সৌন্দর্য সন্ধানের পথক্রমা

সুধীর চক্রবর্তী
আরম্ভটা ঠিক গল্পের মতো। ২০০৪ সালের গোড়ায় কলকাতা থেকে কবি জয় গোস্বামী ফোন করে জানাল, ‘একটা আনন্দের খবর জানাচ্ছি। এইমাত্র খবর পেলাম আপনি এ-বছর সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন আপনার লেখা বাউল ফকির কথা বইটির জন্যে।  খুব আনন্দ হচ্ছে। অভিনন্দন নিবেন।’ সংবাদটা আকস্মিক এবং অপূর্বকল্পিত, অন্তত আমার পক্ষে। অবশ্য এই একই বইয়ের জন্যে ২০০২ সালে আমার কপালে জুটেছিল আনন্দ পুরস্কার। তবে সেটা হাজার হলেও একটা প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার, যদিও তার অর্থমূল্য খুব কুলীন – পাঁচ লাখ টাকা! কিন্তু সাহিত্য অকাদেমি সম্মান ভারতবর্ষের সবচেয়ে দুর্লভ অর্জন – কেননা এই রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দেওয়া হতো ২৪টি ভাষায় লেখা সে-বছরের সেরা বইটির জন্য। (এখন দেওয়া হয় ২৮টি ভাষার সাহিত্যকে।) তার মানে ভারতের নানা ভাষা নানা পরিধানের বৈচিত্র্যময় দেশে ২৪ জন প্রাপক প্রতি বছর এই সর্বভারতীয় সম্মান অর্জন করেন। প্রসঙ্গত জানানো উচিত যে, ২০০৪ সাল ছিল সাহিত্য অকাদেমি সম্মান অনুষ্ঠানের  সুবর্ণজয়ন্তী। ১৯৫৪ সালে এই খেতাবদানের সূচনা ঘটে। প্রথমবারের প্রাপক ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ, সেটি ছিল তাঁর মরণোত্তর পুরস্কার।
যাই হোক, জেনে ভালো লাগছিল যে সর্বভারতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মানের শিরোপা জুটল কিনা এই অধমের কপালে! তখনো জানি না যে পঞ্চাশ বছরে বেশিরভাগ প্রাপক ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক আর গল্পকাররা। গদ্য প্রবন্ধ লিখে এ-সম্মান পেয়েছেন আমার আগে মাত্র পাঁচজন। আর কীসব সেই বাঘা বাঘা লেখক – শশীভূষণ দাশগুপ্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, অশোক মিত্র, শঙ্করীপ্রসাদ বসুর মতো আমার অনেক বয়সে বড় অগ্রজরা। তাঁদের মধ্যে শশীভূষণ বাবু তো আমার সাক্ষাৎ শিক্ষক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কি সৌভাগ্য, তাঁদের মতো মহারথীদের পাশে কিনা আমি? যাই হোক, তখনো কিন্তু জানি না যে ২০০৫ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে রাজধানী দিল্লিতে এই পুরস্কার আনতে গিয়ে পরিচয় হবে একজন অসাধারণ গুজরাটি শিল্পী তথা ভ্রামণিক অমৃতলাল বেগড়ের সঙ্গে। তাঁর গুজরাটি ভাষায় লেখা ভ্রমণকথা সৌন্দর্যানি নদী নর্মদা একই বছর সাহিত্য অকাদেমি সম্মান পেয়েছিল। সে তো আরো ২২ জন তাঁদের ভাষায় লিখে একই শিরোপা পেলেন কিন্তু ঘটনাচক্রে আলাপ হয়ে ঘনিষ্ঠতা ঘটে গেল বেগড়জির সঙ্গে। তিনি নিজে সস্ত্রীক এসে বাংলা ভাষায় কথা বলে আমাদের দুজনকে (সঙ্গে আমার স্ত্রীও ছিলেন) মুগ্ধ এবং অবাক করে দিলেন। কিন্তু সে-কথা পরে হবে।
আগের কথা হলো, দিল্লির সাহিত্য অকাদেমি কার্যালয় থেকে সচিবের পোশাকি চিঠি এলো। দিনক্ষণ জানা গেল। বিমানের টিকিটও এসে গেল দুজনের। পৌঁছে যেতে আমাদের রাখা হলো দিল্লির এক অভিজাত হোটেলে। ২৪ জন প্রাপকের ওই একই আস্তানা। পরদিনের প্রাতরাশে আড়চোখে তাঁদের অনেককে দেখে নিলাম কিন্তু কথা হলো না। তামিল তেলেগু মালয়ালম সিন্ধি ডোগরী উর্দু কাশ্মিরি মণিপুরি নেপালি কোনো ভাষাই তো বলতে পারি না। খানিকটা স্বচ্ছন্দ ইংরেজি ভাষায় আর কাজ চলার মতো হিন্দি জানি। নানা জাতি আর নানা ভাষার সংযোগ-সংকট যে এতো তীব্র আর বাস্তব তা মর্মে মালুম হলো। ভাষার বিচ্ছেদ বুঝি এতো প্রবল? জানতে পারিনি আগে।
