স্বতন্ত্র সত্তার অন্বেষণ 

লোকশিল্প একটি দেশের বা অঞ্চলের স্বাতন্ত্রিক পরিচয় বহন করে। হতে পারে তা লোকসংগীত, লোককথা, লোকছড়া, লোকনৃত্য কিংবা লোকচিত্র। লোকশিল্পের অন্য শাখাগুলো যেভাবে সমাদৃত ও গবেষকদের আনুকূল্য লাভ করেছে লোকচিত্রের বেলায় তা অনেকটাই ম্রিয়মাণ। অথচ লোকচিত্রের উজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে বাংলাদেশে, যা একান্তই আমাদের, যেখানে রয়েছে নিজস্বতার স্পষ্ট ছাপ এবং জিআই পণ্য হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার মতো বৈশিষ্ট্য। এ-বিষয়টিকে পাঠকের সামনে প্রকাশ করার কষ্টসাধ্য কাজটি সম্পন্ন করেছেন গবেষক মামুন অর রশীদ তাঁর বাংলাদেশের ঐতিহ্যিক ও লোকচিত্র গ্রন্থে। এ-গ্রন্থে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাপ্ত লোকচিত্রের পরিচয় তুলে ধরেছেন। অসাধারণ বর্ণনা, বিরল চিত্রের সমাবেশ, অসংখ্য তথ্য সংযোজন এবং তুলনামূলক আলোচনা গ্রন্থটিকে অসাধারণ সাহিত্যমূল্য দান করেছে।

বাংলাদেশের ঐতিহ্যিক ও লোকচিত্র গ্রন্থটিতে বাংলাদেশে প্রাপ্ত ছয় ধরনের অসাধারণ লোকচিত্রের পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা রয়েছে যা নওগাঁ, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সিলেট, মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, নড়াইল কুমিলস্না ইত্যাদি স্থানে চর্চা করা হতো এবং এখনো কিছু কিছু অঞ্চলে চর্চিত। এখানে আলোচিত হয়েছে গাজীর পটের চিত্র, জড়ানো পটের চিত্র, পুঁথি চিত্র, পাটা চিত্র, কাঠের প্রচ্ছদ চিত্র, সরা চিত্র এবং মনসার মেড়চিত্র। এই চিত্রগুলোর রয়েছে নিজস্ব রূপ, ভিন্ন ভিন্ন ধারা ও পরিবেশনরীতি। রাজস্থানি চিত্রকলা কিংবা মহীশূর চিত্রকলায় যে-সৌন্দর্য আমরা অন্বেষণ করি, বাংলাদেশের ঐতিহ্যিক লোকচিত্রকলা তার থেকে কোনো অংশে ন্যূন নয়। এ-গ্রন্থে কেবল ঐতিহ্যিক চিত্রকলার নতুন একটি রূপই পাঠকের সামনে উপস্থাপিত হয়নি, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এসব চিত্রের সামাজিক মূল্যমানও।

