স্মৃতি গড়ার আয়োজন

Zia Hasna126

জিয়া হাশান

অফিস থেকে ফেরার পথে অফারটা আলমের ঘাড়ে সওয়ার হয়। বাসায় এসে তাই সরাসরি বউয়ের কোলে মাথাটা নামায় – ‘চলো দুজনে নেপাল ঘুরে আসি। এক সপ্তাহের ট্যুর।’

রুবি স্বামীর মুখের দিকে তাকায়। না, ঠাট্টা-তামাশার কোনো শানে-নজুল তাতে লেখা নেই। হাসি-মশকরার সূচনাবাক্যও নয়। বরং সিরিয়াসনেসের দৃঢ় পায়ে ঠাঁই। সুদৃঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়ানো আলমের মুখ-চোখজুড়ে। সঙ্গে স্বাদ-আহ্লাদ ভালোবাসার মাখামাখি। তার মানে সত্যিই যেতে চায়।

রুবির হিসেবি হাত চা নাড়া থামায়। মাঝপথে থিতু হয়। ডাইনিং টেবিলে মুখোমুখি বসা স্বামীর মুখপানে এবার পুরো মনোযোগ জড়ো করে – বিশ বছরের সংসার, কত তার উত্থান-পতন, চড়াই-উতরাই। কই, তার কোনো অাঁকাবাঁকা ছিলা পথেও তো এমন সম্ভাবনা কখনো উঁকি দেয়নি। বলেনি, চলো দুজনে মিলে দুপা হাঁটি। আজ কিনা মুঠো একেবারে খোলা, উদারহস্ত সুদূরে ছড়ানো। তাই অবলীলায় বিদেশ যাওয়ার অফার? ছেলেমেয়ে রেখে টোনাটুনির প্রমোদভ্রমণের খায়েশ?

কাহিনিটা কী, কোন পথে পা বাড়াতে চায় এ ভারি বয়সে এসে? রুবি হিসাব মেলাতে পারে না। অজানা-অচেনা এক খটকা তার কোল-ঘেঁষে দাঁড়ায়। তাকে সে স্পষ্ট দেখতে পায়। কিন্তু আলম তাকে থিতু হতে দিতে চায় না। বরং পত্রপাঠ বিদায়ের উদ্যোগ নেয় – ‘অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয় না তাই…।’

সত্যিই রুবি অনেকদিন ধরে ঢাকার কংক্রিটের বস্তিতে বন্দি। দমবন্ধ হওয়ার জোগাড় তার। মনটা একটু খোলা হাওয়ার আশায় খাঁচার পাখির মতো ছটফটায়। তাই বলে নেপাল, হিমালয়কন্যার দেশে? কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন কিংবা সিলেট-শ্রীমঙ্গল হলে না-হয় কথা ছিল। বাস-ট্রেন সই। অল্পস্বল্প খরচে পোষ মানানো সম্ভব; কিন্তু নেপাল?

তার চাই উড়ালপথ। সে তো অনেক মোটা খাইয়ের ব্যাপার। তার জোগান আসবে কোত্থেকে?

চায়ে চুমুক রেখেও আলম বউকে পাঠে গড়িমসি করে না। নির্ভুল লাইন ধরে সে এগোয় – ‘টাকা-পয়সা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। রুমি-সুমির পরীক্ষা শেষ। ওদের বড় খালার কাছে রেখে গেলেই হবে।’

অ্যাঁ! প্ল্যান-প্রোগ্রাম সব বানানো সারা। টাকা-পয়সার  জোগাড়-যন্ত্র শেষ! রুবির চায়ের প্রথম চুমুকটা ধায় লটারির পানে। আজকাল তার চেহারা-সুরতের অন্ত নেই। হাসপাতাল গড়া, খেলাধুলায় মাতার নামে রাস্তার মোড়ে মোড়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর আবার জামা-কাপড়. রড-সিমেন্ট এমনকি প্যান ধোয়ার লিকুইডের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে হাতের কাছে, চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়। না চাইতেও অনেক সময় ঘরে আশ্রয় নেয়। পকেট-ভ্যানিটি ব্যাগে মুখ গোঁজে। ও কি তার কোনোটার যত্ন-আত্তি করেছে? কিনে কিংবা পেয়ে লুকিয়ে রেখেছে? এতদিনে টাকসই লেগেছে। দুটো এয়ার টিকিট কিংবা কোনো প্যাকেজের অংশীদার হয়ে মুখ বের করেছে। তাই এখন বউ নিয়ে প্রমোদভ্রমণে যেতে চাইছে। বুড়ো বয়সে একটু মাস্তির স্বাদ নেওয়ার শখ জাগছে আর কী। তাতে রুবিরও আপত্তি নেই। বরং সায় ষোলো আনা। তাই বলে কৌতূহলও তো দাবিয়ে রাখতে পারে না। – কই পেলে এত মোটা দাগ, ভারি তহবিল? লটারিতে…?

