স্মৃতির ছায়াপাত

শাহীন আখতার

 

মাঝে মাঝে আমার মনে হতো এসব সুখী মুহূর্তের স্মৃতিচিহ্ন নয়,

আমার আত্মায় বয়ে যাওয়া ঝড়ের স্পর্শময় অমূল্য ধ্বংসাবশেষ।

– ওরহান পামুক

 

সেকেন্ডহ্যান্ড বই

তখনো ট্রেন ছাড়তে মিনিটদশেক দেরি। একশ টাকায় সানগস্নাস কিনে সাবিনা যখন আরো সস্তার জিনিস খুঁজছে, তখন পাশের বুকস্ট্যান্ডের সংকীর্ণ তাকে অনিতা সেনের স্মৃতিকথা নজরে পড়ে। বাদামি মলাটের সাদামাটা ছাপার, ট্রেনে পড়ার উপযোগী একখানা সেকেন্ডহ্যান্ড বই। শ্রীহট্টবাসী নীলিমা দাসের শুভ পরিণয়ে শিলং পুলিশবাজার থেকে শংকরলালের প্রীতি উপহার। সাবিনা পায়ের কাছে ব্যাগ নামিয়ে দ্রুত বইয়ের পাতা ওলটায় – কী নেই নীলিমা দাসের হাতের হলদে ছোপ লাগা জরাজীর্ণ বইটিতে! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, অল ইন্ডিয়া কমিউনিস্ট পার্টি, আগস্ট আন্দোলন, আজাদ হিন্দ ফৌজ, পঞ্চাশের মন্বন্তর, দাঙ্গা, দেশভাগ…

ট্রেন চলতে শুরু করলে সাবিনা কোলের ওপর বই নামিয়ে সানগস্নাস-চোখে বাইরে তাকায়। কাচের নীলচে রং-মেশানো ফাগুন-সকালের বাদামি রোদ্দুর; ছায়া-ছায়া ঘর-গেরস্থালি; পাতা-ঝরানো, ধুলা-ওড়ানো ফিকে নীল বাতাস; ছোট-ছোট পাহাড়গাত্রে ধাপে-ধাপে ওঠা বোতল-সবুজ চায়ের গাছ, পাহাড়ের তলদেশের ঝোপঝাড়, রাশি-রাশি জংলি ফুল – স্বপ্নে দেখা প্রবহমান দৃশ্য যেন। অজানা খুশিতে ওর মনটা দুলে ওঠে। অথচ ঢাকা ফেরাটা সবসময় নিরানন্দের – গতরাতেও সিলেটের হোটেলে ব্যাগ গোছাতে-গোছাতে ভাবছিল সাবিনা। ফিরে গিয়ে সেই তো ঘড়িধরে চলা একঘেয়ে জীবন। রোজ মৌখিক ব্রিফিং নিয়ে রণক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়া যেন। দেশের সমস্যাও অন্তহীন, ওর রিপোর্ট লেখাও চলবে অনন্তকাল। আর বছরে এক-দুবার সিলেটের মতো শহরে উঠতি সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণদান। তখনো চাকরি ছেড়ে বই লেখার প্রস্তাবটা ওর মনে পড়েনি। ব্যাগের চেইন টেনে চিরুনি-হাতে যখন দেয়াল-আয়নার সামনে দাঁড়ায়, তখনো নয়। তখন বন্দরবাজারে কে একজন দাউদের মলমের ক্যানভাস করছিল। ক্যানভাসারের গলাটা নির্ঘাৎ রেকর্ড করে বাজানো হয়েছে। না হয় টানা ঘণ্টাদুই লাগাতার বকবকানি! জানালার শাটার টানতে গিয়ে সুরমা টাওয়ারের নিয়ন সাইনের দিকে তাকিয়ে থাকে সাবিনা। ওর খোলা চুলে নদীর জোলো বাতাসের মাতামাতি। মুখে ঠান্ডা হাওয়ার প্রলেপ। হু, আগামীকাল এ-সময় ঢাকা!

প্রস্তাবিত বইটা আর কিছু নয়, সাবিনার মেজো ভাইয়ের ভাষায় – পরিবারের সোনালি ইতিহাস। ওদের বাবা মোয়াজ্জেম হক, যিনি গল্পের কেন্দ্রে, তিনি ছাত্রাবস্থায় পালিয়ে গিয়ে সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দিয়েছিলেন। এ নিয়ে বড়জোর একখানা মানপত্র লেখা চলে, আস্ত বই কিছুতেই নয়, যেখানে দু-দুবারের ব্রেনস্ট্রোকে গল্পের কথক প্রায় স্মৃতিভ্রংশ। বয়সও নববই ছাড়িয়ে গেছে। সেই নববইপূর্তিতে প্রবাসী অর্থবান ছেলে যদি মনে করে, পরিবারের সোনালি ইতিহাস লেখাটা বাথরুমে রঙিন টাইলস বা গিজার বসানো, ড্রয়িংরুমে ঝাড়বাতি ঝোলানোর মতো – তার ভুল ভাঙাতে যাওয়াটাই অর্থহীন। ‘আমি ভেবে দেখি’, বলে সাবিনা হতাশা গোপন করে আলোচনার ইতি টানে। তারপর চাকরি ছাড়ার কথা রোজ ভাবলেও অনিতা সেনের স্মৃতিকথা হাতে আসার আগে বই লেখার কথা মনে আসেনি।

ট্রেনের জানালায় কনুই চেপে আবেশে চোখ বোজে সাবিনা। বাতাসে থেকে থেকে আমের বউল, লেবু বা শজনে ফুলের ম-ম সুবাস। জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস গন্ধবাহী স্মৃতি চারিয়ে ঝড়ের বেগে এগিয়ে যায়। মোয়াজ্জেম হক সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের দ্বিতীয় বছর শিলচরের ভাতের দোকানে শজনে ফুলের বড়া আর মানকচুর ঘণ্ট দিয়ে আকাঁড়া চালের ভাত খেয়েছিলেন। দুদিনের অনাহারীর মুখে তা-ই ছিল অমৃত। এর প্রায় তিন বছর পর শিলচরের ভাতের দোকানটা মোয়াজ্জেম হকের মনে পড়ে। তখন জাপান রাজকীয় বাহিনীর সঙ্গে আজাদ হিন্দ ফৌজ বর্মা থেকে প্রায় দুশো মাইল মার্চ করে ইম্ফলের উপকণ্ঠে। মোইরাংয়ে তেরঙা পতাকা উড়িয়ে ইম্ফল সেনানিবাস অবরোধ করে রেখেছে। রোজ হামলা-পালটাহামলা চলছে। আকাশ থেকে আমেরিকান বম্বারের মেশিনগানের গুলি সব এদিকে। আর চার্চিল রেশন যথা – বিস্কুট, চকোলেট, খেজুর, কিশমিশ, টিনভর্তি পনিরসহ নানান মুখরোচক খাবার আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে অবরুদ্ধ সেনানিবাসে। তখন আজাদ হিন্দের শিবিরে খাদ্যের বড় অনটন। চালের সঙ্গে লিঙ্গরা বলে একপ্রকার ঘাস সিদ্ধ করে রসদের সাশ্রয় করা হচ্ছিল। একদিন শিলচর কত দূর দেখতে মণিপুরি সহযোদ্ধার সঙ্গে পাহাড়-চূড়ায় ওঠেন মোয়াজ্জেম হক। ‘আর মাত্র নয়টা পাহাড় রেঞ্জের পর’, সহযোদ্ধা বলেন। ‘ওই তো পশ্চিমে!’ যদিও শিলচর ছিল ৯৯ মাইল তফাতে। দিগন্তজোড়া রোদ-ঝলসানো, চোখধাঁধানো, ঢেউখেলানো সবুজ পাহাড়-চূড়ার সমাহার। তবু অত দূর হতে, পাহাড়ের মাথা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে উড়ে এসে শজনে ফুলের গন্ধটা যেন খিদাটা চারিয়ে দিয়েছিল।

