ভুবনযাত্রীর পায়ে পায়ে

মাহবুবা রহমান

নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কোনো ভ্রমণকারীর ভ্রমণ হয়ে ওঠে পর্যটন। অনেকেই দূর-দূরান্তে যান, অনেক কিছু দেখেন কিন্তু সে-দেখা কেবল ‘চোখের দেখা’ হয়ে থাকে। ‘দেখার চোখ’ না থাকলে কোনো ভ্রমণ ভ্রমণও হয়ে ওঠে না, পর্যটন তো দূরের কথা। সে কেবল ঘুরে বেড়ানো মাত্র। সে-কাহিনি সাধারণত কেউ লেখেও না। কারণ কিছুই তো দেখা হয়নি আসলে, অন্যকে কী দেখাবেন। রবীন্দ্রনাথের দোহাই দিয়ে বলতে পারি – নিজেকে জানাটাই শেষ কথা নয়। নিজেকে জানানোও ততটাই জরুরি। তেমনি কোনোকিছু দেখাটাই সার্থক হয়ে ওঠে না যদি বলে, লিখে সেই দেখাটাকে দেখানো না যায়। বাংলা-সাহিত্যে সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পালামৌ হয়ে উঠেছিল এক অর্থে প্রথম সার্থক ভ্রমণকাহিনি। চেনা বিষয়ের ভেতর অচেনাকে দেখা, অচেনা বিষয়ের ভেতর চেনা বিষয়কে খুঁজে বেড়ানোর চেয়ে কঠিনই বলা যায়। বাংলা সাহিত্যের রবীন্দ্রনাথ, প্রবোধকুমার সান্যাল, অন্নদা শংকর রায়, সৈয়দ মুজতবা আলী থেকে শুরু করে অনেকেই মন-মাতানো, হৃদয়গ্রাহী ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন। বাংলাদেশের লেখকদের ভেতরে অল্প কজনই তেমন ভ্রমণকাহিনি লিখতে পেরেছেন। তবুও আমরা হাসান আজিজুল হক, হুমায়ূন আহমেদ, রাবেয়া খাতুন প্রমুখের ভ্রমণকাহিনি পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। সাম্প্রতিককালে মঈনুস সুলতান, শাকুর মজিদের মতো কয়েকজন ব্যক্তিত্ব ভ্রমণকাহিনি লিখে বিশিষ্টতার প্রমাণ দিয়েছেন।

তাঁদের লেখা ভ্রমণকাহিনি আদৃত হয়েছে অনেকের কাছে। আর ভ্রমণকাহিনি লেখক হিসেবে তাঁরা পেয়েছেন পুরস্কার, হয়েছেন সংবর্ধিত। সম্প্রতি শাকুর মজিদের ভ্রমণকাহিনি নিয়ে চারটি খণ্ডে ভ্রমণসমগ্র প্রকাশিত হয়েছে ঢাকার অভিজাত প্রকাশনী ‘কথা’ প্রকাশ থেকে। ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত শাকুর মজিদ পাঁচটি ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন। সংযুক্ত আরব-আমিরাত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের তিনটি শহরে এবং ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের কয়েকটি শহরের গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল এই ভ্রমণকাহিনিগুলো। সেই ভ্রমণকাহিনি নিয়ে যথাক্রমে আমিরাতে তেরোরাত, আমেরিকা : কাছের মানুষ দূরের মানুষ, সক্রেটিসের বাড়ি, পাবলো নেরুদার দেশে, নদীর নাম টে শিরোনামে এই পাঁচটি ভ্রমণকাহিনি প্রথম খণ্ডে বিপুল পরিমাণ রঙিন আলোকচিত্রসহ প্রামাণ্যরূপ পেয়েছে। প্রথম পৃষ্ঠা থেকেই পাঠকরা লেখকের সঙ্গে ঢুকে পড়বেন তাঁর ভ্রমণের জগতে। তাঁর ঘুরে বেড়ানো অঞ্চলের নিবিড় পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে ওইসব এলাকার সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক নানা বাস্তবতা। যেমন – ‘বিদেশিরা আমিরাতের যে কানুনটি নিয়ে সবচে বেশি শংকিত তা হচ্ছে আঠারো বছর বয়স হবার পর কোনো বিদেশি আমিরাতের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে পারবে না, তবে পড়াতে পারবে। পড়াতে পারবে এ জন্যই যে, আমিরাতের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর মতো পূর্ণ নাগরিক এখনো তাদের মধ্য থেকে হয়ে ওঠেনি। আল আইনে এক বাংলাদেশির আকামায় (পরিচয়পত্রের আরবি নাম) চোখ বুলিয়ে অবাক হলাম। কারণ পরিচয়পত্রটি বিদেশির জন্য, কিন্তু সম্পূর্ণ আরবি ভাষায় লেখা। তাকে বললাম – বাহ্। তাদের মাতৃভাষার প্রতি এত শ্রদ্ধা? ভদ্রলোক আমার মুখের ওপর জবাব দিলেন – কিসের মাতৃভাষা? এটা করা হয়েছে পুলিশদের জন্য। আরব পুলিশেরা কি ইংরেজি জানে? অবশ্য এখন কিছু কিছু পুলিশ ইংরেজি বুঝতে ও পড়তে পারে, কিছু কিছু শরিকা ইংরেজি ও আরবি ভাষায় আকামা ছাপাচ্ছে। আরবরাও এখন ধীরে ধীরে শিক্ষিত হয়ে উঠছে।’ এই ছোট্ট বর্ণনার ভেতর দিয়ে পাঠক সহজেই বুঝতে পারবে শিক্ষা ও ভাষাগত দিকে তাদের বাস্তবতা একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। লেখক তুলে ধরেছেন শিক্ষাগত ক্ষেত্রে আরব-আমিরাতের নানা অগ্রগতির পরিসংখ্যান। আরব-আমিরাত থেকে অনেক দূরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আরব-আমিরাত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের আনাগোনা এখন প্রায় নিত্যই বলা চলে। ফলে শাকুর মজিদকে আমেরিকাবিষয়ক ভ্রমণকাহিনি লিখতে এমন কিছু হাজির করতে হয়েছে, যা বহুবার বহুজনের লেখায় থাকলেও শাকুর মজিদের লেখার গুণে হয়ে উঠেছে নতুন। যেমন ‘পাপের শহর : লাসভেগাস’ উপশিরোনামে থাকা অংশটি পড়লে বোঝা যায় তিনি সেখানকার বিলাস-ব্যসনে জীবন উদযাপনের একটি নতুন জগৎ আবিষ্কার করেছেন। – ‘আলো নিভে গেলে পর্দা সরে গেলে। মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো নর্তকীর দল। মাইকে ঘোষণা হলো ম্যাসিকান নৃত্য শুরু হবে এখন; কিন্তু পারফর্মারদের দিকে ঠিকমতো তাকানো যাচ্ছে না। অন্ধকার ঘরে সামান্য নীলাভ আলো জ্বলে উঠেছে মাঠের কোনায়। নর্তকী দলের মেয়েরা স্টেজ ছেড়ে দর্শকের আসনের অর্ধেক পর্যন্ত এসে একটা অর্ধবৃত্ত বরাবর দৌড়ে আবার মাঠের ভেতর গর্তে ঢুকে গেল। যারা এলো আর গেল, এদেরকে ভালো করে দেখা হয়নি। অনেকক্ষণ তাকানোর পর বুঝতে পারলাম তারা কেবল কোমরের কাছে গাছের পাতার মতো এক ধরনের সামান্য কাপড় পরে এসেছিল। হঠাৎ করে চড় খেলে যা হয়, অনেকটা সে রকম। মানসিক প্রস্তুতি এমন ছিল না, এখানে ওয়েলকাম ডান্সটা হয় শরীরে কোনো কাপড় না পরে।

