স্মৃতির ছায়াপাত

শাহীন আখতার

। ২।

চিঠিতে মা আরো লিখেছেন – ছেলেটা এত কম কথা বলত! একদিন তা শুধোতেই নিরো বলে – ‘ওর বাড়ি ত্রিপুরা জেলায় (বর্তমান কুমিল্লা), মা। কথায় বাঙাল টান তো, তাই তোমার সামনে মুখ খুলছে না।’ তাতে সম্ভবত শ্লাঘা বোধই করেছিলেন আমার মা লীলাবতী। যে-ছেলে কলকাতায় ডাক্তারি পড়ে, কদিন পর আইএমএফ ডাক্তার হবে, সে শিলংয়ে এসে শামুকের মতো গুটিয়ে আছে – তাতে কি প্রমাণ হয় না, শিলংবাসী তুলনামূলকভাবে বেশি
পরিশীলিত! কলকাতা কসমোপলিটন শহর হলেই কী – ওটা তো খোট্টা-উড়ে-বাঙালে ভর্তি। আশ্চর্য যে, মায়ের বাড়ি কিন্তু হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ। মাত্র দুই জেনারেশনের শিলংয়ে আনাগোনা, শরীরে নাক ঘষলে এখনো রোমকূপ থেকে হাওরের মাছের আঁশটে গন্ধ বেরোবে। মায়ের চিঠির লাইনে লাইনে আমি তখন সমাজের ক্লাস-কাস্টের তীব্র দুর্গন্ধ পাচ্ছিলাম। আমাদের লড়াইটা এলিটিসিজমের বিরুদ্ধেও নয় কি? আজ লিখতে বসে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের একটি গান খুব মনে পড়ছে – হবিগঞ্জের জালালি কইতর, সুনামগঞ্জের কুড়া/ সুরমা নদীর গাঙচিল আমি, শূন্যে দিলাম উড়া/ শূন্যে দিলাম উড়া রে ভাই, যাইতে চান্দের চর/ ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কইলকাত্তার উপর/ তোমরা আমায় চিনোনি…

এভাবেই চেনাতে হয় নিজেকে, নিজের শিকড়সমেত। ঝামা দিয়ে ঘষে ঘষে পরিশীলিত হওয়ার মধ্য দিয়ে নয়।

আমি হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে প্রথম দেখি – বিয়ানীবাজারের একটি ঘরে পড়ে আছেন। টিবি হয়েছে। আমাকে বললেন, তোমরা কত কাজ করছ। আমার জীবনের কোনো মূল্য নেই। ভীষণ বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। আমি তো তখন খুব ভেটেরান! বললাম – কিচ্ছু ভাববেন না। গান লিখে যান, কবিতা লিখে যান। ওটাই হবে আমাদের হাতিয়ার। এভাবেও তো আপনি বিপস্নবকে ত্বরান্বিত করতে পারেন! এখন আমার এ-কথাগুলো পড়ে কারো মনে হতে পারে, আমার উপদেশ শুনেই বুঝি হেমাঙ্গ বিশ্বাস পরবর্তীকালে ফেমাস হয়েছিলেন।

মাকে ঠেস দিয়ে আমি বাঙাল ভাষার সাফাই গাইছি ঠিকই, প্রায় এক যুগ হাটে-মাঠে ঘুরেও নিজে তা রপ্ত করতে পারিনি। হয়তো মন থেকে চাইনি, নিজের পরিশীলিত বাংলায় কাজ চালানো যাচ্ছে যখন! কিন্তু মণিপুরি বা অহমিয়াদের বেলায় ওটি চলবে না। ওদের ভাষা শিখতেই হবে। আমি জানতাম অল্পস্বল্প, কাজ চালানোর মতো। বাকিটা নেচে-কুঁদে পুষিয়ে নিতাম। আমি আগেই বলেছি, আমি ছিলাম দুরন্ত স্বভাবের। এক জায়গায় দুমিনিটও স্থির থাকতে পারতাম না। বাঙালিদের তো এটা করতে নেই, ওটা করতে নেই, এটা অমুক, ওটা তমুক – এক রাজ্যের বাধানিষেধ। আমি বড় হয়েছি খাসিদের মাঝে। পরে যখন দুর্ভিক্ষের বছরে ভানুবিল ও দুর্লভছড়ায় মণিপুরিদের সঙ্গে কাজ করছিলাম, তখন ওদের নিকোনো উঠোনে লাফাতাম-ঝাঁপাতাম। আর ফুক ফুক করে হুঁকা খেতাম। ওরা বলত – ‘তুই ঠিক আছিস। হাঁড়িমুখোদের গাঁয়ে ঢুকতে দেখলে ঝাঁটা মারব।’ মজার ব্যাপার – ছোট-বড় সব জাতের বাঙালি ছিল মণিপুরিদের কাছে অস্পৃশ্য। সে লাল ঝাণ্ডার লোক হলেও ক্ষমা নেই। ঘরে ঢুকতে দিত না। খেতে দিত আলাদা থালায়। থাকতে দিত বসতবাটি থেকে দূরে আলো-বাতাসহীন ছাপরা ঘরে। তাতে বর্ণহিন্দু কমরেডরা তো শকড। আমাকে ব্যঙ্গ করে বলতেন – আপনি কোন জাদুবলে কল্কে পেলেন, কমরেড?

