হলুদ ফুলের গান

অনিল ঘোষ
সরষে ফুল ওই ঝোপা ঝোপা
হলুদ বলে বেটেছি
মন-জাঙালে হলুদ ছটা
বিহার কনে সেজেছি
(আদিবাসী গান : ২৪ পরগনা)
হলুদ ফুল মনের ফুল। মনের কথা। আপন কথা, গোপন কথা। যে-কথা ফুল হয়ে ফোটে, গান হয়ে ওঠে। সারদা সেই ফুলে সাজবে। সেজে নেচে-গেয়ে মাতাল করে দেবে টুসু পরবের হিমেল রাত।
শেষ পৌষে টুসু পরব। খুশির পরব। ধানলক্ষ্মী পৌষলক্ষ্মী টুসু। পৌষজুড়ে তার আবাহন,
শেষ দিনে পুজোপাট, নাচ-গান-উৎসব। বিশে মোড়লের উঠোনে আসর বসেছে। কুমারডাঙা থেকে উঠোনে প্রতিমা এসেছে ঢাক-ঢোল- শাঁখ বাজিয়ে, উলু দিয়ে আর খই ছড়াতে-ছড়াতে। দুপুরেই পুজো সারা। রাতে নতুন চালের পিঠে, মাংস আর হাঁড়িয়া উৎসর্গ করে শুরু হবে নাচ-গান। চলবে প্রথম মাসের সকাল পর্যন্ত।
বাদাভূমির দেশে টুসু আসে বাপের ঘর। সঙ্গে আসে নতুন সন। মানে নববর্ষ। বছর চুক্তিতে যারা গিয়েছিল রাখালি, মানদারি খাটতে, তারা ফিরল চুক্তি শেষ করে। আর যারা গিয়েছিল নামালে, মাটি কাটায়, ইটভাটায়, কলে-কারখানায় – তারা ফিরেছে অন্তত দুদিনের জন্য।
সারদার চোখ সারাদিন খুঁজে বেড়ায় একটি মুখ। এতো মানুষ ফিরল, তবে সে কেন এখনো ফিরল না? কালো পাথরকোঁদা শরীর, বাবরি চুল আর গভীর চোখের মানুষটার টানেই তো এই সাজপাট, এই হলুদ ফুলের বাহার। হলুদ ফুল প্রতীক্ষার ফুল। ওই রং মনের মানুষের রং। সারাদিন ঘর-বার শুধু। বারবার সারদা এসে দাঁড়ায় পুবের মাঠের কোলে। দৃষ্টি মেদেরঘেরীর দিকে স্থির।
মেদেরঘেরী কতদূর? হুই পুবের মাঠের পার। সারদার মন যেন উড়োপাখি। ডানা মেলে উড়ে যায় ওইদিকে। ওর বুকের ঘরে এক মাতাল পাখির বাস। ক্ষণে ক্ষণে তার কুব-কুব ডাক – আছে নাকি! আসছে নাকি!
সেই মানুষ মোহন সর্দার। সারদার মনের মানুষ। তিন পরব আগে সে এসেছিল ওর বাপের কাছে। বিয়ের কথা পাকা করতে।
সারদার বাপ কুশ সর্দার দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল। মেয়ের রূপ আছে আর বাপের আছে রুপোর খাঁই। হবে না কেন, মেয়ে খাটতে-খুটতে দড়। মাঠের কাজ, ধান-চালের কাজে পাকা। কত টাকা আসছে ঘরে। সর্দার-ঘরে এমন মেয়ে তো লক্ষ্মী। চাইলে কত ভালো সম্বন্ধ হা-হা করবে। হাড়-হাভাতে কুশের আর কেউ নেই, ওই এক মেয়েই ভরসা। সে-ই কিনা মন দিয়ে বসল চালচুলোহীন মরদ মোহন সর্দারকে! কী আছে ওর? না নিজের ঘরদোর, না একফোঁটা জমি। বোন-বোনাইয়ের ঘরে বাস। থাকার মধ্যে পাথরপারা গতর। বুক চিতিয়ে সে বলেছিল, গতরে খাটব, খাস জমিন পাব, ঘর তুলব চাষ করব, তুমার মেয়ার ভাবনা কি!