কিন্তু এরপর যা দেখলাম তা ভোলার নয়। দেড় ঘণ্টার এই প্রদর্শনী। এখানে জাদু ছিল, সার্কাস ছিল, নাচ ছিল, গান ছিল, অন্ধকূপের মোটরসাইকেল খেলা ছিল। ঠাস করে মঞ্চ দুভাগ হয়ে যাওয়া, নিমেষেই ব্যাক স্ক্রিন পরিবর্তন হওয়া, মঞ্চ ঘুরে যাওয়া এবং নিমেষের মধ্যে ব্যালে নাচের জন্য বরফের আস্তরণ গড়ে তোলা – এর সব কিছুতেই ছিল অতি উঁচুমানের প্রদর্শন। এর মধ্যে নকল ম্যাডোনা আর নকল মাইকল জ্যাকসনের নাচ-গান দেখে অনেক দেরিতেই মনে হবে যে, আসলেই ওরা আসল নয়।’ এমনি আরো অনেক চোখধাঁধানো জীবন ও মানুষের বিচরণ তাঁর এই ভ্রমণকাহিনিতে। সক্রেটিসের বাড়ি ভ্রমণকাহিনিটি শিরোনামের কারণেই যেন যে-কোনো বোদ্ধা পাঠককে আকৃষ্ট করবে। এই কাহিনির শুরুতেই অ্যাডলফ হিটলারের ছবি এবং তার নিচে লেখা উদ্ধৃতিটি ‘Adolf Hitler-Socrates Napoleon Bonapart : The man was who has no sense of history, is like a man who has no ears or eyes.’ আমাদের চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে বার্লিন, প্যারিস এবং এথেন্সের হৃদয় বৃত্তান্ত জানতে। ‘সক্রেটিসের জেলখানা’ নামক অনুচ্ছেদে প্লেটোর সংলাপে একটি চুম্বক অংশ পাওয়া যাবে।

সক্রেটিসের বাড়ি নামে ভ্রমণকাহিনিটির নাম হলেও বার্লিন এবং প্যারিস এই ভ্রমণকাহিনির প্রধান আকর্ষণ হতে পারে। প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে সাম্প্রতিককালের যোগসূত্র এই ভ্রমণকাহিনিটিকে করেছে প্রামাণ্য এবং বাঙ্ময়ও।

পাবলো নেরুদার দেশে প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৩ সালে। পৃথিবীর এই মহান কবিকে প্রামাণ্যভাবে দেখা হয়ে যায় তাঁর দেশ চিলির নানা অঙ্গনের চলচ্ছবির মাধ্যমে, যা শাকুর মজিদের কুশলীকলমে উঠে এসেছে। কবির জীবনের নানা জানা-অজানা বিষয় এই কাহিনির অন্যতম আকর্ষণ। ‘বেলাভিস্তা গ্রামের শেষ মাথায় সান ত্রিস্টোবাল পাহাড়ের নিচে নেরুদা তাঁর তৃতীয় স্ত্রী মাতিলদেকে নিয়ে গোপনে বসবাস করার জন্য ১৯৫৩ সালে পরিত্যক্ত একটা বাড়ি কিনে বসবাস শুরু করেন। বাড়ির নাম দেন লা কাস কনদা। মানে ‘কোঁকড়ানো চুল’। তাঁর নতুন স্ত্রীর চুলের আকার থেকে এসেছে এ-বাড়ির নাম। রাস্তার ওপর থেকে সরাসরি একটা ছোট্ট সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে হয়। সেখানে সাজিয়ে রাখা নেরুদাকে স্মরণ করা যায় এমন জিনিসপত্র। এটাই পাবলো নেরুদা ট্রাস্টের পরিচালনায় সান্তিয়াগোতে নেরুদা মিউজিয়াম। স্যুভেনির শপে জনপ্রতি ৫ ডলার টিকেট কেটে ভেতরের দরোজা দিয়ে ঢুকতেই খোলা উঠান। পাবলো নেরুদার লা চাসকোনা বাড়ির বাইরের বাগান।’ ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের কয়েকটি শহরের কথা জীবন্ত হয়ে উঠেছে নদীর নাম টে ভ্রমণকাহিনিটিতে। আগেই বলা হয়েছে, পুরো বইয়ে প্রায় প্রতিটি পৃষ্ঠায় চাররঙা আলোকচিত্রের শৈল্পিক সমাহার। এতে ভ্রমণকাহিনিগুলো এতটাই মনোগ্রাহী হয়েছে, যেন সেখানে না-গিয়েও কোনো পাঠক ওই এলাকাটি অনুপুঙ্খভাবে দেখতে পারবেন। যেমন – ‘এডিনবারায় ইতিহাসের শেষ নেই, ঘটনার শেষ নেই। কিন্তু অত কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার মতো এত সময়ই-বা আমার কোথায়? মনে মনে মিরনের প্রতীক্ষা করি, আর তাদের পুরনো গলিপথ দিয়ে হেঁটে বেড়াই। হঠাৎ দেখি একটা রাস্তা দুভাগ হয়ে দুদিকে চলে গেছে। এই রাস্তার মোড়ে একটি স্তম্ভের ওপর বসে আছে এক সারমেয়। নিছক একটি স্থাপত্যকর্ম নয়, এর পেছনে একটি কাহিনি লুকিয়ে আছে। যে-সারমেয়টি আমরা দেখছি, তার নাম ববি। ববির যখন দুই বছর বয়স তখন ববির মালিক গ্রেফেয়ারস মারা গিয়ে তার নাম হয় গ্রেফেয়ারস কিরকেয়ার্ড। কিন্তু বাদ সাধল ববি, সে তার মালিকের কবর ছেড়ে এক পাও নড়বে না। কী আর করা, স্থানীয়রাই তিন বেলা ববিকে খাবার দিয়ে আসত। এরও চোদ্দো বছর পর ১৮৭২ সালে ববি মারা যায়। পরে এই চার্চ-চত্বরে বেদির ওপর ববির মূর্তি বানিয়ে ববিকে অমর করে রেখেছে এডিনবারাবাসী।’

