হাসান আজিজুল হকের গদ্য : বিষয় ও রচনাকৌশল

একজন সৃজনশীল মানুষকে নিয়ে লিখতে গিয়ে স্বভাবতই তাঁর সৃজনশীল রচনার কথাই সবার আগে মনে পড়বে। পাঠকের বেলায়ও বিষয়টি সত্য। বিশেষত যাকে আমরা প্রচলিত ধারার কবিতা গল্প উপন্যাস বলি, তার প্রতি সবার আগ্রহ বেশি থাকে। তবে কবি বা লেখকের রচনার ক্ষেত্রে তাঁর কোন রচনা সৃজনশীল নয়, তা বলা রীতিমতো দুঃসাধ্য। সে-চেষ্টা অবশ্য না করাই উচিত। কারণ একজন সৃজনকর্মী সর্বসময়ের জন্য শিল্পী। কাজেই তিনি যা রচনা করেন তার প্রতিটি পরতে সৃজনশীলতার ছোঁয়া থাকে। তিনি যদি প্রবন্ধ লেখেন বা ডায়েরি লেখেন বা কোথাও তাৎক্ষণিক বক্তৃতা দেন তবু তার ধরন অন্যদের চেয়ে আলাদা। একটা স্বতন্ত্র দৃষ্টি বা ভঙ্গি তাঁর থাকে, যে-ভঙ্গি অন্য কারো মতো নয়। যদিও তিনি সামাজিক জীব, পারিবারিক সদস্য অন্যদের মতো এবং সেজন্য যাবতীয় পারিবারিক-সামাজিক কাজ করেন, কথাবার্তা চালিয়ে যান সবার মতো, তবু এর মধ্যেও তিনি আলাদা; হয়তো এক দঙ্গল লোকের মধ্যে থেকেও তিনি নিভৃতে তাঁর সৃজনকর্মের পরিকল্পনা করছেন বা কোনো শৈল্পিক বুনন চলছে তাঁর মাথার ভেতর। আরো একটি বিষয় এখানে বলা প্রয়োজন যে, সৃজনশীল ব্যক্তির সৃষ্টি বা রচনা মূল্যায়নের জন্য মূল্যায়নকারী লেখককে সৃজনশীল হতে হবে। তিনি সৃজনশীল না হলে লেখকের রচনা সম্পর্কে যে-ব্যাখ্যা তিনি দেবেন সেখানে গলদ থেকে যেতে পারে। সবচেয়ে জরুরি হলো, লেখক বা শিল্পী যা লেখেন, যে-অনুভূতির কথা বলেন তা উপলব্ধি করার ক্ষমতা সবার থাকে না, সেজন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমালোচকের কাছে অহেতুক বা গুরুত্বহীন মনে হতে পারে। যাঁরা সৃজনশীল ব্যক্তি নন, তাঁদের রচনা, বিশেষত গদ্য বা অন্য জাতীয় রচনা, সৃজনশীল সাধারণত হয় না। সাহিত্যের নানা মাধ্যমে লেখার ক্ষেত্রে লেখকের রচনার চারিত্র পালটে যায় – সে-পরিবর্তনে লেখকের বাকভঙ্গিসহ শব্দচয়ন এমনকি বাক্যরীতিও পালটে যেতে পারে। এমনিতেই একেকটি ফর্ম একেক ধরনের শৈলী গ্রহণ করতে চায়। এবং সে-কারণে লেখককে কবিতার বেলায় বা গল্প-উপন্যাসের বেলায় স্বতন্ত্র ভাষারীতি তৈরি করে নিতে হয়। যাঁরা একই সঙ্গে অনেকগুলো মাধ্যমে লেখেন, তাঁদের বেশ সতর্ক থাকতে হয়। কিন্তু গদ্য বা পদ্যের ব্যবধান না থাকলেও লেখককে সতর্ক থাকতে হয় প্রতিটি নতুন লেখার সময়। লেখকের এই কাজে পাঠক সম্পৃক্ত নন বা পাঠকের এসব জানার কথা নয়। তবু লেখার নতুনত্ব বলতে যা বোঝায় সেটা সবসময় বিষয়ের ওপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে এর প্রকরণের ওপর। যাঁরা শুধু গদ্যভাষা ব্যবহার করে লেখেন, তাঁদের বেলায়ও গদ্যের ভাষার তারতম্য ঘটে। তিনি উপযুক্ত বিষয় ও ফর্মের জন্য নির্দিষ্ট ভাষা ব্যবহার করেন, ঢংটি পালটে যায়। সত্যি কথা বলতে, এসব বিষয়ে যাঁরা সচেতন নন, যাঁরা শুধু বিষয়গৌরব নিয়ে থাকেন, লেখক হিসেবে তাঁরা বৈচিত্র্যপূর্ণ নন।

