স্মৃতি

আহমাদ মোস্তফা কামাল

মা নেই, মায়ের স্পর্শ যেন লেগে আছে এখনো, এই ঘরে। মুনীর ঘুরে-ঘুরে দ্যাখে – যে-চেয়ারে মা বসতেন, যে-বিছানায় ঘুমাতেন, সেগুলোতে আলতো করে হাত বুলায়, যেন মাকেই ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দেখছে সে, এভাবে। মায়ের তসবি, জায়নামাজ, পানের বাটা, রুমাল, তোয়ালে সব রয়ে গেছে তেমনই, যেমনভাবে তিনি রেখে গিয়েছিলেন। দেখে মনে হয়, মা গেছেন পাশের ঘরে, যেন এখনই এসে বলে উঠবেন – ‘তসবিটা দে তো বাবা, রাখি এক জায়গায়, চলে যায় অন্য জায়গায়। কে যে দুষ্টুমিটা করে!’

‘কে আর করবে! তোমার নাতি-নাতনিরা আছে না?’

‘আরে নাহ। ওরা আমাকে জ্বালায় না। এই বাসায় জিন-ভূত আছে।’

‘জিন-ভূত থাকলেও তোমার কাছে আসবে না মা। সারাদিন কী সব দোয়া-দরুদ পড়ো, ওরা তো ভয়েই পালাবে।’

জিন-ভূতের কথাটা কথার কথা। নাতি-নাতনিদের কাঁধ থেকে দোষ অন্য কোথাও চাপাতে হবে না? ওদের এতটুকু বকলেও মা রেগে যান, মন খারাপ করে থাকেন। মুনীর অথবা তার ভাইদের কেউ হয়তো বলে – ‘এত রাগ করো কেন, মা? আমরা তোমার বকা খেয়েছি না? মা-বাবা তো একটু বকেই।’

‘দাদু হলে বুঝবি।’

একবাক্যে মায়ের বক্তব্য শেষ। হ্যঁা, দাদা-দাদি না হলে হয়তো এই অবুঝ-অন্ধ-প্রশ্নহীন স্নেহের ব্যাপারটা বোঝা যায় না। তাদের দাদিও তো এরকম কত কা- করতেন! মা কিংবা বাবা ছেলেমেয়েদের একটু বকলেই দাদু কাঁদতে শুরু করতেন। শুধু কেঁদেই ক্ষান্ত হতেন না, এমনসব কথা বলতেন, যাকে ইমোশনাল বস্নø¨vকমেইলিং ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। যেমন – ‘আসলে আমাকেই বকতে চায়, পারে না, তাই ছেলেমেয়েদের ওপর দিয়ে রাগ ঝাড়ে। বুড়ো হয়েছি, কাঁধে চেপে বসেছি, না পারে ফেলতে, না পারে রাখতে। গলার কাঁটা। না পারে গিলতে, না পারে উগরাতে। বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিয়ে এলেই পারিস। টুঁ শব্দটি করব না। কেউ টেরও পাবে না। লোকে মনে করবে আবর্জনার বস্তা ফেলে দিয়ে এলো…’

একা-একাই এসব ভয়ংকর কথা বলতেন দাদু। তখন কেউ আর কোনো কথা বলত না, বলার সাহসই পেত না আসলে। অথচ মা-বাবা কী যে যত্ন

করতেন তাঁর, এতটুকু অসুবিধা হতে দিতেন না। দাদুর অন্য কোনো অভিযোগও ছিল না এসব নিয়ে, কেবল নাতি-নাতনিদের কেউ বকলেই শুরু হয়ে যেত এসব বকবকানি। কেউ শুনলে নির্ঘাৎ ভাবত –  তাঁকে কতই না কষ্টে রেখেছে তাঁর ছেলে আর ছেলের বউ। বাবা ফিসফিসিয়ে মাকে বলতেন – ‘মা তো আবার ক্ষেপেছে। থামাবে কে?’

‘তুমি থামাও।’

‘আমি পারব না। তুমি যাও।’

‘তা তো পারবেই না। রাগিয়েছ তুমি, এখন আমাকে কতগুলো বকা খেতে হবে।’

মা গিয়ে হয়তো বলতেন – ‘নামাজ পড়েছেন মা? ভাত খাওয়ার সময় হয়ে গেছে তো!’

