হারানো অতীতের কার্যকারণ অনুসন্ধান

সাইফুল আলম

হাসান অরিন্দমের পঞ্চম গল্পগ্রন্থ প্রেম ও পটভূমি (২০১৮)। তিনি ইতোমধ্যে নিয়মিত গল্পচর্চার মাধ্যমে নিজেকে চিনিয়ে নিতে সমর্থ হয়েছেন। বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ-গ্রন্থে তিনি সমকালস্পর্শী। সমকালের সামাজিক ব্যাকরণের নানা প্রান্ত উন্মোচনে গল্পকার তৎপর। এ-কারণেই ভাষা ও শিল্পপ্রকরণে তিনি নিরীক্ষাপ্রবণ। তবে এই নিরীক্ষার কারণে গল্পের বিষয় উদ্ধার করা পাঠকের পক্ষে দুরূহ হয় না। নিরীক্ষার বাতাবরণ, দৃষ্টিকোণ ও পরিচর্যারীতি শিল্পসুষমায় ব্যঞ্জনাধর্মী। এ-গ্রন্থে নয়টি গল্প সংকলিত হয়েছে। গ্রন্থের শেষ গল্প ‘প্রেম ও পটভূমি’র নামে গ্রন্থটির নামকরণ করা হলেও প্রতিটি গল্পে আমরা উপলব্ধি করি : ‘যা হারিয়ে যায়’ তার জন্য শুধু আকুলতা কিংবা ব্যাকুলতা নয়, গল্পের কাঠামোর মধ্যেই তার কার্যকারণ অনুসন্ধান এবং জীবনদৃষ্টি ও শিল্পসৃষ্টির সমন্বয় সাধন।
‘প্যারাডাইস রিগেইন’ কিংবা ‘সোনালি জ্যোৎস্নার কল্পকথা’ গল্পে নগরজীবনের কদর্যতা ও শহরের মানুষের অমানবিকতা ফুটে উঠেছে। মূল ঘটনা ছিল, শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির মাঠে এক শিশু ক্রিকেট খেলার টেনিস বল খুঁজতে গিয়ে পাইপের মধ্যে পড়ে মারা গিয়েছিল। সে-মৃতদেহ উদ্ধার হয় সাধারণ মানুষের চেষ্টায়। এই ঘটনা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ভীষণ উদ্বেগ ও উত্তেজনা নিয়ে প্রচার করেছিল। লেখক ওই ঘটনা নিয়েছেন মাত্র। হাসান অরিন্দমের এই গল্প ঘটনাপ্রধান কিংবা চরিত্রনির্ভর নয়। চরিত্রের চেতনাগ্রাহ্য দৃষ্টিকোণ অথবা অন্তর্ময় পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কাহিনিবিন্যাস করেন। এ-গল্পে দেখা যায়, জুনায়েদ কলোনির মাঠে ক্রিকেট খেলছিল। টেনিস বলটা খুঁজতে গিয়ে পানির পাম্পের জন্য বোরিং করা পাইপের মধ্যে সে পড়ে যায়। তার মা এ-খবর পেয়ে ছুটে আসেন। মায়ের আর্তচিৎকারে ২১-২২ বছর বয়সী
চার-পাঁচজন তরুণের সত্যিই মন গলেছিল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখক দেখিয়েছেন, একাধিক বাহিনী নানা কথা বললেও শিশুটিকে উদ্ধার করার কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। এ-ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেউ কেউ রাজনীতিও করতে চেয়েছে। লেখকের সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণের সঙ্গে চরিত্রের ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ এ-গল্পের তাৎপর্যময় দিক। হাসান অরিন্দম ‘সোনালি জ্যোৎস্নার কল্পকথার’ মাধ্যমে মূলত দেশের সিস্টেমে নতুন রক্ত সঞ্চারিত হোক – পরোক্ষভাবে সেটাই প্রত্যাশা করেন।
