হলদে ফুলের বিকেল

পা প ড়ি র হ মা ন
চৌকোনো আরশির ভেতর দিয়ে সাত্তার মিয়া একজোড়া চোখ দেখেছিল। চারপাশে তখন এতটাই হুলস্থূল আর ঠেলাঠেলি, হাসি-ঠাট্টার-উপচানো-স্রোত, উৎসুক-দৃষ্টি – সেসব এড়িয়ে সাত্তার মিয়ার অন্যকিছু দেখার উপায়ও ছিল না। কিন্তু সাত্তার মিয়া হাল ছাড়ে নাই। যতটুকু দেখা যায় তার চেয়েও অধিক-কিছু দেখবে বলে উদগ্রীব ছিল। শাহ্নজর বলে কথা! লোকে বলে শাহ্নজরের ওই এক পলকের দেখাও নাকি একশত এক দিবারাত্রির সমান। ফলে সাত্তার মিয়া মুখে প্রকাশ
না-করলেও মনে মনে মরিয়া ছিল একশত একরাত্রি হাসিল করার জন্য।
উজ্জ্বল আয়নার চারকোনা ফ্রেমের ভেতর নয়নের গোলগাল মুখটা ফুটন্ত শাপলার মতো স্থির ছিল। তার ক্ষুদ্রাকৃতি কপালের ওপর টায়রা-টিকলির ঝালর তিরতিরিয়ে দুলছিল – যেনবা ঢেউ ভেসে এসে নাড়িয়ে দিচ্ছিল ফুটন্ত ফুলের শোভা।
নয়নের কুচকুচে কালো ভ্রƒর ওপর রক্তবর্ণ কুমকুমের ফোঁটা – সারিবদ্ধভাবে গড়িয়ে নেমেছিল গালের গভীর টোলে। বাঁকানো ভ্রƒ-জোড়ার নিচে প্রায় নিমীলিত আঁখিদ্বয়। শুধু কাজলের কালো টানেই যারা ভ্রমরের মতো ডানা মেলে দিয়েছে। আর দীর্ঘ ঘনপল্লব ছায়া ফেলেছে চোখের নিচের পেলব অংশের ওপর। নয়নের পদ্ম-পাপড়ির মতো চোখের ওপর সাত্তার মিয়ার নজর সেঁটে রইল। যেন সে কোনো ক্লান্ত-ফড়িং। বিকেলের নিষ্প্রভ-রোদ্দুরে গাছের কোনো মৃত শাখায় বসে আছে। অন্যত্র উড়েটড়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও তার নাই। সাত্তার মিয়ার দৃষ্টি ক্লান্ত ফড়িঙের মতো বসে থাকলে কী হবে? চারপাশে তখন চিল্লাপাল্লা শুরু হয়েছে – ‘ও নওশা – আয়নার ভিতর দিয়া কী দেখেন?’ এমত জিজ্ঞাসায় সাত্তার মিয়া বিব্রত। এত ভিড়ভাট্টার মাঝে এমন জিজ্ঞাসার উত্তর কী? ফলে সাত্তার মিয়াও তবদা মেরে থাকে। ফের কে যেন কলকলিয়ে ওঠে – ‘ও নওশা আয়নার মইদ্যে দেখতাছেন কী?’
সাত্তার মিয়ার মনে হয় সে বলে দেয় –
‘তেমন কিছুই দেখতেছি না। দুইটা চক্ষুই খালি দেখতাছি। শাপলার ফুলের মতন চেহারায় ঢেউ-লাগা-চক্ষু!’
