হৃদয়-গভীরে গজায় যে বীজ

গতকাল রাতে একঝলক বৃষ্টি হওয়ায় আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। ফলে ঘুম থেকে উঠতে বেলা হয়ে গেছে শরীফ জোয়ার্দারের। কেউ তাকে ডাকেওনি আজ। কী আশ্চর্য! এত চুপচাপ কেন সব। বারান্দা থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ আসছে। উঁকি দিতেই দেখতে পেলেন সারসার পড়ে আছে কাঁচা আমের সরষে-মাখা ফালি। রাতে বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় চকচকে রোদ যেন ধোপাবাড়ির পিটিয়ে ফর্সা করা কাপড়। দেখেই চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। ফ্লাস্কভর্তি চা টেবিলে রেখে দুখান পরোটা আর সামান্য আলুভাজা প্লেটে চাপা দিয়ে মলিনা গেছে মেয়ের কোচিংয়ে। আসতে আসতে বেলা দুপুরে গিয়ে পড়বে। কিন্তু কাপের তলায় বাজারের ফর্দটা দেখে চা খাবার ইচ্ছা উবে গেল শরীফ জোয়ার্দারের। মাসের পয়লা বাজার মানেই বেতনের অর্ধেক খসে যাওয়া। শরীফ জোয়ার্দার খুব হিসেবি মানুষ। খুচরো বাজারে একেবারেই আস্থা নেই তার। তার বাপ-দাদার আমলে মাথায় ঝাঁকা ভরে বাজার নিয়ে ঢুকত মুটে-মজুররা। তারপর কাছা মারা অবস্থায়ই বারান্দার লাল মেঝেতে উবু হয়ে বসে পান্তা খেত পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ মেখে। যাওয়ার সময় দুটো কাঁচামরিচ চেয়েও নিয়ে যেত বাজারে মুড়ি মেখে খাবে বলে।

সে দিন যেন চোখের পলকে নেই হয়ে গেল। পরোটা ছিঁড়ে মুখে দিতেই মনে পড়ল গতকাল রাতের কথা। টানা তিনদিনের ছুটিতে মানুষ গ্রামমুখী হওয়ার কারণে রাস্তায় বাড়তি চাপে পুরো শহর জ্যামে আটকে থাকে কয়েক ঘণ্টা। তিনি মাঝপথে নেমে হাঁটা শুরু করেছিলেন। কিন্তু রাত তখন প্রায় দশটা। মেঘও করেছিল বেশ। পকেটে বেতনের অতগুলো টাকা নিয়ে বেশি রাতও করতে চাচ্ছিলেন না। তাই তো একটু দ্বিগুণ ভাড়ায় রিকশা চেপে এসেছেন বাসায়। না হলে বৃষ্টির কবলে পড়তেই হতো তাকে। আর না হলে ছিনতাইকারীর কবলে। রেলবস্তির ওখানে ছিনতাই একটা নিয়মের মতো দাঁড়িয়ে গেছে। ছেলে অবশ্য বুদ্ধি শিখিয়ে দিয়েছে তাকে। রিকশায় উঠেই সিটের তলায় টাকা রাখলে ছিনতাইকারীরা কিছুই পাবে না। দু-একবার এটা করে ফল পাওয়ায় শরীফ জোয়ার্দার বেশ ভালো বাঁচাই বেঁচেছেন। শুধু কমদামি মোবাইলগুলোর ওপর দিয়ে ফাঁড়া কেটে যেত। হঠাৎ তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বিছানার তোশক উলটালেন। না নেই! প্যাকেটটা নেই! পুরো বিল্ডিংটা বুঝি ঘুরতে লাগল ভন ভন করে। তার মানে কাল প্যাকেটটা ভুলে ফেলে রেখে এসেছেন রিকশায়। মেঝেতে ধপ করে বসে পড়লেন। এই ভুলোমনার জন্য তিনি এটিএম কার্ড পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারেননি। মাত্র তো কটা টাকা! তার যে কত ভাগে ভাগ করে খরচের খাতায় সব চলে যায়, কিন্তু এখন কী হবে তার। মেয়ের স্কুল, কোচিং, ছেলের খরচের টাকা, বাজারের টাকা, বাড়ি ভাড়ার টাকা – সবই তো ওতে ছিল।