শাকুর মজিদের ভ্রমণসমগ্রের দ্বিতীয় খণ্ডটি চারটি ভ্রমণকাহিনি নিয়ে সংকলিত। চীনের সরকারি টেলিভিশন সিসিটিভির আমন্ত্রণে সে-দেশের মোট ছয়টি রাজ্য সফল করে দুটো আলাদা ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন শাকুর মজিদ। প্রথমটি হলো মিং রাজার দেশে এবং দ্বিতীয়টি নাশিপাড়া লিজিয়াং অন্য দুটি ভ্রমণকাহিনির দেশগুলোও এশিয়ার অন্তর্গত। এর ভেতরে আছে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। মিং রাজার দেশে ভ্রমণকাহিনিটি শুরু হয়েছে Mao Zedong-এর উদ্ধৃতি – ‘War can only be abolished through war, and in order to get rid of the gun it is necessary to talk up the gun.’ দিয়ে। শুরু করেছেন বেইজিং শহরের কথা দিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই সেই শহরের মানুষজন, পরিবেশ-প্রকৃতি, আবহাওয়া লেখকের দ্রষ্টব্য বিষয় ছিল। যেমন – ‘বেইজিংয়ে শীতকালে অনেক শীত হয়, বরফ জমে। গ্রীষ্মে বাদলাও কম যায় না। কিন্তু আগস্টের ভোরে এমন গুমোট সাধারণত থাকে না বেইজিংয়ের আকাশ। কিন্তু আজ বেশ মেঘলা। ঘনকুয়াশার ভেতর দিয়ে গাড়ি চলছে এবং একসময় টের পেলাম, বৃষ্টি তাড়িয়ে নিচ্ছে আমাদেরকেও। ঘণ্টা-দেড়েকের মাথায় যেখানে এসে আমাদের বাস পার্কিং করে রাখা হলো, সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে তিন হাজার ফুট উচ্চতার প্রাচীর চূড়াটি।’ গিয়েছেন ইতিহাসের দিকেও। ‘চীনের এই মহাপ্রাচীর নির্মাণের ইতিহাসটিও খুব সুখকর ছিল না। শাসকবর্গের কঠিন আদেশের মুখে শ্রমিকরা বাধ্য ছিল এই কঠিন নির্মাণকাজের জন্য। শত শত শ্রমিক এই কঠিন কাজটি করতে পাথরচাপা পড়ে মারা গেছে। প্রায় দুশো কোটি ঘনফুট মাটি ভরাট করতে হয়েছিল এই প্রাচীর নির্মাণে। যেসব নির্মাণশ্রমিক এই কাজে নিযুক্ত ছিলেন, তাদের বেশিরভাগই ছিল যুদ্ধবন্দি। বালু, মাটি আর পাথরকুচি ছাড়া অন্য যেসব উপকরণ দিয়ে দুই দেয়ালের মাঝখানের জায়গাটি ভরাট করা হয়েছিল তা ছিল শ্রমিকদের মরদেহ।’

নাশিপাড়া লিজিয়াং কাহিনি শুরুর উদ্ধৃতিটি এত সাধারণ কিন্তু কতই না অনন্যসাধারণ। ‘Build a hut, marry a Naxi girl and enjoy the sunshine.’ – পুরো জীবনটাই যেন এই ছোট্ট উদ্ধৃতিতে অপূর্ব এক সুরে বেজে ওঠে। যথারীতি এই কাহিনিতেও ইতিহাস, রাজনীতিতে সমকালীন জীবন প্রতি পরতে পরতে মিশে গেছে। ‘কুবলাই খান যখন এখানে ঘাঁটি গেড়ে বসেন, সে-সময়ের স্থানীয় শাসক মু-পরিবার কুবলাই খানের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। তখন থেকেই এই শহরের রাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে যায়। রাজনৈতিক গুরুত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ-শহর ব্যবসা-বাণিজ্যেও প্রসারতা লাভ করতে থাকে। এই শহরের বয়স এক হাজার বছর। এটিই চীনের একমাত্র প্রাচীন শহর, যে-শহরটি রক্ষাপ্রাচীর দিয়ে কখনোই ঘেরা ছিল না। এটি ছিল একেবারেই উন্মুক্ত। এই প্রাচীন শহরের রক্ষাপ্রাচীর না থাকার কারণটাও বেশ মজার। এ-শহরের মু-পরিবারটি প্রায় পাঁচশো বছর শাসন করেছিল। তারা মনে করত রক্ষাপ্রাচীর দিয়ে শহর ঘিরে দেওয়া মানে কারো ভয়ে ইঁদুরের গর্তে ঢুকে বসে থাকা।’

মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর ভ্রমণের ঝলমলে ভ্রমণকাহিনি ‘মালয় থেকে সিঙ্গাপুরী’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৬-০৭-এ সেখানের ভ্রমণ নিয়ে। মালয়েশিয়া আমাদের কাছে যেন Mahathir Mohammad-এর দেশ। ফলে তাঁর উদ্ধৃতি – ‘When I travel around, I look at things carefully; make comparisons of what I see. I don’t accept things at face value, you cannot trust what you hear or see. I was also following something my mother taught me. When you are enjoying a real good meal, stop when the food is still good. So, I guess it’s good for me to stop now’ দিয়ে শুরু হবে কাহিনি এটাই স্বাভাবিক। কুয়ালালামপুর সত্যিই এক দৃষ্টিনন্দন শহরের নাম। কিন্তু সেখানের নান্দনিকতার সঙ্গে মিলেছে শৃঙ্খলা। যেমন – ‘কুয়ালালামপুরের স্থানীয় অধিবাসীরা তাদের প্রয়োজনে স্টেশন থেকে স্টেশনে নেমে যাত্রাপথ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু আমাদের কোনো গমত্মব্য নেই। আজ সারাদিন ঘুরে ঘুরে কুয়ালালামপুর দেখে সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে যাওয়া আমাদের কাজ। আমরা কোন স্টেশনে নামব তার কোনো ঠিকানা নেই। যে-কোনো জায়গায়ই নেমে যেতে পারি, আবার চাইলে পথের শেষ মাথায়ও যেতে পারি। সুতরাং সবচে বেশি দূরত্বের টিকেটটি কেটে আমরা বুকিত বিনতাংয়ে স্টেশনটি থেকে উঠে রওনা দিয়েছি শহরের শেষ প্রান্তের দিকে।

দূরত্ব হিসেবে এগারোটি রেলস্টেশনে যেতে দু-রকমের দাম আছে টিকেটের। সোয়া রিংগিত আর আড়াই রিংগিতের টিকেট কেটে রাস্তার ওপরের রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া যায় শহরের অপর প্রান্তে। কেবল চলাচলই নয়, এক জায়গায় বসে যিনি কুয়ালালামপুর শহর দেখতে চাইবেন, তার কাছে এই মনোরেল ভ্রমণটি বড় তাৎপর্যের। মনোরেল বলেই অনেক ওপর থেকে ঘুরে ঘুরে শহরটাকে দেখা যায়।’

জীবনযাপনের সঙ্গে সঙ্গে জীবন উদযাপনের নানা দিক মালয়েশিয়ার মানুষেরা কত না বৈচিত্র্যে লালন করেন তার কাহিনি, গল্প তুলে এনেছেন শাকুর মুজিদ। আধুনিক সিঙ্গাপুর বিজ্ঞান-প্রযুক্তি উন্নয়নের এক রোল মডেল। সংস্কৃত সিংহপুর ব্রিটিশদের কাছে হয়ে গেছিল সিঙ্গাপুর। দুশো বছর আগে জঙ্গলে ঘেরা এই দ্বীপটি চীন-মালয়েশিয়া ও শ্রীলংকা থেকে আসা মানুষেরা নতুন করে গড়ে তুলেছিল। তারই ফলে ইতিহাসের নানা পথ পাড়ি দিয়ে হয়ে উঠেছে আজকের সিঙ্গাপুর। সেখানে বর্তমানে বাংলাদেশির সংখ্যাও কম নয়। ‘লিম্বো রো : সিঙ্গাপুরের বাঙালিপাড়া’ শিরোনামের অংশটি সেখানের বাঙালি জীবনকে চলচ্চিত্রের মতো হাজির করেছেন। ‘এই বাংলাদেশি পাড়াটা আমারও ভালো লেগে যায়। বেশ কয়েকটা রেস্টুরেন্ট আছে। ঢাকার নামি বাংলা রেস্টুরেন্টগুলোর নামে নাম কস্তুরী, রাঁধুনি, বৈশাখী, খাবারদাবার – এসবই বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টের নাম। রাঁধুনি রেস্টুরেন্টটি আমাদের প্রিয় হয়ে যায়। একেবারে ঢাকায় আমাদের ঘরের খাবারের মতো এর রান্নার স্বাদ। এই রেস্টুরেন্টের মালিক পরিবারের সবাই এখানে কাজ করেন। কর্তা মহোদয় দিনে বসেন, সন্ধ্যায় কর্ত্রী। তাদের এক ছেলে আছে, দিনের বেলা সিঙ্গাপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, বিকেলে এসে বাবা-মাকে সাহায্য করে। ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বাঙালি বন্ধুরাও মাঝেমধ্যে তাদের সাহায্য করে।

