জিয়া হায়দার : আধুনিক নাটকের বিশিষ্ট রূপকার

পঞ্চাশ-ষাটের দশকে নবনাট্যচর্চার উর্বর পথ নির্মাণ করেছিলেন মুনীর চৌধুরী, নুরুল মোমেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ও সাঈদ আহমদ। ক্রমবর্ধমান এ-পথের আরেক নাট্যপ্রকৌশলী জিয়া হায়দার (১৯৩৬-২০০৮)। তাঁর নাট্যচর্চার পথ বহুদিক বিস্তৃত। তিনি একাধারে নিরীক্ষাপ্রিয় নাট্যকার, দক্ষ নাট্যনির্দেশক, নিষ্ঠাবান নাট্যসংগঠক, বিদগ্ধ নাট্যগবেষক-প্রাবন্ধিক ও নাট্যবিষয়ক সফল শিক্ষক। জিয়া হায়দারের ভিন্ন পরিচয়, তিনি কবি। তাঁর কাব্যিক সত্তা নিরীক্ষাধর্মী নাট্যরচনায় ও সংলাপ সংযোজনে সহায়ক হয়েছে।

জিয়া হায়দারের নাটকের বিষয় ও আঙ্গিক – দুক্ষেত্রেই স্বাতন্ত্র্য ও সাফল্য পরিলক্ষিত হয়। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তপ্রাণ, শান্তি প্রত্যাশা, ন্যায়বিচার, চিরন্তন প্রেম, বীভৎস হাস্যরস, মানবতা তাঁর নাটকের বিষয়-আশয়। অ্যাবসার্ডিটি, চেতনাপ্রবাহ, মিউজিক্যাল, কাব্যিক ফর্মে গড়ে ওঠে তাঁর নাটকের আদল।

নাট্যকারের পাশাপাশি জিয়া হায়দার নাট্যগবেষক ও প্রাবন্ধিক। তিনি নাটক বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করেছেন। দীর্ঘকাল নাট্যকলা পড়িয়েছেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম নাট্যকলা বিভাগ চালু করেন। তাঁর রচিত নাট্যবিষয়ক মূল্যবান গ্রন্থসমূহ : নাট্যবিষয়ক নিবন্ধ, নাট্য ও নাটক, বাংলাদেশ থিয়েটার ও অন্যান্য রচনা, স্তানিসøাভস্কি ও তার অভিনয় তত্ত্ব, নাট্যকলার বিভিন্ন ইজম ও এপিক থিয়েটার, বিশ্বনাট্য সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং থিয়েটারের কথা

(প্রথম থেকে পঞ্চম খ-)

জিয়া হায়দার নিজের সমস্ত নাটক এবং অন্য বহু নাটকের বেতার ও মঞ্চনির্দেশনা দিয়েছেন। নাট্যনির্দেশক হিসেবে তিনি অত্যন্ত সচেতন ও নিষ্ঠাবান ছিলেন। তাঁর রচিত নাটকসমূহে তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মঞ্চনির্দেশনা লিপিবদ্ধ করেছেন; নাটকের সেটে, আসবাবপত্রে, আলোতে, শব্দ-প্রক্ষেপণে নতুনত্ব এনেছেন। তিনি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। নাট্যসংগঠক হিসেবে তাঁর কর্মদক্ষতা ছিল ঈর্ষণীয়। মুনীর চৌধুরী ও মমতাজ উদ্দীন আহমদের মতো জিয়া হায়দারও বিদেশি বিশিষ্ট নাটকসমূহ বাংলাদেশের নাট্যজনদের কাছে পরিচয় করে দেওয়ার জন্য দেশি ভাষায় অনুবাদ-রূপান্তর করেছেন। এ-কাজে তিনি ছিলেন যথেষ্ট স্বাধীন এবং দেশীয়করণে দক্ষ কারিগর। আমরা বর্তমান প্রবন্ধে জিয়া হায়দারের কেবল মৌলিক ও রূপান্তরিত নাটকসমূহ আলোচনায় সীমাবদ্ধ রাখব।

জিয়া হায়দারের সাদা গোলাপে আগুন নাটক বীরাঙ্গনাদের মর্মন্তুদ জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে রচিত হলেও গোটা মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাচিত্র বিধৃত হয়েছে। এটি ১৯৭২-এ বেতার নাটক হিসেবে প্রচারিত এবং পরবর্তীকালে মঞ্চ নাট্যরূপ দেওয়া হয় – গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায়।১

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। পশ্চিম পাকিস্তানি হিংস্র  সেনাদল বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় যুদ্ধ। দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু হায়েনারা দেশটাকে তছনছ করে দেয়। হত্যা আর ধর্ষণে তারা ছিল উন্মত্ত। হাজার হাজার ধর্ষিত বাঙালি নারী গর্ভবতী হয়। এ এক চরম করুণ অধ্যায়। বাংলাদেশ সরকার ধর্ষিতাদের বীরাঙ্গনা হিসেবে অভিহিত করলেও তাঁরা প্রকৃত সামাজিক মর্যাদা পাননি। স্বাধীনতার প্রথম পর্যায়ে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ব্যাপক জটিলতা সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানপন্থি রাজাকার ও গোঁড়াসমাজ তাদের মেনে নেয়নি। বাবা মেয়েকে ঘরে তোলেনি। স্বামী স্ত্রীকে আশ্রয় দেয়নি। প্রেমিক প্রেমিকাকে গ্রহণ করেনি। বহু ধর্ষিতা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পাগল হয়েছেন, আত্মহত্যা করেছেন। এমন হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতির মধ্যেও কেউ কেউ ধর্ষিত বীরাঙ্গনাদের গ্রহণ করেছেন, ভালোবেসে সংসার সাজিয়েছেন। জিয়া হায়দারের সাদা গোলাপে আগুন এ-মর্মকথারই নাট্যরূপায়ণ।