ট্রেনের প্রলম্বিত হুইসেল মিলিয়ে যেতে ‘কুলাউড়া স্টেশন’ সাইনটা সাবিনার দৃষ্টিপথে ভেসে ওঠে। জয়ন্তিকা এখন ধীর, শম্বুকগতির। দেশভাগের আগে, সাবিনার বাবা বলেছিলেন –  কুলাউড়া থেকে লাতুর নামের বদলি ট্রেনে শিলচর যাওয়া যেত। শিলচর থেকে হিল সেকশন রেলপথে কুমিল্লা হয়ে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। হিল সেকশন রেললাইনটা পাতা হয়েছিল আসামের চা স্টিমারযোগে চট্টগ্রাম বা চাঁদপুর হয়ে কলকাতা বন্দর পাঠানোর জন্য। সাবিনা উৎফুলস্ন হয়ে ভাবে, কুলাউড়া-শিলচর-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম-সমুদ্রপথে রেঙ্গুন – এভাবেই তো মোয়াজ্জেম হকের সম্ভাব্য যাত্রাপথটা আঁকা যায়! যদি তিনি সত্যিকারে কুলাউড়া-শিলচরের বদলি ট্রেন ধরে থাকেন, তাঁকে কিছুটা সময় এখানে অপেক্ষা করতে হয়েছিল সেদিন।

তখনকার দিনে কুলাউড়া ছিল নামী জংশন – শিলচরের ভাতের দোকানের কথা ফের মনে পড়তে সাবিনা ভাবে – এখানেও খাবার হোটেল থাকার কথা নয় কি! দু-চারজন চেনা লোকও সেই সঙ্গে থাকার কথা। বিশেষত পস্ন্যাটফর্মে। তখন ঘণ্টায়-ঘণ্টায় দূরপাল্লার বাস ছিল না। জনসংখ্যা কম হলেও রেলস্টেশনগুলোতে ভিড়-ভাট্টা লেগেই থাকত। টিকিট পাওয়ার জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করত মানুষ। প্রথম শ্রেণিসহ আরো কিছু কম্পার্টমেন্ট তখন তো সাহেবদের জন্য রিজার্ভ। তাছাড়া শিলচর সিলেট জেলারই অংশ তখন। পাসপোর্ট-ভিসার বালাই নেই, তাই কুলাউড়া-শিলচরের ট্রেনে যাওয়া-আসাও ছিল খুব। সেই শিলচর হয়ে রেঙ্গুনে পাড়ি জমাচ্ছেন মোয়াজ্জেম হক। ঘর পালানো ছেলের মনে তখন কত কিছুতে সন্দেহ, আতঙ্ক! হয়তো ভিড়ের মধ্যে পরিচিত কেউ কাঁধ চেপে ধরল – ‘কলকাতার ক্যাম্পবেলে ডাক্তারি পড়ো না তুমি? এখানে কী করো? চোরের মতো পালায়ে যাও কই?’

পস্ন্যাটফর্ম নিরাপদ নয় ভেবে মোয়াজ্জেম হক নিশ্চয় কুলাউড়ার কোনো এক খাবার হোটেলে ঢুকে পড়েন সেদিন। তখনো ধোঁয়া-ধোঁয়া ঘোলাটে সকাল। দিনের আলো ভালো করে ফোটেনি। সবে চারপাশে জল ছিটিয়ে দরজার মুখের লাকড়ির চুলায় চা চাপানো হয়েছে। ভাত রান্না হতে আরো ঘণ্টাতিনেক বাকি। মোয়াজ্জেম হক এগিয়ে যান হোটেলের পেছনের অন্ধকার কোণের কাঠের বেঞ্চিটার দিকে, যার পাশে গতরাতের এঁটো-কাঁটার বালতি, ক্ষয়া সাবান, থিকথিকে ময়লা পানি, বাঁশের বেড়ায় টাঙানো তরকারির ঝোলমাখা ছেঁড়া গামছা, পাশে কমিউনিস্টদের যুদ্ধবিরোধী সাদা-কালো পোস্টার – এক ভাই এক পাই, নাহি দিব সমরে। তখন টেলিভিশন ছিল না, রেডিওরও আক্রা। তবু কারো জানতে বাকি নেই – সুভাষ বসু কলকাতার এলগিন রোডের পৈতৃক বাড়ি থেকে উধাও। বাঙালির ছেলের এমন বুকের পাটা, বাড়িভর্তি সশস্ত্র পাহারাদারের চোখে ধুলা দিয়ে পালায়! এখন রাজের অবস্থা মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল। পাগলা কুত্তা কী করে – অন্যকে কামড়াতে যায়, নয়তো নিজের ঠ্যাং নিজে কামড়ায়।

মোয়াজ্জেম হকের চোখাচোখি হয় সহযাত্রী বন্ধুটির সঙ্গে। একজন পকেটে হাত রাখলে অন্যজন সবেগে মাথা নাড়েন। সামনে দীর্ঘ পথ – কথাটা মনে রাখতে হবে। কিন্তু কিছু একটা অর্ডার না করে বসে থাকাও যায় না। লোকজন সন্দেহবশত নানা কথা জিজ্ঞেস করবে। শুরুতে ওরা এক কাপ চা ভাগাভাগি করে খান। লাতুর ট্রেনের কয়েকটা বগিতে সিলেটের চা পাতাই শুধু যায়। তা বোঝাই হতে সময় লাগলে অভুক্ত পেটে আরো ক-কাপ চা। সঙ্গে টেনশন রিলিজ করতে ক্যাপস্টেন সিগারেট। এই ব্র্যান্ডের সিগারেটই বয়স ষাট পর্যন্ত মোয়াজ্জেম হককে সঙ্গ দিয়েছে।