যা বলছিলাম। আমি আর বাবা ঘাপটি মেরে আছি দুজায়গায়। একজন জোড়হাট, আরেকজন মণিপুর। মা তখন দাদাকে খুঁজতে চেষ্টার ত্রম্নটি করেননি। মায়ের মন তো, পরে নিজে মা হয়ে বুঝেছি, তাঁর সহজাত প্রবৃত্তিই বলে দিচ্ছিল – ছেলে চলে গেছে এমন জায়গায়, যেখানে ঘোর বিপদ আসন্ন। দাদা চলে যাওয়ার আগের রাতে, মা লিখেছেন – শুতে যাওয়ার আগে নিরো এসে বলল, ‘ধরো আমি কোথাও চলে গেলাম, তোমাদের কাছ থেকে টাকাকড়ি নিলাম না। তাহলেও কি তোমরা আমায় পুলিশে দেবে?’ দাদার কথা শুনে মায়ের তো আক্কেলগুড়ুম। বলে কী, নিজের সন্তানকে কেউ পুলিশে দেয়, সে যত অন্যায়ই করুক! মুখে বললেন, ‘কী আবোলতাবোল বকছিস, বাপু! রাত হয়েছে – শুতে যা। কাল আবার আমাকে সকাল সকাল উঠে মুরগির স্যুপ বানিয়ে নিয়ে যেতে হবে অ্যাসাইলামে। জানিস তো, পল্টুদা যক্ষ্মা বাঁধিয়ে ওখানে ভর্তি হয়েছেন!’

পরদিন সকাল। এপ্রিল মাসেও বৃষ্টির মতো কুয়াশা ঝরছে। উনুনে চায়ের জল চাপিয়ে মা দাদাকে ডাকতে গেলেন। কোথায় দাদা আর তার বন্ধু। ওদের বাক্স-বেডিংও হাওয়া হয়ে গেছে। কলতলায় খাসি দারোয়ানের বউটি বাসন মাজছিল। ও দাদাদের বেরোতে দেখেনি। বলল, ওর স্বামী গেছে রেশনে কেরোসিন কিনতে, যুদ্ধের বাজার তাই রাত থাকতেই লাইনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মা চুলো নিভিয়ে ছুটলেন সিলেট মোটর স্টেশন। ওখানে দাদার নামে সিট বুক করা নাই। তারপর এ-বাড়ি, ও-বাড়ি – মায়ের ছোটাছুটি। শিলংয়ের তখনকার অনেক হর্তাকর্তা বাবা-মায়ের চেনা ছিল। তাঁদের একজন সিলেটে ফোন করে দিলেন রেলস্টেশনে নজর রাখতে। কিছুতেই কিছু হলো না।

মায়ের চিঠি পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, সিলেট থেকে ট্রেন ধরেনি যখন, ওরা শিলং থেকে বাসে চেপে শিলচর, তারপর হিল সেকশন রেলপথে গেছে চট্টগ্রাম, যাতে ওদের কেউ ধরতে না পারে। আমাদের মধ্যে চিঠি চালাচালি না হলেও বুঝতে পারছিলাম – দাদারা অবশ্যই চট্টগ্রাম গেছে। ওখান থেকে সমুদ্রপথে রেঙ্গুন। এর কারণ হয়তো এলগিন রোডের বাড়ি থেকে সুভাষ বসুর নিখোঁজ হওয়ার দুনিয়া-মাতানো বার্তাটি, যা তখনকার খবরের কাগজের পাতায় রোজই নতুন নতুন গুজবসমেত ভেসে উঠত। তার মধ্যে ১৯৪১ সালের ১৭ জানুয়ারির মোক্ষম গুজবটি হচ্ছে – সুভাষ তাইসুং নামের এক জাহাজে করে কলকাতা ছেড়েছেন। সেই জাহাজ গেছে পেনাং, সিঙ্গাপুর হয়ে হংকংয়ের দিকে। গুজবটি ছড়ানোর উদ্দেশ্য উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের দৃষ্টি ফেরানো। তাতে যৎপরোনাস্তি কাজ হয়। সরকারবাহাদুর গুজবটি আমলে নিয়ে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস, সুরমা ভ্যালি লাইটহর্স রাইফেলসকে সতর্ক করে পূর্ব সীমান্তবর্তী প্রতিটি ঘাঁটির ওপর নজর রাখতে বলে। যেন কোনোভাবে সুভাষ বর্ডার পেরোতে না পারেন। রেঙ্গুন, পেনাং, সিঙ্গাপুর, হংকং বন্দরেও তখন সতর্কতা জারি হলো – প্রতিটি যাত্রীকে ভালোভাবে তল্লাশি করো, পাসপোর্ট নতুন করে চেক করো। সন্দেহ হওয়া মাত্র গ্রেফতার। সেসব খবরের সূত্র ধরে দাদা যে গুরুর পদাঙ্ক অনুসরণ করবে, তাতে আশ্চর্য কী। ওর মুসলিম বন্ধুটি মৌনীবাবা সেজে খুঁটে খুঁটে পত্রিকা পড়ত কি শুধু শুধু!

