স্মৃতি অম্লান

মীর মোবাশ্বের আলী

Mazharul Islam

এ অঞ্চলে স্থাপত্যের ভুবনে এক কিংবদন্তির নায়ক মাজহারুল ইসলাম। ১৯১২ সালের ১৫ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। যদিও তিনি বিগত দুই দশক ধরে স্থাপত্য পেশায় সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত ছিলেন না, তবু তাঁর তিরোধান স্থপতিকুলের জন্য এক অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। একটা পরিবারে এক বর্ষীয়ান গুরুজনের অবস্থান বিষয়ে পরিবারের সদস্যরা অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং মনে করে, এরকমটাই চলতে থাকবে; কিন্তু হঠাৎ করে তাঁর তিরোধান হলে সবাই পিতৃহীন অসহায় বোধ করে এবং একটা হারানোর ব্যথা অনুভব করে। এক্ষেত্রেও তাই। মনে হয় আমাদের সবার মাথার ওপর থেকে একটা ছায়া সরে গেল, যা আর কখনো ফিরে আসবে না। এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী স্থপতি মাজহারুল ইসলাম শুধু তাঁর পরিবারের আপনজন ছিলেন না, তিনি স্থপতিকুলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সকলের আপন না হলেও তিনি সবাইকে ছুঁয়েছিলেন, সবার মনে স্থান করে নিয়েছিলেন। তাঁর সমস্ত জীবনই ছিল পরিবেশকে ঘিরে এবং পরিবেশে অবস্থানকারী মানুষকে নিয়ে। তাই তাঁর মৃত্যুতেও সবাই আন্দোলিত, শোকাহত ও দুঃখিত। তাঁর অন্তর্ধানের কষ্টটা তাঁর পরিবারের সঙ্গে স্থপতিকুল ভাগ করে নিয়েছেন; এটাই স্বাভাবিক।
স্থপতি মাজহারুল ইসলাম শুধু এক অনন্য ব্যক্তিত্বই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান বা ইনস্টিটিউশন (institution)। আমি তাঁকে সবসময় স্যার (sir) বলতাম। বাংলাদেশে এ-অঞ্চলের পরিচিত লোকদের সাধারণত নাম ধরে ডাকা হয় না। চাচা, মামা, ভাই, ভাতিজা, বিয়াই – এ-জাতীয় একটা সম্পর্ক পাতিয়ে নেওয়া হয়। নিদেনপক্ষে স্যার, মুরুব্বি, মাস্টারসাহেব এরকম ডাকা হয়। আমার কাছে এটা বেশ ভালো লাগে। পশ্চিম দেশে ইংরেজিতে গুরুস্থানীয় লোককেও প্রথম নাম ধরে (first name) ডাকা হয়। একজন বয়স্ক শিক্ষককে ছাত্র ‘হাই ডেভ’, ‘হাই জর্জ’ এরকম নামে ডাকছে, এটা একটু শ্রুতিকটু মনে হয়। যা-ই হোক, এ-লেখায় আমি এখন থেকে ইসলাম সাহেবকে বারবার স্যার (sir) বলেই উল্লেখ করব।
মাজহারুল ইসলাম একজন সুশিক্ষিত মানুষ। তিনি প্রথমে বিজ্ঞান পড়েন। ১৯৪২ সালে বিএসসি পাশ করে কলকাতার শিবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি পান ১৯৪৬ সালে। তারপর যুক্তরাষ্ট্রের অরিগন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক হন ১৯৫২ সালে। পরে ১৯৫৭ সালে লন্ডনের বিখ্যাত এএ স্কুল থেকে ট্রপিক্যাল আর্কিটেকচারে শ্রু স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা লাভ করেন। শুধু তাই নয়, ১৯৬১ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্কিটেকচারে মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। এখানে তিনি বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি পল রুডলফের কাছে শিক্ষালাভ করেন ও