খসে  পড়া তারার গল্প

(এক)

একফালি ঝকঝকে আকাশের দিকে তাকিয়েই চোখ বন্ধ করে বন্যা। একসাথে এত আলো সহ্য হয় না ওর। ক্লান্তিতে হাত পা ছেড়ে দিয়ে পানির উপরে ভাসতে থাকে সে। শুধু নাকটা  জেগে আছে পানির ওপরে। চোখ বন্ধ করেই স্রোতের বেগটা বেশ বুঝতে পারছে ও। স্রোত বন্যাকে বেশ খানিকটা দুরে নিয়ে এসেছে, বুঝলেও সাঁতরে পাড়ে যাবার বিন্দু পরিমান শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই বন্যার শরীরে। তাই শরীরটাকে পানির উপরেই ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত সে এখন । একটা গাংচিল চিৎকার করতে করতে ঠিক বন্যার মাথার উপর  দিয়ে পার হয়ে গেল। ৬ বছরের সৌরভ,  বন্যার একমাত্র ভাই,  খালি পা,খালি গায়ে নদীর পাড় দিয়ে বন্যার সাথে সাথে দৌড়াচ্ছে আর কাঁদছে।”  বন্যা উঠে আয়, ও বন্যা উঠে আয়, ” শব্দগুলো কান্নার সাথে মিলেমিশে একাকার। সৌরভের ভেজা শরীর থেকে টুপটাপ করে পানি পড়ছে। মাথার একঝাঁক ভেজা চুলের  পানি  সৌরভের চোখের নোনা পানির স্রোতটিকে হালকা করে দিচ্ছে। বন্যার কানে সৌরভের চিৎকার  অস্পষ্ট একটা গোঙানি হয়ে পৌঁছাচ্ছে। কিসের শব্দ এটা বুঝতে পারছেনা বন্যা। একদমই ভয় করছে না বন্যার। বিষয়টা বেশ উপভোগ করছে সে। ভেসে ভেসে যদি দূর কোন দেশে পৌঁছে যাওয়া যেত,স্বপ্নের কোন  দেশে। মেঘেদের মিছিলে যদি হারিয়ে যাওয়া যেত! যেখানে কেউ জানত না বন্যার বাবার পরিচয়।, বাবার নামের সাথে নিজের নামটাকে চিরতরে মুছে ফেলা যেত যদি! এমন একটা জায়গায় যদি চলে যাওয়া যেত যেখানে বন্যা শুধু নিজের পরিচয়ে বাঁচতে পারত!  তখনই সৌরভের মুখটা মনে পড়ে বন্যার। বড় বড় চোখ দুটি ছলছল করছে ,একটু সুযোগ পেলেই শুরু হবে বর্ষন। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে বন্যার, ভাইটাকে ব্ড্ড ভালোবাসে ও। মাথাটা শূণ্য  মনে হয় বন্যার হঠাৎ করেই। তারপর আর কিছুই মনে থাকে না ওর।

 

(দুই)
বন্যা আর সৌরভ এ গাঁয়ে আছে প্রায় এক বছর ধরে। এটা ওদের নানাবাড়ি। নানা মারা গেছে যখন বন্যার মা খুব ছোট। বন্যার মায়েরা তিন বোন। ভাই নেই। বন্যার মা সবার ছোট।  ওরা মায়ের হাত ধরে এসেছিল এ গাঁয়ে। সাথে নিয়ে এসেছিল  ধানের চাতালের পাশে ঘুপচি ঘরের ছেঁড়া পাতলা দুটি চ্যাঁ,  সবসময় ব্যবহার করা প্লেট, গ্লাসসহ বাক্সতে তুলে রাখা কাঁচের জগ, চারটি প্লেট, কয়েকটা হাতলভাঙ্গা কাপ,  পাতিল, কড়াই, নতুন বিছানার চাদর সব।  মা ধানের চাতালের লোকের কাছ থেকে পুরনো যে খাটটা কিনেছিল শুধু সেটা আনতে পারেনি। বন্যা আর সৌরভের মন খুব খারাপ হয়েছিল । পুরনো রংচটা যেমনই হোক, খাট তো।  ঘুপচিগুলোর মধ্যে শুধু ওদেরই খাট ছিল। নানিবাড়ি খাট আছে কি না সেটাই ভাবনার বিষয় ছিল দুই ভাইবোনের। মায়ের হাতের ব্যান্ডেজ তখনও খোলা হয়নি। চাতালের সবাই খুব ভালোবাসত ওদের। চিলাহাটি ট্রেন ষ্টেশন পর্যন্ত এসেছিল ওরা সবাই। জিনিসপত্র সব তুলে দিয়েছিল ট্রেনে। কুষ্টিয়া ষ্টেশনে নেমে গাড়িতে করে এসেছিল নানাবাড়ি । খুব মন খারাপ হচ্ছিল ওদের চাতালের সবার জন্য। যদিও সেই ছোটবেলা থেকে মা ধানের চাতালে কাজ করতে বের হলেই ওদের দুই ভাইবোনকে ঘুপচিতে আটকে রেখে যেত। সারাদিন ঘুপচিতে খুব কষ্ট হতো বন্যার। ছটফট করত বাইরে যাওয়ার জন্য। তারপর সৌরভ কে পাওয়ার পর থেকে ওর দেখাশোনা করতেই সময় পার হয়ে যেত। বন্যা খুব স্কুলে যেতে চাইত, আজ তার স্বপ্ন পূরণ  হতে চলেছে। মা বলেছে ওদের দুজনকেই স্কুলে ভর্তি করে দিবে।তবুও চাতালের সবার জন্য কষ্ট হচ্ছে খুব।

