স্মৃতির ছায়াপাত

শাহীন আখতার

 

\ ৬ \

 

নোটবই ১

সুলেখা কালি, ঝরনা কলম। জন্মমৃত্যু-বৃত্তান্ত, কিছু প্রচলিত নীতিকথা, প্রবাদ-প্রবচন, উপদেশ, আর কিছু অলিখিত পাতা – সবই বিবর্ণ। জায়গায়-জায়গায় কালি লেপ্টে গেছে। হরফগুলি পড়া যায় না।

বাংলায় অনার্স বলে কথা, সময়টাও কলিকাল। বন্দনাগীতের স্থলে মামি হাসনা বেগম নোটবইয়ের দুর্দশা বর্ণনা করে এর অনুলিপি শুরু করেছেন।

কিন্তু কার জন্মমৃত্যু-বৃত্তান্ত? প্রচলিত নীতিকথা, প্রবাদ-প্রবচনগুলি কী? উপদেশ কার উদ্দেশে? সুলেখা কালির ঝরনা কলমে কে লিখেছে – হাসনা বেগম, না মোয়াজ্জেম হক?

রাত বাড়ে। উত্তর মেলে না। ভাষাটা এমন সাংকেতিক যখন, অনার্সে নিশ্চয় হাসনা বেগমের পাঠ্য ছিল চর্যাগীতি – প্রাচীন বৌদ্ধযোগীদের সান্ধ্য বা মরমি ভাষায় রচিত গীত। ‘যেখানে কায়া, বাক্য, চিত্ত প্রবেশাধিকার পায় না তাকে কীভাবে সহজ বলবে, বলো?’ তবু চর্যার কবিদের গীত সাবিনার পক্ষে কিছুদূর বোঝা সম্ভব – ‘আলিকালি ঘণ্টা নেউর চরণে। রবিশশি কু-ল কিঊ আভরণে।’

কিন্তু বন্দনাগীতের স্থলে নোটবইয়ের দুর্দশা বয়ান বেহুদা প্রলাপ নয় কী?

সাবিনা হারিকেনের সলতে উসকে দেয়। সন্ধ্যা থেকেই লোডশেডিং। ও কুমিল্লা শহর থেকে ফিরে বাড়ির গেটের বোগেনভেলিয়ার ঝাড়ের নিচে ভূতের মতো দাঁড়িয়েছিল। মোবাইলে চার্জ নেই যে ফোন করে গেট খুলতে বলবে। লোহার ভারী পাল্লায় আঙুলের টুকটুক শব্দ মাঝখানের উঠান পেরিয়ে ঘর পর্যন্ত পৌঁছায় না। মামার বাসা থেকে ফোনে ‘আসছি’ বললেও নীহার বানু ওর বাড়ি ফেরার আশা মনে হয় ছেড়ে দিয়েছেন। নিজের পেটের মেয়েকে এতটা অবিশ্বাস! ও রেগে গিয়ে গেটে ধামধাম শব্দ করে খানিক। শ্যামলা টর্চ টিপে উঠানের কোণের হাঁস-মুরগির খোঁয়াড়ের দিকে চলে যায়। এ শেষ চান্স। সাবিনার ফের গেট পেটানোর শব্দে উঠানের কোণ থেকে ছুটে আসে শ্যামলা। ‘ও মা, ছোড আফায়!’ কোমরের চাবির গোছা বের করে, গেটের তালা খুলতে খুলতে বলে, ‘আমি বলি, খোয়াড়ে দাফাদাফি, বেজিতে বুঝি মুর্গা ধরছে!’

সাবিনা কথা বলে না। শাঁ করে বাড়িতে ঢোকে। ওর অবস্থা বেজিতে ধরা মুরগির মতোই। ঠাসাঠাসি ভিড়ের লোকাল বাসে ও ভর্তা হয়ে এসেছে। কুমিল্লা-ঢাকার পুরো ভাড়া সেধেও ডাইরেক্ট বাসের টিকিট মেলেনি। অগত্যা লজঝড়ে মুড়ির টিন। তাও ঘাটে-অঘাটে যাত্রী তোলা-নামা করে বিশ কিলোমিটার পথ আসতে দুই-আড়াই ঘণ্টা লাগিয়েছে। এভাবে যাতায়াত করে মানুষ! ঢাকা যাও, তার জন্য সুব্যবস্থা যদি ট্যাঁকে কড়ি থাকে।

সাবিনা দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতে দেয়ালঘড়িতে রাত পৌনে এগারোটা। নীহার বানু কামরা থেকে উঁকি দিয়েই কপাট ভেজিয়ে দেন। যা রাগ ঝাড়ার আগামীকাল হবে। সঙ্গে ছেলেমেয়ের স্বার্থপরতার লম্বা ফিরিসিন্ত। গত কদিন ধরে নিয়ম করে দুবেলা বকে যাচ্ছেন – তিনি কি সন্তান পেটে ধরা, রক্ত পানি করে বড় করার সময় হিসাব-কিতাব করেছেন? বয়স দুই পর্যন্ত একেকটা জোঁকের মতো গায়ে লেপ্টে থাকত। সকালের নাশতা দুপুরে খেয়েছেন। কোলে নিয়ে হয়তো পিঁড়ি পেতে খেতে বসেছেন, ভাতের থালায় হিসি করে দিল। এসব মনে নেই সাবিনার। ওর শুধু মনে আছে – আম্মা পায়ে তুলে দোলাতে-দোলাতে ঘুম পাড়াতেন যখন, তখনো তাঁর মুখের ওপর বই ধরা থাকত। একবার থাবা মেরে বই ফেলে দিয়ে ও আম্মার হাতে চটকানা খেয়েছে।

হুম, সন্তানেরা অমনই। মায়ের স্যাক্রিফাইস ভুলে গিয়ে নিজের মার খাওয়ার কথাই মনে রাখে।

সাবিনা টেবিলের ঢাকা দেওয়া খাবারের দিকে ফিরেও তাকায় না। তিতু মামার বাসায় খেয়ে এসেছে – ঘোষণা দিয়ে হারিকেন হাতে দোতলায় উঠে যায়। হুমড়ি খেয়ে পড়ে নোটবইয়ের ওপর।

