বাংলাদেশের ছোটগল্প : ষাটের দশক

বিশ্বজিৎ ঘোষ

বিশ শতকের ষাটের দশক বাংলাদেশের ইতিহাসে এক উন্মাতাল সময়। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কারণে এ-সময়ের বাংলাদেশ ছিল বিক্ষুব্ধ, আলোড়িত, আন্দোলিত এবং স্বাধিকার চেতনায় উন্মথিত। এই সময়খণ্ডে রচিত সাহিত্যে সংক্ষুব্ধ-উন্মথিত বাংলাদেশের নানামাত্রিক ছবি শিল্পিত হয়ে আছে। এ-কথা উক্ত কালপর্বে রচিত বাংলাদেশের ছোটগল্প সম্পর্কেও সমানভাবে প্রযোজ্য। দেশ বিভাগ-পরবর্তী বাংলাদেশের ছোটগল্পের উত্তরাধিকারকে আত্মস্থ করেও ষাটের ছোটগাল্পিকরা অঙ্গীকার করলেন নানামাত্রিক নতুন প্রবণতা। এ-কথা অনস্বীকার্য যে, ষাটের দশকে বাংলাদেশের গল্পসাহিত্যে সূচিত হয় একটি নতুন স্রোত। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক কল্লোল আর সংক্ষোভের পটে রচিত এ-কালের গল্প প্রকৃত অর্থেই উদ্ভাসিত করেছে ষাটের উন্মাতাল বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের সংক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠীকে। একদিকে সামরিক শাসনের শোষণ-নির্যাতন, অবাঙালি পুঁজির বিকাশ, গণতান্ত্রিক শক্তির বিপর্যয়; অন্যদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী-আন্দোলন ও স্বাধিকার বাসনা এই সময়কে সংক্ষুব্ধ করে তোলে। এ-কালপর্বে পূর্ববর্তী গাল্পিকরা গল্পের ভুবন থেকে প্রস্থান করেছেন, উঠে এসেছে নতুন প্রজন্মের তরুণ গল্পকারেরা।

আলোচ্য কালপর্বে ছোটগাল্পিক চৈতন্যে আমরা লক্ষ করি দুটি প্রবণতা। একদিকে রয়েছেন সেসব শিল্পী, যাঁরা সামরিক শাসনের ভয়ে শঙ্কিত হয়ে জীবন-জীবিকার নিরাপত্তার প্রশ্নে আশ্রয় নিলেন বেতার টেলিভিশন-বিএনআর-প্রেস ট্রাস্টের নিরাপদ সৌধে। এঁদের  রচনায়  এলো পলায়নি মনোবৃত্তি, ফ্রয়েড-এলিস দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এঁরা নির্মাণ করলেন মৈথুন-সাধনার শব্দমালা। অপরদিকে আছেন সেসব শিল্পী, যাঁরা বিপর্যস্ত যুগ-পরিবেশে বাস করেও সমকাল-চঞ্চল জীবনাবেগ, যুগসংক্ষোভ এবং প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-দ্রোহ-বিদ্রোহ অঙ্গীকার করে গল্পের শরীরে জ্বেলে দিয়েছেন সমাজ-প্রগতির আলোকবর্তিকা। স্বৈরশাসনের শৃঙ্খলে বাস করেও এঁরা ছিলেন সত্যসন্ধানী, সংরক্ত সমকালস্পর্শী এবং প্রগতিশীল সমাজভাবনায় উচ্চকিত। ষাটের দশকে যেসব গল্পকার বাংলাদেশের সাহিত্যে আবির্ভূত হন, তাঁদের শিল্পকর্ম বিশ্লেষণ করলেই উপর্যুক্ত মন্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হবে। যেসব ছোটগাল্পিক সময়ের এ-পর্বে সাহিত্য-সাধনায় ব্রতী হন, তাঁরা হচ্ছেন – নাজমুল আলম, সুচরিত চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, সাইয়িদ আতীকুলস্নাহ, মাফরুহা চৌধুরী, শহীদ আখন্দ, হুমায়ুন কাদির, শওকত আলী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, হাসনাত আবদুল হাই, রিজিয়া রহমান, রাহাত খান, বুলবন ওসমান, মাহমুদুল হক, দিলারা হাশেম, রশীদ হায়দার, আবদুশ শাকুর, মাহবুব তালুকদার, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আহমদ ছফা, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সুব্রত বড়ুয়া, সেলিনা হোসেন, কায়েস আহমদ প্রমুখ। শৈল্পিক সিদ্ধি এবং জীবনার্থের প্রশ্নে এঁদের অনেকের মধ্যে রয়েছে মেরুদূর ব্যবধান, তবু আমরা তাঁদের একই পঙ্ক্তিতে বিন্যসত্ম করেছি – কেননা, এঁদের সকলেরই রয়েছে অভিন্ন কুললক্ষণ – এঁরা সকলেই দ্রোহ-বিদ্রোহ-সংক্ষোভ-সংগ্রামমুখর উত্তাল ষাটের গল্পকার।