চার দৃশ্যের এ-নাটকে প্রথমেই দেখা যায় একটি হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ড। মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিত গর্ভবতী নারী সালমা, শানু, বেলি, কুমু ও আইভী হাসপাতালে ভর্তি – চিকিৎসাধীন। এরা কমবেশি সবাই উচ্চশিক্ষিত। নাট্যকার এদের পারস্পরিক সংলাপ বর্ণনায় যুদ্ধদিনের কঠিন-করুণ চিত্র ফুটিয়ে তোলেন। সে এক বীভৎস অমানবিক পৈশাচিক ঘটনাবৃত্ত। নির্যাতিত নারীদের ভাষ্য অনুযায়ী তারা বেঁচে মরে আছে, মরে বাঁচতে চায়। বন্দিদশায় তারা আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। উপকরণের অভাবে পারেনি। হায়েনা বাহিনী তাদের কাপড় পর্যন্ত খুলে নিয়েছে, চুল কেটে ফেলেছে। যেন পীড়িত মেয়েরা আত্মঘাতী না হতে পারে।

বাঙালি মেয়েরা সম্ভ্রম রক্ষার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকে। তাদের কাছে ইজ্জতই সব। মান-মর্যাদা রক্ষাই একমাত্র অভীষ্ট। সেই সম্ভ্রম যখন লুট হয়ে যায়, তখন আর তাদের বেঁচে কী লাভ! তাই সালমা ঘুমের বড়ি না খেয়ে জমিয়ে রাখে। একবারে বেশি করে খেয়ে আত্মহত্যা করবে। করেও তাই।

শানু মানসিকভাবে শক্ত। সে বাঁচতে চায়। নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সে বলে, ‘আমি জোর করেই জায়গা করে নেব। কেউ বিয়ে না করলে তো বয়েই গেল। বাপের পরিচয় ছাড়াই আমার সন্তানকে আমি বড় করব। তাকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করে ছাড়ব। নিজেকেও করব। বিদ্রোহ করব। সমাজকে বাধ্য করব।’ (পূর্বোক্ত, পৃ ৩) সেই শানুই ক্রমশ পাগল হয়ে যায়, যখন সে জানতে পারে যুদ্ধে তার বাবা মারা গেছে, চাচারা ভিটেমাটি দখল করে নিয়েছে এবং তাকে কটাক্ষ করে আজেবাজে মন্তব্য করে। চরিত্রটি জিয়া হায়দারের সযত্ন সৃষ্টি। সাদা গোলাপ স্নিগ্ধ ও পবিত্রতার প্রতীক। যুদ্ধের আগে সে বাড়িতে সাদা গোলাপের চারা লাগিয়েছিল। হাসপাতালে আসা মুক্তিযোদ্ধা ভাই আবিদের কাছে বিপুল আগ্রহে জানতে চায়, গোলাপ ফুটেছে কি না। একসময় শানু অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ে। মৃত্যুর আগে প্রলাপ বকে, ‘সাদা গোলাপটায় আগুন লেগেছে। … কী অদ্ভুত সুন্দর হয়ে সাদা গোলাপটা লাল হয়ে যাচ্ছে। … গোলাপের গন্ধ নিয়ে ছাইগুলো বাতাসে উড়বে – দাদামণি, ছোটকু, তুই সে আলোতে ঘুমোস, প্রাণভরে ঘুমোস।’

(পূর্বোক্ত, পৃ ২২-২৭)

নাট্যকার জিয়া হায়দার শানুর এ-সংলাপ প্রতীকী অর্থে প্রয়োগ করেছেন। সাদা গোলাপ বাংলার সাদামাটা নির্মল মানুষের পরিচায়ক। তাকে রক্তাক্ত ও বিধ্বস্ত করতে লিপ্ত হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকচক্র। গোলাপের সুবাসে বাংলার জনগণ সদাজাগ্রত থেকেছে এবং বাংলাকে স্বাধীন করেছে।

শানুকে দেখতে এসে আবিদের সঙ্গে বেলির ভালোলাগা- ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বেলির সঙ্গে হাসানের প্রেম ছিল। বেলির বর্তমান অবস্থা দেখে চতুর ও হৃদয়হীন হাসান সরে যায়। বোন শানুকে হারিয়ে আবিদ বেলিকে ঘরে আনে। এই সদর্থক বক্তব্যের মধ্য দিয়েই জিয়া হায়দার সাদা গোলাপে আগুন নাটকের সমাপ্তি টানেন।

জিয়া হায়দারের তীব্র স্বদেশপ্রেম ছিল বলেই তিনি বাংলার স্বাধীনতা ও বীরাঙ্গনাদের সপক্ষে কলম ধরেছেন। প্রচলিত নাট্যরীতি মেনেও নবনিরীক্ষা করেছেন। বর্তমান নাটকে ক্ষেত্রবিশেষে অ্যাবসার্ডধর্মী সংলাপ সংযুক্ত করেন। সংলাপে আপাতত বিচ্ছিন্নতা পরিলক্ষিত হলেও তা একই সূত্রে গাঁথা। বীরাঙ্গনাদের নস্টালজিক মনোভাবনার প্রকাশ। যেমন –

কুমু : বাচ্চি নিশ্চয় একটুও দুষ্টু হয়নি।

বেলি : হাসান প্রথম প্রথম ভীষণ চঞ্চল ছিল। ও বলতো,

আমিই নাকি ওকে সিরিয়াস করে তুলেছি।

সালমা : এতোদিন পরে আমার সেই মাকে দেখতে ইচ্ছে করছে কেন?

বেলি : কিন্তু ওকে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না।

সেজন্যে ওকে নিয়ে আমার ভয় ভয় লাগতো।

কুমু : বাচ্চিকে ওর বাবা কিছুতেই সামলাতে পারে না।

সালমা : মার একটা ছবিও নাই বাড়িতে। সবাই বলে মা দেখতে ঠিক আমারই মতো। নাকি আমিই মায়ের মতো?