তখন পর্যন্ত মোয়াজ্জেম হকের যা লেখালেখি পরীক্ষার খাতায়। বিজ্ঞানের ছাত্র বলে বর্ণনায় বাহুল্য নেই, একেবারে নির্জলা সারসংক্ষেপ। ভাষাটাও জায়গায়-জায়গায় দুর্বোধ্য। যেন টেলিগ্রাফিক কোড, সেই রকমই বিমূর্ত প্রায়। সুভাষচন্দ্র বসুর চ্যালার মনে ডরভয় না থাক, ধরা পড়ার আশঙ্কা তো ছিলই। সেক্ষেত্রে প্রথম সমুদ্রদর্শনের অবাক করা সবুজ-নীল জলরাশি, উত্তাল তরঙ্গের কথা তো লেখাই যায়। আর গাঙচিলের নির্দোষ ওড়াউড়ি। প্রথম রাতে সমুদ্রপীড়ায় আক্রান্ত হলে মা সায়মা খাতুনের কথা মনে পড়েছে খুব। কোথায় যত্নআত্তি-ওষুধপথ্য, নিজের বমি থেকে উঠে অন্যের বমি সাফ করতে খালাসিদের সঙ্গে হাত লাগাও। নোনাজলে চিড়া ভিজিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি। স্পষ্টতই বোঝা যায় – সারেঙের হেলপারের কাজে তাঁদের জাহাজ ভাড়াটা মওকুফ হলেও খাবার যার-যার, শয্যা জাহাজের খোল বা উন্মুক্ত ডেকে। পরদিন সমুদ্রপীড়া কেটে যেতে ডেকে দাঁড়িয়ে আকাশের তারা গুনছিলেন – আদমসুরত-সপ্তর্ষি, তখনই সুসংবাদটা আসে। শেষের দুদিন কেবিনে থাকতে পারাটা মিরাকল, ডাক্তারবাবুর মহানুভবতা – মোয়াজ্জেম হক লিখেছেন। সাবিনা ভাবে – স্মার্ট ছেলে নিরোই হয়তো ভজিয়েছিল জাহাজের ডাক্তারবাবুটিকে, সে তাঁর আত্মীয় বা চেনা কেউ, যা কথায় কথায় প্রকাশ হয়ে পড়ে। তাতে খাবারের কষ্টটাও ঘোচে। হয়তো নোটবইয়ে লেখার মওকাও মেলে। তখন দুই বন্ধুতে দুই বার্থের একটা চলনসই কেবিন শেয়ার করছিলেন। সাবিনা কল্পনা করে – নিরো বাড়িতে চিঠি লিখতে বসেছে। ডেক থেকে ঘুরে এসে মোয়াজ্জেম হকের ইচ্ছা হল কিছু লিখবার। তাঁর তো বাড়িতে চিঠি পাঠানোর উপায় নেই। বাবা-মা দুজনেই নিরক্ষর। অন্যকে দিয়ে চিঠি পড়াতে গেলে খবরটা জানাজানি হয়ে যাবে। মোয়াজ্জেম হকের মন্ত্রগুপ্তির তালিম না থাকলেও, ব্রিটিশ ভারতের নাগরিকমাত্রই তখন জানে, এর ফলাফল কত মারান্তক।

বাবার পক্ষে সাফাই গাইতে পেরে সাবিনার বেশ হালকা বোধ হয়। যেন মোয়াজ্জেম হকের বাড়িতে চিঠি না-লেখার অপবাদ বংশপরম্পরায় ওর ঘাড়ে বর্তায়।

রেঙ্গুনে পৌঁছে রমরমা অবস্থা। আজ এ-বাড়িতে নেমন্তন্ন তো কাল ও-বাড়িতে। এটুকু লিখে মোয়াজ্জেম হকের কলম বন্ধ। যারা দাওয়াত খাওয়াচ্ছে বা বাড়িতে থাকতে দিচ্ছে – নাম-পরিচয়-ঠিকানা লিখে তাঁদের হাতকড়া পরাবার বন্দোবসন্ত করবেন নাকি? নোটবই বাজেয়াপ্ত হওয়ার ভয় তো পদে-পদে। রেঙ্গুনের পথে বেরোলে পরিব্রাজক মাত্রই চোখে অন্ধকার দেখবেন – উজানি কইয়ের মতো নানা বয়সের ঝাঁকে-ঝাঁকে মেয়েমানুষ। এর কারণ জানতে চাইলে মোয়াজ্জেম হকের সঙ্গীর জবাব – দেবা না জানমিন্ত। তারপর বিশ ঘণ্টা ট্রেন জার্নি করে মান্দালয়। ট্রেনভাড়া ভূতে জোগালেও, সাবিনা ভাবে, মান্দালয় যাওয়াটা শুধু-শুধু বেড়াতে নয় নিশ্চয়। ভান পরিব্রাজকের যদিও। বর্মার প্রাচীন ঐতিহ্যম–ত শহর মান্দালয়। তাছাড়া ব্রিটিশদের লুটে নেওয়া বর্মার শেষ স্বাধীন রাজার প্রাসাদ দেখতে তখনো হয়তো লোকে ভিড় করত। মাত্র তো ১৮৮৫ সালে রাজা থেবোকে হটিয়ে বর্মার দখল নিয়েছে ব্রিটিশরাজ। প্রাসাদ-সংলগ্ন দুর্গের যে-অংশটা জেলখানা, যেখানে নেতাজি ১৯২৪-২৭ আটক ছিলেন, এ তো তাঁদের তীর্থক্ষেত্র। যদিও প্রাসাদ-কেল্লাঘেরা পরিখার ফুটন্ত পদ্ম, শালুক আর অদূরের আরাকান প্যাগোডার বর্ণনা ছাড়া এ-ব্যাপারে নোটবই নীরব। ততদিনে দু-বন্ধুর জানা হয়ে গেছে, সুভাষ বসু জার্মানিতে। জিন্দেগিতে তাঁর দর্শন মেলে কিনা সন্দেহ। নেতা যে পথের দাবী পড়ে মান্দালয় জেল থেকে শরৎবাবুকে পত্র দিয়েছিলেন, তা স্মরণ করেই হয়তো ফিরতি পথে পথের দাবী থেকে পড়ে শোনায় মোয়াজ্জেম হকের সঙ্গীটি। বিশ ঘণ্টার লম্বা জার্নি। মোয়াজ্জেম হক বইটা টেনে নিয়ে পড়তে শুরু করেন। এই প্রথম তাঁর আধুনিক কোনো উপন্যাস পড়া। কারবালার কাহিনি, আবু হানিফা ও জয়গুন বিবির পুঁথি পাশের বাড়ির এক চাচা উঠানে মশাল জ্বেলে পড়তে বসতেন। সে-আসরে খড়ের গাদায় মশার কামড় খেয়ে শুনতে-শুনতে ঘুমিয়ে পড়তেন বালক মোয়াজ্জেম। তারপর স্বপ্নে দুলদুলের পিঠে চড়া শুধু নয়, হাতে তলোয়ারও উঠে আসত। ঘুমন্ত অবস্থায় ঢিশিম-ঢিশিম লড়াই, আর যাই হোক তরবারিতে নয়। কুস্তাকুসিন্তটা পাড়ার গাট্টাগোট্টা গু-া টাইপের কোনো ছেলের সঙ্গেই হবে, যাকে দূর থেকে আসতে দেখলে চোঁ-চোঁ দৌড়ে সোজা মায়ের কোল। এমনিতে ছেলের সাত বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের সন্তন্যপানে মেহের আলি তিতিবিরক্ত, তারপর এহেন কাপুরুষতা! তিনি তখন চটে গিয়ে ছেলেকে হাতে চুড়ি পরে দরজার চিপায় লুকিয়ে থাকার পরামর্শ দেন। গল্পটা শুনে হেসে ওঠে মোয়াজ্জেম হকের সঙ্গীটি। বলে, লড়াইয়ের জন্য মোটা বা রোগা হওয়া কোনো ব্যাপার নয়, ইচ্ছেটাই আসল। পথের দাবীর নায়ক সব্যসাচী তালপাতার সেপাই বই তো নয়! কিন্তু সাহস-বুদ্ধি আর কৌশলে সু. ব’র কাছাকাছি। (নোটবইয়ে সুভাষচন্দ্র বসুকে সু. ব লেখা হয়েছে)। মোয়াজ্জেম হকের আফসোস যে, সব্যসাচীর দুর্ধর্ষ অ্যাকশনের বর্ণনা খুব কমই আছে উপন্যাসে। খ্রিষ্টান মেয়ে ভারতীর ভবিষ্যতের ব্যাপারে এতটা উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার ছিল, যে-মেয়ে অপূর্বর বিরুদ্ধে আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে?