আলম মাথা নাড়ে – না, ভাগ্যে তার বিশ্বাস নেই। লটারির টিকিট সে কেনেনি কখনো।

তাহলে কেউ দিয়েছে? কারো কোনো মোটা কাজের বিনিময় – ‘নিন, দুটো এয়ার টিকিট। যান, বউকে নিয়ে নেপাল ঘুরে আসুন।’ সরকারি অফিস হলে বলা যেত উপরি; বেতনের বাইরে বাড়তি আয়। কিন্তু ওর চাকরি তো উন্নয়ন কাজের অফিসে। তারা আবার কোরান-হাদিস মেনে চলে। হারাম পয়সার আনাগোনাকে চান্স দেয় না।

শেষে কোনো কূল-কিনারা ধরতে না পেরে রুবি নিজের অবস্থান ক্লিয়ার করে – ‘আমি কিন্তু এক টাকাও দিতে পারব না। নেক্সট মানথে ওদের নতুন ক্লাসে ভর্তি। একগাদা বাড়তি খরচ।’

– ঠিক আছে। তুমি জোগাড়-যন্ত্র করো। নেক্সট উইকে ফ্লাইট ধরা চাই।

অফিস আর বাদুনিয়া, সে মাত্র তিনদিনের মাথায় সরকারি মহাযজ্ঞশালা থেকে দুটো পাসপোর্ট বের করে আনলে রুবি বিস্ময়ে স্বামীর দিকে তাকায়। তবে তার অবাক হওয়ার পালা তখনো আরো অনেক বাকি। কাঠমান্ডুতে পা দিয়ে তা টের পায়।

উভয় দিকের বাবা-মায়ের অমতে তাদের বিয়ে। আবার দুজনেরই পায়ের তলা তখন ফাঁকা। কারো কোনো চাকরি-বাকরি নেই। তাই বিয়ের পরপরই ক্যারিয়ার নিয়ে শুরু হয় তাদের তুমুল ঘোড়দৌড়। ফলে হানিমুনের ছিটেফোঁটাও  জোটেনি তাদের ভাগ্যে। কোনো ফাঁকফোকর পায়নি সে আসন নেওয়ার। তবে বন্ধু-বান্ধবীর কাছে শোনা – সে এক মৌজ-মাস্তির যুবধর্ম। বর-কনের ইচ্ছাঘুড়িতে ভর। কিন্তু এই ভারি বয়সে আলম কাঠমান্ডুতে নেমে হানিমুন-ভাবে সওয়ার হয়। তার সব ডালপালায় চড়তে চায়। কোনোটাই যেন তার বাকি রাখা চলবে না।

তাই রাস্তায় হাজারো লোকজনের সামনে আবদার জোরে – ‘এসো, হাত ধরে হাঁটি। এখানে কে দেখবে।’ রুবিকে তখন নয়াবধূর মতো বরের বগলতলায় হাত ঢুকিয়ে রাস্তা পাড়ি দিতে হয়। ট্যাক্সিতে যখন-তখন ঘাড়ের ওপর দিয়ে আলম হাত চালান করে। ট্যাক্সিঅলা হাঁ হয়ে মুখ ঘুরিয়ে – ‘দ্যাখো, বুড়োবুড়ির ভিমরতি।’ কিন্তু আলম নির্বিকার। মুখের কাছে মুখ এনে কথা বলে। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে ডাকে – ‘এসো, চুমু খাই। বিশ্ববাসী দেখুক।’ লজ্জায় রুবি জড়োসড়ো হয়। তা কাটাতে আলম কুড়াল চালায় – ‘ছাড়ো, ওসব, সাতটা দিনই তো।’ ফলে রুবিকেও স্বামীর সঙ্গে পায়ে পা ফেলে এগোতে হয়।