পঞ্চাশের দশকের বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। তিনি প্রধানত ছোটগল্পের লেখক। কয়েকটি উপন্যাসও তাঁর রয়েছে। এর বাইরে রয়েছে তাঁর অজস্র  নন-ফিকশনাল লেখা। সেগুলোকে সৃজনশীল বলতে না চাইলে লেখকের প্রতিভা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। অবশ্য হাসানের পাঠক মাত্র জানেন যে, তাঁর কথাসাহিত্যের গদ্যও কত সৃজনশীল ও মননঋদ্ধ। আমরা অবশ্যই তাঁর সৃজনশীল লেখাকে অধিকতর মর্যাদা দিতে চাই বা দেওয়া উচিত। এবং সেখানে লেখকের প্রকৃত সত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রশ্ন উঠতে পারে, লেখক নিজেও যেহেতু জানেন তাঁর আসল ক্ষেত্র হলো সৃজনশীল রচনা (যা হাসানের বেলায় গল্প বা উপন্যাস) তাহলে তিনি কেন অন্য রচনার দিকে ধাবিত হন বা লিখতে চান? সেটা কি বাধ্য হয়ে? নাকি কোনো সম্পাদকের পীড়াপীড়িতে? এবং সৃজনশীল লেখকের অসৃজনশীল রচনার গুরুত্ব কতটুকু? আমাদের ধারণা, লেখক কারো অনুরোধ বা উপরোধে সৃজনশীলের বাইরে লিখে থাকলেও সেখানে লেখকের শিল্পমানসের যোগ থাকে পুরোপুরি। প্রতিটি লেখায় লেখকের সত্তা হাজির হয়ে যায়। সেখানে লেখকের মতামত দর্শন মানস বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার পরিচয় মেলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লেখকের অপ্রধান রচনায় লেখকের মূল রচনার অনেক জিজ্ঞাসার জবাব মেলে। এখানে লেখক অনেকটা প্রত্যক্ষ আর মূল বা সৃজনশীল রচনায় তিনি খানিকটা পরোক্ষ। সে- পরোক্ষতা অবশ্য লেখাটি শিল্প হয়ে ওঠার জন্য জরুরি। যে-প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি রচনাটিকে শিল্পে পরিণত করে, সেই উপস্থিতির প্রত্যক্ষতা অন্য রচনাটিকে অসৃজনশীল করে তোলে। তবে দুই সৃজনকর্মের কর্মী যেহেতু একই ব্যক্তি, সে-কারণে সৃজনীপ্রতিভা সব জায়গায় থাকে ভিন্ন অনুপাতে। যে-লেখক একই সঙ্গে অনেক ফর্মে কাজ করেন তিনি জানেন যে, তাঁর মস্তিষ্কে যেসব প্রসঙ্গ বা অনুভূতি তাঁকে আলোড়িত করে, তার জন্য সব মাধ্যম উপযুক্ত নয়। সেজন্য তাঁকে বিষয় অনুযায়ী মাধ্যম নির্দিষ্ট করতে হয়। ধরা যাক, তাঁর মাথায় দারিদ্র্য বিষয়ে একটি আইডিয়া এলো, এটা নিয়ে তিনি গল্প লেখার কথা ভাবতে শুরু করলেন; কিন্তু কিছুক্ষণ এগোনোর পর তাঁর মনে হলো এটার জন্য গল্প উপযুক্ত জায়গা নয়, তাঁর জন্য উপযুক্ত জায়গা হলো প্রবন্ধ। কারণ দারিদ্র্য মোটা দাগের বিষয়, এটা নিয়ে কবিতাও লেখা চলে না, গল্প লিখতে গেলে দারিদ্র্য বিষয়ে কোনো উপযুক্ত পরিপ্রেক্ষিত তাঁর মনে পড়তে হবে বা এ-জাতীয় অভিজ্ঞতা তাঁর থাকতে হবে। বরং প্রবন্ধ লিখে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে থাকবেন। অন্যদিকে গল্পকার যদি প্রবন্ধ লিখতে না পারেন, তবে ওই বিষয় নিয়ে তাঁকে বিপাকে পড়তে হবে অথবা তাঁকে অসফল একটি গল্প লিখতে হবে। একজন লেখক বিভিন্ন মাধ্যমে লিখে তাঁর বিচিত্র প্রতিভার যেমন পরিচয় দেন, তেমনি তাঁর নিজের

লেখক-সত্তার বৈশিষ্ট্যকে সবার মধ্যে উন্মুক্ত করে দেন। হাসান আজিজুল হকের ননফিকশনাল গদ্য তাঁর চারপাশটাকে চিনিয়ে দেয়, পরিপূর্ণ হাসানকে বোঝার জন্য তাঁর এ-জাতীয় গদ্য রচনা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে সাহিত্যের বাইরে অন্য অজস্র বিষয় নিয়ে তাঁর মতামত ও অবস্থান জানা যায়। একই সঙ্গে এই রচনা তাঁর মূলধারার রচনার ব্যাখ্যাও বটে। একজন লেখক যত বেশি অন্য লেখকদের নিয়ে বা অন্য বিষয় বা মাধ্যমে লিখবেন, তিনি তত বেশি প্রকাশিত হবেন। তিনি যে নিজেকে সমসাময়িক রাখতে পারেন বা অন্যদের রচনা সম্পর্কে তাঁর জানাশোনা আছে, সেটাও এ-রচনার মাধ্যমে জানা যায়। এ-জাতীয় লেখায় তাঁর সমাজ, সংস্কৃতি, সংসার, পরিবার, রাষ্ট্র, ভাষা, নৈতিকতা, দর্শন, জীবনভঙ্গি, রুচি প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে মতামত জানা যায়। হাসান আজিজুল হকের গদ্য রচনায় (এখানে গদ্য বলতে ননফিকশনকে বোঝানো হবে) বিচিত্রভাবে আমরা তাঁকে পাই – বাগ্মী ও আপসহীন এক শিল্পী, যেন অনবরত নিজেকে প্রকাশ করে যান, ব্যবচ্ছেদ করে যান তাঁর দেখা পৃথিবীকে। বিচিত্র জীবনাভিজ্ঞতার প্রতিটি অণু-পরমাণু তিনি হয়তো গল্পে গাঁথতে পারেন না সবসময়, সেটা চলে আসে তাঁর গদ্যে। সেখানেও তিনি সচল সাবলীল স্বচ্ছতোয়া। এমনকি তিনি যখন সাহিত্য-সমালোচনা করেছেন সেটাও প্রচল ধারার নয়। প্রবন্ধের নামকরণ থেকে শুরু করে ব্যাখ্যা-বিশেস্ন­ষণ ও আয়োজন মিলিয়ে তাঁর লেখার জগৎ স্বতন্ত্র। আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীল রচনার বাইরে অজস্র রচনা আছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বাইরেও ধর্ম সমাজ সংস্কৃতি সভ্যতা দর্শন অর্থনীতি রাষ্ট্রনীতি এমনকি ব্যাকরণ বিষয় নিয়েও লিখেছেন। তিনি নিজের লেখা সম্পর্কে যেমন লিখেছেন, তেমনি তাঁর সমসাময়িক বিভিন্ন লেখককে নিয়েও লিখেছেন। নিজের বা অন্যের লেখা নিয়ে তিনি বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েছেন। এর অর্থ এই যে, তিনি সবসময় প্রাসঙ্গিক ছিলেন, তাঁর সময়ে যাবতীয় বিষয়ে তিনি জড়িত ছিলেন। খ্যাত-অখ্যাত নবীন-প্রবীণ সবার লেখাকে তিনি সাদরে গ্রহণ করেছেন (দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে, যেমন মীর মশাররফ হোসেন বা বিষাদ-সিন্ধু নিয়ে তিনি কোথাও কিছু লেখেননি)। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমাদের কোনো বড় লেখক রবীন্দ্রনাথের এই আদর্শকে গ্রহণ করেননি, হয়তো তাঁরা এর তাৎপর্য বুঝতে পারেননি। তাঁরা অন্য কারো লেখা কদাচিৎ পড়েন আর তাঁদের সম্পর্কে কখনো লেখেন না। অন্যের লেখা পড়লে বা তাঁদের নিয়ে লিখলে যে নিজেই আলোকিত বা আলোচিত হতে পারেন এই বোধ তাঁদের হয়তো নেই। আর এভাবেই একটা দেশের যাবতীয় সাহিত্য আলোর পাদপ্রদীপে আসে, সাহিত্যের সত্যিকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধিত হয়। যাহোক, আমরা হাসান আজিজুল হকের বেলায় লক্ষ করব যে, তিনি সমালোচনা সাহিত্য নিয়ে বেশ এগিয়ে গেছেন। অন্য লেখকদের নিয়ে তিনি লিখেছেন, তবে কম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা প্রতিষ্ঠিত লেখক; নবীনদের নিয়ে তিনি লেখেননি। সাহিত্য-সমালোচনা নিয়ে তাঁর প্রধান গ্রন্থটি (কথাসাহিত্যের  কথকতা) অবশ্য বিপুলভাবে পাঠক সমালোচক গবেষক গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের কথাসাহিত্য নিয়ে তাঁর যে-উপলব্ধি, সেটি খাঁটি তো বটেই, একই সঙ্গে তা বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের প্রকৃত চেহারাকে শনাক্ত করে। তিনি সেসব জায়গায় আলো ফেলেছেন,  যেখানে আগে তেমন আলো পড়েনি।