সাত্তার মিয়া ও-রকম বলে না। তার কেন যেন অস্বস্তি হয়। সে মনে মনে ভাবে – এমন কথা বললে সবাই তাকে পাগল ঠাওড়াবে। কিন্তু কী যে বলা উচিত সেটাও তার বুদ্ধিতে কুলায় না। ততক্ষণে ভিড়-করে-থাকা মানুষজন হেসে ওঠে। কে যেন ওই হাসির ফাঁক দিয়ে বলে ওঠে – ‘নওশার চক্ষুতে সমস্যা আছে বোধকরি।’
এক্ষণে সাত্তার মিয়া বিব্রত হয়। তার মাথার ভেতর কতকিছুই যেন গ-গোল পাকিয়ে যায়। ফলে সে পড়িমরি করে বলে বসে –
‘বকুলফুল দেখতাছি।’
এ-কথা বলার পর জোর-হাসির-রোল ওঠে।
সাত্তার মিয়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রুমালে মুখ ঢাকে। আর নয়নও যেন লাজুক হেসে মাথা নিচু করে। তক্ষুনি আয়নায় চৌকোনো ফ্রেম থেকে ফুটন্ত-শাপলা অদৃশ্য হয়ে যায়।
সারসের মতো গলা উঁচু করে সাত্তার মিয়া আয়নার ভেতর ফের তাকায়। মনে গোপন আশা – যদি আরেকবার নয়নের মুখটা দেখা যায়। কিন্তু ততক্ষণে আয়নাটাও অদৃশ্য হয়ে গেছে।
নতুন শাড়ির খসখস শব্দ তুলে কে যেন সাত্তার মিয়ার পাশে বসে। ভাবি-সম্পর্কীয় কেউ হবে হয়তো। সে কাঁপা কাঁপা-হাতে রুহআফজার শরবত সাত্তার মিয়ার সম্মুখে উঁচু করে ধরে। এই শরবত এখন নওশা তার স্ত্রীকে খাইয়ে দেবে। স্ত্রী এক চুমুক দেওয়ার পর সেই শরবত নওশা খাবে।
নওশাকে খাইয়ে দেবে নয়ন। আদতে নয়নের হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে খাইয়ে দেবে অন্য কেউ। এই শরবত খাওয়ানোর সময়ে নওশার মাথায় চটিচাট্টি মারা পুরনো রেওয়াজ। কোনোমতে নওশার নাসারন্ধ্রে বা পাঞ্জাবির জেল্লাতে রুহআফজা ফেলতে পারলে আর কথাই নাই। হাসি আর ঠাট্টায় বিয়েবাড়িটাই তখন মেতে উঠবে।
এসবই আদতে কায়দার কেরামতি দেখা। নতুন-জামাই চোখ বাঁকিয়ে-চুরিয়ে যতটা পারে বউকে দেখে নেবে। বা নওশাও কায়দা-কেতাবে কতটা দুরস্ত সেটা অন্যরা পরখ করে নেবে। মাথায় চটি-চাট্টি খেতে খেতে গ্লাসের শরবতে চুমুক দেয়ো নওশার কায়দা-কেতার ভেতরেই পড়ে।
শাহ্নজরের নিয়ম-কানুন মেনে বিদায়-পর্ব অবধি ‘বকুলফুলেই’ ডুবে রইল সাত্তার মিয়া। অতঃপর কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে, কিছুপথ ঘোড়ার গাড়িতে চেপে বউ নিয়ে ঘরে ফেরার পরও সে ‘বকুলফুলেই’ বিভোর।
বিয়ের কয়েক বছর বাদেও সাত্তার মিয়া বিষয়টি নিয়ে ভেবেছে – নয়নের কুমকুম-অঙ্কিত মুখখানি দেখে কেন তার বকুলফুলের কথাই মনে হয়েছিল? বকুলফুলের পাপড়ির মতো ঘোলাটে সাদা রঙে ডুবানো নয়নের শরীর। কিন্তু শাহ্নজরের আরশিতে ওই শরীরের কিছুই দৃশ্যমান ছিল না। বরং সাত্তার মিয়া ভালো করে দেখেছিল ঘনপল্লবে ঢেকে থাকা নয়নের আঁখিদ্বয়। ওই আঁখি দেখে সাত্তার মিয়া ধাঁ করে একটা ফুলের কথাই ভেবেছিল। শাপলাফুল। কিন্তু সে কিনা বলে বসল –
‘বকুলফুল দেখতাছি।’
বেকুব আর কাকে বলে! জানা নাই-বুঝা নাই – আন্ধার মতো যে-কথা কয়, লোকে তারেই তো বেকুব বলে!
সাত্তার মিয়া সত্যই যে বেকুবের হদ্দ তা কিনা ধরা পড়ল দিনকয়েক বাদেই।
সংসারের কাজসাজ করেটরে নয়ন একদিন মেন্দিপাতা তুলল। সেই পাতা শিল পাটায় মিহি করে বেটে হাতের তালুতে নকশা তুলতে বসল। সাত্তার মিয়া তখন কাজ থেকে সবে ঘরে ফিরেছে। নতুন বউয়ের সম্মুখে সে হাত মেলে দিল। হাসতে হাসতে নয়নকে বলল –
‘সখ কি খালি মাইয়া মাইনষেরেই থাকে? পুরুষের কি কুনু শখ থাকতে নাই?’