সাবিনা জানালা দিয়ে দৃষ্টি প্রসারিত করে। গোটা পস্ন্যাটফর্মে ফেরিঅলাদের ছোটাছুটি, বেচাকিনির ধুম। তার মধ্যে ফালি করা আনারসের কাটতিই সম্ভবত বেশি। সাবিনার পাশের সিটের যাত্রীটিও ট্রেনের জানালার নিচে দাঁড়িয়ে গোগ্রাসে আনারস খাচ্ছে। সিজনের সস্তা ফল, যার গড়ানো রসে শার্টের গোটানো হাতা অবধি মাখামাখি। সেদিন পস্ন্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে এমন মৌজে আনারস
খাওয়ার অবস্থা ছিল না মোয়াজ্জেম হকের। সাবিনা ভাবে – নয়তো চায়ের দামের চেয়ে এ-পড়তায় ভালো পড়ত। চা-পানের অবশ্য আরেকটা কারণও থাকতে পারে। তখন তো খবরের কাগজ খুললেই চা কোম্পানির গদ্য-পদ্যে ‘ড্রিংক মোর টি’র নানা চটকদার বিজ্ঞাপন। তার মধ্যে ‘অশান্তি আর উদ্বেগের গস্নানি চা-ই দূর করে’ যুদ্ধের দিনের লাগসই ট্যাগলাইনটা মনে ধরা অসম্ভব নয় এ দুই উদ্ভ্রান্ত তরুণের, যারা বাবা-মায়ের অজান্তে অচেনা গন্তব্যে পা বাড়িয়েছে।

জয়ন্তিকা হুইসেল বাজিয়ে ধীরলয়ে চলতে শুরু করলে সাবিনা সিট থেকে উঠে পড়ে। আনারসের মহাভোজের পর লোকটা যে সিগারেট ধরাল, ওটা ক্যাপস্টেন না তারা মার্কা – তা না ভাবলেও চলবে। ও টয়লেটের বেসিনে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দেয়। বাতাসে-ওড়া কপালের চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিকঠাক করে যখন কম্পার্টমেন্টে ফেরে, তখন অনিতা সেনের স্মৃতিকথা ঢেঁকুর তুলে পড়তে শুরু করেছে পাশের সিটের সেই লোক। দেখলে মনে হয় ছাপোষা কেরানি হবে হয়তো, বা ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভও হতে পারে। শার্টের ময়লা কলার আর রেক্সিনের ব্রিফকেসে সেরকম মনে হওয়াই স্বাভাবিক। হয়তো কোম্পানির নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ বাজারজাতকরণে শ্রীমঙ্গল বা শায়েস্তাগঞ্জ যাচ্ছে। কোলের ওপর বইটা এমনভাবে মেলে ধরেছে, এর ছেঁড়া পাতা বাতাসে উড়ে গেলেও ক্ষতি নেই, ওষুধের স্যাম্পল, ব্যবহৃত ময়লা টাওয়েল, টুথব্রাশ আর টুকিটাকি জিনিসে ভর্তি ব্রিফকেসটা যেন বহাল তবিয়তে থাকে। সিটে বসে সাবিনা উসখুস করে – কোন বাহানায় ফেরত চাইবে বইটা? তা গরম, না নরম গলায়? নরম গলায় কথা বললে ওকে কাস্টমার ঠাওরে বকবকানি জুড়ে দেবে, ওষুধ বা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির দালালগুলো যেমন হয়। সাবিনা বেহুদা বাতচিত করে অনিতা সেনের স্মৃতিকথার মৌতাতটুকু নষ্ট করতে চায় না। আর গরম গলায় ও অচেনা লোকের সঙ্গে কথা কইবে কেন। লোকটা তো ব্রিফকেসের কোনাটা ওর ঊরুতে ঠেকিয়ে দিয়ে উত্ত্যক্ত করছে না, বই পড়ছে শুধু। রেলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে একের বই বা খবরের কাগজ অন্যের পড়ার হক সবার জন্মগত।

লোকটা কি আনারস খেয়ে হাত ধুয়েছে? নীলিমা দাসের ফেলা হলদে দাগের ওপর তীব্র গন্ধযুক্ত তরল হলুদ আঠালো পরত – সেকেন্ডহ্যান্ড বই বলে গ্রাহ্যই করছে না। সাবিনা নিরুপায় হয়ে লোকটার দিকে পিঠ দিয়ে জানালায় মুখ ঘুরিয়ে বসে। ভাবে, এখানকার শজনেগাছে এত ফুল হয়, এ তো নীলিমা দাসের রোজকার রান্নার বাঁধা আইটেম হওয়ার কথা। সঙ্গে সিলেটের সোবহানীঘাটের গলা-চুলকানো পাহাড়ি ওল। তারপরই আচমকা ওর মনে অতীতের ভাবনাটা সকৌতুকে খেলে যায় – যে বই পড়তে-পড়তে রান্না করে বা রান্না করতে-করতে বই পড়ে, তার রান্নাটা কেমন?

‘অখাদ্য!’ বলে পাতে পানি ঢেলে পাটি ছেড়ে উঠে পড়তেন মোয়াজ্জেম হক। তস্তরির সাজা পান তেকোনা টেবিলে পড়ে-পড়ে শুকাত বা গরমকালে পচে উঠত। নীহার বানু নির্বিকার। পরের বেলায় আধা-কষা তরকারিতে একহাতে ছড়ছড়িয়ে পানি ঢালছেন তো আরেক হাত অব্যর্থভাবে চুলার ধারের জলচৌকির দিকে। যেখানে মসলাপাতির ঝাঁ-ঝাঁ গন্ধমাখা খোলা বই পড়ে রয়েছে। সাবিনার ভাইবোনেরা যখন শাহনামা, বিষাদ সিন্ধু, আনোয়ারা, মেজদি, ঘরে-বাইরে খুঁজত, তখন বলত না যে ফেরদৌসী, মীর মশাররফ হোসেন, নজিবর রহমান, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের বইটা খুঁজছি। বলত, আম্মার বই। হাশমত খালা আর তিতু মামা বলতেন, নীহার বা নীহারবুর বই। এভাবে নীহার বানু হলুদ-মসলায় খোদাই করে তার অখ্যাত নামটা বইয়ের পাতায় জারি রেখেছিলেন। তখন কম বই-ই কিনে পড়া হতো। আশপাশের কয়েক মৌজার তাবত স্কুল-কলেজ বা পলস্নীমঙ্গল লাইব্রেরির বইগুলো যেন হেঁটে ভিড় করত নীহার বানুর দরজায়। আসলে খাল কেটে কুমির আনার মতো মোয়াজ্জেম হকই ছাতা মাথায় বগলে চেপে আনতেন এসব, কে কোন স্কুলের হেডমাস্টার, গ্রন্থাগারিক, দফতরি – এ কিসিমের মানুষজন ধরে-ধরে। ফেরত দেওয়ার সময় তাঁর মুখ কালি। ‘তোমার কা-জ্ঞানের এত অভাব! পাতায় পাতায় হলদির দাগ লাগাইছ। মানুষগুলিরে কী জবাব দিব আমি?’