নাজমুল আলম, সুচরিত চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, মাফরুহা চৌধুরী, হুমায়ুন কাদির, হাসনাত আবদুল হাই, রিজিয়া রহমান, বুলবন ওসমান, মাহবুব তালুকদার প্রমুখ শিল্পীর গল্পরচনার প্রয়াস ষাটের দশকে শুরু হলেও এ-দশকের প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রকরণ-সতর্কতা এবং মনোগহন-বিশ্লেষণ এঁদের রচনায় প্রাধান্য পায়নি। নাগরিক মধ্যবিত্তের অতলযাত্রা আর অন্তঃসারশূন্যতা নিয়ে গল্প লিখেছেন নাজমুল আলম এবং সাইয়িদ আতীকুল্লাহ। চট্টগ্রামের লোকায়ত জীবন এবং লোকগাথা-কিংবদন্তি নিয়ে সুচরিত চৌধুরী অনেক গল্প লিখেছেন, যা বাংলাদেশের গল্পের ধারায় সংযোজন করেছে একটি নতুন মাত্রা। মুর্তজা বশীর, রিজিয়া রহমান, আহমদ ছফা, বুলবন ওসমান এবং মাহবুব তালুকদারের গল্পে ধরা পড়েছে সমাজসচেতন মানস-প্রবণতা এবং সমাজপ্রগতির বাসনা।

ইতিহাস-ঐতিহ্যের গল্প-অবয়ব সৃষ্টিতে রিজিয়া রহমান বিশিষ্টতার পরিচয় দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর ‘অগ্নিস্বাক্ষরা’ গল্পের কথা উলেস্নখ করা যায়। তবে তাঁর গল্পে পরিলক্ষিত হয় উপকাহিনির আধিক্য, যা ছোটগল্পের শরীরে জড়ো করে উদ্বৃত্ত মেদ। মাফরুহা চৌধুরী নাগরিক মধ্যবিত্তের হার্দ্যজটিলতা উন্মোচনেই সমধিক আগ্রহী। হাস্যকৌতুক আর ব্যঙ্গের ধারায় বাংলাদেশের গল্পে শহীদ আখন্দ রেখেছেন বিশিষ্টতার স্বাক্ষর। ব্যঙ্গের আবরণে সুকৌশলে তিনি উন্মোচন করেন মানবজীবনের গভীরতর কোনো
সত্য-উপলব্ধি। সরস ব্যঙ্গ-কৌতুকের ধারায় আবদুশ শাকুরের সিদ্ধিও এ-প্রসঙ্গে স্মরণীয়। সামাজিক অসংগতি ও নাগরিক মধ্যবিত্তের জটিলতা উন্মোচনে আবদুশ শাকুর সরস ব্যঙ্গ-কৌতুকের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। গ্রাম ও নগরের পটে নিম্নবিত্ত মানুষের দৈনন্দিনতা নিয়ে গল্প লিখেছেন হাসনাত আবদুল হাই। তাঁর গল্পের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য প্রকরণ-সতর্কতা। চিত্রলতা, আবেগী ভাষা এবং সংহত সংলাপ হাসনাত আবদুল হাইয়ের ছোটগল্পের জনপ্রিয়তার মৌল কারণ। হুমায়ুন কাদির, মাহমুদুল হক, দিলারা হাশেম প্রমুখ শিল্পীর রচনায় প্রাধান্য পেয়েছে আধুনিক মানুষের একাকিত্ববোধ, হার্দিক রক্তক্ষরণ এবং অতীত স্মৃতিমুগ্ধতা। নাগরিক মধ্যবিত্তের বিকৃতি, অসংগতি আর সদর্থক জীবনচেতনায় উত্তরণের ইতিকথা নিয়ে গড়ে উঠেছে বশীর আল হেলালের গল্পভুবন।

