আমি তৈয়েবা খাতুন। ডাক নাম রোজী। আমার বাবা ডা. একেএম আবদুল ওয়াহেদ। মা সৈয়দা সারা খাতুন। তিনি মাত্র ৩০ বছর বয়সে সিরোসিস অব লিভার হয়ে অনেক ভুগে ২৭শে মার্চ, ১৯৪১ তারিখে ইন্তেকাল করেন। তিনি আমার নানা সৈয়দ হায়দার আলীর অত্যন্ত আদরের দ্বিতীয় কন্যা এবং চতুর্থ সমত্মান ছিলেন। তিনি অত্যন্ত সুন্দরী, মধুর স্বভাবের এবং শুনেছি সদাহাস্যময়ী ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর শ্বশুর মৌলবি আবদুল ওয়াসেক সাহেব (আমার দাদা) তাঁর অকালমৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে কবিতা লিখেছিলেন, ‘তুমি সদা সুহাসিনী, তুমি পঙ্কজ পদ্মিনী, অমূল্য মানিক মনসার।’ আমার দাদা তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।

আমরা চার ভাই-বোন। ১. তৌহিদা খাতুন (বেবী), ২. আবদুল জববার (খোকন), ৩. তৈয়েবা খাতুন (রোজী), ৪. আবদুস সাত্তার (ছোট্ট)। আমার বাবা ডা. একেএম আবদুল ওয়াহেদের জন্ম ২৮শে জুন ১৮৮৯, ১৫ই আষাঢ়। বাংলা সন জানা নেই, হিসাব করলে বের করা যাবে। তিনি খুবই মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং ছোটবেলা থেকেই তিনি মানুষের সেবা করতেন। বিপদে-আপদে মানুষকে সাহায্য করতেন। এই অতিমহৎ গুণটি তিনি তাঁর মা জমিলা খাতুনের থেকে পেয়েছিলেন।

 

দাদি

আমার দাদির নাম মোসাম্মৎ জমিলা খাতুন। জন্ম ১৮৮০, মৃত্যু ২রা আগস্ট ১৯৫২। ৭১ বছর বয়সে ঢাকার পুরানা পল্টনের ‘পরম ভবন’ বাড়িতে। সেখানে বর্তমানে আছে ‘ইব্রাহীম ম্যানশন’। মাত্র দুদিনের সর্দি-জ্বরে। আমার দাদির চার ছেলে ও দুই মেয়ে। তাঁর বড় ছেলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের এককালীন অধ্যক্ষ ডা. একেএম আবদুল ওয়াহেদ – যিনি প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি তাঁর মায়ের সব সদ্গুণের অধিকারী ছিলেন। আমার দাদি ছিলেন দিলদরাজ, পরোপকারী, সহজ-সরল মানুষ, অত্যন্ত ধৈর্যশীলা, কর্মঠ এবং সদাপ্রসন্ন। আমি আমার দীর্ঘজীবনে এমন মানুষ আর দেখিনি।

১৮৯৫ সালে তিনি আমার দাদা মৌলবি আবদুল ওয়াসেকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের বিবাহের পঞ্চাশতম সুবর্ণজয়মত্মী উদ্যাপিত হয়েছিল ১৯৪৫ সালে।  ভাইপো, ভাইঝি, ছেলের বউরা, নাতি, বিশেষ করে নাতনিদের চাপে পড়েই সেদিনের সেই অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান হয়েছিল। এরপর দাদা আমাদের সবাইকে নিয়ে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করেছিলেন এবং পরে আমরা সবাই মিষ্টি খেয়েছিলাম বলে মনে আছে।

আমার দাদিকে কখনো শাড়ি পরতে দেখিনি, সবসময়ে সরু পাড়ের ধুতি পরতেন। তবে যতদিন দাদা বেঁচে ছিলেন ততদিন দাদি সবসময়ে হাতে একটা চুড়ি, কানে ছোট্ট ফুল, নাকে নাকফুল এবং গলায় একছড়া বিছা-হার পরতেন। যেদিন আমার দাদা ইন্তেকাল করলেন সেদিন আমি চবিবশ পরগনা জেলার বশিরহাটে আমার দাদির সঙ্গে দাদার পাশেই বসে ছিলাম। আমার জীবনে সেই প্রথম কাউকে মরে যেতে দেখেছিলাম। দিনটা ছিল ১১ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫। আমার দাদি মূর্তির মতো বসে রইলেন। তাঁর নাকের ফুল, কানের ফুল, গলার হার, হাতের চুড়ি খুলে আমার হাতে দিয়ে দিয়েছিলেন। দাদিকে কাঁদতে দেখিনি।

ঘরভর্তি আত্মীয়-স্বজন সবাই হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। আমার দাদি পাথরের মতো বসে ছিলেন।

সেকালের সেই আমল হিসেবে দাদির বিয়ে বেশ বেশি বয়সেই হয়েছিল। বিয়ের সময়ে তাঁর বয়স ছিল ষোলো বছর। দাদিরা ছিলেন পাঁচ বোন এবং দুই ভাই। তাঁর বাবা মোহাম্মদ খলিলুর রহমান রেলওয়েতে চাকরি উপলক্ষে উড়িষ্যার বালেশ্বরে থাকতেন। দাদির মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ায় বা মারা যাওয়ায় এবং মেয়ে বড় হয়ে যাওয়ায় সবাইকে নিয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন। বড় মেয়ে জমিলা খাতুনকে আমার দাদার সঙ্গে এবং তাঁর পরের দুই বোনকে আমার দাদার মেজো ও সেজো দুই ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দেন।

উড়িষ্যায় থাকাকালীন আমার দাদির বাবা আরো দুবার বিয়ে করেন। দাদির মুখে গল্প শুনেছি তাঁদের একজন ছিলেন বিলেতি মেমসাহেব এবং অন্যজন ছিলেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বা ফিরিঙ্গি মেমসাহেব। একজনের মৃত্যুর পর আরেকজনকে বিয়ে করেন। তিনিও বেশিদিন বাঁচেননি। এঁরা নিঃসমত্মান ছিলেন। খুব ভালো মানুষ ছিলেন দুজনই। দাদির বাবার তিন নম্বর পক্ষের একটি মেয়ে করু এখনো জীবিত। ভাই ছিল, নাম পাঁচকড়ি, অনেক কম বয়সে মারা যায়। দাদির প্রথম ভাই মোহাম্মদ সালামুর রহমান, ইনি ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন (বোধহয় রেলওয়ের)। এঁর ছেলেমেয়েরা হলো – আমেনা, ফাতেমা ও শাহাদাতুর রাহমান এবং নবীউর রাহমান। পিতৃ-মাতৃহারা হওয়ায় এঁরা সবাই আমার দাদির কাছে মানুষ হয়েছে। দ্বিতীয় ভাই মোহাম্মদ হামিদুর রহমান। যতদূর জানি ইনি জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন। এঁর মেয়ে ছিল না, তিন ছেলে ছিল। প্রথমজন চাঁদ, অতিঅল্প বয়সে মারা যান। খুব সুন্দর দেখতে ছিলেন। দ্বিতীয়জন মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান, আমাদের সবার প্রিয় হাফেজ চাচা। তৃতীয়জন মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান। ম্যাট্রিক পাশ করে সরকারি চাকরিতে ঢুকেছিলেন। বিয়ের এক বছর পরে ছোট্ট একটা ফুটফুটে ছেলে রেখে তিনি মারা যান। মোখলেস চাচা তাঁর বিয়ের আগে (কালীঘাটে) আমাদের বাড়ি থাকতেন। তাঁর বিয়ে যেন আবছা আবছা মনে আছে। ফজলু চাচার মা অনেক দিন বেঁচে ছিলেন। তিনি দেশবিভাগের পর ১৯৫০ সালে ঢাকায় আসেন এবং বাকি জীবন ঢাকাতেই থাকতেন। হাফেজ চাচাকে উনি এতই ভালোবাসতেন যে, দুনিয়া একদিকে আর হাফেজ চাচা একদিকে। শরৎচন্দ্রের বিপ্রদাসের মায়ের চরিত্রের জীবন্ত রূপ আমরা দেখেছিলাম তাঁর মধ্যে এবং তা তাঁর জীবনের শেষ পর্যন্ত একইভাবে ছিল। ঘটনাচক্রে বাড়ি বেদখল করার উদ্দেশ্যে ফজলু চাচাকে কে কীভাবে চালাকি করে জেলে ঢোকায়। বেচারা বিনাদোষে, বিনাবিচারে সাত বছর জেখ খাটলেন। তখন মাত্র আইএ ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। সেই থেকে কলকাতায়ই রয়ে গেছেন। মাঝেমধ্যে দুয়েকবার ঢাকায় ঘুরে গেছেন।

ফজলু চাচার জন্য আমার দাদিকে শোক করতে দেখেছি। কিন্তু ফজলু চাচার মাকে কোনোদিন ব্যস্ত বা দুঃখিত বা চিন্তিত হতে দেখিনি। তিনি আমাদের সঙ্গেই থাকতেন। ১৯৫০ সালের দাঙ্গায় আমাদের আত্মীয়-স্বজনের যাঁরা এক কাপড়ে পালিয়ে এসেছিলেন তাঁদের অনেকেই আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ফজলু চাচার মা-দাদিও আমাদের বাড়িতে থেকে গিয়েছিলেন। তারপর হাফেজ চাচার বাড়ি চলে যান এবং শেষ পর্যন্ত সেখানে ছিলেন।

আমার দাদার মৃত্যুর পর আমার দাদি পাকাপাকিভাবে আমাদের কাছে চলে আসেন। কখনো কখনো তিন-চারদিনের জন্য বশিরহাটে বেড়াতে যেতেন, তবে কখনোই বেশিদিন থাকতেন না। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় খুব বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। সেসময়ে আমরা আমাদের কালীঘাটের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের নোটিসে মুসলমান এলাকা পার্ক সার্কাসে চলে এসেছিলাম। সেখানে এক বছর থাকার পর ১৯৪৭ সালের ১০ অথবা ১১ আগস্ট আমরা কলকাতা থেকে ঢাকার উদ্দেশে শিয়ালদা স্টেশনে ট্রেনে চড়েছি। কখন রেলগাড়ি চলবে সেই আশায় এদিক-ওদিক দেখছি, সময় যেন কাটছে না। এরপরে আবার জাহাজে চড়ব, জীবনে প্রথম জাহাজে  চড়া হবে। উত্তেজনার শেষ নেই। দাদির কাছে এসে দেখি তিনি নিঃশব্দে অঝোরে কাঁদছেন। চোখের পানিতে তাঁর পায়ের সামনের জায়গাটা সয়লাব হয়ে গিয়েছিল। তখন আমরা ভাই-বোন বেশ হাসাহাসিই করেছিলাম দাদির কান্না দেখে। এখন বুঝি কত কষ্টের এবং অসম্ভব দুঃখের সেই কান্না। নিজের দেশ, পরিচিত পরিবেশ, আত্মীয়-স্বজন, সারাজীবনের সাজানো ঘরবাড়ি, চোদ্দপুরুষের ভিটে – সবকিছু ছেড়ে অচেনা জায়গায় সম্পূর্ণ অচেনা পরিবেশে যেতে কেমন লাগে!

আমার দাদার বোন এবং তাঁর স্বামীর মৃত্যু হলে তাঁদের একমাত্র সমত্মান লুৎফর রহমানকে আমার দাদা-দাদি অত্যন্ত আদরে ও যত্নে মানুষ করেছিলেন। শুরু হলো আমার দাদির পিতৃমাতৃহীন ছেলেকে পুত্রতুল্য স্নেহে মানুষ করার কাজ। এ-কাজ তিনি সারাজীবনই করেছেন। বাড়িতে তখনো কোনো ছেলেমেয়ে না থাকায় তিনি খুবই আদরে মানুষ হয়েছিলেন। সবার বড় বলে তিনি ছিলেন আমাদের মিয়া চাচা। তিনিও সারাজীবন আমার দাদা-দাদিকে খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন এবং ভালোবাসতেন। আমার বাবার তিনি ষোলো বছরের বড় ছিলেন।

আমার দাদির প্রথম সমত্মান আমার বাবা একেএম আবদুল ওয়াহেদের জন্ম হয় ১৮৯৮ সালের ২৮শে জুন (১৫ই আষাঢ়), মৃত্যু ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে। আববার জন্মের তিন বছর পর বড় ফুপু সোহেলা খাতুনের জন্ম হয়। এরপর আমার মেজো চাচা আবদুল ওয়াদুদের জন্ম হয়। এরপর আমার দাদির এক ছেলে, জন্মের আট মাস পরে মারা যান। নাম জানা নেই। এরপর আমার ছোট চাচা আবদুল মাবুদ হন। তিনি যতদিন সুস্থ ছিলেন, ততদিন প্রবীণ হিতৈষী সংঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং অনেক কাজও করেছেন। সবশেষে আমার দাদির ছোট মেয়ে মোসাম্মৎ লায়লা খাতুন। ইনি মাত্র একুশ বছর বয়সে দুই ছেলের পরে এক মেয়েকে রেখে মৃত্যুবরণ করেন। দাদি নিজের এই এক বছরের নাতনি ডোরাকে বুকে তুলে নিয়ে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে মানুষ করতে লাগলেন। এই ঘটনার আরো আগে দাদির নিজের বড়ভাই ও তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁদের দুই মেয়ে ও দুই ছেলেকে আপন সমত্মানের মতো নিজের কাছে রেখে বড় করেছিলেন। এঁদের বয়স আমার মেজো চাচা ও ছোট চাচার মাঝামাঝি। এঁদের ছোটভাইটা খুবই ছোট ছিল। হয়তো দুই-তিন বছর হবে। এরপর আমার দাদির ছোটভাইয়ের স্ত্রীবিয়োগের পর তাঁর ছেলেদের মানুষ করার দায়িত্ব আমার দাদিকেই নিতে হয়েছিল। বড় ছেলেটি খুব কম বয়সে মারা যায়। ছোটভাই আবার বিয়ে করেন। সেখানে এক ছেলে হয়। তিনি কেমন যেন একটু খামখেয়ালি ধরনের ছিলেন। ছেলের দেখাশোনা তেমন একটা করতেন না। ছেলে একটু বড় হলে বললেন, তুই তোর বড় ফুপুর কাছে গিয়ে থাক এবং আমার সেই চাচাও দাদির কাছেই বড় হয়েছেন।

আমার বড় ফুপুর বিয়ে হয়েছিল হুগলিতে। আমার ফুপ্পার প্রথম পক্ষের মেয়ের আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তারপর আমার ফুপুর পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ে হয়। আমার ফুপ্পারা খুব ধনী জমিদার ছিলেন। শুনেছি তিনি খুব ভোজনবিলাসীও ছিলেন। হঠাৎ তিনি ইন্তেকাল করেন। দাদিও দাদার সঙ্গে মাঝে মাঝে হুগলি যেতেন                  পিতৃমাতৃহীন নাতি-নাতনিদের দেখতে। তবে বেশিদিন থাকতে পারতেন না। ইতোমধ্যে আমার দাদির বড়ভাইয়ের মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। ছেলেদের সবাইকে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে দেখাশোনা করেছেন এবং প্রয়োজন মতো বকাঝকাও দিতেন।

সকাল থেকেই সবাইকে খাওয়ানোর জন্য রান্নাঘরে ঢুকতেন। সব রান্না তিনি নিজের হাতেই করতেন। মোটা কাজের জন্য লোকজন ছিল, তবে পারতপক্ষে আমার দাদি কোনো ফরমায়েশ করতেন না। সেটা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ ছিল। যতটা পারতেন নিজেই করতেন। ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে সবাইকে উঠিয়ে নামাজ পড়াতেন এবং বাড়ির মসজিদে মৌলবি সাহেবের কাছে আরবি পড়াতে পাঠাতেন। তারপর চা-বিস্কুট অথবা মুড়ি নাশতা খেয়ে পড়তে বসা এবং গোসল করে ভাত খেয়ে স্কুলে যাওয়ার তদারকও আমার দাদি করতেন। এরই মধ্যে দুষ্টুমি করা, পড়ায় ফাঁকি দেওয়া ইত্যাদি এসব নিশ্চয়ই হতো এবং সে-কারণে শাসিত্ম পাওয়ার ব্যবস্থাও নিশ্চয়ই ছিল।  দাদির স্নেহসিক্ত অথচ কঠিন শাসন এবং দাদার তদারক ও কঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে থেকেও তাঁদের পড়াশুনা কিন্তু বেশিদূর এগোয়নি।

দাদির ছোটভাইয়ের ছোট ছেলে ম্যাট্রিক পাশ করে সরকারি চাকরিতে ঢুকেছিলেন। মেজোভাইয়ের লেখাপড়া বেশিদূর এগোয়নি। ওদের বড়ভাই শিশুকালেই মারা যান, মেজোর লেখাপড়া বেশি না হলেও তাঁর ব্যবসায়িক বুদ্ধি ছিল প্রখর। দাদা-দাদিরা তাঁকে দোকান করে দিয়েছিলেন। খুব ভালো ব্যবসা ছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে তাঁর ব্যবসায় খুবই সাফল্য হয়েছিল। সেই ধারা দেশভাগের সময় পর্যন্ত বজায় ছিল। ১৯৫০ সালে দাঙ্গার সময়ে দোকানের ভাগ ছোট বৈমাত্রেয় ভাইয়ের হাতে দিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ভাইপোদের বড় যাঁরা, সবাইকে দাদি বিয়ে দিয়ে সংসার করার দায়িত্বে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। এই সময়ে দাদি আমাদের সঙ্গে ঢাকায় থাকতেন। কিন্তু চিঠিতে সবার খোঁজখবর নিতেন। আমরা যখন ঢাকায় আসি তখন আমাদের আত্মীয়স্বজন কেউ প্রায়ই আসেনি।