সত্যিকারে সুভাষ বসুর কাবুল-মস্কো হয়ে বার্লিন যাওয়ার কথা তখন কেউ ভাবতেই পারেনি। তার কারণ সম্ভবত জানুয়ারির শেষাশেষি ওই অঞ্চলের হাড়-কাঁপানো শীত, বরফাচ্ছাদিত হিন্দুকুশ পর্বতমালা। দুর্ভাগ্য দাদার, আর সপ্তাহখানেক অপেক্ষা করলেই জানতে পারত – সুভাষ বসুর অভিমুখ পুব নয় ছিল পশ্চিমে। সে-সময় ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের জব্দ করা একটি চিঠির সূত্রে বাজারে খবর রটে – সুভাষ আফগানিস্তান থেকে ইরান-ইরাক-তুরস্ক হয়ে জার্মানির দিকে যাচ্ছেন। সেইমতো ধুরন্ধর শত্রম্নটিকে নিধনের জন্য ব্রিটেনের স্পেশাল অপারেশনস এক্সিকিউটিভ (এসওই) তাদের ইস্তাম্বুল প্রতিনিধির ওপর মার্চ অর্ডারও জারি করে। এই অর্ধসত্য খবরটি মাত্র কটা দিন আগে প্রচার হলে, মায়ের সারাজীবনের আফসোস – তার বুক চিরতরে খালি হতো না।

কেউ যা ভাবতে পারেনি, সুভাষ বসু সত্যিকারে সেই কঠিন, দুর্গম গিরিপথ বেছে নিয়েছিলেন। শুধু কথায় নয়, কাজেও জানবাজ। তাই আদর্শের অমিল সত্ত্বেও মানুষটাকে আমি শ্রদ্ধাই করতাম। এখনো করি। মার্চের শেষাশেষি তুষার ধবল হিন্দুকোশ পর্বতমালা পেরিয়ে অক্সাস নদীর কাছের আফগান সীমান্ত। তারপর মধ্য এশিয়ার তিলোত্তমা নগরী সমরখন্দ থেকে ট্রেনে চেপে সোভিয়েত রাজধানী মস্কো। তাঁর এই পথপরিক্রমা পরে জানাজানি হলে, আমি ক্যালেন্ডার মিলিয়ে দেখেছি – দাদারা যখন শিলংয়ের বাড়ি থেকে পালায়, তখন সুভাষ বসু মস্কো থেকে আকাশপথে বার্লিন। ততদিনে যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপ থেকে উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যের বসরা, সিরিয়া পর্যন্ত।

যেমন গুরু তেমন তাঁর শিষ্য। দাদারা চট্টগ্রাম থেকে রেঙ্গুন গিয়েছিল জাহাজের সারেং সেজে। সঙ্গে মাত্র দশটি টাকা। এসব কথা যখন রেঙ্গুন থেকে লিখে জানায় দাদা, আমি তখন শিলং। গায়ে পাঁচড়া, পায়ে ফোসকা নিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছি। নিমপাতা-কাঁচা হলুদবাটা গায়ে মেখে ঘরের সামনের রোদে পা মেলে বসে থাকতাম সারা দুপুর। বাগানটা আগাছায় ভরে গিয়েছিল। দাদার চিঠি আসার পরদিন মালীকে নিয়ে বাগানের পরিচর্যায় নেমে পড়লেন মা। পায়ে গামবুট। পরনে মণিপুরি ফানেক-চাদর। পিঠে লম্বা বিনুনি। সরু আঙুলে কাঁচি ধরে কচকচ করে গাছের ছোট ছোট মরা ডাল ছাঁটছেন। এইচএমভির গ্রামোফোনে বাজছে রবীন্দ্রসংগীত – ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো।’ মাকে এত সুখী আর কখনো দেখিনি।

 

স্বপ্নে সায়মা খাতুনের আবির্ভাব

সাবিনা স্বপ্ন দেখে – কেরোসিনের কুপি হাতে এক বৃদ্ধা তাঁর ছেলেকে খুঁজছে। একবার ধানের গোলায় উঁকি দেয় তো, পরক্ষণে হাঁড়ির ঢাকনা তুলে দেখে বা নিভা ছাইয়ের গাদা নখ দিয়ে আঁচড়ায়। তাঁর হাতের মিটমিটে বাতিটা আরও অদ্ভুত। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে যেন বলছে – এ-ঘরে নেই, অন্য ঘরে চলো। পরের ঘরখানায় একটা কাঁথা-কুঁথি রাখবার বাঁশের মাচা। বৃদ্ধা বাতিটা মাটিতে নামিয়ে দোলনার মতো ওতে দোল দিতে দিতে সুর করে গাইছে – ‘আমার ছেলে! আমার ছেলে! অ-অ…’ চোখ মেলে সাবিনা। বিছানার অর্ধেকটা রোদে ভেসে যাচ্ছে। গলার নিচে থিকথিকে আঠাল ঘাম। কোলবালিশটা ঠেলে সরিয়ে ও শুয়ে শুয়ে ভাবে – হুম, দুপুরের ভাতনিদ্রা! বাড়ি এলে যা হয় – কখন ঘুমায়, কখন জেগে থাকে নিজেও জানে না। ও অনিতা সেনের বই বন্ধ করে পাশ ফিরেছিল দাদি সায়মা খাতুনের কথা ভাবতে ভাবতে। নীল ফিতাপাড়ের সাদা শাড়ি। মাথাভরা ধোঁয়াটে-সাদা কোঁকড়ানো চুল (সায়মা খাতুন বলতেন গুয়াথুবড়ি চুল)। সন্ধ্যা নামলে কুপি-হাতে এঘর-ওঘর তোকাতুকি করতেন। বাড়ির লোকেরা আড়ালে বলাবলি করত, ‘জিনে ধরছে!’ পরে আববার মুখে সাবিনা শুনেছে – দাদির আলঝেইমার্স ডিজিজ ছিল।