নয়ন কিছুক্ষণ মৌন থেকে সাত্তার মিয়ার হাত ধরে বলল –
‘থাকব না ক্যান? আসেন নকশা কইরা দেই।’
আর এই ‘নকশাই’ ক্রমে সাপ হয়ে ছোবল হেনেছিল সাত্তার মিয়ার অন্তরে। সাত্তার মিয়া দেখল নয়নের নকশার ফুল-পাতা সব ঘুরপথে যেতে লাগল। সরলপথ যেন তারা চেনেই না। ফলে হিজিবিজিতে সাত্তার মিয়ার হাতের তালু ভরে উঠল।
সাত্তার মিয়া হাত সরিয়ে নিল না। একেবারে নিশ্চুপ থেকে খেয়াল করতে লাগল নয়নের দৃষ্টিপথ। নয়ন কি কাছের সমস্ত কিছুই ঝাপসা দেখে? শুধু কি কাছের? নাকি দূরেরও?
নয়নের দৃষ্টিশক্তি কি ক্ষীণ?
মেন্দির হিজিবিজি নকশা দেখে সাত্তার মিয়ার বুক ফেটে চিৎকার বেরোতে চাইল। কিন্তু সে তা হতে দিল না। শুধু বোবার মতো নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইল।
নিজেকে সান্ত¡না দেওয়ার ছলে জোরেশোরেই বলল –
‘কানলে কি হয় রে মমিন? কানলে কি আর সব পাওন যায়? মাইনষের কান্দন কি আল্লায় শোনে? মাইনষের দুঃখ কি আল্লায় বোঝে?’
সাত্তার মিয়ার কথা শুনে নয়ন মাথাটা আরো নিচু করল। এতটাই নিচু যে, তার মুখটাই যেন আড়াল হয়ে গেল সাত্তার মিয়ার দৃষ্টি থেকে। সাত্তার মিয়া দেখল ঘনকালো চুলের মাঝ দিয়ে শাদা-পথ, সিঁথি হয়ে কোথায় যেন পৌঁছেছে। যেন গভীর অরণ্যের ভেতর একটা সরু-পথ চলে গেছে সীমানার বাইরে।

দুই
স্বামী-সাত্তার মিয়ার বাড়িকেই নিজের মনের মতো সাজিয়ে নিল নয়ন। যদিও তার চোখের দৃষ্টি জোরালো নয়। দেখেশুনে চলাফেরা করতে করতে সবই যেন তার আয়ত্তে এসে গেল। টিউবওয়েলের-পাড়, কামিনীতলা, হেঁসেল, লাকড়ির মাচা, পুকুর, কবরখানা, বাতাবিলেবুর জোড়া-গাছ পর্যন্ত নয়ন অনায়াসে চলাফেরা করতে শিখল। সাত্তার মিয়াও হাত গুটিয়ে বসে থাকল না। তার সাধ্যের ভেতর ডাক্তার-কবিরাজ সবই ঘাঁটল। কিন্তু ফলাফল শূন্য। সবারই একই জবাব – নয়নের দৃষ্টির ত্রুটি জন্মগত।
এত দৌড়াদৌড়ির পরও কাজ কিছুই হলো না দেখে সাত্তার মিয়া নিরাশ হয়েছে। কোনো-কোনোদিন ক্ষেপে উঠতে চেয়েছে। প্রচ- ক্রোধ তাকে উন্মাদ করে তুলতে চেয়েছে। নয়নের চোখের আলো মৃদু – এ-কথা কেন তাকে ঘুণাক্ষরেও জানানো হয় নাই? বিয়ের আগে এসবই গোপন রাখা হয়েছে। সাত্তার মিয়া ভেবেছে নয়নের দুই গালে কষে দুই থাপ্পড় লাগিয়ে জিজ্ঞেস করে –
‘কানা মাইয়া পরের গলায় গছাইয়া শান্তি পাইছে বেবাকে, না?’