বাংলাদেশের ছোটগল্পের ধারায় শওকত আলীর অবদান বিশিষ্ট ও ব্যতিক্রমধর্ম-চিহ্নিত। নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনের বহুমাত্রিক অসংগতির চিত্র-অঙ্কনের ষাট-দশকী মৌল প্রবণতার পথ ছেড়ে গল্পে তিনি বিচরণ করেছেন গ্রামীণ জীবনতটে, গ্রামের নিরন্ন নিঃস্ব খেটে-খাওয়া মানুষের যন্ত্রণা, সংগ্রাম ও দহনের পোড়োজমিতে। শওকত আলী শ্রেণি-সচেতন শিল্পী, তাই বস্ত্তবাদী সমাজচিন্তার আলোকে তিনি তুলে ধরেন গ্রামীণ মহাজনশ্রেণির শোষণের চিত্র, নির্মাণ করেন সর্বহারা মানুষের সংগ্রাম ও উত্তরণের জয়গাথা। ‘নবজাতক’ গল্পে তাঁর সাহসী মানুষ মন্তাজ আলী মহাজনী শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে এভাবে :

চুপ করে থাকে সবাই। মা বাপ সন্তান চুপ করে থাকে। আগুনে কাঠের চ্যালা পোড়ে, নানা শব্দ হয়। ধীরে ধীরে আবার কথা বলে মন্তাজ আলী। মনোহর বোষ্টমের গানের কথা বলে, ধান নিয়ে আধিয়ার কিষাণের কথা ওঠে। মহাজন সেদিনও এমনি করেই মেরেছিলো। মহাজনরা চিরকাল অমনি করেই মারে।

লেলিহান সাধ (১৯৭৩) কিংবা শুন হে লখিন্দর (১৯৮৬) সংকলনের কোনো কোনো গল্পে উচ্চারিত হয়েছে এই প্রতিবাদ, যেসব গল্প লেখা হয়েছে ষাটের পটভূমিতে। ‘লেলিহান’ গল্পে মহাজনের ঘরে আগুন দেয় সংগ্রামী শোষিত মানুষ, কপিলদাস বহুদিনের ভুলে-যাওয়া অভ্যাস পুনরায় রপ্ত করে ঘায়েল করতে চায় শ্রেণিশত্রু। ‘শুন হে লখিন্দর’ গল্পে শোষিত মানুষের নির্মম প্রতিশোধ-বাসনা মনসামঙ্গলের মিথ-কাহিনির প্রতীকে ফুটে উঠেছে ব্যঞ্জনাগর্ভ শিল্পায়নে। তবে ‘উন্মূল বাসনা’ (১৯৬৮) থেকেই লক্ষ করা গেছে, নর-নারীর যৌনপ্রবৃত্তি ও আদিম কামনা রূপায়ণে তিনি ক্রমশ হয়ে উঠেছেন উৎসাহী।