‘আর খাওয়া! ভাতের বদলে বিষ দাও, খেয়ে মরি।’

‘ছি মা! এসব বললে লোকে কী ভাববে?’

‘কী আর ভাববে! তোমরা যা করছ, তাতে লোকের ভাবায় আর কী আসে যায়!’

‘আচ্ছা মা, ছেলেমেয়েরা দুষ্টুমি করলে একটু না বকলে চলে?’

‘ওরা দুষ্টুমি করে? কত্ত ভালো ওরা। কত্ত লক্ষ্মী।’

‘পড়াশোনা করতে চায় না…’

‘দরকার নাই পড়াশোনার। ওই অতটুকুন বাচ্চা, পড়াশোনার কী বোঝে?’

‘আচ্ছা ঠিক আছে মা, আর বকব না। এখন উঠুন তো! আপনি না খেলে তো ওরাও খাবে না!’

খাওয়ার টেবিলে একদল নাতি-নাতনি নিয়ে বসে দাদুর ভিন্ন চেহারা। একটু আগে যে এত কথা বলেছেন, তার চিহ্নমাত্র নেই। হাসি-হাসি মুখ, গালভরা গল্প!

আহা, সেসব নির্মল-নির্ভার দিন! এক স্বচ্ছ, এত উজ্জ্বল যে, মনে হয় সেসব স্মৃতিতে কখনো কোনো দাগ লাগেনি, ধুলোও জমেনি এতটুকু।

মা যখন দাদি হলেন, তখন যেন ফিরে পেলেন নিজের শাশুড়ির রূপ। নাতি-নাতনিদের কেউ কিছু বললে আর রক্ষা নেই। এসব ব্যাপার কি ফিরে-ফিরে আসে? এই শর্তহীন মায়া-স্নেহ-ভালোবাসা? কোথায় থাকে এগুলো? মায়ের স্মৃতিচিহ্নগুলো ছুঁয়ে দেখতে-দেখতে এরকম কত কথা যে মনে পড়ে মুনীরের!

