মহাজাগতিক

অমর মিত্র

আকাশ মেঘে ঢেকেছে দুপুর থেকে। এখন অন্ধকার যেন যুগান্তে ধেয়েছে, এমনই তার ব্যাপ্তি। সন্ধে পার হয়ে গেছে ঘণ্টা-দুই আগে। চায়ের দোকানটিতে বসে দুলু – আবদুল লতিফ কামিল্যা বড় – মোবাইল ফোনের সাইজের একটি যন্ত্র কানে লাগিয়ে উৎসুক হয়ে আছে, ব্যাটারি ডাউন। তাই শব্দ ক্ষীণ হয়ে গেছে। কষ্ট করে শুনতে হচ্ছে। চায়ের দোকানটি মহকুমা শহরের মিউনিসিপ্যালিটির বড় বিল্ডিংয়ের সমুখে। শহরের গায়ে ইছামতী নদী। নদীর ওপরে ব্রিজ। ব্রিজ পেরিয়ে চলে যাওয়া যায় সীমান্তে। তারপর অন্য দেশ। এসব দুলু জানে। তার জানার উৎস ট্রানজিস্টার। আজ ট্রানজিস্টার গড়বড় করছে। ব্যাটারি ডাউন। মানুষের কণ্ঠস্বর খুব ক্ষীণ। দুর্লভ দেখল এক ব্যক্তি এসে বসেছে তার সামনের বেঞ্চে।

দোকানের প্রবেশপথের দুই ধারে দুটি বেঞ্চ। ডানদিকে ভেতর করে মস্ত উনুন। কয়লার আঁচ। চায়ের কেটলি বসানো। তবে এখন আঁচ পড়তি। দোকান কিছু বাদে বন্ধ হবে। দুলু জিজ্ঞেস করল ব্যক্তিটিকে, চা নেবেন?

তিনি বললেন, চা, দিন, চায়ের অনেক গুণ?

দুধ-চিনি দেবে? জিজ্ঞেস করল দুলু।

তিনি ঘাড় কাত করলেন। দুলু লোকটিকে দেখতে থাকে। ধুতি ও শাদা শার্ট পরা। ব্যাকব্রাশ করা চুল। মুখখানিতে যেন সমাহিত ভাব জেগে আছে। ক্লান্তি আর বিষণ্ণতাও। অচেনা লোক। সে জিজ্ঞেস করল, আজ্ঞে কোথা থেকে আসা হচ্ছে?

পানিতর।

ও, পান্তর, ঘোজাডাঙা বর্ডারের দিকে?

বর্ডার? লোকটি বিস্মিত হয়।

বাংলাদেশ বর্ডার, এই তো কাছেই।

বাংলাদেশ কী, এইটাও তো বেঙ্গল প্রভিন্স।

আনকা লোক এসে পড়ে এমনি। দুলু দেখেছে এমন। কিছুই জানে না, আবার সব জানে। বেঙ্গল প্রভিন্স! বেঙ্গল প্রভিন্স কী? বাংলাদেশ না পশ্চিমবঙ্গ? এখন লোকটা বিনবিন করে বলছে চায়ের কথা, আচার্য প্রফুলস্নচন্দ্র চায়ের গুণাগুণ নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন, চা খেলে শরীরে অনেক উপকার হয়, তিনি কোন রেলস্টেশনে দেখেছেন। নবহট্ট, নৈহাটি মনে হয়।

আজ্ঞে। দুলু কামিল্যা একটু থমকে গেল। আচার্য প্রফুলস্নচন্দ্র মানে সেই ফ্যাক্টরি যিনি গড়েছিলেন? কী নাম যেন?