অকাদেমি সম্মান অর্পণ করা হবে সন্ধেবেলা, তার আগে রিজার্ভ বাসে করে আমাদের অর্থাৎ প্রাপকদের ও তাঁর পরিজনদের নিয়ে যাওয়া হলো অকাদেমি প্রাঙ্গণের কাছে এক প্রশস্ত লনে। বুকে একটা বর্ণময় আর জাঁকালো ব্যাজ এঁটে দিলেন এক কর্মী, তাতে ইংরেজি হরফে আমার নাম এবং তার নিচে লেখা Bengali । ব্যস, এই বারে আমি বহুরকম নিমন্ত্রিত মানুষের জমায়েতে বিশিষ্ট ও বিশ্লিষ্ট হয়ে পড়লাম। বুঝতে হলো, আর আমি কোনো ব্যক্তি নই, সর্বভারতীয় পটে আমি এখন বাংলা ভাষা ও বাঙালির প্রতিনিধি। নিমন্ত্রিত সারাদেশের বহু বিশিষ্ট নাগরিক, রাজপুরুষ আর লেখক-লেখিকারা উদ্যানে ঘুরছেন এবং নানা স্টল থেকে বিনামূল্যে ইচ্ছেমতো খাদ্য তথা গরম-গরম ভোজ্য তুলে নিয়ে খাচ্ছেন। কেউ কেউ অপাঙ্গে আমার কাছে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ব্যাজটায় পড়ে নিচ্ছেন আমার নাম এবং করমর্দন করে হাসছেন, সৌজন্যবিনিময় করছেন। তবে সর্বদাই ইংরেজি ভাষায়ন।
এরপরে আর বিস্তৃত বর্ণনায় যাওয়ার দরকার নেই। শুধু সংক্ষেপে বলা দরকার যে, একটা প্রশস্ত দর্শকভরা প্রেক্ষাগৃহের বিশাল মঞ্চে আমরা ২৪ জন চেয়ারে বসলাম অর্ধবৃত্তের আকারে। প্রথম চেয়ারে বসলেন A-বর্ণমালা অনুযায়ী অসমের লেখক। হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, B-তে আমি দ্বিতীয় চেয়ারে, তৃতীয় চেয়ারে D-তে ডোগরি ভাষার লেখক, E-তে ইংরেজি ভাষার লেখক এই ক্রমানুসারে। একঝলক দেখে নিলাম সকলেই তাঁর নিজস্ব প্রাদেশিক পোশাক পরেছেন। ইংরেজি ভাষার লেখক উপমন্যু চ্যাটার্জি পরেছেন চোস্ত এক স্যুট-টাই। আমার পোশাক কোঁচা দেওয়া ধুতি আর সিল্কের পাঞ্জাবি। সচিব সৎ চিদানন্দন একে একে আমাদের ডেকে নিলেন, বসতে হলো সকলের সামনে মঞ্চ আলো করে। তিনি আমাদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিলেন। তারপরে অকাদেমির সহসভাপতি আমাদের বন্ধু সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পরিয়ে দিলেন একটি স্ন্দুর মালা, অবশেষে সভাপতি গোপীচাঁদ নারাং হাতে তুলে দিলেন অকাদেমি সম্মান অর্থাৎ একটি তাম্রফলকে খোদিত শিল্পধারা প্রতীক পুরস্কার এবং সঙ্গে চেক অর্থমূল্য। ক্রমানুসারে আমার ডাক পড়ল অসমের লেখকের পরেই। মনে হলো, ভাগ্যে আমার ভাষার আদ্যাক্ষর ‘B’ তাই দ্বিতীয় সুযোগটা পেলাম। একে একে একজনকে ডাকা, বসানো, মালা দেওয়া, পরিচয় প্রদান তারপরে সম্মান অর্পণ বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সবশেষে ডাক পড়ল বেচারা উর্দু লেখকের, কারণ তাঁর ভাষার আদ্যাক্ষর যে সাহেবি হরফে U – সেটা আবার ইংরেজি বর্ণমালার শেষ ধাপের অধিবাসী। আহা রে! পরদিন সকালে একটা ছোট হলে সীমায়িতসংখ্যক বিশিষ্ট আমন্ত্রিতদের সামনে পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে ২৪ জনকে তাঁদের নিজের লেখালেখি, সাহিত্যাদর্শ আর পুরস্কৃত বইটি সম্পর্কে বলতে বলা হলো ইংরেজিতে বা হিন্দিভাষায়। আমি ইংরেজিতেই বললাম এবং ওই অধিবেশনের সভাপতির চেয়ার থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ফুট কেটে শ্রোতাদের বললেন, ‘এই লেখক আমার বিশেষ বন্ধু। তাঁর আর একটি গুণপনা হলো গান গাইবার দক্ষতা। এখানে তার সুযোগ নেই।’
পরের দিন সন্ধে পেরিয়ে যাওয়ার পরে হোটেলে আমাদের কক্ষে কলিংবেল বেজে উঠতে দরজা খুলে দেখলাম খাড়া চেহারার উজ্জ্বলবর্ণ এক ভদ্রলোক সস্ত্রীক দাঁড়িয়ে আছেন। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল ইনি আমাদের সঙ্গে একই পঙ্ক্তিতে বসে গতকাল সন্ধেয় সাহিত্য অকাদেমি সম্মান পেয়েছিলেন আর আজ সকালে শুনেছি হিন্দিভাষায় তাঁর ভাষণ। ভদ্রলোকের পরনে শাদা খদ্দরের পাজামা ও শাদা কুর্তা – তাঁর স্ত্রীর পরনে পাড়অলা শাদা শাড়ি। দুজনেরই পেটা চেহারা। ভদ্রলোক আমার সাদর আহ্বানে ঘরে ঢুকে যুক্ত করে প্রণামের ভঙ্গি করে নতমস্তকে সপ্রতিভভাবে বললেন, ‘নমস্কার। আমার নাম অমৃতলাল বেগড় আর ইনি আমার ধর্মপতœী কান্তা। আপনারা বাঙালি জেনে পরিচয় করতে এলাম। আমার মুখে বাংলা ভাষা শুনে খুব আশ্চর্য লাগলো তো? আসলে আমি শান্তিনিকেতনের কলাভবনে চিত্রশিক্ষা করেছি। আচার্য নন্দলাল বসু আমার গুরু। তাঁর কাছ থেকে শিখেছি কেমন করে প্রকৃতিকে দেখতে হয়, জানতে হয় সাধারণ গরিব খেটে খাওয়া মানুষদের জীবনধারা। তাঁর আদর্শটি আমার শিল্পশিক্ষা আর ছবি আঁকা’, বলে আমাকে উপহার দিলেন তাঁর আঁকা একসেট পিকচার পোস্টকার্ড – বর্ণরঙিন দক্ষ হাতের কাজ।