যে-বইগুলো কখনো ফেরত দিতে হয়নি, তা ছিল জ্যোতি ঠাকুরের বিধবা কন্যা সুরবালার। নীহার বানুর সঙ্গে ওর সেলাইয়ের নকশার কার্বন কপি আর বইয়ের আদান-প্রদান ছিল ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের বছর পর্যন্ত। সাবিনাদের ঘরের মেহগনি কাঠের পালঙ্ক, বাঘের থাবা আকৃতির পায়ার পড়ার টেবিল আর কালো বার্নিশের গোল তেপায়া তখন ঠাকুরদের কাছ থেকে ন্যায্য দরে কেনা হলেও এক বস্তা বই ছিল মাগনা, সুরবালার তরফ থেকে দানসামগ্রীর মতো। তাঁদের দেশত্যাগ সাবিনা স্বচক্ষে দেখেনি। শুনেছে। ওর জন্মের পরের বছর গাঁয়ের জোতদার পরিবার মজুমদারেরা সোনামুড়া চলে যায়, সঙ্গে যায় জ্যোতি ঠাকুরের পুত্র-কন্যারা। ঠাকুরের এক কোমর-বেঁকা ছেলে ছিল। সাবিনার মনে হয়, ওকে পাক খেয়ে-খেয়ে ধুলা উড়িয়ে গাঁয়ের মেঠোপথে হাঁটতে দেখেছে। আর ঠাকুরের ছোট মেয়ে প্রিয়বালা তো একটা ডাঁসা পেয়ারাই উঠানের কোণের গাছ থেকে তখন-তখন ছিঁড়ে ওকে খেতে দিয়েছিল। প্রিয়বালার ফ্রিল দেওয়া কুঁচিদার লম্বা জামার নিচে পায়জামা ছিল না। মোটা মোটা সুঠাম পা। আরেকবার প্রিয়বালাকে দেখেছে পড়ন্ত বেলায় পুকুরের শানের ঘাটে বিড়াল কোলে বসে থাকতে। কুচকুচে কালো বিড়ালের পলকহীন পান্নারঙা চোখ।

‘এ এক ছাড় বানোয়াট!’ নীহার বানু মেকি রাগ দেখিয়ে বলতেন, ‘মেয়েডারে নিয়া আমি আর পারি না। খালি মনগড়া কেচ্ছা… তহন ওর পেয়ারা খাওনের বয়স হইছিল, না দাঁত উঠছিল?’

তারপর তিনি সলজ্জ হাসতেন একটুখানি – ‘সাবা পেডে থাকতে আমি গল্প-উপন্যাস পড়তাম তো খুব! হেইডাই কাল হইছে। খুব সম্ভব আরব্য উপন্যাসটাই খতম দিছিলাম সেই সময়।’

তা তিনি দিতেই পারেন। সাবিনা শুনেছে, ওর আগে আম্মার একটা স্টিলবর্ন বেবি হয়। খুব বিস্নডিং হতো বলে তাঁকে বেডরেস্টে থাকতে হয়েছিল কিছুদিন। মুখটা কাগজের মতো সাদা হয়ে গিয়েছিল। লোকে দেখতে এসে বলত – ‘কালা বউ ধলা অইছে!’ সেই খুশিতে সুস্থ হওয়ার পরও বিছানা আঁকড়ে পড়ে রইলেন। চুলার ধারে গেলে যদি রং ময়লা হয়ে যায়! সঙ্গে নতুন বাহানা – পেটে ফের বাচ্চা আসছে। সাবিনা ভাবে, ও পেটে থাকতে আম্মার নিরক্ত মুখে কবুতরের রক্তবিন্দুর মতো টুকটুকে লাল নাকফুলটা নিশ্চয় খুব ঝলমল করত। বার্মিজ রুবি ছিল তো ওটা। সম্ভবত, বর্মা থেকে আববারই আনা। তখনো ও জানত না যে, আজাদ হিন্দ ফৌজ হেরে গেলে ব্রিটিশদের গুয়ের গামলা টেনে নিয়ে ইরাবতী নদীতে ফেলতে হয়েছে মোয়াজ্জেম হকদের। গায়ে পোকা, চুলে জটা। একবেলা খাবার জুটত – তাও উচ্ছিষ্ট।

সে যা-ই হোক, সাবিনার ছোটবেলায় মজুমদার গোষ্ঠী, সেন, বকশি আর ঠাকুরদের দেশছাড়াটা যেন কলেরা-বসন্ত, ঘূর্ণিঝড় বা ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগপূর্ণ ঘটনা। গাঁয়ের জৌলুসই তাতে নষ্ট হয়ে যায়। লোকজনও থেকে-থেকে বলত – গেরামডা কানা কইরা হ্যারা চইল্যা গেছে। বকশিদের এক ঘর থেকে যাওয়া সত্ত্বেও তাঁদের বাড়িটা মনে হয় কে যেন দুহাতের তালুতে জোরে চাপ দিয়েছে, তাতে ঝুরঝুরিয়ে ভেঙে পড়ছে দালানকোঠা, ইট-সুরকি। এখনো দূর থেকে গাছ-গাছড়ার ফাঁক দিয়ে নজরে পড়ে পাশাপাশি তিনটি সাদা মঠ – পূর্বপুরুষের বাঁধানো সমাধি। ঠাকুরদের বেলায় তারও বালাই নেই। সাবিনার স্মৃতিতে জ্যোতি ঠাকুরের পরিবারবর্গের চলে যাওয়ার স্মারক – সে-সময়ের গাঁয়ের একমাত্র পানীয়জলের মাথাভাঙা চাপকল। সিঁড়িতে ফাটল-ধরা শানের ঘাট, যেখানে কাঁটা গাছ আর সাপের গর্ত ছিল। আর সুরবালার কথা ভাবলে মাথার চুল-চাঁছা, সরু কালো পাড়ের সাদা ধুতির বালবিধবার সর্বজনীন চেহারাটা ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে, যে দেশছাড়ার সময় প্রিয় বইপত্র দান করে গিয়েছিল।