গত পনেরো বছর ধরে তারা এখানে এই রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করছেন। তিনি নিজে ক্যাশবাক্সে বসেন, খাবার সাজানো থাকে শেলফে, নিজের পছন্দমতো নিজে নিয়ে আসা যায়। দামও আহামরি বেশি নয়। আমার স্ত্রীর সবচে প্রিয় জায়গা হয়ে যায় এই রাঁধুনি রেস্টুরেন্ট। হোটেল থেকে দশ মিনিট হেঁটে এসে এই রেস্টুরেন্টে খাওয়া আমাদের নৈমিত্তিক রুটিন হয়ে যায়।’ আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ভ্রমণ নিয়ে কাহিনিটির নাম শাকুর মজিদ এমনভাবে লিখেছেন যেন ইতিহাস প্রতিধ্বনিত হয় এই নামের ভেতরে – কালাপানি। নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসুর উদ্ধৃতি – ‘One individual may die for an idea; but that idea will, after his death, incarnate itself in a thousand lives. That is how the wheel of evolution moves on and the ideas and dreams of one nation are bequeathed to the next! ‘You give me your blood and I will give you independence!’ দিয়ে শুরু হওয়া কাহিনি বাঙালির জীবনকে যেন গেঁথে দেয় এর সঙ্গে। ‘কালাপানি : সেলুলার জেল’ অংশটি পড়লেই বোঝা যায় লেখকের উদ্দেশ কেবল ভ্রমণ নয়, সেখানে স্বপ্ন বাস্তবতা তাঁর মন ও মননে আগে থেকেই ঠাঁই পেয়েছিল। ‘সেলুলার জেলটি আন্দামানের মূল শহরের প্রাণকেন্দ্রেই। আমরা যখন পৌঁছোই তখন চারদিকে দিনের আলো নিভে গেছে। সেলুলার জেলের মূল ভবনে প্রবেশ করতে না পারলেও এর চত্বরে প্রবেশ করতে পেরেই তখনকার মতো সন্তুষ্ট হয়ে চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম স্বপ্নের সেলুলার জেল। সঙ্গীদের প্রত্যেকের চোখে-মুখে কেমন একটা বেদনার ছায়া লক্ষ করলাম। বুঝতে কষ্ট হলো না যে, তারাও আমার মতো স্মৃতিকাতরতায় আক্রান্ত। ঘুরতে ঘুরতে আমরা চলে আসি জেল ভবনের ভেতরের চত্বরে। ছেলেবেলায় যাদের কথা ভেবে আবেগাক্রান্ত হয়ে যেতাম এখানে দেখতে পেলাম সেই স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের কয়েকজনের মোমের তৈরি মূর্তি। মোহিত মৈত্র, মোহন কিশোর নামদাস, পণ্ডিত রাম রাখা বালী, বাবা ভানুসিং, ইন্দুভূষণ রায়, বিনায়ক দামোদর সভারকার – এঁরা প্রত্যেকেই এক একটি ইতিহাস।’ বিপুল পরিমাণ আলোকচিত্র বরাবরের মতো এই কাহিনিটিকেও করেছে প্রামাণ্য।

এরই ধারাবাহিকতায় লক্ষ করা যায় তাঁর ভ্রমণকাহিনি রচনার দক্ষতা বজায় থেকেছে পরের দুটি খণ্ডেও। ভ্রমণসমগ্রের তৃতীয় খণ্ডে আছে চারটি ভ্রমণকাহিনি। এশিয়ার অন্যতম দ্রষ্টব্য দেশ ভিয়েতনাম। ভিয়েতনাম ভ্রমণের দিনপঞ্জি লিপিবদ্ধ করেছেন হো চি মিনের দেশে ভ্রমণকাহিনিতে। যথারীতি শুরুতেই আছে একটি উদ্ধৃতি। স্বাভাবিকভাবেই সেটি ভিয়েতনামের নবজন্মের পথিকৃৎ হো চি মিনের। ‘Remember, the storm is a good opportunity for the pine and the cypress to show their strength and their stability.’ শুরুতেই এসেছে ভিয়েতনাম যুদ্ধের ছবি ও কথা। ফরাসিদের কলোনি কী করে আধুনিক ভিয়েতনাম হয়ে উঠল, তারই বৃত্তান্ত ছড়িয়ে আছে এ-কাহিনির পাতায় পাতায়। ভিয়েতনামিরা কী করে দেশটিকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছে, সেই বৃত্তান্তগুলোও পাওয়া যাবে এই কাহিনিতে। কিন্তু হো চি মিন এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধ হয়ে আছে যেন এক প্রধান উপজীব্য বিষয়। ‘ভিয়েতনাম এবং হো চি মিন শব্দ দুটি একই সুতোয় গাঁথা। হো চি মিন ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা। ১৮৯০ সালে হুয়াং টু গ্রামে হো চি মিন জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের অনেক চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়ে হো চি মিন ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু তৎকালীন পুঁজিবাদী বিশ্ব তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের স্বীকৃতি না-দেওয়ায় তিনি সাম্রাজ্যবাদী ফরাসিদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের স্বাধীনতাযুদ্ধ ঘোষণা করেন। তাঁর নেতৃত্বে ভিয়েতনামিরা যুদ্ধে জয়লাভ করে। হো চি মিন হন ভিয়েতনামের প্রথম প্রেসিডেন্ট। সমস্যা পুরোপুরি দূর হয় না। দক্ষিণ ভিয়েতনামে আসন গেঁড়ে বসে থাকে ফরাসি আর আমেরিকানদের পুতুল সরকার। হো চি মিন ভিয়েতনামের তৎকালীন পুতুল সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন, যার ফলে শুরু হয় আমেরিকানদের সঙ্গে ভিয়েতনামিদের যুদ্ধ। দীর্ঘ এই যুদ্ধের নেতৃত্বও দিয়েছিলেন হো চি মিন। আমেরিকানদের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে ১৯৬৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর হ্যানয়ে তাঁর নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন ভিয়েতনামের এই বিপ্লবী নেতা।’ জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনের নাম থেকেই পরের শ্রীলংকা ভ্রমণের কাহিনির নাম রেখেছেন সিংহল সমুদ্র থেকে। এবার আর সে-দেশের কোনো ব্যক্তির উদ্ধৃতি দেওয়া নেই তার বদলে আছে বনলতা সেন কবিতাটি। শুরুতেই শ্রীলংকার ইতিহাসের দিকে নিয়ে গেছেন লেখক আমাদেরকে।