সাত্তার মিয়া এভাবে না-বললেও নয়নকে ধমক-ধামক কম দেয় নাই। নয়ন সামান্য হোঁচট খেলেই সাত্তার মিয়া চিৎকার করে বলেছে –
‘ক্যামনে চল অ্যাঁ? যাইতে-আইতে খালি উষ্টা খাও।’
নয়ন যেন মুহূর্তে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চেয়েছে। তার মুখের সাদাটে-বরণ লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে। সাত্তার মিয়া দ্রুত সেখান থেকে সরে গেছে। ঠিক সরে যাওয়া নয়, যেন পালিয়ে বেঁচেছে।
কী হবে নয়নকে বকেঝকে? প্রায় আলো-নিবু-নিবু চক্ষু নিয়েও তো নয়ন ঘর-গেরস্তালি করে চলেছে। সাংসারিক কাজকর্মে সে এতটাই নিপুণা যে, কিছুতেই ধরা যায় না তার দৃষ্টির ক্ষীণতা। সাত্তার মিয়ার খাল-বিল-পুকুর থেকে ধরে আনা মলা-চেলা-পুঁটির ভাই নয়ন নিমেষেই কেটেকুটে-ধুয়ে তোলে। ঘরের পেছনে সে পালান করেছে। ঝিঙা আর লাউয়ের ডগাগুলোও সে যতেœর হাতে জাঙলায় তুলে দেয়। কালি-ঝুলি-মাখা হাঁড়িকুড়ি মেজে ঝকঝকে করে তোলে। তবে নয়ন চলাফেরা করে খুব বুঝে-শুনে। সন্তর্পণে। তাকে দেখে সহসা ধরার উপায় নাই যে – চোখের দৃষ্টি তার আবছা।
সাত্তার মিয়ার সংসারে নয়ন যেন পরগাছার মতো বেঁচে রইল। যে বেঁচে আছে, শ্বাস নিচ্ছে, জগৎ-সংসারের আলো-ছায়া দেখছে – কিন্তু নিজের শরীরের শেকড় তার অন্য বৃক্ষের ওপর। সাত্তার মিয়ার বনস্পতির ছায়াতেই নয়ন দিব্যি বেঁচেবর্তে রইল। এবং বছরতিনেক বাদে তাদের কোল পূর্ণ করে ছেলে জন্মাল।
ছেলে তো নয় যেনবা ফুটন্ত-টগরফুল। ছেলের মুখ দেখে সাত্তার মিয়া খুশি হতে চেয়েও পারল না। প্রচ- ভয় তাকে গ্রাস করল – পোলাডাও যদি মায়ের মতো আন্ধা হয়?
এই দুশ্চিন্তা নিয়ে সাত্তার মিয়া বছর পার করে দিলো। আর মোজাফফর ততদিনে হামাগুড়ি দিলো, হাঁটতে শিখল। আর সাত্তার মিয়া লুকিয়ে-চুরিয়ে নানা পরীক্ষা নিল। যেমন লাল বলটা গড়িয়ে দিয়ে খেয়াল করত মোজাফফর সেটা ঠিকমতো ধরতে পারে কিনা? ক্রমে সাত্তার মিয়ার শঙ্কা কমল। মোজাফফরের চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ। দূরের পোকামাকড়ও সে স্পষ্ট দেখতে পায়। পিঁপড়ার বাসা দেখতে পেলে সরে দাঁড়ায়। পিঁপড়ারা যে খুব সুবিধার প্রাণী নয়, সেটাও সে ততদিনে বুঝে গেছে।
ছেলে মোজাফফর যত বড় হতে লাগল, নয়নের দৃষ্টিশক্তি তত ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হলো। কিন্তু নয়ন এ-কথা কাউকে প্রকাশ করল না। নিজের অচলাবস্থা জানাতে সে যেন কুণ্ঠিত বোধ করে। নয়ন এই ভেবে নিজেকে সান্ত¡না দেয় –
‘সাত্তার মিয়া তো চেষ্টার ত্রুটি করে নাই। ডাক্তার-কোবরেজ কিছুই সে বাকি রাখে নাই। আমারই তো কপাল মন্দ।’
নয়নের প্রায় নিষ্প্রভ দৃষ্টির সামনে মোজাফফর একদিন যুবক হয়ে উঠল। যুবক হয়ে সামান্য কাজবাজে মন দিলো। আর একদিন হুট করে বউ নিয়ে ঘরে ফিরল। শ্যামলা-বরণ ডাগরচোখের মেয়ে আঁখি। মাঝারি গড়ন। কাজেবাজে চটপটে। মুখটা যেন অচেনা মায়ায় পরিপূর্ণ।
ছেলে নতুন বউ নিয়ে ঘরে এলো, কিন্তু সেই বউয়ের চেহারা নয়ন দেখল কিনা বোঝা গেল না। সাত্তার মিয়ার তীক্ষè দৃষ্টির ভেতরও নয়নের অভিব্যক্তি ধরা দিলো না। নয়ন কোনোকিছুই বলল না। নতুন বউয়ের জন্য পাটালি গুড় আর ঘন দুধে ক্ষীর রান্না করল। তবে তার চলাফেরার পরিবর্তন এলো। সাত্তার মিয়া দেখল, নয়ন যেন আগের চেয়েও অনেক ধীরস্থির। সে যেন হাওয়ায় ভর করে উড়ে বেড়ায়। মাটি তার পায়ের স্পর্শ পায়-কি-পায় না বোঝা যায় না। নয়নের যেন হঠাৎ করে দুটো ডানা গজিয়েছে। সেই ডানা মেলে সে যেন উড়ে বেড়াচ্ছে।
মোজাফফর বা সাত্তার মিয়ার জাল ফেলে তুলে আনা গুঁড়া মাছের ডাঁই সে পূর্বানুরূপ কুটতে বসে। কিন্তু মাছ কুটতে কুটতে সন্ধ্যা নেমে আসে। তখন নয়ন উঠে গিয়ে উঠানের লাইট জ্বালিয়ে দেয়। ফের মাছ নিয়ে বসে। ধীরেসুস্থে যতœ করে মাছের লেজ কাটে। ডানা-পাখনা কাটে। আঁশ তোলে। মাছের কানকো টেনে বের করে। সকালে তুলে আনা মাছ কাটতে কাটতে দিনের আলো ফুরিয়ে ফেলে। কেবল মাছ নিয়েই নয়নের এত সময় ব্যয় করাকে আঁখি ভালো চোখে দেখে না। আঁখির মনে হয়, সংসারের অন্য কাজগুলো ফাঁকি দেওয়ার জন্য নয়ন মাছ কুটাতে ব্যস্ত থাকে। শাশুড়ির আলোহীন চোখের খবরটা আঁখি এতদিনে জেনে গেছে। এই জানা তাকে বেদনার্ত করার বদলে ক্রোধান্বিত করেছে। মোজাফফর কেন বিয়ের আগে মায়ের এই অচলাবস্থা তাকে বলেনি? এজন্য সে মোজাফফরকে গালমন্দও কম করে না।
‘নিজের মাওডা যে আন্ধা সেইটা আমারে আগে বলে নাই! এই কানাবেটিরে আমি কি সারাজীবন টাইন্যা যাব নাকি?’
