সবকিছু বড় বেশি আকস্মিক হয়ে গেল। কিংবা সেটাও ঠিক নয়। কারণ এরকমই তো হবার কথা ছিল মনে হয়। সেই কত বছর ধরে একটু একটু করে আশাভঙ্গ, বিশ্বাসভঙ্গ, কারণে-অকারণে চতুরতা, কথার প্যাঁচ, দুটো দেশের ভেতরে প্রায় দুহাজার মাইলের তফাৎ, তার ভেতরে ছয় দফা, তার ভেতরে গণজাগরণ, তার ভেতরে পাকিস্তান জুড়ে সাধারণ নির্বাচন, সবকিছু মিলিয়ে এরকম যে কিছু একটা হবে, সেটা ভাবা সংগত ছিল রশিদের।

আর বিগত কয়েক সপ্তাহজুড়ে যে মহাজাগরণ এবং সেইসঙ্গে মহাহানাহানি, সব মিলিয়ে কেন যে তার মন সচেতন হয়নি, এটা একটা ভাববার বিষয় বটে। অথবা সে সবই বুঝতে পেরেছিল, শুধু কর্তব্যকাজটি করে উঠতে তার মন চায়নি।

কিন্তু কেন যে মন চায়নি।

সে কি চোখে দেখেনি পহেলা মার্চ যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে, তখন কীভাবে বিক্ষুব্ধ জনতার ঢল নেমেছিল রাজপথে? ঢাকা মুহূর্তের ভেতরে পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে? সে কি কানে শোনেনি যে, বঙ্গবন্ধু ছাত্রনেতৃবৃন্দকে ডেকে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের নির্দেশ দেন? এবং ছাত্ররা তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই পরিষদ গঠন করে?

সে কি দেখেনি যে, দোসরা মার্চ বঙ্গবন্ধুর আহবানে সমস্ত দেশে, এমনকি দেশের আনাচে-কানাচে পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হয়? দোকানের ঝাঁপ হয়ে যায় বন্ধ, কারখানার চিমনিতে ধোঁয়া ওঠে না, স্তব্ধ হয়ে যায় যানবাহন এমনকি গরুর গাড়ির চাকা পর্যন্ত? আদালতের কাজ পর্যন্ত স্থগিত হয়ে যায়?

এবং সেইদিনই আকস্মিকভাবে স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার সন্ধ্যা সাতটা থেকে কারফিউ জারি করে। এবং বিক্ষুব্ধ জনতা সেই কারফিউকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আন্দোলন শুরু করে রাজপথে এবং বুলেটবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে রাজপথে?

এবং এই দোসরা মার্চেই প্রথম ছাত্রদের সভায় লাল সবুজ সোনালি রঙের স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা আকাশে ওড়ে?

সে কি দেখেনি, তেসরা মার্চ বঙ্গবন্ধু পল্টন ময়দানে এক বিরাট জনসভায় আবেগাপ্লুত হয়ে কি বলে ওঠেন না, ভাইসব, পল্টনে এই জনসভা আমার শেষ জনসভা হতে পারে? আমার মৃত্যুতে যদি বাঙালি মুক্ত জীবন পায় এবং দুবেলা পেট ভরে খেতে পায় তাহলেই আমি সুখী হবো?

সেদিন তো সে তার অফিসের কলিগদের চোখের আড়ালে সেই জনসভায় যোগ দিয়েছিল।

আর সেইদিনই তো স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠ করা হয়। ‘চুয়ান্ন হাজার পাঁচশত ছয় বর্গমাইল বিসত্মৃত ভৌগোলিক এলাকার সাত কোটি মানুষের জন্যে আবাসিক ভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ।’

রশিদ তো ছাত্রজীবনে পলিটিক্স করত, কতদিন ছাত্রমিছিলে স্লোগান দিয়ে বেড়িয়েছে, এখন সরকারি চাকরিতে ঢুকে সব ভুলে গেলে চলবে কেন?

ভয়, প্রচণ্ড একটা সন্দেহ এবং অনিশ্চয়তা এরকম ব্যবহারের পেছনে কাজ করেছিল কি?

বা ক্রমাগত গৃহী জীবন কি রশিদকে ঘরকুনো করে ফেলেছে?

