স্মৃতিটুকু থাক

স্মৃতি যাঁকে ঘিরে বারবার নিয়ে যাচ্ছে  শান্তিনগরের  ‘বাগানবাড়ি’তে – জানলাম-শুনলাম সেই বাড়িটি বিক্রি হয়ে গেছে। নতুন ব্যবস্থাপনায় বাড়িটির নতুন চেহারা দেখার কোনো উদ্যোগ মনের ভেতরে জাগল না। কথা হচ্ছিল আপনার অন্যতম কৃতী সন্তান ইকবাল বাহার চৌধুরীর সঙ্গে।

আনোয়ারা বাহার খালা (কখনো ডেকেছি ‘আপা’ বলে) আপনার শতবর্ষ-জন্মদিনে, ১৩ ফেব্রম্নয়ারি ২০১৮, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে (শাহবাগ) সন্ধ্যা ৬টায় আপনার স্নেহধন্যরা সমবেত হয়েছিলাম। সেখানে এই অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা ইকবাল বাহারভাই নানা আয়োজনে ঢাকার এবং কলকাতার স্বনামধন্য ব্যক্তিদের আলোচনা শুনিয়ে, আপনার জীবনসুধাভরা স্মৃতিকথার আলোকচিত্র দেখিয়ে, সংগীতের সুরে আপনার জন্মের একশ বছর উদ্যাপনের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই সভায় তাঁর সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলা হয়নি, দেখা হয়েছিল।

ফেব্রুয়ারি  মাস। ভাষার মাস। বইমেলার মাস। ফাল্গুনের সুবাস ছড়িয়ে ফুলে, ভালোবাসায় বসন্ত-আবাহনীর স্রোত নেমেছিল পথে পথে। জাদুঘরে পৌঁছাতে পেরেছিলাম নির্ধারিত সময়ের দেড় ঘণ্টা পরে, সাড়ে সাতটায়।

সুন্দর পরিবেশ তখন সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে। সেদিনের সম্মানিত আলোচকরা সামনের সারির আসনে বসে ছিলেন। মঞ্চের সব আসন আলোচকদের জন্য শূন্য হয়ে অপেক্ষা করছিল। দৃশ্যপটে দেখা যাচ্ছিল। পেছনের সারিতে বসলাম। আপনার স্মৃতিসুধাভরা কথা মাইকে শুনছিলাম, দেখছিলাম পর্দায় বক্তাদের ছবি। আপনার কর্মব্যসত্ম নানাদিনের ঘটনা-স্মৃতি বক্তব্যে জানছিলাম। অন্ধকার হলঘরের ্নিশ্চুপ পরিবেশ মনের স্মৃতিকোঠায় আলো জ্বেলে দিলো।

সময় কোথা দিয়ে কেটে গেল জানি না। চালিত ‘সিডি’ শুনছিলাম। পর্দায় স্বনামখ্যাত বিশিষ্টজনেরা বলছিলেন। তাঁরা আপনার সঙ্গে কলকাতায়, ঢাকায়, শামিত্মনগরের বাসায়, বুলবুল একাডেমির (বাসার) বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। আপনার মূল সাধনা ছিল শিক্ষার সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটানো। পর্দায় গানের সুর জাগিয়ে ভেসে উঠলেন আপনার-আমাদের প্রিয় শিল্পী মালেকা আজিম।

জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে গান গাইলেন আপনার মেয়ে সুগায়িকা নাসরিন। শামা চৌধুরী ও সাদী মহম্মদ গাইলেন। শ্রদ্ধা ও স্মৃতিসুধা ছড়িয়ে দিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক পারভিন হাসান (উপাচার্য সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি), ইকবাল বাহার চৌধুরী, প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়, মফিদুল হক। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন সংস্কৃতিসেবী অধ্যাপক কাজী মদীনা।

বক্তাদের কথার অনুরণনের মধ্যে ডুবে গেলাম। উঁকি দিলেন আপনি। হাসিমুখ। গম্ভীর। আভিজাত্য। সব মিলিয়ে আপনি বাংলাদেশের গৌরব। জাতির গৌরব।

