হৃদয়ের মণিকোঠায় আগলে রাখি তাঁর স্মৃতি

নাজিয়া জাবীন

কীভাবে এ-লেখার শুরু, কীভাবেই বা তা শেষ করব কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না, পারছি না। হয়তো এলোমেলো হয়ে ঘটনাগুলি এ-পাতায় স্থান নেবে কারণ কোন ঘটনাটি কখন মনে হবে, এত ঘটনা, এত কথা যা হয়তো আমি সন-তারিখ হিসেবে পরপর সাজাতেও পারব না।

দেখতে দেখতে বেশকটা দিন পেরিয়ে গেল। দিনটি ছিল জুলাই মাসের ১৪ তারিখ। সকাল থেকেই মানুষটির শরীরের যন্ত্রণা বেড়েছে। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে বারবার। কখনো জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ছে। ব্লাড প্রেশার একদম নেমে যাচ্ছে আবার উঠছে। ডাক্তার-নার্স প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন আর আমাদের বুঝ দিয়ে যাচ্ছেন কোন ইঞ্জেকশন কতটুকু দেওয়া হচ্ছে, এরপর আর কোনটা দেওয়া যেতে পারে, কোনটা আর কাজ করবে না ইত্যাদি। আসলে তাঁরা আমাদের প্রস্ত্তত করছিলেন কোনো একটা খারাপ সংবাদের জন্য। গত ছয় মাস ধরে ভুগছেন তিনি। পাল্লা দিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন কঠিন ব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে।

রাত বাড়ছে, আইসিইউতে আমরা তখন বেশ কয়েকজন। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছি। ডাকছি যন্ত্রণাকাতর মানুষটিকে যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করে দিতে। হাসপাতালের বিশাল বড় বড় জানালা দিয়ে বাইরে তখন থমথমে কালো রাত। থিরথির করে লেকের পানি বয়ে চলেছে। ঝিরঝিরে হাওয়ায় গাছের পাতা দুলছে। হঠাৎ একপশলা বৃষ্টি তাঁর চোখের পানিতে ধুয়ে দিয়ে গেল, ধরণিকে ধুয়ে দিয়ে গেল যন্ত্রণাকাতর মানুষটির সমস্ত ব্যথা, যন্ত্রণা, কষ্টকে। ঘড়িতে সময় তখন ১২টা বেজে কয়েক মিনিট অর্থাৎ ১৫ জুলাই ১২টা কয়েক মিনিট। বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে বড় বড় চোখে শেষবারের মতো তিনি কী যেন দেখলেন, তারপর? তারপর সমস্ত কিছুর ইতি।

শুধু ইতি নয়, তাঁর বিশাল কর্মযজ্ঞ, দেশপ্রেম, তাঁর নীতি, তাঁর দৃঢ় চেতনাবোধ, অসাম্প্রদায়িক চিন্তা, প্রগতিশীল সংস্কৃতিমনা মানুষটির বিশাল এক কর্মময় জীবন শুধু পড়ে রইলো না, আমাদের ও জাতিকেও এক শূন্যতায় তিনি ফেলে গেলেন।

মাত্র নয় মাসের ছোট্টটি আমি। মা গিয়েছেন আমেরিকায় ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য লেখাপড়া করতে। মায়ের রেখে যাওয়া শাড়ির মধ্যে মায়ের গন্ধ নিতে চাই। আলনায় ভাঁজ করে রাখা শাড়ি বারবার টেনে হাতে নিতে চাই, মায়ের ফেলে যাওয়া ব্যাগটার মধ্যে কী যেন খুঁজি। বড় খালা এ-দৃশ্য সহ্য করতে পারলেন না, পোঁটলা বেঁধে নিয়ে এলেন তাঁর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে।

সেই যে কখন থেকে আমার দুই মা, দুই বাবা; আমার হলো তিন বোন আর চার ভাই। এখন চুলে পাক ধরেছে, তবু এই দুই পরিবারের মধ্যে আমি কোনো রেখা টানতে পারি না, পারি না তুলতে কোনো দেয়াল। কেউ কেউ সে-দেয়াল তুলতে চায়, আমার মন তা খানখান করে ভেঙে ফেলে, ভেঙে দিতে চায়।