হাসানের ননফিকশনের বিষয়বস্ত্ত ও তাঁর বৈচিত্র্য লক্ষ করার মতো; সমাজ সংস্কৃতি সংসার সাহিত্য শিল্পের নানা বিষয় নিয়ে তিনি বিভিন্ন সময়ে লিখেছেন। সে-লেখার প্রতিটির জন্য তাঁর স্বতন্ত্র মনোযোগ লক্ষ করা যায়, লক্ষ করা যায় কী বিচিত্রভাবে জীবনকে তিনি অবলোকন করেছেন। আমাদের চারপাশটাকে আমরা যেভাবে দেখি, যেভাবে উপলব্ধি করি, সেভাবে সব সময় উপস্থাপন করতে পারি না। সৃজনশীল ব্যক্তিরা যা দেখেন তা পেয়ে তাকে আরো ভালোভাবে, আরো গভীরভাবে বর্ণনা করতে পারেন; সে-বর্ণনা সে-কারণে অন্যদের অন্তর ছুঁয়ে যায়। সমালোচনা তাঁর এ-জাতীয় রচনার বড় একটা অংশ জুড়ে আছে – এ-কথা ঠিক, তবে তাঁর সমালোচনা প্রচলিত বা টাইপড নয়, বরং সেখানেও সৃজনশীলতা উপস্থিত প্রগাঢ়ভাবে। কথাসাহিত্যের কথকতা, অতলের আঁধি, অপ্রকাশের ভার, সক্রেটিস, ছড়ানো ছিটানো, চালচিত্রের খুঁটিনাটি এগুলো তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এটা ঠিক যে, তাঁর গদ্যজাতীয় রচনা সবটা পরিকল্পনা করে রচিত হয়নি। দু-একটি ছাড়া অন্য গ্রন্থের বেলায় এ-মন্তব্য করা চলে, তবে এ-প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, অতি ক্ষুদ্র রচনার বেলায়ও তিনি স্বতঃস্ফূর্ত। বিচিত্র বিষয়ে তিনি লিখেছেন : সাহিত্য সংস্কৃতি শিল্প বা সমালোচনা হয়তো মোটা দাগে তাঁর বিষয়বস্ত্ত তবে সে-বিষয়ের বাইরে মানবজীবন সংশিস্ন­ষ্ট অজস্র বিষয় রয়েছে তাঁর পেটিকায়। একটা বড় অংশ জুড়ে তাঁর রচনায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ; স্বাধীনতা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা, ভাষা, তার আগে আছে স্বাধীনতার পটভূমি, দেশভাগ, দাঙ্গা, উদ্বাস্ত্ত সমস্যা, শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় ও তার শিক্ষা, ভাষারীতি, প্রমিত বাংলা, উচ্চারণ, ভাষা-আন্দোলন, দুর্নীতি কিংবা জনগণের অধিকার। বলা বাহুল্য, স্বদেশ নিয়ে তাঁর আকুতি বা উপলব্ধি ধরা পড়েছে প্রতিটি লেখায়। বাংলা সাহিত্যের অনেক লেখকের লেখা নিয়ে তিনি তাঁর অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন, নিজের মতামত দিয়েছেন, সাহিত্যের মৌল বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে এসব লেখার তুলনা করেছেন। তাঁর পূর্বসূরি অনেকের এবং সমসাময়িক অনেক লেখক নিয়ে রচনা করেছেন কিছু মূল্যবান প্রবন্ধ। সব লেখাই বিস্তারিত নয়, তবে তাঁর ক্ষুদ্র লেখাও তাৎপর্যপূর্ণ। পূর্বসূরিদের মধ্যে আছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মীর মশাররফ হোসেন, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, আবুল ফজল, জগদীশ গুপ্ত, কমলকুমার মজুমদার, বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, সরদার জয়েনউদ্দীন, শিবরাম চক্রবর্তী, শামসুর রাহমান, শিবনারায়ণ রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আরজ আলী মাতুববর, এখলাস উদ্দীন ও আনিসুজ্জামান। সমসাময়িকদের নিয়ে লিখেছেন, তবে তা পরিমাণে বেশ কম। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে নিয়ে তাঁর একাধিক লেখা আছে। অবশ্য বাংলাদেশের কথাসাহিত্য নিয়ে লিখিত প্রবন্ধে তিনি বাংলাদেশের উল্লে­খযোগ্য লেখকদের নিয়ে লিখেছেন। বন্ধুবান্ধব সংস্কৃতিকর্মী যাঁদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় বা সখ্য ছিল কিংবা পরিচয়হীন ব্যক্তি যাঁরা বাংলা ভাষা সাহিত্য বা বাংলাদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতিতে বিশিষ্টজন হয়ে উঠেছেন নিজ গুণে, তাঁদের নিয়েও তিনি লিখেছেন। নাজিম মাহমুদ, ওয়াহিদুল হক এই দুজন সংস্কৃতিকর্মীকে নিয়ে তিনি নিজের মতামত ও সম্পর্ক বিষয়ে কথা বলেছেন। বিশ্বসাহিত্যের কিছু লেখককে নিয়ে তিনি কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছেন – গুন্টার গ্রাস, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, নগুগি উয়া থিয়োংগো – এঁরা হলেন এই তালিকাভুক্ত। সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে তাঁর রচনা লক্ষ করলে বোঝা যাবে, তিনি একটা বিশেষ ধারার মানুষ সম্পর্কে আগ্রহী, যাঁরা প্রগতিশীল এবং হয় সত্যিকার অর্থে মানুষ অথবা লেখক। এক হিসেবে তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রধান রূপকার সম্পর্কে তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মন্তব্য ও বিশেস্নষণ তীক্ষ্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ এবং তাঁর নিজস্ব দার্শনিক প্রত্যয় দ্বারা ব্যাখ্যাত। সব মিলিয়ে তাঁর এ-জাতীয় রচনা বাংলা ও বাংলাদেশের সাহিত্যের একটি বাকচিত্র, যা আমরা পেয়ে যাই বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাখ্যায়।