আঁখির গালমন্দ নয়নও শোনে। কিন্তু এমন ভাব করে যেন সে চোখ দুটোর সঙ্গে শ্রবণশক্তিও হারিয়েছে। আঁখির ভাষা যেন সে বুঝতে পারে না। এমন ভাব করে বলে –
‘বউ কি আমারে কিছু বলতাছ?’
আঁখিও তাড়াতাড়ি উত্তর দেয় –
‘না আম্মা – কাউরে আমি কিছুই বলতাছি না।’
আঁখির কথা শুনে নয়নের মুখের রেখায় কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। নির্বিকার থেকে বলে – ‘না মনে হইল তুমি বুঝি কোনো কামের কথা বলতাছ।’
আঁখি বিশ্রী রকম মুখ ভেংচিয়ে অন্যদিকে সরে যায়। নয়নের চোখের নিষ্প্রভ আলোতে আঁখি মাঝে মাঝে আনন্দিতও হয়।
‘ভালাই হইছে – কানাবুড়ি কিছুই চক্ষে দ্যাখে না।’
মোজাফফর ঘরে ফিরে এলে আঁখির এক্কেবারে অন্য রূপ। যতœ করে স্বামীকে খাবার বেড়ে দেয়। মোজাফফরের পিঠের ওপর প্রায় ঢলে পড়ে বলে –
‘আম্মারে আরেকবার ডাক্তার দেখাও।’
আঁখির হঠাৎ এমন গায়ে-পড়া-দরদ দেখে মোজাফফর বিব্রত হয়। তোতলাতে তোতলাতে বলে –
‘আম্মার চিকিৎসায় আব্বায় তো কুনু গাফিলতি করে নাই।’
আঁখি এ-কথায় গা করে না। বরং ভালোমানুষী গলায় বলে –
‘না, কইছিলাম কী – বয়স তো হইতাছে – এক্করে আন্ধা হইয়া গেলে তো মুশকিল।’
মোজাফফর চুপ করে থাকে। কী বলবে সে এ-কথার উত্তরে? আঁখি ফের গলায় দরদ ঢেলে বলে – ‘এক্করে আন্ধা হইয়া গেলে তারে তো আমাগোই টানতে হইব।’
মোজাফফরের কাছ থেকে কোনো সাড়া-শব্দ পাওয়া যায় না। হয়তো সে ঘুমিয়েই পড়ে। অথবা ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে। আঁখিও হয়তো ঘুমিয়ে পড়তেই চায়।
ঘরের মাঝখানে বাঁশের বেড়ায় পার্টিশন। নয়ন বা সাত্তার মিয়া কি তাদের দুজনের কথালাপ শুনছে? শুনে ফেললে আঁখি বেশ লজ্জায় পড়বে। আন্ধা-শাশুড়ির অন্ধকার ভবিষ্যৎ নিয়ে সে যে ভেবে মরছে – এটা সে অন্য কাউকে জানাতে চায় না।
যদিও তাদের ঘরের বাইরে ও ভেতরে কবরের মতো অন্ধকার। এমন থইথই অন্ধকারে হঠাৎ বজ্রপাত হলেও আলো তেমন ফুটবে না। আঁখি ঘুমিয়ে পড়ার পূর্বে ভাবে, কথা তো আর অন্ধকার নয় যে, সবকিছু আড়াল করে রাখবে? মানুষের কথা হইল পা-ওয়ালা হাওয়া। যে এদিক-ওদিক সহজেই উইড়া বেড়ায়।

তিন
ভোরবেলার আলোর রং কেমন নয়ন কি তা জানে? হয়তো জানে, হয়তো জানে না। কিন্তু ভোরের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সে জেগে ওঠে। প্রথম আলোর লালিমা সে দেখতে না-পেলেও হয়তো অনুভব করে। সকালের সূর্যের চারপাশে হেলায়ফেলায় যে লালচে রং পড়ে থাকে সেটা তার বিয়ের-শাড়ির-রং। নয়নের এমনই মনে হয়। সাত্তার মিয়া নয়নকে হয়তো ওই রকম রঙের কটন-বেনারসি দিয়েছিল। নয়তো কাঞ্চিভরম বা গাদোয়ান-কাতান – নয়নের মনে খুব স্পষ্টভাবে সেই শাড়ির রংটা ফুটে রয়েছে। বিস্তীর্ণ জলাশয়ের আনাচে-কানাচে যেমন করে শাপলাফুল ফুটে থাকে।