রশিদ জানে না। তার অত ভাবার ক্ষমতা বর্তমানে নেই।

ঢাকার রক্তক্ষয়ী তাণ্ডব, জ্যান্ত মানুষকে চোখের সামনে চলন্ত বাস থেকে জোর করে নামিয়ে রাস্তার ঘাসের ওপরে চেপে ধরে রেখে জবাই করা, বোরকাপরিহিত মহিলাদের রিকশা থেকে জোর করে নামিয়ে গাড়ির মধ্যে তুলে ফেলা – এসব তো তার অফিস-ফেরতা নিজের চোখে দেখা।

বাড়ি ফিরে এসে সে আর সেদিন দেরি করেনি। ঝটিতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা ত্যাগ করার। তার স্ত্রী এখনো যুবতী। পঁচিশে মার্চের পর সে আর স্কুলে যায়নি। স্কুল বন্ধ। সবকিছু বন্ধ। নিতান্ত বাধ্য হয়ে ডাক্তার-নার্সরা কাজ করে যাচ্ছে হাসপাতালগুলোয়। কোনো কোনো ডাক্তারের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন রশিদের এক বন্ধু তার ডাক্তার শ্যালকের কোনো খোঁজ পাচ্ছে না। অথচ উনত্রিশে মার্চ সে হাসপাতালে গিয়েছিল অপারেশন করতে।

এখন এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহ।

যার জন্যে তাকে এখন এইভাবে রাতের অন্ধকারে অচেনা কোনো কাফেলার সঙ্গে মিলিত হতে হয়েছে।

আর কিছু না হোক তার স্ত্রী এবং ছেলেকে অন্তত দেশের ভেতরে অথবা সীমান্তের ওপারে রেখে আসতে পারে। তার ড্রাইভার লোকমানের বাড়ি সীমান্তের ধারে। তারই পীড়াপীড়িতে সে রাজি হয়েছে তার ওখানে যেতে। তারপর ঠিক করা যাবে, কীভাবে কী করা যায়।

এখন পথ চলতে গিয়ে মনে মনে নিজেকে একটা গর্দভ ছাড়া আর কিছু সে ভাবতে পারছে না। নিজেকে সে দায়িত্বশীল একজন স্বামী এবং পিতা হিসেবে আর ভাবতে পারছে না।

এখন সে হাঁটছে রাতের অন্ধকারে। পিঠে তার পাঁচ বছরের ঘুমন্ত ছেলে। পায়ে পায়ে চলতে এখন কষ্ট হচ্ছে তার। আগে-পিছে নীরব এক কাফেলা। তার জামার খুঁট ধরে হাঁটছে রাকিবা। ভয়ে তার গলা বসে গেছে। ইচ্ছা হলেও সে আর কথা বলতে পারছে না কদিন ধরে। সেই তার চোখের সামনে থেকে কলাবাগানের গলি দিয়ে যখন টেনেহিঁচড়ে জোয়ান মদ্দ ছেলেগুলোকে ট্রাকে তোলে, সেই দৃশ্য দেখার পর থেকে তার গলার স্বর বন্ধ। অথচ এই সময় গলার স্বরেরও যে কতখানি প্রয়োজন, সে-কথা রাকিবাকে কে বোঝাবে?

 

রশিদ চাকরিতে ঢোকার আগে ছাত্র ইউনিয়ন করত। সচেতন একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছিল। তারপর লেখাপড়া শেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানে এক বছর ট্রেনিং নিয়ে এসেছিল কারিগরিবিদ্যায়। ফিরে এসে ভালো চাকরি পেয়েছিল সরকারি একটা প্রতিষ্ঠানে। স্ত্রী রাকিবা একটা স্কুলের শিক্ষয়িত্রী। এর ভেতরেই দেশের ভেতরে ভাঙাগড়া চলতে লাগল। ছেষট্টিতে ছয় দফার রেশ ধরে পূর্ব পাকিস্তানে গণসচেতনতা বাড়তে লাগল।

এ এক আশ্চর্য সচেতনতা। এর মাত্র এক বছর আগেই যখন পাক-ভারত যুদ্ধ হয়, তখন পূর্ব পাকিস্তানিদের ভেতরে পাকিস্তানের জন্যে প্রেম উথলে উঠেছিল। সকলেই মনে মনে সে-যুদ্ধে শামিল হয়েছিল। ভারতের মুণ্ডুপাত করেছিল মনে মনে। আর ঠিক সেই যুদ্ধের পরপরই মানুষের ভেতরে এক প্রশ্ন জেগে উঠেছিল, পূর্ব পাকিস্তানের নিজস্ব নিরাপত্তা কই? পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ভারত তু করে ডাক দিলেই তো পূর্ব পাকিস্তান তার পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ত। পূর্ব পাকিস্তানের ডিফেন্স কই? তাদের যুদ্ধ করার অস্ত্রশস্ত্র কই, জাহাজ কই, টাকা কই, প্রশিক্ষণ কই, আরে?