সাহিত্য বা সাহিত্যব্যক্তিত্বের বাইরে তিনি আরো অনেক বিষয় নিয়ে লিখেছেন; বিশেষত দর্শন শাস্ত্র নিয়ে তাঁর বেশকিছু অ্যাকাডেমিক লেখা আছে। দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপনার সুবাদে এই লেখাগুলো তিনি তৈরি করেছেন। এখানেও তাঁর সৃজনীশক্তি ও নিজস্ব মননের পরিচয় মেলে। ‘মার্কসীয় দর্শন’, ‘মানবকল্যাণ’, ‘বাংলাদেশ দর্শন’, ‘গণিত ও অধিবিদ্যা : কান্ট’ – এগুলো এ-জাতীয় লেখা। সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর চিন্তাকে তিনি গ্রন্থিত করেছেন, বাংলাদেশের সামাজিক নানা সমস্যা নিয়ে তিনি ব্যাখ্যা ও বিশেস্নষণ করেছেন, নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। তবে উল্লেখ করা যায় যে, রাজনৈতিক বিষয়ে তিনি সচেতন হলেও এ-বিষয়ে তেমন কিছু লেখেননি। হয়তো বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভয়াবহ অবস্থা নিয়ে তিনি কথা বলতে আগ্রহ পাননি। তবে আমরা যারা ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে জানি তারা জানি যে, তিনি প্রবলভাবে রাজনীতি-সচেতন এবং বিভিন্ন আলোচনায় বা সভায় রাজনৈতিক বিষয়ে তাঁর মতামত সরাসরি বলতে দ্বিধাবোধ করেন না। তবে আগেই যেমনটা বলেছি, তাঁর লেখায় বাংলাদেশ বিপুলভাবে উপস্থিত, বিশেষত বাংলাদেশের সমসাময়িক বাস্তবতা ও সমস্যা নিয়ে তিনি স্পষ্টভাবে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন।

তিনি এমন কতকগুলো বিষয় তাঁর রচনায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন যে তাঁকে ভিন্নরুচির বা সূক্ষ্মরুচির লেখক হিসেবে সহজেই শনাক্ত করা যায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তাঁর বাগ্মিতা ও হিউমার। তিনি যে মানবের বিচিত্র কৌতূহলের জায়গা নিয়ে লিখেছেন ক্ষুদ্র বা বড় রচনা তাকে নতুনধারার রচনা হয়তো সমালোচকরা বলবেন না, তবে হাসানের সমগ্র রচনার তুলনায় এ-জাতীয় রচনা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ – তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়ের সূক্ষ্মতার জন্য যেমন, তেমনি লেখকের ভাবনার অভিনবত্বের জন্য। কয়েকটি উদাহরণ লক্ষ করা যেতে পারে; ‘নিঃসঙ্গতার বাস্তব’, ‘বুদ্ধির দায়ে বুদ্ধিজীবী’, ‘শিক্ষার মৃত্যু ঘটেছে, কেবল অমেত্ম্যষ্টিক্রিয়া বাকি’, ‘বাংলাদেশ : পালিয়ে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায়’, ‘গানের গুঁতো’, ‘পথ জুড়ে শুধুই কাঁটাবালি’, ‘ফুরায় না সব লেনদেন’, ‘বই : শূন্য হাতে ফেরা’, ‘নিজের দিকে ফেরা’, ‘গণতন্ত্র : বাও মেলে না’, ‘জোড়াখোলা সেলাই-রেখায়’, ‘জীবনের পক্ষে মাথা নিচু করে দাঁড়াতে হয়’, ‘মুক্তিযুদ্ধটা আবার শুরু করতে হবে’, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’, ‘আরণ্যক : বাড়ি কি গৃহ?’, ‘না-লেখা’ ইত্যাদি। প্রবন্ধ বা নিবন্ধের নামগুলো শুনলেই কেমন একটা নতুনত্বের স্পর্শ পাওয়া যায়। তবে নামই এখানে মূল চমক নয়, মূল চমক লেখায়। একটা বিষয়, হাসানের গদ্য পড়তে গিয়ে মনে হবে যে, কত বিচিত্রভাবে তিনি তাঁর চারপাশের জগৎকে উপলব্ধি করেছেন। এবং যে-উপলব্ধির সারাৎসার নিয়ে তিনি প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন, সেখানে ধীরে ধীরে তাঁর সত্তা ও বোধি প্রকাশিত হয়, প্রকাশিত হয় তাঁর নানা প্রকরণ ও ব্যঞ্জনা। নানা কৌণিকে তাঁর চিন্তাসূত্র পাঠকের অনুভূতির জগৎকে উত্তেজিত করে। বস্ত্তত হাসানের লেখার যে ব্যাপ্তি ও বৈভব তা তাঁর চিন্তা, কল্পনা ও অনুভবসৌন্দর্যের যোগফল। আবার অন্য একটা কথাও এ-প্রসঙ্গে বলা উচিত যে, তাঁর সৃজনশীল রচনায় তিনি নিজেকে আড়ালে রেখেছেন, তাঁকে সেখানে ঠিক চেনা যায় না; এখানে, এই গদ্যে তাঁকে প্রায় বোঝা যায়। বলতে কী, হাসান যেভাবে হাসান হয়ে উঠলেন সে-পথরেখা এখানে পাওয়া যায়। বাল্য-কৈশোর থেকে লেখক হয়ে ওঠার শুরুতে, অপরিণত থেকে পরিণত লেখক হওয়ার যাত্রায়, খ্যাতি পাওয়ার পর, কিংবা সমাজ সংসার রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার পর তাঁর অনুভূতি নানান বিষয় আমরা পেয়ে যাই তাঁর এসব গদ্যে।