আমার চেয়ে বয়সে বড় এই নির্মেদ ঋজু কাঠামোর মানুষটি কয়েক বছর ধরে ভেঙে ভেঙে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত সময়কালে নর্মদা নদীর তীর ধরে দুই হাজার ৩১২ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে পরিক্রমা করে যে-অভিজ্ঞতাঋদ্ধ বইটি লেখেন তার জন্যেই পেলেন সাহিত্য অকাদেমি সম্মান। তাঁর বিনয়নম্র আচরণ আর নম্র ভাষা থেকে বোঝা যাচ্ছিল না যে কতখানি আত্মশক্তি আর চারিত্র্য বল থাকলে তবে এতখানি কষ্টসাধ্য দুর্গম পথে পাড়ি দেওয়া যায়। পথ বলা উচিত হবে না নর্মদা কূলের তটভূমিকে। তার পথে পথে পাথর ছড়ানো আর অনবরত জঙ্গল, ঝরনা, অগণিত বিচিত্র অতিথিপরায়ণ মানুষ, অতিদরিদ্র নারী, লুটেরা, মন্দির ও কীর্তনীয়াদের দল, পরিক্রমাকারী প্রচুর সাধু-সন্ত আর দুঃসাহসী পথিক, সাপ ও ভয়ঙ্কর মৌমাছি – সব কিছুকেই পার হয়ে এসেছেন এই মানুষটি শুধু             অন্তর্গত ভক্তি আর প্রত্যয়ের জোরে। এঁকে গেছেন স্কেচের পরে স্কেচ। অন্তরে প্রোজ্জ্বল রেখেছেন নর্মদার রূপবিভঙ্গ আর বারে বারে প্রণত হয়েছেন তাঁর পায়ে। মধ্য প্রদেশের অমরকণ্টক থেকে যাত্রা শুরু করে শেষতক পৌঁছেছেন গুজরাটের ভারুতে এসে। পথে পার হয়ে এসেছেন সুদীর্ঘ বিস্তৃত বিন্ধ্য আর সাতপুরা পর্বতমালার পাদদেশ। তবু ভরিল না চিত্ত। দুঃখ করে বললেন, ‘নর্মদা পরিক্রমার দুটো প্রধান শর্ত হলো হাঁটতে হবে নগ্ন পদে এবং বাঁচতে হবে ভিক্ষা করে। দুটোই আমার অনায়ত্ত রয়ে গেল।’ আরেকটা শর্তও তিনি পালন করতে পারেননি – এই নদী-পরিক্রমার নির্দেশিত সময়কাল হলো একটানা তিন বছর তিন মাস ও তেরো দিন। তিনি ঘুরেছেন বারে বারে, একেক অংশ ধরে, জীবিকা-জীবন সামলে অনর্গল পরিব্রাজনে সন্নিহিত জনজীবনকে দেখে ও তার ছবি এঁকে। আমি চমকিত বিস্ময়ে অমৃতলাল আর কান্তাকে দেখি। মনে হয়, সাহিত্য অকাদেমি সম্মানের চেয়ে অনেক বড় পুরস্কার পেয়ে গেছি।
কিন্তু এ-লেখার উদ্দেশ্য অমৃতলালকে জানা বা জানানো নয়, বরং তাঁর চোখ দিয়ে নর্মদাকে জানা। সাধারণ পর্যটক বা ধর্মার্থীরা নর্মদা পরিক্রমার ক্লেশকর অভিজ্ঞতা থেকে পেতে চান কোনো ঐহিক বা পারমার্থিক তৃপ্তি ও হৃদয়ের শান্তি। কিন্তু অমৃতলাল দেখেন নর্মদার কত বিচিত্র গতি আর তরঙ্গসৌন্দর্য, শোনেন তার কলস্বর, গভীর নির্জন শান্ত রাতে দেখেন নর্মদার অতল জলে চাঁদের সাঁতার, কানে ভেসে আসে দূরাগত দেহাতি গানের সুর, সঙ্গ পান প্রকৃতির কোলে জায়মান মনুষ্যজীবনের আতিথ্য প্রবণতায়, স্পর্শ নেন তাদের শ্রমকিণাঙ্কিত জীবনের স্বেদগন্ধে। শতচ্ছিন্ন বস্ত্রাবৃত নারীর লজ্জা তাঁর হাতের তুলি কাঁপিয়ে দেয় – চাক্ষুষ দেখতে পান ভারতীয় জীবনের অন্যতর এক মুখমায়া, যারা চিরবঞ্চিত কিন্তু অভিযোগহীন, শীতার্ত রাত্রের করুণ হিম যারা সহ্য করে দাঁতে দাঁত চেপে। যারা সাপের সঙ্গে করে গুহাহিত সহবাস কিন্তু তাদের আঘাত করে না। সৌন্দর্যানি নদী নর্মদা বইটি আমি অমৃতলালের মাতৃভাষায় পড়তে পারিনি সেই ভাষা জানি না বলে। আমার এই নিয়ে মোট তিনবার পড়া হলো ইংরেজি অনুবাদে Narmada : River of Beauty| অনুবাদিকার নাম মারিয়েত্তা মাদ্রেল। ১৯৮২ সালে তিনি ইংল্যান্ড ত্যাগ করে চলে আসেন প্রথমে তিব্বতের লাসায় তারপরে চিনের হংকংয়ে, ইংরিজি পড়াতে। তারপরে চলে আসেন ভারতে। থাকেন টানা বারো বছর এবং নিজের নাম নেন ‘মীরা’। নর্মদা পরিক্রমার পথে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় ও আলাপ হয় অমৃতলাল বেগড়ের, যার পরিণতি এই অনুবাদগ্রন্থ। এখন মারিয়েত্তা ফিরে গেছেন ইংল্যান্ডে।
অমৃতলালের বই নিয়ে কথা বলার আগে কতকগুলো জরুরি তথ্য জেনে নিলে ভালো হয়। যেমন জানা যায়, ভারতবর্ষে যতগুলো বহুদূরগামী নদী আছে তার মধ্যে আদি নাম গঙ্গার। নর্মদার স্থান পঞ্চম। কিন্তু গঙ্গার মতো নর্মদাও সকলের কাছে পবিত্র বলে শুদ্ধেয় এবং নর্মদাøান এক মহাপুণ্যকর্ম। ‘নর্মদা’ কথার মানে হলো, যে আনন্দ দিতে পারে। নর্মদার জল সবচেয়ে পরিশুদ্ধ এবং এ-নদীর পুণ্যসলিলে অবগাহন ও জলপান নদীসংলগ্ন জনপদ জীবনের সম্বল। নর্মদা নদীকে নিয়ে যেসব লোককথা বা লোকবিশ্বাস গড়ে উঠেছে তাতে বলা হয়েছে, নর্মদা অবিবাহিতা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে কুমারী নর্মদা গঙ্গার চেয়ে পবিত্র। এসব তথ্য সাজালে বোঝা সহজ হয় যে, কেন বহুকাল ধরে নর্মদার বীরভূমি ধরে কঠিন শ্রমে পায়ে হেঁটে তবু কত পদাতিক ব্রজন করতে উৎসুক।