সচেতনতা গড়ে উঠল। বাঙালির মনের ভেতরে প্রশ্নটা বেশ বড়সড় করে জাগ্রত হলো। আমার নিরাপত্তা কই? আমার ন্যায্য হিস্যা কই? পূর্ব পাকিস্তানি হিসেবে আমার ভবিষ্যৎ কী?

অবশ্য তারও আগে একবার, বরং বলা যায় প্রথমবার সকল বাঙালির মনে ভাষা নিয়ে একটা প্রশ্নের জন্ম হয়েছিল। নিজের মাতৃভাষাকে পাকিস্তানিদের উর্দুর কাছে নত হয়ে যাবার ভয়, যেখানে বাংলাভাষীরাই সংখ্যায় ছিল অধিক। সেটার যদিও কোনোরকমে একটা সুরাহা হয়েছিল, কিন্তু বাঙালির মনের ভেতরে সেই যে অন্তর্গত পরিবর্তন শুরু হয়েছিল, তা ক্রমাগতই যেন নীরবে অগ্রসর হতে লাগল।

 

তারপর তো ছয় দফার ভেতর দিয়ে বাঙালি ক্রমে জেগে উঠল। নিজের আত্মপরিচয় খুঁজে পেল। তখন আর পেছনে তাকানো নেই। তারপর তো ইলেকশন। সেই ইলেকশনে বঙ্গবন্ধুর দল পেল তিনশোর ভেতরে দুশো আটাশি আসন। কিন্তু ক্ষমতা পাবে কি পাবে না, তা নিয়ে দ্বন্দ্বে ভুগতে লাগল বাঙালি। সেই সময়, ছাত্রদের মুখে শোনা গেল সেই কালজয়ী স্লোগান, কৃষক শ্রমিক অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।

 

কিন্তু ব্যস, এখন সব প্রশ্নের সুরাহা হয়ে গেছে। এখন দেশবাসীর সামনে একটিই প্রশ্ন। তা হলো এই শত্রুকবলিত দেশটি স্বাধীন হতে কতদিন লাগবে? আর কীভাবেই-বা স্বাধীন হবে? ইতোমধ্যেই যেখানে বাঙালির জীবন ধূলিসাৎ এবং নারীর সম্মান ভূলুণ্ঠিত, সেখানে এই দেশ আদৌ স্বাধীন হবে কি না।

 

গভীর এই রাত। কালো মিশমিশে অন্ধকারে কেউ কারো মুখ দেখতে পারছে না। আর রাকিবার এভাবে তার জামা খামচে ধরে পথচলা। তাদের আগে-পিছে চেনা-অচেনা কাফেলা। তার ড্রাইভার লোকমান আলি বেশ তৎপরতার সঙ্গে তাদের গাইড করতে করতে চলেছে। মধ্য-পঁয়ত্রিশের এই যুবকটি একজন ড্রাইভার হলেও খুব মানবিক বলতে হবে। সে-ই পরামর্শ দিয়েছে, স্যার, আমাগের বাড়ি চলেন। খুব নির্জন এক গিরাম, স্যার। আর একটু দূরেই সীমান্ত দেখা যায়। বেশি অসুবিধে হলি সেখানে চলি যাওয়া যাবেনে।

ড্রাইভার লোকমানের কথায় তখন ততটা কান দেইনি। এখন চলতে চলতে মনে হচ্ছে, মন্দ কী। দেখাই যাক। জীবন কখন কীভাবে, সেটা তো এখনো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।  চলমান ছককাটা জীবন কীভাবে ওলট-পালট হয়ে যায়, পালট আর ওলট, সে তো তারা এখন চোখেই দেখতে পাচ্ছে।

 

এর আগে তারা অচেনা একটা নদী পার হয়েছে। গোটাতিনেক খাল পার হয়েছে। বড় বড় শস্য নিড়ানো মাঠ পার হয়েছে। কোনদিকে এখন গতি তারা জানে না। একজন শুধু আরেকজনের পিছে চলেছে। সকলের লক্ষ্য দক্ষিণ-পশ্চিম। কারণ এই কাফেলার দেশের বাড়ি সেইদিকে। মানুষ বিপদের সময় যে নিজের উৎসের দিকে ফিরে যেতে চায় এ-ও এক অভিজ্ঞতা রশিদের। কোনো কোনো কাফেলা গেছে পুবদিকে। লক্ষ্য আগরতলার কাছাকাছি যাওয়া। আর তারা দক্ষিণ-পশ্চিম। লোকমান বলেছে একবার তার দেশে পৌঁছতে পারলে আর চিন্তা নেই। সেখানে চারদিকে নদী। সামনেই ভারতের সীমান্ত। সেখানে অনেকে ইতোমধ্যে চলে গেছে। সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এখন এটা এপ্রিল মাস। মাঝামাঝি। ঢাকা আর নিরাপদ নয়। ঢাকার আশপাশ নিরাপদ নয়। এখন যেতে হবে দূরে। আরো দূরে।