আলমের টুকটাক অভ্যাস আছে। বন্ধুদের পাল্লায় ধরা দিয়ে মাঝেমধ্যে বারে ঢুঁ মারে। রুবির কিন্তু কখনো চাখার কিংবা দু-এক চুমুক দেওয়ার ইচ্ছা হয়নি। কিন্তু কাঠমান্ডুতে এসে আলম হোটেলরুমেই আসর বসায়। পানি-সোডা-কোক মিলিয়ে সুস্বাদু গ্লাস বানায়। স্বামীর সঙ্গে তখন রুবিকেও দু-চার পেগে গলা মেলাতে হয়। তারপর শুরু হয় বিছানায় আলমের হুল্লোড়, নতুন বিহার; অভিনব আসনে রুবি একবারে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে। তবে পাতজুড়ে তার অনাস্বাদিত স্বাদের আনাগোনাকেও অস্বীকার করতে পারে না।

এখনকার নতুন বর-কনেরা ঝাড়া হাত-পায়ে সুখ পুষতে চায়। তাই দু-চার বছরের আগে জোড়ায় তালি লাগাতে অনিচ্ছুক তারা। একসময় ছিল হানিমুনের মেইন কোর্স, মূল প্রতিপাদ্য – ফিরে শ্বশুর-শাশুড়িকে নাতি-নাতনি আগমনের সুসংবাদ দেওয়া। আলম যেন সে-শাখায়ও চড়তে চায়। তাতে জাঁকিয়ে বসার আয়োজন করে – পুরো সাতদিন প্রোটেকশনবিহীন ঘোড়া দাবড়ায়। বিছানায় ঝাঁপাঝাঁপিতে মাতে। রুবি সামান্য ঘাড় বাঁকাতে যায়। আলম তাও সোজা করে – ‘ঠুলি-মুলি ছাড়ো। রস-কসহীন ছ্যাবা ছ্যাবা মনে হয়।’

ফলে রুবিকে শঙ্কায় জাপটায়। কেননা, তার বয়স বহু পথ হাঁটলেও কোনোকিছুতে স্থায়ী কলুপ অাঁটার নিশ্চিত সড়কে ওঠেনি। এখনো মাসে মাসে দিনতিনেক প্যাড ব্যবহার করতে হয়। তাই দেশে ফিরে ভয়ে ভয়ে থাকে। এ-বয়সে একটা কিছু হলে আলম তো উদ্বাহু-নৃত্যে নাচবে ঠিকই; কিন্তু বড় বড় ছেলেমেয়ের সামনে তার নিজের পেট বেলুনি রূপ ধরলে লজ্জাশরমকে  আর এড়ানো যাবে না। সে চোখ-মুখ মেলে হাজির হবে। কিন্তু সপ্তাহ দুই পরে সেনোরার নতুন প্যাকেট খোলার দরকার পড়লে স্বস্তি হাত-পা মেলে – আহ! নিশ্চিন্ত, ভাগ্যিস এতবড়, টানা সাতদিনের ঝড়ঝাপটা একবারও মুখোমুখি বয়নি। নিশ্চয়ই ডানে কিংবা বাঁয়ে মুখ ঘুরিয়ে পাশ কেটে গেছে।

নেপাল ট্যুরের আগে উঁকি মারা খটকা ফেরার দুদিন পর আবার দরজায় এসে দাঁড়ায়। রুবি তা স্পষ্ট দেখতে পায়। কারণ আলম কাঁচাবাজারের ব্যাগের জন্য হাত পাতে। শুক্রবার সকালে নাস্তার বুঝব্যবস্থা শেষে হাত বাড়ায় – ‘দাও, ব্যাগ দাও। কাঁচাবাজারটা সেরে আসি।’

রুবি হাতের কাজ, আলমারির কাপড়-চোপড় গোছগাছ করা রেখে স্বামীর পানে ফেরে – অ্যাঁ! কী বলছে ও? কাঁচাবাজারে যাবে? আলু-পটোল, কাঁচকি-গুঁড়া মাছের মুখোমুখি হবে? কিন্তু সে তো ওর শত্রুপক্ষের ময়দান। ফলা-হাতে খাড়া হাজারো ঘাতক। পা দিলেই বুক এফোঁড়-ওফোঁড়। তাই বিশ বছরের সংসারে বিশদিনও তাকে সে-কুরুক্ষেত্রে পাঠানো যায়নি। আর আজ কিনা নিজেই ব্যাগ চায়। এত বছরের শর্ত ভাঙতে হাত বাড়ায়?