নয়ন মনের আয়নায় ওই রং দেখতে দেখতে কলপাড়ে যায়। টিউবওয়েলের হাতলে দু-একটা চাপ দিতে-দিতেই আঁখিও উঠে পড়ে। মোজাফফর সকাল-সকালই কাজে চলে যায়। দুইটা চাল দ্রুত ফুটিয়ে না-দিলে সারাদিন তার খাওয়া হয় না। পেটে খিদা নিয়ে কতইবা কাজ করা যায়?
বিয়ের পর থেকেই আঁখি অনেকবার বলেছে একটা টিফিন-বক্সে যেন ভাত-ভর্তা নিয়ে যায়। নিদেনপক্ষে দুইটা খুসকো রুটি। কিন্তু মোজাফফর তাতে রাজি না। মোজাফফরের একই কথা –
‘আমি তো আর মস্ত অফিসার না। এক জায়গায় বইসা কাজ করি না। বাক্সপেঁটরার খাবার নিয়া আমার ঘুরতে ভালা লাগে না।’
আঁখি করুণভাবে তাকিয়ে বলেছে –
‘ঘরের খাওন নিত্য খাইলে শরীলডা পুষ্ট থাকব।’
‘দুই বেলাই তো ঘরের খাওন খাই। পুষ্ট কি কম মনে হয় আমারে?’
বলেই দুই হাতে আঁখিকে বুকে টেনেছে। আলিঙ্গনের ভেতর আঁখি আহ্বলাদে গলতে গলতে বলেছে –
‘এ্যাই ছাইড়া দেও। আম্মা দেইখ্যা ফেলাইব।’ মুখে এমন বলেছে সে, কিন্তু মনে মনে নিশ্চিত জানে কানাবুড়ি আবার দেখব কী?’
মোজাফফরের শরীরে একাকার হতে হতে ফের বলেছে –
‘দুর অ। ছাড়ো তো। আম্মা দেইখা ফেলাইব।’ আঁখির এসব কথাবার্তায় যে প্রচ্ছন্ন বিদ্রƒপ থাকে মোজাফফর তা ধরতে পারে। কিন্তু সে আঁখিকে ঘাঁটায় না। বউয়ের সঙ্গে খামাকা কাইজ্যা-ফ্যাসাদের দরকার কী? নয়নের ভাগ্যের ফের তাতে ফিরবে না। ভাগ্যের রাহু নয়নকে গিলে ফেলেছে। ফলে যা ঘটবার তা-ই ঘটতে চলেছে। মোজাফফরের সাধ্য নাই নয়নকে রক্ষা করার। সে জানে, গরিবের ঘরে জন্ম নিলে ভাগ্যের মুখ ব্যাজারই থাকে। গরিবদের ভাগ্য ফেরে না। গরিবরা যদি মাথা ঠুকে রক্তাক্ত করে ফেলে তাতেও সৃষ্টিকর্তার মন গলে না। গরিবদের দিকে নজর দেওয়ার মতো সময় কই তাঁর? মোজাফফর জানে, গরিব নিজের ভাগ্যকে কবর দিয়েই জন্মগ্রহণ করে। গরিবের ভাগ্য হলো পাথর। পাথর ভেদ করে যা কোনোদিন কোনো বৃক্ষ অঙ্কুরিত হয় না।
মোজাফফর এতদিন সবকিছুই মেনে নিয়েছে। সে জানে ঘরে ফিরেই প্রত্যহ খেতে হবে সবজি-আনাজের ভাঁপ-ওঠা তরকারি। মোটাচালের ভাত। আঁখির সঙ্গে ক্লান্তিকর সঙ্গম।
ভোর হলেই গরমভাত নাকেমুখে গুঁজে বেরিয়ে যাওয়া। ফের শাক-পান্তার জোগাড় করে ফিরে আসা। রাত যুবতী থাকতে থাকতেই মোজাফফর ফিরে আসে। কাজের শেষে কোথাও দু-দ- জিরাবে তেমন আস্তানা তার নাই। শাক-পান্তা জোগাড়ের ছোটাছুটিতেই সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আর ক্লান্তিই যেন তাকে ঘরে ফেরার তাড়া দেয়। মায়ের জন্য তার ভাবনা নাই, এমন নয়। কিন্তু মোজাফফর জানে, সে কিছুই করতে পারবেন না। নয়নের চোখ নিভে গেলে তেল-সলতের জোগান সে দিতে পারবে না।