১৯৪১ সালের ২৭শে মার্চ আমার মা সৈয়দা সারা খাতুন এক বছর রোগে ভোগার পর ইন্তেকাল করেন। আমার দাদি কত দুঃখ কত অসীম ধৈর্য নিয়ে সহ্য করেছেন তা ভাবলে অবাক লাগে। আমরণ কখনো তাঁকে কাঁদতে দেখিনি। সবচেয়ে ছোট মেয়ে কত কম বয়সে চোখের সামনে মারা গেল, বড় মেয়ে বিধবা হলো, তাঁর প্রিয় সমত্মান আমার বাবার ছোট ছোট চারটি সমত্মান রেখে স্ত্রীবিয়োগ হলো। এই ধাক্কা আমার দাদা সামলাতে পারেননি। খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু আমার দাদি ধৈর্যের সঙ্গে এই শোক সহ্য করেছিলেন। আমার মা আমার দাদা-দাদির অত্যন্ত প্রিয় পুত্রবধূ ছিলেন। খুব ভালোবাসতেন তাঁকে। নিজে কাঁদেননি বটে, তবে দাদার শোকে কখনো তাঁকে সান্তবনা দিতে যাননি। প্রায়ই দেখতেন দাদাকে হাউমাউ করে কাঁদতে। দাদি ছোটবেলায় আমাদেরকে মায়ের গল্প বলতেন। আমাদেরকে মায়ের কবর
জিয়ারত করতে নিয়ে যেতেন। আমরা চার ভাই-বোন অলিখিতভাবে দাদির এতিমখানায় যুক্ত হলাম। এই সময়ে আমার ফুপাত বোন ডোরা আর আমরা ছাড়া আর কেউ ছিল না। আমরাই শেষ ব্যাচ।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে যখন কলকাতায় জাপানি বোমা পড়ল তখন বাবা আমাদের বশিরহাটে দাদির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা দুই-তিন মাস সেখানে ছিলাম। আমার দুই ফুপাত ভাইও সেখানে গিয়েছিল। ওদের বোনটা তো দাদির কাছেই থাকত। সেই সময়টা আমাদের বড় আনন্দেই কেটেছিল। এই সময়ে আমি দাদির সমাজসেবা দেখতাম। দুপুরে সবার খাওয়া ও নামাজের পরে দাদি একটু বিশ্রাম নিতেন। বলা বোধহয় বাহুল্য হবে না যে, বাড়ির কাজের লোকজন এবং আশ্রিত সবাইকে খাইয়ে তিনি বিশ্রামে যেতেন, বিশ্রাম থেকে উঠে চুল আঁচড়িয়ে ছোট একটা নীল কাপড় চুলে জড়িয়ে একটা ছোট খোঁপা করতেন যেটা ছোট একটা পেঁয়াজের মতো মাপের। আমার দাদির চুল খুব কম ছিল। তারপর আসরের নামাজের জন্য অজু করে মুখে তেল মেখে চোখে সুরমা লাগিয়ে নামাজ পড়ে একটু কোরআন শরিফ পড়তেন। তাঁর তক্তাপোষে মাদুর বিছানো থাকত, মাথার কাছে চারিদিকে রাখা যায় এমন র‌্যাকে নানা রকম ধর্মীয় বই, হাদিস এবং কোরআন শরিফ রাখা থাকত। তক্তাপোষের পাশে ছয়-সাতজন বসা যায় এমন একটা লম্বা বেঞ্চ থাকত। দাদির নামাজ শেষ হওয়ার আগেই সেখানে অনেকে এসে বসতেন, সবার সঙ্গে তিনি কুশলবিনিময় করতেন।
সুবিধা-অসুবিধার কথা মন দিয়ে শুনতেন এবং সবার খোঁজখবর নিতেন। এরই ফাঁকে কয়েকটা ছোট ছেলেমেয়েকে আরবি, কাউকে বাংলা পড়ায় সাহায্য করতেন। পুরনো পড়া ধরতেন, নতুন পড়া দিতেন। যাওয়ার সময়ে তাদের হাতে মোয়া, খই কিংবা বাতাসা দিতেন। এর মধ্যে বাড়ির কাজের লোকের ছেলেমেয়েরাও থাকত, মাঝে মাঝে বয়স্ক মহিলাদেরও সুরা মুখস্থ করানো, কোরআন শরিফ পড়ানো, কাউকে নামাজ পড়ানোও শেখাতেন। সেলাই করা শেখাতেও দেখেছি। কাউকে আবার চৌকির তলা থেকে বীজ দিয়ে বলতেন, তোমার ঘরের ধারে দুহাত জায়গা ভালো করে কুপিয়ে এখনই গিয়ে এটা বিসমিল্লাহ বলে লাগিয়ে দাও। এখনই লাগাবার সময়। রোজ সকালে চাল ধোয়া পানি, মাছ ধোয়া পানি দিও, গাছ ভালো হবে। একদিন কাকে যেন বললেন, ছেঁড়া শাড়িটা একটু সেলাই করতে পারো না। জবাবে সে বলল, আমি সেলাই করতে জানি না। তাকে কিছু পয়সা দিয়ে বলেছিলেন কাল কাপড়টা ধুয়ে নিয়ে এসো, আমি সেলাই করে দেবো। কারো অসুখ-বিসুখ শুনলে দরকারমতো ওষুধ দিয়ে সাহায্য করতেন। দাদি অনেক দেশি ঔষধি গাছের টোটকা ওষুধ জানতেন। প্রত্যেক দিন দাদির একই নিয়ম। তবে পাড়ায় কোথাও বাচ্চা হওয়ার খবর শুনলেই ছুটে যেতেন। কেউ মারা যাওয়ার খবর শুনলে সেখানে চলে যেতেন গোসল করাতে। এই দুটো কাজ  তিনি সারাজীবন করেছেন। সপ্তাহে একদিন পাড়া বেড়াতে যেতেন। আমাদের বলতেন, তোরা কে কে আমার সঙ্গে যাবি। আমরা তো একপায়ে খাড়া। কারো বাড়ির উঠান দিয়ে, কারো বাগানের পাশ দিয়ে, কোনো পুকুরের পাড় দিয়ে আমরা দাদির সঙ্গে যেতাম। কোথাও বসা নয়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সবার সঙ্গে কুশলবিনিময় করতেন। কাউকে বীজ দিতেন, কারো মুরগির অসুখ, মুরগিকে হলুদ না কী খাওয়ার যেন পরামর্শ দিতেন। এইভাবে সবার খোঁজ নিতেন। শেষ গন্তব্য ছিল আমার নানির বাড়ি। তাঁর পাশের বাড়ি ছিল দাদির সেজো বোনের বাড়ি। তাঁর বিয়ে হয়েছিল আমার নানার চাচাত ভাইয়ের সঙ্গে। সেখানে তাঁদের পারিবারিক কবরস্থান। সেখানে আমার নানার কবরের পায়ের কাছে আমার মায়ের কবর। দাদি তা দেখিয়ে বলতেন, তোদের মায়ের কবর। জিয়ারত করা শিখিয়ে দিতেন।

আমরা ঢাকায় আসার কাছাকাছি সময়ে সদ্য হওয়া বড় বড় ডাক্তার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে এলেন, তাঁরা সবাই পুরানা পল্টনে আমাদের আশপাশের বাড়িতেই থাকতেন। কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেল দাদি সবার খোঁজখবর রাখছেন, প্রয়োজনমতো সাহায্যও করছেন। যেহেতু তিনি সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন তাই সবাই তাঁকে আম্মা বলে ডাকতেন। আমাদের নিচতলায় ডা. রহমান থাকতেন, তিনি অবিবাহিত ছিলেন। চাকর-বাকর নিয়ে থাকতেন, বাড়িতে ভালো খাবার রান্না হলে দাদি আমাকে দিয়ে তাঁর বাড়িতে পাঠাতেন।

আগেই বলেছি, দাদি জীবনে দুটো কাজ সবসময়ে করতেন। তা হলো, কোথাও বাচ্চা হলে সেখানে যেতেন প্রসূতিকে সাহায্য করতে এবং কেউ মারা গেলে সেখানে যেতেন গোসল করাতে। চেনা-অচেনা যে-ই হোক এই কাজে তাঁর কোনো ক্লান্তি ছিল না। অনেক প্রসব করাতে করাতে তাঁর অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। মেডিক্যালে থার্ড ইয়ারে পড়ার সময়ে ছুটিতে বাড়ি এলে আমার বাবাও তাঁর সঙ্গে যেতেন। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীদের অসুখ-বিসুখে দেখতেন। তখনই তাঁর মনে হয়েছিল, মাকে যদি ভালো করে লেখাপড়া শিখিয়ে ধাত্রীবিদ্যায় পারদর্শী করা যায় তবে গ্রামের মানুষকে ভালো করে সাহায্য করতে পারবেন। যেই ভাবা, সেই কাজ।

আমার দাদিরা দুই বোন এবং তাঁর এক চাচাত ভাইঝি এই তিনজনকে খুব যত্নের সঙ্গে বাবা লেখাপড়া শেখাতে লাগলেন। এঁরাও খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। বাবা ছুটি পেলে এসেই মা-খালাদের পড়াতেন। সেই সময়ে গ্রামে ডাক্তার তো দূরের কথা, অভিজ্ঞ ধাত্রী বা নার্সও ছিল না। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রসব করানোর অভিজ্ঞতাও তাঁদের অনেক হয়েছিল। তাঁদের কৃতিত্বের পুরস্কারস্বরূপ নিজের স্কলারশিপের টাকা দিয়ে তিনজনকে তিনটা ব্যাগে যত রকম যন্ত্রপাতি লাগতে পারে তা উপহার দিয়ে বলেছিলেন, এই ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে যাবে। দাদির সেই ব্যাগ ছোটবেলায় দেখেছিলাম। ১৯৪৬-এর দাঙ্গার সময়ে আমাদের কালীঘাটের বাড়ির সব জিনিসের সঙ্গে সেই ব্যাগ লুট হয়ে যায়। আমরা যখন ঢাকায় আসি তখন এখানে কোনো লেডি ডাক্তার ছিলেন বলে মনে হয় না। থাকলেও হয়তো হাতেগোনা এক-দুজন কলকাতা থেকে এসেছিলেন। কত অচেনা লোক খুঁজে খুঁজে এসে আমার দাদিকে নিয়ে যেতেন। আমরা দাদিকে বাধা দিতে চেষ্টা করতাম। কোথায় যাচ্ছেন, জানা নাই, চেনা নাই? দাদি হেসে বলতেন, তোরা ভয় করিস কেন? আল্লাহ আছেন না! মানুষের এই বিপদে যেতে হয়, আমি আর কী করব? যা করার আল্লাহ করবেন। আমি শুধু চেষ্টা করব, আমার যা জ্ঞান আছে তা দিয়ে সাহায্য করতে। তবে দাদিকে কোনোদিন কোনো বিয়েতে যেতে দেখিনি। বাড়িতে গাড়ি থাকলে গাড়িতে যেতেন, নাহলে ঘোড়ার গাড়িতে যেতেন। তখন ঢাকায় বন্ধ ঘোড়ার গাড়ির চল ছিল।

ঈদ, বকরি ঈদ, শবেবরাত ছাড়া যে-কোনো কারণে হোক বাড়িতে পোলাও-কোরমা রান্না হলে দাদি নিজেই রান্নাঘরে যেতেন। আশপাশের প্রত্যেক বাড়িতে সেই খাবার পাঠাতেন।

১৯৫০ সালে বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল। চাচা-চাচিরা ছেলেমেয়ে নিয়ে একবস্ত্রে নদী পার হয়ে সাতক্ষীরা, খুলনা এবং ঢাকায় চলে আসেন। আমার নানি, মামাদেরও একই অবস্থা হয়েছিল। সবাই উদ্বাস্ত্ত। আমাদের বাড়িতে প্রায় পঁচিশ-ত্রিশজন আশ্রয় নিয়েছিল। সবাইকে দাদি পরম যত্নে রেখেছিলেন।

’৫২-এর ভাষা-আন্দোলনের সময়ে দাদিকে কাঁদতে দেখেছি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার ভাষায় আমি কথা বলব, তাতে গরমেন্টের কি?’ বরকত, সালাম, আরো যাঁরা সেই সময়ে শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের জন্য কোরআন খতম করে তাঁদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেছিলেন। এত ইবাদত-বন্দেগির পাশে খবরের কাগজও পড়তেন। জীবনের শেষদিকে তিনি তাঁর ছেচলিস্নশজন নাতি-নাতনির প্রত্যেকের জন্য সোয়েটার বুনে দিয়েছিলেন। জীবনের প্রত্যেক বৃহস্পতি ও শুক্রবারে রোজা রাখতেন। ইফতার করতেন শুধু এক বাটি শরবত খেয়ে। তারপর নামাজ পড়েই ভাত খেতেন। সারাদিন পরে খেতে বসলেই আমরা ঘিরে বসে যেতাম। দাদির হাতেমাখা সেই ভাত অমৃতের মতো লাগত। সবাইকে খাওয়াতে খাওয়াতে নিজের আর ভালো করে খাওয়া হতো না। তবু কী যে খুশি হয়ে আমাদের খাওয়াতেন! তখন আমরা বড় হয়ে গেছি, তবু। আজো সে-কথা মনে হলে ভাবি, তাঁকে আমরা কত কষ্টই না দিয়েছি! সবসময়ে হাসিমুখে আমাদের সব অত্যাচার-জুলুম সহ্য করেছেন, কখনো তাঁকে রাগ করতে দেখিনি। এই সময়ে আমার বড় ফুপুর ছোট মেয়ে আমাদের ছোট আপাও ঢাকায় এসেছেন ডাক্তারি পড়ার জন্য। সবসময়ে আমার বাবার সঙ্গে খাওয়ার জন্য দাদি রাতে বসে থাকতেন। আমরা কত বলতাম, দাদি, আপনি খেয়ে নিন, বলতেন আমার বাচ্চাটা আসুক তারপরে খাব। বাবাকে বাচ্চা বলতে আমরা হেসেই অস্থির হয়ে যেতাম, দাদিও আমাদের সঙ্গে হাসতেন। বলতেন, তোরাও বুঝবি একদিন।

কোনো কঠিন রোগীর বাড়ি থেকে ফিরে উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করতেন বাবা কতক্ষণে আসবেন এবং তাঁকে সব বলবেন। আমরা বলতাম, আপনি তো নিজেই সব লিখে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছেন, তবু কেন বলতে হবে? বলতেন, ছেলে হলে কী হবে, ও-ই তো আমার ওস্তাদ। ওর কাছ থেকেই তো আমার এই বিদ্যা শেখা। সব শুনে বাবা বলতেন, তুমি তো সব ঠিকই করেছ মা।

যতদূর মনে হয় ১৯৪৯ বা ’৫০ সাল হবে, বিলেত থেকে সদ্য পাশ করে এলেন প্রফেসর হুমায়রা সাঈদ, মাদ্রাজি মহিলা। যেমন বড় ডাক্তার ছিলেন, তেমনি ভালো মানুষও ছিলেন। রোগীদের প্রতি খুব দরদ ছিল। তখন ডা. হাবিবুদ্দীনও ছিলেন কিন্তু মেয়েদের বেশিরভাগ মহিলা ডাক্তারের কাছে যেতে চাইতেন বলে তাঁর চাহিদা ছিল খুব বেশি। কোনো এক রোগীর বাড়িতে আমার দাদির সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল এবং আমার দাদির অভিজ্ঞ হাতের কাজ দেখে তিনি এতই অভিভূত হয়েছিলেন যে, সেই থেকে তাঁকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁর প্রশংসা করতেন। অনেক সময়ে এমনও হয়েছে যে, উনি হয়তো ক্লাস নিচ্ছেন সেই সময়ে কেউ ডাকলে উনি বলতেন, আপনারা ডা. ওয়াহেদের মাকে নিয়ে যান, আমি ক্লাস শেষ করে আসব। হয়তো ক্লাসে যাওয়ার আগে ডাকলে বলতেন, ডাক্তার ওয়াহেদের মা কি এসেছেন? তাহলে আপনারা চিন্তিত হবেন না। আমি ক্লাস কিংবা ওয়ার্ড শেষ করেই যাব। আমার দাদিও খুব ভদ্র ও বিনয়ী ছিলেন। রোগীর বাড়ি থেকে ডাকতে এলে, সবসময়ে বলতেন, আপনারা ডা. হুমায়রা সাঈদকে আনুন।

দাদিকে কেউ কিছু উপহার দেওয়ার চেষ্টা করলে বিনয়ের সঙ্গে বলতেন, আমি আল্লাহর ওয়াসেত্ম মানুষের বিপদে উপকার করার জন্য কাজ করতে পছন্দ করি। আল্লাহ যে আমাকে কিছু করতে দিলেন, সে-ই আমার খুশি, তাতেই আমি আল্লাহর কাছে শোকর করি। সবসময়ে তিনি ডা. হুমায়রা সাঈদের আসার অপেক্ষায় থাকতেন। তাঁকে সব বলে জিজ্ঞেস করতেন, আমি যা করেছি ঠিক করেছি তো?

আমার বাবার কাছে ডা. হুমায়রা সাঈদ আমার দাদির কাজের ভূয়সী প্রশংসা করতেন। আমার দাদি ভালো উর্দু বলতে পারতেন, তাঁর সঙ্গে উর্দুতেই কথা বলতেন। আমার দাদি নিজের কাফনের কাপড় নিজেই ঠিকঠাক করে রেখেছিলেন। মাঝে মাঝে রোদে দিয়ে রাখতেন। আমাদের বলতেন, দেখ, দেখে তোরা শিখে রাখ। আমরা সরাসরি বলে দিতাম, ওসব আমরা পারব না। তবু জোর করে আমাদের শুনিয়ে বলতেন, সব ঠিক করা থাকল, তোদের শুধু কর্পূর কিনতে হবে। তাঁর মৃত্যুর পর দেখা গেল সবকিছুই তিনি গুছিয়ে রেখে গেছেন। এমনকি দাফনের পরে যারা বাড়িতে ফেরত আসবে তাদের শরবত খাওয়ানোর চিনি পর্যন্ত তিনি গুছিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। আজিমপুর পুরনো কবরস্থানে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।

 

দাদা

আমার দাদারা চার ভাই ছিলেন। নাম যথাক্রমে আবদুল ওয়াসেক (আমার দাদা), আবদুর রাজেক, আবদুল নাতেক ও আবদুল মোমত্মাক। এঁদের বাবারাও চার ভাই। বোন ছিল কিনা জানা নেই। নাম যথাক্রমে আবদুদ দৈয়ান, আবদুর রায়হান, আবদুস সোবহান এবং খোরশেদ জামান। ডা. আবদুদ দৈয়ানরা তিন ভাই ডাক্তার ছিলেন। শুধু আবদুস সোবহান উকিল ছিলেন। আমার পরদাদা আবদুদ দৈয়ানের চিকিৎসাশাস্ত্রে অগাধ পা–ত্য ছিল। তিনি মোরেলগঞ্জ অঞ্চলে বহুদিন প্র্যাকটিস করেছেন। খুব প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। মোরেল সাহেবের জমিদারিতে মোরেল দুই ভাই ডাক্তার ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আমার পরদাদা আবদুদ দৈয়ান কাজ করতেন। ইংরেজদের সাহচর্যে থাকার জন্য হোক বা এমনিই হোক তিনি খুব স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন। শুনেছি, তিনি অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন। দীর্ঘদেহী, উজ্জ্বল, গৌরবর্ণ অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। পথে চলার সময়ে সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতেন, এদিক-ওদিক তাকাতেন না। এসব কথা একাধিকবার আমার বাবুর মুখে শোনা। মোরেল সাহেবরা জমিদারি বিক্রি করে দেশে ফিরে যান। যাওয়ার সময়ে আমার পরদাদাকে অনেক ডাক্তারি বই এবং যন্ত্রপাতি ছাড়াও নানা উপহার দিয়ে যান। তার কিছু অবশিষ্ট আমরা বশিরহাটে দাদারবাড়িতে চিলেকোঠার ঘরে দেখেছি বলে মনে পড়ে। আমার বাবু আমার দাদা-দাদির প্রিয় বড় ছেলে এবং ডাক্তার ছিলেন বলে সেসব যন্ত্রপাতি ও বইপত্র তিনিই পেয়েছিলেন। চিলেকোঠার ঘরটা আমার বাবুর জন্য সাজানো থাকত, বশিরহাটে গেলে তিনি ওই ঘরেই থাকতেন। ১৯৫০ সালের দাঙ্গায় বশিরহাটের সবাই এক কাপড়ে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন।

আমার দাদা মৌলবি আবদুল ওয়াসেক যখন বারো বছরের শিশু, তখন তাঁর পিতা ডা. আবদুদ দৈয়ান মোরেলগঞ্জে রোগী দেখতে গিয়ে সেখানেই ইন্তেকাল করেন। শুনেছি কাঠ-কয়লা দিয়ে তাঁদের দরজায় লিখে রেখেছিলেন তাঁর কী অসুখ হয়েছে এবং কী করলে ভালো হতে পারতেন। ডা. আবদুদ দৈয়ানের চার ছেলে। নাম যথাক্রমে আবদুল ওয়াসেক আমার দাদা, আবদুর রাজেক (মজিদ চাচা, সামাদ চাচাদের বাবা), আবদুল নাতেক (সাহাদত চাচা, ফিরোজা ফুফুদের বাবা) এবং আবদুল মোমত্মাক (তাঁর ছেলের নাম মঈদ)। ফিরোজা ফুপুর মেয়ে ডলির সঙ্গে পরে আমার বড় ভাই আবদুল জববার (খোকনের) বিয়ে হয়।