বর্তমান সময়ে বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকার হাসান আজিজুল হক বাংলা ছোটগল্পের ধারায় সংযোজন করেছেন প্রাতিস্বিক মাত্রা। উত্তর বাংলার গ্রামীণ জীবন তাঁর গল্পের কেন্দ্রীয় শিল্প-উপাদান। বস্ত্তবাদী জীবনদৃষ্টির আলোয় তিনি উন্মোচন করেছেন সমাজজীবনের বহুমাত্রিক অবক্ষয়, শোষিত-ক্লিষ্ট মানুষের হাহাকার ও বঞ্চনা, কখনো বা তাদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কাহিনি। শাহরিক আত্মকেন্দ্রিক জীবনের নির্বেদ ও আপাত আনন্দের উচ্ছ্বাস উপেক্ষা করে তিনি গ্রামীণ মেহ-মানুষের সমষ্টিগত জীবন-অর্ণবে অবগাহন করেছেন – বাংলা গল্পের ধারায়, এভাবে তিনি নির্মাণ করেছেন তাঁর আপন ভুবন, স্থাপন করেছেন ‘নিজস্ব এক উপনিবেশ’। বস্ত্তত, হাসান আজিজুল হক হচ্ছেন সেই ব্যতিক্রমী গল্পকার, যাঁর বেশ কিছু গল্প নির্দ্বিধায় সমগ্র বাংলা গল্পের আসরে প্রথম পঙক্তিতে স্থান পাওয়ার যোগ্য। কখনো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কখনো জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী কি কমলকুমার মজুমদার, কখনো বা ম্যাক্সিম গোর্কির প্রভাব পড়েছে হাসানের ওপর – তবু হাসান আজিজুল হক এসব প্রভাববলয় অতিক্রম করে অবশেষে বাংলা গল্পধারায় স্থাপন করেন নিজস্বতার পরিচয়।

উত্তর-বাংলার গ্রামীণ জনপদের ভাঙন, সামাজিক শোষণ, কখনো প্রতিবাদ, বাঁচার সংগ্রাম – এসব কথা নিয়ে হাসানের গল্পজগৎ। তাঁর সব গল্পের মূলে আছে বাঁচা, জান্তবভাবে বাঁচা, শিশ্নোদর-পরায়ণভাবে বাঁচা, স্থূলতম শারীরিকভাবে বাঁচা এবং সেই বাঁচার ন্যূনতম অস্তিত্বের নানান চেহারা, আর তার থেকে মুক্তির রূপও হরেক রকম। আর তা থেকে পরাজয়ের রূপও বিচিত্র। টিকে থাকার, বাঁচার, হেরে যাওয়ার বিস্বাদ, কটু, প্রায় নিয়তিবাদী উপলব্ধি, শিবনারায়ণ রায়ের ভাষায় ‘নিরুচ্ছ্বাস আর্তি’ নিয়ে গড়ে উঠেছে হাসানের ধ্রুপদী বিশাল গল্পভুবন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তরকালে মুক্তিযুদ্ধের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে তিনি লিখেছেন বেশকিছু সার্থক ছোটগল্প, যা প্রধানত গ্রথিত হয়েছে জীবন ঘষে আগুন (১৯৭৩) এবং নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫) গল্প-সংকলনে। প্রধানত কৃষির সঙ্গে জড়িত গ্রামীণ মানুষের জীবন নিয়ে গল্প লিখেছেন হাসান। কিন্তু স্রষ্টার ব্যতিক্রমী জীবনার্থের স্পর্শে তাঁর গল্পগুলো হয়ে উঠেছে শাশ্বত মানবাত্মার প্রতিভূ। প্রথম পর্বের গল্পে তিনি যৌনতা এবং মানুষের আদিম কামনার শিল্পছবি নির্মাণে ছিলেন উৎসাহী। সামাজিক অবক্ষয় এবং মূল্যবোধের বিপর্যয় ধরতে তিনি ব্যক্তিমানুষের যৌনজীবনের পদস্খলনকেই তাঁর গল্পের শিল্প-উপাদান হিসেবে নির্বাচন করেছেন প্রাক-সত্তর গল্প-পর্বে। কিন্তু ক্রমে তিনি অবগাহন করেছেন রাঢ় বাংলার বৃহত্তর জনজীবনসাগরে, এবং সেখান থেকে তুলে এনেছেন বেঁচে থাকার সঞ্জীবনী সুধা, দ্রোহ-বিদ্রোহ-প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সূর্যদীপ্র বাণী।