‘অপূর্ব হালদার! আরে ও তো ছুঁচো। ভীরু তায় স্বার্থপর।’ মোয়াজ্জেম হকের সঙ্গীর সোজাসাপটা মন্তব্য, ‘পুলিশের কাছে ও যে পথের দাবীর গোপন কাজকারবার ফাঁস করে দেবে এ জানা কথা।’ কিন্তু ছুতমার্গী হওয়া সত্ত্বেও ব্রাহ্মণ-ছানাটি কি দেশপ্রেমিক নয়? সে রাজবিদ্বেষী তো অবশ্যই, যে গান্ধীজির দক্ষিণ আফ্রিকার অনুকরণে ফিরিঙ্গির হাতে অপদসন্ত হয়েছে এই রেঙ্গুন শহরেরই রেলস্টেশনে সাহেবদের জন্য নির্দিষ্ট বেঞ্চিতে বসতে গিয়ে!

দেশপ্রেম শুধু রাজবিদ্বেষ দিয়ে মাপা যায় না। তার জন্য অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া চাই। কথাটা সম্ভবত নিরোর। কারণ পরের ছত্রেই মোয়াজ্জেম হকের ভাবনা – তাঁরা কি অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন? আয়নায় দোদুল্যমান ছবি – বাড়ির ভাবনা, বাবা-মার জন্য ভাবনা, যারা আশা করেছিলেন ছেলে ডাক্তার হলে দুঃখ-কষ্ট দূর হবে। ‘সেই ডাক্তারি পড়া ছেড়ে, পরিবার-পরিজন ত্যাগ করে,’ সঙ্গীটি বেশ জোর দিয়ে বলে এবার, ‘প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ তো হওয়া গেছে!’ মোয়াজ্জেম হকও মনে স্বসিন্ত নিয়ে ভাবেন – আর যাই হোক, ওরা তো অপূর্বর মতো বোথা কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে এখানে আসে নাই!

এ-ধরনের ঘোরাঘুরি আর উপন্যাসের চরিত্রের চুলচেরা বিশেস্নষণের আড়ালে নিরো হয়তো স্বদেশি ‘সন্ত্রাসীদের’ গন্ধ শুঁকে বেড়াচ্ছিল। সেলুলার জেল-ফেরত মামার ভূত তখনো তার ঘাড়ে। না হলে ব্যাংককে আসার হেতু কী? এসেই ভারতীয় স্বাধীনতা লিগের আখড়ার হদিস পেল কীভাবে? তাদেরকে মোয়াজ্জেম হক গদর পার্টির লোক বলেই হয়তো ‘গদর’ নামে নোটবইয়ে উল্লেখ করেছেন, যা অনুলিপি করার সময় না-বোঝার কারণে হাসনা বেগম ‘গাদ্দার’ করে দেন। প্রথম দর্শনেই ‘গদর’দের ভালো ঠেকেনি মোয়াজ্জেম হকের, যদিও নিরোর মুখে তাঁদের নিয়ে কখনো মন্দ কিছু শোনেনি। হয়তো দীর্ঘদিন নির্বাসনে থেকে লোকগুলি চোয়াড়ে হয়ে উঠেছে। বাতচিত বেজায় খর, কাউকেই রেয়াত করে না। যখন-তখন আটশো বছরের গোলামির প্রসঙ্গ টেনে কথা বলে, যেন ইংরেজ-খ্রিষ্টান আর অভারতীয়-মুসলমান – এ দুই শাসকবর্গ ওদের কাছে মুড়ি-মুড়কির মতো সমান। ইংরেজরা তো দুশো বছর ধরে দুহাতে লুটেপুটে দেশটাকে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলেছে। অন্যদিকে ছয়শো বছরে এদেশ থেকে এক দানাও কি সরিয়েছে মুসলমান শাসকেরা? এখানে থাকতে-থাকতে এখানকার জল-হাওয়ায় মিশে গেছে একদিন।