‘অহনো আইলো না মজু? অয় কি বর্মার যুইদ্ধে মইর‌্যা গেছে!’ দাদির কথা শুনে ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে খিলখিলিয়ে হাসত রোখসানা, কখনো মেজোভাই বা দুজনে মিলে একসঙ্গে। ‘পড়া বাদ দিয়া রং দেহস! মাগরিবের আজান পড়ছে, পড়তি যা!’ নীহার বানু চুলা থেকে ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে তাড়া দিলে ওরা সরে যেত। সাবিনার তখনো পড়ালেখা করার বয়স হয়নি। তখন ওর গায়ে চুলকানি হতো খুব। খড়ের গাদায় গড়াগড়ির কথা কিছুতেই নীহার বানুকে বলা যাবে না। তিনি নামাজে দাঁড়ালে চুপিচাপি ওর গায়ে খাজলির মলম লাগিয়ে দিত রোখসানা। কী রোগের কী দাওয়াই! তার ওপর ছারপোকার দুর্গন্ধ। তাতে চুলকানি যেন বাড়ত আরো। নীহার বানু মোনাজাত ধরেছেন। এখনই জায়নামাজ গুটিয়ে উঠে আসবেন। সাবিনাকে চাপা গলায় তাড়া দিত রোখসানা। সাবিনা মার খেলে, বকাটা রোখসানার প্রাপ্য – ভুলভাল ডাক্তারি ফলাবার জন্য। চৌকাঠ থেকে দুধাপ নেমেই অন্ধকার উঠানের দিকে তাকিয়ে ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত সাবিনা। রোখসানা তখনো সায়মা খাতুনের ঘরের দিকে ইশারায় ওকে যেতে বলছে। দাদির ঘরটা সেইফ জোন। নীহার বানু পারতপক্ষে ওখানে ঢোকেন না। তা সত্ত্বেও সাবিনা দরজার নিচে দাঁড়িয়ে থাকলে রোখসানা পড়া ছেড়ে উঠে আসত। ‘কী, মাইর খাইতে চাও? যাও না যে বড়?’ তারপর কানের কাছে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলত, ‘দাদির ঘরে মনের সুখে গা চুলকাইতে পারবা, কানতেও পারবা বিলবিলাইয়া – তোমার যা স্বভাব!’

রাতে মোয়াজ্জেম হক যখন বাড়ি ফিরতেন, ততক্ষণে সায়মা খাতুন জায়নামাজে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে প্রায় বেহুঁশ। সাবিনাও গুটিসুটি মেরে বিলবিলিয়ে কাঁদত দাদির সঙ্গের জিনটার ভয়ে। ‘আম্মা, এই দেহেন আমি। আপনের মোয়াজ্জেম, আম্মা!’ ছেলের গলা শুনে ধড়মড়িয়ে উঠে বসতেন সায়মা খাতুন। পেটের আওলাদ যেন বেগানা পুরুষ, লম্বা ঘোমটা টেনে কুঁজো হয়ে ঘুরে বসতেন সঙ্গে সঙ্গে। আববা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ত্রাণকর্তার মতো হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিতেন সাবিনাকে। আববার গায়ে ডেটলের ঝাঁঝালো গন্ধ।

সাবিনা দ্রম্নত সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামে। মোয়াজ্জেম হকের ঘরে যে ভুরভুরে স্যাভলনের গন্ধ, এ নিশ্চয় নীহার বানুর কীর্তি! তিনি কদিন ধরে স্বামীর শরীরে মৃত্যুর গন্ধ পাচ্ছেন। গন্ধটা কেমন জিজ্ঞাস করলে উদাস হয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকেন। দুজনের ষাট-বাষট্টি বছরের দাম্পত্য জীবনে এই প্রথম বিছানা আলাদা হয়েছে। এখন মুখোমুখি দুটি ঘরে দুজন। দুটি ঘরেই ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে। মোয়াজ্জেম হকের বিছানার দিকে তাকিয়ে সাবিনার বুকটা কেঁপে ওঠে। সাদা চাদরে যেভাবে মাথা মুড়ে টানটান শুয়ে আছেন, তাতে মুর্দা বলে ভ্রম হয়। চাদরে আতর ছড়ানোতে পরিবেশটা আরো মৃত্যুময় হয়ে উঠেছে। নীহার বানুকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তা বলে বাথরুমে উঁকি দিতেও যায় না সাবিনা। হাত-লাঠিটা দেয়ালে দাঁড় করানো যখন, দরজা ভেজিয়ে ভেতরেই আছেন হয়তো। দরজার ছিটকিনি তোলা তো স্বামী-স্ত্রী দুজনের জন্যই ডাক্তারকন্যা রোখসানার বারণ। ওর হুকুম অক্ষরে অক্ষরে মানা হচ্ছে শুনলে খুশিতে আটখানাই হবে। স্যাভলন ছড়ানোর জন্য তো অবশ্যই। তাতে ডাক্তার হিসেবে স্বস্তি পায় বোধহয়।