সাবিনা পাশে পড়ে থাকা অনিতা সেনের স্মৃতিকথা চটজলদি হাতে তুলে নেয়। লোকটাকে ঘুমে ঢুলতে দেখে তাজ্জব হয়ে ভাবে, কখন ট্রেনের বোল পালটে গেছে! আগে ছিল লাতুর ট্রেনে মোয়াজ্জেম হকের গন্তব্য – শিলচর-করিমগঞ্জ। আয় ঘুম যায় ঘুম। মধ্যিখানের অনেকগুলো বছর গায়েব। সর্বোপরি ট্রেনের নামও গেছে পালটে। জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস যেন বর্ডারের ধার ঘেঁষে গা ঝাঁকিয়ে গাইতে-গাইতে যাচ্ছে – সোনামুড়া-আগরতলা। আগরতলা-সোনামুড়া। তাই রে না রে না, তাই রে না রে না। আহা মন্নুভাই। সাদা স্যুটের মিশমিশে কালো মানুষটা ছিলেন সাবিনাদের স্কুলের অবৈতনিক নাচের শিক্ষক। পায়ে ঘুঙুর বেঁধে, কোমর দুলিয়ে-দুলিয়ে নাচ শেখাতেন। বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানশেষে ভেগে যান সোনামুড়ার ফাতেমাকে নিয়ে। সাবিনার ক্লাসমেট জোহরার বড় বোন ফাতেমা। যারা মজুমদারদের সঙ্গে জমিজিরাত আর বসতবাড়ি বদলে সোনামুড়া থেকে আসে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরের বছর। সঙ্গে-সঙ্গে খেতাব জোটে রিফিউজি। (সাবিনাদের গাঁয়ে মোহাজের শব্দটার চল ছিল না)। ফাতেমার সবুজ জালির ওড়নাটা হামেশাই নাইলনের বেগুনি জামা পিছলে গড়িয়ে পড়ত। মন্নুভাইয়ের নাচের তালিমের সময় আরো বেশি-বেশি। ‘এরহম বেশরম-বেলাজ, পাহাইড়া-রিফুজি ছাড়া কে অইব!’ কে তখন বলেছিল কথাটা? সে যে কেউ হতে পারে। কষ্ট করে তিন যুগ আগের স্মৃতি হাঁটকানোর দরকার কী। ফাতেমার মতো এমন সুগোল বুক স্কুলের দ্বিতীয় কারো ছিল না। ছিল না এইট ক্লাসে উঠেই জান লবেজান করা শরীর দেখানোর পাঁয়তারা।

আসলেই কি তাই? সাবিনার মনে পড়ে – জোহরার ছোট দাদি খোলা বারান্দায় লম্বা নলের গড়গড়ায় গুড়ুম-গুড়ুম টান দিতেন যখন, তাঁর বুকের কাপড় কোলে নামানো থাকত। ওর সুন্দরী জোয়ান চাচি বারবাড়ির পুকুরঘাটে গোসল করতেন উদাম হয়ে। পুকুরের পানি ছুঁয়ে থাকা গাছের ডাল-পাতাই ছিল আব্রম্ন। সেই অবস্থায় শীত-গ্রীষ্ম সব ঋতুতে হাঁসের মতো ডোবাডুবি করতেন আর পাহাড়ি সুরে গান গাইতেন। ‘সোনামুড়ার জঙ্গলে রেইপড হইছিল তো! হেইত্তন মাতাডা গেছে।’ স্কুলের লেইজার পিরিয়ডে ঘোড়ার মতো ভাজা বুট দাঁতের তলায় ভাঙতে-ভাঙতে সবজান্তা জোহরা বলেছিল কথাটা। গাঁয়ের লোকেরাও জানত। তা বলে চাচিকে রেয়াত করত না। ভাবখানা এমন যে, তা করবার হকদারই ওরা নয়। বলত – তখন মেয়েদের রেইপ হওয়াটা ছিল মামুলি ব্যাপার। ওরা নিমকহারাম ছিল না, তাই জানবাজি রেখে ঠাকুরের ছোট মেয়েকে রক্ষা করেছে। আর এটা তো হিন্দুস্থানের মামলা। তাতে ওদের ভালো-মন্দ হাত ছিল না যখন, এ-গাঁয়ের রীত-রিসালা কী দোষ করেছে? গ্রামে সায়া-ব্লাউজের চল নেই ঠিকই, আধা-নাঙাও থাকে না সচ্ছল ঘরের বউ-ঝিরা। পুকুরঘাটে বাঁশ, সুপারির ডাল নয়তো কলাপাতার বেড়ার আব্রম্ন থাকে। এর ব্যতিক্রম ’৬৬-তে পূর্ব পাকিস্তানে হিজরত করা জোহরাদের পরিবার। সাবিনার বুঝ হওয়ার পর ’৭৩-৭৪ সালেও অবস্থা বিশেষ পালটায়নি।

এর কারণ হয়তো, সাবিনা পরে ভেবেছে, তাঁরা পালটাতে চায়নি বা তেল-জলের মতো আলাদাভাবে থাকতে চেয়েছে। সেই সামর্থ্য তাঁদের ছিল। মজুমদারদের বদলি পরিবার। জোত-জমির অভাব নেই। প্রতিটা পুরুষের একাধিক বউ। সন্তানসন্ততিও তাই অজস্র। জোহরার দাদার কুলপতির মতো আচরণ সহ্য করা ছাড়া গাঁয়ের লোকেরা আর কী করবে। কুৎসা যা করার সব আড়ালে-আবডালেই করত। সে পুরুষমানুষ বশ করতে ও বাড়ির মেয়েদের জাদুটোনার তেলেসমাতি পর্যন্ত।

জোহরাদের বাড়ি থেকে মোয়াজ্জেম হক রোগী দেখে ফিরলে নীহার বানু জেরা করতেন। সওয়াল যত কড়া ভাষায়ই হোক, জবাব হতো অস্পষ্ট, ইশারাময়। কেন? সাবিনা আজো জানে না। হয়তো মোয়াজ্জেম হক মানুষটাই অমন, কৌতূহল উসকে দিয়ে তামাশা দেখতে ভালোবাসেন। ট্রেন লাউয়াছড়ার জঙ্গলে ঢুকলে বড়-বড় গাছে ভালুকের লোমের মতো মস ঝুলতে দেখে সাবিনার মনটা হঠাৎ তিক্ত হয়ে ওঠে। আববা আরাকানের জঙ্গলের হাতিঘাস বা সুন্দরবনের শ্বাসমূলের শানেনজুল গল্পচ্ছলে শিক্ষা দিলেও ছোটবেলায় কখনো তো বলেননি যে, এ-অঞ্চলে অত্যধিক বৃষ্টিপাতের দরুন গাছপালায় রোঁয়া-ওঠা ঘন সবুজ কার্পেটের মতো মস হয়, রংবেরঙের অর্কিড ফোটে! তাঁর কলকাতা থেকে রেঙ্গুন যাওয়ার পথে শিলচরের ভাতের দোকানই বা আসে কোত্থেকে?