(পূর্বোক্ত, পৃ ২৬)

জিয়া হায়দারের পংকজ বিভাস নাটকটি ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে রচিত এবং ১৯৭৪-এ নাট্যকারের প্রযোজনায় বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত। নাটকটি সাদা গোলাপে আগুন নাটকে পরিপূরক। সাদা গোলাপে আগুন নাটকের ঘটনাকাল স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে, আর পংকজ বিভাসের ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে, স্বাধীনতার ২৪ বছর পরের ঘটনাধারা। পূর্ববর্তী নাটকের বেলি, আবিদ, হাসান চরিত্র বর্তমান নাটকেও সম্প্রসারিত রূপে উপস্থিত।

সাদা গোলাপে আগুন নাটকে বীরাঙ্গনা বোন শানুকে সেবাসদন হাসপাতাল থেকে আনতে গিয়ে আবিদের পরিচয় হয় আরেক গর্ভবতী বীরাঙ্গনা বেলির সঙ্গে। প্রেমিক হাসান বেলিকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। বেলির সঙ্গে আবিদের ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শানু মারা গেলে আবিদ বেলিকে ঘরে আনে এবং বিয়ে করে। বিয়ের পাঁচ মাস পর রানির জন্ম হয়। বেলি-আবিদের পক্ষে কোনো সন্তান নেই। রানিকে তারা অকৃত্রিম মমতায় ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে মানুষ করে। রানিকে কবির পছন্দ করে, হাসানের ছেলে মাহমুদও। কবির মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলতে পারে না। মাহমুদ বিয়ের প্রস্তাব দেয়। বেলি ও তার পরিবার এ-বিয়েতে সম্মতি দেয়। হাসান তা জানতে পেরে মাহমুদকে জানায় যে, বেলি-আবিদের দাম্পত্য জীবন বৈধ নয়। তাদের কোনো আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়নি, বিয়ের কাবিননামাও নেই। মাহমুদ সত্য জানার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। ইতোমধ্যে হাসান বেলির সঙ্গে দেখা করে তার মনে হারানো ভালোবাসার চাপা আগুন উসকে দেয়। শুরু হয় নাটকীয় দ্বন্দ্ব। জিয়া হায়দারের এ-পর্যায়ের নাট্যসংলাপ অধিক পারদর্শিতার স্বাক্ষরবাহী।

বেলির সঙ্গে বিয়েতে মাহমুদ দ্বিধান্বিত হলে কবির বিয়ের প্রস্তাব দেয়। বেলি-আবিদের বিয়ে বৈধ ও রীতিসম্মত প্রমাণিত হলে মাহমুদও বিয়েতে রাজি হয়। ক্ষুব্ধ ও শোকাহত বেলি সবাইকে উদ্দেশ করে বলে – ‘অক্যুপেশন আর্মি ধরে নিয়ে যায় আমাকে। আরো অনেক মেয়েকে। সেই ক্যাম্পেই ছিল শানু, আবিদের বোন। আমাদের শরীর নিয়ে প্রতিটি রাতে চলত নরকের খেলা। একজন নয়, দুজন নয় – কে জানে কতজন। প্রতিরাতে। কারো চেহারা দেখিনি। কারো চেহারা চিনিনি। সন্ধ্যা না লাগতেই হাজার হাজার মেয়ের চিৎকার। কেন চিৎকার করতাম জানি না। ঘরে হাজার পাওয়ারের আলোতেও সমস্ত পৃথিবী হয়ে যেত অন্ধকার। … রানি, আমি জানি না তোর পিতা কে? কিন্তু বিশ্বাস কর। এতদিন ধরে, এই তেইশ বছর ধরে, তোর তেইশ বছরের জীবনে আবিদ তোকে তার নিজের মেয়ে জেনেই বড় করেছে। তার সমস্ত স্নেহ উজাড় করে দিয়েছে।’

(পূর্বোক্ত, পৃ ৮৮)

রানি কোনো আকুতি-আবেদনে সাড়া না দিয়ে স্যুটকেস হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়, নাটকেরও পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে পুনশ্চ, নাট্যকার জিয়া হায়দার নাটকটির শেষ অন্যভাবেও হতে পারে বলে উল্লেখ করেন! বেলির শেষ সংলাপের পর রানি স্যুটকেস নামিয়ে রেখে শান্ত ও দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে আসে; মাটিতে পড়ে থাকা কাবিননামাটা তুলে নেয়। কিন্তু দেখে না, বরং হাতের মুঠোয় পুরে মোচড়াতে থাকে। তিনজনেই স্থির, তিনটি পৃথক আলোর বৃত্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে। আলো নিভে আসে।

নাটকের বর্তমান সমাপ্তি আমার কাছে অধিক সার্থক বিবেচিত হয়। এখানে সদর্থক ভাবনা আছে। আছে মা-বাবা ও মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা। কাবিননামার চেয়ে ভালোবাসার বন্ধনই প্রবল সত্য।

জিয়া হায়দারের সর্বাধিক নিরীক্ষাধর্মী ও আধুনিক নাট্যকলাসমৃদ্ধ নাটক শুভ্রা সুন্দর কল্যাণী আনন্দ।২ এটি প্রচলিত নাট্যধারায় সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য এক সৃজনকর্ম। নাটকের প্রতিপাদ্য বিষয় : মানুষ শান্তিপ্রত্যাশী। কিন্তু শান্তি সহজে ধরা দেয় না। নাট্যকারের অভিমত, ‘পৃথিবীতে কোনোদিন শান্তি আসেনি এবং আসবেও না।’

(পূর্বোক্ত, ‘নিবেদন’)

নাটকের চার – চরিত্র শুভ্রা, সুন্দর, কল্যাণী ও আনন্দ সুবর্ণগ্রাম থেকে শান্তিগড়ে যেতে চায়। সুবর্ণগ্রাম স্টেশনের স্বল্পায়তন নোংরা পরিবেশে ট্রেনের প্রতীক্ষায় কেটে যায় নাটকের সমস্ত সময় – ট্রেন আর আসে না, শান্তিগড়ে যাওয়াও হয় না। দীর্ঘসময় পরিসরে উল্লিখিত চারটি চরিত্র ছাড়া পয়েন্টসম্যান ও স্টেশন মাস্টারের মাধ্যমে গড়ে ওঠে নাটকের প্রতিপাদ্য বিষয় ও শিল্পকাঠামো।

শুভ্রা সুন্দর কল্যাণী আনন্দ নাটকের প্রাণশক্তি সংলাপ। চরিত্রসমূহের পারস্পরিক সংলাপ প্রক্ষেপণ আর দ্বান্দ্বিক আচার-আচরণ নাটকের গতিধারাকে করেছে প্রাণবন্ত।