নয় মাস বয়স। মোড়া ঠেলে ঠেলে হাঁটতে শুরু করি মগবাজারের বাড়িতে। একসময় মোড়া গড়িয়ে চলে যায়, আমি এক পা দুপা করে সামনে চলতে থাকি। ডালিবু, বড় ভাইয়া, ছোট ভাইয়ার খুশি ধরে না। আববু খুশিতে কোলে তুলে নেন আমাকে। আরো কিছুদিন পর তখন ধানমন্ডির ২৪ নম্বর রাস্তার সে-সময়কার সবচেয়ে আধুনিক ভবনের রেলিংবিহীন ঝুলন্ত সিঁড়িতে আমি দৌড়ে বেড়াই। একবার একতলায়, একবার দোতলার ঝুলন্ত বারান্দায়। এরপর পরিবারের বিশাল আঙিনায় বিশাল এক বৃক্ষের ছায়ায় আমার বেড়ে ওঠা।

৩নং পরীবাগের বাড়ির একদিকে অফিস, আরেকদিকে বাসা। বাড়ির সামনে সবুজ বাগান। প্রতি বিকেলে আববু পাইপ দিয়ে গাছে পানি দিতেন। আমি তাঁর পেছনেই ঘুরঘুর করতাম। খুরপা দিয়ে বাগানের আগাছা পরিষ্কার করতাম। ফুলের ডাল কেটে আববু একটা থালায় রাখতেন। প্রায়ই সে-থালা আমার হাতেই থাকত। গোলাপের কাঁটা খুবই শক্ত। কীভাবে গোলাপের কাঁটা ভেঙে তা ফুলদানিতে সাজাতে হয় এটা তাঁর কাছেই আমার প্রথম শেখা। সন্ধ্যায় কালো মশার দল ঝাঁকবেঁধে ঘুরে বেড়াত। আববু স্প্রে দিয়ে সে-ঝাঁকে কেরোসিন ছিটিয়ে দিতেন। মান্নান মালি মশাল হাতে সেখানে আগুন দিতেই দপ করে মশার দল পুড়ে ছাই হয়ে যেত। আমি ভর সন্ধ্যায়ও বাগানে তাঁর পিছু ছাড়তাম না। ছুটে বেড়াতাম তাঁর পিছু।

৩নং পরীবাগে বাস্ত্তকলাবিদের যে বড় টেবিলটিতে বসে আববু রাজনীতি কিংবা সমাজ, নয়তো স্থাপত্য, না-হয় দর্শন নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, সে-টেবিলটাতেই এক কোণে বসে কাগজ-পেনসিল নিয়ে ছবি অাঁকতাম আমি। পটুয়া কামরুল ইসলাম চাচা, শিল্পী রশিদ চৌধুরী প্রায়ই আসতেন এখানে। শিল্প ও রাজনীতি নিয়ে চলত তাঁদের আড্ডা। কামরুল চাচা আর আববু প্রায়ই রসিকতা করে কথা বলতেন। দেখেছি শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, শিল্পী এমদাদ চাচাকে। দেখেছি রাজনীতিবিদ আবদুর রাজ্জাক, মহিউদ্দিন চৌধুরী, পংকজ ভট্টাচার্য, মানস সরকার, কাজী আরিফ, কমরেড ফরহাদের মতো সমাজসচেতন মানুষদের। কাজী আরিফকে দেখেছি, তাঁর মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগেও তিনি এসেছেন পরীবাগে। সন্ধ্যায় আম্মু আর আববুর সঙ্গে কথা বলে গেছেন। আববু তাঁকে সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন, শুধু এটুকু মনে আছে আমার।

আববুর সঙ্গে বৈঠক করতে আসতেন মতিয়া চৌধুরী। তাঁকে আমি আর আমার বোন মতিয়া খালা বলেই সম্বোধন করতাম। আমরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম তাঁর ইয়া বড় একটা হাতখোঁপার দিকে। মিটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে প্রায়ই তিনি আমাদের সঙ্গে গল্প করতেন। একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করেই ফেলেছিলাম, খালা আপনি মাথায় কী তেল দেন? খালা উত্তর দিয়েছিলেন, কিন্তু আমাদের তাতে বিশেষ লাভ হয়েছিল বলে মনে পড়ে না।