রহস্য আরো ঘনীভূত হয়, সেদিনই জয়ন্তিকার লশকরি চালে জেরবার হতে-হতে বছরদুই আগেকার একটি ঘটনা যখন সাবিনার মনে পড়ে। মোয়াজ্জেম হক তখন ব্রেনস্ট্রোকে পিজি হাসপাতালে। শরীরের বাঁপাশ সম্পূর্ণ অবশ। তবু বেডপ্যান ব্যবহার করবেন না। জোর করে বাথরুমে যেতে চাইতেন। ডানা ভাঙা পাখির মতো বিছানা থেকে গড়িয়েও পড়তেন সঙ্গে-সঙ্গে। তখন ধারেকাছে আয়া না থাকলে একা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ত। একদিন হাসপাতালের কেবিনে শুধু নীহার বানু আর সাবিনা। ধরাধরি করে বিছানায় তোলার সময় মোয়াজ্জেম হকের ঠোঁট কাঁপছিল। মাথার নিচে বালিশ গুঁজে দিতে ‘নিরো-নিরো’ বলে কপাল চাপড়ালেন কেন তিনি? নীহার বানু জানেন কিছু? সাবিনার ছয় বছরের বড় বোন রোখসানাও জানতে পারে। ও পেটের সন্তান হলে কি, নীহার বানুর সখীর মর্যাদায় বড় হয়েছে। তাছাড়া আববার কুঁচকির কাছাকাছি কালোজামের মতো যে বুলেটের দাগটা, এর হদিস রোখসানাই ওকে দিয়েছিল। যদিও তখনো ও ডাক্তার হয়নি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী মাত্র। সাবিনা পড়ে মফস্বলের স্কুলে ক্লাস এইটে। হাসপাতালে নীহার বানুর কটমটে চেহারার দিকে তাকিয়ে সাবিনা অবাক হয়ে ভাবে – জোহরাদের বাড়িতে নিরো নামে কেউ ছিল কি, বা অন্য কোথাও, যার জন্য যৌবনকালে আম্মাকে পস্তাতে হয়েছে! ক্যাম্প খাটের নিচে বেডপ্যান ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সাবিনা। প্লাস্টিকের বিনটা ভাঙা অ্যাম্পুল, সিরিঞ্জ, খালি স্যালাইন বোতলে ভরে গেছে। আয়াকে না ডাকলেই নয়। তখন কেবিনের অ্যাটাচড বাথে অজু করতে যাচ্ছিলেন নীহার বানু। ‘আজরাইলের দুয়ারতে ফিরছে মানুষটা! কই আল্লা-খোদার নাম নিব, তা না’ – বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে তিনি গজগজ করেন, ‘নিরো-নিরো – এ কি আলামত!’

 

অনিতা সেনের স্মৃতিকথা

আমার একমাত্র দাদা নিরোদচন্দ্র সেন, যাকে আমরা নিরো বলে ডাকতাম, ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে, মা চিঠিতে জানান – নিরো শিলংয়ের বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেছে। তার আগের বছর ১৯৪০ সালে, দাদা কলকাতার ক্যাম্পবেল মেডিক্যালের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তখন, ২৯ জুন কাগজে একটি ঘোষণা বেরোয় সুভাষ বসুর নামে : বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের স্মৃতিতে ৩ জুলাইকে সিরাজ
উদ-দৌলা দিবস হিসেবে পালন করা হবে। কুখ্যাত হলওয়েল মনুমেন্ট শুধু যে নবাবের স্মৃতিকে কলুষিত করছে তা নয়, প্রায় দেড় শতাধিক বছর ধরে আমাদের দাসত্ব ও অপমানের চিহ্ন হয়ে শহরের মাঝখানে খাড়া আছে। এই মনুমেন্টকে অপসারিত করতে হবে।… ৩ জুলাই এ-অভিযান শুরু হবে।

সেদিন হিন্দু-মুসলিম একাট্টা হয় সুভাষ বসুর এই ডাকে। আচকান-পায়জামা-পাগড়ির ইসলামিয়া কলেজের ছাত্ররা ক্লাস ছেড়ে দলবেঁধে বেরিয়ে আসে। হলওয়েল মনুমেন্ট দূর করো দূর করো – সবার মুখে এক সেস্নাগান, এক দাবি। অন্যথায় আন্দোলন চলছে, চলবে। সুভাষ বসুকে প্রেসিডেন্সি জেলে পুরেও আন্দোলন দাবাতে পারেনি ব্রিটিশরাজ। জেল-জুলুম অগ্রাহ্য করে তাঁর মুক্তির দাবিতে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নামে। পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জে আরো অনেকের সঙ্গে দাদারও মাথা ফাটে সেদিন। বাড়িতে খবরটা জানায়নি দাদা। আমরা পরে শুনেছি – ওর কপালে আর মাথার তালুতে পাঁচ-ছটা স্টিচ পড়েছিল। রাজ মনুমেন্ট সরাতে বাধ্য হলেও বছর শেষে ফাইনাল পরীক্ষায় আর বসা হয়নি দাদার। কারণ হিসেবে আমাকে লেখে – কী হবে পরাধীন দেশে লেখাপড়া করে, ডাক্তার হয়ে? সবকিছুর আগে চাই স্বাধীনতা, তারপর অন্য কিছু। কথাটা আমার খুব মনে ধরে। আমিও তখন একই গোয়ালের গরু। তবে শুধু স্বাধীনতা নয়, আমরা চাইতাম সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদী সমাজ। শিলংয়ের সেন্টমেরিজে আইএ পড়তে-পড়তে আমি কমিউনিস্ট পার্টির কন্টাক্টে আসি সে-বছরই। মা-বাবা জানতেন সেটা। কিন্তু দাদা পরীক্ষায় বসেনি – সেই খবর কেন যেন গোপন করি। মাকে দাদার চিঠির আরেকাংশ পড়ে শোনাই, যেখানে লেখা ছিল শ্রদ্ধানন্দ পার্কে সুভাষ বসুর বক্তৃতা শুনে মোহিত দাদা। সে তাঁর পরম ভক্ত। কথাটা আমি একটু নাক সিটকেই বলি সেদিন। আমার মতো একজন নব্য কমিউনিস্ট কী করে উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতাকে পাতে তোলে!