এ সমস্ত ক্লিনিক্যাল বিষয়-আশয় ছেড়ে সাবিনার ইচ্ছা করে খানিক আগের স্বপ্নটায় ফিরে যেতে। দাদি, অপেক্ষাকৃত জোয়ান বাবা-মা, যাদের সেণহে, শাসনে জীবনটা নির্ভাবনাময় ছিল একদিন। কখন পুরনো সময় শুকনো পাতার মতো উড়ে গেছে! একটা কান্নার পাখি যেন থেকে থেকে ডানা ঝাপটাচ্ছে ওর বুকের শূন্য গহবরে। দাদি নাই। বাবা-মাও কেমন অচেনা, ভিনজগতের আজব দুজন বুড়া-বুড়ি, বিশেষত আববা। তিনি ভাত খেয়ে উঠে হাতের পানি না ঝরতেই বলেন, খাই নাই, নিয়মিত দু-চারটা বড়ি মুখের পাশ দিয়ে উড়ে পড়ে খাটের চিপায়, মনের ভুলে এক নামাজ পড়েন দুইবার। তাঁদের সান্নিধ্যে পরলোকের ভাবনা করা চলে, বই লেখাটা মনে হয় অর্থহীন। ও কি ঝোঁকের মাথায় চাকরি ছেড়ে ভুল করল?

দরজায় দাঁড়িয়ে বাড়িটার দিকে তাকালে সাবিনার আরো ধাঁধা লাগে। মনে হয় অন্য কারো অচেনা বাড়ি – ও গেট খোলা পেয়ে মনের ভুলে ঢুকে পড়েছে। পুরনো বসতবাড়ির স্মৃতি বলতে একখানা পারিবারিক গ্রম্নপছবি। তাতে ধরা আছে বিবর্ণ পাতাবাহারের ঝাড় আর করোগেট টিনের বেড়ার খানিকটা অংশ। হাতলবিহীন চেয়ারে বসা বস্তার মতো জড়োসড়ো সায়মা খাতুনকে ঘিরে অর্ধবৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছে নাতি-নাতনিরা। ক্যামেরার কালো নেকাব সরিয়ে সবাইকে হাসতে বলা হলেও কেউ হাসছে না। বিষ-পিঁপড়ার কামড় সত্ত্বেও যার যার মতো গাম্ভীর্য বজায় রেখেছে। সাবিনার জন্মের আগের উঠানের কোণের একটা কাঁঠালগাছ মাঝে মাঝে গল্পের অনুষঙ্গ হয়ে আসে। সে-গাছে সারা বছর ঘন কোয়ার মিষ্টি কাঁঠাল ফলত, যা থেকে গাঁয়ের লোকও বঞ্চিত হয় নাই। সে-বাবদে গাছটার সুনাম এখনো জারি আছে। একটা চৌচালা ঘরের ছনের চাল, যা কখনো সুনাম অর্জন করে নাই, সেটি উড়ে যায় নীহার বানুর বিয়ের রাতে। রাতের দ্বিতীয় প্রহরেও আকাশে এককণা মেঘ ছিল না বা গাছে গাছে বেতাল বাতাস, আচমকা তুফান উঠলে নবদম্পতি ভাবেন, এ রোজ কেয়ামত। আসমানটা বুঝি ঘন ঘন জমিনে বাড়ি খাচ্ছে। পরের বার নীহার বানু শ্বশুরবাড়ি আসেন ছমাস পর। তাঁর আববা হাজি চানের শর্তমতো এ-সময়টায় ঘরের খুঁটি বদলে চালের বাঁশের কাঠামোয় পেরেক ঠুকে রুপার মতো চকচকে টিন বসাতে হয়েছিল। তাতে নীহার বানুর জিত হলেও সায়মা খাতুনের ভাষায় ‘আনাম নোকসান’। কিন্তু সরাসরি কিছু বলার তাঁর সাহস হতো না। পাশ দিয়ে বউকে যেতে দেখলে ছড়া কাটতেন – ঘরে নাই ভাত, নাঙের উৎপাত। নীহার বানু সদম্ভে ঘাড় ঘোরালে খামোশ। কখনো কখনো কান্নার ভান করতেন। যেন রুপালি টিনের ঝিকিমিকিতে তাঁর চোখ উপচে জল গড়াচ্ছে। তাতে বউ তো বউ, ছেলেরও মন ভিজেনি। বরং ভাবখানা এমন যে, সায়মা খাতুনকে টিনের চালের নিচে ঠাঁই দেওয়ায় তাঁর বর্তে যাওয়াই উচিত।

সে তো বহুদিন আগের কথা। সাবিনাদের ছোটবেলাতেও ঘরে ঘরে বিজলিবাতি ভাবা যেত না। হারিকেন জ্বেলে সন্ধ্যায় পড়তে বসত ওরা। নাইত কাঁচা ঘাটের পানাপুকুরে। এখন পাইপের ভেতরের গরম পানি, অ্যাটাচড বাথ, দোতলা পাকা বাড়ি, ইটরঙা প্রাচীর, লোহার গেট – কামাল করে দিয়েছেন মেজভাই। দারিদ্র্যকে যিনি কার্স ভাবেন, তিনি সেই অভিশপ্ত অতীতকে মুছে ফেলতে তো চাইবেনই। ওদিকে সাবিনা তা হারাতে চায় না। নিরেট আভরণহীনও দেখতে ভয় পায়। ও চায় ‘অভিশপ্ত অতীত’ যেন নীহার বানুর ফ্রেমে-বাঁধানো সূচিকর্মের মতো রঙিন হয়, তেমনি স্মৃতিবিধুর, মোহনীয়।

কেমন ছিল সেটা?