কামিনী শহর থেকে সমস্ত কামনার কুঁড়িকে হত্যা করা হয়েছে। তাই শুভ্রা স্বস্তির প্রত্যাশায় শান্তিগড়ে যেতে চায়। সে বদ্ধঘর নয়, খোলা বাতাসে থাকতে চায়। কৃষ্ণচূড়া পছন্দ করে। কিন্তু এমনটি পায় না বলে সে ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। আয়নায় চোখ রেখে চমকে ওঠে, মনে হয় চেহারা বিবর্ণ হয়েছে। কেন সে আর শুভ্রা নয়। সে কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে বলে, ‘আর কতক্ষণ! কতক্ষণ এই অসহ্য বিরক্তিকর আত্মক্ষয়ী বন্দিদশা।’

(পূর্বোক্ত, পৃ ৫৬)

চার যাত্রীর মধ্যে হার্দিক সম্পর্ক গড়ে উঠলেও শুভ্রার সঙ্গে সুন্দরের সম্পর্ক কিছুটা নিবিড়। যেমন আনন্দের সঙ্গে কল্যাণীর। তবে এদের প্রধান পরিচয় শান্তি-অন্বেষায় সহযাত্রী। সুন্দর আদতেই সুন্দর। বৈরী পরিবেশে সে নিজেকে খাপ খাইয়ে চলতে পারে। আবার প্রয়োজনে প্রতিবাদও করে। শৈশবকালীন স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, সে দুষ্টু প্রকৃতির ছিল। ক্ষেত্রবিশেষে বন্ধুর প্রতি ঈর্ষান্বিত হলেও পরক্ষণেই তার জন্য কাতর হয়ে পড়ে। নাট্যিক ব্যঞ্জনা ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টিতে তার ভূমিকা অপ্রতুল নয়। মাঝেমধ্যে সে দার্শনিকের মতো কথা বলেছে, ‘জীবন গল্পের মতোই।’ (পূর্বোক্ত, পৃ ৩৭) অথবা, ‘অনিশ্চিতিই যে জীবনের সত্য কল্যাণী।’

(পূর্বোক্ত, পৃ ৩৯)

আনন্দের হাত ধরে কল্যাণী স্টেশনে এসেছে। সে মনে করে, নগর থেকে বসন্ত পলাতক। তবু সে খোলা জানালা দিয়ে কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্য দেখতে চায়। আনন্দ বলে, ‘আমি তোমার বসন্তের আনন্দ হয়েছিলাম, এখনো আছি।’ (পূর্বোক্ত, পৃ ১৬) যমজ বোন লক্ষ্মীর প্রতি কল্যাণীর ছিল প্রবল আক্রোশ ও হিংসা। লক্ষ্মী ভালো আলপনা ও ছবি আঁকতে পারত। নিজেকে নিরাভরণ সাজে অপরূপ করে তুলতে সমর্থ ছিল – যা কল্যাণীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে বোনের মৃত্যুতে কল্যাণী অনুতপ্ত হয়। বলে, ‘আমি শুনলাম, সারা বাড়িতে এক নিঃশব্দ কান্নার ধ্বনি। আমি ছুটে গেলাম মায়ের ঘরে, পেলাম না। ছুটে গেলাম লক্ষ্মীর ঘরে। দেখলাম, মা তার অশ্রুবিহীন নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছেন শূন্যের দিকে আর, আর, লক্ষ্মীর শান্ত হ্রদের মতো চোখদুটো নিথর নিস্পন্দ হয়ে যেন ব্যঙ্গ করছে আমাকে।’

(পূর্বোক্ত, পৃ ৫৫)

শুভ্রা, সুন্দর, কল্যাণীর মতো আনন্দ চরিত্রটিও নাট্যকার জিয়া হায়দারের সযত্ন সৃষ্টি। আনন্দ তার ‘সাজানো বাগানের সমস্ত আনন্দ ছেড়ে’ (পূর্বোক্ত, পৃ ১০) চলে এসেছে, কল্যাণীর হাত ধরে, গন্তব্য শান্তিগড় – অধিক শান্তির প্রত্যাশায়। আনন্দ কৈশোরে খুব দুরন্ত ছিল, খানিকটা নিষ্ঠুর প্রকৃতির বললেও ভুল হয় না। ঘাসফড়িঙের নরম পাখা ছিঁড়ে ফেলা, বুলবুলি পাখিকে ঢিল ছুড়ে মেরে ফেলা তার নিত্যকর্ম ছিল। তবে আনন্দ কিছুটা রসিকও বটে। শুভ্রা যখন বলে, আরশোলা চারদিকে গিজগিজ করছে, আপদগুলো এলো কোত্থেকে! প্রতি-উত্তরে আনন্দ বলে, ‘আমাদের সংবর্ধনা জানানোর অপেক্ষায় আত্মগোপন করেছিল। সুযোগ বুঝে বেরিয়ে পড়েছে এখন।’ (পূর্বোক্ত, পৃ ১৪) এবং ‘দুঃসহ প্রতীক্ষায় মৃত্যুবরণ করার চেয়ে আরশোলা হয়ে এই ঘরে বেঁচে থাকা অনেক ভালো সুন্দর।’

(পূর্বোক্ত, পৃ ৬৬)

নাটকে পয়েন্টসম্যান চরিত্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতিলৌকিক, অতিভৌতিক ব্যাপারটি ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে এটি সার্থক চরিত্র। নাট্যাকারের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় উপস্থাপন ও আঙ্গিকের স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টিতে পয়েন্টসম্যানের সহায়ক ভূমিকা সুবিদিত। স্টেশনে পানি নেই, আলো নেই – এক বদ্ধ গুমোট অবস্থা। পয়েন্টসম্যান বলে :