পি. সি. রায়, বেঙ্গল কেমিক্যাল।

হুঁ, বেঙ্গল কেমিক্যাল যাঁর গড়া? মনে পড়ল দুলুর। তার গ্রাম বাগু–র হরিশ কু-ুর ছেলে বাপ্পা ওই ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। কদিন আগে হরিশ এসেছিল বসিরহাট কোর্টে। জমি নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে মামলা। মাঝে মাঝে তারিখ পড়ে। সে-ই বলে গেল ছেলে নিয়ে তার খুব চিমত্মা। এই বয়সে চাকরি গেলে সংসার টানবে কী করে? এর ওপরে মামলা শেষই হচ্ছে না।

তিনি বললেন, ঠিক বলেছেন, বেঙ্গল কেমিক্যাল, বাঙালির গর্ব, দেশীয় প্রতিষ্ঠান।

বেঙ্গল কেমিক্যাল তো তুলে দেবে বলছে।

তুলে দেবে মানে? তিনি বিস্মিত হলেন, কেন তুলবে, অমন আর একটা হোক, সস্তার ওষুধ পায় দেশের মানুষ, এই তো সেদিন হলো, আমারই বয়সী বলা যায়, আমাদের নিজেদের জিনিস, বড়লাটের কাছে জানাতে হবে এ-সিদ্ধান্ত ভুল।

আমি রেডিওয় শুনলাম, দিলিস্নর গরমেন্ট বলেছে তুলে দেবে।

দিলিস্নর গরমেন্ট তুলে দেবার কে? কথাটা বলে তিনি বিড়বিড় করলেন, পরাধীন দেশ, সায়েবদের ভালো-মন্দ দুই-ই আছে।

তারাই মালিক নাকি।

তিনি চুপ করে বসে থাকলেন। দুলু ভাবে, এক একজন এমন থাকে, প্রথমেই খুব প্রতিবাদ করে ওঠে, তারপর সবটা বুঝে চুপ করে যায়। গরম কথা দিয়ে কি কারখানা খোলা যাবে? সমীক্ষায় বলে কেন চটকল সব বন্ধ হয়ে গেছে। আর গরমেন্ট যদি বেচবে বলে, আটকাবে কে?

কিন্তু আচার্য পি. সি. রায় কী বলছেন, তাঁর নিজের করা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি, বিলেতেও অমন মানের ওষুধ হয় না।

পি. সি. রায়? তিনি কি আছেন? অবাক হয়ে লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকে দুলু। তার কানে এবার পুরুষকণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। আন্দামানে খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে, তার ফলে এদিকে আগাম সতর্কতা। আগামী আটচলিস্নশ ঘণ্টা মৎস্যজীবীদের নদী ও সমুদ্রযাত্রা নিষেধ। এখানেও ঝড় আসছে।

আপনি কোথায় যাবেন? দুলুর যেন মনে হয় তিনি গাঙে নৌকো নিয়ে কোথাও যাবেন। সতর্ক করা প্রয়োজন।

বলতে পারছি না। তিনি মাথা নাড়লেন।

পান্তরে ঘর?

তিনি মাথা নাড়লেন। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন, আর কোনোদিন পান্তরে যাওয়া হবে না, চিরতরে ছেড়ে এসেছি।

বেচে-বুচে চলে এয়েচেন, বাপ-মা, ভাই-বুন নেই? দুলু জিজ্ঞেস করল। এ তার অভ্যেস। এই অভ্যেসের জন্য ছেলের কাছে বকুনি খায়, ‘এত জানার কী দরকার? চুপ করে থাকতি পার না?’ তার প্রশ্নের জবাব পায় না দুলু। না পেয়ে প্রসঙ্গ বদলায়, বলল, গাঙে যাবেন না দুদিন, নিষেধ করছে গরমেন্ট, ঝড়বৃষ্টি আসছে খুব।

গাঙ তো পার হয়ে এলাম, আবার কেন পার হবো, খেয়ার মাঝি বলছিল বটে, আকাশের গতিক ভালো না।

খেয়ার মাঝি, কোন ঘাট? দুলু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে জামতলা?

এই তো সংগ্রামপুর ঘাট। তিনি আবার চুপ, তারপর বললেন, ওরা আকাশ দেখে বলতে পারে ঝড়বৃষ্টির কথা, কত তারা চেনে!