বারান্দায় কয়েকটা কাক আমের কাটা ফালি নেওয়ার জন্য কা কা করেই যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে গোটা বারান্দা তার কাছে আস্ত সমুদ্র হয়ে উঠল। আর আমের ফালিগুলো ঝড়েপড়া নৌকোর মতো দুলতে শুরু করে দিয়েছে যেন। মনে হচ্ছে নৌকোর মাঝিরা একসঙ্গে খোয়াজ খিজিরকে ডাকা শুরু করেছে, এত তীব্র তাদের স্বর যে, শরীফ জোয়ার্দারের মাথাটা ফেটে যাবে বুঝি। দৌড়ে গিয়ে চোখ-মুখে পানি দিতে লাগলেন। বুকটাও কেমন চিন চিন করছে। বেসিনের আয়নায় অসংখ্য ফুটি ফুটি দাগ। সেখানে নিজের চেহারাটা সবসময়ই ঝাপসা দেখায়। আজ মনে হলো ঝাপসা না, আয়নাটা সত্যি কথাই বলে। দরজায় প্রবল ধাক্কাধাক্কির শব্দে শরীফ জোয়ার্দার বুঝে উঠতে পারলেন না কেন এভাবে কেউ দরজায় শব্দ করছে। ডোর মিরর দিয়ে দেখলেন দারোয়ান। এখন কথাও বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না তার, তবু দরজা খুললেন।

– স্যার, কতবার কলিংবেল দিলাম কন তো? নিচে এক পাগলায় খুব জ্বালাচ্ছে, আপনার সঙ্গে দেখা না কইরা যাইবই না।

– আমি কারো সঙ্গে এখন দেখা করতে পারব না ইদ্রিস। তুমি চলে যেতে বলো তাকে।

– স্যার, হেইডা কি আর কই নাই মনে করেন। কয় আপনে নাকি খুব জরুরি জিনিস ফালায় থুইয়া আইছেন। সেইটা দিবার আইছে। ঘণ্টার উফরে হইয়া গ্যাছে স্যার। নিচে বইয়া আছে।

কথাটা শুনেই চমকে উঠলেন তিনি। কোনোমতে স্যান্ডেল পায়ে গলিয়ে নিচে নেমে গেলেন। সিঁড়ি যেন আর ফুরাচ্ছে না তার। আধাবয়স্ক মাথাভর্তি কাঁচা-পাকা চুলের মাঝে নিরেট খোদাই করা একটা মুখ। প্রত্যেকটা ভাঁজ আলাদা করে ধরা যায়। আগে দেখেছেন কি না একে মনে করতে পারলেন না শরীফ জোয়ার্দার। তবু মাঝসমুদ্রে কাঠের টুকরো পাওয়ার মতো লোকটিকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

– ভাই, আপনি কি আমার প্যাকেটটা পেয়েছেন?

লোকটির মুখে চওড়া হাসি। লুঙ্গির কোঁচড় থেকে প্যাকেটটা বের করে দিয়ে বলল,

– স্যার, বৃষ্টির জন্যি কাল রিকশায় খেপ মারতে পারি নাই। আপনেরে নামায় দিয়া গ্যারজত চলি যাই। সকালে ঝাড়তি-মুছতি গ্যালে এইডা পাই। তহনই বুঝছি এইডা আপনের।

শরীফ জোয়ার্দার ডাঙায় উঠলেন এতক্ষণে। এমন মানুষও আছে দুনিয়ায়!

– কিন্তু আপনি বুঝলেন কী করে এটা আমারই?

– কী যে কন স্যার। রিকশায় উঠবার আগেই তো পলিথিন নামায় দিলাম আপনেরে। আপনি কইলেন এই কাগজের প্যাকেডডা সিডের তলে থাকুক, বৃষ্টিতে ভিইজ্জা যাবার পারে। পরে তাড়াহুড়ায় আমারও মনে ছিল না, আপনেরও ছিল না।

– কিন্তু আপনার তো স্মরণশক্তি অসম্ভব ভালো। বাড়িটাও ঠিক মনে রেখেছেন। নাম কী আপনার? বাড়ি কোথায়?