নয়ন চিরতরে অন্ধ হয়ে গেলেও মোজাফফর কী করতে পারবে? শহরে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করানোর টাকা তার কাছে নাই। মোজাফফর জানে, নয়নের অন্ধত্বের মাঝ দিয়ে সবকিছুই আপন নিয়মে চলবে। কাজ শেষে সে ঘরে ফিরবে। রাতের অন্ধকারে আঁখির সঙ্গে যৌনসঙ্গমে মিলিত হবে। দুই-একটা সন্তান জন্ম দিয়ে সেও একদিন সাত্তার মিয়ার
মতো অথর্ব হয়ে উঠবে। ক্রমে তার মুখের ভাষা হারিয়ে যাবে। রোগ-শোক-জরার জীবন, নিত্য-অভাবের জীবন থেকে তার নিস্তার মিলবে না। মোজাফফর জানে, কোনোকিছুতেই তার আর উদ্ধার নাই।
সত্যি-সত্যিই নয়নের চোখের আলো প্রায় সবটাই নিভে গেল। চলাফেরা বা কাজবাজ যাই সে করে, অভ্যাসবশত করে। নয়নের সমস্ত পৃথিবীতে অন্ধকার থইথই করলেও সে এ নিয়ে কোনো কথাই বলল না। নয়ন জানে, বলেও কোনো লাভ নাই। বললে বরং অন্যের করুণা তাকে বিদ্ধ করবে। অন্যদের ‘আহারে-উহারে’ ব্যস – এই পর্যন্তই তো। সমাধান কিছু নাই। নয়ন জানে, সমাধান আসলে কোথাও নাই।
একটা টিনের ঘর, তার ভেতরে সামান্য এতটুকু আড়াল। বাঁশ কাটিয়ে ক্যাচা বানিয়ে এই সাত্তার মিয়াই দিয়েছিল। মোজাফফর যখন যুবক হয়ে উঠল তাকে আলাদা বিছানা দিতে হলো। যদিও রাতের ঘোরঘুট্টি অন্ধকারে কোনো কিছুই মালুম হয় না। কিন্তু রাতের আঁধার মানুষের নড়াচড়া ঢাকতে পারে না। রাত যত কালোই হোক, যত অন্ধকারই সে ধারণ করুক – মানুষের অস্তিত্ব গ্রাস করার ক্ষমতা তার নাই।
মোজাফফর বউ নিয়ে আসার পরও বাঁশের আড়ালটুকু তেমনই রয়ে গেছে। বাড়ে-কমেনি। ওই আড়াল মানুষের নড়াচড়াকে ঢেকে রাখে। কিন্তু কথারা ওই আড়াল ভেদ করে ভেসে বেড়ায়।
ওই ভেসে বেড়ানো কথা থেকেই নয়ন জেনেছিল আঁখির গর্ভ হয়েছে। জেনেছিল আসন্ন সন্তান নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর উৎকণ্ঠা –
‘আম্মার মতো চক্ষের সমস্যা যদি আমাগো পোলাপানের থাকে?’
পুরুষকণ্ঠ বলেছিল –
‘হুম – চিন্তার বিষয়। আম্মার মতন চক্ষু নিয়া জন্মাইলে কী যে করবাম?’
নয়নের কানে এসব কথার কিছুই প্রবেশ করে নাই। সে শুনছিল কাচের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ। কোথাও যেন গোছা-গোছা-চুড়ি বেজে উঠছিল। আর নি-িদ্র অন্ধকার ভরে উঠছিল কিঙ্কণে। নয়নের মনে হয়েছিল, এই মিষ্টি বাজনা শুনতে শুনতে রাত পোহায়ে যাবে। নয়ন যেন কোনো অপার্থিব আনন্দে ভেসে বেড়াচ্ছিল।
মোজাফফরের বউ আঁখির গর্ভ হয়েছে!