অথচ কতদিন হয়ে গেল মা চলে গেছেন! কতগুলো দিন! তাঁর মৃত্যুর সময় মুনীর ছিল দেশের বাইরে। এক মাসের একটা ট্রেনিং প্রোগ্রামে জার্মানিতে গিয়েছিল সে। তার অনেক আগে থেকেই মা অসুস্থ ছিলেন – প্রায় দুবছর ধরে শয্যাশায়ী। বহু চেষ্টাচরিত্র করেও আর সারিয়ে তোলা যায়নি। হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ডাক্তাররা, বলেছিলেন –  ‘বাসায় নিয়ে যান, যত্নআত্তি করেন, ছেলেমেয়ে-নাতি-নাতনি নিয়েই বরং ভালো থাকবেন তিনি।’ এমনকি, যে-ডাক্তার দীর্ঘকাল মায়ের চিকিৎসা করতেন, তিনিও এক-এক করে সব ওষুধ বন্ধ করে দিলেন। ওগুলো নাকি কোনো কাজই করছে না আর। বয়স হয়ে গিয়েছিল মায়ের। বার্ধক্য নাকি এমন এক রোগ যার কোনো চিকিৎসা নেই, ডাক্তাররা কেবল চেষ্টা করেন জীবনের শেষ দিনগুলোতে মানুষটার যেন একটু কম কষ্ট হয়, সেটি নিশ্চিত করতে। তারা – মুনীর এবং তার ভাইবোনরা – এই অনিবার্য বাস্তবতাটিকে মেনেও নিতে শুরু করেছিল, যদিও এই মেনে নেওয়াটাই কঠিন ব্যাপার। এই পরিবারের কেন্দ্রে ছিলেন মা। মুনীররা তিন ভাই, দুই বোন। বোনদের বিয়ের পর দূরে চলে গেলেও ভাইরা রয়েছে একসঙ্গেই। আড়াইতলা এই বাড়িতে তিনজনের সংসার, আবার বোনরা আসে মাঝে-মাঝে, আসে আত্মীয়স্বজনও, একটু চাপাচাপিই হয়। তিন ভাইয়ের সামর্থ্যও আছে এই পুরনো ধাঁচের বাড়িটি ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করার। সাড়ে তিন কাঠার পস্নøট, ছয়তলা বাড়ি সহজেই তোলা যাবে, নিচতলায় পার্কিংসহ অন্যান্য সুবিধাও রাখা যাবে। কিন্তু মায়ের অনুমোদন নেই তাতে। বাবা বহু কষ্ট করে এই বাড়িটা তুলেছেন, চারতলার ফাউন্ডেশন ছিল, দোতলা পর্যন্ত তুলতে পেরেছিলেন, হাউস বিল্ডিং থেকে নেওয়া ঋণের টাকা শেষ হয়ে যায় ওটুকু তুলতেই, পরে তিনতলায় কেবল একটা রুম তুলেছিলেন, আর পারেননি। আকস্মিক হার্টঅ্যাটাকে চলে গিয়েছিলেন তিনি। মায়ের ধারণা – বাড়ি করতে গিয়েই বাবার হার্টের অসুখটা হয়। এই বাড়ির প্রতিটি বিন্দুতে বাবার হাতের ছোঁয়া, বাবার রক্ত আর ঘাম মিশে আছে, মা সেটি নষ্ট করতে রাজি নন। চারতলার ফাউন্ডেশন তো দেওয়াই আছে, বাকি দুটো তলা তুলে নিলেই হয় – এই হলো মায়ের ইচ্ছা। এই বাড়ি তাদের অনেক দিয়েছে, এ-ও সত্য। বাবার হঠাৎ মৃত্যুর পর এই বাড়ির ভাড়াই ছিল পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস। নিচতলায় তারা সবাই থাকত, দোতলা ভাড়া, তিনতলার রুমটার সঙ্গে একটা বারান্দা, একটা কিচেন, আরেকটা বাথরুম জুড়ে দিয়ে সেটাও ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। এই সামান্য আয় দিয়ে কী কষ্ট করেই না মা সংসার চালিয়েছেন! ছেলেমেয়েরা বড় হতে লাগল, এক-এক করে পড়াশোনা শেষ করল সবাই, চাকরিতে ঢুকল আর সংসারের চেহারা আবার বদলাতে লাগল। মেয়েদের বিয়ে হলো, ছেলেদের বউ এলো ঘরে, তাদের ছেলেমেয়ে হলো, মায়ের ঘর হয়ে উঠল চাঁদের হাট। মা ওভাবেই বলতেন। ভাড়াটিয়াদের উঠিয়ে দিয়ে দোতলা আর তিলতলার চিলেকোঠায় ভাগাভাগি করে নিল বড় দুই ভাই, মুনীর রইল মায়ের সঙ্গে নিচতলায়।