কুশের মুখ ব্যাজার হয়ে যায়। এমন পাত্র ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া উচিত। পারল না মেয়ের মনের কথা টের পেয়ে। তবে ছেড়েও কথা বলেনি। সোজা হেঁকেছিল, বিহা করবা ভালো কতা, তব্যা আমার এট্টা নধরপানা শোর চাই, একজোড়া বকরি, দুগন্ডা কুঁকড়ো আর পনেরো-কুড়ি ট্যাকা। বিহার খরচট কিন্তুক তুমার।
অ্যাত! মোহনের চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। কুশের মুখে জয়ের হাসি, সদ্দারের মেয়া বিহা কইরলে পণ দিতি হয় জানো না! মরদ হও তো পণ দে নে ঝাও -।
মোহনের মাথা নুয়ে পড়ে। পরক্ষণেই চুল ঝাঁকিয়ে বলে, আমি আজি তব্যা একখান কতা -।
খোলসা করো।
বিহাই বায়না করবার নাগব।
মানুষটা একগন্ডা কুঁকড়ো বাপের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, তিন পরবের মধ্যি বাকি পণ শুধে মেয়ারে নে ঝাব ঠিক।
সেই তিন পরবের শেষ পরব যায়-যায়। আশার একখানি ছবি সারদার চোখে ঝুলিয়ে দিয়ে মোহন মাঠ পাড়ি দিয়েছিল এমনি এক শীতের দিনে। বাতাসে ভাসছিল হাঁড়িয়ার গন্ধ। পাতাখসা শিমুল গাছের পাশ দিয়ে আস্তে আস্তে তার শরীরটা মাঠের মধ্যে হারিয়ে গেল। মাঝেমধ্যে খবর আসে কোনো ইটভাটা, কোনো ধানকল থেকে, ট্যাকার জোগাড় হয়নি, হলেই আইব -। সেই মানুষটা কি আজকের কথা জানে না! হলুদ ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা এ-রাত কি বিফলে যাবে!
সারদা হলুদ ফুলে সাজবে বলে হলুদ শাড়ি পরল। চুড়ো করে বাঁধা কালো চুলে হলুদ ফুল গুঁজল। ঝোলাল হাতে-কোমরে। মালা পরল গলায়। শালুক ডাঁটার মতো ফন ফন করে সারদা। কালো মেঘে চিকুর হানা রূপ তার। আগুন জ্বলে অঙ্গে অঙ্গে। জ্বলুক জ্বলুক। জ্বালানো- পোড়ানো না হলে সাজে কী গুণ, কী সার্থকতা!
সাজপাট শেষ করে সারদা ঘরের বাইরে আসে। সূর্য কাঁসার থালা হয়ে আড়াআড়ি ঝুলছে দেবদেউলের মাথায়। রোদের অাঁচল গোটানো। শেষ পৌষের বেলা এখন যাই-যাই। বিশে মোড়লের উঠোনে বাজে গুব-গুব ঢাকের শব্দ।
এ সময় কুশ বলে ওঠে, আর কী আইবে র্যাক?
চালখসা ঘুপচি ঘরের দাওয়ায় বসে কুশ। হাঁড়িয়ার নেশায় ঝিম। আজ তো নেশারই দিন। সকাল থেকেই টানছে আর বসে বসে এক কথার ফুলঝুরি, মোহন কি আইল র্যা ?
সারদা ঝেঁঝে ওঠে, আমি কি জানি!
খপর পাস নাই?
পেলে তো জানত্যা।
কুশ ধন্ধে পড়ে। নেশায় টলমল মাথা দোল খায় নারকোল পাতার মতো। বিড়বিড়ি করে বলে, তব্যা তুই হলুদ ফুলে সাজিস কিয়ের নেগে অাঁ?