মনে আছে, বিয়ের পরপরই আলম লম্বাহাতি শর্ত হাজির করে – বেলায় বেলায় ডাল-ভাত, আলু-ডিম তাও ভালো। তবে নিত্য বাজারপূজার প্রসাদ চাই না। কিস্তি-পথে আসা ফ্রিজ বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোয় নিত্যপূজা থেকে বাঁচা। তবে সপ্তাহে সপ্তাহে? তা রুবিই সামলায়। ব্যস্ততা অসুস্থতায় স্বামীর হাতে ব্যাগ তুলে দিয়ে দেখেছে, কোনো সুফল হয়নি। আলু-পটোলের সাক্ষাৎ মেলেনি। বরং পাড়ার দোকানের ডিম-ডালে বেলার পর বেলা পাড়ি দিতে হয়েছে। আজ তাহলে ব্যাগ চাওয়া, কাঁচাবাজারে যাওয়ার সখ কেন? রুবিকে অবাকে না পেয়ে পারে না।

একবার ভাবে, সঙ্গে যাই; দুজনে মিলে সেরে আসি। ওকে একা ভালোমানুষ পেয়ে দোকানিরা ভোলাবে। বাসি-পচায় ব্যাগকে বুঝ দেবে। তাছাড়া অভ্যাস নেই, তাই মাছ-মাংস, শাক-সবজি থেকে আদা-হলুদ-জিরার এত লম্বা-চওড়া ফর্দ, তার সবাইকে তুষ্ট করা, মনে করে মিলিয়ে আনা কী এই বয়সে ওর পক্ষে সম্ভব হবে? শেষে অবশ্য রুবি ঘাড় ঘোরায় – না, থাক। একাই যাক। দেখি কী করে। দরকার হলে বিকেলে নিজেই আরেকবার যাবে। তাই স্বামীর হাতে ব্যাগ তুলে দিয়ে রুবি বাসায় ওঁৎ পেতে থাকে।

ফিরে এলে নিজেই আবার ব্যাগ ধরে। স্বামীর সখের বাজার! কাজের মেয়েটার ওপর ভরসাতে তাই থিতু রাখে না। ব্যাগ থেকে একটা একটা আইটেম তোলে – ও মা, হিসাবমতো দেখি সবাই তুষ্ট। সব হাজির। কোনোটাই বাদ নেই। আবার তরতাজাও বটে। শাকসবজির গায়ে-গতরে যৌবন, মাছেরা সপ্রাণ। কিন্তু একি এনেছে? রুবি পলিথিনে মোড়া প্যাকেটটা আলাদা রাখে। এটা তো কোনো তালিকায় ছিল না। ভুলেও মুখে আনেনি।

আলমের নিজের একদম অপছনদ। যে-হাঁড়িতে রান্না, তাতেও সুচিবাই। তার অন্য তরকারিও মুখে নেয় না। আর রান্নার বিদ্ঘুটে উৎপাত, বিকট গন্ধ আরো অসহ্য। তাই যখন বাসায় থাকে না, তখন কেবল হাঁড়িতে তোলা সম্ভব হয়। অথচ রুবির দারুণ পছন্দ। রান্নায়ও ওস্তাদ। মুখে দিলে মোমের মতো গলে। তার মানে শুধু বউকে খুশি করতে আনা? রুবি চ্যাঁপা শুঁটকির প্যাকেটটা তুলে রাখে। আলমের ফিল্ড-ট্রিপের সময় তার বাকি ব্যবস্থা। মোম বানিয়ে গালে তোলা যাবে।