‘তার কেবলই মনে হতো আবার আসবেন বিদ্রোহী নজরুল’ গল্পে চেঙ্গিস খান সজলদহ জেলা সদরের অগ্নিবীণা সড়কে ৯৯/ক বাড়িতে থাকে – বাড়ির নাম ‘ধূমকেতু’। ক্যাডেট কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক চৌধুরী আলিমদ্দিনের ছেলে চেঙ্গিস খান।
পিতা-মাতার মৃত্যুর পর সে বাড়িতে একা থাকে। দুই বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তারা স্বামীর সংসারে। চেঙ্গিস খান ছিল ক্যাডেট কলেজের ছাত্র। দুরন্তপনার শাস্তির ভয়ে সে কলেজ থেকে পালিয়ে যায়। সে-কারণে কলেজ প্রশাসন তাকে রাখেনি। চিত্রকর সৈয়দ সাজিদ হাসান আর চেঙ্গিস খানের আলাপচারিতায় গল্প জমে ওঠে। হাসান গল্পের বয়ানে কিছু ফাঁক-ফোকর রাখেন। সেখান থেকে পাঠক গল্পটি তাদের মতো করে বুঝে নিতে পারেন। সৈয়দ সাজিদ হাসান বুঝতে পারে, চেঙ্গিস খানকে আপাতদৃষ্টিতে উদভ্রান্ত দেখালেও সে যে-কোনো বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে পারে। ফেসবুকে চেঙ্গিস খানের উপস্থিতি ও মন্তব্য দেখে সাজিদ উদ্বিগ্ন হয় যে, এতে করে অনেকে তার শত্রম্ন হতে পারে। এক্ষেত্রে দুটি মন্তব্য উলেস্নখযোগ্য – ‘সৎ সাজার সহজ উপায় ধার্মিক সাজা’; ‘খ্যাতিমান কিংবা ক্ষমতাবান মানুষমাত্রই শ্রদ্ধেয় নয়’। চেঙ্গিস খানের স্ট্যাটাসগুলোর অনিবার্য পরিণতি ছিল ‘সজলদহে দুষ্কৃতিকারীদের অস্ত্রের আঘাতে চেঙ্গিস খান নামক একজন নিহত।’ সাজিদ বিশ্বাস করতে পারেনি, চেঙ্গিসের মতো একজন নিরীহ পাগলাটে লোক কারো শত্রম্ন হতে পারে। তার স্মৃতি টাটকা থাকতে থাকতে সে তেলরঙে ছবি আঁকার জন্য তুলির আঁচড় দিতে শুরু করে। ছবি আঁকার সময় সাজিদ দেখতে পেল পটে চেঙ্গিস নয়, নজরুলের মুখ হচ্ছে। হাসান প্রচলিত অবস্থার পরিবর্তন চান। এ-কারণেই নজরুলের পুনরাবির্ভাব তাঁর প্রত্যাশা।
‘দৃষ্টি জুড়ে ছায়াবাজির খেলা’ গল্পে তেষট্টি পেরোনো তমশেরের ঘুম আর জাগরণ একাকার হয়ে ওঠে চেতন-অবচেতনের গহিন গাঙে। এই ঘোরের মধ্যে তাকে একটি লোক পরামর্শ দেয়, ‘কেবল দুঃখগুলো জাবর না কেটে যেটুকু সুখ ছিল বা আছে সেগুলো মুছে ফেলছেন কেন মন থেকে?’ এটা উপলব্ধির পর তমশের নির্ভারচিত্তে ঘরে যায়। সে অবাক হয় – সে এক যুগে এতটা গভীরভাবে ঘুমতে পারেনি। অথচ আজ এক ঘুমে সকাল হয়ে গেল। তমশেরের মনে হয় শেষ বিকেলের নদীর তীরে যার সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেটা সত্যি, না ছানিপড়া চোখের দৃষ্টিভ্রম? হাসানের এই গল্পটি জাদুবাস্তবধর্মী গল্প। বিষয়বিন্যাসের কারণে চরিত্রসমূহ হয়ে উঠেছে অন্তর্সংলাপধর্মী ও স্বগতকথনমুখ্য। ঘটনাংশ বর্ণনায় আনুভূমিকতা অপেক্ষা উল্লম্ফনধর্মিতা প্রাধান্য পেয়েছে।