লোকমান মাঝেমধ্যেই রাকিবার কাছে আসছে। তাকে সাহস দিতে। ভয় নেই বেগম সাহেবা। ভয় নেই। আর কিছুদূর গেলি পরেই আমাগের গ্রাম আসি যাবেনে।

আর কিছুদূর মানে মাঝখানে বিশাল পদ্মা নদী। সেটা যে কীভাবে পার হওয়া যাবে সে-কথা কেউ এখন ভাবতে পারছে না। তবে উপায় একটা হবেই। রাতের অন্ধকারে অনেকে পার হয়ে যাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র, এ-খবর তারা আগেই পেয়েছে।

রশিদের কাঁধে ঘুমন্ত ছেলে। তার ওপর রাকিবার এভাবে তার জামা আঁকড়ে ধরে রাখা। মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত লাগছে। মনে হচ্ছে রাকিবাকে ধমক দিয়ে বলে, জামা ছাড়ো। ভয় কি শুধু তোমার একার? এরা সকলে ভয় পাচ্ছে না?

কিন্তু এটাও মুখ ফুটে রশিদ বলতে পারছে না। কারণ সে জানে, রাকিবা কীভাবে এই কদিন বেঁচে আছে। স্ত্রীর প্রতি গভীর এক মমতা তার মনকে মাঝে মাঝে আলোড়িত করছে। কিন্তু সে কী করবে। কীই-বা করার ক্ষমতা আছে তার। শুধুমাত্র স্ত্রী এবং সন্তানকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া ছাড়া। অবশ্য তার বন্ধু আহসান তাকে এই মুহূর্তে ঢাকা ছাড়তে মানা করেছিল। বলেছিল, দোস্ত, এখন সবদিক বিবেচনা করলে ঢাকা নিরাপদ। কারণ পাকিস্তানি জান্তা এখন সর্বতোভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করবে যে, ঢাকা নিরাপদ একটি প্রাদেশিক রাজধানী।

কিন্তু রশিদ তার বন্ধুর কথা মানতে পারেনি। কারণ তার মনে হয়েছিল ঢাকার ঘরে ঘরে তল্লাশি চলবে। আর তাই যদি চলে তাহলে রশিদ বা রাকিবা কেউ নিরাপদে থাকবে না। রশিদ যে এককালে ছাত্র ইউনিয়ন করত তা তারা অচিরেই টের পেয়ে যাবে। তার বাড়িতে প্রচুর রাজনৈতিক বই আছে। সে সক্রিয়ভাবে এখন আর রাজনীতি না করলেও এ-ব্যাপারে তার যথেষ্ট উৎসাহ আছে।

তাই বন্ধুর পরামর্শে কিছু যৌক্তিকতা থাকলেও সে মানতে পারেনি।

তবে এ-কথা ঠিক, কয়েক সপ্তাহ ধরে ঢাকা শহরের মানুষ এক দোজখখানার ভেতরে দিবারাত্রি কাল ক্ষেপণ করছে। বাড়ির দরজার কড়া নেড়ে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে তরুণ তাজা সব ছেলেকে। তরুণী মেয়েদের জোর করে তুলে নিচ্ছে ত্রিপল-ঢাকা গাড়ির ছাউনির নিচে। রাকিবা কদিন আগে বলেছে, আমার কাছে এমন কিছু আছে, ওরা কিছুতেই আমাকে ধরতে পারবে না। আমাকে অপমান করতে পারবে না।

এটা তোমাকে আগেই বলে রাখছি।

কেন তুমি এ-কথা বলছ? রশিদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছে।

না, এমনি। কথা ঘুরিয়ে রাকিবা বলেছে।

তারপর তার শিক্ষয়িত্রীর সংস্কৃতমনকে উপেক্ষা করে রশিদের কানে কানে বলেছে, তুমি কি জানো, মেয়েদের জীবনের শুরু থেকেই একটা ভয় তাদের মনের অন্তরালে সর্বক্ষণ কাজ করে? আর সেটা হলো ধর্ষিত হবার ভয়?