তাঁর সংস্পর্শে আসেন। স্যার যে শুধু অনেক ডিগ্রির অধিকারী ছিলেন তা-ই নয়, তিনি ছিলেন সত্যিকারভাবেই শিক্ষিত। অনেক বিদ্যা অর্জন করে তিনি হয়ে ওঠেন প্রাজ্ঞ বা জ্ঞানী (wise)। তাই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বা আলাপ করতে মজা লাগত বা ভালো লাগত। তীক্ষè বুদ্ধি বা জ্ঞানের ছোঁয়া পাওয়া যেত। স্যার আমাকে খুব তর্ক করার সুযোগ দিতেন না। ‘যা জানেন না, তা নিয়ে বেশি কথা বলবেন না’ – এরকম উক্তি করে থামিয়ে দিতেন। উল্লেখ্য, স্যার সবাইকে আপনি করে বলতেন, যত ছোট বা সামান্যই হোক না কেন। তাঁর এই আপনি বলে সম্বোধন করার মধ্যে কোনো হঠকারিতার ভাব প্রকাশ পেত না। বরং সবার প্রতি সম্মানের ভাব প্রকাশ পেত, সবার কথাকেই তিনি মূল্য দিচ্ছেন বলে মনে হতো। শিক্ষার একটা বিশেষ দিক হচ্ছে, তা মানুষকে পরিশীলিত (refined) করে। স্যারের বেলায় এই পরিশীলিত কথাটা খুবই প্রযোজ্য। এমনকি তাঁর কাজের বেলায়ও এই পরিশীলিত কথাটা খুবই প্রযোজ্য। তাঁর কাজের বেলায় এই পরিশীলিত ভাবের সঙ্গে একটা পারফেকশনিস্টের (perfectionist) পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি সবকিছু নির্দোষ (fault ছাড়া) ও নিখুঁত চাইতেন। এ-জন্যে তিনি একটু রাগী বা মেজাজি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। চুন থেকে পান খসলেই তিনি মনঃক্ষুণ্ন হতেন। কাজের বেলায় একটা কাজ বারবার করে নিখুঁত হওয়া পর্যন্ত তিনি লেগেই থাকতেন।
মাজহারুল ইসলাম তৎকালীন পূর্ববাংলা – বর্তমান বাংলাদেশের প্রথম সত্যিকারের শিক্ষিত স্থপতি। সে-সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন স্থপতি, কেউ কেউ ডিপ্লোমাধারী, এখানে কাজ করেছেন। জহিরউদ্দিন নামে একজন যিনি ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেকচার পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টও ছিলেন, বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের ডিজাইন করেছেন। চিশতি নামে একজন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভবন ডিজাইন করেন। ফিদা হাসান নামে একজন চট্টগ্রাম নিউমার্কেটের ডিজাইন করেন। থারিয়ানি নামে একজন ঢাকার কিছু ভবনের কাজ করেন। তাঁদের কাজের মাঝে কোনো উৎকর্ষ বা সৃজনশীলতার পরিচয় পাওয়া যায় না। সত্যিকার অর্থে একজন স্থপতির কাজ বলেই মনে হয় না। অথচ তখন দেশভাগের পরপর এ-অঞ্চলে বিপুল নির্মাণ কর্মকাণ্ড শুরু হয়। এর দায়িত্ব যাঁরা পেয়েছিলেন তাঁরা যোগ্যতার প্রমাণ না দিয়ে শুধু নিরানন্দ নৈরাজ্যই সৃষ্টি করেছেন। এ-সময়টাতে স্যার কাজ শুরু করেন ও তা অন্ধকারে সূর্যোদয়ের মতো, একজন পথপ্রদর্শকের সমাজকে আনন্দময় সৃষ্টি ও সৃজনশীলতার ভুবনে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো। তিনিই প্রথম ডিজাইনের ব্যাকরণ মেনে, পশ্চিমা যুক্তির প্রভাব মেনে এদেশীয় প্রযুক্তি ও উপকরণ দিয়ে, অর্থবহ সৃজনশীল ভবন নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন।