– জে স্যার, নাম মোর কুরবান আলি। বাড়ি খুলনার তালা থানায়। আপনের জিনিস ফেরত দিবার পারছি স্যার। খোদার কাছে হাজার শুকুর।

আবছা আলো-অন্ধকারে সিঁড়িতলার জায়গাটা শরীফ জোয়ার্দারের কাছে স্বর্গের মতো লাগল, এমন ফেরেশতার মতো মানুষটাকে আবার জড়িয়ে ধরলেন তিনি। ঘরে নিয়ে খাওয়াতে চাইলেন। কিন্তু কুরবান আলির তাড়া আছে। সে আর দাঁড়াতে চায় না। পাঁচশো টাকা দিতে চাইলেন তাও নিল না। জিহ্বা কেটে বলল,

– স্যার, আপনে যদি কোথাও যাইতে চান, নিয়ে যাই চলেন কিন্তু টাকা নিবার পারব নানে।

মলিনার আসার সময় হয়ে গেছে। এরপর শরীফ জোয়ার্দার বাজারের জন্য কুরবান আলির সঙ্গে বের হলেন। বড় আনন্দের সঙ্গে বাজারের চায়ের দোকানে পুরি দিয়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে চা খেলেন দুজনে। যেন কতদিনের দোস্তি তাদের, এমনই গল্পে মেতে রইলেন। সেদিন দু-একটা জিনিসের গোলমাল হয়ে গেল। মলিনা খুব চেঁচালেন। তবু সব ভালো লাগতে লাগল তার। মেয়েকে নিয়ে বিকেলে আইসক্রিম কিনে দিলেন। ছেলের সঙ্গে প্রায় অনেকক্ষণ ফোনে কথা বললেন। ছেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ছে। হলেই থাকে। প্রথম বছর বাসা থেকেই যাতায়াত করত, কিন্তু শরীফ জোয়ার্দার ভেবে দেখলেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছেলের নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই যাতায়াতে। তাছাড়া তরুণদের জন্য বিশেষ করে সাহিত্যের ছাত্রদের নিবিড় একান্ত সময় দরকার। পর্যাপ্ত স্বাধীনতা না থাকলে ওদের বিকাশ হবে কীভাবে। মলিনার মন খারাপ হলেও ছেলের খুশি দেখে কে।

শরীফ জোয়ার্দারের বাড়ি যশোরের মনিরামপুরে। বছরে একবার যাওয়া হয় সেখানে। অবসর জীবনে তার খুব ইচ্ছা সেখানে থিতু হবেন। কিন্তু মলিনার তাতে বড্ড আপত্তি। সবকিছুর সঙ্গে আপস করে চলতে গিয়ে জীবনের অনেক কিছুই তার সীমাবদ্ধ। দুই বেডের এই ফ্ল্যাটটুকুতে দিনের শেষে ফিরে টুলের ওপর বসে সিগারেট ফোকেন আর মনে মনে ভাবেন, একদিন কুরবান আলিকে বাসায় দাওয়াত দিয়ে খাওয়াবেন। কিন্তু কিছুতেই কথাটা স্ত্রীর কাছে পাড়তে পারছেন না। যশোরের আত্মীয় বলবেন যে তারও উপায় নেই। কুরবান আলির কথায় খুলনার ভাষা বড় জীবন্ত। মিথ্যা কথাও সে বলে না। একজন রিকশাচালক যে তার বন্ধুমানুষ সে-কথা তিনি কাউকে বলতে পারেন না। শরীফ জোয়ার্দারের চাকরি আছে আর মোটে দশ বছর। এর ভেতর ছেলেটাও দাঁড়িয়ে গেলে তাকে ভাবতে হবে না অতকিছু। কিন্তু দিনদিন তার খরচের ভাগগুলো আরো ভাগে বিভক্ত হয়েই চলেছে। মলিনার কোমরের ব্যামো, ফলে ছুটা বুয়া নিতে হয়েছে। মেয়ের বন্ধুদের জন্মদিন লেগেই আছে বারোমাস। আগের সেই চকোলেটের প্যাকেটে আজকাল পোষায় না। গোমড়া মুখ একদম ভালো লাগে না তার। সিগারেটের সংখ্যাও কমিয়ে এনেছেন খরচ বাঁচাতে। মলিনার বড় সাধ আর একটু ভালো ফ্ল্যাটে গিয়ে তারা ওঠেন। কিন্তু শরীফ জোয়ার্দারের এই একটিমাত্র আপত্তি সংসারে। এমন খোলামেলা বড় বারান্দার বাড়ি কি আর পাওয়া যাবে। এখন তো সব বারান্দা বলতে কবুতরের খোপ। দমবন্ধ হয়েই মারা যাবেন তিনি সেখানে। তাদের বাড়িটার