হুম! কিছু মিলছে না, বোধহয় করবাবুর ইটভাটার কাছে জামতলা ঘাট পার হয়েছে। দুলুর ছেলেবেলায় বসিরহাটে গাঙ পার হতে হতো খেয়ায়। ওপারে সংগ্রামপুর, কেটে একদিকে আর একদিকে পান্তর হয়ে ঘোজাডাঙা, তারপর বাংলাদেশ, তখন ছিল পাকিস্তান। সাতক্ষীরে (সাতক্ষীরা) শহর। সাতক্ষীরের লোক এদিকে আসে মাঝেমধ্যে। আত্মীয়স্বজন আছে। তার ফুপুর বাড়ি সাতক্ষীরে ছিল। ফুপু নেই। তার ছেলেমেয়ে চারজনের একজন আরবে, বাকিরা ওদেশে ছড়িয়ে গেছে। সাতজন্মেও দেখা হবে না। দুর্লভ জিজ্ঞেস করল, পান্তরে যাবেন না কেন?

কী করতে যাব?  চুপ করে থাকে লোকটা।

দুলু কামিল্যার খুব কৌতূহল। তা হয়েছে সেই চোদ্দ বছর বয়স থেকে রেডিও শুনে শুনে। সে ট্রানজিস্টারের নব ঘোরাতে ঘোরাতে লোকটির দিকে ভালো করে তাকায়। কী হয়েছে এর? যে-লোকটি রাজস্থানে পুড়ে মরেছে ঘাতকের হাতে তার কেউ নাকি? সে তো মালদার মানুষ। তার কেউ আছে নাকি পান্তরে? খবরটা একবার বলে থেমে গেছে। রেডিও সব খবর বলে না ভালো করে। রেডিও যে সরকারের। রেডিও সরকারের বিপক্ষে তেমন কিছু বলতে চায় না। এই যে বেঙ্গল কেমিক্যাল উঠিয়ে দেবে, কেন দেবে তা খোলাসা করে বলছে না। গরমেন্ট তার সব কথা জনসাধারণকে জানায় না। তবু রেডিও ভরসা। কোথায় কোন দেশে হাসপাতালে বোমা ফেলে সমস্ত রোগী মেরে দিয়েছে, সে-খবর অবশ্য রেডিও দেয় বলে দুলু জানে। তার জানার উৎস তো রেডিও। ভাবল, লোকটার কিছু একটা হয়েছে, লোকটা তার ভেতরে ডুবে আছে। তার  কথা স্পষ্ট করে শুনছে না। আবার ভুলোমনের হতে পারে। কিছু মানুষ আছে দুঃখ বয়ে বেড়ায়। সে বলল, বর্ডার জানেন না, পান্তর তো ঘোজাডাঙার দিকে, বর্ডার সামনেই।

কিসের বর্ডার, ঘোজাডাঙা দিয়ে সাতক্ষীরা যায় তো, মহকুমা সাতক্ষীরা, বসিরহাট কি সাতক্ষীরে মহকুমার ভেতরে ছিল না একসময়?