তার কথা শুনে একটু বিস্মিত হয়ে রশিদ স্ত্রীর মুখের দিকে সেদিন তাকিয়েছিল।

আর রাকিবা বলেছিল, এ-ভয় তাদের মনের গভীরে সারাটা জীবন সুপ্ত অবস্থায় থাকে। বৈরী পরিবেশে এই ভয় বাইরে বেরিয়ে আসে। কি কুমারী কি বিবাহিত, এ-ভয় তাদের আজন্ম সহচর, খোকার বাবা।

এখন এভাবে পালিয়ে যাওয়ার ভেতরেও সেই একই ভয় যেন রাকিবার মনে কাজ করছে। কে বা কখন হঠাৎ করে কোথাও থেকে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, হল্ট। রোখ যাও।

বা হঠাৎ করে ব্রাশফায়ারের শব্দ।

এখন পর্যন্ত অবশ্য কিছু হয়নি। কাফেলার ভেতরে অনেক বুদ্ধিমান এবং বুঝদার মানুষ আছে, যারা লেখাপড়া বেশি না জানতে পারে, কিন্তু দিকনিশানার ব্যাপারে গভীর জ্ঞানের অধিকারী।

 

মাঝে মাঝে কেউ কেউ হঠাৎ করে ডুকরে উঠছে, যারা এখনো মা-বাবা বা ছেলে বা স্বামীর শোক সামলে উঠতে পারেনি। নিজের চোখের সামনে যারা নিজের সন্তানকে নিহত হতে দেখেছে। স্বামীকে জোর করে হানাদারের পিকআপ ভ্যানে তুলে ফেলতে দেখেছে, তারপর তার আর খোঁজ পায়নি। যারা মানুষের জীবন যে এরকম হতে পারে বা হয় কোনোদিন কল্পনাতেও আনতে পারেনি। ছাপোষা বাঙালির জীবনে এসব আবার কী? সেই ছেলেবেলায় মা-বাবার কাছে শুনেছিল রশিদ হিন্দু-মুসলমানের রায়টের কথা। হিন্দুস্থান-পাকিস্তান। কিন্তু সেসব তো অনেকদিন আগের। সেসব স্মৃতি তো ঝাপসা হয়ে গেছে। কিছু তো মনে পড়ে না। সব মা-বাবার কাছে শোনা। দেশভাগের রায়টের সময় রাকিবার মা-বাবা পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানের দিকে পা বাড়িয়েছিলেন। রশিদের জীবন-ইতিহাসও তাই। দেশভাগের সময় রশিদের বাবা পূর্ব পাকিস্তানে চাকরি করতেন। যদিও তার দেশ ছিল চব্বিশপরগনা। কিন্তু পাকিস্তান হবার পরে তিনি আর পশ্চিমবঙ্গে ফিরে যাননি। এরপরও পশ্চিমবঙ্গে তাদের প্রচুর আত্মীয়স্বজন চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। একবার কোনোরকমে সীমান্ত পার হতে পারলে অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকা যাবে। রাকিবা তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। বাপ মারা গেছে তার। মা আছেন। কিন্তু তিনি চট্টগ্রামে, তার ফুপাতো ভাইয়ের কাছে। আন্দরকিল্লার কাছে বাড়ি। তাদের কোনো খবর এখনো ঠিকমতো পায়নি রাকিবা। শুধু এটুকু জেনেছে যে, তারা নিরাপদে আছে। বিশেষ অসুবিধা হলে সীমান্ত পাড়ি দেবে।

এখন এ-মুহূর্তে পূর্বাপর অনেক কিছু ভাবছে সে। স্কুলের চাকরি ফেলে সে চলে এসেছে। রশিদ তার প্রতিষ্ঠানের একজন দায়িত্বপূর্ণ অফিসার; কিন্তু তাতে কী। এসব তো জানমাল নিরাপত্তার কোনো গ্যারান্টি দিতে পারছে না।

অন্ধকারে একবার হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল রাকিবা। মুখ দিয়ে চাপা একটা আর্তনাদ বেরোল। সঙ্গে সঙ্গে ভুঁইফোঁড়ের মতো বাঁশবাগানের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলো দুটো কালো ছায়া। কাফেলার চোখে-মুখে শঙ্কা ফুটে উঠল। কেউ কেউ দৌড় দেবার জন্যে প্রস্ত্ততি নিল।

দুটো ছায়ার একটা বলে উঠল, ভয় পাবেন না, আমরা বাঙালি। কোনো সাহায্য লাগবে?

কাফেলায় মধ্যবয়স্ক একজন মহিলা ছিল। সে বলে উঠল, বাবা, একটু পানি।

দাঁড়ান, পানি দিচ্ছি। বলে অন্ধকারে একজন নড়েচড়ে উঠল। তারপর পাতলা টিনের গেলাসে মহিলার হাতে দিলো এক গ্লাস পানি। মহিলা শব্দ করে ঢকঢক করে পানি পান শেষ করে আবার বিনীত স্বরে বলে উঠল, আরো এক গেলাস বাবা।

আরেকজন এবার বলল, আমরা কি রাতটা এখানে কাটাতে পারি?

