স্মরণে কাইয়ুম চৌধুরী

প্রণবরঞ্জন রায়

তাঁর পরিণত বার্ধক্যেই, কিন্তু আমাদের অনাকাঙ্ক্ষিত, তাঁর প্রয়াণের পর থেকে কাইয়ুম চৌধুরীর নামটি মনে পড়লেই মানসচোখে ভেসে ওঠে – এক শীতের ঈষদুষ্ণ রোদ ঝলমলে জগৎ। যা ছবিতে নির্মিত। আনন্দের আশা জাগানো সে-জগতে বাস যে সম্ভব নয় – তাও স্বতঃবোধ্য। কারণ, তা ছবিরই।

কাইয়ুম চৌধুরী নামটি উচ্চারিত হলেই মনে পড়ে এমন এক স্নিগ্ধ নির্মল ব্যক্তিত্বকে যাঁর সান্নিধ্য ছিল প্রীতিময়। আর সকলের কাছেই তা। জীবনের ক্লেদ, মালিন্য, বৈপরীত্য, হিংসা, দ্বেষ সম্বন্ধে তিনি যে অনবহিত ছিলেন তা নয়। কিন্তু জীবনের সে-দিক চিন্তা তাঁকে ক্লিষ্ট করত না। তিনি তাঁর ছবিতে এক সুন্দর সাযুজ্যময় ভুবনের স্বপ্নকে মূর্ত করে আনন্দ পেতেন। আর সহৃদয় দর্শককে সেই আনন্দ-উৎসবে আমন্ত্রণ জানাতেন। তাঁর ছবির জগৎ অভিজ্ঞতার জগতের কাছাকাছি পাশাপাশি থেকেও ছিল দূরের এক সজ্জিত-অলংকৃত কাঙ্ক্ষিত তদ্গত জগৎ। শিল্পীর একাকী বাসের বিকল্প মানস-জগৎ নয়। স্বপ্নদ্রষ্টা কাইয়ুম জগৎসংসার-উদাসীন ছিলেন না। শুধু, মলিন দ্বন্দ্বময় ভুবন থেকে উত্তরণের স্বপ্ন দেখতেন।

মানুষ কাইয়ুম চৌধুরী তাঁর সামাজিক দায়দায়িত্ব নিয়ে বোধ হয় সাধারণের চেয়ে অনেকটা বেশিই সক্রিয় ছিলেন। তাই, তাঁকে আমরা সেই ভাষা-আন্দোলনের সময় থেকে শুরু করে স্বাধীনতা যুদ্ধবিরোধীদের বিচার-দাবির পর্ব পর্যন্ত সব রকম সমাজ-রাষ্ট্রনৈতিক আন্দোলন আর সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, সুস্থ, গণতান্ত্রিক-উদ্দীপনা-সংশ্লিষ্ট সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সোৎসাহে যুক্ত দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম।

সেই অভ্যাসের বশে, এ-সব প্রয়াস-প্রচেষ্টায় কাইয়ুম-সাহেবের স্বতঃপ্রণোদিত ব্যক্তিগত অবদানকে সৃষ্টিশীলতার গৌরব দিতে ভুলতে বসেছি। বাংলার স্বারূপ্যচেতনায়-উদ্বুদ্ধ শিল্পীর কর্মকান্ডের সেই বিশিষ্ট দিকটির কথা, তার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে, বিশেষ করে বলা দরকার। আজকে শিল্পকলা জগতে ‘সাধারণ্যের কলা’ (পাবলিক আর্ট) হঠাৎ গুরুত্ব পাচ্ছে। সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই (বিংশ শতকের) ‘সাধারণ্যের শিল্প’ (তত্ত্বানুসারী নয়; আত্মিক উপলব্ধি-সম্ভুত) চর্চা করে গেছেন কাইয়ুমভাই।

পঞ্চাশের দশকের ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে, ষাটের দশকের স্বারূপ্য প্রকাশের কাল হয়ে, সত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের উত্তাল পর্ব পেরিয়ে, আশি-নববইয়ের দশকের গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়ে, একবিংশ শতকে স্বাধীনতা যুদ্ধবিরোধীদের বিচার-দাবির কাল পর্যন্ত আন্দোলনের, দাবি-দাওয়ার বাণীবহ বার্তা সাধারণ্যে পৌঁছে দেওয়ার, বিতরণ করার প্রয়োজন বারবার অনুভূত হয়েছে। একই ধরনের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদ-দিবস আর পহেলা বৈশাখের নববর্ষ উদযাপনের মতন বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক জাতীয় উৎসবানুষ্ঠান পালনের বার্তা সাধারণ্যে প্রচারের জন্য। জাতীয় প্রয়োজনেই, এক বার্তাসহ দৃষ্টিসুখকর নান্দনিক বাংলা-লিপি ও লিপিভিত্তিক নকশা নির্মাণ পদ্ধতির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। এই লিপির গঠন ও নকশা নির্মাণের ধাঁচটি, ছাপাই মাধ্যমে বিশেষ করে বিজ্ঞাপন ইত্যাদির জন্য ব্যবহৃত হলেও, তা উদ্ভবে এবং ব্যবহারে মূলত হাতে আঁকার। হরফের ছাঁদ – মোটা আর জ্যামিতিক। তাতে পরিচিত বাংলালিপির পেলবতা নেই। কিন্তু এই লিপির গড়নের সঙ্গ পূর্বীনাগরী থেকে বিবর্তিত আদি-বাঙ্গালা লিপির চেহারার একটা দূরগত সাদৃশ্য আছে। আর এ-ছাঁদের লিপির সমাহারে গঠিত শব্দ সাজিয়ে যে-ধরনের নকশা বোনা হয়, সে-সব নকশার গঠনের সঙ্গে বাংলার সনাতন নকশিকাঁথার আর আলপনার কিছু গঠনতান্ত্রিক সাদৃশ্য দেখা যায়। লিপি-অঙ্কনের ঋজু জ্যামিতিকতার সঙ্গে বিন্যাসের পেলবতা মিলে এ-সব বার্তাবহ নকশা, কোমলে-কঠিনে এক অনবদ্য দর্শনীয়তা পায়। আমার মতন পশ্চিমবঙ্গীয় চোখে এ-জাতীয় হরফসংবলিত নকশা একান্তভাবে বাংলাদেশীয়। আর তা বাংলাদেশীয় বাঙালির স্বাতন্ত্র্যভাবনারই ফসল।