চারধারে পুরনো আমলের বেশ কটা বাড়ি। তেমাথা রাস্তার ওপর বলে আলো-রোদের অভাব নেই এখানে। এমন ভালো বাড়ি কেউ মরতে ছাড়ে!

মলিনার কোমরে শুধু ব্যথাই নয়, মাংসের স্তূপও বেড়েছে। রাতের অন্ধকারে মলিনাকে কাছে টানলে সে বলে ওঠে,

– আহ্! ছাড়ো! ছাড়ো!

নিস্তরঙ্গ রাতগুলোতে বারান্দায় উঠে গিয়ে আকাশের তারাদের সঙ্গে সঙ্গে তার ঠোঁটের সিগারেটও জ্বলে আর নেভে।

অনেকদিন হয়ে গেল কুরবান আলির সঙ্গে দেখা নেই। অফিস থেকে ফেরার পর গলির মুখে প্রায়ই খোঁজেন নির্ভার হাসিতে মাখা মুখটাকে। কিন্তু সংশয়ভরা মন নিয়ে বাসায় ফেরেন তিনি। কোথাও শান্তি পান না শরীফ জোয়ার্দার। ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ে গ-গোল লেগেই আছে একের পর এক। ভাগ্য ভালো যে, মলিনা সিরিয়ালে ব্যস্ত থাকে। খবরে তেমন মন বসে না তার। টকশোর তুমুল কথা-কাটাকাটির চেয়ে নাকি সিরিয়ালের ওইসব কূটকচালি অনেক ভালো। অথচ অফিসে গেলে তাকে খবর শুনতে হয়। বাজারে গেলে নিত্যদামের ওঠা-পড়ার খবর, বাসে ক্ষমতাসীন আর বিরোধীপক্ষের খবর; সবখানে শরীফ জোয়ার্দারকে খবরের চাপে পিষ্ট হতে হয়। সেদিন গিয়ে জানাল বাজারে নাকি কাঁচামরিচের কেজি আড়াইশো টাকা! খবরটা শুনেই গা ঘামতে শুরু করে দিলো তার। কুড়ি টাকার কাঁচামরিচ চাইতেই দোকানদারের মুখঝামটা খেতে হলো,

– মিঞা, নিলে পঞ্চাশ টাকার লন নাইলে বাড়ি যানগা।

নিরুপায় শরীফ জোয়ার্দার বুঝে পেলেন না এত রেগে যাওয়ার কী আছে। আজকাল কোথাও কথা বলার জো নেই। সবাই কেমন রেগে রেগে আছে। মনের ভেতর কুরবান আলির মুখটা ভেসে ওঠে। আহা, ওর সঙ্গে থাকলেই কেমন শান্তি। মাছ মারার গল্প, শীতের পিঠার গল্প, আরো কত কথাই না হতো ওর সঙ্গে। হঠাৎই পেছন থেকে সেই দরাজ গলা শুনতে পান,

– স্যার, ওঠেন, রিকশায় ওঠেন। দ্যান দিকিনি ব্যাগগুলান দ্যান। বলেই ব্যাগ নিয়ে নিল হাত থেকে।

– কচুর শাক কিনেছেন স্যার। চিংড়ি দিয়ে রাইধে খেয়েন। খুব টেস্ট।

আহারে, ওর কথা শুনে একটু আগের সব চাপ বুক থেকে নেমে গেল শরীফ জোয়ার্দারের।

– কোথায় ছিলেন এতদিন?