ভাষা-প্রয়োগ এবং সংলাপ নির্মিতিতে হাসান আজিজুল হক পরীক্ষাপ্রিয় কথাশিল্পী। কখনো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কখনো-বা কমলকুমার মজুমদার তাঁকে প্রভাবিত করেছেন প্রতিবেশ-নির্মাণ কিংবা বাক্যগঠন প্রক্রিয়ায়। ডিটেইলসকে সংহত উপায়ে স্বল্পকথায় ধারণ করতে হাসান আজিজুল হক পারঙ্গম শিল্পী। চিত্রল পরিচর্যায় গল্প-প্রতিবেশ সৃষ্টিতে হাসানের সিদ্ধি শিখরবিন্দুস্পর্শী। প্রকৃতির চিত্র অঙ্কনে তাঁর নৈপুণ্য সবিশেষ উলেস্নখযোগ্য। চরিত্রের অন্তর্সত্তার অনুগামী হয়ে উঠে আসে হাসানের নিজস্ব প্রকৃতিলোক।

ষাটের উত্তালতা, সংক্ষোভ আর নির্বেদের জগৎ থেকে গৃহীত হয়েছে জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের গল্পসাহিত্যের মৌল উপাদান। নাগরিক মধ্যবিত্তের বিচ্ছিন্নতা, রতিবিলাস ও অমত্মঃসারশূন্যতার গল্প-অবয়ব নির্মাণেই তিনি অধিক আগ্রহী। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং আত্মকথনরীতির সাহায্যে তিনি উন্মোচন করেন চরিত্রের অন্তর্লোক, কখনো-বা চেতনতল-উদ্ভাসী টুকরো চিত্রকল্পের সাহায্যে তুলে ধরেন বিশেষ কোনো চরিত্রের অন্তর্সত্তা। মগ্নচেতনার পথেও তিনি কখনো কখনো বিচরণ করেন মানব-অস্তিত্বের মৌলসংকট উন্মোচনে। সূচনা-পর্বে জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত গল্প লিখেছেন গ্রামীণ নিম্নবিত্ত জীবন নিয়ে, এবং এক্ষেত্রে তাঁর সিদ্ধি শীর্ষবিন্দুস্পর্শী। ‘কেষ্টযাত্রা’, ‘রংবাজ ফেরে না’ প্রভৃতি গল্প এ-প্রসঙ্গে স্মরণীয়। ‘কেষ্টযাত্রা’ প্রকৃত অর্থেই, বাংলা ছোটগল্পের ধারায় এক উজ্জ্বল নির্মাণ। কিন্তু অনতিবিলম্বেই তিনি গ্রামীণ জীবন ছেড়ে নাগরিক মধ্যবিত্ত আলয়ে সন্ধান করলেন তাঁর গল্প-উপাদান। উত্তর বাংলার জীবনপটে উত্তরকালে তিনি লিখেছেন কিছু অসাধারণ গল্প – যে-গল্পে ফুটে উঠেছে গ্রামীণ মানুষের স্বপ্ন, সংগ্রাম আর সম্ভাবনার কথা। ‘মন্বন্তর’, ‘বিচার চাই’, ‘সম্রাট’, ‘দিন ফুরানোর খেলা’ প্রভৃতি গল্প এ-প্রসঙ্গে স্মরণীয়।

