অন্ধ আঁখি কানে দেখে

মোরশেদুল ইসলাম-পরিচালিত আঁখি ও তার বন্ধুরা সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে। এটি কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল-রচিত কিশোর-উপন্যাস আঁখি ও আমরা কজন অবলম্বনে নির্মিত। শিশু-কিশোরতোষ চলচ্চিত্র আমাদের দেশে খুব বেশি নির্মিত হয়নি – হচ্ছে না। তবে এর প্রয়োজনীয়তার কথা ভাবা হয়েছিল ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল প্রাদেশিক আইন পরিষদে তৎকালীন শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম ও দুর্নীতি দমন বিভাগের মিনিস্টার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘The East Pakistan Film Development Corporation Bill, 1957’ শীর্ষক বিলটি যখন উপস্থাপন করেন, তখনই। বিলটির ওপর আলোচনা করতে গিয়ে প্রাদেশিক আইন পরিষদের মাননীয় সদস্য মো. এমদাদ আলী বলেছিলেন – ‘মিস্টার স্পিকার স্যার, আমি মিনিস্টার সাহেবকে একটা কথা বলব যে অন্যান্য দেশে দু’রকমের ফিল্ম আছে। একটা হল সার্বজনীন মঙ্গলের জন্য আর একটা হল শিশু শিক্ষার জন্য। মিনিস্টার সাহেবকে অনুরোধ করব এই দু’রকমের ফিল্ম যাতে হয় তার চেষ্টা করবেন। এতে শিশুদের নৈতিক চরিত্র ভাল হবে।’

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, এ-মনোভাবের প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৯৬৬ সালে – ওই বছরই ফজলুল হক নির্মাণ করেন এ-অঞ্চলের তথা পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম শিশু-কিশোরতোষ চলচ্চিত্র সান অব পাকিস্তা। এরপর ১৯৭৬ সালে সরকারি পর্যায় থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অনুদান প্রথা চালু হলে নীতিমালায় একটি শিশুতোষ চলচ্চিত্রকে অনুদান দেওয়ার বিধান রাখা হয় এবং সেই সূত্রে বাদল রহমান-প্রস্তাবিত শিশু-কিশোরতোষ চলচ্চিত্র এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী অনুদান পায়। এটি ১৯৮০ সালে মুক্তিলাভ করে। তবে এ-চলচ্চিত্রের আগে ১৯৭৮ সালে সুভাষ দত্ত-নির্মিত শিশু-কিশোরতোষ চলচ্চিত্র ডুমুরের ফুল মুক্তি পেয়েছিল। ২০১৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আঁখি ও তার বন্ধুরাও সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র। সরকারি অনুদানে এর আগে তিনি দীপু নাম্বার টু (১৯৯৬) এবং আমার বন্ধু রাশেদও (২০১১) তৈরি করেছিলেন। মোরশেদুল ইসলামই এদেশে ধারাবাহিকভাবে শিশু-কিশোরতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ করে চলেছেন। তাঁর শরৎ ’৭১ (২০০০), দূরত্ব (২০০৪), পুতুলের বিয়ে (২০১০) শিশু-কিশোরতোষ চলচ্চিত্রই।

সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত, মনন চলচ্চিত্র ও ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড-প্রযোজিত আঁখি ও তার বন্ধুরায় আঁখি নামে এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর কানে দেখার গল্প বলা হয়েছে। আঁখি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ স্কুলে পড়তে যায়। সেখানে সে প্রতিকূল অবস্থাতেও সহপাঠীদের সাহায্যে কীভাবে তার সহজাত ক্ষমতার প্রকাশ ঘটায় তা দেখানো হয়েছে চলচ্চিত্রটিতে। আলোচ্য চলচ্চিত্রটিকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করে পাঠ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভাগগুলো হচ্ছে : গল্প, নির্মাণ-প্রবণতা (দৃশ্য, শব্দ ও সম্পাদনাগত দিক) ও তাৎপর্য নির্ণয়।

 

গল্প

মুহম্মদ জাফর ইকবাল-রচিত উপন্যাস থেকে হুবহু সবকিছুই যে নির্মাতা নিয়েছেন তেমন নয় – কিছু অংশ নিয়েছেন, কিছু অংশ বর্জন করেছেন, আবার নিজে কিছু সংযোজনও করেছেন। এটা করতেই হয়, কারণ উপন্যাস আর চলচ্চিত্র আঙ্গিক হিসেবে একে অন্যের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। উভয়ের উপকরণ আলাদা। একটি পড়ার, অন্যটি দেখা ও শোনার মাধ্যম। তাই উপন্যাস থেকে বিষয় বেছে নিলে আঙ্গিকগত কারণেই এই রদবদল করতে হয়।