১৯৬১ সালে মাজহারুল ইসলাম উচ্চতর স্থাপত্য শিক্ষা শেষ করে দেশে ফিরে আসেন ও এ-অঞ্চলে স্থাপত্য পেশার গোড়াপত্তন করেন। খুবই সৌভাগ্যের কথা যে, তার এক বছর পর ১৯৬২ সালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাযথ মানের স্থাপত্য শিক্ষার সূত্রপাত হয়। চারজন যুক্তরাষ্ট্রীয় শিক্ষক নিয়ে সে-দেশের সিলেবাস অনুসরণ করে যাত্রা শুরু হয়। এ-ধরনের একটা স্কুল স্যারের খুব মনঃপুত হয়নি। স্যার পছন্দ করতেন সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, মানবিকতা ও বাঙালিয়ানা। তিনি ছিলেন সত্যি সত্যি বামপন্থী। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তাপুষ্ট, সে-দেশীয় সিলেবাস অনুসরিত, পেডাগগি (padagoggy) বা ক্লাসরুমভিত্তিক স্থাপত্য শিক্ষা স্যারের খুব মনঃপুত হয়নি। পক্ষান্তরে গুরু-শিষ্যের হাতে-কলমে পরীক্ষামূলক প্রাচ্যের নিজস্ব পদ্ধতির একটা শিক্ষাব্যবস্থা হয়তো আরো বেশি পছন্দ হতো। কিন্তু তিনি পাশ করা স্থপতিদের খুবই যোগ্য ও সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখতেন। স্থাপত্য শিক্ষার বিদ্যাপিঠ শুরু করা হলেও পাশ করে কোথায় চাকরি বা জীবিকা অর্জন করবেন তার পরিকল্পনা করা হয়নি। তাই প্রথম ব্যাচের (১৯৬৭-৬৮) ছাত্ররা চাকরির পদ সৃষ্টির জন্য আন্দোলন করলে তিনি তাদের পূর্ণ সহযোগিতা ও সমর্থন দেন। স্যার খুব সহজেই নতুন স্থপতিদের শ্রদ্ধা ও ভক্তিভাজন হয়ে উঠতে সমর্থ হন। নতুন স্থপতিরা স্কুলে যে মূল কাঠামোগত (basic) শিক্ষাটা লাভ করে আসেন, তিনি তাঁকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে, অনুশীলন ও চর্চার মাধ্যমে উৎকর্ষ সাধন করতে প্রয়াসী হন। স্যারের এ-প্রয়াস ‘চেতনা’ নামে একটা সংগঠন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। স্যারের ‘চেতনা’ নামের প্রতিষ্ঠানটাকে আমার ড. জনসনের ইংলিশ লিটারারি সোসাইটির সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছা করে। ড. জনসন, যিনি প্রথম ইংরেজি ডিকশনারি লেখেন, তাঁর সোসাইটিতে তৎকালীন ইংরেজি সাহিত্যের অনেক নামকরা কবি-সাহিত্যিককে আলোচনা, ভাবের আদান-প্রদান, আরো সাদামাটাভাবে বললে, আড্ডা দেওয়ার সুযোগ করে দেন। এ-সোসাইটি ইংরেজি সাহিত্যে অনেক প্রভাব ফেলে ও সমৃদ্ধ করে। স্যারকে কেন্দ্র করে ‘চেতনা’ এ-এলাকার স্থাপত্যের ভুবনে বিশেষ প্রভাব ও অবদান রাখে। এর মধ্যে কিছুটা ছোটখাটো গবেষণার কাজও হয়। মাজহারুল ইসলাম একজন আগাগোড়া নিবেদিতপ্রাণ স্থপতি। স্যারের চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা, কর্মকাণ্ড, সাধনা ইত্যাদি ছিল স্থাপত্যকে ঘিরে। স্যারের কাছে স্থাপত্য একটা জীবনধারা ছিল। একটা লোকের প্রায় সকল কাজের নিয়ন্ত্রক। তাঁর স্থাপত্যকর্ম সম্বন্ধে আলোচনা না করলে তাঁর সম্বন্ধে কিছুই বলা হলো না। এই স্বল্পপরিসরে বিশদ আলোচনা সম্ভব নয়। তবু কিছুটা বলার চেষ্টা না করলেই নয়। স্যার অরিগন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের ছাত্র ছিলেন। সে-স্কুলে বাওহস (Banhaus) ও মডার্নিস্ট ধারার প্রাধান্য ছিল। এ-ধারা মানে ভালো