কাফেলার মাথায় দাঁড়িয়ে যারা তদারকি করছিল, তাদেরই কেউ একজন বলে উঠল, এখানে না মা, সকাল হবার আগে আমাদের আরো কিছুদূর যেতে হবে। তারপর আমরা বিশ্রাম নিতে পারব। শুনেছি, ওদিকের গ্রামেও এখন জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়েছে। যদি ভাগ্য ভালো থাকে, তাহলে আমরা কাল বিকেলের ভেতরে ভারত সীমান্তে পৌঁছে যাব।

রাকিবা এই সময় রশিদের কাছে এসে বলল, আমার বুকের ভেতরে কেমন যেন করছে। আমি আর হাঁটতে পারছি নে।

তার কথা শুনে রশিদ একটু কাছ ঘেঁষে মিনতি করে বলল, তাই বললে কি হয়, সোনা? এখনো কিছু পথ বাকি আছে। পাক মিলিটারির কাছে এটুকু পথ কিছু নয়, তাছাড়া ওদের আছে দামি সব গাড়ি। দেশের যে-কোনো জায়গায় গাড়ি নিয়ে তারা হাজির হতে পারে।

রাকিবা হঠাৎ ছেলেমানুষের মতো গোঁ ধরে বলল, আমি আর যেতে চাই না, বাসায় ফিরে যেতে চাই!

তার কথা শুনে অবাক হয়ে গেল রশিদ। একটু যেন বিরক্ত হয়ে বলল, এখন ফিরে যাওয়াটা হবে ঝুঁকির, তুমি বুঝতে পারছ না, রাকি?

রাকিবা এবার রশিদের কাছ ঘেঁষে প্রায় তার বুকের ওপরে ঝুঁকে পড়ে বলল, দেখো, আমি যদি ধরা পড়ি, আর আমাকে যদি ওরা ধরে নিয়ে যায়, তাহলে আমি কিন্তু আত্মহত্যা করব। আমি একজন মা। আমি কিছুতেই ওদের আমার গায়ে হাত দিতে দেবো না।

রাকিবার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল রশিদ। এসব কী কথা! রাকিবার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল?

কিন্তু রাকিবারই-বা দোষ কী, সে কি এই কদিনে সবকিছু জেনে গেছে না? রোকেয়া হলের মেয়েদের কথা তার কানে গেছে না? রাকিবা কি ছেলেমানুষ?

রশিদ এবার তার মাথায় হাত দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ছিঃ রাকি। এসব কথা এখন বলতে হয় না। এখন যেভাবে হোক আমাদের এই মৃত্যুপুরী থেকে বেরোতে হবে। এই দেশ এখন মৃত্যুপুরী, রাকি। কথাটা বলে সে তার ঠোঁট রাকিবার গালে ছোঁয়াল।

অন্ধকারে কিছু দেখা গেল না।

তার কথা শুনে চুপ করে গেল রাকিবা। রশিদ এই সময় ছেলেকে এক কাঁধ থেকে আরেক কাঁধে নিয়ে বলল, কোনোরকমে লোকমানের বাড়িতে একবার পৌঁছতে পারলে আর চিন্তা নেই। তারপর সীমান্ত পার হয়ে গেলেই আর চিন্তা কী, ওখানে আমাদের আত্মীয়স্বজনেরা আছে, আমার ছোট চাচাই রয়েছেন বসিরহাটে তার ছেলেমেয়ে সব নিয়ে। দু-তিনজন ফুপুর একজন কলকাতায় আর দুজন বসিরহাটে।

না, একবার সীমান্ত পেরোতে পারলে আমাদের কোনো অসুবিধে হবে না।

কিন্তু ভারতে যাবার আগে কাফেলার সামনে এখন বিরাট নদী। পদ্মা। পার হতে গেলে সুযোগ বুঝে পার হতে হবে।

আজকের রাত এই গ্রামে কাটাতে হবে। কাল সকালে আমরা নদী পার হবো, যদি অবস্থা ভালো থাকে। কাফেলার সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটি এবার কথা বলে উঠল। এতক্ষণ সে শুধু অপরের কথা শুনছিল।

নদী? কে একজন বালক কাফেলার ভেতরে বলে উঠল, মা, নদী আমি পার হবো না, আমার ভয় করে।

তার মা শুনে বলল, পাগল, এখন জান বাঁচাতে হবে না? শয়তান পাকিস্তানি সৈন্যদের চেয়ে নদী, আমাদের এই পদ্মা, অনেক ভালো রে বাবা। দেখবি ঠিক আমরা নদী পার হয়ে মাগুরা চলে যাব।