সমালোচনা-সাহিত্য নিয়ে তাঁর লেখা বেশ আলোচিত; তিনিও সমালোচকদের এক হাত নিয়েছেন। এবং সমালোচনা কীভাবে হওয়া উচিত, আদৌ সমালোচনা সম্ভব কিনা এসব নিয়ে বেশ রাগতসুরে প্রবন্ধ লিখেছেন। সমালোচকদের তিনি একবার হাভাতে বা ডাকাত বলেছিলেন, যারা পরের পাতের ভাত কেড়ে খায়। অর্থাৎ যারা কিছুই করতে পারে না, তারা অন্যের লেখার সমালোচনা করে লেখক হতে চান। এ-ধরনের কয়েকটি লেখার মূল বক্তব্য ছিল, আগে মূল রচনা, তারপর সমালোচনা, সমালোচনার গুরুত্ব আছে তবে তা মূল রচনাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে।

যেসব লেখার শিরোনাম বা বিষয়বস্ত্তর ফিরিস্তি ওপরে দেওয়া হলো সেখানে হাসান আজিজুল হকের চিন্তার পরিধি সম্পর্কে হয়তো খানিকটা আঁচ করা যেতে পারে। তবে আমাদের ধারণা, সত্যিকারের হাসান আজিজুল হককে বা গদ্যের বৈচিত্র্যকে জানার জন্য বা গদ্যের পরিধি জানার জন্য তাঁর বিচিত্র-বিষয়ের গদ্যের কাছাকাছি যেতে হবে আমাদের, যেখানে তিনি নিজেকে উজাড় করে লিখতে পেরেছেন।

হাসানের গদ্য চমৎকার বলেছি। এর সঙ্গে যোগ করতে চাই তাঁর গদ্য স্বতন্ত্র ডিকশন তৈরি করেছে, আর সেটা সম্ভব হয়েছে তাঁর ভাষারীতির নতুনত্বে ও বিষয়ের গভীরে যাওয়ার ক্ষমতার কারণে। হাসানের পাঠকরা জানেন, তিনি যে-বিষয়ে কথা বলেন সেখানে তিনি আলাদা একটা স্বর তৈরি করেন, সে-স্বরটি হাসানীয়, তাঁর সঙ্গে যার মতপার্থক্য আছে তিনিও স্বীকার করবেন হাসানের বলার ধরনটি আকর্ষণীয়। তবে এ-কথা ঠিক যে, কোনো লেখকের গদ্য ভালো লাগে বলা যেমন সহজ, তেমনি তা কেন ভালো লাগে তা বলা বেশ কঠিন। যে-যে গুণ সংশিস্নষ্ট লেখকের গদ্যকে নতুন মাত্রা দেয় বা নতুন ভঙ্গি দেয় তা শনাক্ত করা শক্ত। আমরা স্টাইল নিয়ে অনেক মন্তব্য বাছাই করতে পারি, অনেক উদাহরণ দিতে পারি স্টাইলের। তবু সত্যিকার অর্থে শৈলী নিয়ে মন্তব্য করা বেশ বিব্রতকর ব্যাপার। বহুল প্রচলিত সে-বাক্যটি মনে করা যাক – যেখানে বলা হয়েছিল, শৈলী হচ্ছে সেই মানুষটি (style is the man)। অর্থাৎ শৈলীর সঙ্গে ওই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব জড়িত, তার রুচি জড়িত, সংস্কৃতি জড়িত। শৈলীর সঙ্গে লেখকের মনস্তত্ত্ব-মানস-মনোভঙ্গি জড়িত। একজন মানুষ কীভাবে বাক্য তৈরি করবে সেটা তার মানসিক স্থৈর্য, মনস্তত্ত্ব, ব্যক্তিত্বের ওপর নির্ভর করে। বাক্য দিয়ে ওই ব্যক্তির মানসগঠনের খানিক বৈশিষ্ট্য জানা যায়। এসব কথাও শৈলী বিচারের বেলায় ছেঁদো, এসব দিয়ে কার্যত শৈলীকে ঠিক আয়ত্ত করা যাবে না কিংবা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা যাবে না। মানুষের চিন্তা করার ধরন বা বিষয়ের ভেতরে যাওয়ার ধরন একেকজনের একেকরকম। এ-সম্পর্কে ভাষাবিজ্ঞানীরা বেশ যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনা করেছেন। বাস্তবিক ভাষা কীভাবে সাহিত্যে নতুনভাবে গঠিত হয় বা নতুন প্রাণ পায় তা সহজে বোধগম্য নয়। ভাষা সাহিত্যের বেলায় নতুন উপাদান হিসেবে তৈরি হয়ে যায়, সেখানে তৈরি করার ক্ষমতা-শক্তি-ইচ্ছা অন্যতম নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। একজন লেখকের রচনা কতটা শ্রেষ্ঠ বা অতুলনীয় সেটা অনেক সময় তাঁর ভাষা-ব্যবহারের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন লেখকের ভাষারীতিকে লক্ষ করলে এসব বক্তব্যের কিছু সারসত্তা খুঁজে পাওয়া যাবে। বঙ্কিম যেভাবে উপন্যাসে বাংলাভাষাকে নির্মাণ করেছিলেন সেজন্যই তিনি মূলত অনন্য। তাঁর অসৃজনশীল গদ্যে সে-ভাষারীতি পালটে গেছে সত্য, তবে সেখানেও বঙ্কিম প্রবলভাবে তাঁর ভাষাশৈলী নিয়ে উপস্থিত। একই কথা রবীন্দ্রনাথের বেলায় বলা চলে। রবীন্দ্রনাথের মতো বিচিত্রভাবে বাংলাভাষাকে বোধ করি কেউ ব্যবহার করতে পারেননি। কবিতা, গান, নাটক, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব ভাষাশৈলী তৈরি করেছেন এবং প্রতিটি ফর্মের মধ্যে ভাষার দূরত্ব রেখেছেন। হাসান আজিজুল হককে এতটা করতে হয়নি। তবে তিনি