আমার দাদিরা পাঁচ বোন এবং দুই ভাই। আমার দাদি জমিলা খাতুন। অন্য বোনদের নাম ফজিলা, ওয়াকিলা, নাবিলা ও সানজিদা। সানজিদা ছিলেন নয়নের দাদি। আমার দাদিদের বড় তিন বোনের বিয়ে হয় আমার দাদাদের তিন ভাইয়ের সঙ্গে। বাকি দুইজনের বিয়ে হয় বাইরে। সেজো বোন ওয়াকিলা খাতুনের বিয়ে হয় আমার নানার (সৈয়দ হায়দার আলী) চাচাত ভাই সৈয়দ বসারত আলীর সঙ্গে। আমরা কিন্তু ছোটবেলায় আমাদের দাদির সেজো বোনকে দাদিই বলতাম। আর তাঁর স্বামীকে বসা নানা বলতাম। আমার এই সেজো দাদিও কিন্তু খুব দানশীলা মহিলা ছিলেন। আমার বসা নানা অত্যন্ত ধনী ছিলেন। দেদার জমিদারি ছিল কিন্তু ভীষণ কৃপণ
ছিলেন। জমিজমা-সম্পত্তির কারণে তাঁর ছেলেরা বশিরহাটে থেকে গিয়েছিলেন দেশবিভাগের পরও। পরে নিজেদের ছেলেমেয়েদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বর্তমানে তারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।

১৯৪৬ সালের ১১ই জুন আমার দাদার মৃত্যু হয়। বাবু আর আমরা সবাই বশিরহাটে গেলাম, বরফের পেটি কিনে ওষুধ নিয়ে যাওয়া হলো। বাবুর সঙ্গে বড়পা, ভাইয়ারা চলে গেল, আমি রয়ে গেলাম। ছোট্টর কথা মনে নেই। তার দু-একদিন পরই দাদা ইন্তেকাল করেন। দাদার ভাইরাও সবাই দাদাকে ঘিরে ছিলেন।

দাদার মৃত্যুর কতদিন পর জানি না তবে তখন থেকেই সবসময়ে দাদি আমাদের সঙ্গেই থেকেছেন। কোনো সময়ে বশিরহাট গেলে দু-একদিন থেকে মেহমানের মতো ঘুরে চলে আসতেন।

আমার দাদাকে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী তাঁর প্রিয় লাইব্রেরির পশ্চিমের বারান্দার সামনে (যেটা মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হতো) সমাহিত করা হয়। তাঁর স্বরচিত কবিতা পাথরে লিখে বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছিল :

আমার মাযার শিরে

কেহ যদি এসো ফিরে

জেয়ারত তবে একবার

‘ফাদখুলি ফি এবাদি

ওয়াদখুলি জান্নাতি’

করে যেয়ো বচন আল্লাহর।

 

 

বাবা

আমার প্রিয়তমা কন্যা শিরীন আমাকে বহু আগে বলেছিল, ‘আম্মা, তুমি জীবনের ঘটনা যা জানো, লিখে রাখো। আমরা তো ভেসে আসিনি। কিন্তু কোথা থেকে এসেছি, তা লিখে রাখো।’

ওর কথামতো অনেক ডায়েরিতে অনেক কিছু লিখেছি, তবু ঠিক মনঃপূত হয়নি। কারণ গুছিয়ে লেখার সেই ধারাবাহিকতা আমার নেই। কেবল যতটা পেরেছি, যখন যা মনে হয়েছে এবং যতটা জানি, লিখেছি। যদি কেউ কোনোদিন আগ্রহ নিয়ে আমার ডায়েরি ঘাঁটে তবে হয়তো অনেক কিছু জানতে পারবে। যদিও অসংখ্য বানান ভুল এবং লেখার ধারাবাহিকতা খুঁজে পেতে কষ্টই হবে। তবু আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাব।

আমরা বাবাকে সবসময়ে বাবু বলে ডেকে এসেছি। কারো কাছে তাঁর কথা বলতে হলে বলেছি বাবা। তাঁর পুরো নাম আবু খালেদ মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ। ডাক নাম আবু।

বাপ-মায়ের সব ভালো গুণ আমার বাবা পেয়েছিলেন। তিনিও সারাজীবন তাঁর বাবা-মার মতো সহজ-সরল জীবনযাপন করেছেন। অসহায় মানুষের দুঃখকষ্টে তিনি তাঁর সাধ্যমতো এমনকি তাঁর সাধ্যের বাইরে গিয়েও সাহায্য করতেন।

তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন, দিন-রাত পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তাঁর পড়ার জন্য তাঁকে তাঁর মায়ের কাছে মারও খেতে হয়েছে। একটা খবরের কাগজ বা বই পেলে তার আগাগোড়া পড়া চাই। পড়ার নেশা তাঁর সারাজীবন ছিল।

জীবনের শেষ সাতটা দিন বাবু হাসপাতালের বেডে যখন খুব অসুস্থ হয়ে শুয়ে ছিলেন, বুকে, হাতে, পায়ে মেশিন লাগানো ছিল, শুধু সেই কটা দিন তিনি পড়াশুনা করতে পারেননি। যতদিন আমি বাবুর সঙ্গে ছিলাম কোনোদিন মনে পড়ে না যে তাঁকে দেখেছি কিছু না পড়ে চুপ করে বসে আছেন। তাঁর মতো আত্মভোলা আর নিরীহ মানুষ আমি জীবনে আর দেখিনি। মানুষের সঙ্গে মিশতে, কথা বলতে ভালোবাসতেন। আর হাসতেন প্রাণখোলা হাসি। এত সুন্দর হাসি – মনে হতো – যেন আকাশের মতো। মনটা ছিল স্বচ্ছ আর শিশুর মতো নরম। মানুষের কষ্ট দেখলে খুবই দুঃখ পেতেন। বিশেষ করে তাঁর রোগীর বেলা। মনে হতো যেন রোগের কষ্টটা তাঁরই হচ্ছে। বড় মায়া-মমতা ছিল রোগীর ওপর। মাঝে মাঝে আমাকে ডেকে বলতেন, ‘তোমার কাছে কোনো বই আছে?’ আমার কাছ থেকে রবিঠাকুরের সঞ্চয়িতা নিয়ে কবিতাও পড়তেন। আমাকেও বলতেন, ‘কবিতা শোনাও।’ ‘সোনার তরী’ কবিতাটা তাঁর খুবই প্রিয় ছিল, বলতেন, ‘কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।’ আর প্রায়ই বলতেন, ‘I am racing against time’.

আমার বড়ভাই শেষ জীবনে পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক কষ্ট পেয়ে ২০০৭ সালের ২৫শে মে ভোরে হাসপাতালে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে মৃত্যুবরণ করেন। যখন বেশি অসুস্থ ছিলেন তখন কিছু বলতে পারতেন না। এমনকি আমাদের চিনতেও পারতেন না। তাঁর অবহেলায় বাবুর লেখা বইপত্রের কোনো হদিস ছিল না। এসব ব্যাপারে তাঁর কোনো আগ্রহও কখনো দেখিনি। বিশেষ করে ভাবির ইন্তেকালের পর ভাইয়ার কোনো কিছুর প্রতি তেমন কোনো মনোযোগ ছিল না। শুধু নিজের বইটাই লিখেছিলেন নিষ্ঠার সঙ্গে।  একটু মনোযোগী হলে কিংবা পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে এটা তাঁর অবশ্যকর্তব্য বলে মনে করলে আজ আমাদের পূর্বপুরুষের কথার অনেক কিছু রক্ষা পেত। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বাবুর প্রতি তাঁর তেমন কোনো আগ্রহ বা তাঁর লেখাগুলো সংরক্ষণ করা যে দরকার এবং সেটা যে বড় ছেলে হিসেবে তাঁরই প্রথম দায়িত্ব, তাঁর তা মনে হয়নি কখনো।

ভাইয়ার অযত্ন-অবহেলায় বাবুর লেখা বহু ডায়েরি, বহু ডাক্তারি প্রবন্ধ হারিয়ে গেছে। বলতে গেলে নিন্দা করা হয়, তবু সত্য প্রকাশের খাতিরে বলতেই হবে, আমার ভাবি (ডলি) বাবুর অত্যন্ত প্রিয়পাত্রী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর লেখা সংরক্ষণ করা তো দূরে থাক, অনেক কাগজপত্রও ফেরিওয়ালার কাছে সেরদরে বিক্রি করে দিতে একটুও কুণ্ঠিত হননি। সে-কথা মনে হলে এখনো বড়ই দুঃখিত হই।

বড় আপা তো আরো আগেই ইন্তেকাল করেছেন। ১৯৮৩ সালের ৭ই জুন মঙ্গলবার সকাল ১০টার সময়ে আমাদের সবার প্রিয় বড় আপা অনেক ভুগে, অবর্ণনীয় কষ্ট পেয়ে ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর ওভারিয়ান ক্যানসার হয়েছিল। আমার সাধ্যমতো বড়পার দেখাশোনা করেছিলাম। তখন আমার জীবনের বড় দুর্দিন ছিল। যত দুঃসময় হোক তবু তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো যে আমার কাছে ছিলেন সে-কথা ভেবে মনে অনেক শান্তি পাই। তবে তাঁর শেষ ইচ্ছা আমরা পালন করতে পারিনি। বড়পা যদি সুস্থ
থাকতেন তবে আমাদের সেসব অমূল্য রত্ন অমন হেলায় নষ্ট হতো না। এসব দুঃখ নিয়েই আমার জীবন শেষ হবে। অনেক সময়ে ভাইয়াকে বলেছিলুম, আমাদের পরদাদা ডা. আবদুদ দৈয়ানের নিজ হাতে লেখা মেটিরিয়া মেডিকার বইটি আমাকে দাও। চেষ্টা করে দেখব মিউজিয়মে দিতে পারি কি না। তাহলে লোকে দেখবে এবং ভালো করে সংরক্ষিত হবে। কিন্তু ভাইয়া মুখ এঁটে বসে থেকেছে, একটা জবাব পর্যন্ত দেয়নি। এটা আমার শুধু না, আমাদের পরিবারের জন্য একটা দুঃখজনক ব্যাপার। যার কোনো ক্ষমা হয় না। বিশেষ করে বাবুর পর ভাইয়া যখন আমাদের বংশধর ছিলেন। এখন প্রবাল হচ্ছে বংশধর। কিন্তু সে বিদেশে থাকে। তাছাড়া এ-ব্যাপারে তার কতটা আগ্রহ আছে তা আমার জানা নেই। ওরা বাবু সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানে কি না সন্দেহ।

আমার বাবা খুবই অভাব আর দুঃখ-কষ্টের মধ্যে মানুষ হয়েছেন। কিন্তু সেজন্য তাঁর মনে কোনো কষ্ট বা অনুশোচনার কথা গল্পের ছলেও বলেননি। আমার দাদার মুখে শুনেছি, বই-খাতার দরকার হলে মুখ ফুটে কখনো বলেননি যে, আমার এটা লাগবে। ছুটিতে বাড়ি এলে যাওয়ার সময়ে ট্রেনে দাঁড়িয়ে দরজায় আসেত্ম আসেত্ম আঙুল ঘষতেন। তখন দাদা বুঝতেন ছেলের বোধহয় কিছু লাগবে। জানতে চাইলে মাথা নিচু করে বিনয়ের সঙ্গে জবাব দিতেন। ছোটবেলা থেকে আমার বাবা খুব ভালো ছাত্র ছিলেন বলে আমার দাদা-দাদিকে বাবার লেখাপড়ার জন্য কোনো চিমত্মা করতে হয়নি। তিনি সবসময়ে বৃত্তি পেয়েছেন। তাঁর নিজের যে মাইক্রোস্কোপ প্রবীণ হিতৈষী সংঘকে দিয়েছেন সেটা হাজী মোহাম্মদ মহসীন স্কলারশিপের টাকায় কেনা, এই স্কলারশিপ তিনি সমস্ত ছাত্রজীবনে পেয়েছেন। বশিরহাট হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন। এরপর কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আইএসসি ও বিএসসি পাশ করেন। বিএসসিতে ফিজিওলজি বিষয়ে সোনার মেডেল পেয়েছিলেন। আমার মায়ের বাক্সে ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোথায় গেল তা জানা যায়নি। বাবুর ঘরের দেয়ালে টাঙানো দাদা, দাদি ও আমার মার ছবি যে কোথায় গেছে তা জানি না। বাবু তমঘা-এ-পাকিস্তান খেতাব পেয়েছিলেন, সে-মেডেল যে কোথায় গেছে তা জানি না।  বাবুর বই ও তাঁর হাতে লেখা ডায়েরি ছাড়াও আরো কত রকম লেখা যে নেই – সেটা তো আরো দুঃখের কথা।

দাদির মুখে শুনেছি, আশপাশে কোনো পাড়ায় হঠাৎ রাত্রে কারো বাড়িতে আগুন লেগেছিল।  বাবু তখন স্কুলে হয়তো নাইন-টেনে পড়েন। পাড়ার অনেকের সঙ্গে তিনিও আগুন নেভাতে সাহায্য করেছিলেন। এর বেশ পরে মেডিক্যাল কলেজে থার্ড ইয়ারে পড়ার সময়ে বশিরহাটের আশপাশের কয়েক গ্রামে মহামারির আকারে কলেরা ছড়িয়ে পড়ে। তখন তিনি তাঁর দুজন সহপাঠীসহ নিজের ছোট মামাত ভাই আমাদের হাফেজ চাচাকে (মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান) নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় মুমূর্ষু কলেরা রোগীর সেবা করেছিলেন। শুনেছি সেই সময়ে গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে গিয়েছিল। মানুষকে দাফন করা বা হিন্দুদের সৎকার করার লোকই পাওয়া যাচ্ছিল না। রোগীর সেবা ছাড়াও তাঁরা দাফন করার কাজও করেছিলেন। যেসব মানুষ মারা গেছেন তাদের ব্যবহৃত কাপড় পোড়ানো, সেই সময়ে কীভাবে চলতে হবে ইত্যাদি যা কাজ ছিল সবই করেছেন অক্লান্তভাবে।

বাবু যখন বশিরহাটের স্কুলে পড়তেন তখন হিন্দু ছেলেরা বা মাস্টারমশাইদের কাছ থেকে মুসলমান ছেলেরা বোধহয় সদ্ব্যবহার পেয়েছিলেন। তা না হলে সে বিষয়ে বাবু কিছু নিশ্চয়ই বলতেন।  মনে হয় সেখানে এই দুই সম্প্রদায় খুব ভালোভাবে মিলেমিশে                      থাকতেন। কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময়েও অন্যরকম কিছু শুনেছি বলে মনে হয় না। সেই সময়ে বাবুদের সঙ্গে অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিও পড়তেন। যেমন সুভাষচন্দ্র বসু, ড. কুদরাত-এ-খুদা, ড. কাজী মোতাহার হোসেন। (তবে ইনি কিন্তু বেশিদিন সেখানে পড়েননি)। সেই সময় ওটেন বলে এক ইংরেজ প্রিন্সিপাল ছিলেন। তিনি এদেশের মানুষের প্রতি খুবই দুর্ব্যবহার করতেন। তাঁর খুব দাপট ছিল। এদেশীয়দের তাচ্ছিল্য ছিল। খুব কম সংখ্যক মুসলমান ছাত্র ছিল। তারা খুব ভয়ে ভয়ে থাকত। হিন্দুদের যে সবার খুব সাহস ছিল তা নয়। কিন্তু সাহস ছিল সুভাষচন্দ্র বসুর। তখন গান্ধীজির স্বদেশি আন্দোলনের সময়। বাবুরা অর্থাৎ ছাত্ররা সবাই আন্দোলনের পক্ষে। কিন্তু জোরেশোরে কিছু করছে না। তার মধ্যে মুষ্টিমেয় মুসলমান ছেলে ভয়ে ভয়েই থাকত।

বাবুর মুখে শুনেছি সুভাষ বসু দেখতে যেমন রাজপুত্তুরের মতো চেহারা, তেমনি ছিলেন তেজস্বী এবং সাহসী। ওটেন ছেলেদের ক্লাসে যেতে বলেছিলেন কিন্তু সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন কেউ ক্লাসে যাবে না। ওটেন যখন আরো চোটপাট দেখাচ্ছিলেন তখন তিনি সব ছাত্রকে কলেজের বাইরে বেরিয়ে যেতে বললেন এবং বললেন কেউ ক্লাস করবে না। সবাই তাঁর কথামতোই চলল। তাতে ওটেন রাগে আরো গরগর করতে করতে বললেন, কাউকে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হবে না। তখন সুভাষ বসু দোতলায় ওটেন সাহেবের ঘরে গিয়ে তাঁকে প্রহার করে কলেজ থেকে বেরিয়ে গেলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়েই তিনি বিলেতে চলে গেলেন এবং আইসিএস পরীক্ষায় রেকর্ড নম্বর পেয়ে তিনি দেশে চলে আসেন। সরকারি চাকরি প্রত্যাখ্যান করে তিনি দেশের সেবায় মনোনিবেশ করেন।

অসহযোগ আন্দোলনে বাবুও অংশ নিয়েছিলেন বিদেশি জিনিস, বিদেশি কাপড়-চোপড় বর্জন করে। অবশ্য তার জন্য নিজের লেখাপড়ার কোনো ক্ষতি না করে। ছুটিতে বাড়ি গিয়ে ছোটভাইদের হুকুম করেছেন, বাড়িতে যত কাচের বিলেতি জিনিসপত্র সব নিয়ে আয়, ভাঙা হবে। আমার দাদি সে-কথা শুনে তাড়াতাড়ি সব ভালো ভালো বাসন-কোসন লুকিয়ে রেখেছিলেন। যা কিছু দুই-চারটা হাতের কাছে পেয়েছিল তাই মহাউৎসাহে ভাঙা হলো, পোড়ানো হলো।

বাবুর সঙ্গে একজন ধনী মুসলমান ছাত্র ছিলেন। তিনি নিজের গাড়ি চালিয়ে কলেজে আসতেন। পরে তিনি পেস্নন কিনেছিলেন এবং নিজে সেই পেস্নন চালিয়ে একবার ঢাকায় এসেছিলেন। তাঁর নাম ডা. রহিম। তিনি কলকাতাতেই প্র্যাকটিস করতেন। তাঁর সঙ্গে বাবুর বহুকাল যোগাযোগ ছিল। একবার পরীক্ষার সময়ে তিনি টয়লেটে যাবার অনুমতি নিয়ে বাইরে গিয়েছিলেন। তখন সেখানে যে-গার্ড ছিলেন তিনি ডা. রহিমকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘Do you have any note?’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘Yes I have’ বলেই পকেট থেকে সরু মোড়ানো কাগজ তাঁকে দিয়েই আবার হলে গিয়ে পরীক্ষা দেওয়া শুরু  করলেন। একটু পরে সেই গার্ড বললেন, আমি এই নোট চাইনি। বলে সেটা তাকে ফেরত দিলেন। সেটা ছিল একটা ১০ টাকার নোট খুব সুন্দর করে পেঁচানো। তিনি এই ধরনের ছোটখাটো দুষ্টুমি করতেন।