‘শ্রীলংকায় সিংহলিদের রাজত্ব যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁর নাম বিজয়। এই বিজয়ের লংকা জয় নিয়ে নানারকম কথাবার্তা ঐতিহাসিকদের মধ্যে চালু আছে। তার একটি হচ্ছে এমন যে, বিজয়ের পিতামহের রাজ্য ছিল কলিঙ্গ আর ভাঙা। আজ আমরা সেটাকে উড়িষ্যা বলে জানি, সেই জায়গাটি ছিল কলিঙ্গ; আর বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে যে-রাজ্য ছিল, তার নাম ছিল ভাঙা।

এই ভাঙার রাজা কলিঙ্গের রাজকুমারীকে বিয়ে করেন। এই রাজকুমারীকে নিয়ে অনেক কথকতা আছে। রাজকুমারীকে নিয়ে সুপাদেবী যে কেবল রূপবতী আর গুণবতীই ছিলেন তা নয়, তিনি নাকি পশুর রাজা সিংহের সঙ্গেও সখ্য করার মতো কারিশমা জানতেন। ঘটনাটি যখন ঘটে গেল, যথাসময়ে রানী গর্ভবতী হলেন এবং সিংহবাহু এবং সিংহসিবলি নামক দুই যমজ পুত্রসন্তানের জন্ম দিলেন। এসব গল্প এই যুগের আমাদের বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু ইতিহাসের বইগুলো এসব তথ্য দিয়ে রেখেছে। এই পত্রযুগলের হাত ও পা নাকি সিংহের মতোই ছিল এবং তাদের সিংহের খাঁচার ভেতর ভরে রাখতে হতো। তাদের সঙ্গে তাদের মা সুপাদেবীও থাকতেন। একপর্যায়ে খাঁচা ভেঙে তারা তিনজন পালিয়ে যান। বাবার সঙ্গে মা ও সন্তানদের সুসম্পর্ক ছিল না। একদিন সিংহবাহু তার বাবাকে খুন করে পেলে এবং তার বোনকে বিয়ে করে এ-রাজ্যের নাম সিংহপুর হিসেবে চিহ্নিত করে বসবাস করতে থাকে।’ শ্রীলংকার নগর এবং লোকজীবনের নানা কেন্দ্রে-প্রান্তে হানা দিয়েছেন লেখক। নিয়ে গেছেন অরণ্যে-নদীতে, পাহাড়ে। পরিচিত করেছেন শ্রীলংকানদের খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, উৎসব-আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে। বিপুল আলোকচিত্রে এ-কাহিনিটিও হয়েছে প্রামাণ্য। নিজে একজন স্থপতি হিসেবে একটি দেশের নানা পরিসরের নির্মাণকলা প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি। তার নানা বর্ণনা থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলংকার একটি তুলনামূলক আলোচনা আমরা পেয়ে যাই এখানে। ‘বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলংকার রাজনৈতিক অবস্থার অনেক মিল। এখানেও সিংহলিদের সঙ্গে তামিলদের সংঘাত। তামিলরা পাহাড়ি অঞ্চলের। বাঙালিদের সঙ্গে পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়িদেরও একটা স্নায়ুযুদ্ধ আছে। শ্রীলংকা সর্বশেষ ব্রিটিশদের কলোনিভুক্ত ছিল, ছিল বাংলাদেশও। আমাদের এই অঞ্চল থেকে ব্রিটিশরা চলে গিয়েছিল ১৯৭৪-এর আগস্টে। তার মাত্র কয়েক মাস পর ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শ্রীলংকা থেকে বিদায় হয় ব্রিটিশরা। শ্রীলংকা থেকে বিদায়ের মাধ্যমে দক্ষিণ এশীয় এই অঞ্চলগুলো থেকে ব্রিটিশ পতাকা চিরতরে সরে যায়। দীর্ঘ তিনশো বছরের ইউরোপীয় শাসনের হাত থেকে মুক্ত হয় শ্রীলংকা।’ সুলতানের শহর ভ্রমণকাহিনিতে এসেছে তুরস্কের ইস্তাম্বুল ও মিশরের কায়রো। তুরস্কের ইস্তাবুল যেন এশীয় ইউরোপের দুই সংস্কৃতিতে তৈরি শহর। ইতিহাসের পথ ধরে তিনি এগিয়েছেন এই ভ্রমণকাহিনিতে বর্ণিত নানা স্থানে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ঘটে-যাওয়া নানা ঘটনার হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা আছে ইস্তাম্বুল শহরটি ঘিরে। যথারীতি তুরস্কের রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি এবং মানুষের নিবিড় পর্যবেক্ষণে পূর্ণলেখকদের বর্ণনা। যেমন একটি বাজারের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন – ‘বাজারটি যদিও মাছের বাজার নামে স্বীকৃত, কিন্তু নানারকমের মনোহারি সওদাভরা, আমাদের মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটের মতো। বাজারে ঢুকতেই যে-চত্বর রয়েছে, দিনের বেলা যেখান দিয়ে গাড়িও চলে, সেখানে বসানো হয়েছে টেবিলচেয়ার। মাথার ওপর অস্থায়ী তাঁবুর মতো শামিয়ানা। এই জায়গাটিতে মাছজাতীয় খাবার অনেক বেশি পাওয়া যায় বলে শুনেছি। আমরা মাছ খেতে এসে দেখি টেবিলময় নর্তনকুর্দন চলছে। এক টেবিলের পাশেই এক তরুণী নিজের মতো নেচে যাচ্ছেন, তার পাশেই একজন লোক ড্রাম বাজাচ্ছেন। খেতে যারা এসেছেন এখানে, বেশিরভাগই স্থানীয় বাসিন্দা, কিছু বিদেশি পর্যটকও আছেন। লোকজন খাওয়া বন্ধ করে তালি বাজাচ্ছে। যেখানে তালির পরিমাণ অপেক্ষাকৃত বেশি, স্বল্পবাসনা তরুণী সেই টেবিলের কাছে গিয়ে নাচছেন। নাচতে নাচতে একসময় তিনি ব্যাঙের মতো একটা লাফ দিয়ে একেবারে টেবিলের ওপরেই উঠে গেলেন। তামেশদাররা পকেটে হাত দেন। কেউ নোট, কেউ খুচরা পয়সা গুঁজে দিচ্ছেন মেয়েটির কোমরে। এটুকুতেই যেন অনেক শান্তি। নোট গোঁজার সময় মেয়েটির কোমরের সঙ্গে যদি একটু হাতের ছোঁয়া লাগে, এতেই খুশি। এর চেয়ে বেশি কোনো চাওয়া নেই তাদের।

বেলি নাচের শর্তই এমনটি যে, এটা পেটের মাংসপেশির দুলুনি দিয়ে শরীরকে নাচাতে হয়। এই নর্তকী খাওয়ার টেবিলে যে-মুদ্রায় নেচেছিলেন, তার কিছুটা প্রাচ্য, কিছুটা পশ্চিমা ধাঁচের। সব মহাদেশের পর্যটকদের মনের খোরাক তার দেওয়া দরকার, তাই তার এমন মিশ্রমুদ্রা। কিন্তু আজ এই সাইনবোর্ডটা দেখেই আমরা ঠিক করে ফেলি, অদ্যরজনি আমরা বসফরাস প্রণালির ওপর জাহাজে ভাসতে ভাসতে রাতের আহার করব। আর সেই সঙ্গে আটশো বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত বেলি নাচ দেখব আর রমণীর সৌজন্যে।’