বিভিন্ন সম্মাননা ও পদকে ভূষিত হয়েছেন আপনি। কোটি কোটি জাগ্রত নারী-পুরুষ-তরুণ-তরুণী-বালক-বালিকা-শিশুর প্রাণে আপনি
শিক্ষা-সংস্কৃতির যে-আলো জ্বালিয়েছেন ত্রিশ-আশির দশক পর্যন্ত সে-আলোই আপনার জীবনের পরিচায়ক।

শৈশবের সহপাঠীরা আপনার উচ্চ শিক্ষাদীক্ষা-সংস্কৃতি চর্চার দক্ষতা থেকে বহু দূরত্বে সরে গিয়েছিলেন। কিন্তু আপনি তাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। অনেকে স্মৃতিচারণে বলেছেন আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ওঠার কথা।

মাতৃহারা আপনি বালিকা বয়স থেকে লালিত-পালিত-শিক্ষিত হয়েছিলেন একমাত্র খালা সুশিক্ষিত, শিক্ষাব্রতী এবং সাহিত্যিক এম ফাতেমা খানমের যত্নে-আদরে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত পোসত্মা গার্লস স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষার পর খালার সঙ্গে কলকাতায় চলে যান। ডাকনাম খুকি। তবে ভাইয়েরা ডাকতেন ‘খুকুমনু’ বলে। সাহিত্যিক, সাহিত্যরত্ন, মোহাম্মদ নজিবর রহমানের আনোয়ারা উপন্যাসটি পড়ে ‘আনোয়ারা’ নাম রেখেছিলেন আপনার বাবা আবদুল হক খান (১৮৮৫-১৯৮১)। আপনার নানা-নানি মেয়েদের নাম রেখেছিলেন পাখির নামে। আপনার মা কানিজ ফাতেমা খানমের (১৯০০-২০) ডাকনাম ছিল ‘কাকাতুয়া’, মেজো খালা মমলুকুল ফাতেমা খানমের (১৮৯৪-১৯৫৭) ডাকনাম ছিল ‘তোতা’। চাচাত খালাদের নাম যথাক্রমে ছিল বুলবুল ও পাপিয়া।

আপনার খালা এম. ফাতেমা খানমকে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন কলকাতায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুলে’ শিক্ষকতার জন্য আহবান জানান। ১৯৩১-৩৪ পর্যন্ত এম. ফাতেমা খানম সেই স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় আপনাকে সেখানে ভর্তি করেন। ১৯৩৪ সালে সেই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে বৃত্তিসহ ম্যাট্রিক পাশ করে বেথুন কলেজে আই.এ. ও বি.এ. পরীক্ষায় সসম্মানে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন।

সেই সময়ে আপনার জীবনসঙ্গী হলেন হবীবুলস্নাহ বাহার চৌধুরী। সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ক্রীড়া সংগঠক, রাজনীতিবিদ, মুক্তমনা জীবনসঙ্গীর সঙ্গে যুগলে এগিয়ে গেলেন মুক্তচিমত্মা-সংস্কৃতি-শিক্ষার নবজাগরণ ঘটাতে ঘটাতে। দেশবিভাগের উত্তাল রাজনৈতিক দাঙ্গা-বিধ্বসত্ম-হিন্দু-মুসলিম বৈরী পরিবেশে আপনি নারীশিক্ষার হাল-বৈঠা ধরলেন। কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে শিক্ষকতা শুরু করলেন। স্বল্পসময়ের মধ্যেই ঢাকায়, পূর্ব পাকিসত্মানে চলে এলেন স্বামীর কর্মস্থলে। পূর্ববঙ্গ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন মুহম্মদ হবীবুলস্নাহ (১৯০৬-৬৬)। আত্মীয়-বন্ধুজন ডাকতেন ‘বাহার’ নামে। পূর্ববঙ্গের ফেনী অঞ্চল থেকে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৪৬ সালে। আপনি ছিলেন নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। সরকারি চাকরি। বদলি হলেন ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী গার্লস হাইস্কুলে। দেশভাগের নিয়মে বিদ্যাময়ী স্কুলের শিক্ষক করুণাময়ী বক্সী বদলি হয়ে কলকাতায় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুলে যোগ দিলেন।

