএনজি ভাড়া করে রওনা দেয়, সবই পিরবাবার দোয়া – সে-বিষয়টি ময়নাকে বারবার করে জানায় ছোলেজা বেগম। তারা বেরিয়ে এলে রামেছাই দরজা এঁটে দিয়েছিল।

লাক্কাতুরার পাশের টিলায় কোনো গাছ আর অবশিষ্ট নেই, কচি ঘাস থেকে শুরু করে সিটকি, করছের চিকন ডাল ভেঙে ভেঙে দীর্ঘ মিছিলে ভরে যায় লাক্কাতুরা থেকে চৌকিদিঘি। এবার সিন্নির দিন আস্ত একটা খাসি দেবে ছোলেজা বেগম, ময়নাকে সে-কথাও জানায়।

অথচ যাত্রা শেষে ফিরে আসতেই সব শেষ হয়ে যাবে কে জানতো। এমন ঘটনার কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি ছোলেজা বেগম। এখন সে মাছের মতো পলকহীন, থানার ভেতরে বসে সে যেন ফিরে যেতে চায় দশটি বছর আগে।

সাত

সেবারও মেঘ-তুফানের রাত, মাত্র দিন-দুই হলো ছোলেজা বেগম গ্রাম ছেড়ে সিলেট শহরে এসেছে। চেনা বলতে এই অন্ধ ফুপু জোবেদা। সেই রাতে দরগায় বসে অন্ধ ফুপু গল্প করে, এইসব কিচ্ছা ছোলেজা বেগম আগে শোনেনি, ফুপুর পাশে বসে সে অবাক হয়ে গল্প শোনে, আর অঘোরে ঘুমায় ছয় বছরের রামেছা।

অন্ধ হইলেও জোবেদা যেন সব দিনের মতো পরিষ্কার দেখে দেখে বলছিল – সাইতশো বছর আগোর মাত, একদিন বাফো শাহজালালের কাছেত একখান গরিব কাঠুরিয়া আইসা খাঁড়াইল। এই গল্প দশ বছর আগে ছোলেজা বেগম শুনেছিল অন্ধ ফকিরের কাছে, এ-গল্প গতকাল শুনেছিল ময়না ছোলেজা বেগমের কাছ থেকে। এ-গল্প মানুষ শুনছে সাতশো বছর ধরে।

শাহজালালের মক্কা-মদিনার মাটির সঙ্গে এই শ্রীহট্টের মাটির মিলমিশ ঘটে গেল, পূর্ণ নগরীর নির্মাণ তখন পুরোদস্ত্তর চলছে। কিন্তু লাক্কাতুরা জঙ্গলের গরিব কাঠুরিয়া বিবাহযোগ্য কন্যার চিন্তায় কখনো বেহুঁশে ঘুমায়, কখনো বা ঘুমহীন রাত্র পার করে। সেই সময় কাঠুরিয়া স্বপ্নে দেখে বাবা, শাহজালালকে। কোরাইশ বংশের এই আধ্যাত্মিক মানুষটিই দিতে পারে তার সমস্যার সমাধান। পরের দিন সকালে কাঠুরিয়া ছুটে আসে, সে বলে – বাবা, আমারে বাঁচান বাবা।

সে জানায়, তার একমাত্র পুরি এখন বিবাহযোগ্য, কাঠুরিয়ার মেয়ে বলে তার কোনো পাত্রের সন্ধান মেলে না। পিরবাবা তাকে দেখব বলে বাড়ি ফিরে যেতে বলে। তখন এইসব রাস্তাঘাট নাই, খালি টিলার পর টিলা জঙ্গলা, গাছ-গাছরা। পরেরদিন সকালে পিরবাবা, পুরনো পোশাক পরে, সাথের অলি-আউলিয়াদের সঙ্গী করে। কুঠার হাতে হেঁটে জঙ্গলের দিকে যেতে থাকলে, অনেক মানুষ বাবার পেছনে হাঁটা শুরু করেন। সারাদিন হজরত শাহজালাল, নিজ হাতে কাঠ কাটেন, তার এই পরিশ্রম দেখে অন্যরাও কাঠ কটে। রাতে দরগায় ফিরে ভক্তবৃন্দের কাছে তিনি জানতে চান যে, আজ সে কী করেছে?

– হুজুর, আপনি কাঠ কেটেছেন?

– এটা কার কাজ?

– কাঠুরিয়ার কাজ।

– তাহলে আজ আমি কাঠুরিয়ার কাজ করেছি, আপনারা আমাকে কাঠুরিয়া বলতে পারেন।

উপস্থিত ভক্তবৃন্দ পরস্পরের দিকে বিহবল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারা সহসা কোনো উত্তর দিতে পারে না।

পিরবাবা আবার বলেন – কী, আমি কি কাঠুরিয়া কি-না?