ডা. ইউসুফের বাবা ডা. ওমার বাবুর সহপাঠী ছিলেন। সবাই তাঁকে ওমারা মিয়া বলে ডাকতেন। বাবুর বিশেষ বন্ধু ডা. গফফার শেঠ, বাড়ি ছিল লাহোরে। তিনি ওমার মিয়ার রুমমেট ছিলেন। একবার ঢাকায় পরীক্ষা নিতে এসে তিনি চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন ওমার মিয়ার সঙ্গে দেখা করতে। সেও বহু আগের কথা। তখন পাকিস্তান আমল, মনে হয় পঞ্চাশের দশকে। ডা. রেফাতুল্লাহর সঙ্গে বাবুর খুবই বন্ধুত্ব ছিল এবং তা জীবনের শেষ পর্যন্ত অটুট ছিল। তাঁর বিষয়ে বলেছিলেন যে, রেফাতুল্লাহ মিয়া থার্ড ইয়ারে থাকতেই প্র্যাকটিস শুরু করেন। গ্রামের লোকজন চোখ দেখাতে এলে নিজেই চোখের পরীক্ষা করে চশমা দিয়ে দিতেন; অবশ্য তেমন রোগী হলে হাসপাতালে নিয়ে যেতেন। ডা. রেফাতুল্লাহর কথাপ্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল। তখন আমরা পুরানা পল্টনের ‘পরম ভবন’ বাড়িতে থাকতাম। হঠাৎ আমরা শুনলাম যে ডা. রেফাতুল্লাহ রোগী দেখার সময়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। খবর পেয়ে মেডিক্যাল কলেজের সব ডাক্তার বাড়িতে গেলেন। ডাক্তাররা কিছুই ধরতে পারছেন না অজ্ঞান হওয়ার কারণ। নানা রকম চেষ্টা চালানো হচ্ছে, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। তখন সার্জন ছিলেন ইংরেজ সাহেব মেজর অ্যালেনসন। তিনি মাথায় অপারেশন করার জন্য তৈরি। মিসেস রেফাতুল্লাহ বললেন, ডা. ওয়াহেদ যা বলবেন তাই হবে। বাবু ব্রেইন অপারেশনে একেবারেই রাজি ছিলেন না। অন্য কেউই তেমন একটা রাজি ছিলেন না। বাবু পকেটে তসবিহ নিয়ে গেলেন। আমার দাদি তিন-চারদিন ধরে জায়নামাজে বসে রইলেন। বাড়িতে সবাই উৎকণ্ঠিত, থমথমে ভাব।  তিন-চারদিন বা তার বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে তাঁর অজ্ঞান হওয়ার। মেজর সাহেব মাথায় অপারেশন করার জন্য ছটফট করছেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর কথাতে সবাইকে সায় দিতে হলো। যন্ত্রপাতিসহ সবাই চলে এসেছিল। যাই হোক,
মাথার একপাশ খুলে কিছুই পাওয়া গেল না তখন উনি মাথার অন্যপাশে অপারেশন করতে চাইলেন। কিন্তু বাবু বললেন, আর কিছু করা হবে না অর্থাৎ সাহেবের ডায়াগনসিস ভুল প্রমাণিত হলো। এ-ঘটনার পরে বোধহয় আরো একদিন পার হলো, হঠাৎ ডা. রেফাতুল্লাহ চোখ খুলে বললেন, কী ব্যাপার? আপনারা সব এখানে কেন? তাঁর কী হয়েছিল তা তিনি বলতে পারেননি। তাঁর জীবন থেকে তিন-চারটি দিন একেবারে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। সবাই বাবুকে বললেন, আপনার ডায়াগনসিসই  ঠিক ছিল। অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে বোধহয় ব্যাপারটা হয়েছিল। স্বসিত্মর সঙ্গে বাবু অনেক শোকর করেছিলেন। দাদি সেজদায় বসে কত যে শোকর করেছিলেন আল্লাহ রাহ্মানুর রাহিমের কাছে। ডা. রেফাতুল্লাহ বাবুর অনেক পরে ইন্তেকাল করেন। কিন্তু যতদিন বেঁচে ছিলেন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। মিসেস রেফাতুল্লাহ এখনো জীবিত আছেন। বেশ কিছুদিন আগে একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। বারবার করে বলেছিলেন, ‘আবার এসো।’ কিন্তু আর যাওয়া হয়নি আমার। জানি না আবার কবে যাওয়া হবে।

বাবুর কাছে তাঁর ছাত্রজীবনের কথা আরো শুনেছিলাম যে, ডিসেকশনের সুযোগ মুসলমান ছাত্ররা তেমন পেতেন না। সবক্ষেত্রেই হিন্দুদের আধিপত্য ছিল। তাঁদের দাপটে মুসলমানরা কোণঠাসা হয়ে থাকতেন। তাঁদের ঘাড়ের ফাঁক দিয়ে যতটা সম্ভব দেখে দেখেই তাঁর শেখা। তাছাড়া ক্লাস শেষ করে রাতের অন্ধকারে ডোমদের সহায়তায় কখনো কখনো ডিসেকশন করা দেহগুলো দেখে শেখার চেষ্টা করতেন। অর্থাৎ অনেক কষ্ট করেই লেখাপড়া করতে হয়েছে। তবু আল্লাহর রহমতে কঠিন অধ্যবসায়ের ফলে প্রথমবারেই খুব ভালোভাবে পাশ করে গেছেন। এরই মধ্যে থার্ড ইয়ারে পড়ার সময়ে ছুটিতে বশিরহাটে গেলে আমার দাদিদের ধাত্রীবিদ্যা যেমন শেখাতেন, তেমনি পাড়া-প্রতিবেশী ছাড়াও অন্য পাড়া বা আশপাশের গ্রামের লোকদের অসুখ-বিসুখের চিকিৎসা করাতেন। তাছাড়া গ্রামে কালাজ্বর ও ম্যালেরিয়া মহামারির আকার ধারণ করলে নিজের মামাত ভাই আমাদের হাফেজ চাচা ও নিজের শ্যালক আমার সেজো মামাকে নিয়ে লোকদের সেবা করতেন। কালাজ্বরের ওপর সেই সময়ে গবেষণা করেছিলেন। পরীক্ষায় কালাজ্বর-বিষয়ে প্রশ্ন আসায় খুব ভালো নম্বর পেয়েছিলেন। তাঁর লেখা খুবই ভালো হওয়ায় মাস্টারমশাইয়ের ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছিলেন। তাঁর সবসময়ে অভ্যাস ছিল, যে-রোগী দেখতেন তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করতেন এবং সেই কেস হিস্ট্রি লিখে রাখতেন। এই অভ্যাস তাঁর সারাজীবন ছিল। তাঁর হাতের লেখা কেস হিস্ট্রি হয়তোবা এখনো প্রবীণ হিতৈষী সংঘের লাইব্রেরিতে থাকতে পারে। বেশ আগে কোনো একসময়ে ভাইয়ার কাছে শুনেছিলাম যে, কোনো অস্ট্রেলিয়ান সাহেব প্রবীণ হিতৈষীতে বাবুর লেখাগুলো দেখে বলেছিলেন, ‘তোমাদের এখানে তো সোনার খনি আছে।’

আসলেও তাই, যদি কেউ গবেষণার জন্য ওখানে যান তবে দেখবেন হয়তো সেখানে অনেক কিছুই পাবেন। আল্লাহর কাছে দোয়া করি যেন তাঁর এত কাজের সুফল মানুষ পেতে পারেন।

মনে পড়ে জাফর সাহেবের কথা। তিনি বাবুকে খুবই মান্য করতেন এবং সবসময়ে দেখাশোনা করতেন। তাঁর গোড়ার গল্পটাও বাবুর কাছে শুনেছি, যা খুব ভালো করে মনে আছে। সেটা হলো, তিনি বলেছিলেন, বাবু যখন ট্রপিকাল স্কুল হাসপাতালে কাজ করতেন তখন জাফর সাহেবও সেখানে ল্যাবরেটরিতে একটা খুবই সামান্য চাকরি করতেন। কোনো কাজ করতেন। বাবুর মাস্টারমশাইরা সেখানে গবেষণা করতেন। বোধহয় কোনো ভ্যাকসিন তৈরির কাজ করতেন। কিন্তু যেহেতু জাফর সাহেব মুসলমান তাই তিনি তাঁদের কাজের কাছাকাছি থাকলে তাঁরা কথা বলা বা কাজ করা থামিয়ে দিতেন। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বাবু জাফর সাহেবকে খুব সাবধানে একেবারে বোকা সেজে থাকতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, ওখানে কাজ করার সময়ে কান খাড়া করে তাঁরা কী বলছেন, কী করছেন, তা লক্ষ রাখতে। তাঁরা কীভাবে কী তৈরি করছেন তা শেখার চেষ্টা করতে। তবে সবকিছু চূড়ান্ত বোকা সেজে। যেন বাঁয়ে যেতে বললে ডানে যাবে এবং ডানে যেতে বললে বাঁয়ে যাবে। কোনো জিনিস আনতে বললে জানা থাকলেও উলটোটা নিয়ে যাবে। যতই বকাঝকা করুক চুপ করে থাকবে। বলবে ভুল হয়ে গেছে স্যার। এই কথা বলে আবার সেই ভুল করবে এবং বিরক্ত হবে না। বাবুর এই পরামর্শে জাফর সাহেব খুবই পারদর্শিতার সঙ্গে বসন্তের ভ্যাকসিন বানানো শিখেছিলেন, যা দেশবিভাগের পর ঢাকায় এসে তাঁর খুবই কাজে লেগেছিল।

বাবুর মাস্টারমশাইরা জাফর সাহেবের বোকামিতে খুবই খুশি হয়েছিলেন এবং প্রকাশ্যেই বলতেন, ‘এই নেড়ে যা বোকা, ওর সামনে আমরা নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারি।’ সেই থেকে তাঁরা জাফর সাহেবের সামনে সব কাজ করতেন। আর তাইতে জাফর সাহেব খুবই ভালো করে কাজ শিখেছিলেন। দেশবিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে জাফর সাহেবের খুবই কদর হয়েছিল। কারণ ওই লাইনে উনি ছাড়া এত অভিজ্ঞ আর কেউ ছিলেন না।

প্রবীণ হিতৈষী সংঘের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দেখে এসেছি যে,  ল্যাবরেটরিতে যাঁরা কাজ করতে আসতেন তাঁদের বাবু নিজেই নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ শেখাতেন। ওখানে রক্ত, প্রস্রাব এবং আরো যা যা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হতো তা বাবুর তত্ত্বাবধানে হতো এবং সেজন্য তিনি যে-রিপোর্ট দিতেন তা যদি অন্য কোনোখানে আরো বেশি পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়া হতো তবে তাঁরা সেইসব রিপোর্টের ভূয়সী প্রশংসা করতেন। সারাজীবন বাবুর অর্জনের জন্য, জানার জন্য প্রবল আগ্রহ ছিল। অনেক সময়ে দেখেছি যে, রোগী দেখতে দেখতে ভেতরে এসে টেলিফোনে তাঁর অধস্তন, বয়সে ছোট, যাঁকে তিনি মনে করতেন ভালো জানে সে-রকম ডাক্তারের সঙ্গে রোগের বিষয়ে আলোচনা করতেন। বলতে শুনেছি যে, ‘আমি এই ওষুধ দিচ্ছি, ঠিক আছে তো?’ কখনো ভাবতেন না যে আমিই সব জানি, আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। এই নম্রতা, ভদ্রতা তাঁর সবসময়ে ছিল। সবসময়ে বলতেন, ‘আপনারা আমাকে বলবেন, পরামর্শ দেবেন, আমি ভুল করলে আমাকে বলবেন।’

বাবু প্রতিদিন নামাজ পড়তেন, কোরআন শরিফ পড়তেন। ভোরে তাঁর নামাজ পড়াটা দেখতে পাইনি। কিন্তু কোরআন শরিফ পড়াটা প্রত্যেকদিন সকালে ঘুম থেকে জেগেই দেখেছি – হয় পড়ছেন অথবা পড়ে কোরআন তুলে রাখছেন আলমারিতে। সারাজীবন তিনি নামাজ, কালাম, রোজা রেখেছেন। আরবি পড়েছেন, তবে ঘরে। আর জুমার নামাজ জীবনে মাত্র দুবার কামাই করেছেন। তবে ইচ্ছাকৃত নয়। জীবনের শেষ শুক্রবারে অসুস্থ হয়ে আর তাঁর মসজিদে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল না, বসেও পড়তে পারতেন না, শুয়ে শুয়ে ইশারায় পড়েছিলেন। খোঁজ নিয়েছিলেন তাঁর সবচেয়ে আদরের নাতি দীপু, টিকুরা নামাজ পড়তে গিয়েছে কি না।

আর একবার শুক্রবারে তিনি কাজের মধ্যে এতটাই নিমগ্ন ছিল যে, সেদিন যে শুক্রবার ছিল তা তিনি সম্পূর্ণভাবে ভুলে গিয়েছিলেন। বাড়ি ছিলেন না। তবে বাড়ি ফিরে তাঁকে যে আফসোস করতে দেখেছিলাম, তা জীবনে ভুলব না। সবসময়ে যে বাড়িতে এসে নামাজ পড়তেন তাও না। অনেক সময়ে পথে বা কলেজে থাকলে জুমার সময় হলে সেখানেই পড়ে নিতেন। আমিই বোধহয় জানতে চেয়েছিলাম, আজকে কোথায় নামাজ পড়লেন? তখন তিনি বলতে লাগলেন যে, ‘আমি আজ জুম্মার নামাজের কথা ভুলে গেলাম? জীবনে কোনোদিন আমার জুম্মার নামাজ ভুল হয়নি, আজ আমার এ কী হলো?’ তাঁর মনের কষ্টের যে-বহিঃপ্রকাশ সেদিন দেখেছিলাম, তা যদি আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারতাম! তখন আমার মনে হয়েছিল এবং এখনো মনে হয় যে, তাঁর সে আন্তরিক অনুশোচনার জন্য আল্লাহ হয়তো তাঁকে আলাদা সওয়াব দেবেন।

সান্তবনা দিয়ে বাবুকে বলেছিলাম, ‘আপনি তো ইচ্ছা করে করেননি, তা তো আল্লাহ জানেন। তিনি নিশ্চয়ই আপনাকে ক্ষমা করবেন।’ তখন থেকে আমাদের নিয়ম হয়ে গেল জুমার দিন সকাল থেকে তাঁকে ফোন করে জানিয়ে দেওয়া।

ওয়াক্তের নামাজও তাঁকে সবসময়ে পড়তে দেখেছি, তবে অনেক সময়ে উলটাপালটা হয়ে যেত। তাও হয়তো রোগী দেখা অথবা অন্য কোনো জরুরি কাজের কারণে। বলতেন, ‘আমার ডিউটি আমি করছি, আল্লাহ তা কবুল করবেন কি না তা আল্লাহর ইচ্ছা।’ পথে থাকলে গাড়িতেই নামাজ পড়তেন। আমার দাদিরও এই অভ্যাস ছিল। আল্লাহর অসীম রহমতে আমিও এই অভ্যাসটা রপ্ত করেছি এবং খুবই চেষ্টা করি নামাজ যাতে কাজা না হয়। তবু কত সময়ে হয়েই যায়।

জীবনের শেষ সাতটা দিন হাসপাতালেও দেখেছি বাবু ইশারায় নামাজ পড়ছেন। অসুখের কারণে মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ছেন বা জ্ঞান থাকছে না। কিন্তু তারপর আবার জেগে নামাজ পড়ছেন। সেই সময়ে তাঁর ছাত্ররা (তখনকার বড় বড় ডাক্তার) সবাই তাঁর জন্য যা করেছেন তা না বললে তাঁদের প্রতি আমাকে অকৃতজ্ঞ থাকতে হবে।

জাতীয় প্রফেসর ডা. নুরুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার মালেক – এঁরা দিন-রাতের মধ্যে যে কতবার আসতেন, বাবুর কুশল জানতে চাইতেন। এই দুজন ডাক্তার হিসেবে সবসময়ে যোগাযোগ রাখতেন। তাছাড়াও আরো অনেক ডাক্তার আসতেন, তাঁদের তত চিনতাম না। এঁরা বাদে আরো আসতেন তাঁর পুরনো ছাত্রছাত্রীরা। তাঁদের দেখলে খুব খুশি হতেন আর বলতেন, ‘তোমাদের বকাঝকা করেছি।’ সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে দেখে ঝরঝর করে কেঁদেছেন।

[আমার ভগ্নিপতি] কামাল ভাইয়ের তখন চট্টগ্রামে পোস্টিং ছিল। কিন্তু বাবুর খবর পেয়ে, অনেক কষ্ট করে এসেছিলেন। তাঁকে দেখেই বাবু বললেন, ‘তোমার কাজ ছেড়ে ঢাকায় এলে কেন?’ মিথ্যা কথা বলে তিনি বলেছিলেন, ‘সরকারি কাজে ঢাকায় এসেছি।’ তখন বাবু আশ্বস্ত হলেন। তখন তাঁর মুখে এমন একটা স্নিগ্ধ স্বর্গীয় হাসি দেখেছিলাম যে, সে ভোলার নয়। আসলে কামাল ভাই তো তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র ছিলেন। তাই হয়তো তাঁকে দেখে মনে মনে অনেক খুশি হয়েছিলেন। একদিন বিকেলে আমাদের বাড়ির মালি আর একটা ছোট ছেলে – যার নাম রব – প্রবাল, পেপির সঙ্গে খেলা করত। ওরা আসায় কী যে খুশি হয়েছিলেন এবং সুন্দর মিষ্টি একটা হাসিতে মুখটা ভরে গিয়েছিল। মিষ্টি করে বলেছিলেন, ‘তোরা এসেছিস?’ সেই সুন্দর স্বর্গীয় হাসি আজো আমার চোখে ভাসে।

ডা. ও মিসেস মনিরুজ্জামান, ডা. শামসুন নাহার এসে বাবুকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন। বাবু বললেন, ‘তোমাদের কত বকেছি।’ বেশি কথা বলা নিষেধ ছিল, তবু বলেছেন। বোঝা যাচ্ছিল কষ্ট হচ্ছে। জ্ঞান ছিল তবু মাঝেমধ্যে ঘুমিয়ে পড়ছিলেন বলে মনে হচ্ছিল। হয়তো অসুখের জের।

বাবুর কথা কত টুকরো টুকরো স্মৃতি হয়ে মনের মধ্যে আনাগোনা করে। গতকাল বাজার থেকে বড় একটা ফুলকপি কিনেছি। এতবড় সচরাচর দেখা যায় না। তাই হঠাৎ পেশাওয়ারের কথা মনে হয়ে গেল। বাবু সেখানকার মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। ওখানে আমাদের বাগানে এর চেয়ে বড়মাপের ফুলকপি হয়েছিল।  অনেকজনকে দেওয়া হয়েছিল। বাবুর সে-আনন্দের কথা আজো মনে হলে বুকটা ভরে ওঠে। এত খুশি হতেন কাউকে বাগানের কোনো জিনিস দিতে পারলে। যারা কাছে থাকত তাদের দেওয়া হতো আমাদের কাজের লোক মারফত, আর যারা দূরে থাকতেন, তারা আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এলে যাওয়ার সময়ে সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হতো।

বলা বোধহয় বাহুল্য হবে না যে, প্রায়ই, প্রত্যেক রবিবারে আমাদের বাড়িতে কেউ না কেউ আসতেন। আর বিমানবাহিনীতে বাবুর যত ছাত্র ছিল তাঁরা সব দলবেঁধে আসতেন। বাবু কী যে খুশি হতেন, মনে হতো বাড়িতে কোনো উৎসব হচ্ছে। কী ভালো যে লাগত বাবুর খুশি দেখে। আর লজ্জা লাগত বাড়িতে হঠাৎ অনেক মানুষের সমাগমে খাবার ব্যবস্থা ভালো করা সম্ভব হতো না বলে। তবে ডাল, ভাত, আলুভর্তা আর কাছের বাজারে যে সবজি পাওয়া যেত, তাই দিয়েই ব্যবস্থা করা হতো। আমি সংসার-অনভিজ্ঞ বাবুর আহ্লাদি মেয়ে। দুনিয়াদারির কিছু জানতাম না।

আমাদের খানসামা যা বলত, যা করত তাই। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে সবসময়ে মাছ-গোস্ত পাওয়া যেত না। মাঝেমধ্যে হঠাৎ কখনো পাওয়া যেত। আসলে হয়তো রোজই পাওয়া যেত হয়তো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যেতে হতো, যা আমার জানা ছিল না।

[জানুয়ারি ২০০৮] ২১ তারিখ বেলা ৩-৩০ মিনিটের মিটিংয়ে যখন গেলুম, তখন প্রবীণ হিতৈষী পত্রিকার একটা কপি হাতে পেয়ে উলটাতে গিয়ে দুবার হোঁচট খেলাম।

