শিল্পী ধীরাজ চৌধুরী : আধুনিকতার অন্যতম রূপকার

শিল্পী ধীরাজ চৌধুরী (১৯৩৬-২০১৮) প্রয়াত হলেন গত ১ জুন। ষাটের দশকের শিল্পীরা, যাঁরা ভারত-বাংলাদেশের চিত্রকলায় আধুনিকতার নতুন দিশার সন্ধান দিয়েছিলেন, এবার তাঁরা একে একে বিদায় নিচ্ছেন। গত কয়েক বছরের মধ্যে চলে গেলেন শ্যামল দত্তরায়, বিকাশ ভট্টাচার্য, গণেশ পাইন, প্রকাশ কর্মকার, বিজন চৌধুরী, কার্তিক চন্দ্র পাইন, সুহাস রায়, বিআর পানেসর, অনিতা রায়চৌধুরী – এরকম আরো অনেকেই। এঁদের সকলেই যে অবদান রেখে গেছেন, তা আমাদের চিত্রকলাকে সমৃদ্ধ করেছে। ইতোমধ্যে সময় পালটেছে। পালটেছে সমাজের সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যকলার অভিমুখও। তাঁদেরই সৃজিত রূপচেতনার ভিত্তির ওপর এসেছে পরিবর্তন। তাঁদের পক্ষে সেখানে নতুন কিছু যোগ করার সুযোগ ছিল খুবই কম। তাঁদের এই বিদায় বা সমাপ্তি আজ তাঁদেরই সৃজনের শিখরকে রণিত করে তোলে আমাদের সামনে।

সমকালীন চিত্রকলায় ধীরাজ চৌধুরীর অবদানকে অনুধাবনের আগে আমরা একটু দেখে নিতে চাই ষাটের দশকের চিত্রকলার চালচিত্রটি। যে-কোনো সময়কে বুঝতেই তো প্রয়োজন ইতিহাসের প্রেক্ষাপট। তবু আমরা বেশিদূর যাব না। শুরু করব ১৯৪৭-এর স্বাধীনতাপ্রাপ্তি, তথা দেশভাগের সময় থেকে। সেটা ছিল এক দুর্মর অভিজ্ঞতা দুই বাংলার সাধারণ মানুষের পক্ষে যেমন, শিল্পীদের পক্ষে তার চেয়েও বেশি। দলে দলে আসছে নিজের জন্মভিটে থেকে বিতাড়িত মানুষ। আশ্রয়ের খোঁজে তারা দিশাহারা। এরই মধ্যে চলছে সাম্প্রদায়িক হানাহানি। এই সন্ত্রাসকে শান্ত করার জন্য মহাত্মা গান্ধী কয়েক মাস পূর্ববাংলার নোয়াখালিতে কাটিয়ে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির দিন রয়েছেন কলকাতার বেলেঘাটায়। হিংসা থামানোর জন্য অনশন করছেন। তাতে সাড়া দিয়ে বিবাদী দুপক্ষই তাঁর কাছে এসে অস্ত্র সমর্পণ করছে। ষাটের দশকের শিল্পী যাঁরা, তাঁদের প্রায় সবারই বয়স তখন আট থেকে দশের মধ্যে। শৈশবে তাঁরা এই দৃশ্য দেখেছেন। এর অভিঘাত কিন্তু ষাটের দশকের চিত্রকলায় রয়ে গেছে।

চল্লিশের দশকের প্রতিবাদী চিত্রচেতনার শুরু অবশ্য আরো অনেক আগে। তেতাল্লিশের মন্বন্তর সব শিল্পীর সামনে নিয়ে এসেছিল অনিবার্য বিপদ-সংকেত। চল্লিশের প্রায় সব শিল্পীই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন মন্বন্তরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী-চেতনায়। জয়নুল আবেদিনের মন্বন্তর চিত্রমালা পরবর্তীকালে প্রবাদপ্রতিম হয়ে গেছে। এছাড়া আরো কিছু শিল্পী মার্কসবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মন্বন্তরের নিদারুণ বাস্তব থেকে গড়ে তুলেছিলেন বিশেষ এক আঙ্গিক-পদ্ধতি, যার ভেতর দিয়ে তাঁরা অবহেলিত, নির্যাতিত ও বঞ্চিত মানুষের হাহাকার ও আর্তিকে রূপ দিয়েছিলেন। পাশাপাশি মেলে ধরেছিলেন সৌন্দর্য বা আদর্শেরও এক মুখ, যে-অভিমুখে যেতে হবে এই সভ্যতাকে। এই ধারার শিল্পীদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য চিত্তপ্রসাদ, সোমনাথ হোড়, দেবব্রত মুখোপাধ্যায়, সূর্য রায়, মণি রায় প্রমুখ। চল্লিশের আর একটি ধারা জেগে উঠেছিল সংঘবদ্ধ শিল্প-আন্দোলন থেকে। ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের বছরেই গড়ে উঠেছিল ‘ক্যালকাটা গ্রুপ’। এর সঙ্গে যুক্তি ছিলেন প্রদোষ দাশগুপ্ত, গোপাল ঘোষ, নীরদ মজুমদার, পরিতোষ সেন, সুভো ঠাকুর, সুনীল মাধব সেন, প্রাণকৃষ্ণ পাল, অবনী সেন প্রমুখ শিল্পী। চল্লিশের এই দুটি ধারার শিল্পীরাই আধুনিকতার ধারায় বড় রকমের পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। সমাজবাস্তবতা ও প্রবহমান ঐতিহ্যের সমন্বয়ে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন আধুনিকতাবাদী বা মডার্নিস্ট এক আদর্শ। এ-কাজে তাঁরা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তাঁদের কয়েকজন পূর্বসূরির কাছ থেকে, যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমৃতা শের-গিল, যামিনী রায় ও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।