ডিজাইনের জন্য ভালো কম্পোজিশন হতে হবে। সব লাইন সরলরেখা হবে, হরাইজন্টাল ও ভার্টিক্যাল লাইনের প্রাধান্য থাকবে। এক্সিসভিত্তিক সাজানো হবে, অভ্যন্তর ও বাইরের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের সুবিধা ভেবে স্পেস সাজানো হবে, প্রযুক্তি ও উপকরণের যথাযথ ব্যবহার থাকবে, আর যে-কাজে ব্যবহার হবে (functional building) সে-কাজে উপযোগী হতে হবে। পল রুডলফের মতো কিছুটা ব্রুটাল (brutal) বা সাহসিকতা ও উপকরণের নিরাভরণ ব্যবহারের চেষ্টাও লক্ষ করা যায়। তাছাড়া মাজহারুল ইসলামের কাজে প্রথমদিকে লে কর্বুশিয়ের ও পরে লুই কানের প্রভাবও লক্ষ করা যায়। মাজহারুল ইসলামের কাজ নিয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে ১৯৯৭ সালে স্থপতি মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ ও আমার চেষ্টায় একটা পোস্ট-গ্রাজুয়েট রিসার্চ থিসিস করা হয়, যার শিরোনাম ‌‌‌‌’The search for conceptual frame work in the work of Mazharul Islam’। সে-সময় স্যারের সঙ্গে আলোচনাকালে তিনি কোনো ডিজাইন ফিলসফি (philosophy) বা পলিসির কথা বলেননি, এমনকি কোনো থিওরি বা কনসেপচুয়াল রূপরেখাও দেননি। তবে তিনি কিছু শব্দ ব্যবহার করেন যেমন – ‘কাজটা খুব গোছানো হতে হবে।’ ‘গোছানো’ শব্দটা স্যারের খুব প্রিয় শব্দ। তিনি এ-দিয়ে বোধহয় অর্ডার (order) বোঝাতে চেয়েছেন। তিনি যত্ন করে কাজ করার ওপর জোর দিয়েছেন। আর যতক্ষণ পর্যন্ত না পারফেক্ট (perfect) হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত বদলে বদলে কাজ করতে বলেছেন। তিনি ডিটেইল (detail) বা খুঁটিনাটির ওপরও খুব জোর দিয়েছেন। স্যারের ড্রইংয়ে দেখা যায়, একটা বড় দেয়ালের একটি একটি করে প্রতিটি ইট আঁকা হয়েছে। স্যারের আরেকটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বাঙালিয়ানা বা বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণ ও মমতা। আমি স্যারকে কোনোদিন স্যুট ও টাই পরা দেখিনি। তাঁর কাছে ফরমাল (formal) বা আনুষ্ঠানিক পোশাক ছিল খদ্দরের পাজামা-পাঞ্জাবি। একসময় তাঁর বাসায় গেলে চিড়ে ভাজা খেতে দিতেন। স্যারের ডিজাইনে বাঙালিয়ানার একটা অসাধারণ অনুপ্রবেশ ছিল। তাঁর ডিজাইনের পরিশীলিত ভাবটাই ছিল বাঙালিত্বের প্রকাশ। তিনি বিশেষ কোনো বাঙালি মোটিফ বা সিম্বল (symbol) ব্যবহার করেননি। তবু তাঁর ডিজাইনের উপকরণ (material) স্কেল ও স্পেস এমনভাবে সাজানো-গোছানো থাকত, যাতে একটা চেনাজানা অতিপরিচিত পরিবেশ পাওয়া যেত। স্থাপত্যকর্ম উপভোগ বা মূল্যায়ন করতে গেলে কিছুটা শিক্ষা, উপলব্ধি ও উদারতার প্রয়োজন বলে তিনি মনে করতেন। আর সেটা না থাকলে তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করতেন। তিনি বাড়াবাড়ি পছন্দ করতেন না। শহরে বাঙালি পিঁড়ি পেতে না খেয়ে টেবিল-চেয়ারে বসে খাবে এটাই কাম্য। এক সময় প্রশ্ন ওঠে, বাথরুমে পশ্চিমমুখী হয়ে বসা যাবে না। তিনি এটাকে হাস্যকর মনে করেন ও কোনো পাত্তা দেননি। স্যার কাজে ও বিশ্বাসে সত্যিকার অর্থেই ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন।