এই বর্ণনা থেকে আমরা দেখি এ-যেন তুরস্কের ইউরোপিয়ান চেহারা। ধর্ম এবং আধুনিকার মিশ্রণে তৈরি তুরস্কের সংস্কৃতির নানা দিক বারবার ফুটে উঠেছে এই কাহিনিতে। ফেরাউনের গ্রাম ভ্রমণকাহিনিটির প্রথমেই আছে নেপোলিয়নের উদ্ধৃতি – ‘From the heights of these pyramids, forty centuries look down on us.’ মিশর সবসময়ই এক দুর্মর রহস্যের নাম। কত না সম্রাট-সুলতানদের উত্থান-পতনে বারবার ভাঙাগড়া সেই ইতিহাসে হানা দিয়েছেন শাকুর মজিদ।

‘মিশরকাহিনি বিশ্বকে প্রথম শুনিয়েছিলেন এক গ্রিক দার্শনিক, পর্যটক ও ইতিহাসবেত্তা। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে জন্ম হয়েছিল তাঁর। নাম হেরোডিটাস। হেরোডিটাসই সরেজমিন পিরামিড পর্যবেক্ষণ করেন, নিজ হাতে মাপজোখ লেখেন এবং নিজের মতো করে শাসক ফারাও থেকে শুরু করে দেশের নামটি পর্যন্ত রাখেন। সেনেফ্রুপুত্র খুপুর নাম তিনি লিখেছিলেন – খিওপস। তাঁর দেওয়া প্রথম তথ্যমতে, এই পিরামিড তৈরিতে এক লাখ লোকের বিশ বছর সময় লেগেছিল। তবে হেরোডিটাসের এ মতামত প্রকাশের প্রায় আড়াই হাজার বছর পরে এসে এখনকার গবেষকরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করছেন। পোলিশ স্থপতি ওয়েসলো কোজিনস্কির মতে, পিরামিডের মূল ক্ষেত্রেই লোক লেগেছিল প্রায় তিন লাখ, আর অফসাইডে প্রয়োজন পড়েছিল আরো ষাট হাজার মানুষের। অন্যদিকে গণিতবিদ কুর্ট মেন্ডেলসনের ধারণা, সর্বোচ্চ পঞ্চাশ হাজার লোকের দশ বছর সময় লেগেছিল পিরামিড নির্মাণের কাজে। প্রত্নত্ত্ববিদ মার্ক লেহনারের মতে, পিরামিড নির্মাণের কাজে দাসদের নিয়োগ করা হয়নি, বরং মিশরীয়রাই এটি নির্মাণের জন্য শ্রম দেয়। তিনি তাঁর গবেষণায় পিরামিডের পাশে শ্রমিকদের থাকার একটা জায়গাও খুঁজে পেয়েছেন। পিরামিড নির্মাণের জন্য বিপুলসংখ্যক পাথরের প্রয়োজন পড়েছিল। এগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল দূর-দূরান্তের পাহাড় থেকে। পাথরের সঙ্গে পাথর জোড়া দিয়ে এমনভাবে পিরামিড তৈরি করা হতো যে, একটি পাথর থেকে আরেকটি পাথরের মাঝের অংশে একচুলও ফাঁক থাকত না। পিরামিড তৈরিতে যত পাথর ব্যবহার হয়েছে, ছয় ফুট উঁচু ও তিন ফুট চওড়া করে পাশাপাশি বসালে সে দেয়াল লম্বায় পঞ্চাশ মাইল ছাড়িয়ে যাবে। এত ভারী পাথর ওপরে টেনে তুলে কীভাবে পিরামিড নির্মাণ করা হয়, সেটি ভাবলে অবাক হতেই হয়। অধিকাংশের ধারণা, ব্লকগুলোকে ঢালু পথে ওপরে টেনে তুলে নির্মাণ করা হয় পিরামিড। আবার হেরোডিটাস এ-সম্পর্কে বলেছেন, পিরাডিম নির্মাণ করা হয়েছিল সিঁড়ির মতো করে, অনেকটা স্টেডিয়ামের সিঁড়ির মতো ক্রমশ উঁচু এবং সমান্তরালভাবে। প্রথম ধাপ সম্পন্ন হওয়ার পরে পাথর এবং বিভিন্ন উপাদান টেনে তার ওপরে ওঠানো হতো এবং তারপর দ্বিতীয় ধাপ নির্মাণের কাজে হাত দেওয়া হতো। আর এভাবেই ধাপে ধাপে নির্মাণ করা হয় পিরামিড।’

মিশরের ভ্রমণকাহিনির সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে আসলে পিরামিডের আদি মধ্যঅন্তের নানা বৃত্তান্ত। এ-কাহিনির চমৎকারিত্ব হলো রহস্যময় মিশর যেন লেখকের ভ্রমণকাহিনিতে যতটা জীবন্ত ততটাই পাঠকের ভ্রমণ আকুতি-জাগানিয়া।

ভ্রমণসমগ্রের চতুর্থ খণ্ডটি চারটি কাহিনির সমাহার। নোবেলের শহর সুইডেনকে পাওয়া যাবে শুরুতেই। যথারীতি আলফ্রেড নোবেলের উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু হয়েছে কাহিনি। সুইডেন এক অত্যাধুনিক দেশ। ঝকঝকে-তকতকে এর রাজধানী স্টকহোম বাংলাদেশিদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। কিন্তু এই ঝকঝকে-তকতকে শহরের পেছনেও আছে ইতিহাসের গভীর সব নির্মাণ। ‘বর্তমান পৃথিবীতে টিকে থাকা বৃহৎ রাজপ্রাসাদগুলোর মধ্যে স্টকহোম রাজপ্রাসাদ অন্যতম। প্রাসাদের সামনের দিকে উড়ন্ত ঈগলের দুটো পাখা। চারদিকে তিনতলা উচ্চতার ভবন দিয়ে আবৃত রাজপ্রাসাদের মাঝখানে একটি বড়সড় কোটইয়ার্ড। রাজপ্রাসাদের এই ভবনগুলোরও প্রতিটির আলাদা আলাদা অর্থ আছে।

দক্ষিণদিকে মুখ করে যে-প্রাসাদটি দাঁড়িয়ে আছে সেটি পুরো জাতির প্রতিনিধিত্ব করছে। পশ্চিমদিকে মুখ করে যে-প্রাসাদটি দাঁড়িয়ে আছে সে রাজার প্রতিনিধিত্ব করছে। আর পূর্বদিকে মুখ করে যে-প্রাসাদটি দাঁড়িয়ে আছে সে রানীর প্রতিনিধিত্ব করছে। আর উত্তরদিকে মুখ করে যে-প্রাসাদটি দাঁড়িয়ে আছে সেটি এই রাজপ্রাসাদে অবস্থান করে যাঁরা সুইডেন শাসন করেছেন তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করছে। সম্পূর্ণ ইটের তৈরি এই প্রাসাদে ১৪৩০টি কক্ষ এবং ৬৬০টি জানালা রয়েছে।’