হাশিয়ায় আঙুরলতা, মাঝখানে রঙিন সুতায় উৎকীর্ণ বাণী – ‘দুঃখ যদি দাও গো খোদা, শক্তি দাও সহিবারে।/ হৃদয় আমার বাধ্য করো, তোমার বাণী বহিবারে।’ কাঠের ফ্রেমবন্দি, কাচে-ঢাকা সূচিকর্ম। ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে রোগীরা যাতে বানান করে বারবার পড়তে পারে, সেভাবে কাঠের বেঞ্চিটার ঠিক উলটাদিকে কালো বার্নিশের ছেঁচা-মুলির বেড়ায় ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন নীহার বানু। ওখানে থাকতে পারত ‘স্বাস্থ্যই সুখের মূল’ বা, ‘আপনার শিশুকে সময়মতো টিকা দিন’ যা সচরাচর ডাক্তারের চেম্বারে, ক্লিনিকগুলোতে দেখা যায়। তখন তো কলেরায় গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। ‘আপনি সতর্ক থাকুন, খাবারে যাতে মাছি না বসে’ বা ‘সব সময় পানি ফুটিয়ে পান করুন’, ‘বাসি খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন’ সেসব রঙিন সুতায় লেখা হয় নাই হয়তো মোয়াজ্জেম হকের অনুরোধ সত্ত্বেও, বা গুণবতী স্ত্রীর সেলাইকর্মের তিনি এমন বিমুগ্ধ দর্শক ছিলেন যে, কাজের কথা বলতে হয়তো ভুলে যেতেন। ছোটবেলায় সাবিনা দেখেছে – মাথার ওপর ঝুলন্ত আধ্যাত্মিক বাণী আর টেবিলে সেমি-আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে মোয়াজ্জেম হক পাড়া-প্রতিবেশীদের জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন বাজারের ডিসপেনসারি ‘নেতাজি ঔষধালয়ে’ যাওয়ার আগের সময়টুকুতে, সকাল সাতটা থেকে দশটা পর্যন্ত। নীহার বানুর কাব্যপ্রীতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলে মুলির বেড়াটা ভরে যায় আমির খসরু, হাফিজ, ওমর খৈয়ামের কবিতায়। দিল্লি-সিরাজ-কাশগড়ের গোলাপের রং কি ময়ূরকণ্ঠী বা জারুল-বেগুনি? সে যা-ই হোক পাতা সর্বদা গাঢ় সবুজ, কণ্টকের আগাটা পাতলা সবুজ, ডাঁটা মরচে সবুজ। সেইমতো রঙিন সুতার লাছি বাছা হতো। শালুর মলাটবন্দি সেলাই খাতার পেনসিলের নকশা বা কবিতার ছত্র কখনো কখনো বদলে যেত সূচিকর্মে। ফ্রেমে বাঁধাই আমির খসরুর কবিতা ‘আগর ফিরদৌসে বরুইয়ে জমিন অস্ত, হামিন অস্ত, এ হামিন অস্ত, এ হামিন অস্ত’ দুর্বোধ্য হওয়ার কারণে বহুত আচ্ছা। এর বাংলা তর্জমা, যা সেলাই খাতায় লেখা রয়েছে, ‘জমিনে যদি বেহেশত থাকে, তা এইখানে এইখানে এইখানে’ –  কিছুতেই নয়। তা এমন জায়গায় শোভা পায় না, যেখানে লোকের খরচ বাঁচাতে লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া ছাড়াই ছোটখাটো শল্যচিকিৎসা চলে।

নীহার বানু এর নাম দিয়েছিলেন আজাদি চিকিৎসা। আজাদ হিন্দের ফিল্ড হাসপাতালের দুরবস্থার কথা স্বামীর মুখে শুনে হয়তো। অথবা এর আরেকটা অর্থও থাকতে পারে – যন্ত্রণা থেকে চিরতরে আজাদি বা মুক্তি। কিন্তু সকালে বিনামূল্যে চিকিৎসা নিতে আসা মানুষগুলোর কইমাছের প্রাণ। যন্ত্রণা সহ্য করার শক্তিও অসীম। পায়ে লম্বা সেলাই নিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে মুখে অপ্রস্ত্তত হাসি ছড়িয়ে সাইনবোর্ডহীন ডাক্তারখানা থেকে বেরিয়ে যেত নিঃশব্দে।

রোজ ভোর না হতেই তখন এত লোকের সমাগম, সাবিনার ঘুম ভেঙে মনে হতো বাড়িটা যেন মুসাফিরখানা বা নিরন্তর উৎসবমুখর এমন এক আবাস, যার অতিথিরা জরাগ্রস্ত, ছেঁড়াফাঁড়া ময়লা পোশাকের কপর্দকশূন্য, দীনহীন। তাদের টুকরো কথা, অভিযোগ, কাতরোক্তি, দোয়াদরুদ চোখ বুজে বাতাসে কান পাতলে এখনো বুঝি আবছাভাবে শোনা যাবে।

‘বাড়িতে পা দিয়া ঘুম আর ঘুম!’ পেছনে লাঠির ঠুকঠুক, সঙ্গে নীহার বানুর জড়ানো গলা, ‘ঢাকায় ঘুমাস না তুই? চোর পাহারা দেস?’