সবাই তখন বলে – জি হুজুর।

কেউ মুখে উচ্চারণ করেন না,  আমরা সে-গল্প শুনি বছরের পর বছর, আর সেই স্বপ্ন থেকেই ছোলেজা বেগমের লন্ডনি স্বপ্নের শুরু। সে অতি ভক্তিসহকারে প্রতিটি বছর বাবা জালালের ওফাতের জন্য কাঠ সংগ্রহে অংশ নিয়েছে। গল্পে বিষয়টি আরো গল্প হয়ে ওঠে যখন জানা যায়, সেদিন দরগায় উপস্থিত সহচরী আর ভক্তদের অনেকেই কাঠুরিয়ার কন্যাকে বিবাহে উৎসাহী হয়। পিরবাবা তখন কাঠুরিয়াকন্যার জন্য পাত্র নির্ধারণ করে দেন আর এই সত্যের প্রতিষ্ঠাও সেদিন হয় যে, কাঠুরিয়াও মানুষ। আমরা সাতশো বছর পর আর জানতে পারিনি, কাঠুরিয়ার জীবনে পরবর্তীকালে কোনো স্বপ্নভঙ্গের ঘটনা ঘটেছিল কি-না। কেননা, গল্পটা আর কাঠুরিয়ার থাকেনি, গল্পটা হয়ে যায় হজরত শাহজালালের। কিন্তু আমরা যখন জানতে পারি যে, ছোলেজা বেগমের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। দিনে দুপুরে লুলু মিয়া আর রামেছার রক্তাক্ত মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। খবরের কাগজের ছবিটা সাদা-কালো হলেও সেখানে রক্তের ধারা স্পষ্ট, মানুষ পড়তে পড়তে লাল রক্তে শিউরে ওঠে।

ছোলেজা বেগম এতদিন বাদে অবাক হয়ে ভাবতে থাকেন, বাবা জালাল সারাদিন কষ্ট করে নিজ হাতে কাঠ কেটেছিল কেন? সে বললেই তো কাঠুরিয়ার মেয়েকে বিয়ে করতে যে কেউ রাজি হতো। বাবা কেন নিজের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাঠ কাটলেন? এই কুদরতির বিষয়টার কথা তার মাথায় আগে আসেনি। এই রহস্যের উত্তর আজ সে কার কাছ থেকে জানবে? ছোলেজা বেগমের বুক হাহাকার করে, আহা রে, বাবা কত কষ্ট করে কাঠ কাটলেন? ইতা ক্যান করলেইন? হেই মাত তিনি কার কাছে জিগাইবেন।

ঘটনাটা দিনে-দুপুরে ঘটেছে বলে বেশ জটিল হয়ে পড়ে। শহরে তখন নানা লোকের আনাগোনা, রাত হলে বিষয়টা হয়তো খোলাসা করা সহজ হতো, রাতে তো আর বেশি মানুষ বাইরে থাকে না, কোন ঘরে কে ছিল না বিষয়টা বের করা সহজ হতো। পুলিশের এমন আশঙ্কার কথায় ছোলেজা বেগমের কোনো বিকার ঘটে না। সে এখন মাছের চোখে তাকিয়ে থাকে, সবাই বুঝতেও পারে না, সে কি নতুন স্বপ্ন দেখে? না-কি সে দশ বছর আগে দেখা স্বপ্নটাকে ফিরিয়ে আনতে চায়। সেই ছয় বছরের রামেছাকে ফিরিয়ে আনতে চায়, আদরে-সোহাগে ছোট্ট মেয়েটাকে সে নিজের বুকে আগলে রাখবে। তার সুদূরের গল্পে জেগে ওঠা স্বপ্নটাকে ডিঙিয়ে মেয়েটাকে বুকে করে ফিরে যেতে চায় গহিন গ্রামে, না-কি সে কোথাও যেতে চায় না। সে কেবল মেয়েকে বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখতে চায়। বাবা জালালের ঘাম-ঝরানো কষ্টের কথা না জানা পর্যন্ত সে মেয়েকে কোলছাড়া করবে না।

কিন্তু প্রাণময় রামেছা কেমন যেন ছোলেজা বেগমের চোখে ঝলক মারে, তাকে কোথায় গেলে পাবে। তার মনে হয় দরগায় চলে যাবে, বাবার দোয়া ছাড়া তার আর কারো কাছে যাবার নাই। কিন্তু এই যে থানা, কোথায় যেন রামেছাকে নিয়ে গেল! এখন সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। তার চোখে ভেসে ওঠে দরগার অলৌকিক ঝরনা। থানার কাঠের চেয়ার থেকে ক্রমশ ছোলেজা বেগম উবু হয়ে যেতে থাকে, ক্রমশ মাটির দিকে ঝুঁকে পড়ে।

কিন্তু থানার কেউ বুঝতে পারে না, ছোলেজা বেগম আর সেখানে নেই। ছোলেজা বেগম যেন কুয়ার সম্মুখে উবু হয়ে কী খুঁজে দেখতে চায়। সে দরগার পেছনে কুয়ার ভেতরে সোনালি খুঁজে ফিরে। যেখানে জীবন নিয়ে লুকিয়ে পড়েছে রামেছা।