তিন উপন্যাসের বিশ্লেষণ

কবির আহমেদ

 

ত্তরের দশকের অন্যতম সেরা গল্পকার নুরুল করিম নাসিমের লেখার সঙ্গে পরিচয় দীর্ঘ সময়ের। তাঁর প্রথম গল্পের সাক্ষাৎ পাই কামাল বিন মাহতাব-সম্পাদিত ছোট গল্প পত্রিকার মাধ্যমে। পরবর্তীকালে দৈনিক বাংলার সাহিত্য পাতায় এবং সাপ্তাহিক বিচিত্রায় তাঁর লেখা পড়েছি। তাঁর গল্পগুলোর বিষয়বস্তু, আঙ্গিক এবং প্রকাশভঙ্গী পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়। পরবর্তীকালে তিনি নাট্যশিল্পের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েন। এছাড়া প্রবন্ধ এবং কবিতাও লিখতে শুরু করেন। যাই হোক আমি প্রধানত তাঁর ছোটগল্পের মুগ্ধ পাঠক ছিলাম। তাঁর গল্পের বিষয়বস্তু, ঘটনা ও চরিত্রচিত্রণ এবং প্রকাশভঙ্গী ছিল স্বতন্ত্র এবং সময়ানুসারে আধুনিক। মাঝখানে কেটে গেছে দীর্ঘ সময়। লেখক ও পাঠকদের জীবন থেকে চলে গেছে অনেক সময়। শিল্প-সাহিত্যজগতেও নানারকম পরিবর্তন উথাল-পাথাল ঢেউ খেলে গেছে। অনেক কবি-সাহিত্যিক হারিয়ে গেছেন আবার অনেক কবি-সাহিত্যিক আবির্ভূত হয়েছেন। বিচিত্র সংগ্রামমুখর ও প্রবাস জীবন সত্ত্বেও  নুরুল করিম নাসিম মাঝখানের একসময় সুপ্ত অবস্থায় থাকলেও বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে পুনরায় আবির্ভূত হয়েছেন স্বমহিমায় ও উজ্জ্বলতায়। সম্প্রতি আমি তাঁর তিনটি উপন্যাস-সংবলিত গ্রন্থ সেরা তিন উপন্যাস পড়লাম। আমার মনে হয়েছে, জীবনশিল্পী নুরুল করিম নাসিম জীবনের বিচিত্র পথে হেঁটে-হেঁটে যে-অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, সেসব বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন উপন্যাস তিনটি। তিনটি উপন্যাসই ভিন্নধর্মী – একটির সঙ্গে অপরটির ক্ষেত্র চরিত্র ঘটনাবিন্যাসের কোনো মিল নেই অথচ তিনটি ঘটনাসমগ্রকে তিনি এঁকেছেন নিপুণ চিত্রকরের মতো। উপন্যাস তিনটির শিরোনাম – এক টুকরো পৃথিবী, অন্য কোন দিন ও কে রবে পরবাসে। উপন্যাস তিনটি সম্পর্কে আলাদাভাবে কিছু বলার চেষ্টা করছি :

 

এক টুকরো পৃথিবী

এই উপন্যাসটি আসলেই এক টুকরো পৃথিবী – একটি পরিবারের সদস্যদের জীবনসংগ্রামের মূর্ত প্রতীক তোলে ধরা হয়েছে এখানে। পিতাহীন  সংসারে বড় ছেলে সংসারের হাল ধরে আছে, তার আবেগ আছে কিন্তু সামর্থ্য সীমিত। তবু তিনি অসীম ধৈর্যের সঙ্গে ছোট ভাইকে দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে বাঁচাতে চান। ছোট ভাই আসফাককে বাঁচাতে ভারতের ভেলোরে নিয়ে যেতে হয় – সেখানে যাওয়ার পর বিভিন্ন মানুষ ও ঘটনার সম্মুখীন হন লেখক। ব্যাপারটা তা নয়। সেটাকে কীভাবে প্রকাশ করা হলো সেটাই হলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জীবনকে নিয়ে যাঁরা উপন্যাসের কাহিনি  রচনা করেন তারা তো এই পৃথিবীরই মানুষ। তাদের অনেক সময় যে অসাধ্য সাধন করতে হয় তা পর্বতসমান কঠিন, সাগরসম অসীম। জীবনের ঘটনাক্রম সৃষ্টি করেন ঈশ্বর; জীবনের নির্মাতা স্বয়ং ঈশ্বর, কিন্তু সেই জীবনকে মানুষ যখন বর্ণনা করতে যায় বা চিত্রণ করতে চায়, তা অনেক সময় হয়ে উঠে ভয়ংকর এবং কোনো কোনো সময় কঠিন ও জটিল শিল্প – এক পরিশ্রমলব্ধ মহাকাব্য – জীবন শেষ হয়ে যায়, মহাকাব্য তথা উপন্যাস যেন শেষ হতে চায় না।