দাদা যখন শিলংয়ের বাড়ি আসে, আমি তখন পার্টির ছাত্র সংগঠনের কাজে আসামভ্যালি ঘুরে বেড়াচ্ছি। মা চিঠিতে লিখেছেন – নিরোর সঙ্গে একটি মুসলিম ছেলেও এসেছিল। ওকে সহপাঠী বলে পরিচয় করিয়ে দেয় নিরো। তার মানে দুজনেই পরীক্ষা ড্রপ দিয়েছে। তারপর নতুন বছরে পড়া বাদ দিয়ে সবান্ধব শিলংয়ে বেড়াতে আসা কেন – দাদাকে আড়ালে ডেকে মা বলেছিলেন কথাটা। ‘মা, তুমি তো জানো স্প্রিং খুব সুন্দর শিলংয়ের! অনেক ফুল ফোটে। আমার মুখে এসব গল্প শুনে ওর ভীষণ দেখবার শখ।’ দাদা তখন ছেলেটির নামও বলেছিল। মুসলমানি নাম বলে মনে রাখতে পারেননি মা। ‘তোর বন্ধুকে খেতে ডাক। তোর বন্ধুকে স্নানে যেতে বল’ – এভাবে দাদার বন্ধুটি যে-কদিন শিলংয়ের বাড়িতে ছিল নামহীন হয়েই ছিল। কোথায় তার শিলংয়ের বসন্তের শোভা দেখা, ফুল দেখা, মা লিখেছেন – সে নাকি খবরের কাগজে রাত-দিন মুখ ডুবিয়ে বসে থাকত। অথচ আমাদের পাহাড়-ঢালের বাংলো প্যাটার্নের বাড়িটা তখন ফুলের জন্য খুব সুখ্যাত ছিল। মায়ের বাগানের ক্যামেলিয়া, অ্যাজেলিয়া, ম্যাগনোলিয়া, চন্দ্রমল্লিকা তখন শিলংয়ের সেরা। গোলাপ, জেরিনিয়াম তো সারা বছরই ফুটত। গেটের মুখে বিশাল জাকারান্ডা গাছটা বেগুনি ফুলে ছেয়ে যেত সেই ঋতুতে। এ-সময়ে শিলং ঘুরতে আসা অচেনা লোকদেরও মা বাড়ি ডেকে বাগান দেখাতেন আর তারিফ শুনতে ভালোবাসতেন। সেই বাগানের প্রতি দাদার বন্ধুর উদাসীনতা মায়ের মর্মপীড়ার কারণ হতে পারত। তা হয়নি, কারণ ছেলেটা দুই হাতে মাছের কাঁটা বেছে খায়। একবার তো এঁটো হাতে মাছ তুলেছিল বলে তিনি তৎক্ষণাৎ বাটি সরিয়ে ফেলেন টেবিল থেকে। আমি চিঠি পড়তে-পড়তে উৎকণ্ঠা নিয়ে ভাবি – এসবে তো দাদার বন্ধুর অপমানিত হওয়ার কথা। মা কী করে পারলেন এমন কাজ করতে -!

আমি ছোটবেলা থেকে জানতাম, আমাদের বাড়ির পরিবেশ উদার। পর্ক বা বিফ বাড়িতে আসে না ঠিকই, জাত-পাতেরও বাতিক নেই। বাবা-মা দুজনেই শিক্ষিত, ভদ্র, গান্ধীর আদর্শে বিশ্বাসী। বাবা ওকালতি করে প্রচুর রোজগার করলেও কালো কোটের নিচে খদ্দরের জামা পরতেন। মা বাড়িতে পরতেন বঙ্গলক্ষ্মী কটনমিলের শাড়ি। বাবার সঙ্গে বাইরে বেরোলে সরু পাড়ের খদ্দরের শাড়িই পরনে থাকত। হাতে সাদাসিধে দুগাছি সোনার চুড়ি। শখ করেও কেউ রেশমি চুড়ি পরত না তখন। বিলেতি জিনিস ভেঙে ফেল/ ছুড়ে ফেল – আমার ছোটবেলায় সবার মুখে-মুখে। তেমন বাধ্যবাধকতা অবশ্য আমার আর দাদার পোশাক-আশাকের বেলায় ছিল না। মা হাতকল চালিয়ে আমার জন্য চলতি ফ্যাশনের জামা-স্কার্ট-টপস সেলাই করতেন। শখ করে শাড়ি পরি যদি, তাই মাঝেসাঝে বানাতেন সায়া-ব্লাউজ। দেখতে রোগা ছিলাম বলে ব্লাউজের হাতাটা কোলবালিশের ওয়াড়ের মতো ঢলঢল করত। ব্লাউজে বোতাম থাকা সত্ত্বেও পরপর সেফটিপিন লাগাতাম অনেক। আমি স্কুলে পড়তেই লেস-বোনা, উলের জামা-মোজা বোনা, এমব্রয়ডারি, আসন তৈরি এসব শিখে গিয়েছিলাম। শেখাটা একরকম বাধ্যতামূলকই ছিল। আসলে আমরা বড় হচ্ছিলাম সিম্পল লিভিং হাই থিংকিংয়ের মারমার কাটকাট পরিবেশে। যুগটাই ছিল অমন।

আমার আরো ছোটবেলার কথা। তখনো আমাদের বেবি অস্টিন কেনা হয়নি। মা-বাবা ওই পোশাকে যখন ঢালু ড্রাইভওয়ে দিয়ে নেমে যেতেন, আমি জানালা ধরে তাকিয়ে থাকতাম। ভাবতাম,
আমার যখন বিয়ে হবে আমিও স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে যাব। পাইনের সারির তল দিয়ে হাত ধরাধরি করে হাঁটব বা ফিটনে করে বেড়াব। আমার পরনে থাকবে লম্বা গাউন আর মাথায় সাদা লেসের গোলাপি হ্যাট। লরোটো-কনভেন্টের ছাত্রী ছিলাম বলেই হয়তো এমনটি ভাবতাম তখন। তখন তো শিলংয়ে সাহেব-মেমেরও অভাব ছিল না।