বিগত দিনের এ-বিপস্নবীদের ব্যাপারে আগ্রহ ছিল না মোয়াজ্জেম হকের। তিনি হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন, মুসলমান হিসেবে তাতে নিজের অতীতের যোগসূত্র আবিষ্কার করে। সেইভাবেই দেখানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল, হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র এ-ভারতভূমি। এ-প্রসঙ্গে নোটবইয়ে সু. বর উল্লেখ শুধু – তিনি কোনোভাবেই ‘গদর’দের মতো নন। এটা শুধুই বিশ্বাস – নেতার প্রতি এক ভক্তের, যে সর্বস্ব ত্যাগ করে বিদেশবিভুঁইয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। তাতে নিজের জাতের লোকেরও সায় নেই। কথাগুলো ‘গদর’দের সভায় উচ্চারণের হিম্মত না থাকলেও আড়ালে-আবডালে সঙ্গীকে বলেন। সে ছাড়া এখানে তাঁর মিতা কে? সেই মিতাও যদি ‘গদর’দের দলে ভিড়ে যায় বাকি থাকে কী? নিজেকে তাই গালিম-পরিবেষ্টিত মনে হয় মোয়াজ্জেম হকের, যদিও তাঁরা তাঁকে নমশূদ্র থেকে ধর্মান্তরিত মুসলিম বই বিগত মুসলমান শাসকের প্রতিনিধি ভাবছে না।

তারপর দীর্ঘদিনের বিরতি। তখন হয়তো ব্যাংকক ছেড়ে মালয়ের কোটা বাহারুর পথে জাপানিদের অনুগামী হয়েছেন। পরের পাতায় দিন-তারিখ উল্লেখ নেই। খুব সম্ভব সিঙ্গাপুরের পতন ঘটেছে আগের দিন। ‘নীরব হইল রণকোলাহল, নীরব সমরবাদ্য’ – নিরোর কণ্ঠে রবিঠাকুরের কবিতা। কিছু মালয় প্রবাসী ভারতীয়র সঙ্গে হৃষ্টচিত্তে পথ চলছেন। গন্তব্য ফারের পার্ক। ওখানে জাপানিদের কাছে ব্রিটিশপক্ষের ফৌজের আন্তসমর্পণ। পথের দুধারের দৃশ্যাবলি মোটেও সুখকর নয়। রাস্তায়, আশপাশের নালায়, খানাখন্দে মৃতদেহ অগুনতি। গত কদিন সিঙ্গাপুরের আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো বম্বিং হয়েছে। ঘরবাড়ি বিশেষ অক্ষত নেই। যে-কখানা আছে, জানালায় শার্সি নেই। তাই ভাঙা কাচ এড়িয়ে সতর্কভাবে পথ চলতে হচ্ছিল। তার মধ্যে নজরে পড়ে – ইউনিয়ন জ্যাকের বদলে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় উড়ছে সূর্যমার্কা জাপানি পতাকা হিনোমারু।

ফারের পার্কে আন্তসমপর্ণের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। দূর থেকে মেজর মোহন সিংকে দেখে মোয়াজ্জেম হকের ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। পথের দাবীর সব্যসাচীর মতো রোগা-পটকা, গালভাঙা, তেরিয়া আদমি। গলায় জোর যেমন, কথার ধারও তেমনি। নিমেষে গায়ের রক্ত গরম হয়ে ওঠে। সদ্য পায়ের কাছে অস্ত্র নামিয়ে রাখা ব্রিটিশ ভারতীয় ফৌজদের দারুণ মাতিয়ে দিয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে তৈরি হতে যাচ্ছে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি – আইএনএ। ‘সব স্বপ্নের মতো। হাজার হাজার টুপি উড়ছে বাতাসে। সঙ্গে গগনবিদারী সেস্নাগান।’ পরমুহূর্তে মোয়াজ্জেম হকের মনে শঙ্কা – ‘এত অল্পেতে কেল্লাফতে! সব কিছু সহিসালামতে চলবে তো?’

সঙ্গে ভারতীয় স্বাধীনতা লিগের পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও জাপানিদের জেরা ‘গানজি’? ‘ইন্ডো’? মোয়াজ্জেম হক গান্ধীর দেশের লোক ঠিক আছে, কিন্তু ইন্ডো শুধালেও মাথা নেড়ে সায় দিতে হয় বলে মনে-মনে তওবা কাটেন। আগে তো গর্দান বাঁচুক! যেভাবে মাথা কাটা পড়ছে লোকের! তার মধ্যেও মালয়ীরা নির্বিকার। এ অশান্ত পরিবেশে তাঁদের আন্তভোলা, আরামপ্রিয় আর আধা-ঘুমন্ত স্বভাবটা অবাক করে দেয় মোয়াজ্জেম হককে। তুলনায় চীনারা একেকটা বিচ্ছু। যুদ্ধের বাজারে জিনিসপত্রের দাম চড়িয়ে মুনাফা লুটছে। যদিও জাপানিদের তোপের মুখে রয়েছে সর্বদা।

যুদ্ধের ক্ষত ধীরে-ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। বোমাবিধসন্ত ঘরবাড়ি নিপাট করে ফেলেছে, নয়তো মেরামত করা হয়েছে। নাচগানের আসর জমেছে কোথাও-কোথাও। তার মধ্যে রংগিং বলে এক প্রকার মালয়ী নাচের বাজার গরম, যদিও নাচার সময় নারী-পুরুষ কেউ কারো দেহ স্পর্শ করে না। তাই নাচটা মোয়াজ্জেম হকের দেখার উপযোগী আর নির্দোষ মনে হয়। সে-সময় তিনি একবার ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। ভাগ্য ভালো জাপানিদের জাভা জয়ের পর কুইনিনের অভাব দূর হয়েছে। জাভার তামাকও আসতে শুরু করেছে স্রোতের মতো। এখন সিগারেট রোল করার কাগজ কিনলেই চলে যায়।