পুরনো ধাঁচের এই বাড়িটিতে আরো টাকা ঢালার কোনো মানেই হয় না। বাবা যে বাড়িটা নিয়ে খুব বেশি পরিকল্পনা করেননি ডিজাইন দেখেই তা বোঝা যায়। কোনো আর্কিটেক্ট তো এরকম ডিজাইনের কথা ভাবতেই পারবেন না, একটু ভালো ডিজাইনাররাও এর চেয়ে ভালো চিন্তা করবেন। ছোট্ট পস্নøট, তার ওপর এলোমেলো ডিজাইনের ফলে জায়গা যেমন নষ্ট হয়েছে, আলো-বাতাসও তেমন একটা ঢোকে না। ফলে মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তারা যেমন নতুন করে তৈরি করার উদ্যোগ নেয়নি, তেমনই কোনোরকম সংস্কারের কথাও ভাবেনি। থাকুক যেমন আছে তেমনই। এরকম ভাবনা কি তাদের মনের মধ্যে ছিল যে, মা তো একসময় থাকবেন না, তখন নতুন করে ভাবা যাবে? কেউ কাউকে বলেনি সে-কথা, কিন্তু ছিল তো বটেই। মা থাকতেই যেহেতু এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে, মায়ের অনুমতি আদায়ের চেষ্টা করা হয়েছে, সেই চিন্তাটা তো আর মরে যায়নি! কী নিষ্ঠুর একটা চিন্তা, তুমি বেঁচে আছো বলে আমরা তোমার এই আবেগের মূল্য দিচ্ছি, যখন থাকবে না তখন এই আবেগ খেলো হয়ে যাবে আমাদের কাছে! কথাটা ভাবলেই একটা অদ্ভুত অপরাধবোধ হয় মুনীরের। অবশ্য তার অপরাধবোধ আছে আরো অনেক বিষয় নিয়েও। মা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকার ফলে শেষের দিকে সে খানিকটা ক্লান্ত এবং হয়তো কিছুটা বিরক্তও হয়ে উঠেছিল। না, কাউকে বুঝতে দেয়নি মুনীর, মাকে তো নয়ই, কিন্তু সে নিজে জানে এ-কথা। প্রথম একটা বছর শুধু চেষ্টাই করে গেছে মাকে সুস্থ করে তোলার জন্য, তারা সবাই মিলে। যখন ডাক্তাররা একেবারে আশা-ভরসা ছেড়ে দিলেন, তখন থেকেই শুরু হলো এক অদ্ভুত অপেক্ষা। যেহেতু সুস্থ হওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই, অপেক্ষাটা তাই তাঁর চলে যাওয়ার জন্য। কী ভয়াবহ! না, মায়ের কোনো অযত্ন করেনি তারা, কখনো। ছেলেমেয়েরা তো বটেই, বউরা এবং নাতি-নাতনিরাও যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে তাঁর শেষ সময়টিকে আদর-যত্ন-মায়া ও ভালোবাসায় ভরে দিতে। কিন্তু এ-ও তো সত্যি, অনির্দিষ্ট কোনোকিছুর জন্য দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করা কঠিন। কেবলই মনে হতে থাকে, এর শেষ কোথায়? মায়ের পাশে কাউকে-না-কাউকে রাত জাগতে হয়, একা তো আর জেগে থাকা যায় না, অন্তত দুজনকে জাগতে হয়। অনির্দিষ্ট সময় ধরে এ-কাজটি করা এত সহজ ব্যাপার তো নয়! মাকে নিয়ে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই, আবার রেখেও যাওয়া যায় না। ফলে প্রায় সবারই বন্দিদশা। অফিস থেকে বাসা, বাসা থেকে অফিস – এই হলো বড়দের রুটিন। ছোটরাও স্কুল-কলেজে যায় বটে, কিন্তু অনেক দিন ধরে সবাই মিলে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় না। শুধু কি তাই? সারাক্ষণ একটা টেনশন, একটা অস্বসিত্ম মনের মধ্যে খচখচ করতে থাকে – কারো কোনো আচরণে মা কষ্ট পাচ্ছেন না তো! কখন কী হয়ে যায়, সেই দুশ্চিন্তাও মনের মধ্যে জেঁকে বসে থাকে। কোনো কাজে মন বসে না, কোথাও স্থির হয়ে দুদ- বসতে ভালো লাগে না, অফিসের কাজ এলোমেলো হয়ে যায়। হ্যাঁ, মুনীর ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এমন নয় যে, সারাক্ষণই ক্লান্ত থাকত সে, কিন্তু কখনো-কখনো খুব অবসাদগ্রস্ত মনে হতো নিজেকে। তো, ঠিক সেই সময়ে, ইউরোপে একটা ট্রেনিং প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য অফিস থেকে তার নাম প্রস্তাব করা হলে খুশি হওয়ার বদলে মুনীর খুব দ্বিধায় পড়ে যায়। ভেবে দেখার জন্য সময় চায় সে। মায়ের যে-অবস্থা তাতে যে-কোনো সময় যে-কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে, এ-অবস্থায় কি যাওয়া ঠিক হবে? যদি সত্যিই কিছু ঘটে যায় তাহলে নিজেকে তো সারাজীবনেও ক্ষমা করতে পারবে না। আবার এ-ও ভাবে যে, মায়ের অবস্থা অনেকদিন ধরেই ভালো না, এখন হয়তো একটু বেশি খারাপ, প্রায়ই স্মৃতিভ্রষ্ট হচ্ছেন, কথা বলতে গেলে জড়িয়ে যাচ্ছে, তার মানে তো এই নয় যে, এখনই তিনি চলে যাচ্ছেন! এই অবস্থায় ইউরোপে ট্রেনিংয়ের এ-সুযোগটা কি ছাড়া ঠিক হবে? এমনিতেই অনেক সুযোগ সে হাতছাড়া করেছে, বারবার এরকম করলে একসময় কেউ আর তাকে নিয়ে ভাববে না। নিজে-নিজে ভেবে কোনো সিদ্ধামেত্ম পৌঁছতে না পেরে মুনীর বউকে বলল ব্যাপারটা। কিন্তু সে-ও কোনো পরামর্শ দিতে পারল না। পরের দিন ভাইবোনদের সঙ্গে বসে আলাপ করল মুনীর। তারা একবাক্যে বলল, ‘যা ঘুরে আয়। এরকম সুযোগ বারবার আসে না। মাকে নিয়ে চিন্তা করিস না, আমরা সবাই তো আছি। আলস্নাহ ভরসা।’