এ-অঞ্চলে একটা পূর্ণাঙ্গ উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান (consulting firm) মাজহারুল ইসলামই প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর ফার্মের নাম দেন বাস্তুকলাবিদ। স্থাপত্য এসেছে স্থাপনা বা স্ট্রাকচার (structure) বা কাঠামো থেকে আর বাস্তু মানে বসবাসের পরিবেশ, আর তার সঙ্গে সুকুমার শিল্প বা কলা – এ দুয়ে মিলে বাস্তুকলা। এ নামটাই বেশি সুন্দর ও প্রযোজ্য বলে মনে হয়। স্যার তাঁর ফার্মের মাধ্যমে অনেক কাজ, অনেক প্রজেক্ট করেন। আমি যতগুলো পারি নাম দেওয়ার চেষ্টা করব। পাঠক যেন তাঁর করা ভবনগুলো চিনতে পারেন, একটু মনোযোগ দিয়ে দেখতে পারেন। স্যারের ডিজাইন করা ভবনের সামনে দাঁড়ালে, একটু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলে তাঁকে চেনা যাবে, তাঁর আসল পরিচয় পাওয়া যাবে। স্যারের করা প্রজেক্টগুলো হচ্ছে আর্ট কলেজ, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্ট ফ্যাকাল্টি (১৯৫৩-৫৫), পাবলিক লাইব্রেরি (১৯৫৩-৫৫), বিসিএসআইআর Bangladesh council for scientific and industrial research (১৯৬২), নিপা ভবনNational Institute of Public Administration (১৯৬৩-৬৪). নিম্ন আয়ের সরকারি কর্মচারীদের জন্য আজিমপুরে একটি হাউজিং (১৯৬৩-৬৪), যা আজববাড়ি নামেও পরিচিত, জীবন বীমা করপোরেশন (EFU) ভবন, বিএডিসি ভবন Bangladesh Agricultural Development Corporation (১৯৬৫-৭১), স্ট্যানলি টাইগারম্যানের সঙ্গে যৌথ কাজ পাঁচটি পলিটেকনিক ভবন। ধানমণ্ডিতে তাঁর নিজস্ব বাসভবন (১৯৬০), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬৫-৭১), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬৫-৭১), জয়পুরহাট চুনাপাথর ও সিমেন্ট প্রকল্পের আবাসিক ভবন (১৯৮০-৮৪), শেরেবাংলা নগরে ন্যাশনাল লাইব্রেরি ও ন্যাশনাল আর্কাইভস (১৯৮০-৮৪), পরীবাগে ওয়ার্র্ল্ড ব্যাংকের স্থানীয় অফিস (১৯৮৭)।
মাজহারুল ইসলামের এসব কাজকে সময়ের ক্রমে তিন ভাগে ভাগ করতে চাই। প্রথম যখন আয়তাকার গ্লাস ও অনেকটা কিউবের মতো মাস (mass), যাতে বৃষ্টি ও সূর্যের আলো নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা একটা অনন্য রুচিকর সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। সায়েন্স ল্যাবরেটরি, পাবলিক লাইব্রেরি ও আর্ট কলেজ – এই প্রাথমিক সময়কার কাজ, তখনকার জন্য এক অভিনব যুগান্তকারী সৃষ্টি বলা যায়। ঢাকার বুকে অন্যান্য ভবনের চেয়ে ভিন্ন অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন এ-স্থাপনা স্যারের মডার্নিস্ট ভাবধারারই পরিচায়ক। মাঝামাঝি সময়ে স্যার বিএডিসি, ইএফইউ, নিপা ইত্যাদি কাজ করেন। এই সময়ে তাঁর কাজে অনেকটা ম্যাচিউরিটি, অভিজ্ঞতা ও আত্মবিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায়। এ-ভবনগুলোতে স্ট্রাকচার বা কাঠামোকে প্রকাশ করা হয় এবং এলিমেন্টের পুনরাবৃত্তি একটা সুর সৃষ্টি (rythm) করে, যা নগরের