প্রথমটা হলো, বাবুর কথা লিখতে গিয়ে তাঁর নামটা লেখার পরেই ডা. ইব্রাহিমের নাম এসে গেল। যেটা আসা উচিত ছিল আরো পরে। তাঁর কথা লেখায় আমি খুশি ছাড়া অখুশি নই। কারণ তিনি আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র এবং সম্মানিত ব্যক্তি, তিনি আমাদের এখানে অনেকদিন সভাপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন। তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এখানে সভাপতি ছিলেন। কিন্তু যাঁর বিষয়ে বলা হচ্ছে তাঁর কথা বলাই যুক্তিসংগত বলে আমার মতো সীমিত জ্ঞানের মানুষের মনে হয়েছে।

আরো দু-একবার বা তারচেয়ে কিছু বেশি আগের প্রবীণ হিতৈষী পত্রিকায় আতিকুর রহমান একটা লেখায় লিখেছিলেন, ‘প্রবীণ হিতৈষীর যাত্রা শুরু হয়েছিল কতিপয় ভদ্রলোকের সমবেত চেষ্টায়’ – কথাটা একেবারেই সঠিক নয়। শুরুটা হয়েছিল নিতান্তই এককভাবে ডা. একেএম আবদুল ওয়াহেদের আন্তরিক প্রচেষ্টায়। বরং এই চেষ্টায় কতিপয় ভদ্রলোকের ঠাট্টা-বিদ্রম্নপ এবং তাঁকে নিরুৎসাহিত করার প্রচেষ্টায় তিনি খুবই মর্মাহত এবং ব্যথিত হন। তাঁরা সবাই শ্রদ্ধেয় মানুষ কিন্তু আমার বাবার এই কাজে সহায়তার বদলে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে বলতেন, ‘ডাক্তার সাহেব, আপনি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছেন। আপনার মাথা খারাপ হয়েছে।’ মাঝে মাঝে খুবই মন খারাপ করতেন। বলতেন, ‘আমি কি সত্যিই ভুল করছি?’ কিন্তু ভেঙে পড়তেন না। আবার নব উদ্যমে কাজ করতেন। বলতেন, ‘আমি হয়তো দেখব না, কিন্তু এর ফল মানুষ ইনশাআল্লাহ একদিন পাবেই।’

তখন আমাদের ধানমন্ডির পাড়া শহরের এক প্রান্তে ছিল। লোকজনের যাতায়াত বলতে গেলে ছিলই না। কদাচিৎ একটা রিকশা দেখা যেত। তখনকার মিরপুর রোড লাল কাঁকরের সরু রাস্তা ছিল। আমাদের বাড়ি থেকে রাস্তা দেখা যেত। কারণ আশেপাশে কোনো বাড়িঘর ছিল না। সৈয়দ ইত্তেহাদ আলীর বাড়ি মিরপুর রোডের ওপারে ৬নং রোডের মাথায় সোজাসুজি দেখা যেত। তবে ওঁদের বাড়ি আমাদের অনেক পরে হয়েছে। প্রধানত ধানক্ষেত থাকায় বড় বড় গাছপালা বেশি তো ছিলই না বলা যায়। গাছপালা ছিল শুধু ৭নং রোডের একটু আগে থেকে অনেকখানি জায়গায়। সাধনা ঔষধালয়ের নানারকম বড় বড় গাছের বাগান ছিল। শুনেছিলাম সেখানে নাকি পারিজাত গাছ ছিল। তাঁর অসিত্মত্ব হয়তো-বা এখনো এমদাদ আলী সাহেবের বাগানে আছে। এখনো (২০০৮ সাল) ওঁদের বাড়িটা আগের মতোই আছে। আমরা ওপাড়ায় বসবাস করতে যাই ১৯৫৪ সালের ১৩ই ফেব্রম্নয়ারি। আমাদের বাড়িটা ছিল ও-পাড়ার তৃতীয় বাড়ি। আমাদের বাড়ির বাইরে তখন ভারা বেঁধে পস্নাস্টার লাগানো হচ্ছে।  ভেতরে পস্নাস্টার এবং রং হয়ে গিয়েছিল। বাসযোগ্য হয়েছিল। তখনো পাড়ায় বিদ্যুৎ আসেনি। হারিকেন, লণ্ঠন জ্বালাতে হতো। সন্ধ্যার পরে শেয়াল ডাকত। সন্ধ্যার পরে মিস্ত্রিরা গলা ছেড়ে গান করত। তখন কিন্তু কোনো ভয় লাগত না। রাস্তায় দিনে রিকশা চলাচল ছিলই না বলতে গেলে। রাতে তো আরো সুনসান। চারিদিকে অন্ধকার নিস্তব্ধ। সন্ধ্যা হলে ঝিঁঝি পোকার ডাক, শেয়ালের ডাক শোনা যেত। আমাদের ওইসব জায়গায় আগে ধানক্ষেত ছিল। মনে হয় তাই নাম হয়েছে ধানমন্ডি। রিকশাওয়ালারা আসতে চাইত না,  ফেরার পথে কোনো যাত্রী পাবে না বলে।

 

মা-হারা

আজ ৫.৪.২০০৯ ভোরে সবু (লাল বিবি আপার মেয়ে) ফোন করে খবর দিলো ‘রোজী খালা, মা নেই।’ আজ ওদের মা চলে গেল। এই যে মা না থাকা, এ যে কত বড় না থাকা তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সারা আকাশ আর পৃথিবী ভরে শুধু নাই, নাই। যখন ওঁর লাশ নিয়ে যাচ্ছিল তখন সবু ও সোরাই ওঁর কফিনের পায়ের দিকে লম্বা কাপড়টা ধরে রেখেছিল। বিলাপ করে কাঁদেনি, নিঃশব্দে হাহাকারে মাকে শেষবিদায়  দিলো। এত করুণ এ দৃশ্য যে, চোখের পানি আটকানো যায় না। আরো কিছুক্ষণ বসে আমি চলে এলাম। বাড়ি পৌঁছাতে দেড় ঘণ্টা লেগেছে। মা না থাকা যে কী জিনিস তা যাদের মা নেই তারাই সে-কথা জানে।

কদিন আগে প্রিন্স উইলিয়াম তার মা প্রিন্সেস ডায়ানার জন্য যে-অনুভূতি ব্যক্ত করেছিলেন, তা পড়ে মনে হলো, সে আর আমি একই পর্যায়ে আছি। ওর এখন বয়স কম, আমার বয়স এত বেশি তবু এই মা না থাকার দুঃখের না আছে কোনো ভাষা, না আছে কোনো সান্তবনা, এ এক অসীম অনন্ত ‘না’ – এই ‘না’র ব্যাপ্তি পৃথিবীর মাটি থেকে আকাশ, দিগন্তবিসত্মৃত চরাচর – সবখানে না, না, নেই, নেই।

ছোটবেলায় ঘুরেফিরে কেবলি আমার মনে হতো সবার মা আছে। শুধু আমাদের কেন নেই? সারাজীবনে এই কেন-র কোনো উত্তর খুঁজে পাইনি। আজো মনটা হাহাকার করে।

আমরা বাবুর সঙ্গে কলকাতায় ২৮/৮ লাইব্রেরি রোডে, কালীঘাটে থাকতাম। বাড়িতে কাজের লোক, বাবুর্চি সবই ছিল, কিন্তু মা না থাকার কী যে এক ভাষাহীন কষ্ট সেই সময়কার শিশুমন জুড়ে ছিল তা প্রকাশ করার ভাষা আজো জানা নেই। ছোটবেলায় খুব আদরেই মানুষ হয়েছি। হয়তো আদরের মাত্রাটা অতিরিক্তই ছিল।

একদিনের কথা মনে পড়ে, পাড়ার লন্ডন মিশনারি স্কুলে পড়তাম আমি আর ছোট্ট। অনেকদিন পর যেদিন প্রথম স্কুলে গেলাম দুজন দিদিমণি গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমাদের অপেক্ষায়। স্কুলের ঝি মোক্ষদা আমাদের আনতে গিয়েছিল। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওনারা বললেন, ‘তোমাদের মা মারা গেছে তা তো জানি না।’ ওই যে ওনারা ‘তোমাদের মা মারা গেছেন’ বললেন, ব্যস হয়ে গেল।

এই মা নেই, মা না থাকা, এই যে বিরাট ‘না’। এই ‘না’টাকে জীবনের সেই শিশুকালের ঊষালগ্ন থেকে কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারিনি। এখন এই শেষ বয়সে এসেও সেই ‘না’কে মেনে নিতে পারিনি। চিরকাল মনটা খাঁ খাঁ-ই রয়ে গেল।

বশিরহাটের বাড়িতে  মাঝে মাঝে দাদি-দাদা আসতেন, নিচের তলার তিনটা ঘর নিয়ে দারোগা সাহেব থাকতেন ছেলেদের নিয়ে। বাবু কোথাও রোগী দেখতে গেলে আমাদের চারজনকে গাড়িতে করে নিয়ে যেতেন। আমরা গাড়ির মধ্যে বসে থাকতাম।

এমনি এক বসে থাকার সময়ে কোন জায়গা, কোন এলাকা কিছু জানি না – তখন অত চিনতামও না – হঠাৎ দারোগা সাহেব আমাদের গাড়ির কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের মা মারা গেছেন? কতদিন হলো?’ ইত্যাদি। বড়পা কি উত্তর দিয়েছিল কিছু মনে নেই। শুধু মনে আছে তারপর আমরা চারজন কেউ কারো সঙ্গে কথা বলিনি, চুপ করে বসেছিলাম। বাবু ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের কী হয়েছে?’ আমরা বলেছি, কিছু হয়নি। বাবু আমাদের কোথায় যেন নিয়ে আমের জুস খাওয়ালেন।

একদিন শরবত খাওয়ানোয় আমার লোভ বেড়ে গেল। তারপর যেদিন আবার কোনো রোগীর বাড়ির সামনে গাড়িতে বসেছিলাম, সেদিন বাবু আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ইতস্তত করে বলেই ফেললাম, ‘আমাদের খিদে পেয়েছে,’ মনে মনে শরবত খাওয়ার লোভ। কিন্তু বাবু তখন বললেন, ‘চলো, বাড়ি গিয়ে ভাত খাবে।’ তারপর থেকে কোনোদিন ওই আবদার করিনি।

প্রায় রোববারে বাবু আমাদের সেজো খালার বাড়িতে রেখে নিজের  কাজে যেতেন, আমরা সারাদিন খেলা করে, গল্প করে সময় কাটাতাম। ভালোই লাগত। যত দেরিই হোক, বাবু কিন্তু আমাদের রাত্রে নিয়ে যেতেন। কদাচিৎ রাত্রে থাকতে দিতেন। মাঝেমধ্যে তুলনবু, রুবীরাও আমাদের বাড়িতে থাকতে আসত।

ছোটবেলায় বোধহয় স্কুলের গেটে দিদিমণিদের সঙ্গে কথা হওয়ার পর কোনো সময়ে আমি আর ছোট্ট বাবুর কাছে নাকি বলেছিলাম, আমরা আর স্কুলে যাবো না। আবদারের ঠেলায় আমাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। বাবু আমাদের নিয়ে পাড়ার লাইব্রেরি মনোহরপুকুর দেশবন্ধু পাঠাগারের মেম্বার করে দিলেন। সেই শুরু, লেখাপড়া নেই, সারাদিন দুষ্টুমি বিকেলে কালীঘাট পার্কে যাওয়া, ছোটাছুটি, দোলনা চড়া আর বাদবাকি সময়ে গল্পের বই পড়া। গল্পের বই পড়াটা নেশার মতো ব্যাপার ছিল।

পার্কে আমাদের অনেক মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো। তার মধ্যে সবিতা মুখার্জীর সঙ্গে আমার খুবই ঘনিষ্ঠতা হলো। সে প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসত। আমিও মাঝে মাঝে ওদের বাড়িতে গেছি। ওরা থাকত ১০/এ রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে ওর দাদামশায়ের বাড়িতে। ওর বাবা বিলেতফেরত ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তিনি মালয়েশিয়ার পেনাং না কোথায় থাকতেন, তাঁকে কখনো দেখিনি। ওরা তিন বোন। বীণাদি, কৃষ্ণাদি আর সবিতা। আর ছোট এক ভাই সমীর। ওর ছোট মাসি লরেটো হাউস কলেজে বাংলা পড়াতেন। একটু পাগলাটে ধরনের ছিলেন। রসা রোড পার হয়ে ওদের বাড়ি যেতে হতো।

বৃষ্টি হলে ছাদে গিয়ে ভেজার আনন্দ খুব বেশি উপভোগ করতে পারতাম না কালীঘাট স্টোরের মেজদার জ্বালায়। আমাদের দেখতে পেলে দূর থেকে শাসাতেন, ইশারায় বাবুকে বলে দেওয়ার ভয় দেখাতেন। তখন দেখতাম এবং এখনো মনে হলে অবাক লাগে মিয়া চাচিরা পাশের বাড়িতে থেকে কোনোদিন আমাদের দিকে খেয়াল করতেন না। মা-হারা চারটে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে কীভাবে থাকে, কী খায়, কী করে, সে ব্যাপারে কোনোই খোঁজখবর রাখতেন না। অন্তত দাদি যখন থাকতেন না, সে সময়েও খেয়াল করতে পারতেন। কিন্তু কখনো করেননি।

 

যুদ্ধ

ছোটবেলায় আমার দেখা বিপর্যয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। সাইরেন বাজা এবং অল ক্লিয়ার সাইরেন বাজাটা বেশ মনে পড়ে। আমাদের ওপর-নিচ মিলিয়ে বাড়িতে আটটা ঘর। নিচের তলার পেছনের ঘরে একটা এয়ার রেড শেলটার বানানো হয়েছিল। তাছাড়া বস্ন্যাক আউট হতো বলে সমস্ত ঘরের আলোয় বড় বড় কালো সরু শেড বানিয়ে বাল্বে পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল যাতে কোনোদিক দিয়ে বাইরে আলো দেখা না যায়। সাইরেন বাজলেই আমরা মহা উৎসাহে নিচের ঘরে নেমে যেতাম। ওই ঘরেই আমাদের যত দুষ্টুমির আয়োজন। আমি আর ছোট্ট, ভাইয়ার তদারকিতে মার্চ করা শিখি। হাত-পা বাঁকা হলে বা কোনো ভুল-ত্রম্নটি হলে দস্ত্তরমতো ভাইয়ার কাছে মার খেতে হতো। ছোট ছোট সাবানের বাক্সে লাল ক্রস দিয়ে ফার্স্ট এইডের বাক্স তৈরি হলো তিনটা। আমি, ছোট্ট আর ভাইয়ার নিজের। অল ক্লিয়ার সাইরেন বাজলেই নিচের ঘর থেকে বেরিয়ে সারা বাড়ির আনাচে-কানাচে, বাড়ির ছাদ পর্যন্ত ভাইয়ার পেছন পেছন মার্চ করে দেখতে হতো কেউ আহত হয়েছে কি না। এই ছিল আমাদের যুদ্ধদিনের খেলা।

বিকেলে মিয়া চাচার বাড়ি থেকে তারাভাই, রাঙাভাই, হীরা, চাম্পা আসত আমাদের সঙ্গে খেলতে। সেও যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা। আমাকে করা হতো নার্স। ছোট্ট আর চাম্পাও খেলায় থাকত, তবে খুব একটা পাত্তা পেত না।

দাদা-দাদি না থাকলে যখন দিনের বেলায় জাপানি বোমারু বিমান আসত তখন আমরা মহা উৎসাহে ছাদের ওপরে উঠে যেতুম দেখার জন্য। সাইরেন বাজা সত্ত্বেও নিচের ঘরে না গিয়ে ছাদে উঠে যেতাম। একটু দূরের কালীঘাট স্টোরের মেজদা আমাদের হাত নেড়ে নেড়ে নিচে যেতে বলতেন। এসব ব্যাপার দাদা-দাদি না থাকার সময়ে। সে সময়ে বোধহয় দাদা-দাদি বশিরহাটে ছিলেন। বাবু আমাদের দুই মাসের জন্য বশিরহাটে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই দুটি মাস আমাদের যত রকমের দুষ্টুমি আর আবদারে ভরা দিনগুলোর কথা এখনো মনে পড়ে এবং খুবই ভালো লাগে। বড়পা শান্ত-শিষ্ট দাদার লাইব্রেরির রাজত্বে একমাত্র রাজকন্যার মতো বিরাজ করতেন। যখন খুশি দাদার লাইব্রেরিতে যাওয়ার অধিকার শুধু বড়পারই ছিল। বিকেলে সাধারণ লোকের জন্য লাইব্রেরি খোলা থাকত। বাবু মাঝে মাঝে শনিবারের ছুটিতে আসতেন। বাবু বশিরহাটে আসা মানে সারাপাড়ায় সাড়া পড়ে যেত। দাদির রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়ার ধুম। লোকজনের আসা-যাওয়ায় বাড়ি গমগম করত। আর দূরদূরান্ত থেকে রোগীর আনাগোনার কমতি ছিল না। বাবু অসীম ধৈর্য নিয়ে রোগী দেখতেন, ব্যবস্থাপত্র দিতেন। কাউকে ফিরিয়ে দিতেন না। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাইকে দেখতেন। সবাই বলত, আবু মিয়া এসেছে। কেউ কেউ বলত আবু ডাক্তার।

আমার নানির বাড়ি ছিল মাত্র এক মাইল দূরে অন্য পাড়ায়। সেখানেও আমাদের আদরের কমতি ছিল না। যেহেতু আমার মা নেই। বাবু যেতেন নানির সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু আমার মায়ের মৃত্যুর পর সেখানে কখনো থাকেননি। দাদি জোর করে পাঠাতেন। তবে সেখানে কেউ অসুস্থ থাকলে ইচ্ছা করেই যেতেন, তখন বলতে হতো না।

বশিরহাটে সেই দুই মাস থাকার সময়ে বেশি দুষ্টুমি আর উপদ্রব করলে দাদি দু-একবার বলতেন, ‘দাঁড়া, বাবু আসুক সব বলে দেবো।’ ওটাই ছিল আমাদের ওষুধ। একদিন-দুদিন ভালো মানুষ, তারপর আবার সেই দস্যিপনা। গাছে চড়া, দৌড়-ঝাঁপ আর পুকুরে দাপাদাপি করে পুকুরের পানি ঘোলা করা। বড়পাকে আমরা সবাই ভয় করতাম আর মান্য করতাম। দাদি মাঝে মাঝে আমাদের জ্বালাতনে অতিষ্ঠ হয়ে বড়পাকে নালিশ করে বলতেন, ‘বল, ওদের একটু দুষ্টুমি না করতে।’ বড়পা আমাদের শাসিত্ম দিতেন দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা। দুষ্টুমির মাত্রাভেদে শাসিত্মর সময় ঠিক করা হতো। তাতেই আমরা জব্দ হতাম।

এই যুদ্ধের সময়েই দেখেছিলাম দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া। রাস্তায় রাস্তায় মানুষ ‘ফেন দাও ফেন দাও’ বলে কাতরাচ্ছে।

 

দাঙ্গা

জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে দেখি, মনের পর্দায় একে একে সবই ভেসে ওঠে। মনে পড়ে সেই ১৬ই আগস্ট ১৯৪৬-এর বিকেলে বাবু আমাকে ময়দানে নিয়ে গিয়েছিলেন মুসলিম লীগের জনসভায়। সেখানে মেডিক্যাল টিমের একটা জায়গা ছিল। ছোট্ট ছিল না, ও বোধহয় সেজো খালার বাড়িতে পার্ক সার্কাসে ছিল। আমাকে বাবু দুপুরে বাড়ি ফিরে বললেন, ‘মিটিংয়ে যাবে? তোমাকে নিয়ে যাই চলো। তখন আমার শাড়ি পরার বয়স ছিল না এবং আমার শাড়ি ছিল না। বড়পা স্কুলে, সেই সুযোগে তার ড্রয়ার থেকে নিজের পছন্দের একটা শাড়ি বের করে পরেছিলাম। ভালো করে শাড়ি পরতে জানি না, তবু যাই হোক করে পরে গিয়েছিলাম।