ভাইবোনদের সমর্থন পেয়েও ঠিক স্বসিত্ম পেল না মুনীর, এবার তাই অনুমতির জন্য মায়ের কাছে গিয়েই বসল। মা সব কথা বোঝেন কিনা বোঝা যায় না, তবু সে সবকিছু বলল। শুনে, মা দুবার জিজ্ঞেস করলেন – ‘কোথায় যাবি?’ সে দুবারই উত্তর দিলো। মা জানতে চাইলেন – ‘কবে আসবি?’ সে জানাল – ‘একমাস পর।’ ‘ও!’ বলে কতক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বললেন – ‘আচ্ছা যা, তোকে আলস্নাহর হেফাজতে আমানত দিলাম।’

মায়ের অনুমতি পেয়েও তার মনের খুঁতখুঁতে ভাবটা গেল না। মনে হতে লাগল, মা তো এখন সবকিছু বোঝার অবস্থায় নেই, ছেলে যে একমাস তাঁর কাছে থাকবে না সেটি কি বুঝেশুনেই অনুমতি দিয়েছেন? দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই কয়েকদিন পর উড়াল দিলো মুনীর। সকালে ফ্লাইট ছিল, বাসা থেকে বেরোতে হলো ভোরে। মা তখন ঘুমাচ্ছিলেন, কয়েকবার ডেকেও সাড়া না পেয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করে সে বেরোল। মা চলে গেলেন তার দু-সপ্তাহের মাথায়। মুনীরকে খবর দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তার কিছুই করার ছিল না। একে তো ট্রেনিংয়ের ঠিক মাঝামাঝি সময়, তার ওপর আয়োজকদের ব্যবস্থাপনায় গিয়েছে বলে হঠাৎ করে ফিরে আসার সুযোগ তার ছিল না। মাকে শেষবারের মতো দেখতেও পারেনি সে।

ফিরে আসার পর সে উপলব্ধি করতে থাকে, মায়ের অনুপস্থিতিতে তার জীবন কতটা শূন্যতায় ভরে গেছে। অসুস্থ ছিলেন, বিছানায় পড়ে ছিলেন, তবু তো ছিলেন। একদিকে ভয়াবহ এক শূন্যতার অনুভূতি, অন্যদিকে নিজের দিকে ফিরে তাকালেই অপরাধবোধ। সে যে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, মাঝে-মাঝে বিরক্তি এসেও ভর করত, ট্রেনিংয়ে গিয়েছিল নিছক পেশার স্বার্থে নয়, বরং তার মনে হয়েছিল – আমার খানিকটা রিলিফ দরকার, এসব মনে হতে থাকে। মা কি কোনোভাবে তার ক্লামিত্ম, বিরক্তি, হাঁপিয়ে-ওঠা টের পেয়েছিলেন? সেজন্যই কি তার অনুপস্থিতিতে অভিমান নিয়ে চলে গেলেন? এসব অপরাধবোধ মুনীরকে কুরে-কুরে খায়। যন্ত্রণা আর মনের এসব বেয়াড়া প্রশ্ন থেকে মুক্তি মেলে না কিছুতেই, মায়ের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে খানিকটা সান্তবনা পাওয়ার জন্যই হয়তো-বা তাঁর ঘরটিকে সে অবিকল সেরকমই রেখে দেয়, যেমনটি তিনি রেখে গিয়েছিলেন। প্রতিদিন সেই ঘরে গিয়ে বসে সে, বিছানায় হাত বোলায়, মায়ের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দ্যাখে। যেন প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছে সে তার অকথিত অপরাধের।