দুবেলা স্কুল করে আবার কিচেন-শাসন রুবির পক্ষে সম্ভব হয় না। বাসার হেঁসেল তাই কাজের মেয়েটা সামলায়। বছরতিনেক ট্রেনিং শেষে এখন ভালোই পারে। কিন্তু আজ ওর হাতের যত্নের বাজার। রুবি তাই নিজেই গলায় ডোরাকাটা অ্যাপ্রন ঝোলায়। চুলার মুখকে হাঁড়িতে তুষ্ট করে।

বিয়ের আগে কিংবা পরে, রুবির যতটুকু জানা, আলমকে কখনো মসজিদে পায়নি। তাকে কেবলামুখী হতে দেখেনি কখনো। কিন্তু এখন খাদ বদলের কাল, পাশ ফেরার পালা। কোনদিকে যে ধায়? কোন খাতে যে বয়? আজ শুক্রবার, আলম কি জুমার পথ ধরবে? তাহলে তো ওকেও হিজাব নিতে হবে। কারণ স্বামীকে মসজিদে পেলে, ঘোমটা কি বউকে ছাড়বে? দেখা যাবে, রাস্তাঘাটে চলমান কালো ভূতপ্রেতের সঙ্গে রফাদফা করে ওকে চলতে হচ্ছে। তাই রুবি কিচেন থেকে আড়চোখটা আলমের ওপর বিছিয়ে রাখে। ডালের ডালনা রান্নার ফাঁকফোকরে বার-দুই ড্রয়িংরুমে চক্কর খায়।

না, আলমের জুমায় যাওয়ার কোনো আয়োজন নেই। সে বরং টিভি-রিমোটে থিতু। ছেলেমেয়ের সঙ্গে ইংরেজি মুভিতে মশগুল।

টেবিলে খাবার দিলে আলম নিজেরটা সেরে উঠে যায়। ডানে-বাঁয়ে তার চোখ পড়ে না। তাই বাকিদের পারাপারের মাঝি রুবি। ডেকে এনে সবাইকে বসায়। সবশেষে তার নিজের পালা। চিরাচরিত বাঙালি গৃহিণীপনার ষোলো আনা পালন করতে হয়। আজ অবশ্য আলম নিজেই হাল ধরে। সকলকে ডেকে নিয়ে বসে। রুবির গোসল-শাওয়ারের সময়টায় ওয়েটও করে। বিশ বছরের মাথায় স্বামীর সংসারে মন। রুবির ভালোই লাগে। তার ভার কমে। তবে এতটা গা-ঘেঁষা, রুবির চৌহদ্দিতে নাক আগানো কেমন বেমানান মনে হয়। তা বলতে গেলে কোন কথায় কোথায় ঘা লাগে, শেষে সংসারি মনটা ভেঙে চার টুকরায় মুখ ব্যাদায়। আবার আগের ধারায় ফিরে যায়। তাই কিছু বলে না। বরং স্বামীর পাতে রুবি কালিয়ার আরো এক পিস তুলে দেয়। আলমও এগোয় – ‘তোমার হাতে জাদু আছে। সামান্য সবজির ঘণ্ট তাও যেন অমৃত। মাংসের বড়াটাও মার্ভেলাস।’

রান্না কি আজ রুবি নতুন করে? একসময় তো ছিল নিয়মিত। এখনো সময়-সুযোগ মুখ ফেরালে খুন্তি হাতে নেয়। চুলায় হাঁড়ি বসায়। অথচ এই প্রথম স্বামীর সার্টিফিকেট। প্রশংসায় মুখ খোলা। তাও ভালো, বেটার লেট দ্যান নেভার, মোটে নার চেয়ে বিলম্বে। রুবি এবার নিজের পাতে আরেক প্রস্ত ডালনা নিয়ে মুখ তোলে।

আর ঠিক তখন, এতক্ষণ যেন তাক করা ছিল। মুখ তোলায় সই পেয়ে আলম ফলাটা ছোড়ে – ‘চলো, নন্দন পার্কে যাই।’ তার ঘায়ে রুবি এফোঁড়-ওফোঁড়ে স্থির হয়ে যায়। মাখানো গ্রাস হাতেই থির থাকে। মুখের তহবিলে আর জমা হয় না। একগোছা বকচুল গাঁথা ময়দানি মাথা নিয়ে আলম পার্কে যেতে চায়? নধর-নবীনের ফুর্তি ফোয়ারায় মাততে চায়?  এমন খাপছাড়া পথে হাঁটার লোক আলম নয়। নিশ্চয়ই তারে কোনো রোগে ধরেছে। ভয়াবহ কঠিন সে-রোগ। রুবি নিশ্চিত ধারণায় দৃঢ় হয়।