আমাদের এই সুবর্ণগ্রামে এক বুড়ি আছে। সে নাকি কবে থেকে একটা কৌটোর ঢাকনা খুলতে চেষ্টা করছে, দম না ফেলে। … সেই বুড়ির কৌটোর ভেতর নাকি তিনটি সাধ – বৃষ্টি পায়রা আর ধানশীষ ভরা আছে। ঢাকনা খুলতে পারলেই সেই সাধগুলো বেরিয়ে আসবে। … তাকে চোখে দেখিনি। সে নাকি দিন নেই রাত নেই ওই ঢাকনা খোলার চেষ্টা করে চলেছে, প্রায় খুলু খুলু হয়, হঠাৎ কোত্থেকে প্রকট দমকা ঝড় আসে, সব ভ-ুল হয়ে যায়।

(পূর্বোক্ত, পৃ ২১-২২)

অতিভৌতিক পরিবেশকে আরো ঘন করে তোলে পয়েন্টসম্যানের এ-সংলাপ, ‘ওই যে একশো চব্বিশ হাজার মহাজনের কথা বললাম, ওইসব লোকেরা, শান্তিগড়ের ট্রেন ধরবে বলে যারা এই এখানে অপেক্ষা করতো, তারা এই ঘরের ভেতর থেকেই তাদের চোখে লেগে থাকা কৃষ্ণচূড়া দেখতে চাইতো, দেখার ইচ্ছে তাদের জাগতো সন্ধেবেলায়। আর ইচ্ছে জাগতেই জানালা খুলে ফেলত তারা। কৃষ্ণচূড়ার বদলে তারা দেখত ন্যাড়া পঞ্চবটী আর শকুনের দল। দেখতে দেখতে তারা সব হঠাৎ চিৎকার করে উঠত, তারপরই হয়ে যেত একেবারে নিশ্চুপ, নির্বাক। এবং কখন যেন আলগোছে মরে যেত, নিঃশব্দে। মরে গেছে কিন্তু প্রাণ তাদের মুক্তি পায়নি, বন্দি হয়েই রয়েছে এই ঘরে – সব আরশোলা হয়ে।’

(পূর্বোক্ত, পৃ ২৯-৩০)

একপর্যায়ে অধৈর্য হয়ে শুভ্রা, সুন্দর, কল্যাণী, আনন্দ নিজ নিজ গ্রামে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু তাও অনিশ্চিত। সে-ট্রেনও চলে গেছে, আবার কবে আসবে কেউ জানে না। শান্তিগড় কেমন জায়গা, কতদূর, কোনদিকে জানতে চাইলে পয়েন্টসম্যান বলে, সে শান্তিগড়ের নাম শুনেছে, কিন্তু চোখে দেখেনি। এমনকি তার

বাপ-দাদারাও নয়। সে আরো যা বলে, তা আপাতভাবে হেঁয়ালি মনে হলেও রহস্যময় – ‘শুনেছি এই সুবর্ণগ্রাম স্টেশন থেকে একটা লুপ লাইন বেরিয়ে গেছে ওই দিকটাতে। জায়গাটার নাম বোধহয় অনন্তপুর। সেইখানে নেমে হেঁটে হেঁটে হেঁটে যেতে হবে। … দশ ক্রোশ হতে পারে, বিশ পঞ্চাশ, একশ ক্রোশ হওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। যেতে যেতে একটা জলাভূমি, একেবারে বদ্ধ। সেখানে মোড় নিতে হবে। … পুব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ ঈশান নৈঋত,

ঊর্ধ্ব-অধঃ – যে-কোনোদিকে নিলেই চলবে। … রাতদুপুর পেরিয়ে গেলে কোনো এক ফাঁকে নাকি ট্রেন এখানে আসে, ভীষণ নিঃশব্দে, তেমন নিঃশব্দেই চলে যায়।’

(পূর্বোক্ত, পৃ ৬৫)

অতঃপর অকস্মাৎ স্টেশন মাস্টার মঞ্চে হাজির হয়। সবাই তাকে জেঁকে ধরে – বসন্তনগর, কামিনী শহর কিংবা শান্তিগড়ের ট্রেন কখন? মাস্টার শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বলে, ‘নিয়তি।’

চারজন যাত্রী শান্তিগড়ে যাওয়ার জন্য স্টেশনে অন্ধকার ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছে যেন ‘অনন্তকাল’, ‘অন্তহীনকাল’, ‘অনাদিকাল’, ‘নিরবধিকাল’ থেকে। জিয়া হায়দার তাদের যাত্রা যার যার নিয়তির ওপর ছেড়ে দিয়ে নাটকের সমাপ্তি টানেন। কেউ শান্তির পরশ আর পায় না।

আলোচ্য নাটকে কিছুটা অ্যাবসার্ডিটির প্রকাশ আছে, আছে অতিভৌতিক ব্যাপার এবং সবচেয়ে বেশি করে আছে চেতনাপ্রবাহ (ংঃৎবধস ড়ভ পড়হংপরড়ঁংহবংং)। সুবর্ণগ্রাম স্টেশনে চারজন যাত্রী শান্তিগড়ে যাওয়ার জন্য ট্রেনের অপেক্ষায় ছিল – নাটকের শেষেও তারা সেই অপেক্ষাতেই থাকে।

শেকস্পিয়রের রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট নাটক অবলম্বনে মার্কিন নাট্যকার টম জোন্স রচনা করেন দি ফ্যান্টাসটিক্স, মিউজিক্যাল কমেডি। এটি অবলম্বনে রচিত হয় জিয়া হায়দারের তাইরে নাইরে না। নাটকটির রচনাকাল ১৯৭৪, প্রথম মুদ্রণ পূর্বাচল পত্রিকায়। পরবর্তীকালে পরিমার্জিত রূপ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।৩