পোল্যান্ড ভ্রমণকাহিনির নাম তিনি দিয়েছেন লেস ওয়ালেসার দেশে। শুরুতেই নিকোলাস কপারনিকাসের উদ্ধৃতি – ‘To know that we know what we know, and to know that we do not know what we do not know, that is true knowledge.’ পোল্যান্ড এক মহাজাগানিয়া দেশ যেন। পোল্যান্ড মানেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দীর্ঘশ্বাসের নাম। শাকুর মজিদ লেস ওয়ালেসাকে এক প্রতিনিধিত্বকারী মানুষ হিসেবে হাজির করেছেন। কিন্তু কখনোই পোল্যান্ডের অন্যান্য অনেক কিছুর পরিচয় হাজির করতে ভুলেননি। ইতিহাস, রাজনীতি, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, আধুনিকতা, ঐতিহ্য বহু কিছু যেন মিলেমিশে গেছে এ-ভ্রমণকাহিনিতে, এসেছে সেখানে বসবাসকারী বাঙালিদের কথা। পূর্ব-ইউরোপের অন্যতম দেশ চেকরিপাবলিক। সাহিত্যমোদী মানুষের কাছে চেকপ্রজাতন্ত্র মানেই প্রাগ। আর প্রাগ মানেই কাফকার শহর। তাই শুরুতেই কাফকার উদ্ধৃতি – ‘Prague never lets you go… this dear little mother has sharp claws.’

‘ইউরোপের অন্যতম প্রধান এই পর্যটন শহরে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৫ লাখ পর্যটক আসেন। সে-হিসেবে প্রতিদিন গড়ে পনেরো হাজারের বেশি পর্যটকের আনাগোনা হয় এ-শহরে। প্রাগে কেউ বেড়াতে আসবেন আর ওল্ড সিটি স্কয়ারে যাবেন না, এটা হতেই পারে না। ওল্ড সিটি স্কয়ারে এলে অবশ্যদ্রষ্টব্য এই টাওয়ারটা। এবং এই টাওয়ারটি প্রতি ঘণ্টায় দর্শকদের জন্য নতুন করে আসে তার এই অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল ঘড়ি মিনারটির জন্য। এখন বোধ হয় সময় হয়ে এসেছে বেলা এগারোটার ঘণ্টা বাজানোর জন্য – সে-কারণেই এত ভিড়।’

এতে বোঝা যায়, কাফকার উদ্ধৃতিটি শুধু কথার কথা নয়। সেখানে পরতে পরতে মিশে আছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নানা কারুকার্য। ‘প্রাগ শহর বিখ্যাত হয়ে আছে গোথিকরীতির স্থাপত্যের জন্য। রোমানিস্করীতি থেকে বেরিয়ে উঁচু, প্রশস্ত টাওয়ারসমৃদ্ধ সূচ্যগ্র খিলানওয়ালা কারুকাজময় গির্জা বানানো শুরু হয় দ্বাদশ শতক থেকেই। তার উল্লেখযোগ্য নমুনা আমরা দেখেছি চার্লস ব্রিজের গোড়ার টাওয়ারে, প্রাগ ক্যাসেলের সেইন্ট ভিটুস চার্চে, কিংবা প্রাগের পুরনো শহরকেন্দ্রে প্রবেশের মুখে ১৮০ ফুট উঁচু পাউডার টাওয়ারে। ১৪৮৫ সালে বানানো এই টাওয়ারটি চোদ্দোশো শতাব্দী পর্যন্ত ব্যবহৃত হতো গানপাউডারের গুদামঘর হিসেবে। এ-কারণে একে পাউডার টাওয়ার হিসেবে ডাকা হয়।

ফ্লোরেন্সে ব্রুনেলিসির উদ্ভাবন করা নতুন এক ধরনের শিল্পকলা ইউরোপে রেনেসাঁস যুগের প্রবর্তন করে। ইতালি থেকে শুরু করে ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি দেশে পনেরোশো থেকে সতেরোশো শতাব্দী পর্যন্ত এই দুশো বছর সময় ধরে এ-ধারার অনুশীলন হতে থাকে। গ্রিক ও রোমান ধ্রুপদী স্থাপত্যের ধারায় ফেরত গিয়ে তারা মূলত সাম্য, আনুপাতিকতা এবং জ্যামিতিক আকারের মাধ্যমে সারিসারি কলাম, গম্বুজ, প্লাস্টারের ব্যবহার করে। সে-ধারার কাজ আমরা প্রাগে এসে পুরনো শহরকেন্দ্রের দি হাউস অ্যাট দ্য মিনিট ভবনটিতে দেখেছি। পঞ্চদশ শতকের গোড়ার দিকে বানানো এই দালান থেকে গোথিকরীতির কারুকাজ খসে পড়ে, তার জায়গায় গ্রিক পুরাণ এবং বাইবেলীয় চরিত্রের সন্নিবেশে তার ফ্যাসাদকে সাজানো হয়। রেনেসাঁস যুগের স্থাপত্যরীতির এক চমৎকার উদাহরণ এই দালানটি অন্য একটি কারণেও বিখ্যাত। তা হলো বিখ্যাত জার্মান লেখক ফ্রানৎস কাফকার পরিবার ১৮৮৯ থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত সময়ে এ-বাড়িতে থাকত। কাফকার শৈশবও কেটেছে এখানে। বর্তমানে এ-বাড়িটি একটি ইতালীর রেস্টুরেন্ট।’

এ-ভ্রমণকাহিনির নাম প্রাগের ঠাকুরোভা, লবণপুরের মোজাট। সেটি বোঝা যাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষ মূর্তিটির বৃত্তান্ত জানার মাধ্যমে – ‘বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ প্রাগে এসে যে-অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন তার পাশেই একটা খোলা পার্ক। প্রাগের অ্যাভিনিউগুলোই এমন। মাঝখানে বিশাল পার্ক, তার দুপাশে রাস্তা। এই পার্কে অনেকগুলো উঁচু গাছ, ফুলের বাগান। পথচারী বা নাগরিকদের হাঁটাচলার সরু সরু পথ, বেশ কয়েকটি বেঞ্চি বিছানো।

পাশে সারিসারি অট্টালিকা। প্রতিটি চার তলার সমান উঁচু। আমি জানি, এসব Row housing-এ প্রতি দুটো তলা নিয়ে এক পরিবার থাকে। প্রতি অ্যাপার্টমেন্টে দুই পরিবার। সামনে-পিছে খোলা, পাশে কোনো জানালা থাকে না। তার যে-কোনো একটিতে রবীন্দ্রনাথের থাকা হয়েছিল প্রায় নববই বছর আগে। এ-দালানগুলোর বয়স দেড়শো বছরের বেশি। হেরিটেজ সাইট। এখানে দালানের বাইরের অংশের কোনো পরিবর্তন আনা যায় না। তার মানে, নববই বছর আগে যে-পরিবেশে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এখনো সেই দালান অবিকৃত। কিন্তু একটা সংযোগ এসেছে দালানের কোনাগুলোতে। এখানে লেখা আছে এই অ্যাভিনিউর নাম : THAKUROVA.