তারপর মনে হচ্ছে, ভারতীয় স্বাধীনতা লিগ-পরিচালিত বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবকদের কোনো অস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, যেখানে রাইফেল ধরা শেখাচ্ছে, স্টেনগান লোড করার তালিম দিচ্ছে। তখন সম্ভবত, রাবার-বাগানের শ্রমিকদের সঙ্গে একই তাঁবুতে থেকে ট্রেনিং নিচ্ছিলেন মোয়াজ্জেম হক। কাজ চালাবার মতো হিন্দি-উর্দু জানা থাকলেও তামিল বিলকুল নেহি আতা। প্যারেড করে তাম্বুতে ফিরে কথা বলার তাই লোকের অভাব। কম্বলের ভাঁজে উপুড় হয়ে শুয়ে নোটবইয়ে লিখছেন – ‘যুদ্ধক্ষেত্রে জান বাঁচাবার জন্য সশস্ত্র ট্রেনিংয়ের বিকল্প নাই, তা মেডিক্যাল কোরের সদস্য হলেও। দেড় বছরে চিকিৎসাশাস্ত্রের কতটুকুই বা রপ্ত হয়েছে?’

মন ভালো নেই। এ বিশৃঙ্খলার শেষ কোথায়? জাপানি বা ভারতীয় – কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। মোহন সিং গ্রেফতার। সুমাত্রায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুই কুল রক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছেন বৃদ্ধ বিপস্নবী, ভারতীয় স্বাধীনতা লিগের নেতা রাসবিহারী বসু। দীর্ঘদিন জাপানে নির্বাসিত এ-নেতাকে কেউ-কেউ শতভাগ জাপানবান্ধব ভাবেন। ‘তাঁর নেতৃত্বে ভারতের স্বাধীনতা আসবে তো?’ ভারতীয় স্বাধীনতা লিগের নব্য সভ্য, টগবগে তরুণদের মনে প্রশ্ন। একই কথা মোহন সিংহের বেলায়ও শোনা গেছে, বিশেষত ছিদ্রান্বেষী বাঙালিদের আড্ডাগুলোতে। মোয়াজ্জেম হকের বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে। খাওয়ার কষ্ট। শোয়ার কষ্ট। সেই দুঃখ অবশ্য ভুলে যেতে হয় ভারতীয় সৈন্যদের ক্যাম্পগুলোর দিকে তাকালে। ওরা না-বন্দি, না-মুক্তমানুষ। যখন-তখন ফেটিগের জন্য তুলে নিয়ে যাচ্ছে। শুরুতে ছিল রাস্তা সাফ করা, নালা-নর্দমা থেকে পচা-গলা মৃতদেহ সরানো, অ্যারোড্রাম তৈরি। তারপর শুরু হলো পাথর ভেঙে রাস্তা বানানো। সমুদ্রতীরে বিশাল বিজয়সন্তম্ভ নির্মাণ। ‘গানজি’র দেশের বলে রেয়াত করছে না। ব্যাংকক থেকে মৌলমিন যে থাই-বর্মা দীর্ঘ রেললাইন পাতা হচ্ছে, তাতেও বেগার খাটতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ভারতীয় বন্দি সেনাদের। ক্যাম্পে-ক্যাম্পে অপুষ্টি ও অনাহারজনিত আমাশয়, স্কার্ভি, বেরিবেরি রোগের প্রার্দুভাব। খাদ্য নাই, ওষুধ নাই। শোনা যায়, পোকামাকড়ের মতো সব মরতে শুরু করেছে। ক্যাম্পের বাইরের মুক্তমানুষ মোয়াজ্জেম হক। তার জন্য খোদার দরবারে শোকর জানালেও মনে অশামিন্ত আর চরম হতাশা। কাঁহাতক বসে-বসে অপেক্ষা করা যায়! ‘ওর কি ভাগ্য – শব্দনিরোধক সেলোটেক্সে দেয়াল ঢাকা প্রায়ান্ধকার কক্ষে অসংখ্য যন্ত্রপাতির মাঝখানে বসে থাকে। কানে হেডফোন।’ বাক্যটা লেখা হয়েছে আলবত নিরোর দিকে ইঙ্গিত করে, যে ততদিনে আজাদ হিন্দ সাইনন (সিঙ্গাপুর) বেতারে কাজ জুটিয়ে নিয়েছে।

যার জন্য রাতদিন  প্রতীক্ষা – ডুবোজাহাজে তিন মাসের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ‘এশিয়া কে আফতাব’ হাজির। রাসবিহারী বসু দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন সু. ব’র কাছে। সিঙ্গাপুরের ক্যাথে থিয়েটারের সেই অনুষ্ঠানে যাওয়া হয়নি। পেটের পীড়া সত্ত্বেও মোয়াজ্জেম হকের নোটবই সরব : সবুরে মেওয়া ফলে। কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে। ঘুমন্ত শিয়ালের মুরগি জোটে না। গতস্য শোচনা নাসিন্ত। মানুষ কাজেই বাঁচে, বয়সে নয়। তারুণ্যের সৎগুণ যথা – সততা, দুঃসাহস, গতিময়তা। এগুলোকেই সম্ভবত হাসনা বেগম অনুলিপির শুরুতে প্রচলিত নীতিকথা বা প্রবাদ-প্রবচন বলে উল্লেখ করেছেন।

রেঙ্গুনে ফিরে মোয়াজ্জেম হকের মনে হয়, নিজের বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছেন। কিন্তু এ-শহরের সঙ্গে আগে দেখা শহরটির কোনো মিলই নেই। যুদ্ধবিধ্বসন্ত। ভাঙাচোরা। ট্রেন যাওয়া-আসা করলেও স্টেশন বলে কিছু নেই। পথঘাট ধুলাবালিতে ভর্তি। অভাব। অরাজকতা। মাটিতে কামান না থাকলেও মাথার ওপর ব্রিটিশ নয়তো আমেরিকান বম্বার। আজাদ হিন্দ হাসপাতালে বোমায় আহত রোগীর সংখ্যাই বেশি।

তা সত্ত্বেও এ যেন মিলনমেলা। ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান, জৈন-শিখ – এমন সম্প্রীতি বিরল। পাশাপাশি বসে একই রসুইখানার খাবার খাচ্ছে। একজনের মুখের বিড়ি আরেকজনের ঠোঁটে। বর্মি চুরুট হলে তো কথাই নেই। জহর বকশির কথা মনে পড়ে মোয়াজ্জেম হকের। আর ওর থুথুতে ভেজা ক্যাপস্টেন সিগারেট।

