রমাপদ চৌধুরীর প্রয়াণ

গত ৩০ জুলাই কথাশিল্পী রমাপদ চৌধুরী ৯৬ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন। ১৯২২-এ তাঁর জন্ম। গত শতকের চল্লিশের দশকে যে-লেখকরা লিখতে এসেছিলেন বাংলা সাহিত্যে, তাঁদের শেষ প্রতিনিধি ছিলেন রমাপদবাবু। দীর্ঘদিন লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন; এবং তা ঘোষণা করেই। সেও বছর বিশ-পঁচিশ হবে। রমাপদবাবু লিখতেন কম। আমি যখন তাঁকে দেখেছি, সেই ১৯৮৩-৮৪ সাল, বছর পঁয়ত্রিশ আগে, তখনই তিনি সমস্ত বছরে একটি উপন্যাস লেখেন আনন্দবাজার কিংবা দেশ শারদীয়তে। সারাবছর কলম নামিয়েই রাখেন প্রায়। তিনি তখন সম্পাদনা করেন রবিবাসরীয় আনন্দবাজার। তাঁর সম্পাদনায় এই রোববারের সাহিত্য ক্রোড়পত্রটিতে এপারের লেখকরা কে লেখেননি; এবং খুব সতর্ক হয়ে লিখতেন তাঁরা। সম্পাদক রমাপদ চৌধুরী। তখন সেরা গল্পটি রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। এই লেখক লিখেছেন, লেখা ফেরত পেয়েছেন আবার লিখেছেন। আমার জীবনে দেখা সেরা সম্পাদক রমাপদবাবু। কেননা তাঁর কাছে যে-পরামর্শ পেয়েছি তা আমাকে সাহায্য করেছে নিজেকে গড়ে তুলতে। তিনি বলতেন, যে-ম্যাগাজিন আপনার কাছে আগ্রহভরে লেখা চাইবে, দেবেন। দেওয়ার চেষ্টা করবেন। বড় প্রতিষ্ঠাননির্ভর করে থাকা লেখকের পক্ষে ঠিক নয়। বড় প্রতিষ্ঠানে বসেই তিনি এই পরামর্শ দিয়েছেন নবীন লেখককে। বড় উপন্যাস লিখছি, কত শব্দ হবে, এক লাখ পঁচিশ হাজার কি তার বেশি। শুনলেন চুপ করে। বিষয়টি কী জিজ্ঞেস করলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কী কী বই সংগ্রহ করেছি। শুনলেন। জিজ্ঞেস করলেন, পটভূমি চেনেন? উত্তর শুনে চুপ করে থাকলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এত বড় উপন্যাস লিখছেন, কে ধারাবাহিক করবে? জানি না। কারো সঙ্গে কথা হয়নি? উত্তর শুনে জিজ্ঞেস করলেন, তবু লিখছেন। হ্যাঁ। তিনি বললেন, আপনি ঠিক পথে আছেন। এভাবেই লিখতে হয়।

রমাপদবাবু এভাবে আমাকে সাহিত্যের পথ চিনিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁকে প্রণাম। তিনি ছিলেন প্রচারবিমুখ মানুষ। তাঁকে কেউ কোনো সাহিত্যসভায় নিয়ে যেতে পারেনি। মঞ্চ পরিহার করেছেন সমস্ত জীবন। টেলিভিশন চ্যানেলেও যাননি। তরুণ লেখকদের সঙ্গে সাহিত্যের আড্ডা দিতে ভালোবাসতেন।