প্রতীকী ব্যঞ্জনা এবং চেতনাপ্রবাহরীতির পরিচর্যা জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ছোটগল্পের উল্লেখযোগ্য প্রাকরণিক বৈশিষ্ট্য। সংহত স্বল্পবাক নির্মেদ সংলাপ-নির্মাণের গোপন মন্ত্র তাঁর করতলগত। আবেগ, কাব্যময়তা আর উদ্ভাসিত নাটকীয়তা থেকে জ্যোতিপ্রকাশের গল্প সর্বাংশে মুক্ত। গল্পের ফর্ম সৃষ্টিতে তিনি নিয়ত পরীক্ষাপ্রিয়। এসব বৈশিষ্ট্য জ্যোতিপ্রকাশের গল্পকে এনে দিয়েছে বিশিষ্টতা।

নগরসভ্যতার অসংগতি আর বিকৃতি উন্মোচিত হয়েছে রাহাত খানের ছোটগল্পে। মধ্যবিত্ত জীবনই তাঁর গল্পের মৌল উপাদান। নাগরিক মধ্যবিত্তের অসংগতি আর নির্বেদ তাঁর গল্পে উপস্থিত হয় যৌনতার প্রেক্ষাপটে। ফলে সেখানে প্রায়শই দেখা যায় আদিম   কামনার খোলামেলা স্থূলচিত্র। ঢাকা শহরের অভিজ্ঞতালোক থেকেই রাহাত খান চয়ন করেছেন তাঁর গল্প-উপাদান। ফড়িয়া, দালাল, উঠতি ব্যবসায়ী, ধূর্ত রাজনীতিবিদ, ধনীর রক্ষিতা, আদর্শহীন থ্রিলার লেখক – এসব চরিত্র বারবার ঘুরেফিরে আসে রাহাত খানের ছোটগল্পে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে সামাজিক ভাঙন নিয়ে তিনি লিখেছেন বেশকিছু ভালো গল্প। রাহাত খানের ভাষা সাবলীল এবং কৃত্রিমতামুক্ত; ফলে পাঠকনন্দিত। ছোট ছোট বাক্য দিয়ে তিনি নির্মাণ করেন গল্পের ফুলেল শরীর।

নাগরিক মধ্যবিত্তের নির্বেদ ব্যর্থতা বিকৃতি অসংগতির পটে গল্প লিখেছেন রশীদ হায়দার। মধ্যবিত্তের পরাভব নিয়ে গল্প লিখলেও কাহিনির অন্তিমে তিনি নির্মাণ করেন উত্তরণের ব্যঞ্জনাময় ইঙ্গিত। সমাজসচেতনতা রশীদ হায়দারের শিল্পীমানসের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। প্রগতিশীল সমাজচেতনার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তাঁর মানুষেরা; তাঁর গল্প আমাদের শোনায় মানবিক সম্ভাবনার জয়গাথা, সদর্থক চেতনায় উত্তরণের বীজমন্ত্র। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়খণ্ডে রচিত তাঁর অনেক গল্পে জড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতি অনুষঙ্গ। অন্তরে ভিন্ন পুরুষ (১৯৭৪), মেঘেদের ঘরবাড়ী (১৯৮২) প্রভৃতি গ্রন্থে স্বাধীনতা-উত্তর ঢাকা শহরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত জীবনের সামূহিক অবক্ষয় ভাষারূপ পেয়েছে। রশীদ হায়দারের গল্পের ভাষা স্ফটিকসংহত, মেদমুক্ত এবং প্রতীকী-পরিচর্যাঋদ্ধ।