গল্প শুরু হয় টিটু নামে এক স্কুলছাত্রের বর্তমান অবস্থা নিয়ে। সে তার স্কুল সম্পর্কে কিছুটা বিরক্ত। কারণ তার শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষার্থীদের মনমানসিকতাকে গুরুত্ব দেন না। উলটো সামান্য কিছুতেই তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠেন। তদুপরি স্কুলের লাইব্রেরিটিও বন্ধ, কারণ শিক্ষকদের ধারণা, সেটি খোলা রাখলে ওখানে শিক্ষার্থীরা ক্লাসের পড়া বাদ দিয়ে অযথা সময় নষ্ট করবে। টিটুর মনও এজন্য ক্ষুব্ধ, কারণ সে লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়তে পারছে না।

ইতোমধ্যে টিটুদের স্কুলে ড. রাইসা নতুন হেডমিসট্রেস হিসেবে আসেন – এসেই স্কুলের পুরনো নিয়মকানুনের মধ্যে কিছু পরিবর্তন আনেন। তিনিই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আঁখিকে প্রাণিত করেন তাঁর স্কুলে ভর্তি হতে। তবে অন্য শিক্ষকরা আঁখিকে ভালোমতো গ্রহণ করেন না। আঁখি তখন স্কুল ছাড়ার কথা ভাবতে শুরু করে। কিন্তু তার সহপাঠীরা তাকে যেতে দিতে রাজি হয় না, তার পাশে এসে দাঁড়ায়। আঁখি জানায়, সে ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী’ একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এখানে থাকতে চায় না, অন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতো হয়ে থাকতে চায়। আঁখির বন্ধুরা তাকে এ-কাজে সাহায্য করে। কিন্তু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়ে সাধারণ মেয়েদের মতো চলাফেরা করা বেশ কঠিন কাজ। সে অন্যদের মতো মাঠে খেলতে অসমর্থ। তার কাছের বন্ধু টিটু লক্ষ করে, আঁখি চোখে দেখতে না পারলেও অন্যদের চেয়ে কানে অনেক দূরবর্তী শব্দ স্পষ্টভাবে শুনতে পায়। আঁখি যাতে ক্রিকেট খেলায় অংশ নিতে পারে সেজন্য সে এক মুচিকে দিয়ে এমন একটি ক্রিকেট বল বানায়, যা ছুটে চলার সময় শব্দ করে এগিয়ে চলে। বলটা সে আঁখিকে দিলে আঁখি পরম আনন্দিত হয়। আঁখি এখন খেলার সময় শব্দ করা উড়ন্ত বলকে জায়গামতো গিয়ে ধরে ফেলতে পারে, বলের শব্দ অনুসরণ করে ব্যাট দিয়ে তাকে আঘাত করতে পারে। আঁখি এভাবে খেলতে খেলতে দক্ষ ক্রিকেট খেলোয়াড়ে পরিণত হয়, সবাইকে দেখিয়ে দেয় যে, সুযোগ পেলে দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের মতো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী একজনও অনেক কিছু করে দেখিয়ে দিতে পারে।

স্কুলে আঁখির ক্রিকেট দল চ্যাম্পিয়ন হলে আঁখি ও তার বন্ধুরা মিলে তা উদ্যাপন করার জন্য বান্দরবানে বেড়াতে যায়। ওখানে এক ডাকাতের দল আঁখি ও তার পাঁচ বন্ধুকে অপহরণ করে। সবাইকে মানবপাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার জন্য ডাকাতরা জঙ্গলের ভেতর এক গোপন আস্তানায় তাদের বন্দি করে রাখে। কিন্তু আঁখি চোখে না দেখলেও কানে স্বাভাবিকজনের চেয়েও অনতিদূরের শব্দ বেশি শোনার ক্ষমতার কারণে ও দূর থেকে ভেসে আসা সিগারেটের গন্ধ নাকে পাওয়ার কারণে বন্ধুদের নিয়ে ডাকাতদের আস্তানা থেকে পালিয়ে আসতে সমর্থ হয় এবং তারই দূরদর্শিতার ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ডাকাতদলের সবাই ধরা পড়ে। শিশু-কিশোররা অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করে – এটি যেমন গল্পে আছে, চলচ্চিত্রেও তা আছে।