গাড়ি থেকে নেমে অনেকখানি হাঁটতে হয়েছিল। তখন আমার হাঁটতে খুবই কষ্ট আর অস্বসিত্ম হচ্ছিল। মনে মনে পস্তাচ্ছিলাম ফ্রক পরে আসিনি বলে। কী হলো না হলো কিছু বুঝতে পারলাম না। দলে দলে যখন লোকজন বেরিয়ে আসছে, তখন বাবু আমার হাত ধরে নিয়ে এলেন গাড়ির কাছে। তারপর আমরা বাড়ি ফিরে এলাম। এসে দেখি পাড়ায় কেমন যেন একটা থমথমে ভাব, সব সময়ের মতো নয়।

কালীঘাট ছিল হিন্দুপাড়া। আমাদের বাড়ির সামনের গোলাপি রঙের বাড়িটার পাশে একটা বড় কাঠের আড়ত ছিল। তারপর বিরাট বসিত্ম, খোলার ছাদওয়ালা। নাম ছিল সাহেববাগান বসিত্ম। সেখানে মুসলমান ছাড়াও নিম্নশ্রেণির হিন্দু, খোট্টা, বিহারি, সব জাতের দরিদ্র লোকেরা থাকত। সব জাতের লোকের সহাবস্থান ছিল। মাঝে মাঝে খুব ঝগড়ার আওয়াজ পাওয়া যেত। কিন্তু সবার সঙ্গে সবার সদ্ভাব ছিল।

আমাদের উঠানের দেয়ালের বাইরে করপোরেশনের কল ছিল। হিন্দ-মুসলমান পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পানি নিত, গোসল করত সকালে যে যার কাজে যাওয়ার আগে। অনেক ফকিরও থাকত। মাজা, ঘষা, কাপড় কাচা ইত্যাদি কাজ করত। তবে মুসলমান মহিলারা রাস্তায় খোলা জায়গায় গোসল করত না। বালতি করে পানি নিয়ে যেত, হয়তো ঘরের মধ্যেই কোনোমতে গোসল করত। আমি বারান্দায় থামের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের প্রাত্যহিক কাজ দেখতাম। সেদিন বিকেলে যেন কেমন একটা অন্যরকম। রাস্তায় লোকজন কম। পরে আমার চাচার কাছে শুনেছিলাম, যখন বসিত্মর মুসলমান লোকেরা কমবয়সী, মধ্যবয়সী, শক্ত-সমর্থ লোকেরা গড়ের মাঠের সেই সভায় গিয়েছিল তখন শুধু অশক্ত বৃদ্ধ লোকেরা এবং মহিলারা ছিলেন। তাদেরকে হিন্দু গু-ারা খুব মারধর করেছিল এবং আগুনও লাগিয়ে ছিল। তবে তা বাড়তে পারেনি নিম্নবর্ণের হিন্দু ও অন্য জাতের লোকের মধ্যস্থতায়। তবু বসিত্ম থেকে পালিয়ে অনেক মুসলমান কালীঘাট পার্কের কাছে টিপু সুলতান মসজিদের মধ্যে ছিল। তারপর কী হলো জানা নেই। চারদিক থেকে কতরকম কথা, কতরকম গুজব শোনা যেতে লাগল।

হিন্দুপাড়ায় মুসলমানদের এবং মুসলমানপাড়ায় হিন্দুদের ওপর দাঙ্গার খবর শোনা যেতে লাগল। বাবু মেডিক্যাল কলেজ থেকে ফিরে বললেন, ‘হাসপাতালে অনেক আহত লোক এসেছে বিভিন্ন পাড়া থেকে।’ যদিও বয়স অল্প ছিল, তখনকার যে অনুভূতি বলে বোঝাতে পারব না। ভয়ের সঙ্গে যেন কেমন একটা অ্যাডভেঞ্চারের যোগ।

একদিন আমরা ওপরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, বাবু নিচে রোগী দেখার ঘরে আছেন, হয়তো পড়াশোনা করছিলেন। অনেক লোক ভিড় করে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ডাকছে, ‘ডাক্তার সাহেব বাইরে আসুন।’ তাদের হাতে লাঠিসোটা ছিল কি না মনে নেই। কিন্তু খুব জঙ্গি হাবভাব। হঠাৎ ভিড় ঠেলে একটি ছেলে এগিয়ে এসে গেটে ঢুকে বাবুর সামনে দাঁড়িয়ে দু-হাত দিয়ে তাঁকে ঢেকে বলল, ‘মাস্টারমশায়ের কাছে আসার আগে আমাকে মেরে তারপর যেতে হবে।’ লোকেরা আসেত্ম আসেত্ম সরে গেল। ছেলেটা অনেকটা দেখিয়েই তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। এমনিতেও বাবুর ছাত্ররা সবাই তাঁকে খুব শ্রদ্ধা করত। অনেকে তাঁর কাছে পড়তে আসত এবং তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে যত্ন করে পড়াতেন। বলা বোধহয় বাহুল্য হবে না যে, এই পড়ানো কোনো পারিশ্রমিকের পরিবর্তে নয়, যে ব্যাপারটা আজকালকার দিনে স্বপ্নেরও অতীত।

তারপরই পাড়ার বখাটে যে ছেলেগুলো শুধু হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়িয়ে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাত তারাই হঠাৎ বলে গেল যে, ‘আজ রাত্রে আপনারা বাড়িতে থাকবেন না। দুই ট্রাক শিখ ছোরা আর লাঠিসোটা নিয়ে আপনাদের এখানে আক্রমণ করতে আসবে। আপনারা খবরদার বাড়িতে থাকবেন না।’ পাড়ার হিন্দু বাসিন্দারাও বলেছিল, রাত্রে বাড়িতে না থেকে আপনাদের দুই বাড়ির সবাই কয়েকজন করে ভাগ করে তাঁদের সবার বাড়িতে ভাগ করে থাকতে। আমরা সেভাবেই সামনে অলকাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তাঁরা ছিলেন গোঁড়া হিন্দু। আমাদের সেই রাতে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তবে সিঁড়ির নিচে যেখানে পানির চৌবাচ্চা ছিল সেখানে আমরা ছিলাম – দাদি, বড় ফুপু, বড়পা, আমি আর বোধহয় ভাইয়া। সারারাত আমরা ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম পানির ওপর। কারণ চৌবাচ্চা ছাপিয়ে অনবরত পানি পড়ে জায়গাটা পানিভরা ছিল। যাই হোক, তবু থাকতে দিয়েছিল বলে আমরা তাদের ধন্যবাদ দিয়ে যেই সকাল হলো বাড়িতে চলে এসেছিলাম। আমরা বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই জায়গা গোবর, গঙ্গাজল দিয়ে পবিত্র করা হয়েছিল।

গলির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। আমি তরতর করে পাঁচিলে উঠে ওদিকে গিয়ে লাফিয়ে নেমে দরজা খুলে দিলাম, সবাই ঢুকল। ঢোকার পর দেখা গেল ভেতরে মাথায় কোপ খাওয়া এক লোক ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিল। বাবু লোকটাকে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন, আমি সাহায্য করলাম। তারপর তাকে বোধহয় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। তার পরিবার-পরিজন কোথায় কিছুই জানে না। আহত হয়েও হিন্দুদের হাত থেকে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে এখানে এসে ঢুকেছে।

এ-ঘটনার কয়েকদিন পর এক সকালে মিয়া চাচার (উনি তখন Retired Commissioner of Police) চেনা পুলিশের লোক একটা জিপ গাড়িতে এলেন। সঙ্গে একটা না দুটো ট্রাক, সঙ্গে আমাদের গাড়ি। তিনি খোলা রিভলবার নিয়ে বসে রইলেন। মিয়া চাচাকে বললেন, ‘স্যার আপনারা ৫ মিনিটের মধ্যে সবাই চলে আসুন।’ আমার মনে আছে আমি আমাদের পারিবারিক অ্যালবামটা শুধু নিয়েছিলাম। আর কে কী নিয়েছিল, মনে নেই। আমরা সবাই ট্রাক আর জিপে উঠলাম। দাদি, বড় ফুপু, মিয়া চাচিরা যাঁরা বয়স্ক এবং পর্দানশিন তাঁরা আমাদের গাড়িতে।

এভাবেই আমরা কালীঘাটের নিজেদের বাড়ি ছেড়ে পার্ক সার্কাসের দিলখুশা স্ট্রিটে সেজো খালাদের বাড়িতে এসে উঠলাম, মিয়া চাচারা চাচির কোনো আত্মীয়দের বাসায় গেলেন। সেই আমাদের নিজেদের বাড়িছাড়া চিরদিনের মতো। কয়েকদিন পর আমরা পার্ক সার্কাসের বালুহক্কাক লেনের একটা বাড়িতে উঠলাম। এই বাড়িতে যাঁরা ছিলেন তাঁরা যদিও খ্রিষ্টান, তবে বোধহয় ভয়ে মুসলমানপাড়ায় থাকতে চাননি। মিয়া চাচারা রাস্তার ওপারে, আমরা এপারে। তাঁদের বাড়িটাও বাঙালি খ্রিষ্টানদের ছিল। আমরা পার্ক সার্কাসের মুসলমানপাড়াতেই থাকতে লাগলাম। এখানে আমাদের ভালো লাগত না। যদিও আমরা এ-বাড়ি ও-বাড়ি দরকার মতো গেছি, এখানে মেয়েদের রাস্তায় বেরোতে বা দোকানে যেতে দেখিনি। এ-সময়ে আমরা লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের রিলিফ সেন্টারে কাজ করেছি। সেখানেই হয়েছিল আমার সমাজসেবার হাতেখড়ি। বাবু সে-সময়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রফেসর অফ ক্লিনিকাল সার্জারি।

 

দেশভাগ

১৯৪৬ সালে কলকাতায় ভয়াবহতম দাঙ্গা হয়। এক বছর পর দেশবিভাগ এবং আমাদের দেশত্যাগ। চোদ্দপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে ঢাকায় চলে আসা, তখন কিন্তু তার মর্ম বুঝিনি। চলে আসার দিনের কথা পরিষ্কার মনে আছে। কী যে খুশি লাগছিল! ট্রেনে চড়ে যাব, খুব একটা অ্যাভেঞ্চারের অনুভূতি। রেলগাড়ি চড়ে অনেকদূর যাওয়ার পর আবার জাহাজে চড়া, কী আনন্দ!

আমরা দেশভাগের দুদিন আগে ঢাকায় পৌঁছাই। ১৪ই আগস্ট ১৯৪৭-এ স্বাধীন পাকিস্তানের জন্ম হলো। চারিদিকে হইচই, উল্লাস, বাজি পোড়ানো এখনো মনে পড়ে। তখন আমরা কয়েকদিন নারায়ণগঞ্জে বিবিবুদের বাড়িতে ছিলুম। তখনো বাবু ঢাকায় সরকারি বাড়ি পাননি। আমরা কলকাতায় থাকাকালীন বড় ফুপু হুগলিতে ফিরে যান। বাবু ঢাকার পুরানা পল্টনের ১১ নম্বর বাড়ি ‘পরম ভবনে’র দোতলা পেলেন। নিচতলায় ডাক্তার আবদুর রহমান থাকতেন। উনি ছিলেন অ্যানটমির প্রফেসর। পাশের বাড়িতে ডা. আনোয়ার আলী এলেন। একটু দূরে ডা. রেফাতউল্লাহ থাকতেন। ডা. ওয়াহেদুদ্দিন, ডা. শামসুদ্দীন – বলতে গেলে ডাক্তারপাড়া। সবার সঙ্গেই সবার
যাওয়া-আসা ছিল। খুবই হৃদ্যতা ছিল। আমাদের পেছন দিকের কোনাকুনি বাড়িটাই আলী রেজা সাহেবরা থাকতেন। নবী সাহেব থাকতেন তাঁদের পাশে। আরো একটু উত্তর দিকে ময়না-বুলবুল আপাদের ভাই খাবেতুর রহমান ভাইরা সপরিবারে থাকতেন। তারপরের বাড়িটা ছিল বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরীর। এঁরা সবাই আমার বাবার রোগী ছিলেন অনেকদিন থেকেই। পাড়ায় আমার দাদি ছিলেন সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠা।

কলকাতায় পার্ক সার্কাসে থাকতে ভাইজানের তাগিদে বাবু আমার জন্য প্রাইভেট টিউটর রেখেছিলেন। শামসুল আলেম সাহেব। তিনি কলকাতায় হেয়ার স্কুলে পড়াতেন। দেশবিভাগের পর তিনিও ঢাকা চলে আসেন। তিনি সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে পড়াতেন, থাকতেন আমাদের কাছাকাছি পাড়া শান্তিনগরে।

এখানে ভাইজানের পরিচয় দিয়ে রাখি। তাঁর নাম জয়নাল আবেদীন। তিনি কলকাতা বেতারে চাকরি করতেন। তখনকার দিনে হিন্দুদের আধিপত্য সবখানেই ছিল। মুষ্টিমেয় যে-কজন মুসলমান কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপরের দিকে উঠেছিলেন, তা শুধু তাঁদের মেধা এবং গুণের জন্য। ভাইজান বাবুর বিশেষ বন্ধু ছিলেন, যদিও বয়সে তাঁর চেয়ে অনেক ছোট ছিলেন। বাবু ডাকতেন আবেদীন সাহেব। তাঁর সঙ্গে কখন কীভাবে আলাপ-পরিচয় হয়েছিল, তা আমার জানা নেই।

বাবুর যত বন্ধু-বান্ধব বা হিতৈষী যাঁদের সঙ্গে আজ পর্যন্ত আমাদের যোগাযোগ আপন আত্মীয়দের মতো বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি তাঁদের সবাই কোনো না কোনোভাবে কিংবা কোনো না কোনো সময়ে রোগী বা রোগ সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে।

ভাইজান ঢাকায় এসে কয়েকদিন আমাদের পুরানা পল্টনের বাসায় উঠেছিলেন। তারপর ৩ নম্বর পুরানা পল্টনে উঠলেন। তাঁর স্ত্রী নুরু এবং স্ত্রীর বড় ভাই টুনু তাঁর সঙ্গে থাকতেন। ওঁদের আর এক কাজিন ইব্রাহীম ভাইও থাকতেন। ভাইজানের বাড়িতে আমরা প্রায়ই বেড়াতে যেতাম। এই নুরুদের খালাত ভাই-বোন মাফিবু, মাক্কি এবং ওঁদের ভাইরাও ঢাকায় থাকতেন। মাক্কিরা থাকত শান্তিনগরে ‘বেলাকুটির’ নামে একটা বাড়িতে।

১৯৪৭ সালে বাবুরা ঢাকায় এসে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অংশ নিয়ে। নতুন কলেজ এবং হাসপাতাল, তাই কাজের মাত্রা বেড়ে গেল। প্রশিক্ষিত নার্স নেই। তার জন্য আলাদা সময় দিয়ে তাদের পড়ানো চলছে। তাদের শেখাবার জন্য যেসব নোট দিতেন সেগুলোই পরবর্তীকালে জড়ো করে চিকিৎসাবিজ্ঞান নামে একটা বই ছেপেছিল কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড। সেই বইয়ের এমন চাহিদা হলো যে, বাংলা একাডেমি সেই বই পুনর্মুদ্রণ করেছিল।

কলকাতায় থাকতেই মাস্টার সাহেবকে বাবু বলে দিয়েছিলেন, ‘She is my child। ওকে কোনো চাপ দেবেন না। ও যতটা পড়তে চায়, ততটাই পড়াবেন।’

ছোটবেলা থেকেই আমি একটু ভাবুক ধরনের ছিলাম, প্রকৃতির রূপ, রস, রং, গন্ধ আমাকে খুবই মুগ্ধ করত, নীল আকাশে সাদা মেঘের আনাগোনা, বসন্তে গাছে সবুজ নতুন পাতা, পাখিদের নানা সুরে ডাক, সন্ধ্যার অস্তমিত সূর্যের সোনালি আভা আমার কি যে ভালো লাগত! আমার মন তন্ময় হয়ে যেত। সেই ভালোলাগা প্রকাশ করার ভাষা আমার জানা নেই।

কলকাতায় যদিও বাড়িগুলো গায়ে গায়ে, গাছপালা কম, তবু তার মধ্যে কোকিলের মিষ্টি সুর আমাকে উন্মনা করে তুলত। পড়ার ফাঁকে তন্ময় হয়ে যেতাম। মাস্টার সাহেব জিজ্ঞেস করতেন, ‘মা, তোমার কী শরীর খারাপ লাগছে? আর পড়বে না?’ এভাবে কী আর লেখাপড়া হয়। পরিণতিতে যা হওয়ার তাই হলো। সারাজীবন গাধা হয়ে
থাকলাম। মানুষ হওয়া আর হলো না। জীবনে অনেক কিছু দেখেছি, অনেক ঠেকেছি, অনেক শিখেছি। তবু মনে হয় যেন অনেক দেখার বাকি আছে।

 

আবার দাঙ্গা

আমার নমামা সৈয়দ সুজাত আলী যেমন চেহারায় ছিলেন সাহেবদের মতো, তেমনি ছিলেন হইচই করা, প্রাণচঞ্চল এক ব্যক্তি। নমামা আমাদের যেমন ভালোবাসতেন, আমরা তাঁকে তেমনি ভালোবাসতাম। মামার আদর-আবদার আমরা তাঁর কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি পেয়েছিলাম। তারপর দাদামামা সৈয়দ আবদুর রাজ্জাকের।

আমার নমামা মাত্র ষোলো বছর বয়সে চেকোশেস্নাভিয়ায় বাটা কোম্পানির ট্রেনিংয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে কতদিনের জন্য গিয়েছিলেন এবং কবে দেশে ফিরেছিলেন তা আমার জানা নেই। আর হয়তো জানাও যাবে না।

যা-ই হোক, নমামা বাটা কোম্পানিতে চেক সাহেবের পরেই দুই নম্বরে ছিলেন। কত লোকের যে কত উপকার করেছেন চাকরি দিয়ে তার বুঝি কোনো ইয়ত্তা নেই। তখনকার দিনে মুসলমানদের চাকরি পাওয়া বড়ই দুষ্কর ছিল। কিন্তু বাটা কোম্পানিতে নমামা যত পেরেছিলেন মুসলমানদের ঢুকিয়ে ছিলেন। কলকাতার বালিগঞ্জ থেকে কয়েকটা স্টেশন পরে বজবজ বলে একটা জায়গা ছিল, সেখানেই বাটা কোম্পানির বাড়িঘর ছিল। ছোটবেলায় আমরা সেখানে গিয়েছি। ভারি সুন্দর সব বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। একেবারে বিদেশের মতো করে তৈরি ছিমছাম সুন্দর। বাংলাদেশে এখন যেখানে টঙ্গীর কাছে বাটার কোম্পানি আছে সেই জায়গা ১৯৪৭ সালে আমার নমামা ঢাকায় এসে নিজে পছন্দ করে ঠিক করে রেখেছিলেন বাটা কোম্পানির পক্ষে। হয়তো তাঁর অত নিষ্ঠুর মৃত্যু না হলে তিনি এখানে বাটার বড় সাহেব হতেন। সবই আল্লাহর ইচ্ছা।