(তিন)

সৌরভের কান্না শুনে জেলেদের  নৌকা অজ্ঞান অবস্থায় তুলে নিয়েছিল বন্যাকে।তুলে নিয়েছিল সৌরভকেও। বন্যা  সুস্থ হবার পর জেলেরা বন্যার নানাবাড়ির ঘাটে নামিয়ে দিয়ে যায় দুই ভাইবোনকে।  জেলেদের নৌকা থেকে নামতেই বন্যার চুলের ঝুঁটিটা ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে ফেলে দেয় কেউ। বন্যা নিজের চুল নানির হাতের মুঠোয় আবিষ্কার করে। শির্নকায় শরীর থেকে চ্যাঁ চ্যাঁ কন্ঠের অজস্র গালি চারপাশের পরিবেশকে ভারি করে তোলে নিমিষেই। বন্যা তার দু একটাই বুঝতে পারে।  ” হারামজাদি, তিনবেলা ভাত খাইয়া শরীলে ত্যাল জইম্যা গেছে না? আমার মাইয়্যার কষ্টের টাহার ভাত! শয়তানের বাচ্চা শয়তান! বাপ যেমন তার ঝি তেমন।তুই জাহান্নামে যাবি যা, আমার নাতিরে (সৌরভ) কুনু জাগা যদি  নেছস তাইলে তোর একদিন কি আমার একদিন”  নিজের চুলের মুঠি নানির হাত থেকে কোনরকমে ছাড়িয়ে  নিয়ে দৌঁড়াতে থাকে বন্যা। সৌরভের চোখদুটি গড়িয়ে পানি পড়তে থাকে। বন্যাকে খুব ভালোবাসে সৌরভ। আজ তো বন্যার কোন দোষ ই নেই। নদীতে বালি ভর্তি ট্রলার যাচ্ছিল, সবার দেখাদেখি সৌরভও সাঁতরে গিয়ে উঠেছিল ট্রলারে, ট্রলার থেকে লাফ দিয়ে পানিতে পড়েছিল সে ও। কিন্তু তৃতীয়বারে ট্লার থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রায় ডুবে যাচ্ছিল সৌরভ। ওকে বাঁচাতে গিয়েইতো বন্যার আজ এমন অবস্থা। নানি যে কেন বন্যাকে দেখতে পারেনা বুঝে উঠতে পারেনা সৌরভ। গরম ভাত,  ডিমওয়ালা বড় বড় পুঁটি মাছ আর ডাঁটার ঝোলের সাথে লেবুর রস দিয়ে মেখে সৌরভকে খাইয়ে দিচ্ছিল নানি। সৌরভের বন্যার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছিল। খেতে বড্ড ভালোবাসে বন্যা! ভাত মুখের মধ্যে দিতেই কান্নাটা অস্ফুট স্বরে বের হয়ে আসতে গিয়ে আটকে যায় গলায়। দম বন্ধ হয়ে একটানা কাঁশতে থাকে সৌরভ।

 

(  চার)