একদম ছোট থেকেই দেখেছি, আববুর কাছে প্রতিদিন আসতেন সুন্দর পরিপাটি মোজাফ্ফর চাচাকে। প্রফেসর মোজাফ্ফর আহমদ বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রেসিডেন্ট। আববু আর চাচা মিটিং করতেন। দেশ-ভাবনা ছিল তাঁদের সবচেয়ে বড় ভাবনা। চাচা আমার একটা নাম দিয়েছিলেন। তিনি আদর করে আমাকে ডাকতেন ‘পুতুল’। বহুদিন চাচাকে দেখি না। খুব শিগগিরই যাব, যেতে হবে।

দেশে বন্যা কিংবা ঘূর্ণিঝড়ে পরীবাগের বাড়ি আরেক রূপে রূপ নিত। ব্যতিব্যস্ত স্থপতি তখন অসহায় মানুষের জন্য দিনরাত খেটে চলেছেন। লম্বা বারান্দার একপাশে আওয়ামী লীগের ত্রাণ কার্যালয়, আরেকদিকে শিল্পী ডালিয়া নওশিনের নেতৃত্বে সংস্কৃতিকর্মীদের ত্রাণ কার্যালয়। আমার আম্মা একবার এদিকে, একবার ওদিকে ছুটে চলেছেন কাকে কী দিয়ে সাহায্য করবেন সেটাই তখন সবার একমাত্র কাজ।

বর্ষামঙ্গল, বর্ষবরণ অথবা পৌষমেলায় একই বাড়ি আরেক রূপে সেজে উঠত। সকাল-বিকেল চলছে ছায়ানটের রিহার্সাল। আসছে ডজন ডজন শিঙাড়া, কাপের পর কাপ চা। ওয়াহিদুল হক আমাদের প্রিয় ওয়াহিদভাই। প্রফেসর আনিসুজ্জামান চাচা, বেগম সুফিয়া কামাল, জামালউদ্দীন আহম্মেদ, ডা. সারোয়ার, মফিদুল হক, হুসনে আরা ইসলাম, কলিম শরাফী, সন্জীদা খাতুন, বিলকিস নাসিরউদ্দিন, ড. নুরুন্নাহার, ফয়জুন নেসা – এমনি সব মানুষের পদচারণায় মুখর তখন ৩নং পরীবাগের লম্বা বারান্দাটা। স্থপতি মাজহারুল ইসলাম প্রচন্ড ব্যস্ত সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড নিয়ে। তাঁর নির্দেশনায় আলোচনায় মুখর সকলে।

খুব ছোটবেলা থেকেই দেখছি নারীনেত্রী মালেকা বেগম (মালেকা খালা), মতিউর রহমান (মতি মামা), আয়শা খালা, আবুল হাসনাত মামা, মিনু খালা, রাখিদি ও পংকজ কাকাকে। স্থপতি মাজহারুল ইসলামের খু-ব কাছের মানুষ সবাই। যতটুকু মনে আছে, তখন তাঁরা সকলেই প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের বেশিরভাগ ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের তরুণ কর্মী।

এক বিকেলে শুনলাম ন্যাপের এক নেতার বিয়ের অনুষ্ঠান হবে ৩নং পরীবাগে। স্থপতি আবারও ব্যস্ত হলেন সামাজিক অনুষ্ঠান নিয়ে। বাড়ির সামনের গোল মাঠটায় লাইন দিয়ে চেয়ার বিছানো হচ্ছে। খাবার টেবিল একপাশে স্থাপন করা হচ্ছে। কোথায় কোনটা বসবে সবই আববুর নির্দেশে হতে থাকল। আমি তাঁর সঙ্গে চেয়ার লাগাতে থাকলাম। বিকেলবেলা লাল বেনারসি পরে বউ এলো। আম্মু বউকে ঘরে নিয়ে তুললেন। আমি বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলাম মুগ্ধ নয়নে। বর যে কে তা বুঝতে পারলাম না। কারণ তিনি অত্যন্ত সাধারণ পোশাকে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। ভানু চাচা, দবির চাচা, নুরু চাচা, মোনায়েম চাচাও ছিলেন বিয়েতে। তাঁরা সবাই ন্যাপের কর্মী ছিলেন। দেশকে ভালোবাসতেন সত্যিই। দেশের জন্যই কাজ করে যেতেন, নিজের জন্য নয়। বউয়ের ছোট বোন বহ্নির সঙ্গে জমে উঠল আমার বন্ধুত্ব। আম্মু-আববুর ব্যস্ত আরেকটি দিন কাটল। সকলের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিলেন আবারো। এ-বিয়েটি ছিল পংকজ ভট্টাচার্য ও রাখী দাস পুরকায়স্থের বিয়ের অনুষ্ঠান।