শাহবাগের শিশু পার্কের তখন কেবল দ্বারোদ্ঘাটন। ক্যাম্পাসের ছেলেমেয়েদের ফুটপাতজুড়ে লম্বা লাইন। দেখে এসে তিনদিন ধরে তার হাতি-ঘোড়ার গল্প। অথচ আলম-রুবির কেবল সামনে দিয়ে হাত ধরাধরিতে আসা-যাওয়া সার। কতদিন বায়নায় হাত অাঁকড়েছে – ‘চলো, ঢুকি। ভেতরে নাকি আজব আজব সব খেলাধুলার আয়োজন।’ আলম হাত ছাড়িয়েছে – ‘বাচ্চাকাচ্চাদের রাজ্য। ওদের সব খেলনাপাতি। তোমার আমার মতো আইবুড়োদের ভার সইবে না।’

– দ্যাখো! ছেলেবুড়ো সবাই যাচ্ছে। তাদের কতবড় লাইন।

– তোমার মন চাইলে তুমি যাও।

রুবি গেছে, বান্ধবীদের সঙ্গে জোট বেঁধে। তারপর পালা-পার্বণে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। কিন্তু আলমের বাঁকা ঘাড় সোজা হয়নি। কখনো এসব খেলনা-পার্কে পা রাখেনি। কিন্তু আজ নন্দনে কেন?  সে তো চেহারা-সুরতে, সুর-স্বরে শিশু পার্কের বাপ।

–        ওদের নিয়ে যাব। কাল শনিবার, সবার ছুটি। তুমিও চলো।

তার মানে ছেলেমেয়েদের আগেই রাজি করানো সারা। এখন বউকে। রুবি খাওয়া শেষ করে। কিন্তু স্বামীর পানে না ফিরে কেবল আড়চোখ রাখে – চলো, দেখি কত দূরে হাঁটো, কতখানি পাশ ফেরো।

পার্কে যেন অনুষ্ঠিত হয় আলমের ছেলেমানুষি উৎসব। রুমি-সুমির উচ্ছ্বাসের পাল্লায় সে নিজেকে তোলে। রোলার কোস্টারে বাচ্চাছেলের মতো দুহাত তোলে হইহইয়ে মাতে। ক্যাবল-কারে ছেলেমেয়ের সামনেই দুহাতে বউকে জাপটায়। তবে দু-একটা রাইডের পর রুবির শরীর বেঁকে বসে। আর কোনোটায় তার পা ওঠে না। ওদের পিছু পিছু ব্যাগ বয়। কিন্তু আলমের উৎসাহ-উচ্ছ্ববাসে কোনো ভাটার লক্ষণ দেখা দেয় না। বরং জোয়াড়ি জলে একটার পর একটা রাইড সে ডুবায়। চড়ে বসে। নাগরদোলার চূড়ায় গিয়ে ফ্লাইং কিসে নিচে বউকে ধরে। কার-রেসে রুমি-সুমিকে হারায়। তারাও একসময় হাঁসফাঁসায়, ঘন নিশ্বাসে লেপটায়। কিন্তু আলম তাদের টানে – ‘আয় ওয়াটার রাইডে নামি। রোলার কোস্টারের আবার টিকিট কিনি।’

ফেরার পথে ট্যাক্সিতে রুবি আলমের পাশে। শরীরে সারাদিনের দৌড়ঝাঁপের রেশ, মৃদু কম্পন যেনবা। তবে তার উচ্ছ্বাসের স্রোত প্রবলবেগে বহমান। উত্তরা পাড়ির পর তাই রাস্তার কূল ছাপায় – ‘পথে কাবাবের ঘর। চলো নামি।’ রুমি-সুমি হাততালিতে সাড়া জাগায়। রুবি গা মোড়ামুড়ির পর নামে। খেতে বসে আলম দেদার অর্ডার হাঁকায়। নিজে যা খায় তার দ্বিগুণ ছেলেমেয়ে ও বউয়ের পাতে তোলে – ‘খাও, এদের কাবাবটা আইসক্রিমের মতো মোলায়েম। সন্দেশের মতো স্বাদ, তাই না?’