সারদা হাসে কাঁপন-লাগা জলের মতো তিরতিরিয়ে। এ কেমন হাসি! কুশ হাঁ-চোখে তাকিয়ে থাকে। মেয়েমানুষের মনের তল পাওয়া মুশকিল। নেশায় ঝিম-ঝিম মাথায় অবোধ ভাবনা।
আসলে বসে বসে সেও তো কম হতাশ নয়। তিন পরব ধরে তীর্থের কাকের মতো বসে আছে। কবে আসে মোহন! সে আজ আসে আর কাল। বিয়ে বায়না করেই ফেঁসেছে। সর্দার সে। কথা দিলে জান দিয়ে রাখবে – এটাই তো সর্দার জাতের রীতকানুন। কানুন আরো আছে। মেয়ে বিয়ে করলে পণ দিতে হয় মরদকে। মেয়ে খাটবে-খুটবে, জীবনভর খাওয়াবে – এই কড়ারে পণ দিয়ে মেয়ে বিয়ে করে মরদ। কবে সেই রাজমহল পাহাড়ঘেঁষা লাল মাটির দেশ থেকে এসব রীতকানুন বয়ে এনেছিল। তখন ওরা হয়তো সাঁওতাল কোল মুন্ডা নামে পরিচিত ছিল। সুন্দরবনে মজুর দলের ওপর সদ্দারি করতে এসে বন কেটে বসত গড়ে থেকে গেল এখানেই দেশ জাত হারিয়ে, শুধু সর্দার পরিচয়ে। তখন থেকে আদিবাসী মাত্রই সর্দার নামে পরিচিত এই বাদাভূমে। এসব কতকাল আগের কথা। বাপ-দাদার মুখে শোনা। জমি গেছে। পেশায় এখন মজুর। দিনকাল পাল্টাচ্ছে, অথচ রীতকানুন থেকে গেল গায়ের লোমের মতো। ওই টানেই মোহন নামের মরদ এখন বিদেশ-বিভুঁইয়ে খেটে বেড়াচ্ছে, আর প্রতীক্ষায় সারদার চোখে জল, মুখে রহস্যের ঝিলিক তোলা হাসি।
কুশ মাথা নাড়ে। নাহ্, বিয়ে না করলেই চলত। তবে দায় থাকত না। ভালো পণে অন্য সম্বন্ধ দেখা যেত। হাড়-হাভাতে কুশের চোখ চকচক করে টাকার গন্ধে। মাথা বিরক্তিতে নড়ে ওঠে, সে কেনদারা মরদ অাঁ! না কুনো খোঁজ, না খপর – ও কি আর আইবে?
সারদার গলায় রাগের অাঁচ, আইবে না তুমায় কয়েছে?
আইলে ভালো, না আইলে কিন্তুক আমি আর শোনব না।
কী করবি তুই?
তুয়ার বে দিতি হবে না! এরপর সক্কলা বলবে, ঘরকে ডাইল রেকিচি। তুয়ার জ্বালায় কি ঘরছাড়া হতি হব্যা! কত সম্বন্ধ আইছে, কত পণ দেবে -।
সারদা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মুখের ওপর বিষণ্ণতার ঢেউ, পণভাই দেখলি বাপ, মনডারে দেখলি না!
হ্যাঁ, সেটা দেখতি গে তো তিন পরব পার।
তব্যা তুই ট্যাকার নেগে তারে ঘরছাড়া করলি ক্যান? হেই বাপ -।
সহসা কুশের বাক্যহারা খোঁচা-খোঁচা দাড়িভর্তি মুখটা ঝুলে পড়ে বুকের ওপর।
সারদা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। জলভাসা চোখ। সে চোখে দোল খায় পুবের মাঠে খড়ো ঘর, পাতাখসা গাছ, চকিত মানুষজন। গুব-গুব ঢাকের শব্দ উদ্দাম আর একা উঠোনে মেয়ে ভিজছে চোখের জলে।
জমকালো অন্ধকার ঘন হয়ে আসে। নক্ষত্রপুঞ্জ একটা একটা করে রুপোর ফুল হয়ে বসছে আকাশের গায়ে। হিম কুয়াশায় ভিজছে মাঠ আর গাছের শরীর। সারদা নিথর। গুব-গুব ঢাকের শব্দ কখন যেন হু-হু বাঁশির সুর হয়ে গেছে ওর কানে। সে-বাঁশি বেজেছিল মোহনের ঠোঁটে, মাঠের বাগানে, নির্জন পুকুরপাড়ে। বাঁশি ছাড়া মোহন অচেনা। ওই বাঁশিই সারদার বুক পুড়িয়েছে। সুরের ফাঁক-ফোকরে দুজনের মন দেওয়া-নেওয়া চোখের কথায়, মনের ভাষায়। কাছে যাওয়ার তো উপায় নেই। সেটা ভালোও দেখায় না সর্দার-সমাজে।
পৌষালি হিমে সারদা ভিজতে থাকে। ঠায় বসে বসে সে রাত নামায়। ঘন গভীর রাত। মনের মধ্যে সেই এক কথার টানাপড়েন, মোহন আসে কি আসে না। এক মন বলে আসবেই। অন্য মনে ভাবনা, কী জানি, কোথায় গেছে, কতদূরে, কী করছে মানুষটা! মন শুধু দুশ্চিন্তাই জানে। চিন্তাজাল হঠাৎ ছিঁড়ে গেল পাড়ার মেয়ে-বউদের কলকল হাসির চোটে, কী র্যাু, এখেনে দেঁইড়ে দেঁইড়ে ধ্যান করবি, না আসরে যাবি?