চলে যাই ’৭১-এর যুদ্ধে। আমার বাবা-মা আমাকে আম্মু-আববুর সঙ্গে ওপারে পাঠাতে চাননি। নয় মাস দীর্ঘ যুদ্ধের পর যেদিনই প্রথম অনুমতি পেলেন, ছুটে এলেন তিনি প্রিয় মাতৃভূমির কোলে। নিজ চোখে ধ্বংসস্তূপ দেখে কান্না থামিয়ে রাখতে পারলেন না। তাঁকে আবারও কলকাতায় ফিরতে হলো, সঙ্গে করে নিয়ে চললেন আমাকে।

২৮ ডিসেম্বর আমাদের পরিবারে এলো আমাদের ছোটভাই খোকন। হাসপাতালে একঝলক তার মুখটি দেখেই আমি আববুর সঙ্গে রওনা দিই কলকাতায়। কলকাতায় অপেক্ষারত আছেন আম্মু, ডালিবু, ভাইয়েরা। কতবার তাঁরা ভেবেছেন, হয়তো আমাদের সঙ্গে তাঁদের আর দেখা হবে না। একটু একটু মনে পড়ে বিমানবন্দরের তখন কী যে অবস্থা। প্লেনে ছিল না কোনো সিটবেল্ট, কলকাতা যেতে তখনো পাসপোর্টের প্রয়োজন হয়নি।

’৭২ সালে রেসকোর্স ময়দানে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বিরাট আয়োজন করা হয়। এ-অনুষ্ঠানে যোগ দেন কলকাতার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। ধানমন্ডির ২৪নং রাস্তার বাড়িতে উঠলেন সুনীল মুনশি, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। দীপেন্দ্র নাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (কাকা), শান্তি সমরায় কাকা। সুভাষ কাকাবাবু ফাঁক পেলেই আমার সঙ্গে গল্প করতে বসে যেতেন। নয় মাস ধরে যে-যুদ্ধ দেখেছি আমি তারই গল্প তাঁকে শোনাতাম। সন্ধে হলেই ইফ্ফাত আরা দেওয়ান, ডালিয়া নওশিন, সাদিয়া আফরীন মোজাইক করা মেঝেতে বসেই খালি গলায় গান শোনাতেন কাকাবাবুকে। স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এ-অনুষ্ঠানকে সার্থক করতে দিনরাত কাজে লেগে গেলেন। সঙ্গে তখন তরুণ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী আবুল হাসনাতও (হাসনাত মামা) ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছেন। সুভাষ কাকার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাদের যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি। কাকাবাবু একটি চিঠিতে লিখেছিলেন –

যার সঙ্গে হোক যত বড় কাজিয়া

বুকের মধ্যে ঠিক থেকে যাবে নাজিয়া।

১৯৭৯ সাল; শুধু দেশ নয়, বিদেশটাকে দেখতে হবে। জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে হবে। আববুর সঙ্গে রওনা দিলাম সুদূর আমেরিকা। বিমানে এই প্রথম এতো দূরের পথ। প্রথম যাত্রাবিরতি ছিল লন্ডনে। সমস্ত লন্ডন শহর তখন ক্রিসমাসের সাজে সেজেছে। এ যেন এক স্বপ্নপুরি। সন্ধ্যায় হোটেলে আববুর সঙ্গে দেখা করতে এলেন ওবায়েদ জাইগীরদার এবং মার্টিন ফ্রেশম্যান। দুজনই আববুর বন্ধু। আমার পরনের কোটটা বেশি ভালো না থাকায় তাঁরা আববুকে জোর দিলেন আমাকে কোট কিনে দেওয়ার জন্য। আমরা চারজন টিউবে বসে বেরিয়ে পড়লাম বলস্ট্রিট সেন্ট্রাল লন্ডনে। এই প্রথম আমি টিউবে চড়লাম। মাটির নিচের বিশাল পৃথিবীকে আবিষ্কার করি অবাক বিস্ময়ে, অবাক ভাবনায়।