ঢাকায় রইলেন স্বামী তাঁর রাজনৈতিক কাজ নিয়ে। আপনি চারজন (শিশু-বালক-বালিকা) ছেলেমেয়ে  নিয়ে চললেন ময়মনসিংহে বিদ্যাময়ী স্কুলের চাকরিতে যোগ দেওয়ার জন্য।

আপনি আমাকে সেসব দিনের সংগ্রামমুখর দিনগুলোর কথা বলেছেন সাক্ষাৎকারে। গল্প করার সময় ছিল না আপনার। নারী আন্দোলনের ডাক নিয়ে ‘পূর্ব পাকিসত্মান মহিলা পরিষদ’ থেকে ১৯৭০ সালে গিয়েছিলাম আপনার কাছে। শিক্ষাব্রত নিয়ে আপনি ১৯৪৭-এর পরে পূর্ব পাকিসত্মানের বিভিন্ন স্কুলের বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রমের পথ আটকে ছিলেন। সেসবই তো ছিল জীবনসংগ্রাম, নারী-আন্দোলন তো বটেই। আপনি সানন্দে নারীশিক্ষার আন্দোলনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে যুক্ত হলেন। বন্ধু ছিলেন উম্মেহানি খানম, মেহেরুন্নেসা প্রমুখ শিক্ষাব্রতী, নারী প্রগতির সংগঠক, নেত্রী।

১৯৪৭-৪৮ সময়কালে পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের জনগণ বসতবাটি ছেড়ে-বিক্রি করে, সমত্মানদের লেখাপড়া ছাড়িয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে। ছাত্রীশূন্য স্কুলগুলো সরকার বন্ধ করে দিচ্ছিল, নয়তো দু-তিনটি স্কুলকে একটি স্কুলে সীমাবদ্ধ করার উদ্যোগ নিচ্ছিল। মেয়েদের পড়ানোর জন্য স্কুলে ভর্তি করাতে মুসলিম পরিবারগুলোকে উদ্বুদ্ধ করার সংগ্রাম শামসুন্নাহার মাহমুদ, সুফিয়া কামাল, আপনি, করেছিলেন সেই সময়। আপনারা যখন স্কুলগুলোকে বন্ধ হতে দিচ্ছিলেন না, সে-সময় স্কুলগুলোকে একত্রীকরণ করে নামকরা চালু স্কুলগুলোকে একটি স্কুলে গ–বদ্ধ করার বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী নাদেরা বেগম ছাত্রীসংঘ গড়ে ছাত্রীদের আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। কলকাতায় লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে ১৯৪৬-এ আপনার অন্যতম ছাত্রী ছিলেন নাদেরা বেগম। তখন কামরুন্নেসা গার্লস হাইস্কুলের আপনি প্রধান শিক্ষয়িত্রী। আপনি তখন মনে মনে এক সময়ের ছাত্রীর সংগ্রামমুখর কর্মকা– আনন্দিত, অন্যদিকে সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনের কর্তব্য – দুয়ের সমন্বয় ঘটিয়ে নীরবে উপেক্ষা করেছেন। নাদেরা বেগম ছাত্রীদের নিয়ে গেলেন, মিছিল করালেন, সরকারের নারীশিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন, পুলিশের তাড়া খেলেন; বন্দিও হলেন একসময়। তাঁর কারাবরণের ঘটনায় আপনি উদ্বিগ্ন হলেন। মন আপনার সুফিয়া কামাল, আশালতা সেন, বদরুন্নেসা আহমেদ প্রমুখের সঙ্গে একাত্ম ছিল। কর্তব্য ছিল সরকারি নারীশিক্ষার রুদ্ধদ্বার সরকারি কাজের নীতি মেনেই উন্মুক্ত করার। দুই ধারার সমন্বয়েই বাংলাদেশের নারীশিক্ষার পথ প্রশসত্ম হতে থাকল। অগ্নিযুগের স্মৃতি এবং প্রেরণা আপনার এবং স্বামী হবীবুলস্নাহ বাহারের যুগল জীবনে নতুন নতুন কর্মময় পদক্ষক্ষপ বাসত্মবায়িত করেছে। করতে হবে, পারতে হবে। সমাজ-প্রগতির জন্য বিপস্নব আপনাদের হাতছানি দিয়েছে, এগিয়ে যেতে প্রেরণা দিয়েছে। ঢাকায় যখন পড়তেন শৈশবে তখনই জেনেছেন লীলা নাগের কর্মকা-। তাঁর ‘নারীশিক্ষা মন্দির’ স্কুলে আপনি শৈশবে নানি ফাতেমা খানমের সঙ্গে যেতেন; কোচিং ক্লাস করতেন। লীলা নাগের নারী আত্মরক্ষা সমিতির উদ্যোগে শরীরচর্চা, লাঠি চালানো, বিপস্নবীদের জীবনীচর্চা হতো। সেসব আপনার স্মৃতিতে বিপস্নবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জাগিয়েছে। আপনার স্বামী হবীবুলস্নাহ বাহার পরোক্ষক্ষ যুক্ত ছিলেন চট্টগ্রামের বিপস্নবী অনন্ত সিংহ, লোকনাথ বল, গণেশ ঘোষ প্রমুখ বন্ধুর কর্মকাণ্ডেরসঙ্গে। লিফলেট লিখতেন, সাইকেল দিতেন ব্যবহারের জন্য। ১৯৩৫ সালে তিনি সরকারি পুলিশের এসপির পদে চাকরির জন্য পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়েও অনুমোদন পাননি – বিপস্নবীদের সঙ্গে পরোক্ষ-যুক্ত থাকার জন্য।