একটু পরেই রাস্তায় আরেক গ্রুপ ভলানটিয়ার জুটে গেল। তারা কাছে এসে বেশ দৃঢ় স্বরে বলে উঠল, জয় স্বাধীন বাংলা। আমরা আপনাদের এই গ্রামে আজ রাত কাটাতে বলব। তারপর সকালে উঠে আপনারা যে-যার মতো চলে যাবেন।

তার প্রস্তাব মনঃপূত হলো সকলের। কারণ হাঁটার মতো মনোবল আর ছিল না।

 

কিছুক্ষণ হেঁটে তারা গ্রামের এক মোড়লের বিশাল ধানের গোলার সামনে এসে দাঁড়াল। তার গরুর গোয়াল বেশ কয়েকটা। কিছু মুনিশ উৎসাহী হয়ে গোয়াল থেকে গরু বের করে ঝাঁটপাট দিয়ে ভেতরে চাটাই আর খড় বিছিয়ে রাতের মতো শরীর এলানোর ব্যবস্থা করে দিলো।

রাকিবা নীরবে কাউকে কিছু না বলে সেই চাটাইয়ের ওপর হাঁটু জড়ো করে শরীর আঁচল দিয়ে ঢেকে শুয়ে পড়ল।

তার দেখাদেখি দলের অনেক মেয়েরা শুয়ে পড়ল। শুধু একজন কিশোরী, সে পা গুটিয়ে বসে থাকল তাদের মাঝখানে। পুরুষেরাও পরিশ্রান্ত। তারাও একে একে বসে বা শুয়ে পড়ল। তাদের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকল বোঁচকা-বুঁচকি, থালা-বাটি, হাঁড়ি-পাতিল, বদনা-বালতি। যার যা কিছু আছে বা হাতের কাছে পেয়েছে সব সাধ্যমতো তুলে নিয়ে যোগ দিয়েছে কাফেলায়। জীবন চলে যাবার আগ পর্যন্ত যেসব জিনিসের প্রয়োজন, মানুষ তাদের ত্যাগ করবে কী করে?

অন্ধকারে বা সামান্য আলোর কুপি দিয়ে ওই বিরাট এলাকা আলোকিত করার উপায় ছিল না। খড়ের কুণ্ড এখানে-ওখানে জ্বালানো যেত, কিন্তু সেটাতেও ছিল দূর থেকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ঝুঁকি। দূরে একটা কুয়ো ছিল। কিছু মানুষ সেই কুয়োর সামনে গিয়ে বালতি দিয়ে পানি তুলে হাত-মুখ ধুতে লাগল।

রশিদও খোকাকে নিয়ে একপাশে বসে পড়েছিল। তারপর চাটাইয়ের ওপর ঘুমন্ত খোকাকে শুইয়ে দিয়ে সে বসে থাকল তার মাথার কাছে। চুপ করে।

রাত প্রায় দুটোর সময় সকল মানুষকে ঘুম থেকে তুলে ডাল-ভাত খেতে দিলো সেই মোড়ল। তার চেহারা দেখা গেল না। কিন্তু সকলে বলতে লাগল এই মোড়ল সাহেব তার মুনিশদের দিয়ে খাবার তৈরি করেছে। তার ঘরের মেয়েরা পর্দানশিন। তারা বাইরের মানুষের সামনে আসে না। তাই মুনিশ বা কামলা দিয়ে এই ব্যবস্থা। রশিদ অবাক হয়ে ভাবল, দেশের এই সংকটে পর্দা করে লাভ কী। হানাদার সৈন্য থোড়াই পর্দানশিন মেয়েদের ধর্ষণ করতে বাকি রাখছে!

ভোররাতে আবার পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে গ্রামের নির্জন পথে যাত্রা শুরু হলো সকলের। মুরব্বি একজন চলতে চলতে হঠাৎ বলে উঠল, আমার য্যান কেমুন ঠেকতিছে। আমরা কি ঠিক পথে আছি। মোড়ল আমাগের ভুল পথ ধরি দিলো না তো?