আববুর সঙ্গে ঘুরে দেখি মাদাম তুসোর মিউজিয়াম, লন্ডন মিউজিয়াম, লন্ডন চিড়িয়াখানা, রানীর বাড়ি – এসবই আমি বিস্ময়ের সঙ্গে উপভোগ করি। ট্রাফালগার স্কয়ারে হাজারো কবুতর দেখে আববুর হাতের মুঠো থেকে হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে যাই কবুতরের পেছনে, কয়েকটি ভীতু কবুতর তখন পাখা মেলে উড়াল দেয় লন্ডনের মেঘলা আকাশে। একদিন পর আমাদের প্লেন শিকাগো শহরের মাটি ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্লেন থেকে বেরোতেই মনে হলো, একরাশ সুচ এসে আমার গায়ে বিঁধল। আববু সযতনে আমার মাথায় তুলে দিলেন কোটের হুড। একটু এগিয়ে যেতেই আম্মু, বড়ভাই আর ডালিবুকে দেখে দৌড়ে যাই তাঁদের কাছে।

শিকাগোতে তখন হিম-হিম ঠান্ডা। বরফের চাদরে ঢাকা সমস্ত শহর। কাঠবিড়ালির দৌড়ঝাঁপ দেখে ভীষণ মজা পাই। একদিন ফোন এলো বাড়িতে। ইঞ্জিনিয়ার এফআর খান সাহেবের ফোন। আববুর সঙ্গে দেখা করতে আসবেন সস্ত্রীক। আম্মু আর ডালিবু মজার মজার রান্নায় টেবিল সাজিয়ে তুললেন। সত্তরের দশকে ইঞ্জিনিয়ার এফআর খান দ্বিতীয় সুউচ্চ ভবন ‘জন হ্যানকক সেন্টার’ তৈরি করে জগদ্বিখ্যাত। একদিন জন হ্যানকক সেন্টার বিল্ডিংটিতে বেড়াতে যাই। এত উঁচু ভবনে এই প্রথম। লিফটে উঠে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠেছিল বোধহয়। খান চাচা খু-ব ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। ডালিবু তাঁকে গীতবিতানের পাতা খুঁজে দিয়ে হারমোনিয়াম বাজাতে শুরু করলেন। আমরা সবাই গলা মেলালাম তাঁর সঙ্গে – ‘তোমার হল শুরু আমার হল সারা’। সে- সন্ধ্যাটিতে বিশাল মাপের এ দুটি মানুষ স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ও ইঞ্জিনিয়ার এফআর খান একসময় গানের সুরে হারিয়ে ফেলেছিলেন নিজেদের কর্মব্যস্ত জীবনের কিছুটা সময়।

শিকাগোতে দেখা হয়েছিল স্ট্যানলি টাইগারম্যানের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের একজন সম্মানিত স্থপতি। বহুবার তিনি বাংলাদেশেও এসেছেন। আমি তাঁকে স্ট্যানলি আংকেল বলে ডাকি। তাঁর দেওয়া দুটি সাইকাডেলিক ছাপা স্কার্ফ আজো আমার ড্রয়ারে সযতনে বন্দি আছে। আববুকে Muz বলেই তিনি ডাকতেন। ঢাকা এলেই আববু গাড়ি চালিয়ে তাঁকে ঢাকা শহর ঘোরাতেন। আমি সিটের পেছনে দাঁড়িয়ে দুই বন্ধুর কথোপকথন অনুসরণ করতে চাইতাম। কিই-বা বুঝতাম?

দেখতে দেখতে আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় হয়ে গেল। পড়ায় আমার বিন্দুমাত্র মন নেই। পেয়ারাগাছে বসে পেয়ারা খাই, ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়াপাখি আমার সঙ্গী, বাগানের রঙিন প্রজাপতিরা আমার বন্ধু। মুরবিবরা চিন্তায় পড়লেন। আববু প্রতি সন্ধ্যায় আমাকে সায়েন্স আর অঙ্ক পড়াতে শুরু করলেন। আমার সায়েন্স প্র্যাকটিক্যাল খাতায় নিজ হাতে এঁকে দিলেন তেলাপোকা, মাকড়সা আর স্করপিয়ন। সে-ছবি দেখে আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে যাই। ছবিগুলি যেন জীবন্ত, পোকামাকড়ের স্বয়ং আবির্ভাব প্র্যাকটিক্যাল খাতায়। পড়াতে এসে প্রথম দিনই আমি আববুর কাছে বকা খেলাম। রাগ করে বললেন, ‘একি, তুমি সঠিকভাবে কলমও ধরতে পারো না?’ প্রথম দুদিন চলল শুধু কলম ধরে সঠিক উপায়ে লেখা। লেখা আর লেখা। জীবনে এই প্রথম আমি তিন আঙুলে সঠিক উপায়ে কলম ধরতে শিখলাম।