বিয়ের পর সংসার-চাকরি, সভা-সমিতিতে যোগ দেওয়া আপনি বন্ধ করেননি। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রতিষ্ঠিত ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম মহিলা সমিতি’র সম্পাদক পদে দশ বছর কাজ করেছেন কলকাতায়। ১৯৩৮-৪৭ পর্যন্ত দুটি স্কুলের সেক্রেটারি ছিলেন। ‘অল ইন্ডিয়া উইমেন্স কনফারেন্সে’র সদস্য ছিলেন। সরোজিনী নাইডু, ইন্দিরা দেবী, লেডি এজরা, বিজয়লক্ষ্মী প–ত, অরুণা আসফ আলী প্রমুখ বহু সংগ্রামী-কৃতী ব্যক্তি নারী ছিলেন আপনাদের সহনেত্রী-সহকর্মী।

ময়মনসিংহে ও ঢাকায় স্কুলে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার পাশাপাশি চালিয়েছেন গানের স্কুল, গানের চর্চা। পাকিসত্মানি সংস্কৃতির বিরুদ্ধ পরিবেশ গড়ে তুলেছিলেন। আবদুল আহাদ, মতি মিয়া, আবদুল লতিফ, হুসনাবানু খানম, লায়লা আরজুমান্দ বানু – সবাইকে নিয়ে বাংলা গান, রবীন্দ্রচর্চা, নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করে আপনি সংগঠিত করেছিলেন সংস্কৃতিচর্চার সমর্থক ও সক্রিয় কর্মীদের। শিশুদের মনে গেঁথে দিয়েছিলেন সুস্থ জীবনচর্চার স্বপ্ন।