দুলু অবাক। এসব কথা সে জানে না। বেতারে বলেনি।  কোনো কথিকায় শোনেনি। এ কোথাকার লোক? পান্তরের না মনে হয়। এদিক ভালো চেনে না। রেডিওতে একটা খবর বলছিল। সে কান পেতে রইল। লোকটার হাতে চায়ের গস্ন­vস আর সুজি-বিস্কুট। লোকটির দিকে তাকিয়ে দুর্লভ কানের ওপর ট্রানজিস্টার চেপে নব ঘুরিয়ে আকাশবাণী ধরতে চাইছিল। সেই খবর শুনবে। খবর হলো রাজস্থানে একজনকে পুড়িয়ে মেরেছে। গাঁইতি আর বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন দিয়েছে। হাবলু বলেছে, কাকা, তোমার আকাশবাণীতে বেশি বলবে না; কিন্তু টিভিতে দেখাচ্ছে। সারাদিন নানা মানুষ এই নিয়ে নানা কথা বলছে; কিন্তু বেতার একবার বলে চুপ করে আছে। জীয়ন্ত মানুষকে জ্বালিয়ে দিয়েছে। এই নিয়ে লোকে ফুটছে। দোকানে চা খেতে এসে এসব নিয়ে
তক্কো-বিতক্কো করে। শুনলে ভয় হয়। ঘরপোড়া গরু তো। আগের বছর যা হয়েছিল আষাঢ় মাসে, হিন্দু-মুসলমানে রায়ট। যত বাইরের লোক এসে হাঙ্গামা আরম্ভ করল। কদিন কারফিউ চলল। কী যে হচ্ছে সব ধরা যায় না। খবর হয় প্রথমে, তারপর খবরের তিল বড় হতে হতে তাল। এইটা কি তেমনি খবর। কিন্তু শুনতে পাচ্ছে, টিভিতে আর ফেসবুকে দেখাচ্ছে। ফেসবুক জানে না দুলু। টিভি তো বাড়িতে আছে। ছেলের মা, বউ দ্যাখে। ট্রানজিস্টার ছাড়া তার আর কিছু নেই খবর জানার। খবরের কাগজ আছে। দোকানের খদ্দেরই পড়ে। দুলু খবরের কাগজে বেশি আকর্ষণ পায় না। তার চেয়ে ট্রানজিস্টার ভালো। সব কানে কানে বলে দেয়, বিরাট আবার সেঞ্চুরি। ট্রেন দুর্ঘটনায় দুশো হতাহত। হতাহত মানে কেউ বেঁচে, কেউ মরে।

লোকটি বলল, চাদ্দিকের কোনো খবরই ভালো নয়, মন খারাপ করা ছাড়া খবর হয় না যেন।

আজ্ঞে সব না, পাকিস্তানকে হকিতে ইন্ডিয়া হারিয়েছে, আর বিরাট কোহলি ইতালিতে বে করতে গেছে।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বেঙ্গল কেমিক্যাল নিয়ে পি. সি. রায়ের কত স্বপ্ন, কোন খবরের কাগজে খবর বেরিয়েছে, স্টেটসম্যান?

দুলু বলল, পি. সি. রায় নিয়ে তো কিছু বলেননি রেডিও, সরকার আর রাখবে না ওই ফ্যাক্টিরি।

আশ্চর্য!  পি. সি. রায় কিছু বলছেন না! বিড়বিড় করল মানুষটি, আমার যা বয়স, বেঙ্গল কেমিক্যালের তাই, এর ভেতরে বন্ধ হয়ে যাবে?

আপনার বয়স কত? তিরিশ হচ্ছে।

দুলু চুপ করে থাকে। অঙ্কে সে খুব পাকা। কিন্তু মেলাতে পারছে না কোনো হিসাব। কী বলছেন তিনি? সে বলল, বেঙ্গল কেমিক্যালের জমি বিক্রি হয়ে গেছে আগে, সেখেনে মণি স্কোয়ার।

সে কী?

বেচাকেনার জায়গা, ওর কাছে লিলি বিস্কুট কারখানা বন্ধ হয়ে আছে অনেক বছর।

লোকটা অন্ধকারের দিকে তাকায়। বিড়বিড় করল, কেউ কিছু বলল না! বাংলার প্রাকৃতিক সম্পদের, বিশেষ করে দেশজ ভেষজের ব্যবহার বাড়াতে ও বাঙালি যুবকের বেকারত্ব ঘোচাতে বেঙ্গল কেমিক্যাল পত্তন করেছেন পি. সি. রায়।

দুলুর ট্রানজিস্টার আবার বিগড়েছে। সে ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছে কিছু শোনার। হচ্ছে না। ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বন্ধই হচ্ছে না। নব ঘুরিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারপর গম্ভীর মুখে বলল, ধরা যাচ্ছে না, এই সময়ে আকাশবাণীর খবর হয়।

কী খবর? লোকটা জিজ্ঞেস করতে দুলু বলল, সব খবর, জগতের খবর। খবর খবরই। তার আবার এইটা-ওইটা আছে নাকি।  দুলু বলল, সবই শুনতে হয়। সব, খবর শোনা আমার অনেক দিনের অভ্যেস।

