হারুন পাশার ‘তিস্তা’র প্রসঙ্গ ও প্রকরণ

যতীন সরকার

 

হারুন পাশার তিস্তা একটি অন্যরকম উপন্যাস। প্রসঙ্গ ও প্রকরণ – দুদিক থেকেই এটি অন্যরকম। নদীকে বিষয়বস্ত্ত করে তো বাংলাভাষায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে অদ্বৈত মল্লবর্মণ পর্যন্ত অনেকেই উপন্যাস লিখেছেন। তিস্তা নদী নিয়েই দেবেশ রায়ের তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত তো বিপুলভাবে পাঠকনন্দিত একটি উপন্যাস। তবু, বলতেই হবে যে, তিস্তার প্রসঙ্গসূত্রেই হারুন পাশা অন্যদের থেকে অন্যরকম একটি উপন্যাস রচনা করেছেন।

কী করে এটি অন্যরকম একটি উপন্যাস হয়ে উঠেছে, সেটি হলো, বাংলা উপন্যাসের প্রচলিত বর্ণনারীতি থেকে আলাদা তিস্তা উপন্যাস। আমাদের প্রচলিত রীতিতে ঔপন্যাসিক বর্ণনা করেন কাহিনি এবং মাঝেমধ্যে চরিত্রের সংলাপ দেন। এমনকি এক লাইনেই লেখক এবং চরিত্রের কথা থাকে। তিস্তা উপন্যাসে এ-রীতি নেই, নেই লেখকের প্রবেশ। চরিত্ররাই নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলেছে। এগিয়ে যায় উপন্যাসের কাহিনি। এই বইয়ের ‘তিস্তা প্রসঙ্গে কিছু কথা’ মুখবন্ধটি যে-কোনো পাঠকের জন্যই অবশ্যপাঠ্য।

অ্যাকাডেমিক বিচারে তিস্তা অবশ্যই একটি ‘আঞ্চলিক উপন্যাস’। বিশ শতকেই বাংলায় আঞ্চলিক উপন্যাস রচনার সূচনা ও প্রসার ঘটলেও সে-সময়কার কোনো উপন্যাসই আঞ্চলিক ভাষায় রচিত হয়নি, পাত্র-পাত্রীদের সংলাপেই কেবল সে-ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। উপন্যাসের সংলাপে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারে পথিকৃতের মর্যাদা প্রদান করতে হয় শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে। তাঁর সম্পর্কে বিশিষ্ট সাহিত্য-সাধক রমাপদ চৌধুরী লিখেছেন –

‘আঞ্চলিক ভাষার সংলাপকে সাহিত্যে সর্বপ্রথম সার্থক আসন দিয়েছিলেন তিনি। এই একটি ক্ষেত্রে তিনি স্মরণীয় – অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্তের চেয়ে কম স্মরণীয় নন।’

শৈলজানন্দও কিন্তু এই ‘স্মরণীয়’ কাজটি সহজে সম্পাদন করতে পারেননি। তিনি যে আসানসোল-রানীনাক্ত অঞ্চলের কয়লাকুঠির শ্রমিকদের কথ্যভাষাকে তাঁর উপন্যাসে স্থান দিয়েছিলেন, সে-বিষয়টি তখনকার অনেক প্রথিতযশা সাহিত্যিকও অনুমোদন করেননি। এ-ব্যাপারে শৈলজানন্দ তাঁর আমার সাহিত্যিক জীবন গ্রন্থে লিখেছেন :

সাঁওতাল পরগনার প্রান্তসীমায় কাঁকর পাথরের এই দেশটি যেমন অনুর্বর, তেমনি রুক্ষ। সেখানকার কথ্য ভাষাতেও তাই সাঁওতালি টান। আমার এই প্রিয়
মাতৃভাষাকে কিছুতেই পরিত্যাগ করলাম না। সাহিত্যে ঢোকালাম তাকে। তাই না দেখে শরৎচন্দ্র বললেন, তুমি করেছ কী! এ আঞ্চলিক ভাষা তো অন্য অঞ্চলের মানুষের কাছে দুর্বোধ্য। এ তুমি ছেড়ে দাও। কথাটা মিথ্যা নয়। তবু আমার মনে খুঁত রয়ে গেল। ভাবলাম – রবীন্দ্রনাথকে একবার জিজ্ঞাসা করবো। … রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘না অন্যায় নয়। যে অঞ্চলের ভাষাই হোক, সাহিত্যে তার প্রবেশাধিকার আছে।’

রবীন্দ্রনাথ নিজে যদিও তাঁর কোনো উপন্যাসেই আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগ করেননি, তবু সংগতভাবেই তিনি যে-কোনো অঞ্চলের ভাষারই সাহিত্যে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। শৈলজানন্দের পর অনেকেই উপন্যাসের সংলাপে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন। বিশ শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকেই তেমনটি করেছেন আমাদের বাংলাদেশের অনেক ঔপন্যাসিকও। এঁদের মধ্যে আবুল মনসুর আহমদ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সরদার জয়েন উদ্দীন, শামসুদ্দিন আবুল কালাম – এই কয়েকজনের কথা বিশেষভাবে উলেস্নখ করা চলে। উলেস্নখ করতে হয় কবি জসীম উদ্দীনের কথাও।