শিকদারদের বড় আমবাগানটা নদীর পাড় ঘেষেই। এই বাগানে অনেক রকম আমগাছ। এদের নামও মজার মজার। বাগানে একটা আমগাছ আছে যেটাতে কাঁচামিঠা আম হয়। এ গাছের আম কাঁচা থাকতেই খুব মিষ্টি তাই এর নাম কাঁচামিঠা আম। বন্যা গল্প শুনেছে শুধু,  এখনো খেতে পারেনি। গাছটা এত বড় যে বন্যা উঠতে পারে না। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই ছুটে আসে এখানে। অন্য সব গাছের আম পেলেও এখনো পায়নি কাঁচামিঠা গাছের কোন আম।

নানির হাত থেকে পালিয়ে এক দৌঁড়ে এখানে এসে থামে বন্যা। হাঁপাতে থাকে খুব। পা আর চলছেনা কিছুতেই। হাঁটু গেড়ে কাঁচামিঠা আমগাছটার নিচে বসে পড়ে বন্যা। খুব  ঘুম পাচ্ছে  তার।  গাছের গায়ে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বন্যা।জেলেদের গামছা দিয়ে মাথা আর গা  মুছে নিয়েছিল কোনরকম। ফ্রকটা এখনো ভিজে আছে। বাতাসে শুকিয়ে যাবে, ওসব নিয়ে ভাবার সময় নেই বন্যার।
ঘুমে বন্যা চোখ খুলে রাখতে পারছে না। কষ্ট হচ্ছে তাকিয়ে থাকতে।এমন সময় একটা শব্দ পেয়ে সেদিকে চোখ রাখতেই তৃপ্তির হাসি প্রসারিত হয় ওর মুখে। কাঁচামিঠা আম! বন্যার চোখের সামনে! নিমিষেই সব কষ্ট,  ক্লান্তি উধাও। যা এতদিনে আল্লাহর কাছে শুধু চেয়ে এসেছে, আজ এভাবে পাবে ভাবতেও পারেনি বন্যা। খেতে গিয়েও সৌরভের কথা ভেবে পাজামার সাথে গুঁজে রাখে আমটা। বাড়ি গিয়ে একসাথে খাবে।

মানুষের কথা কানে আসতে থাকে বন্যার, সতর্ক  হয়ে শোনার চেষ্টা করে। ক্রমশ শব্দগুলো কাছে আসতে থাকে। মির্ধা বাড়ির সেলিম মামা,  জামাল ভাই, কনিকা আর সোহেল। কনিকা ওর সাথেই পড়ে। যদিও বন্যার থেকে বয়সে ২-৩ বছরের ছোট কনিকা। বন্যা চিলাহাটি থাকতে কোন স্কুলে যেতে পারেনি তাই বয়স যাই হোক পারগতার দিক বিবেচনা করে ওকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করেছে স্যার ম্যাডামরা।
“তোমরা কি আম পাড়বা মামা?” বন্যার কথায় সেলিম হেসে  বলে, ” নারে মামা, বড় রাস্তায় যাব।”তাইলে তোমাগো হাতে বাজারের ব্যাগ আর এত বড় কোটা ক্যান মামা?””বড় রাস্তার খই গাছগুলায় সব খইগুলান পাইক্যা রইছে, আইজকাই পাড়ব। তুই যাবি আমাগো হাতে?? ”
বন্যার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠে। ওকে সেলিম মামা নিতে চাইছে সাথে, কেউ কোথাও নিতে চায় না বন্যাকে। সবাই শুধু তাড়িয়ে দেয়। এ পৃথিবীতে বন্যাই যেন শুধু অযাচিত!! ভালোবাসার লোকের বড্ড অভাব।

( পাঁচ)