আপনার বাড়ি এখেনে? লোকটা জিজ্ঞেস করল।

টাকির দিকে। বলল দুলু।

দুলু কামিল্যার গ্রাম টাকির কাছে। গ্রাম বাগু–। ইছামতীর ধারে। ওপারে বাংলাদেশ। অল্প জমি আছে। গ্রামের বাড়িতে এক ছেলে থাকে, আর এক ছেলে মুম্বাইয়ে গয়নার কাজ করে। গ্রামের বাড়িতে বড় আর ছোট মিলিয়ে চারটি গাইগরু। দুধের ব্যবসা করে ছোটটি। আরো নানা কাজ করে। মেজর এই চায়ের দোকান। জমি যে বিঘে তিন আছে, তা জলকরে দিয়ে নিশ্চিন্ত। ওদিকে চিংড়ি, ভেটকির খুব চাষ হয়। চাষ জমিতে নদীর নোনাজল ঢুকিয়ে সম্বৎসর মৎস্য উৎপাদন। দুর্লভ বছরে একটা টাকা পায়। নিশ্চিন্ত। ধান চাষের হ্যাপা নেই। ফসল লুট হয়ে যাওয়ার চিমত্মা নেই। ধান মরে যাওয়া, ধানে পোকা লাগার উদ্বেগ নেই। এসব নেই বলেই, দিনমানে খবরের কাগজ পড়া আর রেডিওয় খবর শোনা যায় নিরুদ্বিগ্নচিত্তে। আজ সে উদ্বিগ্ন হয়েছে। তার ছেলে নুরুল, নিলু ঠিকঠাক ফিরে আসুক। একটা লোককে জীয়ন্ত জ্বালিয়ে দিলো!

ছোট ট্রানজিস্টারটি তার জীবনে চতুর্দশ। রেডিওর আরম্ভের দিন থেকেই সে রেডিও নিয়ে আছে। মনে পড়ে যায় কাঠের বাক্সর মতো রেডিও, উঠোনে বাঁশের খুঁটি লাগিয়ে তার অ্যারিয়াল। তার আগে গাঁয়ের ঘটক-বাড়িতে হেডফোন না কী ছিল। একজন কানে দিয়ে মানুষের গলা শুনতে পেত। দুলু ঘটকবাড়িতে তা দেখে অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করে একটা রেডিও নিয়ে এসেছিল বাড়িতে। প্রতিবেশীরা শুনতে আসত। ভিড় করে শুনত সমীক্ষা, পলিস্নর নানা কথা, চাষবাসের কথা আর গান। গান বলতে সেই অনুরোধের আসর। দুলুর দুই নয়ন যেন টলটল করে উঠল, মনে পড়ে গেল, সে পোস্টকার্ড ছেড়েছিল আকাশবাণীতে। তার নাম একবার বলেছিল। পুরো নাম। আবদুল লতিফ কামিল্যা, দুলু, গ্রাম বাগু–, পোস্ট টাকি, ২৪ পরগনা জেলা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান, বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা… শুনতে চেয়েছিল সে।  আপন মনে বলল,  সে একটা দিন ছিল বলুন, হেমন্ত, মান্না, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা, লতা, প্রতিমা, সুপ্রীতি ঘোষ…। একের পর এক গায়কের নাম উচ্চারণ করছে দুলু কামিল্যা। তারপর বলল, বিবিধ ভারতী, রেডিও সিলোন, আমিন সাহনি, শুক্কুরবারের রাত আটটায় নাটক, বলতে বলতে হাসতে লাগল। তারপর জিজ্ঞেস করল, পান্তরে কার বাড়ি যদি না হয় কার ঘর গিইলেন?