নয়নের আলোহীন চোখ গভীর কালোতে ডুবন্ত ছিল। কিন্তু তবু তার মনে হচ্ছিল – সবই যেন সে স্পষ্টই দেখতে পাবে!
পরদিন বিকেলের আলো ছিল উজ্জ্বল। নরম আর মায়াময়। নয়ন তার চেনা স্থান ধীরে ধীরে পেরিয়ে যাচ্ছিল। নয়ন পৌঁছেছিল
বাড়ি-লাগোয়া ক্ষেতের কিনারে। যেখানে এন্তার সরষে ফুল ফুটে ছিল। সরষে ফুলের তীব্র ঝাঁজ তাকে সম্মোহিত করে ফেলেছিল। সরষে ফুল কিংবা অড়হরের ক্ষেতও হতে পারে। অড়হরের ফুলও হয় হলুদ বরণ। আর পাতাগুলো ঝাঁজাল।
নয়নের মনে পড়ে, ছোটকালে কোনো একদিন সে এমন করে হেঁটেছিল। ক্ষেতের আইল ধরে। হলদে ফুলের উৎসবে তার নাতিদীর্ঘ শরীর লুটোপুটি খেয়ে ছিল। সরষে ফুল কিংবা অড়হরের হলদে-ঢেউ তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল দূরে। বহুদূরে। নয়ন বেমালুম ভুলে ছিল বাড়ি ফেরার কথা। নয়নের ওই জীবনে সাত্তার মিয়া ছিল না। মোজাফফর বা আঁখিও ছিল না।
চেনাপথ ধরে চলতে চলতে নয়ন হঠাৎ জলস্পর্শে চমকে ওঠে! কখন সে যেন পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে! পুকুরের জল এখন কতটা অতল? শীতের মরশুম এলেই পুকুরটা যেন ঠিক বয়স্ক হয়ে ওঠে। কেমন বিশীর্ণ আর স্থবির দেখায় তাকে! নয়ন যেন এখনো স্পষ্ট সেই বুড়িয়ে যাওয়া পুকুরকে দেখতে পায়।
আজ যেন নয়নের ঘরে ফেরার তাড়া নাই। সাত্তার মিয়া বা মোজাফফর যদি গুঁড়া মাছের ডাঁই এনে রাখে, সেসব তেমনই পড়ে থাকবে। থাকুক। পুকুরের প্যাচপ্যাচে-জলে পা ভিজিয়ে নয়ন যেন লোভাতুর হয়ে ওঠে। আরেকটু গভীরে গেলে জলের হিমভাব বা উচ্চতা বোঝা যাবে। কিন্তু চার-পাঁচ কদম সামনে এগিয়েই সে বাধাগ্রস্ত হয়। কে যেন শক্ত করে তার দুই-পা পেঁচিয়ে ধরে। নয়ন পা সরিয়ে সেই বাঁধন আটকাতে চায়। কিন্তু বিফল হয়।
খুব দ্রুত তার পা থেকে ঊরু অবধি কেউ যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। নয়ন তীব্র ভয়ে চিৎকার করে উঠতে চায়। কিন্তু তার কণ্ঠ চিরে গোঁ-গোঁ ধ্বনি ছাড়া কিছুই শোনা যায় না। দুহাত বাড়িয়ে সেই কঠিন বন্ধন খুলতে গেলে নয়নকে আরও তীব্র-ভয় গ্রাস করে ফেলে। এমন হিম! এত শীতল কী তাকে বেড়ি পরিয়েছে? পুকুরের জলের কি এতটাই ক্ষমতা? কি তাকে এমন দড়ির মতো বেঁধে ফেলেছে? আর জলের শরীর কি এতটাই বরফশীতল হয়?
নয়নের এতসব ভাবনাচিন্তার মাঝেই ওই হিম-স্পর্শ তাকে জলের ভেতর ঠেলে দেয়। আর নয়ন সাঁতার দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে। দড়ি দিয়ে পা-বাঁধা থাকলে জলের ওপর ভেসে ওঠা অসম্ভব।
প্রায় পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর বসবাস করেও নয়ন কিছুই জানতে পারেনি। এ-বাড়ির কিছুই আদতে তার জানা হয় নাই। যেমন সে জানতে পারে নাই – পুকুরের ধার-ঘেঁষা-জংলায় কখন সাপখোপ বাসা বেঁধেছে?
হয়তো দু-চারবার নয়ন তাকে দেখেছিল। নয়নের প্রায়ান্ধ চোখজোড়া চন্দ্রবোড়া সাপটাকে হয়তো কোনো হলদে ফুল ভেবে ভুল করেছিল!