গবেষক সমগ্র গ্রন্থটিকে মোট বারোটি অধ্যায়ে বিভক্ত করে আলোচনা করেছেন। প্রথম অধ্যায়টিতে ‘বাংলাদেশের লোক-ঐতিহ্যিক চিত্র’ নামে তুলে ধরা হয়েছে লোকচিত্রের গুরুত্ব ও সাধারণ চিত্রকলা থেকে লোকচিত্রকলার পার্থক্যবিষয়ক আলোচনা। গবেষকের মতে, সাধারণ শৌখিন চিত্রকলার সঙ্গে লোকচিত্রকলার অনেক গভীর পার্থক্য বিদ্যমান। সাধারণ চিত্রকলার প্রকাশ ঘটে নান্দনিকতা বোধকে লালন করার জন্য অথবা নিছক আনন্দ লাভের উপায় হিসেবে; কিন্তু লোকচিত্রের ক্ষেত্রে তা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সাধারণ মানুষের জীবনাচার। গবেষকের মতে, ‘লোকচিত্রকলা একটি লোকালয়ের সংহত মানসকে প্রকাশ করে; তার সঙ্গে বিশ্বাস ও ক্রিয়ার প্রত্যক্ষ সংযোগ থাকে।’ এ-সংযোগের কারণেই লোকচিত্রকলা সাধারণ মানুষের মধ্যে স্থান করে নিতে পারে। এ-গ্রন্থে গবেষক ভারতবর্ষীয় চিত্রকলা থেকে বাংলাদেশের লোকচিত্রকলা কীভাবে স্বতন্ত্র ধারায় চিহ্নিত হতে পারে তা উলেস্নখ করেছেন। এক্ষেত্রে গবেষক বাংলাদেশে প্রাপ্ত বা অঙ্কিত চিত্রকলা, যা দেশভাগের পর বিলুপ্ত হয়ে স্থানীয় বস্তুগত ঐতিহ্যের অংশে পরিণত হয়েছে এবং যা এদেশের লোকজীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেসব চিত্রকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এখানে তিনি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশেস্নষণের মাধ্যমে কীভাবে লোকচিত্রগুলো বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত হলো সে-বিষয়েও আলোকপাত করেন। এই অধ্যায়ের তৃতীয় খ– গবেষক লোকচিত্রকলার বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা করেন। বাংলাদেশের লোকচিত্রে আলপনা, দেওয়ালচিত্র, নৌকা সাজানোর চিত্র, পুঁথি চিত্র, পট চিত্র, সরা চিত্র ইত্যাদিতে লোকোমটিফ পাওয়া যায়। এসব চিত্রের বিষয় হিসেবে সাধারণত ব্যবহার করা হয় ফুল, উদ্ভিদ, লতা-পাতা, প্রাণী, বাদ্যযন্ত্র, নর-নারী, পারিবারিক বিবাদ, অভাব, প্রতারণা, মৃতদেহ সৎকার ইত্যাদি অনুষঙ্গ। আবার ঐতিহ্যিক চিত্রকলায় প্রাধান্য পায় রাজপরিবেশ, হুঁকাপানরত অভিজাত পুরুষ, শাসনকর্তা, হাতি, ঘোড়া, অন্দরমহল ইত্যাদি বিষয়। ধর্মকেন্দ্রিক চিত্রকলায় দেব-দেবীর মূর্তি, রাধা-কৃষ্ণ, মথুরা, বৃন্দাবন প্রভৃতি বিষয়ের সংযোজন দেখা যায়। এই গ্রন্থে গবেষক চিত্রধারা, এর উপলক্ষ, বিষয়-বিবরণ, চিত্রের উপাদান একটি ছকের মাধ্যমে সাজিয়ে বিষয়টিকে স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। যেমন – চিত্রধারা : চৌকো পটচিত্র; উপলক্ষ্য : জীবিকা; বিষয়-বিবরণ : পির মাহাত্ম্য, হাস্যরস; চিত্রের উপাদান : মকর, বাঘ, গাজী পির, হুঁকা, হরিণ, রাক্ষস, চাঁদ সদাগর, নৌকা। গবেষকের মতে, লোকচিত্রের বিষয়গত বৈচিত্র্য সম্পর্কে গবেষণার পাশাপাশি এর শৈলীও অধ্যয়ন করা সম্ভব। কারণ বাংলাদেশের লোকচিত্রগুলোর অসাধারণ শৈলী দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা চিত্র ফুটিয়ে তুলতে ব্যবহার করে প্রাকৃতিক রং, যা স্থানীয় অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হয়। চিত্রগুলো আঁকা হয় চট, গামছা, মার্কিন কাপড়, তালপাতা ও তুলট কাগজে। আবার পোড়ামাটির ফলকের ওপরেও অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয় চিত্র। এসব চিত্রের শৈলীগত বৈচিত্র্য আলোচনা করতে গিয়ে গবেষক দেখেন, এসব চিত্রে ‘চিত্রানুপাত বা পারসপেক্টিভ গুণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে রক্ষা করা হয়নি। দূরের বা কাছের বস্তুর পার্থক্য বোঝাতে অঙ্কিত উপাদানে যে তারতম্য থাকতে হবে, সে-জ্ঞান এই শৈলীতে অনুপস্থিত।’ তবে এসব চিত্রের আকর্ষণীয় দিক হলো, কালো রঙের আউটলাইনের ব্যবহার এবং দ্বিমাত্রিক জ্ঞান। প্রায় সবক্ষেত্রেই এসব চিত্রে শুধু একপাশের একটি চোখ দেখা যায়। গবেষক মনে করেন, এই সামঞ্জস্য চিত্রগুলোকে এক সূত্রে বাঁধতে সাহায্য করে।

দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে শুরু হয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব লোকচিত্র-পরিচিতি। প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে চমৎকারসব লোকচিত্রের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা, বিষয়-পরিচিতি, চিত্রকরের পরিচয়, সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা, চিত্র নির্মাণে ব্যবহৃত সামগ্রীর পরিচয়, সংযুক্ত গান, পরিবেশনরীতি, প্রাপ্তিস্থান এবং বর্তমানে সেই লোকচিত্রের অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা। বাংলাদেশের চিত্রকলার উৎসসন্ধানী চিত্রকলাগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো গাজীর পটের চিত্র, যা বাংলাদেশের স্থানীয় ও দুর্লভ লোকচিত্রের নিদর্শন। গাজীর পটের বিস্তার ঘটে মুসলমান আগমনের পরিপ্রেক্ষেতে পির-শক্তির প্রতি মানুষের বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে। এই গাজীর পট পরিবেশিত হতো ‘পট-গায়ক’ বা ‘পট-নাচুনি’র মাধ্যমে। তারা বছরের বিশেষ সময়ে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে হাটবাজারে বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল বা সামান্য টাকার বিনিময়ে এই পটচিত্রের সঙ্গে গান পরিবেশন করত। গাজীর পটের সঙ্গে লোকবিশ্বাস ও লোকচিকিৎসার যোগ থাকায় এটি একই সঙ্গে আদৃত ছিল বিনোদন ও বিপদভঞ্জনের উপায় হিসেবে। এই পটচিত্রের বিষয় হলো, গাজী পির ও তাঁর মাহাত্ম্য প্রচার। হিন্দু দেব-দেবীর বিপরীতে মুসলমানদের মহৎ শক্তির প্রতিরূপ সৃষ্টির তাগিদ থেকেই গাজীর পটের উদ্ভব বলে গবেষকদের ধারণা। সাধারণত এটি গঠনের দিক থেকে চৌকো পট। প্রতিটি পট অনেকগুলো প্যানেলে বিভক্ত। এই অধ্যায়ে বর্ণিত রয়েছে গাজী কালু ও চম্পাবতীর গল্প, যা গাজীর পটের মূল উপজীব্য এবং পটচিত্রের প্রধান বিষয়। এই পটের পরিবেশনরীতি বেশ সরল। দ– ঝোলানো পটে ছোট লাঠি দিয়ে টোকা মেরে মেরে গান পরিবেশন করা হয়। দর্শক থাকেন অর্ধগোলাকারে সজ্জিত। তবে চৌকো পটের বদলে জড়ানো পট হলে এর পরিবেশনরীতিও বদলে যায়। গাজীর পটে চিত্রের মাধ্যমে যে-গান পরিবেশিত হয় তা এ-চিত্রগুলোকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে। গানের প্রথম অংশে থাকে অলৌকিক ক্ষমতা প্রকাশের মাধ্যমে গাজীর মাহাত্ম্য বর্ণনা। দ্বিতীয় অংশে থাকে লোকরঞ্জন ও বিনোদনের জন্য প্রস্তুতকৃত গ্রাম্য হাস্যরস মিশ্রিত কাহিনি, যা সামাজিক সত্যের পরিচয় বহন করে। পূর্বরূপের গাজীর পট এখন সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত। তবে বাংলাদেশের নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, কুমিলস্না, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সওদাগরেরা এখনো কিছু কিছু ‘পট-নাচানো’ অব্যাহত রেখেছেন। এই পট পরিবেশনকে ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে তুলনীয় মনে করা এবং এর সামাজিক ও আর্থিক মূল্য না থাকায় পটুয়ারা এই পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, সেইসঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ লোকচিত্রের নিদর্শন।

এরপর গবেষক আলোচনায় রেখেছেন জড়ানো পটের চিত্র। এই লোকচিত্রের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে একই সঙ্গে চিত্র, গান ও নাচ পরিবেশিত হয়। বাংলাদেশে এই পট ব্যবহারের ইতিহাস শতবর্ষ-পুরনো। পট বা কাপড়ে ফুটিয়ে তোলা হয় কাহিনি। এই পটগানের ও চিত্রের নির্দিষ্ট কোনো ছক নেই। সমাজভেদে এই চিত্রের পার্থক্য হয়ে থাকে। এই গ্রন্থে ধামরাইয়ে প্রাপ্ত জড়ানো পটের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। চটের ওপরে শক্ত কাগজ আঠা দিয়ে লাগিয়ে এটি তৈরি হয়েছে। পট প্রস্তুত ও অংকনের কিছু রীতি রয়েছে। যেমন – পটের গানের জন্য পট তৈরি হতো কাপড়ের ওপর গোবর-মিশ্রিত মাটির প্রলেপ দিয়ে। তার ওপর তেঁতুলবিচির আঠা লাগিয়ে তৈরি হতো চিত্র আঁকার উপযুক্ত জমিন। পটের গান পরিবেশনের রীতিও ভিন্ন। এতে একসঙ্গে তিন থেকে পাঁচজন লোকের প্রয়োজন হয়। গবেষক এই অধ্যায়ে এর পরিবেশনরীতিকে আকর্ষণীয় করে বর্ণনা করেছেন। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে এই পটচিত্রের নবরূপ দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে এর বিষয় হিসেবে এসেছে সুন্দরবন, পরিবেশ, গণতন্ত্র, নির্বাচন, মানবাধিকার, শিশু-অধিকার, স্বাস্থ্য তথ্য, পলিথিন প্রতিরোধ ইত্যাদি। অন্যান্য লুপ্তপ্রায় লোকচিত্রগুলোর মধ্যে জড়ানো পটের চিত্র আজো টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত।