বড় রাস্তার দুইধারে সারি সারি বাবলা গাছ। একেকটা গাছ অনেক বছরের পুরনো।  পাকা বাবলা ফলের (খই বা ডুঙ্কুর বলা হয় অঞ্চলভেদে) ঘ্রাণে বাতাসে একটা মাদকতা সৃষ্টি হয়েছে। কাচা, পাকা বাবলা ফল মিলে এক অপরুপ সৌন্দর্যে ভরে উঠেছে গাছগুলো। নতুন বউ যেমন নানা অলংকারে সাজে , গাছগুলোকে দেখে ঠিক তেমন লাগছে। কাচা ফলগুলো হালকা সবুজ, পাকা ফলের কিছু গোলাপি আর কিছু লাল টুকটুকে। রাস্তার উপরে পড়ে আছে অনেক বাবলা ফল, যেগুলোর খোসা ছাড়ানো । খোসা ছাড়ানো সাদা সাদা ফলগুলোর মাথায় গোলাপি আভা, কোনটা পুরোপুরি গোলাপি। জানা অজানা নানা পাখির সমাবেশ এখানে। পাকা ফলের উপর বসে  ঠোঁকর দিচ্ছে …কোনটা খেতে পারছে কোনটা ঠোঁট থেকে পড়ে যাচ্ছে রাস্তায়। দুপুর বেলার নির্জনতা ভেঙ্গে বড় রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে দু একটা দুরপাল্লার বাস চলে যাচ্ছে। ট্রাক মোটরসাইকেল, ভ্যানও  হুইসেল বাজিয়ে  নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত চারপাশ। বন্যা মুখে কিছু না বললেও মনে মনে ধন্যবাদ দেয় সেলিম মামাকে। রাস্তা থেকে পাকা বাবলা ফল কুঁড়িয়ে ওড়না ভর্তি করে ফেলেছে বন্যা। কুঁড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে মুখ ভর্তি করে খেয়ে নিচ্ছে পাকা ফল। সেলিম মামা কোমরের তাগির সাথে বাজারের ব্যাগ বেঁধে,?  হাতে লম্বা  কোটা নিয়ে তরতর করে একগাছ থেকে অন্যগাছে উঠে যাচ্ছে। নামছে ব্যাগভর্তি বাবলা নিয়ে। সবাই ভাগ করে বাবলা নিয়ে বন্যাকেও কিছু ফল দেয় ওরা। সবার সাথে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে বন্যা। কিছুদূর যেতেই জামাল ভাই  সেলিম মামাকে বলে, ” হেইদিনের টিয়্যা পাখির কতা ভুইল্যা গেছনি?  ” হ রে ভুইল্যা ই তো গেছালাম এহেবারে। ন দেহি কি অবস্তা ওইগুনার?” সেলিম মামা জিব কেটে উত্তর দেয়। টিয়্যা পাখি?” জানতে চায় বন্যা। ” হ রে  বন্যা, চল দেহি, বেশি পাইলে তোরেও এডা ছাও দিবানে।” সেলিম মামার এমন কথায় বন্যা উচ্ছাসে লাফিয়ে ওঠে। ওড়না ভর্তি বাবলা আর পাজামার কোচরে কাঁচামিঠা আম নিয়ে সেলিম মামাদের দলটিকে অনুসরন করে বন্যা।

পূর্ব দিকের কয়েকটা ক্ষেত পাড়ি দিয়ে ব্যাপারির বড় দীঘির কাছে পৌঁছায় ওরা। সন্ধ্যা নামব নামব করছে, গোধূলির লাল আলোয় চারপাশ স্বর্গের মত লাগছে । ব্যাপারিদের দীঘিটা অনেক বড়, অনেক রকম মাছের চাষ করেছে এখানে। দীঘির চারপাশ ঘিরে কলা, আম, লেবু, পেয়ারা,পেঁপে,  জামরুল গাছ। দীঘির দুইদিকে দুটো টোঙ। দিনে রাতে ব্যাপারির লোক ঐ টোঙে বসে পাহারা দেয়।দীঘির উত্তর পাশের ছোট একটা আম গাছে  গতসপ্তাহে সেলিম মামারা টিয়া পাখির বাসা দেখে গেছে। সেলিম আর জামাল গেছে টিয়া পাখির খোঁজে। বন্যা আর কনিকা দীঘির পাড়ের ঢালে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কলাগাছের ঝোপের পাশে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছে শুধু। কেউ টের পেয়ে যেতে পারে বলে কথা বলতে নিষেধ করেছে সোলিম মামা। তাইতো অন্ধকারের গায়ের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে আছে দুজন।কতক্ষণ  দাঁড়িয়ে আছে এভাবে বলতে পারবেনা কেউ, হঠাৎ করেই নিস্তব্ধতা ভেঙে কানে এলো.. বন্যা পালা…! পালা….!দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বড় রাস্তায় এসে থামে ওরা।তখন গাঢ় অন্ধকার। একটা দুর পাল্লার গাড়ি দ্রুত চলে যায় ওদের পাশ দিয়ে,  সেই গাড়ির ক্ষীণ আলোতে সেলিম মামার হাতে ঝলকে উঠে টিয়া পাখির কতগুলো বাচ্চা।

 

( ছয়)