প্রি-টেস্টের পর স্কুল বন্ধ হলো। আমি চলে এলাম পরীবাগে। ফাঁকি দিয়ে পড়ার দিন শেষ হলো। বিকেলে আববুর কাছে আর রাতে আমার টেবিলের পাশে ঠায় বসে থাকতেন আম্মু। রাতের বেলা ঘরের কোণে রাখা বেতের মোড়াটা প্রায়ই মড়মড় করে উঠত। মনে হতো আরো কেউ এসেছেন ঘরে। আববুকে সে-কথা বললে তিনি হেসেই তা উড়িয়ে দিতেন।

লেখাপড়া করে, দেশকে ভালোবেসে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে তিনি আমাদের দেখতে চেয়েছিনে। মনেপ্রাণে এ-বাঙালি মানুষটি আমাদের মনে গেঁথে দিতে চেয়েছিলেন –

মানুষ হ মানুষ হ

আবার তরা মানুষ হ

অনুকরণ খোলসভেদী

কায়মনে বাঙালি হ

শিখে নে দেশ-বিদেশের জ্ঞান

তবু হারাসনে মা’র দান

বাংলা ভাবে পূর্ণ হয়ে

সম্পূর্ণ বাঙালি হ

বিশ্বমানব হবি যদি

সুধন্য বাঙালি হ।

শিল্পী কামরুল ইসলাম চাচার এ-ব্রতচারী যেন তাঁর ধ্যান-জ্ঞান, তাঁর বিশ্বাস। বিশ্বের যা কিছু ভালো তা দিতে চেয়েছেন দেশকে, দেশের যা কিছু ভালো তাতে একজন স্থপতি শুধু স্থাপত্যকলার মাঝেই বন্দি থাকেননি। দেশের জন্য সংগ্রাম করেছেন, স্বাধীনতাযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন। নতুন প্রজন্মকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য গড়ে তুলেছিলেন চেতনা নামক সংগঠন। স্থপতি রবিউল হুসাইন, স্থপতি ওয়ারেস, স্থপতি মোবাশ্বের ছাড়াও অনেক স্থপতির নিয়মিত পদচারণায় তখন বাস্ত্তকলাবিদ ছিল প্রাণচঞ্চল দেশ গড়ার কেন্দ্রবিন্দু।

এসব কথা লিখতে বসে প্রায়ই চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। চশমার কাচ মুছতে হয়েছে বারবার। আজ সবই স্মৃতি। আজ মাথার ওপর বিশাল সে-বৃক্ষ, মিষ্টি সে-ছায়া, পিতার সে-স্নেহ, নীতিতে অটল বিশাল মাপের সে-মানুষটি নেই, যাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি পৃথিবীকে জেনেছি, চোখ মেলে দেখেছি বিশ্বব্রহ্মান্ডকে, ভালোবাসতে শিখেছি প্রকৃতিকে, রুখে দিতে শিখেছি অন্যায়কে, ভেঙে দিতে পারি দুঃস্বপ্নকে, আলিঙ্গন করতে পারি সুন্দরকে, জীবন দিয়ে ভালোবাসতে পারি দেশকে, ঘৃণা করতে পারি তাঁবেদারকে, নীরবে এসে দাঁড়াতে পারি একজন নিঃস্ব মানুষের পাশে।

আমি সত্যিই সে-ভাগ্যবান শিশু। সাতচল্লিশ বছর যে-শিশু স্থপতি মাজহারুল ইসলামের হাত ধরে তাঁর স্নেহের ছায়ায় হেঁটেছে। ঘুরঘুর করেছে তাঁর চারপাশে। আজ মধ্যবয়সে দাঁড়িয়ে তাঁকে অন্তরের সমস্ত শ্রদ্ধা জানাই। হৃদয়ের মণিকোঠায় রাখি তাঁর স্মৃতি, আগলে রাখি তাঁর স্নেহ, অন্তরে ধারণ করতে চেষ্টা করি তাঁর শিক্ষা, সম্মুখে যেন দেখতে পাই তাঁর রেখে যাওয়া আলোকিত এক পথ।