তবে অমৃতলাল মূলত শিল্পী বলে তাঁর বইজুড়ে নর্মদার এমনসব মুখশ্রী ধরা পড়েছে যাতে তাঁর শিল্পীমনের দৃষ্টিকোণ থেকে রূপময় নদীর ভেতর থেকে যেন জেগে উঠেছে এক জীবন্ত সত্তা, যা চিরপ্রবাহী বলে অম্লান। প্রতিদিন ভোরে তাঁর দিন শুরু হতো নর্মদা মাকে প্রণাম করে। কেবল একদিন, ৩রা নভেম্বর, তিনি নর্মদাকে প্রণাম করার আগে প্রণাম জানালেন শিল্পগুরু নন্দলাল বসুকে, তাঁর জন্মদিনের স্মরণে। মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন নন্দলালের কাছে তিনি শুধু শিল্পকলার দীক্ষা নেননি। শিখেছেন নিসর্গ সৌন্দর্যকে ভালোবাসতে। তাঁর কাছে শিক্ষিত না হলে এই পরিক্রমায় তিনি ব্রতী হতেন না। কাজেই আজ আগে গুরু-প্রণাম, পরে নর্মদা।
সৌন্দর্যানি নদী নর্মদা বইটি পড়তে পড়তে যত এগোনো যাবে ততোই বোঝা যাবে দ্রষ্টা পরিব্রাজকের সঙ্গে নর্মদা হাত ধরে আছে এক শিল্পীমন, যে ওই তরঙ্গ-উত্তাল তীব্রবেগে ধাবমান নদীর অন্তরের কথা পড়তে পারে আর অবলোকন করে নদীপারের বসত বানানো সেই সব মানুষজনের জীবনধারা, যা নদীধারার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা, যাদের কথা বা অস্তিত্ব বড় একটা ফুটে ওঠেনি সাহিত্যকারদের লেখনীতে। কী করে ফুটে উঠবে? এমন আরণ্য পার্বতী জীবন তো কল্পনা থেকে লেখা যায় না, অভিজ্ঞতা একে জারিত করে প্রকাশ ঘটায়। যেমন অমৃতলালের মতো গহন দ্রষ্টার ভাবনায় ও মননে এসেছে।
এখানে একটা কথা বিবেচনা করতে হবে। স্ত্রী-পুত্রসহ পরিবারভুক্ত একজন সামাজিক মানুষ সংসারধর্ম করছেন, আপন গরজে চিত্রচর্চা করছেন, স্থাপন করেছেন এক শিল্পবিদ্যালয়, যার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে থেকে গড়ে তুলছেন জীবনমনস্ক ছাত্রদের – তিনিই নিয়ম করে মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ছেন নর্মদার  অন্তর-সন্ধানে, নিজের সত্তাকে প্রসারিত করছেন, জীবনকে দেখতে পাচ্ছেন প্রকৃতির রুদ্রমধুর পটে এবং সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন একটি-দুটি ছাত্রকে, ভ্রমণব্যয় নির্বাহের জন্য হাত পেতে চেয়ে নিচ্ছেন অনুকম্পায়ী পতœীর গহনা – এমন সংযোগ বড় একটা দেখা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা, এতোসব সংযোগের ক্ষেত্রফল অমৃতলাল প্রকাশ করে গেছেন দুটি পথে – লিখনী আর চিত্রকলায়। নর্মদাজীবনকে পুরোপুরি বুঝতে হলে তাঁর আঁকা ছবিগুলাকেও মিলিয়ে দেখা দরকার।              সেইসঙ্গে মগ্ন পাঠক পেতে পারেন লেখকের প্রজ্ঞাবহুল দৃষ্টিকোণের নানা ঝলক।
যেমন এক জায়গায় তিনি জানাচ্ছেন, শুকনো নদীখাতের দিকে গভীরভাবে দেখে বোঝা যায়, তীব্র স্রোতা নদী কেমন করে মাটি আর পাথরকে কেটে কত অপরূপভাবে রূপময় করে তুলেছে। পাশাপাশি তাঁর ভাষ্য হলো, আকাশে তারামণ্ডলীর দীপ্তি আর সৌন্দর্য ফুটে ওঠে যখন আকাশে চাঁদ থাকে না এবং গাছের অঙ্গসংস্থান স্পষ্ট হয় গাছ যে-সময়ে পাতা ঝরিয়ে নগ্ন হয়। এ হলো শূন্যতার মধ্যে সুন্দরকে নবরূপে পাওয়া। তারপরে বুঝতে পারি আমরা যে, এই তন্নিষ্ঠ নদীসাধক জলদাস, নর্মদার মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন দেবতাকে এবং সেই জন্যই পরিক্রমার প্রতিটি প্রত্যুষে তিনি উচ্চারণ করে চলেছেন : ‘ত্বদীয় পাদ পঞ্চসম নমামি দেবী নর্মদে’। লক্ষণীয় এই তথ্য যে, একেকবারে দুতিন মাসের নদী পরিক্রমার জীবনে তিনি কোনোভাবেই খবরের কাগজ পড়ার চেষ্টা করেননি। এ-ব্যাপারে তাঁর মন্তব্য হলো, যদি আমরা সন-তারিখ আর নামগুলো মনে না রাখি তবে দশ বছরের পুরনো সংবাদপত্র পড়ে মনে হবে যেন আজকের সদ্য প্রকাশিত কাগজ – কেননা – অত্যাচার, ডাকাতি, অপহরণ, হত্যা, ধর্ষণ আর ক্ষমতালিপ্সার বৃত্তান্তে ভরা থাকে খবরের কাগজ!