এরপর রয়েছে বাংলাদেশের অমূল্য পুঁথিচিত্রের বর্ণনা। এখানে গবেষক বিস্তারিত তুলে ধরেছেন অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতার চিত্র, পদ্মপুরাণ পুঁথিচিত্র, শাহানামা এবং ইস্কান্দারনামা পুঁথিচিত্র সম্পর্কে। আত্মিক শিক্ষাদানের অভিপ্রায়ে কথোপকথনের ভঙ্গিতে সৃষ্টি হয় প্রজ্ঞাপারমিতা পুঁথি। সাধন-পদ্ধতি সহজে অনুধাবনের জন্য এই পুঁথিতে সংযুক্ত হয়েছে অসাধারণ সব চিত্র। দেবীর চিত্রের পাশে রয়েছে বর্ণনা। প্রজ্ঞাপারমিতা পুঁথি রয়েছে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, ব্রিটিশ মিউজিয়াম, রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল, বরেন্দ্র জাদুঘর ইত্যাদি স্থানে। এসব পুঁথিতে ফোলিও ও চিত্রসংখ্যার পার্থক্য রয়েছে, তবে এতে পাল আমলের চিত্রকলার একটি সাধারণরীতি লক্ষণীয়। রঙের ব্যবহার ও অংকন-কৌশলেও রয়েছে সাদৃশ্য।

পুঁথির স্থায়িত্বের জন্য ব্যবহৃত কাঠের ফ্রেমে অঙ্কিত চিত্র পাটাচিত্র হিসেবে বা প্রচ্ছদচিত্র হিসেবে পরিচিত। অভিনব ভঙ্গিতে পাটা প্রস্তুত করে তাতে চিত্র ফুটিয়ে তোলার কৌশল প্রাচীন এবং বাংলা অঞ্চলে এটি স্বতন্ত্র স্থানের অধিকারী। গবেষকের মতে, বিষ্ণুপুর এই শিল্পের একটি কেন্দ্র। পাটাচিত্রের বিষয় সাধারণত লোকায়ত ধর্মবিশ্বাস থেকে সংগৃহীত। এখানে প্রাধান্য পায় বিষ্ণুর দশাবতার, রামচন্দ্র, কৃষ্ণলীলা, মহাভারত, চৈতন্যলীলা ইত্যাদি বিষয়। এই চিত্রের চর্চা পূর্ববঙ্গে হলেও বাংলাদেশেও পাটাচিত্র বিরল নয়; কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে তা লুপ্তপ্রায়।

এরপর রয়েছে সরাচিত্রের বর্ণনা। মাটির সরায় রঙের প্রলেপ দিয়ে তার ওপর শিল্পীরা আঁকেন চিত্র। দেব-দেবীর চিত্রই সরায় প্রাধান্য পায়। এতে ফুটিয়ে তোলা হয় পৌরাণিক ও আঞ্চলিক মাতৃকাদেবীর বৈশিষ্ট্যসংবলিত চিত্র, যা বাংলাদেশের অসাধারণ শিল্পচেতনাকে লালন করে। সরাচিত্রের মতো মনসার মেড়চিত্রেরও প্রাধান্য রয়েছে লোকচিত্রে। মনসামঙ্গলের কাহিনি এসব চিত্রের প্রধান বিষয়। চারকোনা আকৃতির শোলার তৈরি ছোট মন্দিরের গায়ে দেবীর চিত্র এঁকে কর– তৈরি করা হয়। মেড়চিত্রে মনসার সঙ্গে অন্য চরিত্রও পাওয়া যায়। এটি বাংলাদেশের একটি বিরল ‘ধর্মজ লোকশিল্প’ বলে গবেষক মনে করেন।

বাংলাদেশের লোকচিত্র আলোচনা শেষে গবেষক তুলে ধরেছেন লোকচিত্র চর্চার কালপুরুষদের পরিচয়। এখানে দীনেশচন্দ্র সেন, গুরুসদয় দত্ত এবং তোফায়েল আহমেদের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এরপর আলোচিত হয়েছে ভারতীয় চিত্রঘরানার বিভিন্ন দিক। এখানে গুলের চিত্রকলা, থানজাভুর চিত্ররীতি, মহীশূরের চিত্রকলা, রাজস্থানের চিত্রকলা, মধুবনি চিত্র, মুঘল চিত্রকলা, ওয়ারলি চিত্ররীতি ইত্যাদি স্থান পেয়েছে। পরিশেষে যুক্ত হয়েছে গাজীর পট ও জড়ানো পটের গান। গবেষকের পরিশ্রম ও অসাধারণ উপস্থাপন-কৌশল গ্রন্থটিকে অসাধারণ করে তুলেছে। বিরল চিত্রের সংগ্রহ, চমৎকার বর্ণনা, সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা, অন্য গবেষকদের উদ্ধৃতি  গ্রন্থটিকে সংহত রূপ দান করেছে। r