টাকাকড়ি সোনাদানার অভাব নেই আইএনএর। সু. বর ডাকে সর্বস্ব দান করে রাস্তার ফকির হয়ে যাচ্ছে হাজার-হাজার মানুষ। শোনা যায়, তেল চিটচিটে পুরনো পাশবই নেতাজির হাতে তুলে দিয়ে খুশিমনে ঘরে ফিরে গেছে ব্যাংককের ভারতীয় গোয়ালারা। এক কোটি টাকার সয়-সম্পদ আজাদ হিন্দের তহবিলে দান করে বর্মার এক মুসলমান ব্যবসায়ী সেবক-ই-হিন্দ উপাধি পেলে গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে মোয়াজ্জেম হকের। জহর বকশির কথাটা মনে পড়ে – ‘তোমরা মুসলিমরা কী করছ স্বরাজের জন্য? কিছু করছ?’ অথচ সু.বর প্রতিটা বক্তৃতায় হায়দার আলি, টিপু সুলতান, অযোধ্যার বেগম হজরত মহলের আন্তত্যাগের কথা থাকবেই। যদিও হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে সু.বর বক্তব্য – ‘মোগল শাসনামল থেকে হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই হয়ে থাকতে লাগলেন;’ বা ‘ইংরেজ হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ তৈরি করেছে;’ এসবে মোয়াজ্জেম হক উচ্ছ্বাসহীন, নিরাবেগ। কেননা, তাঁর কল্পনা করতেও অসুবিধা হয়, সেই স্বর্ণযুগে বকশিরা কেমন ছিল বা মজুমদারেরা আর মেহের আলির পূর্বপুরুষগণ।

ধর্ম এক হলে কী, মোয়াজ্জেম হক লিখেছেন, কালো টুপির দক্ষিণ ভারতীয় মুসলিমদের সঙ্গে তো বন্ধুত্ব হচ্ছে না! ভাষা না জানা হয়তো বড় বাধা। তা সত্ত্বেও আজাদ হিন্দে মুসলিমদের সংখ্যা বাড়তে দেখলে নিজের নতুন পরিচয়ের বিভ্রাট দূর হয় সাময়িকভাবে। যাদের নিয়ে তিনি গর্বিত হতে পারতেন, নোটবইয়ের কোথাও এম জেড কিয়ানি বা শাহনেওয়াজ খানের মতো আজাদ হিন্দের মুসলিম সেনানায়কদের উল্লেখ নেই। এর কারণ হয়তো তাঁরা পেশায় সৈনিক যখন, হয় এ-পক্ষে নয় ও-পক্ষে লড়াই তো করবেনই। যারা বিপাকে পড়ে এ-বাটে এসেছেন, তাঁদের সঙ্গে মোয়াজ্জেম হকের তুলনা কী। বরং সঙ্গীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটায় নিজেকে তাঁর এতিম-এতিম লাগে। সাবিনার মনে হয় – একই কারণে তিনি হয়তো তখন লক্ষ্যভ্রষ্ট। অগ্নিমন্ত্রের ধারক নিরো দূরে চলে যাওয়ায়, আগুনের উত্তাপটাও সরে গেছে। ‘তোমরা রক্ত দাও, আমি স্বাধীনতা এনে দেব।’ স্কুলের সাজা পাওয়া ছাত্রের মতো নোটবইয়ের পাতা জুড়ে সু. বর সেই বিখ্যাত বাণী। তাতে মনের সায় নেই, অথচ পরীক্ষায় উতরাতে হবে।

কখনো-কখনো রাতের ঘুমভাঙা চোখে একটি ছেঁড়া-ছেঁড়া অনিশ্চিত পথরেখা আবছা অন্ধকারে ভেসে ওঠে। রেঙ্গুন থেকে ট্রেনে প্রোম। প্রোম-টাঙ্গুপের রাস্তায় কি এখনো গরুর গাড়ি চলে? টাঙ্গুপ থেকে সাম্পান যায় আকিয়াবে? আকিয়াব থেকে ভুথিদং-মংডু সাম্পানে আর পায়ে হেঁটে। ফের সাম্পানে বাংলার প্রবেশপথ – উখিয়ার ঘাট। নাফের তীরে ঘন বাবলার বন, নিবিড় নারকেল-সারি। তাতে বাতাসে দোল খায় অগুনতি বাবুইর বাসা, যা হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। অথচ যুদ্ধ বাধার পর দেশে ফেরাটা পুলসেরাত পার হওয়ার মতোই কঠিন।

এ-টানাপড়েনের অবসান ঘটে বাহাদুর শাহ জাফরের মাজারে কুচকাওয়াজ করতে যাবার দিন। সেদিন আজাদ হিন্দে যোগ দেওয়ার যৌক্তিকতাও যেন খুঁজে পান মোয়াজ্জেম হক। গর্বভরে নিজেকে ভাবতে শুরু করেন – আজাদি ফৌজ।

সামান্য এক বরইগাছের নিচে ঢেউটিনে ছাওয়া সম্রাটের মাজার ঘিরে অস্থায়ী স্থাপনা। মোয়াজ্জেম হক টুপিটা কপালে টেনে রয়ে-রয়ে কাঁদছেন। কেন কাঁদছেন, মাজারে কখন ফুলের সন্তবক অর্পিত হলো, সু. ব ভাষণে কী বলছেন – জানেন না। খালি মনে হচ্ছিল – দু-আড়াই বছরের অব্যক্ত কান্না যেন নিজের অজাস্তেই বরফের মতো বুকে চাকা বেঁধে ছিল, দরবেশ-কবি-সম্রাটের অদৃশ্য পরশে বরফের চাকাটা আসেন্ত-আসেন্ত গলে অশ্রম্ন হয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। কোথায় যেন মিল মরহুম সম্রাটের সঙ্গে তাঁর বাবা মেহের আলির। বিষণ্ণ চোখদুটিতে, না দাড়িতে? মেহের আলির ভাঙা গাল, উঁচা কণ্ঠা আর মধ্যিখানে তীক্ষন হাড় বের হওয়া লম্বা নাক আগে থেকেই। এখন মহামন্বন্তরে বেঁচে থাকলেও হয়তো কংকালসার। পরনে ছিন্ন বসন। মহামারিতে আক্রান্ত। মোয়াজ্জেম হকের আরো মনে হয় – মাথার রত্নখচিত তাজ, বুকে দোলা রক্তবর্ণের রুবি আর অশ্রম্ন-ফোঁটার মতো অজস্র মুক্তামালায় শোভিত তসবিরে বাহাদুর শাহ জাফরের বিষাদ ঢাকা পড়ে নাই। তা উৎকীর্ণ হয়ে আছে তাঁর কবরগাত্রে – ‘কিতনা বদনসিব হ্যায় জাফর দাফন কিলিয়ে/ দো গজ জমিন মিল না সাকে কুওয়ে ইয়ার মে।’