কুমার নদী থেকে একটা সরু  খাল চলে গেছে বড় রাস্তা বরাবর। বর্ষাতালে নদীতে ভরা যৌবন যখন উপচে পড়ে তখন তা নদীকে ছাপিয়ে সরু খালটিকেও যৌবনা করে দেয়। বর্ষাকাল ছাড়া বছরেরে বাকিটা সময় খালটা শুকনা থাকে  ।তখন তা মানুষের পায়ে চলা পথ হয়ে যায়।
কুমার নদী আর এই খালের মুখেই বন্যার নানাবাড়ি। গ্রামের সব বাড়িতে বিদ্যুৎ থাকলেও বন্যাদের ঘরে নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। হারিকেন আর ল্যাম্প ই ভরসা ওদের। মা টাকা পাঠালেই বন্যাদের ঘরে সংযোগ দেয়া হবে বিদ্যুৎ। মার পাঠানো টাকা দিয়েইতো নতুন টিনের ঘর, ঘরের পাশে টিউবওয়েল,  টয়লেট দেওয়া হয়েছে।সৌরভের স্কুলের ইউনিফর্ম, জুতা -মোজা , বন্যার স্কুলের ইউনিফর্ম সব হয়েছে। বন্যার একটা সাদা জুতা মোজা পরার খুব শখ। স্কুলের প্রায় সবাই সাদা জুতা মোজা পরে আসে। বন্যার খুব ভালো লাগে দেখতে। স্পঞ্জ পরে স্কুলে যেতে একটুএ ভালো লাগে না বন্যার। নানিকে বলেছিল একটা সাদা জুতার কথা। নানি ভাবল সৌরভকে জুতা পরতে দেখে বন্যার বুঝি হিংসে হচ্ছে!! নানি যে কেন বন্যাকে সহ্য করতে পারে না.. অনেক ভেবেও তার  কোন উত্তর মেলে না বন্যার। তার চেহারাটা অনেকটা তার বাবার মতন বলে? তাহলে তা তো সৌরভের ও। নানি সৌরভকে ভালোবাসে। এটা বুঝতে পারে বন্যা।এজন্য নানির উপর  কোন রাগ  হয়না বন্যার।
এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির পিছনের খালের ঢাল বেয়ে বাড়িতে উঠে আসে  বন্যা। দরজা খোলা। মাটিতে মাদুর পেতে হারিকেনের আলোতে পড়ছে সৌরভ। নানি ঘরে নেই জেনেই দ্রুত ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দেয় বন্যা। বন্যাকে দেখে সৌরভের চোখদুটিতে পানি ছলছল করে ওঠে। মুখ ফিরিয়ে পড়ায় মন দেয় সৌরভ। ভাইয়ের অভিমান দেখে হেসে ফেলে বন্যা। এক এক করে সারাদিনের পাওয়া সম্পদগুলো ভাইয়ের সামনে বের করে আনে ও।  কাঁচামিঠা আম, ওড়নার টোপর ভর্তি পাকা পাকা বাবলা, আর টিয়া পাখির বাচ্চা দেখে সৌরভের   মুখ আনন্দে চকচক করতে থাকে। কিন্তু বিপত্তি  অন্য জায়গায়,  পাখি রাখা হবে কোথায়? কোন খাঁচা নেই যে ওদের কাছে। আপাতত সৌরভের জুতার বাক্সেই রাখা হবে পাখি এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। পাখিসহ জুতার বাক্স ঘরের বিছানার নিচে একপাশে লুকিয়ে রাখে ওরা। বাবলা ফলগুলোও রেখে দেয়, বাক্সের উপর। কাজ শেষ করে দরজার খিলটা আলতো করে আলগা করে রাখে  ওরা।  নানি মুখ ভার করে ঘরে ঢুকে কারো সাথে কথা না বলে শুয়ে পড়ে খাটে। এমন দেখেনি নানিকে ওরা কখনো। খুব মারাত্মক কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পারছে বন্যা, কিন্তু কি ঘটেছে বুঝতে পারছে না। নানিকে জিজ্ঞেস করার মত সাহস নেই বন্যার। মাটিতে বিছানা পেতে ঘরের এককোনে শুয়ে পড়ে বন্যা।
ঘরে নতুন খাট কেনা হয়েছে মায়ের পাঠানো টাকা দিয়ে। তাতে নতুন তোষক, চাদর। বন্যা নতুন তোষক আর চাদরে মুখ ডুবিয়ে  মায়ের ঘ্রাণ নিয়েছিল। নানির সাথে দুই ভাইবোন ঘুমিয়েছিল সুখের আবেশে।  কি জানি কি কারনে বন্যা সেদিন নষ্ট করেছিল বিছানা। যা কোনদিন হয়নি, বন্যাও বুঝে উঠতে পারেনি কি থেকে যে কি হয়েছিল সেদিন!! গ্রামের প্রায় সবাইকে বলেছিল নানি সে কথা। বন্যা মনে রাখেনি সে কথা। কষ্টও পায় নি।ইচ্ছে করে  করেনি কাজটা বন্যা। শুধু নানির লাঠির বাড়ির দাগ মিশে যেতে সময় লেগেছিল কিছুদিন। বাড়ির পাশের রুনার মা মামি বলেছিল” বন্যা দৌঁড়া, পলাইয়া যা, ও বন্যা পলা শিগগীর। ” বন্যা নড়েনি একটু কোথাও। বসেছিল যতক্ষণ নানির মনের জ্বালা আর হাতের জোর শেষ না হয়। না, বন্যা কাঁদেওনি শব্দ করে। দু চোখ বেয়ে শুধু অভিমান ঝরে পড়েছিল। মজিদ নানার  বউ, যে সবসময় দু চারটা কথা শোনানোর জন্য প্রস্তুত থাকে , এসেছিল সেদিন ও। টেনে টেনে বলছিল ” আসলেই বন্যা তুই :বড় ত্যাড়া মাইয়্যাগো। পুলাপান মানুষ, নানি মারবার চাইছে দৌঁড়াইয়া সইরা যাবো – তা না। গেডির রগ ব্যাকা সবকয়ডা। এত্ত জিদ মাইয়া মাইনসের ভালো না। বন্যার নানি, তোমারেও কই এই নাতনিরে পাইল্যা তুমার কোন লাভ নাই। বাপের মাইয়্যা, স্বভাব ও বাপের নাগাল। ”
নানিও সম্মতি জানিয়ে একমুখ থুথু ফেলে বলেছিল, ” কুত্তার জিদ”।এবার বন্যার অভিমানগুলো ফুসে ওঠে,  গোঙানী দিয়ে শব্দ করে ছিটকে বেরিয়ে আসে। নানির মারগুলো বন্যাকে কষ্ট দিতে না পারলেও মজিদ নানার বউয়ের কথা বন্যা সহ্য করতে পারে না। বাবাকে ঘৃণা করে বন্যা। নিজের চোখের সামনে দেখেছে মাকে কি  নির্মমভাবে মেরেছে বাবা। কেউ বাবার সাথে বন্যাক তুলনা করলে খুব কষ্ট পায় বন্যা।