ভাষা-ব্যবহারের এই মৌলিক কৌশল ও ভাষার বিচিত্র ক্ষমতা-প্রয়োগরীতি ভালোভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। মানিকের রচনার ভাষা সম্পর্কে হাসানের যে-উপলব্ধি সেদিকে নজর দিলে বোঝা যায়, তিনি ভাষা নিয়ে কতটা সচেতন। তাঁর মন্তব্য লক্ষ করা যাক : ক. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষারীতির দিকে একটু নজর দিলে ঠিক এই ধারণাটা তৈরি হয় যে, ভাষা তিনি ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন বাস্তবকে শান দেওয়ার পাথর হিসেবে যাতে বাস্তব পাতলা হয়, সূক্ষ্ম হয়, আগুনের মতো উজ্জ্বল তপ্ত হয় আর তাতে দেখা দেয় ক্ষুরের ধার। … ভাষাকে শান দেওয়ার পাথর বলা গেল সেটাও বোধহয় ঠিক নয়। বাস্তব একটা আলাদা ব্যাপার, তাকে ভাষায় ঘষে স্ফুলিঙ্গ বের করা যায় হয়তো কিন্তু ভাষা তো পাত্রও বটে, লেখক বাস্তবকে ভাষার পাত্রেই ধরার চেষ্টা করেন। তখন আর বাস্তবকে ভাষা থেকে কোনো রকমেই আলাদা করা যায় না। তাহলে মনে হয় কথাটি এভাবে বলা যায় যে, বাস্তবের অন্তর্নিহিত অসংখ্য দ্বন্দ্বের অস্তিত্ব মেনে নেওয়া, সেসব দ্বন্দ্বকে দ্বন্দ্ব হিসেবে শনাক্ত করা, সত্যের আপেক্ষিকতাকেই দিগ্দর্শন জ্ঞান করা এবং দ্বন্দ্ব অতিক্রম করে একটা পর্যায়ে সমগ্রতা পাওয়ার প্রক্রিয়াটিকে ভাষা এবং অবশ্যই কোনো লেখকের ভাষারীতির আলোচনায় প্রয়োগ করতে হবে। অন্যদিকে ভাষা বিষয়ে প্রথম দ্বন্দ্বটিই এই যে, ভাষা হচ্ছে তর্কাতীতভাবে, প্রশ্নাতীতভাবে সর্বসাধারণের সম্পত্তি, একশভাগ পাবলিক প্রপার্টি, পুরোপুরি ভাগের মা।

(‘ভাষারীতি’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়)

খ. রং-রেখা যাঁরা ব্যবহার করেন, ধ্বনি ছন্দ তাল নিয়ে যাঁদের কাজ, দৃষ্টিগ্রাহ্য দেহভঙ্গিমা যাঁরা ফুটিয়ে তুলতে চান কোনো সংবাদ, তাঁদের কাজে মুক্তি বেশি। ভাষা নিয়ে যাঁদের কাজ তাঁদের তা নয়। ভাষা মাটিতে এমনভাবে পড়ে থাকে – বিশেষ করে গদ্যের ভাষা – যে তা নড়তে চায় না। তার পাখা নেই। শব্দের অর্থ কোনো একভাবে নির্ধারিত, বারোয়ারি, বাজারি, তা বোধহীন ওজনের মতো শব্দকে টেনে নামিয়ে আনতে চায়। শব্দ, বাক্যবন্ধ, শব্দ-সাজানো, বাক্য তৈরি কী ক্লান্তিকরভাবেই না কতকাল ধরে একরকম, কী অবসাদে জড়তায় তাদের অর্থ বাঁধা, কী ভোঁতা কী দৈনন্দিন! কিন্তু এতে কোনো নাড়া না দিয়েই কাজ চালিয়ে নিয়েছেন বহু লেখক, যাঁদের লেখা পড়লেই বোঝা যায় ভাষা তাঁরা বারোয়ারি সম্পত্তির মতোই পেয়েছেন, বারোয়ারি সম্পত্তির মতোই তাকে ব্যবহার করতে চান।

(‘ভাষারীতি’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়)

হাসান আজিজুল হকের দুটি মন্তব্য গভীরভাবে ভাবলে সাহিত্যে ভাষার প্রয়োগ নিয়ে লেখকের দর্শন বা চেষ্টা সত্যিকার অর্থে ভাষা সাহিত্যকে কী ঐশ্বর্য দিতে পারে সে-সম্পর্কে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট হয়। পাশাপাশি এটাও প্রত্যয় হয় যে, তিনি ভাষা-ব্যবহারের সত্যিকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি নিজের ভাষারীতি সম্পর্কে পরোক্ষভাবে মন্তব্য করেছেন। ভাষা যে মানবিক আচরণ ও দ্বন্দ্ব পরিস্ফুট করতে তার গতি -চহারা পালটে ফেলে সে-বিষয়টি তিনি উল্লেখ করেছেন। আবার প্রচলিত ভাষা, যাকে তিনি বারোয়ারি বলেছেন, সেটি কীভাবে সাহিত্যের ভাষায় রূপান্তরিত হয় সে-সম্পর্কে মন্তব্য না করলেও এটা স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, জনগণের ভাষাকে নিজের লেখার ভাষা সহজে করা যায় না। কাজটি কঠিন, যারা সহজ মনে করে ব্যবহার করেন তারা সত্যিকার অর্থে লেখক নন। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি লেখার জন্য স্বতন্ত্র ভাষা লেখককে তৈরি করতে হয়। চরিত্রানুযায়ী ভাষাই চরিত্রকে বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে জীবন্ত করে তোলে।

তবে গদ্য ও পদ্যের বেলায় তিনি যে-মন্তব্য করেছেন সেটা সবসময় ঠিক নয়। গদ্যের ভাষা নড়তে চায় না বা তা ভোঁতা বা গতিহীন বলে তিনি যে মন্তব্য করেছেন তা যদি ঠিক হয় তাহলে সব গদ্যই পড়ার অযোগ্য হতো। আমরা দেখেছি, অনেক লেখকের গদ্য পাখাহীন নয়, বরং তা চঞ্চলা নদীর মতো। এটা ঠিক যে, গদ্য যুক্তির ভাষা, তা কবিতার মতো সুরে সুরে চলে না সবসময়, তবে গদ্যকে সাবলীল গতিমান করে তোলেন লেখক। এখানে শব্দচয়নের মুন্শিয়ানা, বুদ্ধির দীপ্তি, রসবোধ, আলংকারিক শব্দপ্রয়োগ এবং চিন্তাশক্তির গতিমান পরম্পরা গদ্যকে প্রচলিত গদ্য থেকে আলাদা করে এবং গদ্য কবিতার মতো পেলব শক্তিমান হয়। আমরা হাসানের গদ্য থেকেই অজস্র উদাহরণ দিতে পারি।