আঁখির দক্ষতা প্রদর্শনের নমুনা দেখে অন্য প্রতিবন্ধীরাও আঁখির স্কুলে ভর্তি হতে শুরু করে। এমনকি হুইলচেয়ারে বসে ক্লাস করা এক শিক্ষার্থীও স্কুলের ফুটবল দলে খেলায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। নির্মাণ-প্রবণতা

ক. দৃশ্য-নির্মাণ

চলচ্চিত্র বস্ত্তত একটি নির্মাণ শিল্প। দৃশ্যের চলৎপ্রবাহ তথা মুভিং ইমেজ দিয়েই প্রধানত গল্পকে বুনে যেতে হয়। দৃশ্যের সঙ্গী হয় শব্দ। এই দৃশ্য ও শব্দকে জুড়ে দিয়ে তথা সম্পাদনার মাধ্যমেই গল্পকে দর্শকের সামনে পেশ করা হয়। আঁখি ও তার বন্ধুরায় বাংলাদেশের প্রথিতযশা শিশু-কিশোরতোষ চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম এ-কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছেন।

এ-গল্প অন্য সাধারণ গল্প থেকে কিছুটা আলাদা ধরনের। একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর গল্পকে সবার দেখার-শোনার উপযুক্ত করে নির্মাণ করা নিশ্চয়ই একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল নির্মাতার জন্য। এই চ্যালেঞ্জ নির্মাতা তাঁর সহজাত প্রতিভাবলে নির্বাহ করেছেন। একটি চলচ্চিত্রে কয়েকটি ‘দৃষ্টিকোণ’ থেকে দৃশ্য ধারণ করা হয়ে থাকে – তার মধ্যে পরিচালক ও চরিত্রবর্গের দৃষ্টিকোণই প্রধান। সবার দৃষ্টিকোণের একত্রিত ব্যবহারেই একটি চলচ্চিত্র অবয়বপ্রাপ্ত হয়। আলোচ্য চলচ্চিত্রে সব দৃষ্টিকোণেরই সুষম ব্যবহার লক্ষ করি। গল্প প্রায়শই এগিয়ে যায় আঁখি ও তার বন্ধু, শিক্ষক-মুচি ও অন্য চরিত্রবর্গের দৃষ্টিকোণ থেকে; কখনো কখনো পরিচালকের দৃষ্টিকোণ থেকে। দৃষ্টিকোণসমূহ ধারণ করার ক্ষক্ষত্রে মাহফুজ-উর-রহমান খানের দক্ষ ক্যামেরা-সঞ্চালনকর্ম সহায়ক হয়েছে। ধীরগতির ট্র্যাকশট দৃশ্যপটে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।

দৃশ্য-সংগঠনে গল্পের পস্নট-সেট-লোকেশন বিরাট ভূমিকা পালন করে – এ-কাজে অশোককুমার ঘোষ দক্ষতা দেখিয়েছেন। গল্পকে বিশ্বাস্য করতে যা যা দরকার তিনি তা-ই করেছেন। অনেকের কাছে বান্দরবানের জঙ্গলে তৈরি ডাকাতদের ঘর নতুন মনে হতে পারে – কিন্তু এ-তথ্য যদি মাথায় রাখি যে, ডাকাতরা ধরা পড়ার ভয়ে অহরহ তাদের আস্তানা বদল করে থাকে, তাহলে বিষয়টি স্বাভাবিক বলেই মনে হবে। কিছুটা নতুন ঘর গল্পের সঙ্গে গেছে, কারণ সদ্যই হয়তো ডাকাতরা এই আস্তানা বানিয়েছে। এ-চলচ্চিত্রে বান্দবানের প্রকৃতিকে ভালোভাবেই ব্যবহার করেছেন নির্মাতা। ঘটনাখ-কে বাস্তবসত্যে পরিণত করার ক্ষক্ষত্রে প্রকৃতির অবদান কম নয় – বান্দরবানের সকাল-সন্ধ্যা-রাত গল্পখ-কে জীবন্ত করে তুলেছে। ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’ গানটির চিত্রায়ণ প্রকৃতিকে আরো মহীয়ান করে – কোথায় কী ঘটছে, তাতে যেন প্রকৃতির কিছুই যায়-আসে না!