কিন্তু এভাবে আর কতদিন? মা চলে যাওয়ার পর এই বাড়ি ভেঙে নতুন করে তোলার প্রসঙ্গটি চাপা পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু চিরদিন যে চাপা পড়ে থাকবে না, এ তো জানা কথাই। সবারই সংসার বড় হয়েছে, ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে, তাদের আলাদা রুম দরকার – এসব নানা প্রয়োজন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাছাড়া বোনদের প্রাপ্য অংশ বুঝিয়ে দেওয়া উচিত, তাদের তো আর কিছু নেই, এই বাড়িটাই নিজেরা মিলে নতুন ডিজাইনে তুললে অনায়াসে সবার জন্য দুটো করে অ্যাপার্টমেন্ট হয়ে যাবে। সেটা সবার জন্যই ভালো, সেটা পাওয়ার অধিকারও আছে সবার। তাছাড়া, তাদের সবারই বয়স হয়ে যাচ্ছে; এসব কাজ করার জন্য এখনই তো উপযুক্ত সময়। সে সবই বোঝে, তবু মায়ের এই ঘরটি আর থাকবে না ভাবতেই বুক ভেঙে আসে।

মুনীর সবার ছোট বলে তাকে একটু বিশেষভাবেই স্নেহ করে ভাইবোনরা। তার এই স্মৃতি-পাহারা দেওয়া কর্মকা– সবার সমর্থন না থাকলেও সহমর্মিতাটুকু তাই রয়েই গেছে। কিন্তু ওকে তো এই ভার চিরকাল বহন করতে দেওয়া যায় না! একদিন তাই ভাইবোনেরা বসে তাকে নিয়ে। গভীর মমতা মেখে বড় ভাই বলেন – ‘স্মৃতিকে এভাবে আঁকড়ে ধরতে নেই, খোকা। মানুষের মৃত্যু যেমন অমোঘ, ফেরানো যায় না, তেমনই স্মৃতির ওপর ধুলোর প্রলেপ পড়াটাও অমোঘ, ফেরানো যায় না। এই ধুলোটা পড়তে দিতে হয়। প্রকৃতি সেটাই চায়। নইলে তো মানুষ বাঁচতে পারত না। সব স্মৃতি জমা করে রাখলে স্মৃতির পাহাড় জমে যেত আর তার নিচে চাপা পড়ে মরে যেত মানুষ। প্রকৃতিই মানুষকে ভুলিয়ে দেয়, ভুলিয়ে রাখে। আমরা সবাই তোর কষ্টটা বুঝি, আমাদেরও কষ্ট লাগে, তবু আমরা চাই – তুই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আয়।’

হ্যাঁ, সে জানে। জানে যে, স্মৃতির পাহাড় জমাতে নেই। জানে যে, মানুষের ‘ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা পর্বতসমান হওয়া চাই।’ কিন্তু এ-ও জানে, মানুষ একটু-একটু করে স্মৃতি ভুলতে থাকে আর একটু-একটু করে মরে যেতে থাকে। স্মৃতিহীনতা মৃত্যুরই আরেক নাম। সে তাই বড় যত্ন করে স্মৃতিকে। যদিও সে জানে না, স্মৃতি আসলে কোথায় থাকে! মনে, নাকি বস্ত্তসামগ্রীতে? জানে না, কেন সে মায়ের স্পর্শধন্য জিনিসগুলোকেই আঁকড়ে ধরে রেখেছে! সে কি তবে বস্ত্তর মধ্যেই স্মৃতিকে খোঁজে? নিজের মনের ওপর আস্থা নেই তার? বস্ত্তগুলো হারিয়ে গেলে কি তবে মায়ের স্মৃতিগুলোও মুছে যাবে তার মন থেকে? না, সে জানে না এসব প্রশ্নের উত্তর। এসব ভয়ংকর প্রশ্নের সামনে নিজেকে দাঁড় করাতেও ভীষণ ভয় লাগে তার, ভীষণ ভয়।