মনে আছে, সে-সময় মায়ের এক মাসতুতো দাদা শিলংয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন আন্দামানের সেলুলার জেলের কয়েদখাটা স্বদেশি। তিনি যে-হাতে পিকরিড অ্যাসিডের বোমা তৈরি করতেন, সেই হাতে তাঁকে জেলখানায় ঝুলঝাড়ু বানাতে হতো। সেই দুঃখে বন্ড সই করে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। তাঁর প্রতিজ্ঞা ছিল – এ দুটির কোনোটাই বাকি জীবন হাত দিয়ে ছোঁবেন না। মা তাই নিশ্চিন্তমনে সাবেক বিপস্নবীকে বাড়িতে ঠাঁই দিয়েছিলেন। তখন মানুষ পরোপকার করত তো খুব! যুগটাই ছিল ফিলানথ্রপির। আমার মা কুষ্ঠ নিবারণ সমিতির সেক্রেটারি ছিলেন। আরো কী সব সভা-সমিতির কাজ থাকত রোজ। মামার কাছে আমাদের রেখে চলে গেলে আমরা চোখ বড় বড় করে বোমা বানানোর ফর্মুলা শুনতাম। মোম মাখানো ম্যানিলা রজ্জুতে যে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিদের ফাঁস লাগানো হয় – তা আমাদের ছোটবেলায় মামার মুখেই শোনা। তারপর নাকি দেড়গুণ ওজনের বালুর বস্তা ঝুলিয়ে পরখও করা হতো। এভাবে বিপস্নবে ইস্তফা দেওয়া মামার কাছেই আমার আর দাদার হাতেখড়ি। দাদা তো চুপচাপ, স্বল্পভাষী – ওকে বোঝা যেত না। আমি ছিলাম চঞ্চল, মারদাঙ্গা টাইপের। বাবা ব্যস্ত মানুষ। একসময় মায়ের একার পক্ষে আমাকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। তখন আমাকে যে ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ীতে পাঠানো হয়, আমার দুরন্তপনাই শুধু এর কারণ ছিল না, মেমগিরি ছাড়ানোরও হয়তো প্রণোদনা ছিল। বিদ্যাময়ীর হেডমিস্ট্রেস ছিলেন মায়ের স্কুল-বান্ধবী। তিনিই সব ব্যবস্থা করলেন। থাকতাম স্কুল-বোর্ডিংয়ে। স্কুল কম্পাউন্ডে অনেক গাছ ছিল। আশপাশের বাড়িতে তো ছিলই। স্কুলের পাঁচিল ঘেঁষে কম্পাউন্ডের বাইরে একটা লিচুগাছ ছিল সে-সময়। কাকে-বাদুড়ে খাবে বলে ওরা জাল দিয়ে ফলন্ত গাছটা মুড়িয়ে রাখত। আমাদের বারণ ছিল গাছে চড়ে লিচু খাওয়ার। তখন তো আইন অমান্যের জোয়ার সর্বত্র! তা বলে আমরা কিন্তু গাছে চড়ে নিয়ম ভঙ্গ করি নাই। পাঁচিলে উঠে ইঁদুরের মতো জাল কেটে লিচু পেড়েছি। হেডমিস্ট্রেসের রুমে ডাক পড়তে জেরার মুখে বললামও সে-কথা। মায়ের স্কুল-বান্ধবী তো থ, টেবিলে কাঠের রুলার নামিয়ে বাচ্চামেয়ের মতো খিলখিলিয়ে হাসতে লাগলেন।

আমি বিদ্যাময়ীতে দুবছর পড়ে ১৯৪০ সালে ম্যাট্রিক পাশ করি। ওখানে গার্লস গাইডেরও সদস্য ছিলাম। একজন মেমসাহেব আসতেন আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা নিতে। একদিন অ্যাসেমবিস্ন শেষে চলে গেলাম স্কুল মাঠের শেষপ্রান্তের কৃষ্ণচূড়ার তলায়। কিংয়ের এফিজি জ্বালালাম। সেটি রিপোর্টেড হয়ে গেলে কল্যাণী ঘোষ নামের নেত্রীগোছের মেয়েটিকে রাসটিকেট করা হয়। বাকিরা ক্ষমা চেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছাড়া পাই। মামার মতোই আমার অবস্থা আর কি।

এখন মনে হয়, মামা সে-সময় খুব সিনিকাল হয়ে পড়েছিলেন। মাকে কুষ্ঠ নিবারণ সমিতি থেকে ফিরতে দেখলে বলতেন, ‘এ কি, তুমি মাস্ক পরোনি! তোমার হাতে দস্তানা কই?’ কখনো-বা ‘কুষ্ঠরোগীদের মতো তোমার তো চটের বসন হওয়ার কথা, খদ্দর কেন?’ বলে টিটকিরি দিতেন মামা। মা কিছু বলতেন না। মৃদু হেসে কাপড় ছাড়তে ঘরে চলে যেতেন। হাতের নখ লম্বা হতে দিতেন মামা। লম্বা হতে হতে নখের মাথাগুলো স্ক্রু ড্রাইভারের মতো পেঁচিয়ে যেত। বলতেন, ‘বোমা বানাব না প্রতিজ্ঞা করেছি। সাহেবদের নখে আঁচড়াব না – তা তো বলি নাই!’ সেই লম্বা নখ দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ভাত মাখতেন, বাবা-মায়ের মুখোমুখি টেবিলে বসে। বাটি থেকে চামচ দিয়ে তরকারি তোলাকে বলতেন সাহেবিপনা। মাছ বা পাঁঠার মাংসে তাঁকে শকুনের মতো নখ দাবাতে আমি নিজের চোখেই দেখেছি। তখন তো টেবিল থেকে বাটি সরাতেন না আমার মা লীলাবতী! কলকাতায় দাদার গতিবিধি খুব সামান্যই জানা ছিল মায়ের। বাবা যা টাকা-কড়ি পাঠাতেন, দাদা বেহিসেবি ছিল বলে তা দিয়ে মাস চলত না। শেষের টানাটানির দিনগুলোতে পার্ক সার্কাসের হোটেল থেকে সস্তায় বিফ চাপ কিনে খেত। সেই চাপ মুসলিম বাবুর্চির হাতেই তো তৈরি, নাকি?

সেদিন চিঠি পড়তে পড়তে মাকে এভাবে চুলচেরা বিচার করছিলাম। আজ ভাবতে অবাক লাগে কী করে পারলাম, যখন তাঁর একমাত্র ছেলে নিখোঁজ, যখন তাঁকে একাই বেরোতে হচ্ছে ছেলের খোঁজে! আমি পার্টির স্টুডেন্ট উইংয়ের কাজে গৌহাটি-গোলাঘাট-জোড়হাট ট্যুর করছি। জরুরি মামলার কাজে বাবা মণিপুরে। দাদার নিখোঁজ সংবাদে আমরা দুজন সাড়া দিইনি। যার যার কাজকর্ম করে গেছি। ভাবতে পারিনি ব্যাপারটা কত ঘোরতর। মাও মনে করেছিলেন – নিরোর চলে যাওয়ার কারণ, ওর বন্ধুর প্রতি তাঁর আচরণ যথাযথ ছিল না। তাই চিঠির ভাষাটা ছিল একজন অনুতপ্তের, যেন যাজকের সামনে কনফেশনের সাজি খুলে বসেছেন। আমিও দূরে বসে চিঠি পড়তে পড়তে জিবে শান দিচ্ছিলাম। তখনকার দিনে কমিউনিস্ট হওয়া ধর্মান্তরেরই মতো – নিষিদ্ধ খাবার খেয়ে, জাত মেরে যার পরীক্ষা শুরু। সে-অবস্থায় মায়ের এতটা বাড়াবাড়ি কোন কমিউনিস্ট মেয়ে সহ্য করবে? r   (চলবে)