তবু কিছু কিছু মানুষ সে-অসাধ্যকে সাধন করেন, যেমন টলস্টয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস, আনা কারেনিনা; ভিক্টর হুগোর লা মিজারেবল, এমিল জোলার নানা, ডানিয়েল ডিফোর রবিনসন ক্রুসো, হারম্যান মেলডিলের মবিডিক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা, শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত, বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী, তারাশংকরের কবি, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র কাঁদো নদী কাঁদো, আবু ইসহাকের সূর্য দীঘল বাড়ী ইত্যাদি।

নুরুল করিম নাসিমের উপন্যাসে এক টুকরো পৃথিবীতে বেশকিছু মানুষের কথা আছে, প্রকৃতির কথা আছে –

দুঃখ-বেদনার সঙ্গে কিছু ভালো লাগার কথা, ভালোবাসার কথা। উপন্যাসের পাতায় পাতায় লেখকের বুদ্ধিদীপ্ততা অকুণ্ঠচিত্ততা ও আবেগের ধারাবাহিকতা রয়েছে। সংগীতের তাল-লয়-সুর বজায় রাখার মতো লেখার গতি ধরে রাখা হয়েছে।

‘দেশ থেকে দূরে পড়ে আছি, এক অজানা প্রবাসে রোগী নিয়ে যে উদ্বিগ্নতার ভেতর বসবাস করছি, সে কথা মনে হয় না। মনে হয় এই আমাদের পৃথিবী, একটুকরো আনন্দময় ভুবন।’                (এক টুকরো পৃথিবী, পৃ ২৭)

 

অন্য কোন দিন

‘এলাকাটা অরণ্যময়। দীর্ঘ গাছ পালা, অদূরে একটা শ্মশান, তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সংকীর্ণ মরা একটি নদী।’ এভাবেই উপন্যাসের শুরু। উপন্যাসের শেষে আছে – ‘আবার খুব করুণ ও বিষণœ সুরে লঞ্চের ভেঁপু বেজে উঠল। মোবারকের মনে হলো তার আর এই পৃথিবীতে কেউ নেই। চোখ ততক্ষণে আবার অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে। যেন তার আত্মার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হারিয়ে গেছে।’

এ যেন এক অন্য জগৎ, অন্য পৃথিবী, আমাদের আশেপাশে অথচ আমাদের এই চেনাজানা জগৎ থেকে আলাদা। জগৎসংসার কত বিচিত্র, কত ধরনের খেয়ালি মানুষের আনাগোনা – সৎ-অসৎ, ভালো-মন্দ, প্রকৃত সাধক-ভ- – বিচিত্র মানুষের কোলাহলে পরিপূর্ণ এই বিশ্বসংসার। তাদের নিয়ে চলাফেরা, মেলামেশা, কথাবার্তায় জড়িত হওয়াও এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। আবার তা ভাষায় বর্ণনা করা আরো বিচিত্র ব্যাপার। সবাই তা পারে না, যিনি পারেন তিনি জীবনের নিপুণ শিল্পী। আমি আশ্চর্য হয়েছি  – ঔপন্যাসিক নুরুল করিম নাসিম জীবনরহস্যের এক দুর্জ্ঞেয় দুর্গের ভেতরের রহস্য উন্মোচনে উদ্যোগী হয়েছেন এবং আমি বলব সফলও হয়েছেন অন্য কোন দিন উপন্যাসে।

এখানে রহস্যময় প্রকৃতি আছে। আছে একধরনের আদীম ধর্মীয় উন্মাদনা, যার আবেশে আকর্ষণে শিক্ষিত অশিক্ষিত

ধনী-দরিদ্র বিভিন্ন বর্ণের-ধর্মের মানুষেরা ছুটে আসে – কিসের টানে, কিসের মোহে বা কোন প্রাপ্তির আশায় – হয়তো যারা আসে তারাও জানে না কেন তারা আসে?  কী তারা চায়?