অভিনয় দৃশ্যমাত্রার সবচেয়ে বড় মৌলিক উপকরণ – গল্পপ্রধান চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে সবকিছু আছে; কিন্তু অভিনীত দৃশ্যে ‘অভিনয়’ যদি না থাকে তাহলে দৃশ্যটি দর্শকমননে কোনো অভিঘাতই তৈরি করবে না। এ-চলচ্চিত্রে সবার প্রাণবন্ত অভিনয় গল্পের জগৎকে সজীব করে রেখেছে, চোখকে ঘটনাস্থল থেকে সরতে দেয়নি। বোঝা যায়, শিশু-কিশোরদের কাছ থেকে এ-অভিনয় বের করে আনার পেছনে সক্রিয় ছিলেন মোরশেদুল ইসলাম। এ-কাজে তিনি বরাবরই পারঙ্গমতার পরিচয় রেখেছেন। আঁখি এ-চলচ্চিত্রের গল্প-কেন্দ্রে অবস্থান করে, সে চোখে দেখে না বটে; কিন্তু শব্দ শুনে, গন্ধ শুঁকে অনেক কিছু আঁচ করতে পারে। এহেন চরিত্রে আঁখিরূপী জাহির নওয়ার হক ইশা বাস্তবানুগ অভিনয় করেছেন। তবে কিছু জায়গায় চোখের পলক না ফেলে তা অনেকক্ষণ ধরে রাখায়
অভিনয়-মুহূর্তটি মেকি মনে হয়েছে।

চলচ্চিত্রটির শেষের দিকে এসে দৃশ্যখ-গুলো গতিবন্ত হয়ে ওঠে। আঁখি ও তার বন্ধুরা বন্দিদশা থেকে কৌশলে মুক্ত হয়ে পালানোর সময় আঁখির ঘ্রাণেন্দ্রিয় প্রখর বলে তারা পুনরায় ধরা পড়ার হাত থেকে বেঁচে যায়। আঁখি বেশ দূর থেকে সিগারেটের গন্ধ পেয়েই বুঝতে পারে, কাছে কোথাও কেউ আছে। সবাইকে সতর্ক করে সে। তার কারণেই পাহারাদারকে কাবু করতে সমর্থ হয় সবাই। পাহারাদারের ছুড়ে ফেলা সিগারেটের আগুন থেকেই জমিয়ে রাখা গোলা-বারুদে বিস্ফোরণ ঘটে – বিস্ফোরণের শব্দ ও ধোঁয়  শুনে-দেখেই ঘটনাস্থলে সেনাসদস্যরা আসে, ডাকাতদলকে পাকড়াও করে। ডাকাত-সর্দার কাদেরের ধরা পড়ার দৃশ্যটি উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেছে – শিশু-কিশোর তথা দর্শকের কাছে জায়গাটি উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।

দৃশ্যমাত্রার একটি বিশেষ দিক হচ্ছে রং-বিন্যাসকর্ম। শুটিংয়ের সময় নানা জাতের আলো ব্যবহৃত হয়, একেক আলো একেক রং ধারণ করে থাকে। ক্যামেরার মাধ্যমে ধারণকৃত শট তাই ভিন্ন ভিন্ন রং-সম্পন্ন হয়। সম্পাদনার সময় শটগুলো জোড়া দিয়ে গল্পকে এগিয়ে নিতে হয়। তখন প্রায়শই বর্ণবিভ্রাট চোখে পড়ে। বর্ণ বা রংগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য না আনলে দৃষ্টিকটু তো লাগেই, সময়ের ধারাবাহিকতাও ক্ষুণ্ণ হয়। এ-চলচ্চিত্রে রঙের মধ্যে সমন্বয়ের কাজটি সম্পন্ন করেছেন সুজন মাহমুদ। এক্ষিত্রে তাঁর সৃজনশীলতার প্রকাশ লক্ষ করা গেছে। সাধারণত নির্মিত চলচ্চিত্রের রং-বিন্যাসের জন্য একটি টোন বেছে নেওয়া হয় – এটা নির্ভর করে প্রধানত চলচ্চিত্রটির গল্প, মেজাজ ও পটভূমির ওপর। এ-চলচ্চিত্রে তেমন কোনো টোন ব্যবহৃত হয়েছে কি না ধরতে পারিনি। এটা আমার অসামর্থ্য হতে পারে। তাছাড়া টোন ব্যবহার করতেই হবে এমন কোনো কথাও নেই।

 