নাটকটি রূপান্তরে নাট্যকার জিয়া হায়দার যথেষ্ট স্বাধীনতা নিয়েছেন, ফলে নাটকটি মৌলিক নাটকের মর্যাদা পেয়েছে। নাট্যকারের ভাষায়, ‘আমি জোন্সের সব ঘটনা গ্রহণ করিনি, অংশবিশেষ মাত্র। তাও কেবল প্রথম অংকের। মূল মিউজিক্যালে মেয়ে চরিত্র মাত্র একটি, নায়িকা – লুইসা। আমি আরো দুটি চরিত্র যোগ করেছি। নায়ক ও নায়িকার মায়েদের। এছাড়াও, জোন্স্ পুরনো মার্কিনি বা পশ্চিমি গানের ছিটেফোঁটাও ব্যবহার করেননি। লাইট কমেডি বলতে যা বোঝায় টম জোন্স্ তা করতে গিয়েও দ্বিতীয় অংকে কিছুটা সিরিয়াসনেস নিয়ে এসেছেন; আমি তাইরে নাইরে নাকে পুরোপুরিই লাইট কমেডি রাখতে চেয়েছি। সে কারণেই বোধ করি, আমি বহু পুরনো গানের, এমনকি চল্লিশের দশকের হিন্দি ছায়াছবি অশোককুমার-মমতাজ শান্তি-অভিনীত কিসমতের একটি গানের প্রথমাংশ এবং রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কতিপয় গানের এক বা দু পঙ্ক্তি ব্যবহার করতেও দ্বিধা করিনি।’

(পূর্বোক্ত, নিবেদন)

তাইরে নাইরে না চিরন্তন প্রেমের কাহিনি। প্রতিবেশী এক তরুণের সঙ্গে ষোড়শী তন্বী মেয়ের প্রেম-ভালোবাসা। প্রথমত এ-প্রেমে তাদের বাবা-মা বাধা দিলেও শেষাবধি তারা মেনে নেয়। নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে তাদের মিলন হয়।

নাটকের ঘটনাধারা সাদামাটা মনে হলেও প্রেমের অনুপম আবেদন, প্রাকৃতিক ও শারীরিক সৌন্দর্যের প্রকাশ, নাট্যিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি, চরিত্রের নির্মম ও মাধুর্যমণ্ডিত রূপ এবং সংলাপ সৃষ্টির নিপুণতায় তাইরে নাইরে না অনবদ্য নির্মাণ প্রকৌশল।

নাটকের অন্যতম চরিত্র ‘মেয়ে’টির নাম নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। চিরন্তন সৌন্দর্য, বয়স ও প্রেমের পরিপ্রেক্ষিতে হতে পারে নাম তার জাহানারা, চিত্রাঙ্গদা, এলিজাবেথ, জুলিয়েট, অ্যান, সোফিয়া, অ্যানিটা, নার্গিস, কাননবালা, শাহনাজ, মাধুরী দীক্ষিত কিংবা জুলেখা। তার নিজস্ব অনুভূতি –

এখন ষোড়শী আমি

প্রতিটি দিনেই কি যেন কি যেন ঘটে যায় আমার ভেতরে,

জানি না বুঝি না আমি।

প্রতি ভোরে ঘুম ভেঙে জেগে উঠে

নিজেকে দেখার জন্যে দাঁড়াই দর্পণে –

আমি ঠিক বলে দিতে পারি :

কি যেন বদলে গেছে আমার ভেতরে,

চোখের পাতায় আমি আলগোছে অনামিকা রাখি,

দেখি, কি যেন বদলে গেছে আমার দৃষ্টিতে।

(পূর্বোক্ত, পৃ ১৮)

আর ছেলেটির নাম হতে পারে মজনু, দেবদাস, দিলীপকুমার কিংবা প্রেমের সম্রাট শাহজাহান। তার নিজস্ব কথন –

ওই যে মেয়েটি।

সে আমাকে বানিয়েছে কিশোর, নির্বোধ,

তার সাথে, তারি প্রেরণায় আমি অসম্ভব ঘটনা ঘটাই,

জীববিদ্যা ভুলে যাই,

এবং অর্জন করি বিপুল অজ্ঞতা।

শুধু তারি কণ্ঠ ছাড়া আর কোনো ধ্বনি পশে না শ্রবণে।

হৃদয়ের মধ্যে কি যে বিস্ফোরণ!

(পূর্বোক্ত, পৃ ২০)

ছেলের বাবা প্রতিবেশী মেয়েকে আড়াল করার জন্য নিজ সীমানায় দেয়াল তুলেছে। দেয়াল ও মা-বাবার বাধা উপেক্ষা করে প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসা অধিক বেগবান হয়েছে। বলেছে –

ছেলে : প্রিয়ম্বদা –

মেয়ে : বলো প্রাণেশ্বর!

ছেলে : লাইলি আমার!

মেয়ে : (গানের সুরে) মজনু গো আঁখি খোলো।

ছেলে : উর্বশী, বিশাখা, বন্যা, জুলেখা, মমতাজ –

মেয়ে : এই তো আমি প্রাণসজনী।

(পূর্বোক্ত, পৃ ২৩)

অবশেষে মা-বাবারা ছেলেমেয়ের ইচ্ছা পূরণ করেছে। তাদের মিলনের ফলে নাটকটি মিলনাত্মক কমেডি হিসেবে সার্থক হয়েছে।

জিয়া হায়দার নাট্যকার, আবার বড়মাপের কবিও বটে। তাই তাঁর নাটকের সংলাপ ও নাট্যিক আবহে কাব্যিকতার ছোঁয়া লেখেছে। এডগার অ্যালান পোর একটি বীভৎস রসের গল্প অবলম্বনে জিয়া হায়দার রচনা করেন উন্মাদ সাক্ষাৎকার। নাটিকাটি ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে বগুড়া জেলা পরিষদ মিলনায়তনে মঞ্চস্থ ও একই বছর প্রকাশিত হয়।৪

তারেক ও মইনুল সাংবাদিক। তারা একটি মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে যায় ডিরেক্টরের সাক্ষাৎকার ও প্রতিবেদন তৈরির জন্য। প্রথমেই সাক্ষাৎ ঘটে ম-ল নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে। সে নিজেকে ডিরেক্টর হিসেবে পরিচয় দেয়। তারপর আসে চৌধুরী, মিস টুনি ও মিসেস মৃধা। এরা মানবতাবাদী ও মানসিক রোগীদের প্রতি হিতৈষী বলে পরিচয় দেয়। এদের আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় মানসিক ভারসাম্যহীন মনে হলেও সাংবাদিকরা সামনাসামনি কিছু বলতে পারে না। প্রকৃতপক্ষেই তারা ক্লিনিকে ভর্তি মানসিক রোগী। অফিস কক্ষে ডিরেক্টর খান প্রহরীদের অনুপস্থিতিতে তারা ডিরেক্টর ও কর্মকর্তা সেজে বসেছে। সাংবাদিকদের উলটাপালটা সাক্ষাৎকার দিতে থাকে। একপর্যায়ে সাংবাদিকদ্বয় রিপোর্টিং বাদ দিয়ে ফিরে আসতে চাইলে তারা সাংবাদিকদের আক্রমণ করে। এমনকি ডিরেক্টর খান তাদের অমানুষিক নির্যাতনে নিহত হন। প্রহরীরা এসে সাংবাদিকদের মুমূর্ষু অবস্থায় রক্ষা করে। ডিরেক্টরের লাশও উদ্ধার হয়। ‘শালা রিপোর্টের নিকুচি করি’ বলে সাংবাদিকরা ক্লিনিক ত্যাগ করে।