বইয়ের ইতস্তত ছড়িয়ে আছে লেখকের অনুভবজাত সদ্ক্তিসমুচ্চয়। যেমন এক জায়গায় বলছেন : ‘মৎস্যজীবী জেলেরাই হল সব নদীর প্রথম সন্তান।’ অভিজ্ঞতা যে কত বিচিত্র দিকদর্শী হয় তা বলতে গিয়ে জানাচ্ছেন, যাত্রাপথে রান্না করবার জন্যে পড়ে থাকা কাঠকুটো জড়ো করে জ্বালানির কাজ চলে যেত আমাদের। একবার খুঁজতে খুঁজতে নদীর পাড়ে পেয়ে যেতাম কিছু চ্যালা কাঠ। রান্নাবান্না খাওয়া-দাওয়ার পরে জানা গেল, একদল শববাহক ওখানে শবদেহ দাহ করে বাড়তি কাঠগুলো ফেলে গেছে। আহা, অজ্ঞানতা কত বড় আশীর্বাদ! তাঁর মনে হলো।
আরেক অভিজ্ঞতা হলো তাঁর শূলপানঝারিতে গিয়ে। সেখানে গাঁওবুড়োর বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া সেরে বসে আছেন প্রাঙ্গণে। হঠাৎ চোখে পড়ল ছায়াঘন গাছের তলায় খাটিয়া পেতে শুয়ে আছে এক নারী। নবাগতদের পদশব্দ পেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে তাকালেন চকিত চাহনি মেলে। কালো মেয়ের সেই আয়ত গভীর চোখ দেখে তাঁর মনে পড়ে গেল সেই কবেকার শান্তিনিকেতনে শোনা গান :
কৃষ্ণ কলি আমি তারেই বলি,
কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ!
অমৃতলাল সবিস্ময়ে ভাবলেন, এই গান তো কতবার শান্তিনিকেতনে শুনেছি কিন্তু কেমন করে জানব যে সেই কালো মেয়েকে খুঁজে পাব শূলপানঝারিতে? সঙ্গে সঙ্গে করে নিলেন তার কটা স্কেচ।
ভ্রমণকথার আসল অর্থ হলো, কষ্ট আর অন্তর্বেদনার সাক্ষী থাকা। অমৃতলাল নর্মদা তীরের জনপদজীবনে গরিব দেহাতি মানুষের মধ্যে জীবনের বিষামৃত মেশা অভিজ্ঞতার কথা চমৎকার করে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেমন গুজরাটের এক গ্রামে উঁচু পাহাড়ি পথে চোখে পড়ল ছোট ছোট মন্দিরে রয়েছে পাথরের শিবলিঙ্গ আর তার পাশে ফণা তোলা তামায় গড়া একটা করে সাপ। নিচে নেমে এসে পুরোহিতকে জিগ্যেস করলেন, ‘এখানে কি খুব সাপ আছে? আসে মাঝে মাঝে।’ ‘হ্যাঁ, অনেকবার দেখেছি, গাছেও থাকে। তবে কাউকে কামড়ায় না।’ ‘ভয় লাগে না?’ ‘হ্যাঁ, অস্বস্তি হয়, তবে তাদের না ঘাঁটালে কামড়াবে কেন? একবার কী হলো জানেন? সে বছর খুব শীতকালে রাতে দিব্যি ঘুমোচ্ছি। হঠাৎ ছাদ থেকে একটা সাপ ঝপ করে আমার বিছানায় পড়ল। আসলে বেশ গরম একটা সুন্দর বিছানা পেয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল।’
– তারপর কী হলো?
– ব্যাপারটা দেখে খুব ঘাবড়ে গেলাম কিন্তু ঘুমিয়েও পড়লাম। ভোরে উঠে দেখি আমার গভীর রাতের অতিথি আপন মনেই চলে গেছে।’
গুজরাটের কবীরবাদে গিয়ে একটা বাড়িতে দুপুরের খাওয়া খেতেই হলো গৃহকর্তার অনুনয়ে। খাওয়া-দাওয়ার পরে অঙ্গনে বসে নানা কথার পিঠে এলো সাপের প্রসঙ্গ। কর্তা বললেন, ‘একবার যখন আমি বেশ ছোট আমাকে সাপে কাটল। সঙ্গে সঙ্গে আমার গা থেকে পূতপবিত্র পৈতেটা খুলে নিয়ে দংশনক্ষতের ওপর দিকে শক্ত করে বাঁধন দিলাম। তারপর ক্ষতের মুখটা কেটে রক্ত বার করে দিলে আমার মা ভয় পেয়ে পাড়ার বৈদ্যকে ডাকল। তিনি বললেন, ‘আগে পৈতেটা খোলো, তারপরে দেখাব আমার ভেলকি।’ আমি বললাম, ‘আমি মরে যাব, তবু পৈতে খুলব না।’ কে একজন ভিড়ের মধ্যে থেকে বলল, ‘ওকে বেশ অনেকটা টাটকা ঘি খেতে দাও, তাহলেই বিষ বেরিয়ে যাবে।’
‘তাই হলো। বাড়ির তৈরি এক লিটার আন্দাজ ঘি আমাকে খাওয়ানো হলো। আমার খুব ঘুম পেয়ে গেল। সকলেই বারণ করল কিন্তু আমি দিব্যি ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোরে ঘুম থেকে উঠে মনে হলো খাসা লাগছে। মাকে বললাম, ‘আহা, রোজই যদি আমাকে সাপে কামড়াত, কী যে ভালো হতো। তাহলে দৈনিক এক লিটার ঘি তো পেটে পড়ত।’