সরদার জয়েন উদ্দীনের পান্নামতি (১৯৬৪) উপন্যাস সম্পর্কে কবি-সমালোচক আবদুল গনি হাজারী মন্তব্য করেছিলেন –

‘তাঁর উপন্যাসের সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, নাগরিক ভাষার সঙ্গে গ্রাম্য ভাষার অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তার চরিত্রগুলোকে কাহিনির প্রেক্ষিতে এমন করে উপস্থিত করা যাতে স্বভাবতই একথা আমাদের মনে হয় যে তার মানুষগুলো যেন গ্রামেরই মাটি দিয়ে গড়া, তারই হাওয়ায় যেন তার নিঃশ্বাস ফেলে পলস্নীর সুশ্যামল বনানীর দীর্ঘশ্বাসের চাপা আওয়াজে, যেন সেখানকার মাঠ ঘাট বিলে তাদের হৃদয় ছড়িয়ে রয়েছে মটর ফলের বুকের পুষ্টতায়। এখানে জয়েন উদ্দীনের কোন জুড়ি নেই। সে যেন গদ্য সাহিত্যের জসীম উদ্দীন।’

জীবনের অপরাহ্ণবেলায় কবি জসীম উদ্দীন বোবা কাহিনী (১৯৬৪) নামে যে-উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন, ব্যাকরণ অনুযায়ী সেটির ভাষাকে সাধু বাংলা ভাষা বলেই আখ্যায়িত করতে হবে। তবু এ-উপন্যাসের পলিস্নবাংলার শব্দ ও বাচনরীতির সঙ্গে গদ্যমিশ্রিত ভঙ্গিটিকে বিশেষ কোনো সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা দুরূহ।

এভাবে বিশ শতকের বিভিন্ন কথাকারের হাতে বাংলা উপন্যাসের আঞ্চলিক ভাষার বিভিন্নমুখী ব্যবহার ঘটতে থাকে। তবে সংলাপ, বর্ণনাসহ সবকিছুতেই আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে কোনো উপন্যাস, সম্ভবত একুশ শতকের আগে রচিত হয়নি। এ-শতকে, ২০০৬ সালের ফেব্রম্নয়ারিতে প্রকাশিত আগুনপাখিই বোধহয় আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত প্রথম বাংলা উপন্যাস। ১৫৮ পৃষ্ঠার পরিসরে বিধৃত একজন কৃষক-কন্যার আত্মকথাকেন্দ্রিক এই উপন্যাসটি লেখা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের উপভাষায়।

এর দশ-এগারো বছর পরে হারুন পাশার তিস্তার পা-ুলিপিটি হাতে এলো। এটি পাঠ করে আঞ্চলিক ভাষার বহুমাত্রিক প্রকাশ শক্তি সম্পর্কে অনেক নতুন ভাবনায় ভাবিত হলাম। আগুনপাখিতে তো একজনের কথা আছে, আর তিস্তায় রয়েছে অনেকজনের স্বর। ভাবের প্রকাশ তো ভাষার মাধ্যমেই ঘটে। বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবনযাত্রার বিশেষ ধরন বা প্রকৃতিই সেই মানুষদের ভেতর বিশেষ বিশেষ ভাবের সঞ্চার ঘটায়, সেসব ভাবকে ধারণ করেই বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষাতেও দেখা দেয় ভিন্নতা। তবে কোনো এলাকার ভাষাই একটি অবিমিশ্র আঞ্চলিক ভাষার ধারক হয়ে থাকে না। এক অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে আরেক অঞ্চলের মানুষের সংযোগে কিংবা এক অঞ্চলের মানুষের অন্য অঞ্চলের অধিবাসী হওয়ার সূত্রে, আঞ্চলিক ভাষাতেও দেখা দেয় বৈচিত্র্য ও অভিনবত্ব। এমনটিই ঘটেছে রংপুর এলাকাতেও। যাদের পূর্বপুরুষরা ময়মনসিংহ থেকে রংপুরে গিয়ে সেখানেই বসতি স্থাপন করেছে, তারা বাড়িতে কথা বলে ময়মনসিংহের ভাষায়, আর বাড়ির বাইরে ব্যবহার করে রংপুরের ভাষা। এই দুরকম ভাষাই ব্যবহৃত হয়েছে তিস্তা উপন্যাসে।