– ধান লাগাতি গ্যাছিলাম। স্যার, আপনের জন্যি কডা নারকেল নিইয়ে আইছি। তিনদিন ধইরে খুঁজছি আপনেরে। দারোয়ান বদল হইছে না।

– কেন এত কষ্ট করেন আপনি?

– কী যে কন স্যার! আপনের মতো কেউ কি আছে ঢাকায় কন। রিকশাওয়ালারে বুকে জড়ায় ধরবি কে স্যার!

কুরবান আলির মজবুত পেশিবহুল পা রিকশায় প্যাডেল ঘোরাতে থাকে যেভাবে, সেভাবে দুজনের সম্পর্কও ঘুরতে থাকে কথার পিঠে কথা দিয়ে। সিটের তলা থেকে মসৃণ তিনটে নারকেল মু- বের করে ব্যাগে পুড়ে দিলেন কুরবান আলি। সঙ্গে কাপড়ের ত্যানায় বাঁধা কয়েকটা শুকনো মরিচ।

– স্যার, এ মরিচে সেই ঝাল। ডাইলে ফোড়ন দিলে সেই স্বাদ। চাইরডে বিচি ছিডায় দিছিলাম গ্যারেজের পাশে। সেই মরিচ ধরিছে। দ্যাখা হলি কাল চাইরডে দিবানি।

– না না, এই তো অনেক। মরিচের যে দাম!

– স্যার, গাছের জিনিসের আর কিসের দাম। আপনে স্যার ওই চায়ের দোকানে থাইকেন। আমি না আসলেও ওইখানে রাইখে দেবেনে ওরা।

আজো বাসায় গিয়ে কুরবান আলির দেওয়া উপহারগুলো দেখিয়ে স্ত্রী-মেয়েকে ডেকে বলতে পারলেন না, তার বন্ধু তাকে দিয়েছে এই অমূল্য উপহার।

– নারকেল এনেছ যে। এ কুরাবে কে? বুয়াদের ঢং জানো তুমি? বাড়তি কাজ দেখলেই চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনিয়ে দেবে।

এত অনাদর মেনে নিতে পারলেন না তিনি। বলে উঠলেন,

– কোথায় কুরানি, দাও আমি কুরিয়ে দিচ্ছি।

পরদিন কুরবান আলির দেওয়া কাঁচামরিচের স্বাদে মলিনার মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা।

– এতদিনে বাজার করতে শিখলে তুমি।

– বাজারে কাঁচামরিচের দর জানো? আগুন বরাবর। এ তো কুর…

মুখ ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছিল সত্যি কথাটা। আসন্ন চিৎকার-চেঁচামেচির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নীরবে ভাত খেতে লাগলেন তিনি। এরপর এক শুক্রবার এক বস্তা মাটি আর দুটো বড় বড় রঙের খালি বালতি নিয়ে বারান্দায় মরিচের বীজ বুনে দিলেন পরম মমতায়। রোজ অফিস থেকে ফিরে বারান্দায় কেটে যায় তার সময়। মলিনার সিরিয়ালের কেচ্ছা বদলাতে থাকে। হারানো ছেলে ফিরে আসে। সম্পত্তি ফিরে পায়, কত কী ঘটতে থাকে। এরই ভেতর ঘন সবুজ দুটি মরিচের চারায় সাদা সাদা ফুল এসে ছেয়ে যায়। ছোট ছোট মরিচের লাবণ্যে একদিন বারান্দায় চিৎকার করে ওঠেন শরীফ জোয়ার্দার। ভয় পেয়ে ছুটে আসেন স্ত্রী। তার কাছে মরিচ ধরার ঘটনাটা মামুলি মনে হয়। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সে-মরিচই বাজারের একটি খরচ বাঁচায়। এমনকি মলিনাও যতœ নিতে শুরু করেন সেই দুটি গাছের। বাজারের জালিব্যাগ দিয়ে ঘিরে দেন টব দুটিকে। পাখিদের আনাগোনাও বেড়ে গেছে মরিচের লোভে।