মোয়াজ্জেম হক যখন মেহের আলির সঙ্গে শেষ মোগল সম্রাটের চেহারার মিল-গড়মিল খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, ততক্ষণে সু. ব বক্তৃতা শেষ করে এনেছেন, কণ্ঠে বাহাদুর শাহ জাফরের কবিতা – ‘গাজিয়োঁ মে বু রহেগি যব তক ইমান কি/ তব তো লন্ডন তক চলেগি তেগ হিন্দুস্তান কি।’

ব্যারাকে ফিরেও মনটা বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। মনকে শক্ত করার জন্য মোয়াজ্জেম হক যখন ভাবেন, তাঁর আববা বা সম্রাটের দুগর্তির প্রতিশোধ নিতে অচিরেই তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে হবে, তখন হু-হু করে আরো কান্না আসে। তা সত্ত্বেও নোটবইয়ে জাঁক করে লিখছেন – ‘আজ বড় স্মরণীয় দিন!’ কুচকাওয়াজের পর দিলিস্নর কাটরা মহল্লার যে-সেপাইটি মোয়াজ্জেম হকের কাঁধে হাত রেখেছিল, সেদিন ব্যারাকে ফিরে তার দাদাজির কাছে শোনা সিপাহি বিদ্রোহের অনেক গল্প বলে। দিলিস্নর খুনি দরওয়াজায় গাছে লটকানো আঠারো মোগল-শাহজাদার লাশ। শহরের কুকুরদের অবিরাম ছোটাছুটি। ধ্বংসসত্মূপ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। বাতাসে কান্নার শব্দ। বারুদের গন্ধ। দিলিস্ন বিরান হয়ে গিয়েছিল। লোকজন হয় মৃত, না হয় বিতারিত। যারা বেঁচেছিলেন জানাজা পড়েই তাঁদের দিন কাবার হচ্ছিল।

যোধপুরী চোগা আর বুশ শার্টে রানি ঝাঁসি বাহিনীর মেয়েদের মার্চ করে যেতে দেখে, মোয়াজ্জেম হকের চোখ ছানাবড়া নয়। মনেও প্রশ্ন নেই। ততদিনে সঙ্গীর ‘দেবা না জানমিন্ত’ জবাবটারও অর্থ হারিয়ে গেছে। বোঝা যায়, পরিস্থিতি তাঁকে বেশ বদলে দিয়েছে। চোখের সামনে অনেক অসম্ভবও সম্ভব হতে দেখছেন। ক্যাম্পের রাজনৈতিক ক্লাসগুলিও নিশ্চয় এ-ব্যাপারে কাজে দিয়েছিল। ‘মেয়েদের আবেগ-সাহস’, মোয়াজ্জেম হক লিখেছেন – ‘প্রেরণা হতে পারে।’ নোটবইয়ে আছে ডা. লক্ষ্মী স্বামীনাথনসহ রানি ঝাঁসি বাহিনীর আরো কিছু মেয়ের নাম, ইম্ফল থেকে ফেরার পর সেই দুঃসময়ে যাদের সঙ্গে আজাদ হিন্দ হাসপাতালে কাজ করার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছিল।

অবশেষে এল সেই দিন। চলো দিলিস্ন। ইউনিফরমের কাঁধে তেরঙ্গা কাপড়ের টুকরায় টিপু সুলতানের লম্ফমান বাঘের প্রতিকৃতি-সংবলিত ব্যাজ। মনে আজাদ হিন্দের আদর্শমন্ত্র – ইতমদ, ইত্তেফাক, কুরবানি। মান্দালয়গামী ট্রেনে ওঠার জন্য পস্ন্যাটফর্মে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। অস্ত্র ছাড়াই পিঠে একমণী বোঝা। তা নিয়ে মুহুর্মুহু সেস্নাগানে ফেটে পড়ছে সবাই – চলো দিলিস্ন। আজাদ হিন্দ জিন্দাবাদ। নেতাজি জিন্দাবাদ। ফৌজি পোশাকের নিচে প্রতিটা শরীর ছুটন্ত অশ্বের মতো টগবগ করছে। রক্ত দেওয়ার জন্য উন্মত্ত একেকজন। তখনই মাথা থেকে জার্মান ফিল্ডক্যাপ নামিয়ে ট্রেনের জানালাপথে সহাস্যে হাত নাড়ে নিরো। মোয়াজ্জেম হকের হাতে তখন তেরঙা পতাকা। যদিও শব্দনিরোধক কামরার বাইরে, যুদ্ধযাত্রার এই ডামাডোলে ওর দেখা পাবেন আশা করেননি, মনে-মনে নিশ্চয় খুশিই হয়েছিলেন। কিন্তু মুসাফা করতে লাইন ভেঙে ছুটে গেলেন না। বন্ধুত্বের খাতিরেই যেন ভিড়ের মধ্য থেকে হাতের পতাকাটা জোরে-জোরে নাড়ালেন শুধু। সু. বর বিদায়কালের ভাষণটা তখনো তাঁর কানে বাজছে, রক্ত-শপথের আড়ালে যা গীতিকবিতার মতো কোমল আর মর্মস্পর্শী – ‘দূরের ওই নদী পেরিয়ে, ওই সব জঙ্গল পার হয়ে, পর্বতমালার ওই পারে আমাদের সেই স্বপ্নের স্বদেশ। যে মাটিতে আমাদের জন্ম, যে মাটিতে আমরা ফিরে চলেছি।… শোনো, স্বদেশ আমাদের ডাকছে… রক্ত রক্তকে ডাকছে…’