বিশে মোড়লের উঠোনে আসর জমজমাট। চাঁদোয়ার নিচে টুসু প্রতিমা-আসীন ধানের গোছায় আর ফুলের শোভায়। খড়ের আগুন জ্বলে দপদপিয়ে। আগুন ঘিরে মেয়েদের নাচ-গান ঢাকের বোলে আর হইহল্লার তালে। গোটা গাঁ যেন হামলে পড়েছে। পিঠে, মাংস আর হাঁড়িয়ায় টইটম্বুর দেহ, মাথা। নেশাড়ু চোখ দোল খায় সারদার ওপর, আই গ টুসুর আসরে আইল নাকি টুলু লক্ষ্মী -!
সারদা তখন নাচের তালে দুলতে শুরু করেছে। হলুদ আলোয় যেন আগুন হয়ে জ্বলছে সারা অঙ্গ। ঝিকমিক ফুলঝুরি পায়ের তালে। গলায় টুসুলক্ষ্মীর গান –
সব পাড়ায় যেও লক্ষ্মী
দখিন পাড়ায় যেও না
দখিন পাড়ায় গেলে পরে
পান দিলে পান খেও না।

নেশাড়ু মানুষগুলো হা-হা করে ওঠে খুশিতে। চাপড় মারে ঊরুতে। আসর জমে গেল মুহূর্তেই। আকাশে আধকালি চাঁদ স্থির। বাতাসে ঝিমঝিম হাঁড়িয়ার গন্ধ। মত্ত সকলে। বিশে মোড়ল পর্যন্ত পাকা গোঁফ মুচড়ে হাসে, আহা মেয়া যে আগ হইছে গ -!
আগুন সত্যিই জ্বলছে জোয়ান মরদগুলোর বুকে। চোখে গিলে খায়। খাবেই তো। মেয়ে তো ফেলনা নয়। কুশের মনে গর্ব হয়।
মেয়েরা তখন সুর পাল্টেছে। নতুন সুর, নতুন কথা –
কলা রুলাম সারি সারি
বেগুন রুলাম দুই সারি
বেছে বেছে তোল না লক্ষ্মী
কাল যাবি শ্বশুরবাড়ি।
শ্বশুরবাড়ির কথায় সারদার মুখ কামরাঙা হয়। পা পড়ে না ঠিক তালে। তাল কেটে যায়। যাবেই তো। মন যে আনচান করে। মনের ঘরে মনের মানুষের বাস। চোখের দৃষ্টি তাই পাগল-পাগল। কোথায় পেল ওর মোহনবাঁশি! সে কি এখনো ফেরেনি!
কুশ বসেছিল দাওয়াঘেঁষে। চুকচুক হাঁড়িয়া টানছিল। পাশে বসা নরেন সর্দার মুখ খুলল এতক্ষণে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, মেয়ারে আমার হাতে দ্যাও হে সদ্দারের পো, তুমার হাতই আমি ভরাট দিব।
কুশ মুখ ফিরিয়ে দেখল নরেনকে। বিশে মোড়লের ছেলে। কাজ করে মেছোঘেরিতে। এমন জামাই হলে মন্দ হয় না। ও পারবে হাত ভরিয়ে দিতে। কুশের মাথা বিষণ্ণতায় দুলল, কী করব, মেয়া যে বায়না করা -।
নরেন হাসল, আরে বাবা, সে তো রাত পার হলি তামাদি হই যাবে, ত্যাখন তো ভাবনা নেই।
কুশের মাথা টলমল করে। ভাবনা ওর মাথাজুড়ে, পেটে নেশার জল। ভাবনা তো বাড়বেই।
নরেন ছাড়ে না, কও খুড়া -।
কুশ ঘড়ঘড়ে গলায় বলে, আমি কইলে হবে! মেয়ার বেপার -।
উঠোনের অন্য কোণ থেকে গণপতি সর্দার হঠাৎ হেঁকে উঠল, তুমার মেয়ারে আমি রানী বানাব, মেয়া আমারে দ্যাও হে খুড়া -।
কথা শুনেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল নরেন, আই শালো তুই কেডা র্যাা, ও মেয়া আমার -।