‘মেঘের আড়ালে ঢাকা ফোন নম্বর’ গল্পে পস্নট নির্মাণের ক্ষেত্রে নিরীক্ষা লক্ষণীয়। প্রথাগত ঘটনার বদলে অনুভব ও অনুষঙ্গ সম্মিলিতভাবে কাহিনিকে সম্প্রসারিত করেছে। আহমদ কারিম উপলব্ধি করেন, অসুস্থতা ও মৃত্যু থেকে পালিয়ে বাঁচা যায় না। তিনি অসুস্থ হয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি হন। তৃতীয়বারের মতো স্ট্রোক করায় তার মতিগতির ঠিক নেই। তার পাশের একজন রোগী ঈশ^রকে ফোন করতে চায়। এই ভাবনা তাকেও প্রভাবিত করে। কারিমের শেষ পর্যন্ত মনে হয়, চেতন-অবচেতনের গহবর থেকে উঠে আসা বিচিত্র চিন্তা তাকে সিজোফ্রেনিয়ার চক্রে ফেলতে পারে। অন্যের কাছে এসব বলে তিনি হালকা হতে চান। কিন্তু কন্যা সেঁজুতিকে বললে সে তাকে মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে চাইবে। পেস্নন ঢাকা এয়ারপোর্টে এলে কারিম পুনরায় নিজস্ব পৃথিবীতে মন কেন্দ্রীভূত করে নতুন নভেলের পস্নট নিয়ে ভাবতে থাকেন। মানবজীবনের অভ্যন্তর-বাস্তবতা রূপায়ণে গল্পকার বর্ণনাত্মক পরিচর্যারীতির পাশাপাশি বিশ্লেষণাত্মক পরিচর্যা রীতি গ্রহণ করেছেন। মানুষের অস্তিত্বকেন্দ্রিক জীবন-অভিজ্ঞতা, ভয়, উৎকণ্ঠা, মনস্তাপ তাঁর গল্পের লক্ষণীয় দিক।
‘ভয় ভয়’ গল্পে রূপায়িত হয়েছে মান্দারতলা গ্রামে আশ্রয় নেওয়া বাস ড্রাইভার বদু লস্করের মৃত্যু এবং গ্রামের মানুষের প্রতিক্রিয়া। গাড়ি দুর্ঘটনায় পতিত হলে ড্রাইভারের দুর্গতির কথা চিন্তা করে বদু পালিয়ে যায় এবং মোবাইল ফোনের সুইচ বন্ধ করে রাখে। শেষ পর্যন্ত মান্দারতলা গ্রামে মাজেদ ব্যাপারির বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেখানে বদু মারা গেলে দুজন নিকটাত্মীয় এসে মাইক্রোবাসে করে তার মৃতদেহ নিয়ে যায়। বদু লশকরের আঙুল থেকে প্রায় সাড়ে তিন আনার সোনার আংটি মাজেদ সরিয়ে রেখেছিল। সে-কারণে মিলাদ হওয়ার পর তার ভয় ভয় করতে থাকে। এ-গল্পে গ্রামীণ জীবনের ডিটেইলের পাশাপাশি বদুর মৃত্যুর পর প্রকৃতি-পরিচর্যায় হাসানের মুনশিয়ানা লক্ষণীয়।
‘হস্তাক্ষর ও মৃত্যুপাঠ’ গল্পে সাজিদ রহমানের হস্তাক্ষর-বিশারদ হওয়ার কার্যকারণ বর্ণিত হয়েছে। হাতের লেখা দেখে মন ও মননের দক্ষতা বিচার করতে পারেন অধ্যাপক সাজিদ রহমান। এ-কাজে দক্ষ হতে গিয়ে তিনি ঘরের ও অফিসের কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না। ঘুমের ঘাটতি দেখা যাওয়ার পাশাপাশি শর্ট মেমোরি লসেরও লক্ষণ প্রকাশিত হলো। স্ত্রী কান্তা তাকে মনোবিদের পরামর্শ নিতে বললেন। সাজিদ প্রেসক্রিপশন দেখে ভুয়া ডাক্তার চিহ্নিত করতে পারেন। সিনেমাহলে ছবির মাঝখানে সাজিদ কান্তাকে জানান যে, শ্যালিকা টুম্পার মধ্যে আত্মহত্যার মারাত্মক প্রবণতা রয়েছে। তাই হঠাৎ সাজিদের উদ্বেগ ও অস্থিরতা তৈরি হয়। তখন কান্তার ভেতর একটি সংকট তৈরি হয় – সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, বাসায় না মনোবিদের কাছে যাওয়া জরুরি। এ-গল্পে হাসানের গদ্য স্বতশ্চল। কাহিনিবিন্যাসে বর্ণনাধর্মিতা থাকলেও নাট্যিক গুণে গল্পটি ঋদ্ধ। ঘটনাংশ নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিধৃত হওয়ার ফলে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সাজিদ রহমানের চেতনাগত দৃষ্টিকোণ সমীকৃত হয়েই কাহিনি পল্লবিত হয়েছে।