১৯৫০ সালে যেদিন তাঁকে মেরা ফেলা হয়, সেদিন তাঁর জ্বর ছিল; কিন্তু তা সত্ত্বেও অফিসের কাজে কলকাতায় যেতে হয়েছিল। সন্ধ্যার সময়ে বাড়ি ফিরে ওপরে যেতে চাচ্ছিলেন ট্যাক্সি ভাড়া দেওয়ার জন্য। হয়তো তাঁর সঙ্গে টাকা ছিল না। সেই সময়ে তাঁর তিন-চারজন হিন্দু বন্ধু (সবাই তাঁর পরের অফিসার) তাঁকে ‘একটু এদিকে শুনে যাও’ বলে বাড়ির পেছনে অন্ধকারমতো জায়গায় নিয়ে গিয়ে ছুরিকাঘাত করে সবাই মিলে। তিনি আর ওপরে উঠতে পারেননি। যেদিন জুলিয়াস সিজার সিনেমাটা দেখেছিলাম, সেদিন শুধু আমার নমামার কথাই মনে হচ্ছিল। তখন তাঁর সবচেয়ে ছোট ছেলেটা মাত্র বিশ দিনের। তাঁর তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। যুঁথি, রেবা, বুলবুল, তোতন। আর ছোট মেয়েটির নাম বাটু। বাটানগরে জন্মেছে বলে। রেবার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। যুঁথি আপাতত কোথায় আছে জানি না। কিছুদিন আগেও ছেলের কাছে আমেরিকায় ছিল। বাটু থাকে রাজশাহীতে। তোতন বোধহয় খুলনায় থাকে আর বুলবুল ঢাকায়। মামি ইন্তেকাল করেছেন বেশ কয়েক বছর হয়েছে। রেবা দেখতে বেশ সুন্দর, কিন্তু বেশ মোটা হয়ে গেছে। ওর ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। শুনেছি নমামার মৃত্যুর খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাটানগর খালি করে সমস্ত মুসলমান পালিয়ে গিয়েছিল। তখন তাদেরকে যে যেখানে পেয়েছে মেরেছে। সেখান থেকে শুরু হয় হিন্দু-মুসলমানদের দাঙ্গা। যার জের কলকাতা ও আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে।

সেটা ১৯৫০ সালের দাঙ্গা। সে-সময়ে আমাদের যারা বশিরহাটে ছিলেন সবাই এক কাপড়ে, কেউ কেউ খলি পায়ে বনবাদাড়, জঙ্গল ভেঙে কবরস্থানে লুকিয়ে থেকে প্রাণ হাতে নিয়ে সাতক্ষীরা বর্ডার দিয়ে খুলনা পৌঁছোয়। আল্লাহর রহমতে আমার চাচারা এবং আমার নানিরা সবাই প্রাণে বেঁচেছিলেন। কিন্তু সেই যে বাড়িঘর ছেড়ে এলেন সেখানে আর ফিরে যেতে পারেননি। সবই বেদখল হয়ে যায়। জিনিসপত্র কিছু পাইনি। আমার দাদার এত বড় লাইব্রেরিটার একটা বইও পাওয়া যায়নি। সব গেল। চোদ্দপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে সব উদ্বাস্ত্ত হয়ে গেল। যাযাবর হয়ে গেল। আজ আমাদের কতজন, কতদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, কেউ কাউকে চেনে না, নিজেরাই হয়তো নিজেদের হদিস জানে না। এই পরিণতি যে কত করুণ, কত হৃদয়বিদারক, তা সে যাদের না হয়েছে তারা বুঝবে না।

 

মুক্তিযুদ্ধের সূচনা

আজ মনে পড়ছে ২৫শে মার্চ ১৯৭১-এর সেই বিভীষিকাময় রাত। আমরা তখন বার্মা ইস্টার্ন হাউসে থাকি। মিমি-শিরীন ছোট ছোট। বড়পা রাত নটার পরে আমাদের বাড়িতে এলো। ওদের নামিয়ে দিয়ে বাবুর গাড়ি ফিরে গেল।

সন্ধ্যায় তুলনবু টুটলাকে নিয়ে আঞ্জু ভাবির সঙ্গে আমাদের বাড়িতে এলেন। ওরা গুলশান থেকে আঞ্জু ভাবিদের গাড়িতে এসেছে। তুলনবু একটা খুব সুন্দর হলুদ রঙের শাড়ি পরেছিলেন। এত সুন্দর লাগছিল। তুলনবুর উদ্দেশ্য ছিল বড়পার সঙ্গে দেখা করা এবং মনের কথা বলা। বড়পার সঙ্গে তাঁর এত বন্ধুত্ব ছিল যে তা বলার নয়। বড়পারা হজ সেরে ঢাকায় ফিরেছেন ১৭ই মার্চ দুপুরে। তারপর বড়পারা চট্টগ্রাম গেল আমাদের শাশুড়ির সঙ্গে দেখা করতে। তারপর কবে ফিরেছিলেন তা মনে নেই। তবে বাবুর ওখানেই ছিল। ওইদিন রাতে বা সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে (পরীবাগ) আসার কথা, কয়েকদিন থাকবে বলে।

তুলনবু কেবলি ছটফট করছিলেন যে বড়পার সঙ্গে বোধহয় আর দেখা হবে না। আমি যতই বলি, আমি ফোন করি, বড়পা তাড়াতাড়ি এসে যাক, তাহলে আপনার সঙ্গে দেখা হবে, ততই উনি আমাকে আটকে দিয়েছেন। কিছুতেই ফোন করতে দিলেন না। বললেন, ‘এখন তো গুলশান থেকে চলে এসেছি, অন্য সময়ে এসে দেখা করা যাবে।’ তবু নানা কথার ফাঁকে ফাঁকে কয়েকবারই বললেন, ‘এ-জীবনে বোধহয় বড়পার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না।’ আর দেখাও হলো না। পরে গোলাগুলির তা-বের মধ্যে তুলনবু অনেক গুলি খেয়ে অনেক কষ্ট পেয়ে শেষ হয়ে যান। বেশ কয়েকদিন ভুগেছেন, ঠিক কোনদিন মারা গেলেন জানা যায়নি। সেই আমাদের শেষ দেখা, আর বড়পার সঙ্গে জীবনেও দেখা হলো না। এখানে বলে রাখি, জীবনে যাদের কাছে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা পেয়েছি তাদের মধ্যে তুলনবু একজন। এমন ভালো মানুষ, এমন মিষ্টি ব্যবহার, আর এমন ভালোবাসা খুব কম মানুষের কাছেই পেয়েছি। বাবু ও বড়পা ছাড়া এমন নিবিড় ভালোবাসা আমি আর কারো কাছে পাইনি।

রাত প্রায় ১০টার দিকে খসরু সাহেব আমাদের বাড়িতে এসে বললেন, আমি এয়ারপোর্টে সানতালকে (ওঁর বউ, ফরাসি মেয়ে) দিয়ে ফিরে আসার সময়ে দেখেছি রাস্তার অনেক জায়গা কেটে ব্যারিকেড দিয়েছে। আজ বোধহয় কিছু একটা হবে। বলা বাহুল্য, ৭ই মার্চের আগে থেকে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা খুবই গরম হয়ে উঠেছিল। তারপর শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের রমনার মাঠের বক্তৃতায় দেশ আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল।

১৯৬৯ সালের (তখন আমরা চট্টগ্রাম ছিলাম) আন্দোলন থেকেই শুরু। তারপর ক্রমশ আরো কত ঘটনা, কত কিছু – সেসবের ইতিহাস আমি কিছু কিছু জানি, তবে নিখুঁতভাবে কিছু মনে নেই। কারণ তখন আমি আমার বাচ্চাদের এবং ঘর-সংসার নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলাম। হরতালের এক-একদিন এক-এক বাড়িতে দুপুরের খাবার আয়োজন করা হতো। আমরা সেই দিনগুলো খুবই উপভোগ করেছি। দিনগুলো মোটামুটি ভালোই কেটে যাচ্ছিল। তখন আমাদের কুলশীর জমি কেনা হয়েছে।

১৯৭০ সালের মে মাসে এই বাড়ির কাজ শুরু হয়। মাত্র ছয় মাসে বাড়ি তৈরি হয়। ১৯৭০ সালের ২৫শে অক্টোবর আমরা ঢাকায় চলে আসি। কারণ তার কিছুদিন আগেই জামালউদ্দীন এই বাড়িতে মিলাদ দিয়ে চলে গেলেন বার্মা ইস্টার্নের ঢাকার ম্যানেজার হয়ে। এই বাড়ির মিলাদের সময়ে বাবু, ভাইয়া, ভাবি, প্রবাল ও পেপিদের নিয়ে এসেছিলেন। বাবু কিন্তু বাড়ির কাজ শুরু হওয়ার আগেও এসে এই জমির ওপর আসরের নামাজ পড়ে দোয়া করেছিলেন।
মিমি-শিরীন বালির মধ্যে কত খেলা করেছে। বাবু আমাকে বলেছিলেন, ‘কখনো মনে করবে না আমার বাড়ি। মনে করবে আল্লাহ দিয়েছেন এবং যতদিন তিনি থাকতে দেবেন ততদিনই থাকতে পারব।’ আমার শাশুড়িও অনেক দোয়া করেছিলেন। বড়পা, কামালভাই সবার দোয়ায় এই বাড়ি ‘রোজভেল’।

খসরু সাহেব উঠেছেন বার্মা ইস্টারের রেস্ট হাউসে, সেই রাতের পরে তাঁর সঙ্গে আমার আবার বহুদিন পর ১৯৭৯-তে বিলেতে দেখা হয়। উনি বেশ আগে থেকে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিলেন। বোধহয়, ১৯৭১-এর পর থেকে। আমরা লন্ডনে আছি শুনে নয়নের বাড়ি থেকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন এবং নিজের হাতে দেশি রান্না খাওয়ালেন। তারপর রাতে আবার আমাদের নয়নের বাড়িতে পৌঁছে দিলেন স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে।

২৫ মার্চ, রাত ১১টার দিকে প্রচ- শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। চারিদিকে বিকট গোলাগুলির শব্দ আর ঘরের মোটা পর্দা ভেদ করে আগুনের লাল আভা তার সঙ্গে অসহায় মানুষের মর্মান্তিক আর্তনাদে রাতের আকাশ ভারী হয়ে উঠেছে। আমাদের পাশের ঘরে মিমি-শিরীনের সঙ্গে বড়পা। সবাই মধ্যের ঘরে একসঙ্গে জড়ো হয়ে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম। সেই মহাদুর্যোগের মধ্যে মিমি বোধহয় হেসেছিল তখন আমার ছোট্ট শিরীন বলেছিল, ‘হাসছ?’ একটা করে গুলি হচ্ছে আর একটা করে মানুষ মারা যাচ্ছে। বাকি রাত আমরা শুয়ে কাটালেও কেউ ঘুমাতে পারিনি। গোলাগুলির শব্দে আর বুকফাটা কান্না-হাহাকারে কান পাতা যাচ্ছিল না। বারান্দায় বের হওয়ারও সাহস হচ্ছিল না। কারণ কোথায় মিলিটারি ওত পেতে আছে কেউ জানে না। রাত থেকেই পরদিন সারাদিন কারফিউ জারি হয়েছিল। রেডিওতে যা কিছু শোনা গেল। এ-ঘটনার বেশ কিছুদিন আগে আমাদের বাড়িতে একটা বুড়ি আসত ছাগল নিয়ে। কিছু চাইত না, কিছু বলত না, বাগানে ঢুকে ঘুরে-টুরে আমাদের বাড়ির পেছনে সার্ভেন্ট কোয়ার্টারের দিকে
ঘুরে-ফিরে চলে যেত। মিমি-শিরীন বাগানে থাকলে ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যেত। একদিন আমি আর জামালউদ্দীন বাগানে চেয়ার পেতে বসেছিলাম। এমন সময়ে আমাদের পাশ দিয়ে যখন সে যাচ্ছে তখন জামালউদ্দীন জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি হাত দেখতে জানো?’ সে কিছু জবাব দিলো না। কেবল বলল, ‘অনেক বিপদ, অনেক রক্ত, অনেক মানুষ মরবে।’ তার কথা যে এভাবে ফলবে তা তখন কে জানত? যাই হোক, পরে আর কোনোদিন তাকে দেখা যায়নি। তখন আমাদের বাড়িতে তারা মিয়া বলে একটা ছোট ছেলে থাকত। সে নিচের ড্রইংরুমে ঘুমাত। সে রাতে ওইসব গোলাগুলির সময়ে ভয় পেয়ে একটা চেয়ারের তলায় বসেছিল। কয়েকজন মিলিটারি এসে দরজায় ধাক্কা দিয়ে, কাচের দরজার ভেতরে টর্চ ফেলে দেখে পরে দরজায় লাথি মেরে চলে গেছে। কাচের দরজা যে তাদের লাথিতে ভেঙে যায়নি, তাতে আল্লাহর দরবারে হাজার শোকর।

পরদিন অর্থাৎ ২৬শে মার্চ সারাদিন, সারারাত কারফিউর পরে ২৭শের সকালে মাত্র দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ ছাড়ল। আমরা মনে মনে প্রস্ত্তত ছিলাম ছাড়া পেলেই বাবুর ওখানে চলে যাব। তারা মিয়াকে ওর ভাই এসে নিয়ে গেল। বাবুর্চি (নাম মনে নেই) ওখানেই রয়ে গেল। ঘরে চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ যা ছিল ওর জন্য রেখে আমরা কিছু সঙ্গে নিলাম। আর কিছু কাপড়-চোপড় নিয়ে আমরা ও বড়পারা বাবুর ওখানে চলে গেলাম। বড় রাস্তা দিয়ে নয়, হাতিরপুল পার হয়ে ভেতর দিয়ে। বলতে ভুলে গেছি, আমাদের টেলিফোন লাইন ২৫শে মার্চ থেকেই কাটা ছিল। হয়তো আর সবারও তাই। বাবুর বাড়িতে ততক্ষণে মিরপুর-মোহাম্মদপুর থেকে অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন। বাবু দুহাত বাড়িয়ে সবাইকে আশ্রয় দিয়েছেন। মরতে হয় সবাই একসঙ্গে মরব – এই ছিল আমাদের কথা। দোতলার সবচেয়ে ভালো ঘর পুবেরটা আমাদের জন্য বরাদ্দ হলো। কামালভাই চট্টগ্রামে থাকায় বড়পা দুই ছেলে নিয়ে বাবুর ঘরে থাকত। দুই ঘণ্টার মধ্যে যে যা পারল কিনে ঘরে ঢুকল। আর যার যা চাক্ষুষ দেখা চারদিকের অবস্থার কথা বর্ণনা করতে লাগল বাবুর সামনে। সামনে বাবুর রোগী দেখার ঘরটা সেজো মামার জন্য দেওয়া হলো। দোতলার মধ্যে বড় ঘরে হাফেজ চাচা আর মিনারা, ছেলেরা সব প্রবীণ সংঘের ঘরে জায়গা পেল। দোতলার সামনের ঘরে (পরবর্তীকালে সেটা রান্নাঘর) বোধহয় ছোট চাচাদের। রশীদ ফুপ্পারাও কোথাও, বোধহয় দক্ষেণের ঘরে, ছিলেন। সে-সময়ে আমাদের বাড়িতে পঁচাত্তরজন উদ্বাস্ত্ত নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন।

একটা জীবনে দুবার উদ্বাস্ত্ত হওয়ার ঘটনায় মানুষ মুহ্যমান। সবকিছু ছেড়ে শুধু প্রাণ হাতে করে পালিয়ে আসা মানুষের অনুভূতি কী হয়, তা যাদের হয়েছে তারাই শুধু জানে।

চোদ্দপুরুষের ভিটে, বাড়ি-ঘর, দেশ ছেড়ে চলে আসতে কত কষ্ট, কত দুঃখ তা দাদির সেই কান্নার কথা মনে হলে আজ হাড়ে হাড়ে বুঝি। তখন কিছুই বুঝিনি, কিন্তু যত বয়স হচ্ছে তত বুঝতে পারছি। যা ছিল অনেক দিনের সুখ, দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ, বেদনার স্মৃতিবিজড়িত নিজের বাড়িঘর, ভিটা-মাচা সব যেন নিজে ‘না’ হয়ে গেল। এই ‘না’র শেষ হলো না।

২৫শে মার্চ ’৭৫-এর বেশ কয়েকদিন আগে আমি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলাম। স্বপ্নটা দেখেছিলাম একটা তিনতলা বাড়িতে অনেক লোকজন। আমরাও আছি। বাড়িটা পেশাওয়ারে দেখা শহরের উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর মতো। ওপরে কাঠের ফ্রেমের জানালা-দরজা। অনেক আওয়াজ আর হইচই, আর্তনাদ। এই স্বপ্নের ঘটনাটা আমার তখনকার ডায়েরিতে লিখেছিলাম। কিন্তু আজ সে-ডায়েরি কোথায় গেছে জানি না। জীবনের কতকিছুই না হারিয়ে গেছে। কত জিনিস, কত স্মৃতি, কত দুঃখ, কত বোকামির ঘটনা, যা আর শোধরাবার উপায় নেই। সেই হতাশায় বুকের মধ্যে টনটনিয়ে ওঠে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা।

সেই ভয়াবহ, দুঃসহ দিনগুলোর কথা মনে হলে এখনো মনে মনে শিউরে উঠি। কত রকমের কথা, কত ঘটনা আজো মনে পড়ে। বাবুর বাড়িতে একটা মেয়েলোক কাজ করত। তার ছেলে পিলখানার দিকে কোথায় যেন থাকত। সে পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল ছেলের খোঁজে। কারো কথা শোনেনি, কারফিউ মানেনি। সেই যে গেল আর কোনোদিন সে ফিরে আসেনি। জানা নেই তার পরিণতি কী হয়েছিল।

আমাদের বাড়িতে সব স্তব্ধ। কামালভাই চট্টগ্রামে বদলি হয়েছিলেন বলে সেখানেই ছিলেন। রাতে ঢালা বিছানা হতো। চারিদিকে তাঁর বইয়ের আলমারি। দিনের অনেক সময়ে বড়পাকে বাবুর ডিক্টেশন নিতে হতো। মাঝখানের বড় জায়গাটা মসজিদে পরিণত হয়েছিল। প্রত্যেক ওয়াক্তে জামাতে নামাজ পড়ত সবাই। সেজো মামা নামাজ পড়াতেন। হাফেজ চাচাও ছিলেন। তাঁরা অনেক সময়ে ধর্মীয় আলোচনা করতেন। আমরা মেয়েরা পেছনের সারিতে জামাতে নামাজ পড়তাম। বড় ফুপু, সেজো মামি ও অন্য চাচিরা রান্নাবান্না, কাটাকোটা করতেন। ছেলে-ছোকরারা বাবুর সামনে ভালো মানুষের মতো ঘুরে বেড়াত আর একেবারে পেছনে সংঘের কোণার দিকে আড্ডা মারত। হয়তো তাস-টাশও চলত। আর কাজ ছিল স্বাধীন বাংলা বেতারে খবর শোনা। ওদের ওপর বাবুর নিষেধাজ্ঞা ছিল বাড়ি থেকে না বেরোনোর। কিন্তু তবু ফাঁকে ফাঁকে বেরিয়ে যেত, তবে খুব সাবধানে – যাতে বাবুর সম্মুখে না পড়তে হয়। তখনকার মিলিটারিদের চেয়েও ওদের বড় ভয়ের ব্যাপার ছিল বাবুর কাছে ধরা পড়া।