বাংলা-বর্ণমালার এ-নকশি ব্যবহারের উদ্ভাবক কাইয়ুম চৌধুরী। যদিও এ-কথা অনস্বীকার্য যে, তার বিকাশ, বিস্তার ও সমৃদ্ধিতে আরো অনেক শিল্পীই সহায়তা দিয়েছেন। তবুও বার্তাবহ দৃষ্টিনন্দন নকশার এ-শিল্পীকে পথিকৃতের সম্মান দিতেই হয়।

প্রত্যেক জাতীর (জাত অর্থে জাতির সঙ্গে পার্থক্য টানতেই এ-বানান) ইতিহাসে এমন এক-একটা সন্ধিক্ষণ আসে যখন সে-জাতীকে তার অভ্যন্তরীণ সংহতি এবং অন্য-জাতীর সঙ্গে তার পার্থক্য স্বাতন্ত্র্য চিহ্ন হিসেবে তুলে ধরতে হয়। পূর্ব বাংলার আর তার পরে বাংলাদেশের বাঙালির জীবনে বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ ছিল তেমনি এক সন্ধিকাল। সারা কাল ধরে বাংলাদেশের বাঙালি তাঁদের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে, বিশেষ করে সামাজিক-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে, তাদের স্বরূপ-ভাবনার চিহ্ন রেখেছে। সাময়িক পত্র-পত্রিকা এবং পুস্তক-প্রকাশনায় বাংলাদেশের প্রকাশন ও মুদ্রণ ব্যবসা আজ বিশিষ্টতা দাবি করতে পারে। বাংলাদেশেরই বলে, যে-সব সাময়িক পত্রের আর বইসহ অন্যান্য প্রকাশনাকে তাদের সুরুচিপূর্ণ অঙ্গসজ্জা দিয়ে চেনা যায়, সে-ধারা প্রবর্তকদের পুরোধা ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। পরবর্তীকালে আরো অনেক গুণী প্রকাশনা-নকশাকার, প্রচ্ছদশিল্পী, সচিত্রকররা কাইয়ুম চৌধুরী-সৃষ্ট গুণমানকে ধরে রেখে, তাঁকে সমৃদ্ধ করলেও, পথিকৃতের সম্মান কাইয়ুম-সাহেবই পেয়ে যাবেন। বাংলার দৃশ্য-সংস্কৃতিকে একান্ত বাংলাদেশি চারিত্র্য দেওয়া এবং একটা রুচিশীল মানে স্থাপন করার কৃতিত্ব যে শিল্পীর, তাঁর নাম কাইয়ুম চৌধুরী। এর পরেও বলার কথা থেকে যায়। জাতীয় সংস্কৃতিতে তাঁর ব্যক্তিগত অবদান যত তাৎপর্যপূর্ণই হোক-না-কেন, তা দিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত সৃজনশীলতার সবটা পরিমাপ হয় না। সাময়িক পত্র-পত্রিকা আর বই প্রকাশনায় সৌষ্ঠবের গুরুত্ব সম্পর্কে তাঁদের নিজেদের কৃতী দিয়ে আমাদের সচেতন করেন, সেই পুলিনবিহারী সেন-বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় জুটি, খালেদ চৌধুরী, সত্যজিৎ রায় আর পূর্ণেন্দু পত্রীর সঙ্গে একসঙ্গেই উচ্চারিত হওয়া উচিত কাইয়ুম চৌধুরীর নাম। স্বকীয়তা চিহ্নিত তাঁর ধরনের প্রকাশনার অঙ্গসৌষ্ঠব সহজে স্থান করে নিতে পারে, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, খালেদ চৌধুরী, সত্যজিৎ রায় আর পুর্ণেন্দু পত্রীর কাজের পাশে।

শেষে আবার, দৃশ্যসংস্কৃতির বিশিষ্ট বাংলাদেশি চরিত্রের নকশাকার হিসেবে কাইয়ুম চৌধুরী স্মরণযোগ্য হয়ে থাকবেন। দাবি শুধু, তাঁর প্রবর্তিত ধারার উত্তরসূরিরা যেন তাঁকে স্মরণে রাখেন।