খ. শব্দ-নির্মাণ

এ-চলচ্চিত্রে শব্দধারণ ও পুনরুৎপাদনের কাজটিও করেছেন সুজন মাহমুদ। তাতেও নিজ দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন তিনি। সংলাপ শব্দমাত্রার প্রধান উপাদান। স্টুডিওতে ডাবিংকৃত সংলাপই দৃশ্যের সঙ্গে বয়ে গেছে। ডাবিং বলতে গেলে একেবারে নিখুঁত। পারিপাশি^র্ক শব্দরাজিও ঘটনাখ- অনুযায়ী প্রযুক্ত হয়েছে। রাতেও কিছু পাখির ডাক শোনা গেছে। অনেকের খটকা লাগতে পারে এই ভেবে যে, রাতেও আবার পাখি ডাকে নাকি? সচরাচর সমতলভূমিতে দু-একটি পাখি ছাড়া অন্য পাখিরা রাতে নীরবই থাকে; কিন্তু পাহাড়ি এলাকায় রাতে বেশকিছু পাখি ডাকে। তাদের ডাকই সাউন্ডট্র্যাকে শোনানো হয়েছে।

এ-চলচ্চিত্রের সাউন্ডট্র্যাক গঠিত হয়েছে ফাইভ-পয়েন্ট-ওয়ান প্রক্রিয়ায়। এতে নানা কোণ থেকে শব্দ শোনা গেছে – মাঝে মাঝে শব্দ ভেসে যাচ্ছে, দূর থেকে কাছে বা কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে – এতে দৃশ্যখ– বাস্তবানুভূতি তৈরি হয়েছে, যদিও সবসময় এ-পদ্ধতি মানসম্পন্ন ইফেক্ট দেয়নি, আর্টিফিশিয়াল লেগেছে। তবে দৃশ্যের মতো শব্দের ক্ষক্ষত্রেও যে লং শট, মিডিয়াম শট, ক্লোজআপ শট ইত্যাদি আছে তা শব্দের পারস্পেকটিভ তৈরির প্রচেষ্টা থেকে ধরা পড়েছে। শব্দশিল্পী সুজন মাহমুদ জেনেবুঝেই কাজটি করেছেন। শব্দ-সংমিশ্রণের কাজটিও দক্ষতার সঙ্গেই করা হয়েছে।

 

গ. সম্পাদনা

সম্পাদনাকর্মটিও সুজন মাহমুদই নিষ্পন্ন করেছেন। একরৈখিকভাবে গল্প এগিয়ে গেছে বলে এর সম্পাদনারীতিও হয়েছে
একরৈখিক-ধারাবাহিক। দৃশ্যখ-সমূহের দৈর্ঘ্য নির্ধারিত হয়েছে গল্পকে গতিশীলভাবে টেনে নেওয়ার তাগিদ থেকে। এর ফলে বেশ সংহত-সংযত মনে হয়েছে সম্পাদনাকর্মটি। কোথাও গল্প ঝুলে গেছে – এমন মনে হয়নি। সব মিলিয়ে সুজন মাহমুদের প্রশংসা করতেই হবে – তিনি একাই শব্দ ও রং-বিন্যাস এবং সম্পাদনার মতো তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন, তাঁর কাজে তিনি নান্দনিকবোধের প্রমাণও রেখেছেন।

 

তাৎপর্য নির্ণয়

গল্পে প্রাথমিকভাবে তাৎপর্য গুঁজে দিয়েছেন উপন্যাসকার মুহম্মদ জাফর ইকবাল নিজেই। সেই তাৎপর্যকে মান্য করেই মোরশেদুল ইসলাম তা দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমে পরিবাহিত করেছেন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরাও যে সুযোগ পেলে দেখিয়ে দিতে পারে, তার কথাই বলা হয়েছে গল্পে-চলচ্চিত্রে। এটাই এ-চলচ্চিত্রের প্রধান তাৎপর্যগত দিক। তাৎপর্য তথা বক্তব্য-মন্তব্য-ভাব সৃষ্টির প্রশ্নে বলা যায় উপন্যাসকার ও নির্মাতা একে অন্যের পরিপূরক।

যে-শিক্ষক সবকিছুতে বাধা দিত – তিনিও শেষের দিকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আঁখির সামর্থ্য দেখে নিজের মানসিকতায় পরিবর্তন আনেন। শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, এক নতুন শিক্ষার্থী হুইলচেয়ারে করে মাঠে সবার সঙ্গে ফুটবল খেলছে। তারপর স্কুলে প্রবেশ করার সময় প্রধান শিক্ষক্ষকা যখন তার হুইলচেয়ার ধরে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে তুলে দিতে উদ্যত হন, তখন ওই শিক্ষকও হাত লাগান এবং এরকম প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী যাতে সিঁড়ি দিয়ে নিজেই উঠতে পারে তার জন্য সিঁড়ির এক পাশে সেস্নাপ বানাতে বলেন। এখানেও একটি বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে বটে।