কথা তার শেষ হতেও পারেনি, সকলে চোখ তুলে দেখে তারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনেই সেনাছাউনি। এই গহিন গ্রামে এইভাবে সেনাছাউনি যেন তারা কল্পনাও করতে পারেনি। চোখের নিমেষে একটা হুড়োহুড়ি বেধে গেল। রাকিবা চিৎকার করে উঠল। দলে আরো যুবতী মেয়ে ছিল। তরুণ সব ছেলেও। তারা অনেকটা গাইড হিসেবেই কাজ করছিল এই দুদিন। কিন্তু এখন যেন সবকিছু কেমন ঘোলাটে হয়ে উঠল। কাঁটাঝোপ, আগাছা, বৃক্ষ, গমের মাঠ, আখক্ষেত ডিঙিয়ে ছুটতে লাগল মানুষ। কান্নার রোল উঠল চতুর্দিকে। দৌড়তে গিয়ে চোখের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ল কেউ কেউ। খোকা তারস্বরে চিৎকার করে বলে উঠল, বাবা। ছেলেগুলো যে-যেখানে পারল ছুটতে লাগল।

 

পাকিস্তানি সেনাছাউনিতে তখন নাস্তার তোড়জোড় চলছিল, ভাজা মাংসের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। সেই মুহূর্তে তারাও যেন অবাক। কিন্তু তা মুহূর্ত মাত্র। পরপরই তৎপর হয়ে চালু করল ব্রাশফায়ার।  চারদিক যেন ধোঁয়ায়, কুয়াশায়, চিৎকারে, কান্নায়, রক্তের ফিনকি ধারায় প্লাবিত হয়ে গেল।

প্রথমেই গুলি খেয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল রাকিবা। একবার মাত্র চিৎকার দিয়েই রাকিবা স্তব্ধ হয়ে গেল। তার হাতের  ঝোলাব্যাগ ছিটকে পড়ল। ড্রাইভার লোকমান স্যার বলে চিৎকার করে উঠল। স্যার, পালান। স্যার চলে আসেন। বলে সে চিৎকার করতে লাগল। খোকা এবার মা, মা বলে চিৎকার করতে লাগল। কিন্তু তার চিৎকার মেশিনগানের শব্দে আর কানে শোনা গেল না।

রশিদ একবার রাকিবার দিকে ছুটে যাবার জন্যে ছেলেকে কোল থেকে নামাতে গেলে ড্রাইভার লোকমান ঝটিতে খোকাকে তার কাঁধে তুলে নিয়ে বলে উঠল, স্যার, পালান। ম্যাডাম আল্লার কাছে চলে গেছেন। তাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। স্যার, আপনি পালান।

কথা বলতে বলতে ড্রাইভার খোকাকে তুলে নিয়ে দৌড় দিলো।

হতভম্ব রশিদ একবার রাকিবা আরেকবার ধূম্রজালে অপস্রিয়মাণ ড্রাইভারের কাঁধে খোকা এই দুজনের দিকে তাকাতে তাকাতে কী করবে বুঝতে না পেরে চুপ করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল। তার মাথার ওপর দিয়ে গুলিবৃষ্টি হতে লাগল। জঙ্গলের পশুপাখির আর্তনাদ মানুষের আর্তনাদের কাছে ম্রিয়মাণ হয়ে গেল। জঙ্গলের গাছের মাথায় যেন ঝড় বয়ে যেতে লাগল। তার চারপাশে মানুষেরা খণ্ডিত বৃক্ষের মতো দড়াম দড়াম করে পড়ে যেতে লাগল। পৃথিবীতে যেন রোজকেয়ামত নেমে এসেছে, এমনি মনে হতে লাগল। কোথায় যেন জ্বলে উঠল আগুন। সেই আগুনে সবকিছু পুড়তে লাগল।

রশিদের মনে হলো, হায় রাকিকে সে কত কথা বলতে সময় পায়নি। কত প্রেমের কথা, অনুরাগের কথা, ভালোবাসার কথা। হায়, রাকি তাকে ছেড়ে কোথায় চলে গেল।

এমনকি পঁচিশে মার্চের পর তারা পরস্পরের কাছাকাছিও হয়নি। কাছাকাছি হতেও তাদের মনে কত অপরাধবোধ জেগেছিল। দেশ যেখানে বিপদগ্রস্ত, সেখানে ব্যক্তিগত সুখ অন্যায় এক অপরাধ। এই বোধ তাদের দুজনকে এতদিন পৃথক রেখেছিল।

রশিদ দাঁড়িয়ে থাকল। তাকে ধাক্কা মেরে কত লোক দৌড়ে চলে গেল। তাকে লাফ মেরে ডিঙিয়ে গেল কতজন। কত লোক চিৎকার করে বলল, দাঁড়ায়ে আছেন ক্যান, পালান, পালান। কিন্তু সে এখন স্থির। সে এখন ঊর্ধ্বমুখী। ঊর্ধ্বে সে কী দ্যাখে তা বোঝার ক্ষমতা হয়তো সেই মুহূর্তে কারো নেই। তবে তার মনে এক অদ্ভুত স্বস্তি, যাক, মারা যাবার আগে তার রাকিবা অন্তত ধর্ষিত হয়নি।