শ্রীযুক্ত কালীভূষণ মুখোপাধ্যায়ের গৃহে, তিনি বসিরহাট কোর্টের মোক্তার।

মোক্তার, বসিরহাট কোর্ট, উকিল? দুলুর গলার স্বরে সম্ভ্রম।

আজ্ঞে না, মোক্তার।

দুলু ভাবল, সে আর কতটুকু জানে। মোক্তার কালীভূষণ মুখুজ্জে! চেনে না। পান্তরের অবনী মুখুজ্জেকে চেনে। বসিরহাট হাই ইশ্কুলের স্যার। এখেনে চা খায় মাঝেমধ্যে। সে জিজ্ঞেস করল, অবনী মাস্টারের ঘর?

আজ্ঞে না। লোকটি মাথা দোলায়।

অবনী মাস্টারের বয়স আপনার মতো, কেউ হবে হয়তো ওঁদের।

লোকটা চুপ করে থাকে, একটু বাদে বলল, ওঁর ছেলে ছোট, পান্তর হাই ইশ্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে, গৌরী বড়।

কালীবাবুরে কেমন দেখতে বলুন দেখি। দুলু জিজ্ঞেস করে কৌতূহলে।

লম্বা, গৌর বর্ণ, ওঁর মেয়ে বাবার মতোই হয়েছিল, খুব নরম মন, গৌরীর হাতের লেখা কী সুন্দর! তাকিয়ে থাকতে হয়।

পিতৃমুখী মেয়ে সুখী হয়। দুলু বলল।

লোকটি নতমস্তকে বসে আছে। দুলু জিজ্ঞেস করল, তিনি কে, গৌরী?

জবাব পেল না দুলু। তখন সে কানের যন্ত্র থেকে পাওয়ার খবর বলল, আবার দেড়শোজন মারা গেছে ইস্তাম্বুলে, নারী-শিশু বাদ নেই কেউ।

তুরস্কে, ভূমধ্য সাগরের তীরের দেশ, যুদ্ধ লাগল নাকি,  বিমান থেকে বোমাবর্ষণে মানুষ মরছে?

না, সন্ত্রাসবাদী হানা, পেত্যেকদিন মানুষ মরছে, মানুষই মারছে মানুষকে, সিরিয়া নামে একটা দেশের মানুষ সব তুরস্ক, লেবানন, আশপাশের দেশে গিয়ে ঢুকছে, সমুদ্দুর পার হয়ে গ্রিস দেশে যাচ্ছে, মাঝসমুদ্দুরে নৌকো ডুবিয়ে দেচ্ছে মিলিটারি, পুলিশে, সিরিয়া কোথায় বাবু?

লোকটি বলল, পশ্চিম এশিয়া, গৌরীকে আমি ম্যাপ চেনাতাম, গৌরী সব চিনে গিয়েছিল, গৌরীকে আমি আকাশের তারা চেনাতাম, গৌরীর খুব জানার ইচ্ছে, কিন্তু আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে সভ্যতা থাকবে না, গৌরী শুনে চোখের জল ফেলত, ওর মনে খুব মায়া ছিল।

দুলু বলল,  আমেরিকার কোন শহরে হলের ভেতরে গুলি করে হাজারপ্রায় লোককে মেরে দিলো বলুন। দুদিন আগে একটা পাগলকে চোর ভেবে পিটিয়েই মেরে দিলো নদীয়ায়। কত মানুষের ঘর পুড়িয়ে দিলো সিলেট, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। দুলু কামিল্যা  ট্রানজিস্টারের নব ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, বাংলাদেশ রেডিও আসে এখেনে, একই খবরই তো হয়, শুধু মৃত্যু, দুপারেই মৃত্যু, আগুন। মিয়ানমার দেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ ভয়ে সমুদ্র পাড়ি দেচ্ছে নৌকোয় করে, ঝড়-তুফানে মরছে, মানুষই মানুষের শত্রম্ন হয়ে উঠছে।

গৌরীকে বলতাম আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু, ইতিহাস, ভূগোল, আপনি বলছেন সব জ্বলছে!