অমৃতলাল স্বাভাবিক নাগরিক জীবনে বসবাস করে কেতাদুরস্ত সভ্য যাপনে কতটা আর জীবন সত্য খুঁজে পেয়েছেন? যাত্রাপথের উপলবন্ধুর পথের দেবতা তাঁকে অনেক গভীরে পাঠ দিয়ে দিয়েছেন। নদীর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর হঠাৎ মনে হলো : জল থেকেই সব নদীই যেন চিরভ্রামণিক। গহন জঙ্গলে দিশাহারা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখতে পান পায়ে চলার পথ। ডায়েরিতে লিখেন : ‘মানুষের পায়ে পায়ে চলার দাগ ধরে গড়ে-ওঠা পথ যেন লোকসংগীতের মতো। তার মতোই এ-পথের দ্রষ্টার নাম জানা যায় না এবং এ-পথ কোনো একজনের চেষ্টায় বানানো নয় – এতে মিশে আছে বহু মানুষের পদাবলি।’
পথে হাঁটার দর্শন তাঁকে ধর্মের নানা কথা শেখায়। একেবারে মরা গরিব কুটিরবাসী তাঁকে নিজের ঘরে শুতে দিয়ে নিজে দাওয়ায় শুয়ে থাকে, নিজে না খেয়ে অতিথিকে খেতে বলে, এমন তো নাগরিক জীবনে তিনি দেখেননি। পর্বতঘেরা দুর্গম পথে পাহাড়ি মানুষের অবিচল বাঁচার সংগ্রাম দেখে তাঁর মনে হলো, ধর্ম মানুষের সমাজকে উন্নত করে। একদিন দেখতে পেলেন এক গহিন জঙ্গলে পাতার কুটিরে বসবাস করা বৃদ্ধ দম্পতিকে। অমৃতলাল আর তাঁর তিন সঙ্গীর প্রচণ্ড তেষ্টা পেয়েছিল গরমে আর রোদে হাঁটার দারুণ পথশ্রমে। দুদণ্ড ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কুটিরবাসী বৃদ্ধ এগিয়ে এলে তাঁরা বললেন, ‘এখানে খাবার জল কোথায় আছে?’ ‘এখানে কোথাও কোনো জলের চিহ্ন নেই – না আছে কুয়ো না আছে একটা ঝর্ণা।’ ‘তাহলে, আপনারা জল খান কীভাবে? কোথা থেকে এলো?’ ‘কেন নর্মদা আছে তো’। ‘সে তো অনেক দূরে’। ‘হ্যাঁ, এক কিলোমিটার পথ, তাও পাথুরে আর জঙ্গলে।’ আমরা বুড়োবুড়ি কষ্ট করে ওখানে গিয়ে øান করে এক এক দু’বালতি জল বয়ে আনতাম, তা-ই থেকে সব কাজ হতো, সেই জলই খেতাম’। ‘খেতাম আনতাম এভাবে বলছেন কেন?’ ‘বলছি এইজন্যে যে আমার গিন্নি গত মাসে পথে পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছে, তাই সে আর যেতে পারে না, আমি একাই কষ্ট করে জল আনি। আপনাদের খুব তেষ্টা পেয়েছে দেখছি – দাঁড়ান ঘর থেকে জল এনে দিই।’ ‘না না, আমাদের চারজন যদি জল খাই তবে আপনারা খাবেন কী?’ ‘তবু, অতিথি দেবতা। তাঁদের তেষ্টার জলটুকু দেব না।’
এমন আশ্চর্য ধর্মশক্তি দেখে অমৃতলালের মনে পড়ল এক সাধুর বলা অপরূপ অভিজ্ঞতার কথা। নর্মদার পথে পথে যেতে এমন একটা জায়গা আসে যা গভীর জঙ্গলে আচ্ছন্ন, প্রায় ১০ কিলোমিটারব্যাপী সেই বনানীর মধ্যে থাকে খাদ্যবস্ত্রহীন ভীলেরা। পথে কাউকে পেলেই তারা তাদের সর্বস্ব লুট করে নেয়, শেষ পর্যন্ত শুধু লেংটিপরে তাদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া যায়। সেই রকম একজন হৃতসর্বস্ব সাধু বলেছিলেন, ‘ভীলরা যখন আমার সব কিছু কেড়ে নিল, এমন কি পোশাক আর খাদ্য পর্যন্ত তখন হাঁটতে হাঁটতে সন্ধেবেলা পৌঁছলাম আরেক গ্রামে একটা কুঁড়েঘরের সামনে। খিদের চোটে তখন আমার দুচোখ অন্ধকার। তাই দেখে চালাঘর থেকে একজন অর্ধোলঙ্গ গরিব মানুষ এসে বলল, ‘আহা, ভীলরা তোমার সব কিছু কেড়ে নিয়েছে? কী করবে ওরা, ওদের যে কিছুই নেই!’ আমি বললাম, ‘আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে, সকাল থেকে সন্ধে কিছুই খাইনি, কিছু খেতে দিতে পারো?’ লোকটি চালাঘরে ঢুকে তখুনি বেরিয়ে এসে আমার হাতে দিলো একটা মাত্র বাজরার চাপাটি। স্রেফ চাপাটি, তাতে নুন নেই, মশলা নেই। সেটাই হাউমাউ করে খেয়ে তার দিকে কাতরভাবে তাকিয়ে থেকে ভাবলাম যদি আরেকটা দেয়, খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে যে! সেটা বুঝতে পেরে লোকটা বলল, ‘আমাদের ঘরে মাত্র চারটে চাপাটি ছিল। তার একটা খেয়েছি আমি, একটা দিয়েছি বউকে, আর একটা দুভাগ করে দিয়েছি আমাদের বাচ্চা দুটোকে, বাকি একটা তোমাকে দিলাম। আর তো নেই। ঘরে বাজরা বা আটাও নেই এক ফোঁটা। তাই তুমিও যেমন খিদেয় মরে যাচ্ছ আমরাও তাই।’
এমন একটা আশ্চর্য অভিজ্ঞতার কথা বলে সেই সাধু অমৃতলালকে বললেন, ‘একেই বলে ধর্ম, বুঝলেন?’