‘জয়িতার প্রত্যাবর্তন’ গল্পে জয়িতার বিয়ে হয় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা শফিকের সঙ্গে। বিয়ের আগে মা তার মতামত চেয়েছিল, ‘তুই পারবি তো সবকিছু ছেড়েছুড়ে বরের সাথে জায়গায় জায়গায় ঘুরতে? তোর চাকরি আবার কীসব লিখিস-টিখিস।’ বিয়ের পর সাংবাদিক-বন্ধু রায়হানের সঙ্গে যোগাযোগ সীমিত করে দেয় জয়িতা। সে ঘর ও স্বামীতে মন নিবিষ্ট করে। কিন্তু ইউএনও শফিক ক্রমেই হীন মানসিকতার পরিচয় দিতে থাকে। তার সেলফোন কেড়ে নেয়, গৃহপরিচারিকা দ্বারা গতিবিধি তদারকি করে। ফলে এই পরাধীন জীবন থেকে পালিয়ে সে চলে আসে পূর্ববর্তী জীবন ও চাকরিতে। চার মাসের চেনা বরকে ছেড়ে আসায় তার কোনো পিছুটান বা অনুশোচনা কাজ করে না। এখানে কাহিনি-বর্ণনায় হাসান জীবনের জটিলতা উন্মোচনে আগ্রহী। এ-কারণে বর্ণনাত্মক পরিচর্যার পাশাপাশি বিশ্লেষণাত্মক পরিচর্যাও প্রাধান্য পেয়েছে। জয়িতার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, নতুন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া আপাতদৃষ্টিতে নারীবাদী হলেও তা মূলত মানবতাবাদী জিজ্ঞাসারই প্রতিফলন।
‘প্রেম ও পটভূমি’ গল্পে তৌসিফ মফস্বলের বিরানভূমিতে সরকারি কলেজের শিক্ষকদের জন্য নির্মিত ডরমিটরিতে একা থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-বছর জুনিয়র মৌমিতাকে নিয়ে একই ছাদের নিচে কেটেছে বৈবাহিক জীবন। তার একটি কন্যাসন্তানও রয়েছে। বহুদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির আশা তিনি একেবারে ছেড়ে দেননি। বন্ধুর পরামর্শ, অধ্যাপকদের আশ্বাস বিবেচনায় রেখে তিনি সিদ্ধান্ত নেন ভাইভার আগে কারো সঙ্গে দেখা করবেন না। মৌমিতার সঙ্গে সংসার না টেকায় একাকিত্বের শূন্যতা পূরণে তারই ছাত্রী রঞ্জনা এগিয়ে এলে প্রথমে তৌসিফ নিজেকে গুটিয়ে রাখে। তবে রঞ্জনার সাহস দেখে তৌসিফের মনে হয়, ওই বীরাঙ্গনা নারীর কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করতেই পারেন। চারপাশের প্রতিকূলতা ছাপিয়ে তাকে নাড়া দেয় রঞ্জনার গালের তিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে অবক্ষয়ের চিত্র গল্পের উপজীব্য হলেও একাকিত্ব মানুষের জীবনে যে-জটিলতা সৃষ্টি করে তার কাহিনি রূপায়িত হয়েছে।
হাসান অরিন্দম লঘু বিষয়কে তাঁর গল্পের উপজীব্য করেননি। বিষয়ভাবনায় তিনি সতর্ক ও সচেতন। আন্তর্জাতিকতা ও বিশ্বমনস্কতার কারণে জীবন পর্যবেক্ষণের মৌলিক দৃষ্টিকোণ পরিবর্তিত হওয়ায় আঙ্গিক বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা সৃষ্টিতে হাসান স্বতঃস্ফূর্ত ও সচেতন। তাঁর গল্প কালোত্তীর্ণ ছোটগল্প হয়ে উঠুক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।