আপনার কী হয়েছে? দুলু জিজ্ঞেস করে।

তিনি চুপ। তারপর বললেন, আমার এখন কী হবে আমি জানিনে।

কেন, দেখে মনে হয় আপনি অনেক জানেন, আমি কিছুই জানিনে, যা শুনি, রেডিওয়।

লোকটি বলল, জানতাম না, খবর পেয়েছি বিকেলে গাঙ পার হবার সময়।

কী খবর, মুম্বইয়ে কিছু হয়েছে, আমার ছেলে আছে, দুলু ভেঙে পড়ে যেন। রেডিওয় অবিশ্যি মুম্বাইয়ের কোনো খবর বলছে না। আজ ব্যাটারি এত ডাউন হয়ে গেল হঠাৎ করে, আপনি কিছু জানেন, খেয়া পার হতে হতে কী শুনলেন?

ঝড় আর বৃষ্টি আসছে। তিনি বললেন, মহাজাগতিক ঝড়, গৌরী তার ভেতরে প্রবেশ করেছে দেখতে পাচ্ছি, সে চলে যাবে ছায়াপথের কোনো এক তারায়। কতদূর, সে কতদূর! বিড়বিড় করতে করতে তিনি দূরের অন্ধকারে তাকালেন।

সবটা বুঝল না দুলু, বলল, ঝড়ের খবর তো রেডিওতেও বলছে, এদিকে ধান ঝাড়া হয়নি, ধান, আলু, কপি, শেষ হয়ে যাবে। কৃষিকথার আসরে বলছিল, আচ্ছা মুম্বইয়ে কিছু হবে না তো, ছেলে নিলু রে ফিরে আসতে বলব?

তিনি বললেন, তখন গাঙ পেরোব, মাঝি আমারে চেনে, বলল, দাদাবাবু দেরি করে আলেন।

দুলু বলল, কিসের দেরি?

আমি গৌরীর জন্য গোপালপুরের যতীন তাঁতির বোনা তাঁতের বস্ত্র নিয়ে এসেছিলাম, বুটিদার।

দুলু বুঝতে পারছিল না। কিন্তু আন্দাজ করতে পারছিল, বলল, কী হয়েছিল?

টেলিগ্রাম পেয়ে এইচি, এদিকে ডায়রিয়া হচ্ছে খুব।

আজ্ঞে না, ডেঙ্গু, অজানা জ্বর, পটাপট মানুষ মরছে।

কলেরা হলো, গৌরী, শাড়িটা খেয়ার মাঝি মনু মিঞারে দিয়ে দিইচি, ফিরার সময়, মিষ্টির হাঁড়িও দিলাম তারে, গৌরী নেই, বাড়ি অন্ধকার!

দুলু বলল, বাবু তুমি মোক্তারের জামাই, বাবু তুমার নাম?

আজ্ঞে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বলে তিনি উঠলেন। অন্ধকারের দিকে পা বাড়াতে আবদুল লতিফ কামিল্যা, দুলু বলল, দাঁড়ান, কোথায় যাচ্ছেন এখন কী করে যাবেন, ঝড় আসচে খুব বড়, রেডিওয় বলচে বাবু। আমার বাড়ি থেকি যান, দুঃখ নিয়ে অন্ধকারে যাবেন না একা।

তিনি অন্ধকারে ভেসে গেলেন যেন। আকাশ গুরগুর করছিল। বাতাস উঠল। রেডিওয় সতর্কবার্তা দিচ্ছিল। ঝড় উঠল। মহাজাগতিক তুফান আছড়ে পড়ল যেন অন্ধকার পৃথিবীতে। মৃত্যু আর ধ্বংসে উন্মত্ত সভ্যতায়। গৌরী নেই। নেই। নেই। দেশ-দেশান্তরে চলেছে দেশ হারানো মানুষের দল। রেডিও থেকে ঝড়ের শোঁ-শোঁ শব্দ ভেঙে পড়ছে দুলু কামিল্যার কানে। নিলু বুদ্ধিমান। নিলু নিশ্চয় নিলু কামিল্যাই নাম লিখিয়েছে সে-দেশে। বাপের নাম দুলু কামিল্যা। সাকিন বাগু–, উত্তর ২৪ পরগনা জেলা। চিনতে পারবে না কেউ। r