অভিনব রীতিতে রচিত উপন্যাসটির মূল বিষয় তিস্তা-ব্যারেজ-সৃষ্ট সমস্যা ও সংকট। পানি নিয়েও আন্দোলন হতে পারে। এর আগে সাহিত্যে বিশেষত উপন্যাসে এমন প্রেক্ষাপট খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে শুধু পানি নিয়ে আন্দোলন নয়, এ-উপন্যাসে জনজীবন তথা জনমানসের বহু বিচিত্র দিকেরই প্রতিফলন ঘটেছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তিস্তাপারের সকল মানুষ সংকটগ্রস্ত হলেও, এখানেও পুরুষতন্ত্রের প্রবল প্রতাপ বিদ্যমান। শুধু প্রতাপ নয়, পুরুষের ছলচাতুরীও। এখানেও পুরুষের প্রেমে পড়ে নারী, আর প্রেমের ফাঁদ পেতে পুরুষ নারীকে করে প্রতারণা। বাপের বয়সী পুরুষের হাতেও লাম্পট্যের শিকার হতে হয় যুবতী নারীকে।

লৌকিক জীবনে প্রতিনিয়ত মার খেতে খেতে অনেকেই অলৌকিকের শরণ নিয়ে মানসিক রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন ধরনের দুরবস্থায় পড়ে ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষেরা সর্বশক্তিমান আল্লার করুণাপ্রাপ্তির সম্পর্কেও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে – ‘গরীবরে আল্লাই বালোবাসে না, মানুষ কি বালোবাসপো? আল্লা যদি বালোবাসতো তাইলে আঙ্গোর কপালো এতো দুঃখু, কষ্ট, যন্ত্রণা কি দিতো? দিতো না। আল্লা বালোবাসলে আঙ্গোরে দনী বানায়া দুনিয়াত পাডাইতো। গরীবের দাম কুনু জাগাতি নাই। মামলায় যাও, বিচারে যাও, খাইতে যাও, পরতে যাও, দুহানো যাও, পাড়া-পড়শীর বাড়িত যাও কুনুহানো গরীবের দাম নাই। এ্যাকটা উহিলের কাছে গেলে গরীবের পুলা দিবো এ্যাক আজার, আর দনীর পুলা দিবো দুই আজার। এ্যাক আজারের দাম বেশি না দুই আজারের দাম বেশি? গরীবের দাম থাকলো? গরীবের গরো জন্মা অওয়াডাই বুল। আল্লা আঙ্গোরে বানায়া ক্যান এতো দুঃখু দেয়?’

তবু বিপদে-আপদে আল্লাহকে না-ডেকে তারা পারে না। আবার আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস তথা ধর্মবিশ্বাসের পাশাপাশি লোকসমাজে স্মরণাতীত কাল থেকে চলে আসা ‘ম্যাজিক বিলিফ’ বা জাদুবিশ্বাসও তাদের ভাবনাবৃত্তে সদা-প্রবহমান। তাই বিপদ-সংকুল নদীতে মাছ ধরতে আসা হতদরিদ্র মানুষটি শিলাবৃষ্টির হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য জাদুবিশ্বাসের আশ্রয় নিয়ে বলে – ‘বাড়িত বউরে কইয়া আই বড় বড় হিল পড়লে বাড়ির উডানো সইষ্যা ছিটাইবা, যাতে আসমান থাইক্যা বড় হিলের বদলে ছুডু হিল পড়ে।’

তবে ধর্মীয় অলৌকিকতায় কিংবা প্রাক্-ধর্মীয় জাদুপ্রকরণে যতই বিশ্বাস রাখুক, তাদের দুর্ভাগ্যের বাস্তব কারণসমূহ চিনে নিতে তাদের একটুও ভুল হয় না – ‘সংসার বড় অইতাছে আর নদীর মাছ কমতাছে। এইডার বড় কারণ অইলো নদী শাসন। আঙ্গোর তিস্তা শাসন হরতাছে ইন্ডিয়া। হ্যারা পানি ছাড়লে যে কয়ডা মাছ আয়ে নদীর মদ্দে আইতে আইতে শ্যাষ অয়া যায়।’ তিস্তা ব্যারেজের ‘যখন কপাট বন্দ করে তখন উজানত এ্যাকনা পানি আইসে। কপাট খুলি দিলে মুতি যে পানি নিবে ওইকনায় পাওয়া কষ্টের হয়।’

ভোটাভুটির রাজনীতি যে তাদের প্রতারণা করে, পুলিশের হাতে যে নির্দোষ মানুষও মার খায়, বড়লোকেরা বড় বড় দোষ করে পার পেয়ে যায়, নির্দোষ গরিবদেরই যে বড়লোকদের দোষের দায় বহন করে ভোগান্তিতে পড়তে হয়, – প্রবহমান বাস্তবতার এরকম বহু দিকেরই প্রকাশ ঘটেছে হারুন পাশার তিস্তায়।

পুরো আঞ্চলিক ভাষায় রচিত উপন্যাসটি পড়ে আমার মনে হয়েছে যে, শুধু উপন্যাস নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উপভাষার উপাদান গ্রহণ করে আমাদের সাহিত্যের সকল প্রকরণেই সমৃদ্ধির নতুন মাত্রা যুক্ত হতে পারে। হারুন পাশাকে ধন্যবাদ।