দৃশ্যমান রূপরেখায় একটা অনন্য অবদান রাখতে সমর্থ হয়। এই ভবনগুলোতে তাঁর প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে বলা যেতে পারে। যে-কাজের জন্য এই ভবনগুলো তৈরি হয়েছে (functionality), তা খুব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়, লাইব্রেরি, আর্কাইভস এগুলো তাঁর শেষের দিকের কাজ। এর মধ্যে একটা নতুন মাত্রা মনুমেন্টালিটি যোগ হয়েছে। তিনি বড় কলাম (column) দিয়ে মনুমেন্টালিটি বা এক্সিস তৈরি করেননি বরং ইটের বিশাল দেয়াল সাজিয়ে একটা বিশেষ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পেরেছেন। আমার কাছে স্যারের লাইব্রেরি-আর্কাইভসের কাজটাই তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বলে মনে হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, তিনি একটা কাজেও ইনটিউটিভ (intuitive) বা কেবল ভালো লাগার জন্য (feeling) কিছু করেননি। সবখানেই কঠোর শৃঙ্খলা ও নিয়মনীতির মধ্যেই থেকেছেন। এমনকি কিছুতেই আর্ট ফর আর্টস সেক (art for arts sake) বা কেবল সৌন্দর্যের জন্য বাড়তি কিছু করেননি। সবটুকুই যুক্তিসম্মত (rational) ও সহজাত সৌন্দর্যে বিকশিত। ধানমণ্ডিতে স্যার যে-বাসভবন ডিজাইন করেছিলেন, সেটা বর্তমানে বিলুপ্ত। আশির দশকের প্রথমদিকে সেখানে উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (ICDDRB) ড. গ্লাস নামে একজন ডাক্তার ভাড়া থাকতেন। তখন আমার সে-বাড়িটা ভালো করে দেখার সুযোগ হয়েছিল। তিনতলা মিলে একটা আবাসস্থল, দেশীয় ইটের কিউবের ফর্ম। ছাদটা ভাসমান (floating)। দিনে ও রাতে আলো জ্বালানো অবস্থায় দেখা যাবে উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে ডিজাইন করা। প্লটে প্রচুর গাছপালার সঙ্গে সমন্বিত। বাড়ির ভেতর লাইটিং ফিক্সচার থেকে শুরু করে সবকিছু যতœ করে ডিজাইন করা। দোতলা, তিনতলা স্পেস। আবার তিনতলার কোনো রুমে যাওয়ার নিজস্ব সিঁড়ি। বাথরুমে বাথটাব বিশেষভাবে তৈরি। সবকিছু মিলিয়ে চমকপ্রদ।
স্থাপত্য পেশার ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন মাজহারুল ইসলাম। স্যার ডিজাইনকে একটা আধ্যাত্মিক (transidental) পর্যায়ে নিয়ে যাননি, তাই কোনো দর্শনও প্রচার করেননি। তিনি স্থাপত্য পেশাকে একটা কার্যকর পর্যায়ে রেখেছেন। পরিবেশ সৃষ্টি ও পরিবেশে ভালো লাগার ওপরই গুরুত্ব দিয়েছেন। ষাটের দশক থেকে এ-অঞ্চলে স্থাপত্য পেশা যত উন্নতি ও প্রসারলাভ করেছে আর কোনো পেশার বেলায় এমনটা হয়নি। আজ এদেশে স্থাপত্য একটা সম্মানের পেশায় অধিষ্ঠিত। স্থপতি মানেই মোটামুটি শিক্ষিত ব্যক্তিত্ব ধরে নেওয়া যায়। কোনো স্থপতিই বেকার নন। তাঁরা জনসাধারণকে একটা কার্যকর দর্শনীয় সেবা দিয়েই জীবিকা উপার্জন করতে পারেন। যে-কোনো নির্মাণকাজেই স্থপতির ভূমিকা আবশ্যকীয়। পৃথিবীর কোনো শহরেই এতো (এক ডজন) বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিষয় পড়ানো হয় না। অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগ খোলা হয়েছে। আমি যে-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি, এমনই একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব সাফল্যের পেছনেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্যারের সদিচ্ছা, প্রচেষ্টা ও অবদান রয়েছে।