উন্মাদ সাক্ষাৎকার নাটিকায় প্রচুর হাস্যরস আছে, কিন্তু তা সর্বত্র স্বাভাবিক নয়, বীভৎস – অমানবিক। মানসিক রোগী তো পাগলই। পাগলে পাগলে ঝগড়া হয়, মারামারি হয়, অশ্লীল গালাগাল হয়। ডিরেক্টর ও ডাক্তারদের বন্দি করে নিজেদের সেলে ঢুকিয়ে নিজেরা কর্তৃত্ব নিতে চায়। একজন রোগীর আচরণ, বাক্যালাপ ও করুণ পরিণতি – ‘সে নিজেকে চালকুমড়ো মনে করত। যখন-তখন চালের ওপর উঠে গোল হয়ে শুয়ে থাকত। সে একবার আরো মজার – না মজার নয় – সিরিয়াস কা- করে বসেছিল। রান্নাঘরে ঢুকে কুক ব্যাটাকে বলে কি না, আমি চালকুমড়ো। আমাকে রান্না করে সবাইকে খাইয়ে দাও। কুক তো মহা-ফ্যাসাদে পড়ে গেল। সেও কিছুতেই ছাড়বে না। খানিক পরে কুক বলে : আচ্ছা দাঁড়াও। তোমাকে তো পয়লা ধোয়ামোছা করতে হবে। এই বলে যেই না তার গায়ে গরম পানি ঢেলে দিয়েছে, আর …’

(পূর্বোক্ত, পৃ ৩০-৩১)

জিয়া হায়দারের মুক্তি মুক্তি নাটিকাটি মার্কিন নিগ্রো কবি-নাট্যকার লিরয় জোন্সের এৎবধঃ এড়ড়ফহবংং ড়ভ খরভব অবলম্বনে রচিত –  স্বাধীন রূপান্তর।

মুক্ত মন মুক্ত জীবন, মুক্ত স্বদেশ-প্রত্যাশীদের বিরুদ্ধে অপশক্তি থাকে। এই অপশক্তি স্বাধীনতাকামীদের বাঁচতে দেয় না। নানা অছিলায় আঘাত হানে। প্রতিবাদও হয়। মুক্তির পতাকা সব নির্যাতন ছাপিয়ে দৃশ্যমান থাকে। জিয়া হায়দারের মুক্তি মুক্তি নাটিকায় এ-সত্যই প্রতীয়মান হয়। পাকিস্তানপন্থি রাজাকার নাটিকার অন্যতম চরিত্র, নেপথ্যের অপশক্তি কণ্ঠস্বর। কণ্ঠস্বর নিরীহ মানুষ ঈমান আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দাঁড় করায় এই বলে যে, সে এক মুক্তিকামী দেশদ্রোহী খুনিকে আশ্রয় দিয়েছে। তার শাস্তি হবে। তাকে দোষ স্বীকার করতে নির্দেশ দেয়। ঈমান চাইলে কোর্ট থেকে উকিল নিতে পারে। ঈমান আলী জানায়, তার উকিল হরমুজ আলি মিয়া আছে। এদিকে অপশক্তি হরমুজকে বিপর্যস্ত করে নিজ দলে কব্জা করেছে। সেও ঈমানকে বলে দোষ স্বীকার করতে। ঈমান আলী সবার উদ্দেশে বলে, ‘আপনারা ভুল লোককে ধরেছেন। আমি অমন কোনো কাজই করিনি, মানে কাউকে জায়গা-টায়গা দিইনি। আমি পোস্ট অফিসে চাকরি করি। … বিশ্বাস করুণ আমি মুক্তি-ফুক্তি না। আমি ঈমান আলী। সবাই আমাকে চেনে।’

(পূর্বোক্ত, পৃ ৪৮)

বহু নির্যাতন ভোগ করে এবং অপশক্তির প্ররোচনায় না জেনে নিজ সন্তানকে হত্যা করে ঈমান আলী মুক্তি পায়। ঈমান আলী বোধ ও চেতনা ফিরে পেলে ‘কণ্ঠস্বর’কে লক্ষ করে গুলি ছোড়ে, কয়েকজন সৈনিককে হত্যা করে। এক সৈনিক ঈমান আলীকে গুলি করলে সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। মুখে বিজয়ের হাসি নিয়ে ঈমান আলী নাটিকার শেষ সংলাপ উচ্চারণ করে, ‘মুক্তি, মুক্তি! শান্তি, শান্তি! স্বাধীনতা, স্বা-ধী-ন-তা।’

(পূর্বোক্ত, পৃ ৬৭)