‘এরকম জীবন সে চায়নি কিন্তু তার ভেতর একজন উদাসী বাউল বসবাস করে। সে আসলে সংসারে এক সন্ন্যাসী। সেই বাউল তাকে সংসারের ভেতর থাকতে দেয় না। কেবলই ডাকে, দিবানিশি ডাকে। তাকে নিয়ে যার। তখন সে অস্থির হয়ে ওঠে। সংসারের মায়া তখন তাকে বেঁধে রাখতে পারে না। সে তখন ছুটে যায় মেলায়,বিভিন্ন ফকিরের আখড়ায়, মাজারে সেখানে গেলে সে কিছুক্ষণের জন্য শান্তি পায়।

(অন্য কোন দিন, পৃ ৬৬-৬৭)

 

কে রবে পরবাসে

তরুণ কবি ও সাংবাদিক জাভেদ তারেকের প্রসাসী জীবনের নানা

ঘাত-প্রতিঘাত, জীবন-সংগ্রাম এবং পরিশেষে এক জীবনদর্শনের সাক্ষাৎ এই উপন্যাসের বিষয়। একটি মনোরম স্বপ্ন নিয়ে জাভেদ এসেছিল গ্রেটব্রিটেনের রাজধানী শহর লন্ডনে, যে-শহরে ব্রিটিশ যুগ থেকে শুরু করে পাকিস্তান পর্ব তারপর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ক্রমবর্ধমান হারে বাঙালিরা এসেছে উচ্চজীবনের আশায় – দুঃখকষ্টকে পরোয়া না করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এসকল মোহগ্রস্ত মানুষের কেউ কেউ সফল হয়। কেউবা কোনো রকমে টিকে থাকে আবার কেউ জীবনযুদ্ধে হেরে যায়। জাভেদ তারেকের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন – সে একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ। প্রতিষ্ঠার বিনিময়ে মানমর্যাদা বিসর্জন দিতে সে রাজি নয়। সে দেখেছে কিছু কিছু নারী ও পুরুষ লন্ডনে এসে জীবনে সুখ নামক সোনার হরিণ ধরতে চেয়েও পায়নি বরং জীবনের কাছে হেরে গেছে, সুখের অভিনয় করতে হয়েছে, প্রকৃত সুখী হতে পারেনি। তাদের কেউ কেউ জীবনের এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে তারা এক গোলকধাঁধায় ঘুরেফিরে মরছে – এখানে থেকেও সুখ নেই আবার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।

কিন্তু তরুণ কবি ও সংবাদিক জাভেদ তারেক সারা জীবনের জন্য ঠকতে রাজি নয়। জীবনের চরম ও পরম সিদ্ধান্ত এখানেই এবং এখনই নিতে হবে – তা যতই কঠিন কঠোর হোক – তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় – পরবাসে আর নয়, নিজ দেশেই ফিরে যাবে সে।

‘জাভেদের মনে হয় এক’দিনে কতরকম মানুষ দেখেছে। এসব নিয়ে দেশে ফিরে গিয়ে একটি উপন্যাস লিখবে। প্রথমে বাংলায় পরে ইংরেজিতে। অভিবাসী বাংলাদেশিদের যেভাবে সে দেখেছে সেসব নিয়ে চমৎকার সব আখ্যান তৈরি হতে পারে। সে সাংবাদিক। তার চোখে অনেক কিছু স্পষ্ট ধরা পড়ে যা অন্যের চোখে পড়বে না।’

 

(কে রবে পরবাসে, পৃ ১০৩)

ঔপন্যাসিক নুরুল করিম নাসিমের সেরা তিন উপন্যাস – তিন জগতের কথা বলে, তবে সেসব জীবনেরই গোপন গহন কথা। আমার ভালো লেগেছে, আশা করি অন্যসব পাঠক-পাঠিকাদেরও ভালো লাগবে। লেখক আবেগপ্রবণ, কিন্তু শিল্পিত ভাষায় অন্তরঙ্গভাবে প্রকাশ করেছেন তাঁর উপলব্ধি।