চল্লিশের দশকের এরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রেক্ষাপটেই ষাটের দশকের শিল্পীরা শুরু করেছিলেন তাঁদের নতুন অন্বেষণ। চল্লিশের শিল্পীরা তাঁদের রূপের নির্মাণে পাশ্চাত্য আধুনিকতা ও আধুনিকতাবাদকেই গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন বেশি। ষাটের শিল্পীরা সেই গুরুত্বকে স্বীকার করে ঐতিহ্য থেকেও আহরণ করতে চেয়েছিলেন রূপের নির্যাস। নব্য-ভারতীয় ঘরানার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যকে তাঁরা নতুন মাত্রায় বিন্যস্ত করেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ বা নন্দলালকে তাঁরা নিছক পুনরুজ্জীবনবাদী বা ‘রিভাইভালিস্ট’ ভাবেননি। গণেশ পাইন, শ্যামল দত্তরায়, বিজন চৌধুরী প্রমুখ শিল্পী দেশীয় ঐতিহ্য থেকে গ্রহণ করেছেন অনেক কিছু। অন্যদিকে নিষ্ঠুর বাস্তবতার নির্মাণে স্বাভাবিকতাবাদী আঙ্গিক ও পাশ্চাত্যের অভিব্যক্তিবাদকে মিলিয়েছিলেন প্রকাশ কর্মকার বা বিকাশ ভট্টাচার্যের মতো শিল্পী তাঁদের রূপের নির্মাণে। সবমিলিয়ে ষাটের শিল্পীরা চেয়েছিলেন ভারতীয় আধুনিকতার নতুন এক আত্মপরিচয় নির্মাণ করতে, যাতে একে কখনো পাশ্চাত্যের অনুকরণ বলে মনে না হয়, আবার তাতে আধুনিকতার সংঘাতও পরিস্ফুট হয়। শিল্পের পথকে সহজ করার জন্য তাঁরা সংঘবদ্ধ শিল্প-আন্দোলনের ওপর জোর দিয়েছিলেন। ১৯৬০ সালে গড়ে উঠেছিল ‘সোসাইটি অব কনটেমপোরারি আর্টিস্টস’, ১৯৬৪-তে ‘ক্যালকাটা পেইন্টার্স’।

ষাটের দশকের আন্দোলনের সঙ্গে নিবিষ্টভাবে যুক্ত ছিলেন আমাদের আলোচ্য এই শিল্পী সদ্যপ্রয়াত ধীরাজ চৌধুরী। ষাটের দশকের শিল্পের মূল যে বৈশিষ্ট্য – ঐতিহ্যচেতনা, বাস্তবচেতনা ও আন্তর্জাতিকতাবোধ, স্বদেশ  ও বিশ্বের যে-সমন্বয় চেয়েছিলেন তাঁরা, তার সব বৈশিষ্ট্যেরই প্রকাশ ঘটেছে ধীরাজ চৌধুরীর ছবিতে। ষাটের অনেক শিল্পীর মতো তাঁর ছবিতেও আখ্যানের একটা আবেশ অনেক সময় তিনি বজায় রেখেছেন। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কোনো একটি বিশেষ সামাজিক পরিস্থিতিকে ছবির ভেতর দিয়ে পরিস্ফুট করে তোলা, কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী পরিম-ল মেলে ধরা। অনেক সময়ই তিনি কাজ করেছেন বিশেষ কোনো সামাজিক সংকট বা আন্দোলন নিয়ে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর করা তাঁর চিত্রমালা আজো প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। একটা পর্যায়ে তিনি কাজ করেছেন স্বাধীন ভারতে যৌবনের সংকট ও সফলতা নিয়ে। এভাবে তাঁর ছবি কখনোই জীবনের হাত ছাড়েনি। অন্যদিকে কবিতার একটি বাতাবরণ ছিল তাঁর ছবিতে। তাঁর ‘বনলতা সেন’-এর প্রতিমাকল্পের ভেতরে চিরন্তনের সঙ্গে সাম্প্রতিকের এক কাব্যসিক্ত সংলাপ তৈরি হয়েছে। এসবের ভেতর দিয়েই তিনি গড়ে তুলেছেন বিশেষ এক রূপ বা ফর্ম, যার মাধ্যমে পরিস্ফুট হয়েছে তাঁর শৈল্পিক আত্মপরিচয়। এই রূপনির্মাণই ষাটের দশকের আধুনিকতায় তাঁর বিশেষ অবদান। এজন্যই তিনি স্মরণীয়। তাঁর ফর্মের বৈশিষ্ট্য আলোচনার আগে আমরা তাঁর শিল্পীজীবনের বিবর্তন ও সফলতার দিকে একটু আলোকপাতের চেষ্টা করব।