(সাত)
গায়ের রং কালো, চামড়া খসখসে।  চোখদুটি বেশ বড় বড়, চুল ঘাড় পর্যন্ত। অযত্নে চুলগুলো লাল হয়ে আছে, সেখানে  বাসা বেঁধেছে উকুন।
খুব বেশি  কথা বলে না বন্যা কারো সাথে।  সবসময় চুপচাপ থাকে। বড় বড় চোখ মেলে শুধু পৃথিবীর মানুষের অভিনয় দেখে আর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে।মায়ের খবর পাওয়ার পর থেকে আরো চুপচাপ হয়ে বসে আছে বন্যা। সৌদি আরবে কাজ করতে গিয়েছিল বন্যার মা, পারভিন। সেখানে মারাত্মক  নির্যাতনের শিকার হয়ে বন্দি এখন।  কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও কেউ জানেনা। বন্যার মা যেখানে কাজ করত তার ঠিক পাশের বাড়িতে কাজ করত ইদ্রিস  মামার বোন। সে কোনরকম বেঁচে ফিরে এসে খবর দিয়েছে। .

কেটে গেছে আরো ৬ মাস। বন্যা জামা কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে বের হচ্ছে। খুব সুন্দর একজন মহিলার সাথে কথা বলছে বন্যার নানি। “কোন চিন্তা করবেন না, বন্যা আমার নিজের মেয়ের মতই থাকবে।  ভারি কোন কাজ করাবো না ওকে দিয়ে, বেতন টা পাঠিয়ে দেব  আপনার কাছে। আমার মেয়ে যা খাবে বন্যা ও তাই খাবে।” বন্যার নানি খুব খুশি। বন্যা ওখানে শান্ত হয়ে থাকলে ভালো। ঢাকায় নিজের বাড়ি মহিলার। বন্যা খেয়ে পরে ভালো থাকবে। বন্যার টিয়া পাখির বাচ্চা উড়তে শিখেছিল, খাঁচাও এনে দিয়েছিল বন্যা। আজ বন্দি জীবনের সূচনালগ্নে এই বন্দিকে তাই খাঁচা থেকে মুক্তি দিয়ে দিল বন্যা।