সাবিনা চমকে উঠে চোখ পিটপিটিয়ে তাকায়। দুয়ারে চেয়ার টেনে বসার পর সামান্য ঝিমুনিই হয়তো এসেছিল, ঘুম কিছুতেই নয়। তা বলে মায়ের কথার প্রতিবাদ করতে যায় না ও। বাবা-মায়ের পড়তি বয়সের শেষ সন্তান। এখনো নীহার বানুর মেজাজ-মর্জি ঠিক থাকলে ওর সঙ্গে নাতি-নাতনির মতো এমনি ধারার মশকরা করেন। এই সুযোগে হয়তো দুপুরের স্বপ্নটা বলে ফেলা যায়। সাবিনা ইতস্তত করে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে – কী কোমল আর ফেরেশতাসুলভ শান্ত-সৌম্য চেহারা। সর্বদা চোখ দিয়ে জল গড়ায় বলে দৃষ্টিটাও ভেজা ভেজা, যা খর হওয়া এক সেকেন্ডের মামলা যদিও। বিশেষত স্বপ্নটা শোনামাত্র তড়পানি জুড়ে দেবেন নির্ঘাৎ। কাজের মেয়েকে তুরন্ত পাঠাবেন রাস্তা থেকে ফকির-মিসকিন ধরে এনে হাত-পা ধুইয়ে তোয়াজ করে খেতে বসাতে, যা সায়মা খাতুনের আমল থেকে সাবিনা দেখে আসছে। খোয়াবে মৃত মুরবিব দেখলে এটাই নাকি দস্ত্তর।

কেন?

সাবিনার প্রশ্নে চটে যেতেন নীহার বানু। সরাসরি জবাব দিতেন না। দিনের শেষে কাছে ডেকে ইউসুফ নবীর গল্প শোনাতেন, যার স্বপ্ন ব্যাখ্যার অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। তখন হয়তো নীহার বানু বাগানের পরিচর্যা করতেন বা আঙুলে ত্যানা জড়িয়ে হারিকেনের চিমনি সাফ করতেন – সাবিনার মনে নাই। পয়গম্বর ইউসুফের আদি স্বপ্নটা, যা ফাঁস হয়ে গেলে ভাইয়েরা দুশমনে পরিণত হয়, তা এখনো স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে : আকাশের জ্বলন্ত চাঁদ আর এগারোটি তারা, বালক ইউসুফকে মাথা নুইয়ে সিজদা করছে। নীহার বানু বলতেন, আল্লাহর নবীদের জন্য এসব কি অসম্ভব? দিলে ইমান আনো। বহু বছর পর সত্যিকারে তা ফলেছিল। তার আগে ইউসুফ নবীর স্বপ্ন তাবিরের ফলে দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা পায় মিশর। নিজেও ফেরাউনের কয়েদখানা থেকে ছাড়া পান। দুর্ভিক্ষের পরেই সম্ভবত রাজসিংহাসনেও বসেন।

তাছাড়া সোলেমানি খাবনামা একসময় ওদের ঘরের কুলঙ্গিতে ভাঙা আতরদান বা আধপোড়া আগরবাতির কাঠির সঙ্গে পড়ে থাকতে দেখেছে সাবিনা। কেউ কি পড়ত? নীহার বানু যে নয়, সে নিশ্চিত। তাঁর আগ্রহ হয়তো সেদিকে গড়ায়নি। সাবিনাও এখন দুপুরের স্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনতে চায় না। ও চায় – স্বপ্নের সুবাদে অতীতের ঘটনাগুলো ভালো করে চোখের সামনে মেলে ধরতে। মোয়াজ্জেম হক নিখোঁজ, তাঁর বাবা-মা খবরের কাগজ পড়তে পারেন না, রেডিও কেনারও সামর্থ্য নাই। বর্মার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তখন আসলে কী ঘটেছিল এ বাড়িতে? প্রায় সত্তর বছর আগে?

সাবিনা হাত ধরে নীহার বানুকে চেয়ারে বসায়। নিজে বেতের মোড়া টেনে কোল ঘেঁষে বসে। তারপর ছোটবেলায় কলম হারিয়ে বা বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে যেমন করে ডাকত, তেমনি মায়ের গলা জড়িয়ে আদুরে গলায় ডাকে – আম্মাজান!

‘সইর‌্যা বয়!’ কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে মেয়ের চোখে চোখ রাখেন নীহার বানু। ‘কী অইছে তোর? আবার গ-গোল করছস জামাইয়ের লগে!’

‘গ-গোল তো সব সময়। এই নিয়া আর ভাবি না, আম্মা। অযথা সময় নষ্ট!’