ষাটের দশকে আমাদের ছোটগল্পের অঙ্গনে যেসব প্রতিভাধর শিল্পী আবির্ভূত হয়েছেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁদের অন্যতম। পুরান ঢাকার ক্ষয়িষ্ণুতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, স্বার্থপরতা আর বঞ্চিত মানুষের জীবনসংগ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর গল্পের সমৃদ্ধ ভুবন। পুরান ঢাকাকে ইলিয়াসের মতো এমন অনুপুঙ্খভাবে আর কেউ দেখেননি। তাঁর গল্পে কাহিনি অপেক্ষা চরিত্র মনস্তত্ত্ব মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে, যা আধুনিক ছোটগল্পের বিশিষ্ট লক্ষণ। নেতি দিয়ে শুরু করে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর চরিত্রকে সমাপ্তিতে পৌঁছে দেন ইতির রাজ্যে। ডিটেইলস তাঁর গল্পে উঠে আসে অবলীলায়। তবে কখনো কখনো এক গল্পের মধ্যে একাধিক উপগল্প পীড়িত করে মূল গল্পস্রোতকে। তিরিশ বছরের সাহিত্যসাধনায় তিনি লিখেছেন মোট তেইশটি গল্প – এমনই স্বল্পপ্রজ এ-শিল্পী। তবে হাতেগোনা এই গল্পগুলোর মধ্যেই ফুটে উঠেছে জীবনের বিচিত্র প্রান্ত, উপলব্ধির বহুবর্ণিল জগৎ। তাঁর অন্য ঘরে অন্য স্বর (১৯৭৬) গল্পগ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে মানবিক সম্পর্কের আত্যন্তিক বিনষ্টি, খোঁয়ারিতে (১৯৮২) যুব-মানসের নির্বেদ, দুধভাতে উৎপাতে নিরন্ন মানুষের জীবনে অমোঘ নিয়তিশাসন, আর দোজখের ওম গ্রন্থে নেতি আর ইতিতে উত্তরণের কথকতা।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রকরণ পরিচর্যায় নিরীক্ষাপ্রিয় শিল্পী। অ্যান্টি-রোমান্টিক দৃষ্টিকোণে প্রাত্যহিক ভাষায় তিনি নির্মাণ করেন যাপিত জীবনের চালচিত্র। পুরান ঢাকার ভাষা, কুট্টিদের খিস্তি-খেউড় আর বাখরখানি-সংস্কৃতি ইলিয়াসের গল্পে শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত যেন। তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন দীর্ঘ বাক্যগঠনে, তবে তাঁর দীর্ঘ বাক্য গল্পের ভেতর পাঠকের অনুপ্রবেশে কোনো বাধার সৃষ্টি করে না। ফ্ল্যাশব্যাক পদ্ধতিতে কাহিনিবয়ন ইলিয়াসের ছোটগল্পের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।

ষাটের গল্পকারদের মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ সবচেয়ে বেশি প্রাতিস্বিকতাবিলাসী শিল্পী। আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতার গল্পভাষ্য নির্মাণে তিনি সিদ্ধহস্ত। বিষয়াংশ এবং প্রকরণের অভিনবত্বে তাঁর গল্পসাহিত্য বিশিষ্টতার দাবিদার। বিচ্ছিন্নতা ও নির্বেদের যন্ত্রণায় তাঁর অধিকাংশ নায়ক পীড়িত ও পর্যুদস্ত। প্রতীকী এবং পরাবাস্তববাদী পরিচর্যা আবদুল মান্নান সৈয়দের ছোটগল্পের বিশিষ্ট লক্ষণ।

আধুনিক নাগরিক মধ্যবিত্তের অনন্বয়, অসংগতি আর হার্দ্য জটিলতা নিয়ে গল্প লিখেছেন সুব্রত বড়ুয়া। মগ্নচৈতন্যের জটিল-বঙ্কিম পথে তিনি উন্মোচন করেন মানব-অস্তিত্বে স্তরীভূত সংকট – অবনীশ বড়ুয়া, মনীষা রায় আর শুল্কাদির হৃদয়ের যত গোপন যন্ত্রণা। বিষয়াংশ এবং প্রকরণ পরিচর্যার বিচারে একজন আধুনিক ছোটগাল্পিক হিসেবে তাঁকে চিনে নেওয়া যায় সহজেই। বাক্যগঠনে তিনি পরীক্ষাপ্রিয়, শব্দ ব্যবহারে সতর্ক। কখনো কখনো চূর্ণ চিত্রকল্প কি অসামান্য কোনো উপমা তাঁর গল্পের পরিণামী ব্যঞ্জনাকে করে তোলে সংহত সুগভীর।