পরিচয়ের পর, এমনকি গাঁটছড়া বেঁধে থিতু হয়েও রুবি বহুবার বায়নায় মুখ খুলেছে। বনেদিপনায় হাত পাকানো হোটেল-রেস্তোরাঁয় খেতে চেয়েছে। আলম তখন বাঁধা জবাবে বুঝ দিয়েছে – ‘কাবাব-কোপ্তার স্বভাব-চরিত্র পাঠান-মোগলি। তার চাই শক্তমোক্ত পেট। আমাদের মতো বাঙালির নরম পাকস্থলীর ঘাড়ে তাকে চাপাবে কেন? শেষে দ্যাখবে সইতে পারবে না।’ আজ তা মোলায়েমে সন্দেশ, মনোহরা আইসক্রিম হলো কী করে? রুবি খেতে খেতে স্বামীর পানে ঘাড় ঘোরায়। সত্যিই আলমের খাদ বদলে গেছে। পাল্টে গেছে তার ভাব-স্বভাব এমনকি মুখের স্বর-সোহবত। কিন্তু কোনো ঝড়ঝঞ্ঝা নেই, নেই ভূমিকম্পের লেশ। তার পরও কেন এতবড় গহিন খাদ বদল? কেন পাশ ফিরে উল্টোদিকে মুখ ফেরানো? রুবি উত্তরের আশায় দেয়ালে মাথা খোঁড়ে। রক্তাক্তে কপাল ফাটায়। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পায় না। তবে স্বস্তির – এখনো হাতের নাগালে। ছেলেমেয়ে-বউয়ে সীমিত। যদি তার বাইরে যায়? নতুন কোনো খাদ পাতে? ঘর তোলে? বয়সটা এখনো ভয়ংকর। বিপদসীমায় বহমান। রুবি শঙ্কায় কাঁপে। ট্যাক্সিতে স্বামীর আরো গা-ঘেঁষে। রাতে বিছানায় এখনো ওর নেপাল ট্যুরের রেশ। নতুন বিহার, আজব আসন চায়। ভারী শরীর নিয়ে অনেক সময় তার সঙ্গে তাল মেলানো সম্ভব হয় না। নিজের মতো কাঠ হয়ে পড়ে থাকে। না, আলমের শরীরে শরীর ঘেঁষে রুবি নিজের মোড় ঘোরায় – যখন যেভাবে চাইবে…।

সপ্তাহ না ঘুরতেই যেন তার ফল পায়। আলম ভারী সোনার একগাছা হার নিয়ে হাজির হয়। রুবি হাতে তোলে – কমপক্ষে ভরি পাঁচেকের আলাপ। যার একগাছা সুতো কেনায় অনীহা – ‘দোকানওলার সঙ্গে কথার কোস্তাকুস্তি, মারপ্যাঁচ খেলায় মুখ ছোটাতে পারব না। তুমি স্কুল থেকে ফেরার পথে নিয়ে এসো।’  আর সঙ্গে যাওয়া, বউয়ের পিছে পিছে ব্যাগ বওয়া, সে আরো অসহ্য – ‘বাজারের মিন্তিরও অধম। সে বেচারা তবু দুপয়সা পায়।’ তাই সংসারের যাবতীয় কেনাকাটা, কিচেনের ন্যাকড়া থেকে আলমের শার্ট-প্যান্ট-পাঞ্জাবি, সব রুবির হাত ধরে ব্যাগে মুখ গুঁজে তবে বাসায় ঢোকে।

অথচ দ্যাখো, এত বড়, পাঁচ ভরি সোনার হারের শপিং, হাতি কেনার সমান, তা একটু জানলও না। নিজে নিজে একাই কিনে নিয়ে এলো? নিশ্চয়ই বউকে চমকে দেওয়ার মতলব। তাকে খুশিতে মাখামাখি করার সদিচ্ছা।