‘ভালোই বুঝদার হইছো!’ বলে নীহার বানু বাইরে তাকান। তাঁর ছানি-কাটা চোখের দৃষ্টি উঠানের কোণের গন্ধরাজ গাছে, যার ফুল-কুঁড়িসমেত লম্বা ডালটা কড়া রোদে নেতিয়ে পড়েছে। ‘দুনিয়া কয় দিনের মাগো!’ আতপ্ত শ্বাস ফেলে মৃদুস্বরে বলেন নীহার বানু –  ‘সবশেষে মানুষের কর্মই আসল।’ কার কর্ম? কী কর্ম? সবাই তো কোনো না কোনো কর্ম করে খাচ্ছে। এ নিয়ে কথা বাড়াতে চায় না সাবিনা। দুম করে বলে বসে – ‘দাদিরে স্বপ্ন দেখলাম একটু আগে। কুপি হাতে আববারে খুঁজতেছে।’

‘খুঁজতাছে!’

‘হু, কুপি ধরে এই ঘর-ওই ঘর…’

‘তোর আববারে নিতে আইছে!’ বলেই হাতের লাঠি ফেলে পা টানতে টানতে স্বামীর ঘরে ছোটেন নীহার বানু। সাবিনা পেছন পেছন বলতে বলতে আসে – ‘এটা মামুলি ব্যাপার, আম্মা। সবকিছু ভুলে যায় বলে আলঝেইমার্সের রোগীরা তো তাই করে। দাদি বেঁচে থাকতে খুঁজত না আববারে, তাঁর শেষ সময়টায়? আববা বর্মা-মালয় না কই কই, বেঁচে আছে না মরে গেছে, চিঠি নাই, তখন তো ফোনেরও কারবার ছিল না – তখনো নিশ্চয়…’

‘স-স’ ঠোঁটে আঙুল চেপে স্বামীর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়েন নীহার বানু। তাঁর জল থইথই চোখে খুশির ঝিলিক। ‘তোমার বাগানে ফুল ফুটছে, বানু! বেহেশতের নেয়ামত।’ মোয়াজ্জেম হক কি খোয়াবে কথা বলছেন? মুখটা বাইরের দিকে ফেরানো। জানালা দিয়ে বাগানটা সত্যি অপূর্ব দেখায়। গ্রিল-আঁচড়ানো বাগানবিলাস আর অপরাজিতার সবুজ লতা, ফুটন্ত বেগুনি-গোলাপি-নীল ফুল – বিকালের মৃদু-মন্দ বাতাসে ধীরে ধীরে দোল খাচ্ছে। নীহার বানুর মনেও যেন তার দোলা লাগে। পরক্ষণে মনে পড়ে, এ তো কাজের মেয়ে শ্যামলার বাগান। ঘরের কাজকাম সেরে বাগানের বেড়া বাঁধাসহ সব এক হাতে করে ওই মেয়ে। যখন নীহার বানু নিজের হাতে ফুলের চারা লাগাতেন, গাছের গোড়ায় সার দিতেন বা মরা ডাল ছাঁটতেন – তখন কথাটা শুনলে কত না খুশি লাগত। নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগা মুখ ফুটে তো বলতে পারত না, এমন মুখচোরা ছিল মানুষটা।

সাবিনা আশা ছাড়ে না। আম্মা খোশমেজাজে আছেন যখন, রাতে ফের দাদির স্বপ্নের কথাটা তুলতে হবে।

 

‘ধুর ধুর। তোর দাদির আবার ছেলের জন্য দুঃখ। মাছের মা-র পুত্র শোক!’ সাবিনা অবাক হয়ে তাকায় মায়ের মুখের দিকে। পান খাওয়া ছেড়েছেন অনেকদিন। তবু কথা বলার ফাঁকে কিছু একটা যেন দাঁতহীন মাড়িতে চিবান। তখন তোবড়ানো গালদুটি ফুলে ফুলে ওঠে। ডাবল খাটে একা আছেনও বেশ। ঘরটা যদিও ছোট, পেস্ট কালারের ডিসটেম্পারের দরুন গুমোট মনে হয় না। দেয়াল থেকে পারিবারিক বাঁধানো ছবি সব নামিয়ে ফেলা হয়েছে, ফেরেশতারা যেন অবলীলায় আসা-যাওয়া করতে পারে। এখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন তো তিনি।

সায়মা খাতুন কি নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিলেন মাছের মায়ের মতো? সাবিনার তো মনে পড়ে না! শোনেও নাই কোনোদিন। শুনেছে –  বাড়ির পরিবেশ ভদ্রলোকের বাসোপযোগী ছিল না, নীহার বানু বউ হয়ে আসেন যখন। চাষাভুষার ঘরবাড়ি যেমন হয় – উঠানে সেদ্ধ ধান, ভেজা খড়, ঘরের পেছনে পাট জাঁক-দেওয়া ডোবার পানিতে মশার রাজত্ব। ভাদ্র-আশ্বিনের গরমে উঠানের বাঁশের আড়ায় যখন পাটের লাছা শুকাতে দেওয়া হতো, এর দুর্গন্ধে প্রায়ই মাথা ধরত নীহার বানুর। দক্ষিণের জানালা খুললে ফলন্ত মরিচগাছ বা লাউ-কুমড়ার মাচা ছাড়া অন্য কিছু নজরে পড়ত না। এ-বাড়িতে ফুলগাছের পরিচর্যা দূরে থাক, রোপণের কথাও কেউ ভাবে নাই কোনো দিন। বই পড়া কি গান শোনারও চল ছিল না।    (চলবে)