মাজহারুল ইসলাম স্থাপত্য ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তাঁর সভাপতিত্বের সময় আমার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট, বাংলাদেশ (IAB) যে পেশাগত মর্যাদার স্থানে অধিষ্ঠিত, তেমনটা অন্যান্য পেশাগত প্রতিষ্ঠানের বেলায় দেখা যায় না। স্যার এ-সংগঠনের নীতি (policy) নির্ধারক ও পরামর্শক হিসেবে আজীবন সম্পৃক্ত ছিলেন। এ ছাড়াও স্যার আন্তর্জাতিকভাবেও সুনামের অধিকারী ছিলেন। আগা খান অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার, মুসলমান অধ্যুষিত দেশে স্থাপত্য যাতে শিল্পকলার মর্যাদা লাভ করে, জনসাধারণ যেন এ-সম্পর্কে সচেতন হয়, কনজারভেশন ও সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে যাতে স্থাপত্য শিল্প বিকশিত হয়, এ-প্রচেষ্টায় সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত থাকে। তারা স্যারকে নানাভাবে সম্মানিত করে ও স্যারের কাজ অন্যদের কাছে তুলে ধরে। স্যার তাঁদের নানা কমিটিতে জুরি ও পরামর্শদাতা হিসেবে ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশের দুটি উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক সেমিনার হয়, যার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল রিজিওনাল আর্কিটেকচার ও কনজারভেশন। রিজিওনাল আর্কিটেকচারের বিষয়ে স্যার একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এটাই বোধহয় স্যারের প্রথম ও প্রধান লিখিত উপস্থাপনা। তিনি এ-লেখায় এ-অঞ্চলের স্থাপত্য ও সংস্কৃতির অতীত অতি গৌরব ও মর্যাদার সঙ্গে ব্যাখ্যা করেন। তিনি সুলতানি আমলকে ও চৈতন্যদেবের সময়কে এ-অঞ্চলের ভাষা, শিল্প ও স্থাপত্যের সূচনা হিসেবে চিহ্নিত করেন। যদিও সুলতানি আমল থেকে বর্তমান কালের  চিন্তা, চেতনা ও প্রকাশের মধ্যে যে-দূরত্ব তা অকপটে স্বীকার করেন। তিনি এদেশে ভূমির ব্যবহার ও স্থাপনার প্রতিষ্ঠায় সূক্ষ্ম চিন্তা, গবেষণা ও বিশেষজ্ঞের ভূমিকার ওপর জোর দেন। লুই কান ১৯৭৪ সালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে তাঁর জীবনের শেষ বক্তব্য রাখেন। দেশে ফেরার পথে তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি সে-বক্তৃতা শেষে বলেন, মাজহারুল ইসলাম ‘ভালো’ স্থপতি। তিনি আরো বলেন, স্যার গুণী ব্যক্তি ও সফল কর্মী। লুই কানের কাছ থেকে স্বীকৃতি অনেক বড় পাওয়া।
মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে আমার মিলের চেয়ে গরমিলই বেশি ছিল। বন্ধু ভাবের চাইতে ঠোকাঠুকিই বেশি ছিল। হয়তো তাই স্যারের অনুপস্থিতিটা বেশি অনুভব হচ্ছে। মাজহারুল ইসলাম চলে গেছেন, কিন্তু মুছে যাননি। স্মৃতিতেই অর্ধেক পাওয়া। স্যারের স্মৃতি বাংলাদেশের স্থপতিকুলের মাঝে অম্লান থাক এ-কামনা করি।