টিলু আর চান্নু এই দুজনা মানিকজোড়ের মতো থাকত। সবাই নামাজ পড়তে এলো কি না, সেদিকেও বাবুর কড়া নজর ছিল। ওরা প্রায়ই বাদ যেত, সেই ব্যাপারটাও বাবুর চোখ এড়াত না। ওরা ধরা পড়ে গেলে প্রচ- বকুনি খেত। কিন্তু তারপর আবার ফাঁক পেলে বেরিয়ে যেত। তখন বাজার পাওয়া এক দুষ্কর ব্যাপার ছিল। বয়স্করা বেরোলে যা পেত নিয়ে আসত। তখন কোনোমতে ডাল-ভাত আর একটা কিছু তরকারি, তার ওপর যদি কিছু পাওয়া যেত তবে সে তো সোনায় সোহাগা। প্রায় সময়েই কিছু পাওয়া যেত না। বাবু এই বাড়ি তৈরি করার সময়ে আল্লাহর কাছে বলেছিলেন, ‘তোমার ইচ্ছাতে এই বাড়ি বানানো হচ্ছে, এখানে যেন আমার গরিব আত্মীয়-স্বজন উপকার পায়।’ শেষ জীবনে তাঁর এই ইচ্ছাটা আল্লাহ রাহমানুর রাহিম পূরণ করেছিলেন। সেজন্য তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন এবং আল্লাহর কাছে শোকর করেছিলেন। বাবু সারাদিন নিজের পড়াশোনা নিয়ে থাকতেন; কিন্তু চশমার তলা দিয়ে গেটের দিকে নজর রাখতেন, কে এলো, কে গেল। তাঁর কড়া দৃষ্টি এড়িয়ে কম বয়সের ছেলেরা মাঝেমধ্যে পালিয়ে যেত। তখন সংঘের কাজও হতো না। কারো নেহাত অসুবিধা না হলে কেউ ডাক্তারের কথা চিমত্মাই করতে পারত না। পাড়ার প্রবীণরা খুব কদাচিৎ আসতেন বস্নাড প্রেশার চেক করাতে। আত্মীয়-স্বজন কেউ এলে বাবু সবার খোঁজখবর নিতেন। কে কী শুনেছে, কী দেখেছে সেসব আলাপ-আলোচনা হতো।

একদিন সবাই আসরের নামাজের পর বসে বসে দোয়া-দরুদ পড়ছেন। এমন সময়ে বেশ লম্বা-চওড়া জওয়ান লোক – দেখে পাঞ্জাবি মনে হয় – গেটে ঢুকতে দেখা গেল। সবাই তটস্থ হয়ে উঠল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সে চট করে বলে উঠল, ‘আমি মুক্তোর ছেলে।’ মুক্তো আমার বড় খালার মেজো মেয়ে। ওরা ধানম–তে
থাকত। মুক্তোবুই ওকে পাঠিয়েছে আমাদের খবর নিতে। সবাই স্বসিত্মর নিশ্বাস ফেলল। এরকম কত গুজব, কত করুণ ঘটনার কাহিনি শুনতে পেতাম। এত বছর পর হয়তো কত ঘটনার কথা আমার মনে নেই।

এরই মধ্যে একদিন খবর পাওয়া গেল, তুলনবুরা সপরিবারে টুটলা, রিতা, বিদু, তার ছেলেমেয়ে, দেবর-জা বেশ অনেকে নৌকা করে তাদের গ্রামের বাড়ি যাওয়ার সময়ে মিলিটারিদের গুলি খেয়েছে। তারপর অনেক কষ্টে তাদের হাত থেকে বেঁচেছে। একমাত্র হামিদুল্লাহ সাহেব যাননি। তখন তিনি উত্তরা ব্যাংকের বড় সাহেব ছিলেন। মিলিটারিদের সঙ্গে বেশ যোগাযোগ ও দহরম-মহরম ছিল তাঁর।

পরে শুনেছি টুটলা বুকে গুলি খেয়ে মার কোলে লুটিয়ে পড়েছিল, তুলনবুর গায়ে চার-পাঁচটা গুলি লেগেছে। রিতার কপালের পাশ দিয়ে গুলি চলে গেছে, কিছুটা আহত হয়েছিল। নৌকায় আর কারো কিছু হয়নি, তুলনবু ছাড়া। হামিদুল্লাহ সাহেব ইচ্ছা করলে তুলনবুকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় এনে চিকিৎসা করাতে পারতেন। কিন্তু তিনি কিছুই করেননি। তুলনবু বরিশাল না কোথায় ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে বড্ড করুণভাবে মৃত্যুবরণ করলেন।

বাবু তুলনবুকে খুব স্নেহ করতেন। খুব মন খারাপ করলেন। আমাদের সবার খুব দুঃখ হলো, সেই দুঃখের জের আজো আছে। আজো মনে হয় যেন তুলনবু অনেক দুঃখ বুকে চেপে চলে গেলেন। জীবনের শেষ ইচ্ছা ছিল বড়পার সঙ্গে দেখা হওয়ার আর মনের কথা বলার। কত দুঃখ বুকে নিয়ে কত অপমান সয়ে অসহায়ভাবে চলে গেলেন এই দুনিয়া থেকে। আল্লাহ তুমি তাঁকে অপার শান্তি দিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসে জায়গা দিও। তুলনবুর মতো ভালো মানুষ আর এমন মধুর ব্যবহার ফাম্মা ছাড়া (তাঁর ফুপু) আমি আর খুব বেশি দেখিনি।

তুলনবুর জন্য গায়েবানা জানাজা পড়া হলো। তারপর সাবাই মিলে সেদিনেই তাঁর জন্য কোরআন খতম দিলেন।

এ-ঘটনার কিছুদিন পরই একদিন আমি আর জামালউদ্দীন পরীবাগে গিয়েছিলাম কিছু কাপড়-চোপড় নাকি আর কিছু আনতে। ফিরেই দেখি একটা সবুজ রঙের জিপ, ঠিক মিলিটারিদের মতো। ভালো করে দেখতেই দেখি মিলু মিষ্টি মিষ্টি হাসিমুখে উঠতে যাবে।  আমি বলেছিলাম, ‘মিলু মিয়া, তোমার জিপটা দেখে মনে হয়েছিল বুঝি মিলিটারির গাড়ি, ভয়ই পেয়েছিলাম।’ হাসতে হাসতে গাড়িতে উঠল। খোদা হাফেজ বললাম। আমরা যখন ছিলাম না তখন এসেছিল। আর তখনই ফিরে গেল। সেই যে গেল আর কোনোদিন ফিরে এলো না আমাদের সবার প্রিয় মিষ্টি হাসির সেই ভাইটা! সবসময়ে তার মুখে একটা মিষ্টি হাসি লেগে থাকত। ও ছিল ঠিক আমার প্রিয় দেবর ইফতিখারের মতো। সবসময়ে হাসিমুখ। তার মৃত্যুও অনেক করুণ, বড় নির্মম! এ-অনেক পরের ঘটনা। ইফতিখার চাকরি করত চা-বাগানে। সেখানে সে বড় নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে খুন হলো। মিলু সেই যে গেল জীবনে কোনোদিন আর ফিরে এলো না। পরদিন লোকমুখে শোনা গেল দুটো বাস পাবনার পথে যাওয়ার সময়ে মিরপুরে বিহারিদের হাতে ধরা পড়েছে। সেই বাসে যত মানুষ ছিল, সবাইকে বিহারিরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। লাশগুলো গুম করে দিয়েছিল। পরে অনেক খোঁজখবর করেও জানা যায়নি। আমাদের ফিরোজা ফুপু বাকি জীবন প্রায় পাগল হয়ে ছিলেন। তাঁকে অবশ্য জানানো হয়নি যে, মিলুকে বিহারিরা মেরে ফেলেছে।

 

বিয়োগ-গাথা

১৯৮৩ সালে বশিরহাটের শান্তিবাড়ির সবচেয়ে আদরের, সবচেয়ে বড় আপা তৌহিদা খাতুন (বেবী) – ডা. আবদুল ওয়াহেদ সাহেবের বড় মেয়ে – ইন্তেকাল করেন। বড় ছেলে ওয়াহেদ করিম আহমদ (দীপু, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট), ছোট ছেলে জাহেদুল করিম আহমদ (ডাক্তার) এবং স্বামী ডা. কামালউদ্দিন আহমদকে রেখে।

এরপর আরো শোক। মহেব ভাই মারা গেলেন। তারপর আরো করুণ ব্যাপার। আমাদের ভাবি বাড়ির সবচেয়ে বড় বউ, সবার প্রিয় হাসি-খুশি সুন্দর সেই ছেলেমানুষ মেয়েটা, মাত্র পঁয়তালিস্নশ বছর বয়সে ১৯৯২ সালের ১৫ই নভেম্বর অপারেশনের টেবিলে হঠাৎ মারা গেলেন। এটা ফিরোজা ফুপুর আরো বড় শোক, একেবারে
সুস্থ-ভালো, এত সজীব প্রাণচঞ্চল মানুষটা হঠাৎ মৃত্যুর মধ্যে হারিয়ে গেল চিরকালের মতো।

আমার দাদামামা (সবচেয়ে ছোট মামা) সৈয়দ আবদুর রাজ্জাক ১৯৯৩ সালের ২৭শে নভেম্বর বেলা ৩টায় বারডেম হাসপাতালে এক্স-রে করার সময়ে দাঁড়ানো অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। কোনোরকম চিকিৎসা ছাড়াই অশেষ দুর্ভোগ সহ্য করে, বলতে গেলে, বিনাচিকিৎসায় সাত-আটদিন বহু কষ্ট পেয়ে অবশেষে মৃত্যুবরণ করলেন।

তিনি আমার নানি সৈয়দা হাজেরা খাতুন ও নানা সৈয়দ হায়দার আলীর সবচেয়ে ছোট ছেলে, খুব আদরের সমত্মান। ছেলেদের মধ্যে সবার ছোট বলে সবাই তাঁকে ‘দাদা’ বলে ডাকতেন। তাই আমরাও সবসময়ে দাদামামা ডাকতুম। সেই ডাক শেষ পর্যন্ত হয়ে গেল ‘দাম্মা’। আমার মেয়েরা এবং বড়পার ছেলেরাও তাঁকে ‘দাদামামা নানা’ বলে ডাকত। খুবই ভদ্র, নম্র, মিষ্টভাষী ও অমায়িক চরিত্রের মানুষ ছিলেন। মুখে সবসময়ে হাসি লেগে থাকত। সুন্দর, উজ্জ্বল, শ্যামবর্ণ চেহারা। তাঁর চেহারায় যে আভিজাত্যের ছাপ ছিল তা শত চিমত্মা-ভাবনা, অভাব-অনটন, শত দুঃখ-কষ্ট-দারিদ্রের মধ্যেও মুছে যায়নি। ছোট-বড়, ধনী-গরিব সবার সঙ্গেই খুব ভদ্র ও অমায়িক ব্যবহার করতেন। রোগশয্যায় যেদিন তাঁকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে শেষবারের মতো দেখেছি, তখন তাঁর খুবই কষ্ট হচ্ছিল। তবু তার মধ্যে মুখে সেই মিষ্টি হাসি লেগেই ছিল।

ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় মন ছিল না তাঁর। মনে হয়, বড়ভাইদের কাছ থেকে তেমন দিকনির্দেশনা না পাওয়ায় এবং নিজের বুদ্ধিতে চলতে গিয়ে আমার নানির সঞ্চয়ের অনেকটাই নষ্ট করেছিলেন। ছোট দুই বোন আর মাকে নিয়ে তবু বসতবাড়িতে থেকে যা হোক চলে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ দেশবিভাগ এবং ১৯৫০ সালের দাঙ্গায় সব তছনছ হয়ে গেল।

 

পরিশিষ্ট ১

আজ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের ছেচলিস্নশতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। প্রতিষ্ঠাতা ডা. এ কে এম আবদুল ওয়াহেদ।

প্রবীণ হিতৈষী সংঘের সব কর্মচারী, সদস্য ও যাঁরা এ-প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যে-কোনোভাবে জড়িত ছিলেন ও আছেন তাঁরা ও সমবেত সুধীবৃন্দ, আসসালামু আলাইকুম।

১০ই এপ্রিল, ১৯৬০ সালের সুন্দর সকালের সেই প্রথম সভায় যেসব সম্মানিত ব্যক্তি এসেছিলেন, তাঁদের কেউই হয়তো আজ আর জীবিত নেই। তবে – দুই একজন ব্যতিক্রম প্রবীণ ছাড়া – সবাই ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, তাঁরা সবাই বিদগ্ধ ব্যক্তি। এখানে একজনের নাম করতেই হবে, তিনি ছিলেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জাকির হোসেন। তিনিই আমার বাবার এই প্রতিষ্ঠানে সাহায্য করার জন্য দশ হাজার টাকা দান করেন। একথা আমরা সবসময়ে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। আমার বাবা তাঁর নিজের বাড়ির পেছনের তিন কামরার আউট হাউসে আল্লাহর অসীম রহমতে প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা করেন।

সেই সময়ে প্যাথলজি কাজের জন্য লোক পাওয়া যেত না। তিনি নিজে হাতে-কলমে কাজ শিখিয়ে তৈরি করতেন। ভালো কাজ শেখার পরে অন্য জায়গায় বেশি মাইনের কাজে চলে যেত। তখন তিনি নিজেই প্যাথলজির কাজ করতেন এবং নব উদ্যমে আর একজনকে শেখাতেন। এই সঙ্গে তিনি জরাবিজ্ঞানে গবেষণার কাজও করতেন। তাঁর প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা মাঝে মাঝে এসে তাঁকে গবেষণার কাজে সাহায্য করতেন। সেইসব কাগজপত্র এই প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরিতে থাকতে পারে বলে আমি আশা করি।

ক্রমে যখন কাজ বেশি হতে লাগল তখন স্থানসংকুলান হতো না। তখন বাবা প্রায়ই বলতেন, এই ছোট জায়গায় এটা বড় হতে পারবে না। প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য যা কিছু করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল, তা তিনি করেছেন। জীবনের শেষ সুস্থ দিনটি পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করে গেছেন। এটা ছিল শেষ জীবনে তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। বলতেন, এটাকে তোমরা বাঁচিয়ে রেখো। যে যাই বলুক এটার কদর একদিন ইনশাআল্লাহ হবেই।

তিনি দেখে যেতে পারেননি বটে, সেটাই আমার দুঃখ, তবু আমি আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করি যে, তাঁর সেই ছোট্ট জায়গায় যে-স্বপ্নের শুরুটা, যার আন্তরিক ও অক্লান্ত চেষ্টার ফলে ১৯৮৫ সালে আজকের এই বড় ইমারতে এসে বাসা পেয়েছে, তিনি আমার বাবার অত্যন্ত স্নেহভাজন জামালউদ্দীন আহমদ। তাঁর অবদান প্রবীণ হিতৈষীর স্বপ্নদ্রষ্টার অবদানের চেয়ে কোনো অংশে কম না, বরং বেশিই। কারণ ছোট জায়গায় যে-প্রদীপটা বাবা জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন সেটা সেখানে থাকলে হয়তো কোনোদিন বড় হতে পারত না।

আমি আন্তরিকভাবে আশা করি আপনাদের সবার সহযোগিতায় এই প্রতিষ্ঠান আরো অনেক বড় হবে, এবং অনেক মানুষের উপকার হবে। এই প্রতিষ্ঠানে যাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন এবং এখনো করছেন, যাঁরা এখানকার সদস্য ও কর্মচারী এবং আজকে যাঁরা অতিথি অনেক কষ্ট করে এই অসময়ে এসেছেন সবাইকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই। আপনাদের সবার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।

খোদা হাফেজ।

 

পরিশিষ্ট ২

আজকে আমার বাবার ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। এত দীর্ঘদিন পরেও আজো মনে হয়, এই তো সেদিন, আমার হাতের ওপর তাঁর মাথা, ক্লান্ত সিত্মমিত স্বরে বললেন, ‘মা, বড় কষ্ট’। তারপরেই কলেমা তাইয়্যেবা পড়েই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। আসেত্ম মাথা নামিয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, মুখের মধ্যে আর কোনো কষ্টের ছাপ নেই। একটা স্নিগ্ধ প্রশান্তি, জীবনের বোঝা পেছনে ফেলে অনন্তের পথে তাঁর যাত্রা। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

আজকে তাঁর কর্মময় জীবনের একটা দিকের কথা বলব, সেটা হলো মানুষের প্রতি বিশেষ করে রোগীদের প্রতি তাঁর দরদ, তাঁর মমত্ববোধ। রোগীকে তিনি এত যত্ন করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতেন, তারপর ব্যবস্থাপত্র দিতেন। যাকে দেখলেন, সে কেমন থাকে তা নিয়ে খুব চিন্তিত থাকতেন, রোগীর লোকজনদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলতেন। খবর না দিলে খুব রাগারাগি, এমনকি বকাঝকা করে বলতেন, রোগীর কষ্ট কী তা কি তোমরা বুঝতে পারছ?

তাঁর ওয়ার্ডে যত রোগী সবাইকে তিনি অত্যন্ত যত্ন করে দেখতেন। ছাত্রদের পড়ানোর সময়েও রোগীদের প্রতি তাঁর সজাগ সহানুভূতি থাকত। কোনো রোগী সুস্থ হলে এত খুশি হতেন যে, মনে হতো যেন তাঁর নিজের কেউ সুস্থ হয়েছে। খারাপ রোগী হলে ডাক্তার এবং নার্সদের ওপর নির্দেশ থাকত যে, কোনো রোগী খারাপের দিকে গেলে যেন তাঁকে জানানো হয়। সন্ধ্যার পরে একবার হাসপাতালে যেতেন রোগীদের দেখতে। ছাত্রদের উপদেশ দিতেন। এছাড়াও ঢালাওভাবে বলা ছিল, তেমন কোনো রোগী থাকলে যে-কোনো সময়ে যেন তাঁকে খবর দেওয়া হয়। কত সময়ে দেখেছি গভীর রাতেও চলে যেতেন। অনেক চেষ্টার পরও যদি কোনো রোগীর মৃত্যু হতো তখন খুবই দুঃখ পেতেন। দুই-তিনদিন পর্যন্ত তাঁর মনটা ভারাক্রান্ত থাকত। বারবার বলতেন, আমার বিদ্যা ও জ্ঞানবুদ্ধিতে আমি তো চেষ্টার কোনো ত্রম্নটি করিনি, কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছার ওপরে তো কারো কোনো হাত নেই। পেশাওয়ারে থাকতেও দেখেছি অসুস্থ মানুষের ওপর দরদ। আবার ছাত্রদের কেউ অসুস্থ হলে আরো ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তেন। খুব সীমিতসংখ্যক ছাত্রছাত্রী নিয়ে খাইবার মেডিক্যাল কলেজ শুরু হয়েছিল তাই তাদের প্রতি খুবই যত্নবান ছিলেন, যাতে তারা সুস্থ থাকে। প্রায়ই বলতেন, আমি ইচ্ছা করে কোনোদিন কোনো রোগীর প্রতি অবহেলা করিনি। রোগীদের প্রতি তাঁর মমত্বের কথা বলে তাঁর প্রতি আমার অশেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি। সারাজীবন দেখেছি, রোগীরা এবং তাঁদের আত্মীয়-স্বজনরা আমাদের আত্মীয় হয়ে গেছেন।

প্রায়ই বলতেন, ‘মা, ইচ্ছা করে আমি কোনোদিন কোনো রোগীর প্রতি অবহেলা করিনি। সময়ে-অসময়ে কখনো কাউকে না দেখে ফিরিয়ে দিইনি, তবু কি আল্লাহ আমাকে মাফ করবেন না?’ তাঁর খাওয়ার মাঝখানে কোনো রোগী ডাকতে এলে খাওয়া ছেড়েই উঠে যেতেন।

প্রবীণ হিতৈষী সংঘের জন্য জীবনের শেষ সুস্থ দিনটি পর্যন্ত অক্লান্তভাবে কাজ করে গেছেন। যখন সংঘটা তাঁর বাড়িতে ছিল তখন সময় ছিল ৪টা-৬টা। কিন্তু তার বাইরে কেউ এলে তাকে ফিরিয়ে দেননি কোনোদিন। প্রয়োজনে রাতেও নিজে প্যাথলজির কাজ করেছেন। দুস্থের সেবায় ছিলেন তিনি নিবেদিতপ্রাণ। তাঁকে এত কাছ থেকে এতভাবে দেখে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার কোনো শেষ নেই। আল্লাহ যে আমাকে তাঁর মতো একজন এত বড় মহৎমাপের মানুষের মেয়ে করে জন্ম দিয়েছেন সেজন্য তাঁর দরবারে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আপনাদের সবার সুস্থ ও দীর্ঘজীবন কামনা করি।

খোদা হাফেজ। r