ক. একইভাবে, মুক্তি যখন এলো ১৬ ডিসেম্বরে, সেই অভিজ্ঞতারও কেউ বর্ণনা করতে পারবেন বলে মনে হয় না। যদি কোটি মানুষের শোক আমি একা আমার এই বুক থেকে খালাস করে দিতে পারতাম, যদি পুরো একটি আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোতে কষ্টের শোকের ক্ষোভের ক্রোধের আক্রোশের উচ্ছ্বাস আমার একার বুক ফাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পারত, যদি লক্ষ মানুষের অশ্রম্ন আমার দুখানি চোখ থেকে মুক্তি পেত, তাহলে হয়তো খানিকটা ন’মাসের অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো যেত। কিন্তু কিছুই করা গেল না, ১৬ ডিসেম্বর এসে গেল, কারও নতুন হাত পা কিছুই গজালো না, দৈনন্দিন প্রতিটি কাজ করতে হলো শান্তভাবে। তবে সত্যিই চুপ থাকতে পারিনি। ক্ষোভ দুঃখ যন্ত্রণা আনন্দ আকাঙ্ক্ষা জীবনপ্রেম একসঙ্গে রান্না হতে লাগল মনের মধ্যে। ফুটতে লাগল টগবগ করে।

(‘বাংলাদেশ : পালয়ে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায়’)

খ. বাংলাদেশ – গভীর অন্ধকারে তার ভাঙনের শব্দ, ধস নামার গম্ভীর ধুপধাপ আওয়াজ; ধস নামছে বিক্রমপুরে, ঢাকায়, মানিকগঞ্জে, তিতাসের তীরে, কর্ণফুলীতে, সিলেটে, সুরমায়, টাঙ্গাইলে, ভুয়াপুরে, গাইবান্ধায়, তিস্তার পাড়ে, রংপুরে, যমুনায়, সিরাজগঞ্জে – অন্ধকারে, ক্রমাগত ধস নামছে, ছোট হয়ে আসছে বাংলাদেশ, অন্ধকারে, বাতাসের ঝড়ের দাপটে জাহাজ ডুবে যাচ্ছে শীতলক্ষ্যায়, ঢাকার সবচেয়ে দীর্ঘ দালানের চূড়াটিও অদৃশ্য হচ্ছে আর ওদিকে উজাড় হয়ে যাচ্ছে সুন্দরবন, চিংড়ি-ডলারের জন্য বন্দুকের নির্দেশে লোনা পানি উঁচু হয়ে আসে, খালপাড়ে রক্তের লবণ লাল টকটকে হয়ে ছড়িয়ে যায়, সমস্ত সুন্দরী গেওয়া মরে যায়, মুমূর্ষু কুকুরের মতো রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার কেঁউ কেঁউ করে ডাকে, আবার উত্তরের মাটির নিচ থেকে পানি সরে যায়, বিশাল বিশাল ফাটল দেখা দেয় প্রসূতি বাংলাদেশের তলপেটে, বাংলাদেশের মাটির এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত, মাটির উপরে ক্রমাগত বালিয়াড়ি এগিয়ে আসে। এসব, এসব কী বীভৎস বর্ণনা, না বীভৎস বাস্তব!

(‘বাংলাদেশ : পালিয়ে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায়’)

বস্ত্তত এই বর্ণনা তীব্র আবেগময় হলেও এর ভেতর লেখকের যে-উপলব্ধি উচ্চারিত হয়েছে তা বাস্তবতার মাটি থেকে উৎসারিত। অধুনা বাংলাদেশের জীবন-সমাজবাস্তবতাকে একজন শিল্পী এর চেয়ে গভীরভাবে হয়তো উপলব্ধি করতে পারেন না। সে-কারণে তিনি এখানে ভাষাকে ব্যবহার করেছেন তাঁর আবেগের বাহন হিসেবে, তাঁর প্রতিক্রিয়ার তীব্রতাকে ধরতে পারে এমন তেজোদীপ্ত শব্দ নির্বাচন করেছেন। এই গদ্য একজন কবির গদ্য তাতে কোনো সন্দেহ নেই, যদিও হাসান সাধারণত কবিতা লেখেন না। তবে আমরা জানি, তিনি কবিতা লিখতেন, তাঁর প্রকাশিত কবিতা দেখারও সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে। আর তিনি কবিতা না লিখলেও কবিতার সমস্ত প্রসাদগুণ তাঁর রচনার মধ্যে উপস্থিত, তাঁর গল্পেও সে-উদাহরণ অজস্র পাওয়া যাবে। এটা ঠিক যে, সব জায়গায় তাঁর গদ্য একই রকম উচ্চাঙ্গের নয়। তিনি কখনো কখনো বৈঠকি ঢংয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন বা বক্তৃতার আদলে প্রবন্ধ লিখেছেন। এটাও ঠিক যে, তাঁর প্রবন্ধ সংকলনে অনেক লেখা আছে যেগুলোকে ঠিক প্রবন্ধ বলা যাবে না। এবং সেগুলো সত্যিকার অর্থে প্রবন্ধও নয়, হয়তো সেগুলো বক্তৃতা, কিংবা কোনো বইয়ের ভূমিকা, কিংবা কোনো

গ্রন্থ-সমালোচনা। সেখানটায় হাসানের গদ্যের স্বরূপ খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে এ-জাতীয় লেখার সংখ্যা নেহায়েত কম। তিনি এ-জাতীয় লেখাকে বাদ দিতে পারতেন। বিশেষ করে ছড়ানা ছিটানো গ্রন্থের কিছু লেখা এরকমের। শেষোক্ত ধারার প্রবন্ধ সম্বন্ধে