লেগে যায় বুঝি গন্ডগোল। আসর মুহূর্তেই ভাঙো ভাঙো। সবাই জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। চোখ দুই প্রতিপক্ষের ওপর নিবদ্ধ। বেশ একটা মজার খোরাক পাওয়া গিয়েছে। হাততালি দিয়ে উৎসাহ দেয় কেউ-কেউ। এর মধ্যে কে যেন টেনেছে সারদার হাত। সারদা ফোঁস করে ওঠে ক্রুদ্দা সাপিনীর মতো। দৃষ্টি যেন ছরির ফলা। আসরে ধুন্দুমার অবস্থা। নেশায় মত্ত দুই প্রতিপক্ষ ষাঁড়ের মতো গজরাচ্ছে। বিশে মোড়ল উঠে না দাঁড়ালে হয়তো লেগেই যেত। বিশের মোড়লি ধমকে সব ঠান্ডা। তারপর সে ঘুরে কুশকে বলে, দ্যাকো সদ্দারের পো, আইবুড়া মেয়া ঘরকে রাখাই খারাপ। ডান-জ্বেনের নজর পড়ে উয়ার ওপর। তুমি বিহা বায়না করিছ ভারো কতা। সদ্দার জবান দিলে তা রাখে। কিন্তুক সত্যিই মোহন না আইলে মেয়ার বিহাট কাল অন্য কারও লেগে ভাববা। ও মেয়ার নেগে গাঁ ঘরকে আ জ্বইলতে দিব না আমি – ।
গণপতি ফোড়ন কাটে, আগ তো জ্বইলবেই, মোহন কি আর আইবে!
ক্যান?
মোহনের লেগে দেখা হইছিল বসিরহাটের ইটভাটায়। ট্যাকা সে কিছু জোগাড় করতি পারেনি। তার ওপর ভাটায় মজুরি নে গোলমাল বেধেছে। ভাটা বন্ধ। মোহন চালি গে কলকেতায়। কলে খাটপে নাকি! আমারে বলেছে, খুব শিগগির ট্যাকার জুগাড় কর্যেট আসপে -।
বাঁকা হাসে নরেন, ও তো তিন পরব ধর্যেে শুনতিছি। ও আর আইবে না। খুড়া ভাবো কী করব।
সারদা চুপ করে শুনছিল এতক্ষণ। আর সামলাতে না পেরে বাঁধভাঙা ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে কান্নায়, হেই বাপ বলা না ক্যানে সে আইবে – আইবে। সে যে কতা দেছে। হেই বাপ উয়াদের কাইজ্যা থামাতি বল।
কুশ তখন হাঁড়িয়ার নেশায় টইটম্বুর। কথা বলার ক্ষমতাই নেই। বিড়বিড় করে নিজের মনে, আমি জানতাম রে মেয়া, তুয়ার নেগে একদিন আগ জ্বইলবে -।
রাত হয়েছে অনেক। কালি চাঁদ ঢলে গিয়ে চারদিক এখন ফিসফিস অন্ধকার, কুয়াশার চাদরে ঢাকা। বিশে মোড়লের উঠোনটা ঝিম মেরে গেছে। খড়ের আগুন নিবুনিচু। ভাঙা আসর আর জোড়া লাগেনি। ঘরে ফিরে গেছে অনেকেই। যারা ফিরতে পারেনি তারা নেশার ঘোরে ওই পড়ে আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, কুঁকড়ে-মুকড়ে।
কুশ সেই যে দড়বচা মেরে শুয়েছে, আর ওঠেনি। ওঠার ক্ষমতাই নেই।
সারদা পা-পা মাঠের কিনারে গিয়ে দাঁড়ায়। চোখ টসটস করে জ্বলে। দৃষ্টিপথ দুলছে। ভেঙে যাচ্ছে কুয়াশাভেজা মাঠপথের ছবিটা। অন্ধকারে রিক্ত হয়ে যায় সারদা। সাজপাট খুলে গেছে। একটা একটা করে হলুদ ফুল ঝরে পড়ছে পায়ের কাছে। বুকের মাতাল পাখিটা কান্নায় গুমরে গুমরে ওঠে, হেই বাপ আমার হলুদ ফুল ঝরে যায় ক্যান? হেই বাপ -।
ঘুমের মধ্যে চমকে ওঠে কুশ। কে কাঁদে? শূন্যমাঠে, অন্ধকারে কুয়াশায় কেঁদে কেঁদে বেড়ায় নাকি স্বয়ং টুসু লক্ষ্মী! 