কুরবান আলির বয়স বেড়ে গেছে। কিন্তু তার হাসি এখনো সেই ঝলমলে প্রাণশক্তিতে ভরপুর। একদিন সে জানাল তার ছেলে মুরগির খামার দিয়েছে। বাড়িতে আগের মতো কষ্ট নেই। সে গ্রামে ফিরে যেতে চায় একেবারে। কুরবান আলির পরিবারের সুখী গল্পে চোখ ভিজে ওঠে শরীফ জোয়ার্দারের। এক সন্ধ্যায় গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে তাদের বিদায়পর্ব; গিজগিজে লোকের ভিড়ে প্রচ- কোলাহলে বিচিত্র ভাষার ছোটাছুটিতে দুজন বয়স্ক মানুষের বন্ধুত্বের কোলাকুলি নীরবে লেপটে যায় অন্য এক ভাষায়। ঢাকা শহরটা শরীফ জোয়ার্দারের কাছে ফাঁকা মনে হয়। সারারাত বারান্দায় মরিচ গাছটার পাশে কাটিয়ে দেন তিনি। দেখতে দেখতে কখন যে জীবনের অন্য আর একটি অধ্যায় শুরু হয় তিনি টেরও পান না। এলপিআরে এখন তিনি। চোখে চশমা তুলতে হয়েছে। ছেলেও বাড়ি ফিরেছে। তবে চাকরি নয়, বন্ধুদের সঙ্গে ব্যবসায় নেমেছে। সেজন্যে বেশ মোটা অঙ্কের টাকাও দিতে হয়েছে ছেলেকে। ইংরেজি সাহিত্যে পড়ে ব্যবসা! মোটেও সায় নেই তার। কিন্তু সংসারে চিৎকার-চেঁচামেচি এড়াতে তাকে মেনে নিতে হয় আবারো সব। অনার্স পড়ছে মেয়েটা। মলিনার বাড়ি বদলের ঝোঁক আবার জীবিত হয়েছে। কিন্তু এই রোদ-বারান্দা ছাড়ার সিদ্ধান্তে অনড় তিনি। মনকে যদিও বোঝান একদিন ভাড়াবাড়ি ছাড়তেই হবে। তবু যে কটা দিন পারা যায়, যাক না। বাড়ি না, একদিন রাতে তাকে ঘরটা ছেড়ে দিতে হয় ছেলের জন্য। কথা নেই, বার্তা নেই বউ নিয়ে হাজির বান্দা।

ছেলের কোনোকিছুতেই মলিনার আপত্তি নেই। মহাউৎসবে সাজিয়ে-গুছিয়ে ছেলেবউকে বাথরুম লাগোয়া, বারান্দা লাগোয়া ঘরটা ছেড়ে দিলেন। মেয়ে আর মলিনা এখন একসঙ্গে ঘুমোয়। তিনি বসার ঘরের ছোট্ট ডিভানে সারারাত এপাশ-ওপাশ করেন। মাঝরাতে সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় টুলে বসে আকাশপাতাল ভাবনায় ছেদ পড়েছে তার। হুট করে এই পরিবর্র্তনে তার হাঁসফাঁস লাগে যত, ততই কুরবান আলিকে মনে পড়ে। অমন পরিষ্কার-পরিপাটি হাসিখুশি রিকশাচালক এই শহরে একজনও নেই আর। গল্প করার জন্য কাউকেই খুঁজে পান না তিনি। স্ত্রী জাঁকিয়ে বসে সিরিয়াল দেখছে, মেয়ে মোবাইলে ঘাড় গুঁজতে থাকে। যেখানে যান সেখানে চোখ নামানো, ঘাড় গোঁজানো মানুষের দল। এতদিন যাদের ঠোঙা ভরে মরিচ উপহার দিয়েছেন অফিসে তারা সে-মরিচের গল্প শুনতে চান না। বউমাকে যে বলবেন সে তো চাকরিজীবী, ঘরে ফিরেই দরজা লাগিয়ে দেয়। ছেলে ফেরে রাত বারোটায়। বারান্দা আর মরিচ গাছের দূরত্বে শরীফ জোয়ার্দারের প্রাণ চৈত্রমাসের মাটির মতো ফাঁক হয়ে ফেটে ফেটে আছে। খাবার টেবিলে ছেলে জানাল সে বড় একটি বাসা দেখেছে। খুব সুন্দর নাকি। মেয়ের, স্ত্রীর সবার মুখ উজ্জ্বল এ-আলোচনায়। শরীফ জোয়ার্দার সারারাত জোনাথন সুইফটের বই খুলে তাকিয়ে রইলেন। মনে মনে আশা করলেন হয়তো নতুন বাসায় একটা বারান্দা পাবেন। আবার মরিচ গাছগুলোর সবুজ পাতারা তাকে জাগিয়ে রাখবে অনাবিল সুখে, যেভাবে কুরবান আলির হাসিমাখা মুখ তাকে নিবিড় বন্ধুত্ব দিয়ে এসেছিল এতদিন।