বইয়ের মধ্যে সঞ্চারিত প্রসারিত মানুষ ও প্রকৃতির সোঙকলমী অবস্থান বারে বারে আমাদের শিক্ষিত করে। নর্মদার ধারাস্রোতে øাত মানুষের সমাজ যেন অন্য গ্রহের মানুষ করে তৈরি করে। দান করে তাদের চলৎধর্ম আর উদ্বৃত্ত জীবনরস। লেখক ও চিত্রকর দেখে অবাক হলো যে, সারাদিন যারা স্রেফ বেঁচে থাকার জন্যে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটে, চড়াই পাহাড়ি পথে দলবদ্ধ হয়ে মাথায় কলসির ওপর কলসি চাপিয়ে ফিরে আসে পানীয় জল নিয়ে, তারাই রাতে দলবেঁধে উদ্দাম গরবা নাচ ঘিরে মেতে ওঠে বাড়তি আবেগে। অক্লান্ত তারা। সেই জনসংহতির নারী-পুরুষরা অমৃতলালের কাছে কিছু শুনতে চাইলে তিনি বললেন, সহজবোধ্য গুজরাটি ভাষায় :
‘আজকে তোমাদের দেখলাম সবাই কী আনন্দে গান গাইছ – তোমরা কেউই শুধু শ্রোতা নও, সকলেই গাইছ নাচছ – সেটাই প্রকৃত আনন্দ। অন্যদের নাচতে গাইতে দেখা হলো নকল আনন্দ। আমাদের দর্শক বা শ্রোতা হলে চলবে না, হতে হবে সক্রিয় শিল্পী, সেটাই হলো সৃষ্টির আনন্দ। এখানে সেটা দেখে আমার খুব ভালো লাগল।
‘আসলে আনন্দ ছড়ানো আছে বাইরে – নদী, পাহাড়, বনজঙ্গল, পুণ্য তীর্থস্থান, ফোটা ফুল আর উড়ন্ত পাখিদের মধ্যে। কিন্তু এখন আনন্দ ঢুকে গেছে ভেতরের দিকে – টেলিভিশনে। ওই যন্ত্রটি আমাদের করে তোলে অসামাজিক আর নিষ্ক্রিয় অথচ এই টেলিভিশন থেকে কেউ প্রত্যক্ষ আনন্দ পাচ্ছি না, পাচ্ছি আনন্দের প্রতিচ্ছবি। আমাদের প্রবাদে বলে : ‘আমাদের চোখ তৃষিত হয়ে আছে দেবতাকে দেখবে বলে’ কিন্তু আমাদের সব সময়ে মনে হচ্ছে, আহা, কখন টেলিভিশন খুলে বসব। তোমরা বেঁচে গেছ যে এখানে বিদ্যুৎ নেই তাই টেলিভিশনের উৎপাত পৌঁছয়নি। তোমরা যেন অনাহত প্রকৃতির প্রকৃত সন্তান। এতো আনন্দ আর ফুর্তি করবার শক্তি আর প্রাণবন্ততা দেখে মনে হচ্ছে, তোমাদের অন্তরের গভীরে রয়েছে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস আর মানবতার অপরাজেয় চেতনা। নর্মদা তোমাদের মধ্যে এই শক্তি সাহস আর প্রেরণা দান করে চলেছে। যুগে যুগে।’
আগে বলেছি, সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারের চেয়ে অনেক বড় প্রাপ্তি হলো আমার অমৃতলাল বেগড় নামের চমকপ্রদ মানুষটির সঙ্গে আলাপ হয়ে, তাঁর পর্যটনের ক্লেশবহুল তবু আনন্দ উৎসারিত দিনগুলোর কথা জেনে। তখনো তাঁর লেখা বইটি আমার পড়া হয়নি। কিন্তু মনে হলো, তাঁর মধ্যে আছে এক প্রজ্ঞাবান পরিণত মানুষ, যিনি সেই ২০০৫ সালে সাতাত্তর বছর বয়সে পৌঁছেছেন, থাকেন জব্বলপুরে। বয়স তাঁর দেহ ও মননে থাবা বসাতে পারেনি। অকাদেমি সম্মানপ্রাপ্তির পরদিন সকালে তাঁর ভাষণে বললেন, ‘আমার জীবনটা হলো গরিবের ভাঙা কুঁড়েঘরের মতো। বৃষ্টি হলো, থেমে গেল, কিন্তু ভাঙা কুঁড়ের চাল থেকে টুপটুপ করে জল পড়েই চলে – আমি তেমনই একটুখানি দেখি কিন্তু তার রেশ থেকেই যায়।’
এখন যখন এতদিন পরে, তাঁর লেখা বইটি খুঁটিয়ে পড়ছি আর টের পাচ্ছি পদে পদে এক মেধাবী ও সংবেদনশীল ভাবুকের ভাবপরিক্রমার নব নব কেন্দ্রে পৌঁছনোর বৃত্তান্ত, তখন মনে হচ্ছে, ইনি শুধু সৌন্দর্যদ্রষ্টা নন, মননের মধু এঁকে শিখিয়েছেন নিসর্গের রূপময়তার অন্তরালে ঢাকা নিগূঢ় সত্যের মুখচ্ছদ দেখার কুশলতা। তার একটা নমুনা দেখাব।
শূলপাণেশ্বরে পৌঁছে অমৃতলাল পূর্ণিমার আগের দুটি রাত থেকে চন্দ্রকলার দিকে লক্ষ রাখছিলেন। অন্ধকারস্তব্ধ চরাচরে নির্জন রাতের কল্লোলিনী নর্মদার ওপরে ফুটে-ওঠা চাঁদ ধীরে ধীরে তার ষোলকলা পূর্ণ করে যখন প্রসারিত আলোকচ্ছটায় চারদিকে উদ্ভাসিত হলো তখন তার দ্রষ্টা মানুষটি ভাবছেন, কী আশ্চর্য যে এতো সমুদ্ভাসিত এই যে চরাচরব্যাপী আলো তা কিন্তু চাঁদের নিজের নয়। মনে হলো, চাঁদ ঠিক লেখক নয়, যেন অনুবাদক। আর কি স্বর্গীয় অনুবাদক! যে নাকি খর রৌদ্রকিরণকে অনুবাদ করে ফেলেছে øিগ্ধ জ্যোৎøায়। রোদের চেয়ে চাঁদনীর ঝলক তো অনেক মনোরম। তবে কি চাঁদকে অনুবাদক বলব, না রূপান্তর করার কর্মী বলব?