ধীরাজ চৌধুরীর জন্ম অবিভক্ত বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মেরাসানি গ্রামে ১৯৩৬ সালের ১ এপ্রিল। তাঁর বাবা যতীন্দ্র চন্দ্র চৌধুরী। ধীরাজের শিল্পীসত্তার বিকাশে তাঁর মা-বাবার কিছু অবদান আছে। তাঁর যখন এগারো বছর বয়স, তখন দেশভাগ হয়। গৃহহীন ও সর্বস্বান্ত হয়ে তাঁরা চলে আসেন। প্রথমে আশ্রয় নেন আসামে। পূর্ববাংলার

প্রাকৃতিক পরিবেশ শৈশবে তাঁর সৌন্দর্যবোধ গড়ে তুলতে অনেকটাই সহায়ক হয়েছে। আসাম থেকে দার্জিলিং, সেখানে তাঁর কলেজের পড়াশোনা। ছবি আঁকার প্রতি আকর্ষণ তাঁর ছেলেবেলা থেকেই ছিল। ফলে পুরোপুরি পারিবারিক সম্মতির বিরুদ্ধেই ১৯৫৫ সালে তিনি ভর্তি হন কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে। কিন্তু কোনো এক সমস্যায় এই আর্ট কলেজ ছেড়ে তাঁকে ভর্তি হতে হয় দিল্লি আর্ট কলেজের সান্ধ্য বিভাগে। সেখান থেকেই পাশ করেন। তারপর দিল্লি হয়ে যায় তাঁর ঠিকানা। ১৯৬২ সালে দিল্লির উইমেন্স পলিটেকনিকে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৬৩ সালে দিল্লি কলেজ অব আর্টে অধ্যাপক হিসেবে। ১৯৯৬ সালে অবসরগ্রহণের আগে পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন এবং ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন দিল্লির শিল্পকলা সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে। ১৯৭৫ সালে তিনি ‘ক্যালকাটা পেইন্টার্স’ দলে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালের পর তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং এখানকার শিল্প-প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে যান।

ছাত্রজীবনে তিনি যে-ছবি এঁকেছেন তার ভেতর অনিবার্যভাবেই ছিল ইমপ্রেশনিস্ট ও পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট আঙ্গিকের প্রভাব। ক্রমান্বয়ে তিনি যখন নিজস্ব রূপের দিকে অগ্রসর হন; তখন তিনি জোর দেন রৈখিক বিন্যাসের ওপর। গড়ে তোলেন দীর্ঘায়ত শীর্ণ অবয়ব বিন্যাস। এর ভেতর থেকে যায় আদিমতার এক অনুষঙ্গ। আদিম গুহাচিত্রের যে-বৈশিষ্ট্যকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করেছিলেন জাকোমেত্তি বা পিকাসোর মতো শিল্পী। আমাদের দেশে রামকিঙ্করের কোনো কোনো কাজে এই দীর্ঘায়ত শীর্ণতা ব্যবহৃত হয়েছে করুণায়ন সৌন্দর্যের রূপায়ণ প্রয়াসে। ধীরাজের ছবিতে এই করুণাদীর্ণ সৌন্দর্য এসেছে নানাভাবে। ২০০২-এ আঁকা ‘বনলতা সেন’ শীর্ষক ছবিটিকে যদি ধরা যায় দৃষ্টান্ত হিসেবে, সেখানে আমরা দেখি কৃষ্ণ মেঘের মতো বিস্তীর্ণ চুল নিয়ে দ-ায়মান এক নগ্নিকা নারীকে, যার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ততোধিক শীর্ণ দীর্ঘায়ত এক মানব-প্রতিমা। প্রেক্ষাপটে লেখা রয়েছে জীবনানন্দের ওই কবিতার কিছু শব্দাবলি। প্রতিমাকল্প ও ক্যালিগ্রাফির সমন্বয়ে গড়ে তোলা এ-ছবিটিকে আমরা ধরে নিতে পারি শিল্পীর নিজস্ব রূপবিন্যাসের একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে, যেখানে ছবি কবিতা থেকে গ্রহণ করে ছন্দের সুষমা। এই কাব্যময়তার মধ্য দিয়েই ধীরাজ চৌধুরী জীবনের বিপন্নতার কথা বলেছেন। সন্ধান করেছেন উত্তরণের পথ। রূপের এই স্বকীয়তাই ষাটের শিল্পকলায় তাঁর বিশেষ অবদান।