জিয়া হায়দারের আরেকটি নিরীক্ষাধর্মী নাটক এলেবেলে।৫ নাট্যকারের ভাষায়, ‘ইমপ্রোভাইজেশনের ওপর ভিত্তি করেই ‘এলেবেলে’ নাটকটির নিরীক্ষা। কাহিনি বা প্লট বলতে সাধারণভাবে যা বোঝায় তার গুরুত্ব এতে খুব বেশি নেই। এবং সেই সঙ্গে পাশ্চাত্যে ষাটের দশকে রেস্টুরেন্ট থিয়েটারের যে প্রচলন ঘটেছিল ‘এলেবেলে’র উপস্থাপনায় তারও আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।’ (পূর্বোক্ত, নাট্যকারের কথা) ইমপ্রোভাইজেশন পদ্ধতির নাটক হচ্ছে প্রত্যুৎপন্নভাবে অভিনেতারাই সংলাপ তৈরি করে। কুশীলবরা একটি নির্দিষ্ট ঘটনা বা কাহিনি দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং নাটকীয় পরিণতি দান করে। এখানে জিয়া হায়দার একটি অতিরিক্ত নিরীক্ষা করেছেন; তা হলো, কুশীলবরা নির্দেশকের নির্দেশই অনুসরণ করবে। প্রচলিত নাট্যরীতির জন্য সেটি ঠিক আছে – ‘ডিরেক্টর মানেই ডিকটেটর’। তবে নাট্যকার জিয়া এ-সতর্কবাণীও উচ্চারণ করেছেন, ‘অযোগ্য ব্যক্তির অবিবেচনাপ্রসূত ডিকটেটরশিপ পরিণামে বিপর্যয়ই এনে দেয়।’ (পূর্বোক্ত, নাট্যকারের কথা) বর্তমান নাটকে হয়েছেও তাই। নির্দেশক চায়, নাটকের পরিণতি ট্র্যাজেডি। কিন্তু পাত্রপাত্রীরা অভিনয় করতে করতে পারস্পরিক হৃদয়বৃত্তিক ব্যাপার-স্যাপারে জড়িয়ে পড়ে। তারা চায়, রোমাঞ্চ, মিলনাত্মক কমেডি নাটক। ফলে নির্দেশকের সঙ্গে তাদের বিরোধ বাধে। পরিশেষে নাটকের সব ভ-ুল, তথা এলোমেলো হয়ে যায়।

আপাতভাবে মনে হবে, নাট্যকার জিয়া হায়দারই নির্দেশক। প্রকৃতপক্ষে তা নয়। জিয়া হায়দারের সামগ্রিক নাট্যমানস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি সদর্থক ভাবনার বাহক। প্রেম-ভালোবাসায় বিশ্বাসী। তাই এলেবেলে নাটকের গোটা অবয়বজুড়ে আছে ভালোবাসার স্নিগ্ধ পরশ – মিলনের বিজয়কেতন। প্রেমিকা মেয়ে সম্পর্কে প্রেমিক ছেলের ভাবনা, ‘ওকে ছাড়া আমি আর কাউকে ভাবতে পারি না। ওকে ছাড়া আমার জগৎ শূন্য মনে হয়। আকাশ অন্ধকার মনে হয়।’

(পূর্বোক্ত, পৃ ১৭)

আর মেয়ে বলে, ‘আমার কী যে ভালো লাগছে। বিশ্বাস করো, আমি অনুভব করছি, সমস্ত হৃদয় দিয়ে অনুভব করছি। আমরা দুজনই বিরহের উত্তাল সমুদ্র পার হয়ে এসেছি। ভেবে দেখো তো কত বাধা, কত বেদনা, কত সাইক্লোন পার হয়ে আমরা এখানে – এই রেস্টুরেন্টের মোহন দ্বীপে আমরা কাছাকাছি এলাম। নিবিড় হলাম।’

(পূর্বোক্ত, পৃ ২৫)

নির্দেশকের সঙ্গে ছেলেমেয়ের ব্যক্তিক ও নাটকীয় দ্বন্দ্ব বাধে। তাদের দ্বন্দ্বমুখর সংলাপ –

নির্দেশক : তোমরা নাটকের কুশীলব মাত্র, তোমাদের সত্তা টত্তা সবই আমার নাটকের, আমার ইচ্ছাধীন।

মেয়ে : কিন্তু আমরা যে মিলন চাইছি, সুখী হতে চাইছি।

নির্দেশক : তোমরা চাইলেই হবে? আমি তা হতে দেবো না। আমি, আমার নাটক, আমি ট্র্যাজেডি, ট্র্যাজেডি চাই –  আমার নির্দেশ। ডোন্ট ফরগেট দ্যাট আই অ্যাম দ্য ডিরেক্টর।

(পূর্বোক্ত, পৃ ৫৬)

ছেলেমেয়ে নির্দেশকের নির্দেশ অমান্য করে বলে, ‘মানি না, মানি না।’ তারা মঞ্চ ছেড়ে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে যায় ক্যাশিয়ার, মিউজিশিয়ান ও ওয়েটার। তাদের প্রস্থানের পর নির্দেশক সম্বিত ফিরে পায়। চেয়ারের ওপর ধপ করে বসে পড়ে। মঞ্চের সব আলো নিভে যায়।

বাংলাদেশের নাটকের সার্বিক উত্তরণের যে-পথরেখা, সেখানে একক কারো ভূমিকাকে বড় করে দেখা সঠিক হবে না। সে-পরিপ্রেক্ষিতে জিয়া হায়দার অন্যতম নাট্যসারথি। তিনি নিরীক্ষাপ্রবণ নাট্যকার। বাংলাদেশের আধুনিক নাটকের বিশিষ্ট রূপকার।

 

তথ্যনির্দেশ

১. সাদা গোলাপে আগুন ও পংকজ বিভাস, জিয়া হায়দার, প্রথম প্রকাশ ১৯৮২, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

২. শুভ্রা সুন্দর কল্যাণী আনন্দ, জিয়া হায়দার, প্রথম প্রকাশ ১৯৭০, বাংলা একাডেমি, ঢাকা। নাটকটির রচনাকাল ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দ।

৩. তাইরে নাইরে না, জিয়া হায়দার, প্রথম প্রকাশ ১৯৯২, বাংলা  একাডেমি, ঢাকা।

৪. দুটি নাটিকা : উন্মাদ সাক্ষাৎকার ও মুক্তি মুক্তি, জিয়া হায়দার, প্রথম প্রকাশ ১৯৮১, মুক্তধারা, ঢাকা।

৫. এলেবেলে, জিয়া হায়দার, প্রথম প্রকাশ ১৯৮১, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ঢাকা। নাটকটির রচনাকাল ১৯৭৫। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী-আয়োজিত ১৯৭৮-এর জাতীয় নাট্য-উৎসবে থিয়েটার ’৭৩ নাটকটি মঞ্চস্থ করে এবং পুরস্কৃত হয়।