এ-কথাগুলো বলার একটি মাত্র কারণ যে, এগুলো তাঁর প্রধান রচনাগুলোর পাশে খানিকটা বেমানান। তিনি যে সৃজনশিল্পী সে-নমুনা তাঁর প্রতিটি রচনাতেই পাওয়া যায়। যে-বিষয় নিয়ে তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন  সে-বিষয় নিয়ে বাংলাদেশে একাধিক ব্যক্তি প্রবন্ধ লিখেছেন। যেমন সংস্কৃতি বা সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বদরুদ্দিন উমর লিখেছেন আবার হাসান আজিজুল হকও লিখেছেন। দুজনের মতাদর্শ এক হলেও দুজনের লেখার ধরন আলাদা, ডেলিভারি আলাদা, বাক্যচয়ন আলাদা। যে-রসবোধ বা শেস্নষ হাসান ব্যবহার করেন, যে সূক্ষ্ম উপমা তিনি ব্যবহার করেন, অন্যরা তা করেন না বা করতে পারেন না। অভিজ্ঞতা ও আদর্শ এক হওয়া সত্ত্বেও সৃজনশীলতার কারণে হাসানের লেখা স্বতন্ত্র শৈলী নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এটা তো হাসানের পাঠক মাত্রই জানেন যে, তাঁর গল্প-উপন্যাস বা স্মৃতিকথার চেয়ে তাঁর গদ্য লেখা কম নয় এবং সেটাও কম আকর্ষণীয় নয়। যখন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি প্রবন্ধ লেখেন তখনো তিনি একধরনের শৈল্পিক আবরণ তৈরি করেন, বুদ্ধির দীপ্তি, শব্দের চাতুর্য, উপমার প্রাখর্য আর নিজস্ব চেতনাদীপ্ত একটি আলোকরেখা তাঁর গদ্যকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। বাংলার জনপদ মানুষ পরিবেশ সমাজ জনরুচি ও তার পরিবর্তনকে তিনি নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দেন, তাঁর অভিজ্ঞতার সারাৎসার নতুন ব্যঞ্জনা পায়, নতুন গন্ধ ছড়ায়, উজ্জ্বল আলো ছড়ায় তাঁর নিপুণ-শানিত ভাষার বর্ণবিভায়। এভাবে তিনি নিজস্ব গদ্যের স্মারক তৈরি করতে পেরেছেন। এর কোনো দোষত্রম্নটি নেই তা বলা যাবে না। সেটাও তাঁর গদ্যরীতির বৈশিষ্ট্য। বাংলাভাষাকে ব্যবহারের অসীম ক্ষমতা তিনি অর্জন করে ফেলেছেন বলা যায় কোনো সংকোচ না রেখে, কোনো দ্বিধা না রেখে। আর এটাও লক্ষ করা যাবে যে, গদ্যে তিনি বিচিত্র বিষয়ে কথা বলেছেন, বিশেষত যে-কথা তিনি গল্পে বা উপন্যাসে বলতে পারেননি। এভাবে তাঁর লেখকসত্তা পরিপূর্ণতা পেয়েছে। সাধারণ বিষয়কে তিনি যখন তাঁর রচনাশৈলী দিয়ে সৃজনশীল গদ্য করে তোলেন, তখন আমরা তাঁর ক্ষমতাকে উপলব্ধি করতে পারি। সাদামাটা অনেক বিষয়কে তিনি সাহিত্যের সামগ্রী করে তুলেছেন, সবটা বাক্চাতুর্য দিয়ে সম্ভব নয়, বরং এখানে যে-জিনিসটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো বিষয়ের গভীরে যাওয়ার তাঁর অপূর্ব ক্ষমতা, বিষয়টিকে নানা কৌণিকে দেখা এবং তাকে পাঠকের কাছে অনুভববেদ্য করে তোলা। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টির পক্ষে যুক্তি দেওয়া যায়। বন্ধুত্ব নিয়ে বা গৃহ নিয়ে তাঁর কিছু লেখা আছে, আপাতভাবে যাকে মনে হবে গুরুত্বহীন বা লেখার জন্য লেখা। কিন্তু হাসান তাকে অসামান্য দীপ্তিতে উন্নীত করেছেন। গৃহ বিষয়ে তাঁর একটি লেখা থেকে উদাহরণ :

হাজার লক্ষ বাড়ির ভিড়ে একটি গৃহ আমি দেখেছি। তার আগে বলি, গূঢ় অর্থে গৃহ তো একটিই। তার নাম পৃথিবী, এই গ্রহ, ধরিত্রী। তাকেই ভাগ করে করে, কোটিতে কোটিতে, অণুতে অণুতে ভাগ করে আমরা থাকি। বাড়িকে যিনি গৃহ করতে চান তিনি ধরিত্রীর অনুকরণ করেন। যে-গৃহটি আমি দেখেছি, চোখের সামনে এখন দেখছি, যারা সেটি নির্মাণ করেছেন তাঁরা এই সর্বধারয়িতা ধরিত্রীকেই অনুসরণ করতে চেয়েছেন। এ-কথা বলছি এই জন্য যে, একদিন মানুষ সারা পৃথিবীর প্রাণপ্রবাহের মধ্যে বাস করত, নিজেকে আলাদা করার চেতনায় তার তখনো কোনো খোঁজ নেই। সে ছিল পুরোপুরি প্রাকৃতিক। জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ, গাছপালা,

নদী-প্রান্তর, আলো-হাওয়া সবই একসঙ্গে জীবনের ধারা বয়ে চলত। প্রকৃতির বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়িয়েই তবে মানুষ মানুষ হয়, সভ্যতা তৈরি করতে পারে। তখন ধরিত্রীর স্মৃতি তার মধ্যে লুপ্ত হয়ে যেতে থাকে। আধুনিক মানুষের এই স্মৃতি নেই। ছোট হতে হতে মানুষ এখন প্রায় সবই হারিয়ে ফেলতে বসেছে। তবু হারিয়ে পুরোপুরি যায়নি, হয়তো যাবেও না কোনোদিন।

(‘আরণ্যক’, বাড়ি কি গৃহ)

হাসানের গদ্যের বিষয়বৈচিত্র্য ও রচনাশৈলীর পরিচয় জানা বোধকরি সহজ নয়, শব্দ, বাক্য, শব্দবোধ, অর্থারোপ, কল্পনাশক্তির ব্যবহার, উইট, রসসঞ্চার, শেস্নষ, অভিনব নিজস্ব ব্যাখ্যা এবং তথ্যকে ব্যবহারের নতুন নতুন কৌশল – এসব গভীরভাবে লক্ষ করা রীতিমতো কষ্টসাধ্য। বিশেষত পাঠক যখন তাঁর পেলব শব্দ ও বাক্য দ্বারা মোহিত হয়ে থাকেন, তখন তাঁর বিচারবুদ্ধি খানিকটা লোপ পায়। এটা ঠিক যে, বাঙালি যে-কোনো পাঠক হাসানকে তাঁর রচনারীতি দ্বারা চিনে নিতে পারবেন। এর অর্থ হলো, তিনি নিজস্ব একটি গদ্যরীতি তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন। সৃজনশীল সবার পক্ষেই এটি সম্ভব তা ভাবা ঠিক হবে না। অনেক সৃজনশীল লেখক আছেন যাঁরা সৃজনশীল রচনার বাইরে স্বকীয় গদ্য লিখতে পারেন না। হাসান আজিজুল হক সেদিক থেকে অবশ্যই ব্যতিক্রম।