পরিপূর্ণ অবসর চলে আসে এক বিকেলে শরীফ জোয়ার্দারের। সব যাতায়াত এক নিমেষে থেমে যায় তার। অফিস থেকে দারুণ সংবর্ধনা দিয়ে হাতে তুলে দেয় নানা উপহার। হাতভর্তি উপহার নিয়ে বাসায় ফিরে দেখতে পান মলিনার মুখ, মেয়ের মুখ বরফের মতো জমাট শীতল হয়ে আছে। প্রথমে কিছুই ভেবে পেলেন না তিনি। মেয়েই প্রথমে কেঁদে উঠে জানাল,

– বাবা, তোমার মরিচ গাছ তুলে ফেলেছে ভাবি।

মলিনার নীরব দৃষ্টি অনুসরণ করে রান্নাঘরে ময়লা রাখার ঝুড়িটার পাশে প্রিয় দুটি গাছের উপুড় হয়ে থাকা নিস্তেজ পাতার দিকে তাকাতেই পায়ের বল হারিয়ে যায় তার। ছুটে গিয়ে সাদা সাদা ফুলভর্তি গাছের শরীর জড়িয়ে ধরেন তিনি। দুবছর পরপর নতুন করে এদের বংশ টিকিয়ে রাখার দিনগুলো এক নিমেষে নেই হয়ে গেল তার। এ তো শুধু তার কাছে মরিচ গাছই নয়, এরা তো তার বন্ধু।  দুঃসময়ের বন্ধু!

মলিনা জানালো, মরিচ গাছের পিঁপড়ে নাকি বউমার জামা-কাপড়ে গিয়ে জড়ো হয়। তাছাড়া সে সুন্দর সুন্দর কিছু টব এনেছে। তাদের পাশে এই বেঢপ রঙের বালতি নাকি বেমানান। বারান্দা সে তার পছন্দে সাজাতে চায়। এই একটিমাত্র ঘটনায় মলিনার স্বামীর প্রতি মমতা জাগে খুব। মানুষ কিছু নিয়ে তো বাঁচে। সে যেমন সিরিয়াল নিয়ে মেতে থাকে, তার স্বামীরও একটা অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই গাছদুটি। সংসারের এই দৃশ্য বদলে বাসার তিনটে মানুষের নীরব সন্ধে বড় কাতর পরিবেশে থমথম করতে থাকে। শরীফ জোয়ার্দার আবার গাছদুটি লাগাতে লাগলেন কিন্তু হঠাৎ কী মনে হতে গাছদুটিকে মাটির গোলায় চেপে বাজারের থলেতে ভরলেন। ঝটপট ছোট্ট ব্যাগটা গুছিয়ে তিনি স্ত্রীকে বললেন আমি যশোর যাচ্ছি। তুমি থাকো ছেলের সঙ্গে। কারো সাধ্য হলো না তাকে আটকানোর। কেউ নড়লই না। যেন পেরেকে গেঁথে রাখা হয়েছে তাদের।

গাবতলী থেকে বাস যখন খুলনার উদ্দেশে ছাড়ল শরীফ জোয়ার্দারের ক্লান্ত চোখে তখন শান্তির ঘুম। পাশের সিটেও শুয়ে আছে তার সঙ্গে সঙ্গে কুরবান আলির দেওয়া উপহার মরিচের বংশধর। তাদের নিস্তেজ পাতাদের দেখলে মনে হচ্ছে তারাও চোখ বুজে আছে নীরবে।