আমি এবং আমার সাথিরা একটু একটু করে স্কুল পাঠের সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হচ্ছিলাম। ১৯৫২ সালে বিদ্যাময়ী স্কুলে, ১৯৫৪ সালে নারীশিক্ষা মন্দির স্কুলে পড়ার সময়ে নারী-প্রগতির তথা সংস্কৃতিচর্চার আবহাওয়ায় বড় হচ্ছিলাম। জানছিলাম আপনাকে। কবি সুফিয়া কামাল, আশালতা সেন, কামরুন্নাহার লাইলী, সন্জীদা খাতুন প্রমুখের পাশাপাশি জানছিলাম-পরিচিত হচ্ছিলাম রবীন্দ্রচর্চার জগতের সঙ্গে। বাংলা ভাষা-আন্দোলন, শহিদদের আত্মদান – এসবের মধ্যে ভাস্বর হয়ে আছেন কৃতী নারীনেত্রীরা, যাঁরা নারীশিক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কত স্মৃতিসুধায় আপনি আমাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন সাক্ষাৎকারে সম্মত হয়ে। ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ (রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রতিষ্ঠিত) সংগঠনটির কাজ আপনার ননাস স্বনামখ্যাত শামসুন্নাহার মাহমুদ ঢাকায় অব্যাহত রেখেছিলেন কিছুদিন। আপনিও যোগ দিলেন।

কী বিস্ময়কর কর্মোদ্দীপনাপূর্ণ-অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ আপনার জীবন। ‘Special officer for women’s education’-এর দায়িত্ব পালনে আপনি ছিলেন অগ্রগামী এবং অনন্য।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন আপনাদের পারিবারিক ঘনিষ্ঠজন। সে-সময়ে সাহিত্যসভায় যাওয়া স্বল্পসংখ্যক নারীর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য ছিলেন শামসুন্নাহার মাহমুদ, সুফিয়া কামাল, লুৎফুন্নেসা আববাসী, রাবেয়া আলী, আপনি আনোয়ারা বাহার।

১৯৫৩ সালের ৭ এপ্রিল স্বাস্থ্যমন্ত্রী হবীবুলস্নাহ বাহার চৌধুরী আকস্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে ১৩ বছর প্রায় বাক্হীন-পঙ্গু অবস্থায় শয্যাশায়ী হয়ে প্রয়াত হন। বড় সমত্মান সেলিনা বাহার জামান তখন দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন। ইকবাল বাহার পড়তেন অষ্টম শ্রেণিতে, শাহীন চতুর্থ শ্রেণিতে, নাসরিন শামস্ বেবি ক্লাসে। সব শেষের মেয়ে তাজীন চৌধুরীর বয়স ছিল দুই। আপনি পর্যুদসত্ম হওয়ার ব্যক্তি নন। অব্যাহতভাবে কাজ করেছেন। বুলবুল একাডেমি দাঁড় করিয়েছিলেন। বিদেশে প্রতিনিধিত্ব করেছেন সংস্কৃতি-সাহিত্য সংগঠনের। লিখেছেন কবিতা, প্রবন্ধ। চর্চা করেছেন সাহিত্য-সংস্কৃতির।

বহু বন্ধু, স্বজন, সমত্মানকে অনাথ করে দিয়ে আপনিও অসুস্থ হয়ে প্রয়াত হলেন ১৯৮৭ সালের ২৭ অক্টোবর বেলা ১১টায়। আপনার মাত্র ৬৯ বছর বয়সে আমাদের কাছ থেকে মৃত্যু ছিনিয়ে নিল। এই অসীম দুঃখ নিয়ে আমাদের চলতে হচ্ছে।

আপনি নেই – কিন্তু আপনি আছেন। পুরান ঢাকার ‘সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি’তে অধ্যাপনা করছি। বহু ছাত্রী পড়ছে নানা বিভাগে। কামরুন্নেসা গার্লস হাইস্কুল, বাংলা বাজার গার্লস হাইস্কুল, সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ, নারীশিক্ষা মন্দির (বর্তমানে শেরেবাংলা গার্লস হাইস্কুল ও কলেজ) থেকে ছাত্রীরা পড়তে আসছে। তাদের কাছে শিক্ষাব্রতী আদর্শ শিক্ষকদের কথা বলি। আপনার কথা, লীলা নাগ, বেগজাদী মাহমুদা নাসরিন, শামিত্ম নন্দী প্রমুখ শিক্ষকের জীবনচর্চা-শিক্ষাচর্চার কথা বলে নিজেই এগিয়ে যাওয়ার সাহস পাই।

আপনার জন্মশতবর্ষে জানাই পরম শ্রদ্ধা।