নাকি পারফরম্যান্স বোনাস? তিন রাতেই এত মোটা হার, বিশাল ভারি অঙ্ক? রুবি স্বামীর মুখোমুখি দাঁড়ায়। আলম ঘুরিয়ে দেয় – ‘দাও, পরিয়ে দিই। তোমাকে রানীর মতো মানাবে।’ রুবি পেছন ফেরে। আলম হারছড়া গলায় ফেলে পেছনে পিন অাঁটে। একেবারে বাংলা সিনেমার দৃশ্য। ভাগ্যিস দরজার ছিটকিনি তোলা। ছেলেমেয়ের চোখের নাগালের বাইরে। সুযোগ পেয়ে তাই আহ্লাদ গলার কাছে উঠে আসে। রুবি তাকে আর দমিয়ে রাখতে পারে না। বরং তাতে ঢাকতে যায় স্বামীকে। ঘুরে দুহাতে জাপটায় বুকে – আজ না চাইলেও পাবে। একেবারে সবটা খোলা, পুরাটা মেলা।

খুলে রাখার আগে রুবি ড্রেসিং-টেবিলের মুখোমুখি দাঁড়ায়। আয়নায় হারগোছার ওপর নজর বোলায়। ঘনিষ্ঠতায় কাছে নেয়। স্নেহমমতায় গায়ে হাত বোলায় – বাহ! কী মিহিবুনন। ডিজাইনটাও হাল ফ্যাশনেবল। নাহ! এ-বয়সেও আলমের রুচিতে ঘাটতি নেই।

আর দাম! তাও নিশ্চয়ই পরিপূর্ণ, ভরা। আকাশ ছুঁইছুঁই দশা। এবার রুবি খাদ বদলায়। তার হিসেবি মন অঙ্কের খাতা খোলে। অনেকদিন জুয়েলারিতে যাতায়াত নেই। তার মেজাজমর্জি তাই অজানা। তবে পত্র-পত্রিকায় দেখা, কলিগদের মুখে শোনা – আজকাল নাকি তার পাছা বেশ ভারি। লাখ ছুঁইছুঁই ভরি। তাহলে এই সুডৌল সুকন্যা নিশ্চয়ই লাখের পর লাখের কমে ভোলেনি। জুয়েলারির দরজা পার হয়নি। তার আগে নেপাল ট্যুর, নন্দন পার্ক জয়, কাবাব ঘর গুলজার আর ছেলেমেয়েদের বায়নাক্কা মেরামত – সব যোগ করলে তো রাজভান্ডারের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়; কিন্তু তার এক টুকরাও রুবি বয়নি। সবটাই আলমের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে পাড়ি। তাহলে ওর ঘাড় হঠাৎ এত পাকাপোক্ত হলো কী করে? বেতনের পুরোটাই বউয়ের হাতে তুলে দেয়। শুধু পকেট খরচটা রাখে। সে আর কত? দু-চার হাজার মাত্র। তাতে কী রাজভান্ডারের খোরাক মেটে? তাকে কি বুঝ দেওয়া যায়? তাহলে? আলম কি কোনো টাকার খনি হাতড়ে পেয়েছে? কোনো গুপ্তধনের সন্ধান?

রুবি আবার স্বামীপানে ফেরে – তোমার টাঁকশালটা কোথায়, বলো তো, আমরাও দু-চার লাখ বানাই।

­- তোমায় বলা হয়নি। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে। কারণ অসুখটার এখন ফাইনাল স্টেজে পা। সে কিউরের পার ছেড়ে নাগালের বাইরে, ওপাড়ের পথে। ওইপারের কাছাকাছি এখন। মাস দু্-চার হয়তো বাকি। তাই প্রভিডেন্ট ফান্ড, এত বছরের চাকরি, মোটাতাজায় কম তো নয়, তারে ঘাড় ধরে কাজে নামিয়েছি। সে বেহুদা চিকিৎসার মাঠে গড়াগড়ি না দিয়ে স্মৃতিগড়ায় মন দিয়েছে। দেখলে তো, এ কদিনে তার গা-গতরে বেশ মাংস লেগেছে। এখন দ্যাখো, কী নাদুসনুদুস। আমি না থাকলেও তাকে নিয়ে খেলায়, নাড়াচাড়ায় তোমাদের ভালো কাল কাটবে।