নগর আর গ্রাম – উভয় প্রাঙ্গণেই সেলিনা হোসেনের অনায়াস যাতায়াত। নিম্নবিত্ত খেটে-খাওয়া মানুষের যাপিত জীবনের নানা সমস্যা নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর গল্পের ধ্রুপদী জগৎ। জীবনের আহবানে, বেঁচে থাকার আকুল বাসনায় তাঁর প্রিয় মানুষেরা গ্রাম ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে শহরে। কিন্তু গ্রামের মতো শহরেও এরা অপাঙ্ক্তেয়, অবশেষে উন্মূলিত, জীবনবিচ্যুত, আশারিক্ত। উৎস থেকে নিরন্তর (১৯৬৯), খোল-করতাল (১৯৮২) প্রভৃতি গ্রন্থে এসব উন্মূলিত নিরন্ন আশাহত মানুষের সাক্ষাৎ পাই আমরা। ইতিহাস-ঐতিহ্যের পটে চরিত্রনির্মাণ সেলিনা হোসেনের উলেস্নখযোগ্য ছোটগাল্পিক বৈশিষ্ট্য। মানব-প্রগতির স্বার্থেই তিনি বিচরণ করেন ঐতিহ্যলোকে, কখনো-বা ইতিহাসে, কখনো-বা সংক্ষোভময় সমকালে। সমাজসচেতনতা এবং বস্ত্তবাদী জীবনপ্রত্যয় নিয়ে সেলিনা হোসেনের প্রিয় মানুষেরা উত্তীর্ণ হয় জ্যোতির্ময় পরমার্থলোকে। এই ইতিবাচক জীবনদৃষ্টি বাংলাদেশের ছোটগল্পে সেলিনা হোসেনের প্রাতিস্বিকতার কেন্দ্রীয় উৎস। বিষয়াংশের মতো প্রকরণ পরিচর্যায়ও সেলিনা হোসেন পরীক্ষাপ্রিয় ও স্বাতন্ত্র্য-অন্বেষী। গল্পে অপ্রচলিত
এবং আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারে তাঁর নৈপুণ্য সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁর গল্পের ভাষা গীতল ও চরিত্রানুগ, প্লট সংহত, আর সংলাপ কেন্দ্র-অভিমুখী।

আশির দশকে প্রথম গল্প-সংকলন প্রকাশিত হলেও গল্পকার হিসেবে কায়েস আহমেদের আবির্ভাব ষাটের দশকে। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার বহুমাত্রিক সংকটের পটে মানব অস্তিত্বের সামগ্রিক রূপ-অঙ্কনই কায়েস আহমেদের ছোটগাল্পিক অভিযাত্রার মৌল-অন্বিষ্ট। এ প্রসঙ্গে তাঁর ‘অপূর্ণ তুমি ব্যর্থ বিশ্ব’, ‘ফেরারী বসন্তকে খুঁজে’, ‘লাশ কাটা ঘর’ প্রভৃতি গল্পের নাম স্মরণীয়। বিষয়াংশ ও শৈলী সৌকর্যে কায়েস আহমেদের গল্পসমগ্র বাংলা গল্পের ধারাতেই দাবি করতে পারে স্বতন্ত্র মর্যাদা। কায়েস আহমেদের ভাষা গদ্য-পদ্যের যুগলবন্দিতে বিশিষ্ট ও ব্যতিক্রমী।

বিশ শতকের ষাটের দশকে রচিত বাংলাদেশের ছোটগল্পসাহিত্য পঞ্চাশের গ্রামজীবন অতিক্রম করে ক্রমশ শহরমুখী হয়ে উঠেছে। পঞ্চাশের ছোটগাল্পিকদের তুলনায় এ-পর্বের ছোটগাল্পিকরা অনেক বেশি আঙ্গিকসচেতন ও প্রকরণনিষ্ঠ; বিষয়াংশ-নির্বাচন, ভাষা-ব্যবহার এবং প্রকরণ-পরিচর্যায় অধিকাংশ ছোটগাল্পিক পরীক্ষাপ্রবণ ও বৈচিত্র্যসন্ধানী।