মান্দালয়গামী ট্রেনের কামরায় প্রবল উৎসাহে সঙ্গীরা গান ধরেছে – ‘কদম কদম বাঢ়ায়ে যা/ খুশিসে গীত গায়া যা…’

 

সকালে ঘুম ভেঙে সাবিনা বুঝতে পারে না ও কোথায়। সবে একটা যুদ্ধক্ষেত্রে ঝটিকা সফর যেন শেষ করেছে। বা অসমাপ্ত রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। কানের কাছে এখনো আইএনএর সেস্নাগান। হাতের লাঠির আগায় পতপত করে উড়ছে তেরঙা পতাকা – ‘সবচে উচা হে দুনিয়া মে হামারা ঝা-া।’ বা সমবেত কণ্ঠে গেয়ে যাওয়া সেই জাতীয় সংগীত – ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’। এসব কিছুর উত্তরাধিকারী হন নাই মোয়াজ্জেম হক। কুঁচকিতে বুলেটের দাগ নিয়ে দেশভাগের পরের বছর বাড়ি ফিরেছিলেন।

বাতাসে শীত-শীত আমেজ। ভোরের দিকেই হয়তো বৃষ্টিটা হয়েছে। এখনো থেকে-থেকে দমকা বাতাস। সাবিনা নাইটির ওপর পাতলা সুতির শাল জড়িয়ে নিচে আসে।

মোয়াজ্জেম হক আধবোজা দরজা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছেন। দৃষ্টিটা কেমন ফাঁকা-ফাঁকা। চাহনির ধার ক্ষয়ে গেছে বহুদিন। এখন কানে প্রায় শোনেনই না। সাবিনা গলায় মাফলার জড়িয়ে দিলে শিশুর মতো হাসেন একটুখানি। বুক-ছাপানো দাড়ি তো নয়, নূর – তেমন ধবধবে, আলো পিছলে পড়ার মতো মসৃণ। চেয়ারের পেছনে সরে গিয়ে তাতে বিলি কাটে সাবিনা। ওর ভাবতে অসুবিধাই হচ্ছে – ওর আঙুলের ফাঁকে সাবেক আইএনএর নূর, বা এ-লোকটা তার বাবা, যার চোখে চোখ পড়ার ভয়ে ও একসময় পায়ের নখে মাটি খুঁড়ত। কবে তিনি পাকানো গোঁফ চেঁছে লম্বা দাড়ি রাখলেন, ওর মনেই পড়ে না। সাবিনার কল্পনায় – গোঁফ-জোড়াটা অপেক্ষাকৃত ছোট হলেও দাড়ির গোছাটা নেই, যখন মোয়াজ্জেম হক মৃত্যু উপত্যকা ইম্ফলের দিকে মার্চ করে যাচ্ছিলেন।

‘আববা, যুদ্ধের গল্প শুনতে চাই। বলেন না পিস্নজ!’ মোয়াজ্জেম হককে ফের শিশুর মতো হাসতে দেখে সাবিনার মনে হয়, ওর ভুল হয়ে গেছে – আববা ’৭১-এর যুদ্ধের কথা ভেবেছেন। যা কষ্টের, শোকের হলেও বিজয়ের। ও নিজেকে শুধরে নিয়ে আইএনএর কথা জানতে চাইলে মোয়াজ্জেম হকের মুখে এক টুকরো আলো খেলে যায়। দাড়িটা আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

‘হু, জহর নিয়া গেল। কইল – খাটরিতে মাছ নাই, পানি নাই।’ মোয়াজ্জেম হক আড়ষ্ট জিবে জড়িয়ে জড়িয়ে বলে যান – ‘কাদা ঘাঁটাঘাঁটি করে মরবানি মিয়া? চলো চলো! যুদ্ধ করতে রেঙ্গুন যাই! ওরা আমাদের মিয়া কইতো। আমরা কইতাম বাবু।’

‘তারপর?’

‘বর্মা গেলাম। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া – তহন মালয় কইতো দেশটারে। হের পরে নেতাজি কইলেন – দিলিস্ন চলো। চললাম। ফিরলাম কলকাতা। আমার তহন পড়া-পরীক্ষা বাকি।’

বাহ্, এক দমে ১৯৪১-৪৮, সাত বছরের পুরা ইতিহাস! সাবিনা বাবার মুখের ওপর আরো ঝুঁকে পড়ে – ‘নোটবইয়ে কখন লিখতেন, আববা?’

তিনি নিরুত্তর। মনে হয় প্রশ্নটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে।

‘আপনি নোটবই খুলে কলম হাতে নিতেন, নিরো যখন বাড়িতে চিঠি লিখতে বসত?’

‘নিরো নিরো’ – মোয়াজ্জেম হকের ঠোঁটের কোণে ফেনা জমলে সাবিনা ভয় পেয়ে যায়। ‘ব্রেনস্ট্রোকের রোগীকে কষ্টের স্মৃতি মনে করাতে নেই’ – রোখসানার সতর্কবাণী ওর মনে পড়ে। তাতে নাকি মসিন্তষ্কে ফের রক্তক্ষরণ হওয়ার সম্ভাবনা। তার মানে আরেকটা জবরদসন্ত স্ট্রোক! কিন্তু আববা যেহেতু বন্দুকের গুলি খেয়েও অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন, তা গুড মেমোরিও তো হতে পারে! এখন এ-তর্ক কার সঙ্গে করবে ও? রোখসানা কাছে থাকলে কথা ছিল। ভরসাও পেত। ও যদিও নিউরোলজির ডাক্তার নয়। নীহার বানুকে ডাকলে ওকে বকতে বকতে ছুটে আসবেন – ‘তোমার বই লেখার এত গরজ, বুড়া বাপেরে খুন করতে চাও!’ সাবিনা চটজলদি শালের কোনা দিয়ে আববার কশের ফেনাটুকু মুছিয়ে দেয়। নিচুগলায় শ্যামলাকে ডাকে। মোয়াজ্জেম হকের চেহারায় অসম্ভব কষ্টের ছাপ, যেন নিরোর কথা স্মরণে আনতে আকাশ-পাতাল তোলপাড় করতে হচ্ছে। r (চলবে)