চলচ্চিত্রটি দর্শনে শিশু-কিশোররা তাদের ‘নৈতিক চরিত্র’ উন্নত রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে। বড়রাও প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের প্রতি তাঁদের আচরণের মাত্রা সম্পর্কে সজাগ হবেন, শিশুমনস্তত্ত্বের বিভিন্ন দিক উপলব্ধি করতে সমর্থ হবেন এবং তাদের মানসিক বিকাশে সহায়তা করবেন – এ-ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণের সর্বোচ্চ গুরুত্ব-তাৎপর্য এখানেই। মোরশেদুল ইসলাম ঠিক এই কাজটিই করে চলেছেন – শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমেই নয়, একসময় শিশু-কিশোরদের নিয়ে ‘ঢাকা লিটল থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন; এখন ‘চিলড্রেন্স ফিল্ম সোসাইটি বাংলাদেশ’ গঠন করে এর কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি প্রতিবছর ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেন্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়ায় শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণের ক্ষক্ষত্রে এ-আয়োজন বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।

সবকিছুর ভেতর দিয়ে তিনি শিশুমনের কৌতূহল জাগ্রত করছেন; তাদের দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করছেন। তার প্রমাণ বিধৃত আছে আঁখি ও তার বন্ধুরা চলচ্চিত্রেও। শিশুরাও যে সুযোগ পেলে তাদের সৃজনশীলতাকে নিজেরাই আবিষ্কার করতে পারে, তার সৃষ্টিশীল প্রকাশ ঘটাতে পারে, সে-বক্তব্যই মোরশেদুল ইসলাম রেখেছেন চলচ্চিত্রটিতে। তাঁর কর্মস্পৃহা অব্যাহত থাকুক, অন্যরাও তাঁর দেখানো পথে এগিয়ে আসুক। না হলে শিশু-কিশোরতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণের ধারা এদেশে মজে যাবে। এ-ধারা জিইয়ে রাখতে দর্শকদেরও অবশ্যপালনীয় ভূমিকা আছে – তাদেরও সিনেমা হলে নিজেদের সমত্মানদের নিয়ে যেতে হবে, বেশি বেশি করে।

 

চলচ্চিত্র-পরিচিতি

চলচ্চিত্র : আঁখি ও তার বন্ধুরা। শুটিং ফরম্যাট : ফোর কে ডজিটাল। অ্যাসপেক্ট রেশিও : ১: ১.৮৯। সাউন্ড : ৫.১। দৈর্ঘ্য : ১১৪ মিনিট। উপন্যাস : মুহম্মদ জাফর ইকবাল। চিত্রনাটক : মোরশেদুল ইসলাম ও মারুফ বাকার। পরিচালনা : মোরশেদুল ইসলাম। প্রযোজক : ফরিদুর রেজা সাগর ও মোরশেদুল ইসলাম। চিত্রগ্রহণ : মাহফুজ-উর-রহমান খান। সম্পাদনা, শব্দ ও রং-বিন্যাস : সুজন মাহমুদ। শিল্পনির্দেশক : অশোককুমার ঘোষ। আবহসংগীত : সানি জুবায়ের। পোশাক-পরিচ্ছদ : প্রীতি রোজারীও। অভিনয়শিল্পী : জাহির নওয়ার হক ইশা, অনন্যা সামায়েল, জাওরিয়া আহমেদ প্রত্যাশা, আরিয়না কবির, শাকিল আহমেদ, আয়মন আহমেদ অরিয়ন, আবদুস শিহাব আপন, সৈয়দ আশিকুজ্জামান রোমিও, ধ্রম্নবমত্মী, নাভিদ হাসান অমি, সুবর্ণা মুস্তাফা, তারিক আনাম খান, আল মনসুর, এসএম মহসীন, মান্নান হীরা, আফসানা মাহমুদ, মুনিরা ইউসুফ মেমী, কমল ঘোষ, উদয়ন বিকাশ বড়ুয়া, সুস্মিতা সিনহা, খান জাহাঙ্গীর আলম, কমল সিদ্দিকী প্রমুখ। প্রযোজনা : মনন চলচ্চিত্র ও ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড। মুক্তি : ২২ ডিসেম্বর ২০১৭।