পরে তাঁর মনে হলো যেন বিশ্লেষণটা ঠিক হলো না, এ যেন অর্ধসত্যের মতো। ভেবে দেখলে বোঝা যাবে এই তত্ত্ব যে সূর্যচ্ছটাকে অনুবাদ করে রম্য চন্দ্রালোকে পরিণত করা যায় কিন্তু চন্দ্রকিরণকে তো অনুবাদ করা যায় না। ঠিক যেমন দুধকে পরিণত করা যায় দইতে, কিন্তু তার উলটোটা হওয়ার জো নেই। তাহলে নতুন তত্ত্ব এই জানা গেল যে, দুধ থেকে দই করতে গেলে লাগে সাঁজা বা এক রসায়নক্রিয়া, তেমনই চাঁদের কাছে আছে এক অলৌকিক রসায়নের গূঢ় কারুকৌশল। হায়, অত বড় মহাশক্তিমান যে সূর্য তার কিন্তু সেই ক্ষমতা নেই!
আলোর অনুষঙ্গে মনে পড়ে তাঁর আরেক অভিজ্ঞতার কথা। হোসাঙ্গাবাদে পৌঁছে অমৃতলালের পরিচয় হলো এক গ্রামবৃদ্ধের সঙ্গে। সবাই তাঁকে দাদু বলে ডাকে। সেদিন ছিল দেওয়ালি উৎসব। চারদিকের ছড়ানো গ্রাম থেকে শত শত লোক, নারীপুরুষ, পায়ে হেঁটে বা গরুর গাড়ি চেপে এসে হাজির হয়েছে নর্মদায় প্রদীপ ভাসাতে। দাদু নিজেও এনেছেন দুটি প্রজ্বলিত দিয়া। তার একটা নিজে ভাসিয়ে অন্যটা দিলেন অমৃতলালকে। কিন্তু তাঁর মধ্যে একটা গড়িমসি ভাব দেখে দাদু বললেন, ‘কী হলো?’ অমৃতলালের মধ্যে একটা গোঁয়ার্তুমি জেগেছিল। তাই বললেন দাদুকে যে, ‘এমনি এক দেওয়ালি তো অমরকণ্টকে দিয়া ভাসিয়েছিলাম নর্মদায়। তাঁকে বলেছিলাম, ‘মা নর্মদা, আমার অন্তরপ্রদীপটা জ্বালিয়ে দাও।’ তারপর তো পাঁচ পাঁচটা বছর কেটে গেল। কই মা তো আমার মিনতি শোনেননি? আমার মনের আঁধার কই মা নর্মদা তো ঘোচালেন না? না, আমি আর দিয়া ভাসাব না আজ। আমার অভিমান হয়েছে।’
দাদু বললেন, ‘তুমি তো আচ্ছা পাগল। মনের ভেতরে আলো জ্বালানো কি অতই সোজা? পাঁচ বছর তো কিছুই নয়, এক জন্ম এমনকি বহু জন্মেই হয়তো অন্তর্দীপ জ্বালানো যায় না।’ খানিক পরে দাদু আবার বললেন, ‘বাইরের আলো সহজেই জ্বালানো যায়, রাখা যায় সাজিয়ে কিন্তু অন্তরের ভেতর আলোকিত করা খুব কঠিন সেটা। ধৈর্য ধরো, মা নর্মদার ওপর স্থির বিশ্বাস রাখো। ভালো কাজের পুরস্কার আছেই।’
ঘুরতে ঘুরতে বিমলেশ্বরে পৌঁছে অমৃতলাল ছবি আঁকার স্কেচবইয়ের বদলে খুলে বসেন কবিতার খাতা। মাঝে মাঝে কবিতা এসেছে তাঁর পরিক্রমার সঙ্গী হয়ে। তিনি লেখেন :
পৃথিবীর তিনভাগ জল আর এক ভাগ স্থল।
মানবদেহের তিনভাগ জল আর এক ভাগ হাড়গোড় –
দুটোর একেবারে সমান অনুপাত।
তেমনই হৃদয় স্পন্দিত হয়, সাগর তরঙ্গিত হয়
সেই তরঙ্গ স্পন্দনই কি পৃথিবীর হৃৎস্পন্দন নয়?
সাগরের মধ্যে আছে আমাদের আদি নিবাস –
মানব শরীরের ভেতরে আমরা বয়ে চলেছি সাগরকল্লোল।
এ-লেখার প্রান্তে এসে মনে পড়ল মাণ্ডলা বলে একটা জায়গায় এসে অমৃতলাল আর তাঁর ভ্রমণসঙ্গীরা খুব ভোরে হাঁটতে শুরু করে একটু বেলায় দেখা পেলেন এক সাধুর। তিনি সমগ্র নর্মদা পরিক্রমা সাঙ্গ করে শান্তচিত্তে আশ্রয় নিয়েছেন এক ভজন কুটিরে। তাঁকে প্রশ্ন করা হলো : ‘সমগ্র নর্মদা পায়ে হেঁটে পরিক্রমা করতে আপনার কত দিন লেগেছে?’
তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘এই মহাতীর্থযাত্রার যে সময় নির্দিষ্ট করা আছে। অর্থাৎ টানা তিন বছর তিন মাস আর তেরো দিন।’
– খাওয়া দাওয়া কী করতেন?
– আমি কোনো দানাশস্য খেতাম না, মানে, ধান চাল গম বাজরা বকাই কিংবা ভুট্টা। খেতাম শুধু শিকড়জাত সবজি আর ফল, দুধ ও দই।
– কোথায় পেতেন?
– না, পয়সা দিয়ে কোনোদিন এসব কিনিনি, চাইনি কারোর কাছে ভিক্ষাও। কেউ নিজের থেকে হাতে করে দিলে নিতাম।
– কিন্তু তাও যদি না জুটত? তখন কী খেতেন?
সাধু বললেন, ‘তখন খেতাম মায়ের টাটকা দুধ – মানে নর্মদা মায়ের জলধারা। নির্মল ও পবিত্র।’