বাহ্! আমরা এসে নামি এই ঠাকুরোভায়’

এতক্ষণ বললাম প্রাগ-ভ্রমণকাহিনির প্রথম অধ্যায়। দ্বিতীয় অধ্যায় ‘লবণপুরের মোজার্ট’-এ পাঠক অনুভব করবেন সংগীতের অনুরণন। ঝকঝকে শহর প্রাগের ভ্রমণ শেষে এই দ্বিতীয় অংশে আমরা পৌঁছে যাব সালজবুর্গ শহর পেরিয়ে অপরূপ প্রকৃতির কোলে। ‘ইউরোপের মধ্য সুইজারল্যান্ডের প্রকৃতির সুনাম শুনেছি অনেক। এই সালজবুর্গ সে-অর্থে অতটা জনপ্রিয় নয়; কিন্তু এই ধারণাটি সত্য নয়। আমি সুইজারল্যান্ড দেখিনি, তাই আমার কথা না ধরলেও হয়। লাভলু ভাই দুটোই দেখেছেন। তিনি বলেন, খুব বড় কোনো ব্যবধান নেই। অনেকটা একই রকমের। তবে অনেক কিছু এই সালজবুর্গে বেশি, সেটা সুইজারল্যান্ডেও নেই।

পাহাড়, নদী, সবুজ অরণ্য – এসব মিলিয়েই প্রকৃতি। আমাদের দেশেও তাই আছে। কিন্তু আমরা যতটা না একেবারেই ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রকৃতিনির্ভর, এরা – এই ইউরোপীয়রা অতটা নয়। ওরা এর মধ্যে নিজেদের হাতের ছোঁয়াও লাগিয়েছে অনেক জায়গাতেই। সেকারণে তাদের শহরতলিগুলো শহরাঞ্চলের চেয়েও বেশি বসবাসযোগ্য, আরামের। তাদের প্রত্যেকের বাড়ির জন্য বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস-টেলিফোন তো আছেই, তার সঙ্গে আছে চমৎকার পিচঢালা পথ; এবং গাছপালার মরা পাতাগুলোও জমিয়ে রাখার জন্য এখানে-ওখানে ছড়ানো-ছিটানো ময়লার ঝুড়ি। এসব থাকলে হাতের কাগজ-টুকরো বা চকলেটের খোসাটুকু যেখানে-সেখানে ফেলতে মন চায় না।

সবুজ বনাঞ্চলের ভেতর দিয়েই রাস্তা। গাড়ি ছুটে চলছে। এ-বাসের প্রায় আশি ভাগ যাত্রীই পর্যটক। মাঝেমধ্যে কেউ কেউ নেমে যাচ্ছে কোনো স্টেশনে। এই মাঝদুপুরে কিছু বয়স্ক লোক ছাড়া বাড়ি ফেরার তাগিদও কারো তেমন নেই।’

আধুনিকতা দিয়ে শুরু আর প্রকৃতি দিয়ে শেষ এই ভ্রমণকাহিনিটি সত্যিই মনোমুগ্ধকর। ভ্রমণসমগ্রের ইতি টানা হয়েছে নেপাল ভ্রমণের কাহিনি অন্নপূর্ণায়। বাংলাদেশের খুব কাছেই এই নেপাল প্রকৃতির এক অপূর্ব লীলাভূমি। ইউরোপের ঝকঝকে শহর তকতকে পথঘাটের কথার পর এই প্রকৃতির কাছে ফিরে আসা নেপালে যেন আমাদের বলে যতদূরেই যাই না কেন, মানুষকে আসলে বারবারই কৃত্রিমতা থেকে অকৃত্রিমতায় পৌঁছাতে হয়। আধুনিকতা থেকে আদিমতায় গিয়ে ফের আধুনিকতায় ফিরে আসে যেন আমাদের নিয়তি। নেপালের মতো দেশ যেখানে প্রকৃতি গভীরভাবে কথা বলে সংস্কৃতির সঙ্গে। বাংলাদেশের সঙ্গে নেপালকে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছেন লেখক এখানের অনেক অনুচ্ছেদেই।

‘দেশের বাইরে গেলে সবসময়ই বিদেশের সঙ্গে নিজের দেশের তুলনা করতে ইচ্ছা করে। আমি আর নাসিরভাই বসেছি এক টেবিলে, খেতে খেতে আমাদের একই আলাপ। আমরা আবিষ্কার করি যে, এই পুরো নেপালটাই হচ্ছে আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের একটা এলিভেটেড, এনলার্জড ভার্সন। ভূমিরূপ, সংস্কৃতি খুবই কাছাকাছি। সমুদ্র আমাদের কাছে বলে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আমাদের পাহাড়ি অঞ্চল অতটা ওপরে নয়, এই যা।

বাংলাদেশের সঙ্গে নেপালের আয়তনের মিল সবচেয়ে বেশি। আমাদের আয়তন ৫৫৫৯৯ বর্গমাইল, নেপালের এর চেয়ে মাত্র এক হাজার বর্গমাইল বেশি। আকৃতি আলাদা। আমাদের মানচিত্রটি বড়ই চমৎকার, কোনো বিশেষ জ্যামিতিক আকারের মধ্যে ফেলা যায় না। ওদের আকৃতিটা অনেকটা একটা ট্রাপিজিয়ামের মতো। তবে পাহাড়ি এলাকা বলে জনসংখ্যা ও ঘনত্ব আমাদের থেকে অনেক অনেক কম। নেপালে প্রতি বর্গমাইলে পাঁচশোজনের মতো থাকে, আমাদের মাশা-আল্লাহ এর চেয়ে পাঁচগুণ বেশি। আমাদের মাথাপিছু বার্ষিক আয় নয়শো, নেপাল আমাদের চেয়ে দরিদ্র দেশ। এজন্যই আমাদের আশি টাকা দিয়ে ওদের ওখানে একশ রুপি পাওয়া যায়। বিস্তীর্ণ পাহাড়শ্রেণিই এই দেশের প্রধান উপজীব্য। এই পাহাড় দেখার জন্য বিদেশ থেকে বছরে প্রায় পাঁচ লাখ পর্যটক আসেন। সৃষ্টিকর্তা তাদের পর্বত দিয়ে পাঠিয়েছে। পৃথিবীর উচ্চতম দশটি পর্বতচূড়ার মধ্যে আটটিই তাদের সীমানায়।’

দিন ও রাতে কাহিনিও এসেছে ফিরে ফিরে। কিন্তু বারবারই উদারমুক্ত আকাশছোঁয়া পর্বতের চূড়াগুলো যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে পাঠককে। শাকুর মজিদের ভ্রমণসমগ্রের প্রতিটি খণ্ডে আছে এই হাতছানি। বিপুল আলোকচিত্রের সমাহার সেটিকে আরো তীব্র থেকে তীব্রতর করেছে। এই হাতছানিতে সাড়া না দিয়ে থাকা যে-কোনো পাঠকের জন্যই কঠিন। আর এখানেই ভ্রমণকাহিনি লেখক হিসেবে শাকুর মজিদ সফল।

সবমিলিয়ে আমাদের মনে হয়, শাকুর মজিদের প্রত্যেকটি ভ্রমণকাহিনি এক নতুন বিন্যাসে, নতুন আবেদনে সমৃদ্ধ হয়েছে এই সংকলন। বাঙালির ভ্রমণসাহিত্যের উল্লেখপঞ্জিতে শাকুর মজিদের ভ্রমণসমগ্রের খ-গুলো সত্যিই অনন্য হয়ে থাকবে।