আমি ১৯৭৪-৭৫ সালে খারিজ পড়ি। তখন দুটি উপন্যাস এপারের বাঙালি পাঠকসমাজকে স্তম্ভিত করেছিল। ১৯৭২ সালে মহাশ্বেতা দেবীর হাজার চুরাশীর মা এবং ১৯৭৫-এ রমাপদ চৌধুরীর খারিজ। খারিজ একটি বালকের মৃত্যুর কাহিনি। বালকের অসহায় মৃত্যু এবং মধ্যবিত্ত শহরবাসীর আত্মোন্মোচনের এক ভয়ংকর কাহিনি খারিজ। এই উপন্যাসের পরতে পরতে মধ্যবিত্ত নাগরিক মানুষের জীবনের নিরুপায় এক পরিস্থিতি, এবং তা থেকে মুক্ত হতে নানা শঠচারিতার আখ্যান বুনেছেন লেখক। কেমন ছিল সেই আচমকা নেমে আসা এক ভয়ানক পরিস্থিতি। অদিতি জয়দীপের ছিল শান্ত এক সংসার। নিস্তরঙ্গ জীবন। তাদের বিবাহ ছিল প্রেমের। অদিতির বাসনা ছিল একটি হাতেধরা কাজের লোক। সর্বক্ষণ থাকবে তাদের সংসারে। এসেছিল এক বালক। পালান। তার বর্ণনা দিয়েছেন রমাপদবাবু এভাবে, ‘রোগা রোগা চেহারা, লাজুক লাজুক মুখ। অজপাড়াগাঁ থেকে এসেছে, চোখে তখনো দাম-শ্যাওলার আভা, মুখে নিকোনো উঠনের ঠান্ডা প্রলেপ।’ বছরবারোর বালক। বাবা খেতে দিতে পারে না তাই লোকের বাড়িতে কাজে দেওয়া। সেই বালকই শীতের রাতে বন্ধ রান্নাঘরে ঘুমিয়েছিল। সকালে দোর খোলে না। দরজা ভেঙে দেখা গেল মরে পড়ে আছে। কী ভয়ানক এক মৃত্যু! জয়দীপ আতঙ্কিত হয়। এরপরে কী হতে পারে? দরজা ভাঙার পর জয়দীপের মনে হয়েছিল পালান বেঁচে আছে। সে ডাক্তার আনতে ছোটে। হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ডাকে। আসলে তখন সে মরে গেছে। কিন্তু পালানের বেঁচে থাকা জয়দীপের অস্তিত্ব রক্ষার সমার্থক হয়ে গেছে তখন। মৃতদেহ পুলিশ নিয়ে যায়। পোস্টমর্টেম হবে। জয়দীপের আত্মরক্ষার প্রয়াস আরম্ভ হলো। মৃত্যুর জন্য কি সে সরাসরি দায়ী? সে ভাড়াটে। বাড়িওয়ালা ওই ঘরে কোনো ভেন্টিলেটর রাখেনি। ভেন্টিলেটর থাকলে কি মরত পালান দম আটকে? তাদের আর একটি ঘর আছে। সেই ঘরে আলমারি আছে আর প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস। সেখানে পালানকে শুতে দেয়নি অদিতি। কেন দেয়নি? আগে একজন ভৃত্য ছিল বিশ্বনাথ, সে চুরি করে পালিয়েছিল। অবিশ্বাস পালানকে ঠেলে দিয়েছিল ওই রান্নাঘরে। আসলে পরতে পরতে রমাপদবাবু পরিবারটিকে কাটাছেঁড়া করেছেন। এই কাটাছেঁড়াতেই তিনি স্বচ্ছন্দ। সুযোগসন্ধানী মধ্যবিত্তের অন্তরাত্মা তিনি যেন দেখতে পেতেন। অনেক উপন্যাসেই কলকাতা শহরের মধ্যবিত্ত জীবনের কথা আছে। তাদের নানা বদলের কথা আছে। আশ্রয়ের জন্য যে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যায়, সে-কথা আছে বাড়ি বদলে যায় উপন্যাসে। অভিমন্যু উপন্যাসে এক ডাক্তারের অসম্ভব মৃত্যুর কথা আছে রাষ্ট্র এবং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে। অথচ মৃত্যুর কোনো কারণই ছিল না। তিনি নিমগ্ন গবেষক। তাঁর গবেষণা ক্ষমতার কোনো বিন্দুতেই সরাসরি আঘাত করছে না বলেই মনে হয়। কিন্তু রমাপদবাবু সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণে চলে যান। আসলে ক্ষমতা সকলকে তার পায়ের কাছে দেখতে চায়। গত চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরে বাঙালি মধ্যবিত্তের বদল ধরা পড়েছে তাঁর লেখায়। খারিজ উপন্যাসে এক জায়গায় আইনজীবী বলছে, ‘আন ন্যাচারাল ডেথ, এঙ্ক্যোয়ারি হবে না? একটা মানুষের মৃত্যু, আমাদের দেশে একটা মানুষের জীবনের চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্ব তার, বুঝলে?’

সবদিক থেকে নিজেকে সুরক্ষিত করে তুলতে চেষ্টা করছিল জয়দীপ। উকিল, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ম্যানেজ, থানাপুলিশ …। জয়দীপের বন্ধু রাধানাথ জয়দীপকে এক জায়গায় বলছে, ‘ঐ বাচ্চা ছেলেটা, পালান না কী নাম, ও মরে গিয়ে এখন একা লড়ছে। আর আমরা সবাই একদিকে, কারণ আমরা শিক্ষিত ভদ্রলোক, পরস্পরকে চিনি, যেমন করে পারি খুঁজে বের করি। ডাক্তার, উকিল, ইনফ্লুয়েন্স সব তো আমাদের দিকে।’

শেষ অবধি করোনারের কোর্টে এই মামলা খারিজ হয়ে যায়। ঘুমের ভেতর পালান মারা গিয়েছিল কার্বন-মনোক্সাইড বিষক্রিয়ায়। প্রবল শীত পড়েছিল। তার গায়ে দেওয়ার মতো লেপ-কম্বল ছিল না। তেলচিটে খুব পাতলা একটা তোশক আর গায়ের চাদর। ঘরটিকে গরম করার জন্য সে কাঠ-কয়লা দিয়েছিল নিভন্ত উনুনে। এতে কার দোষ থাকতে পারে? জয়দীপ-অদিতির? বাড়ির মালিক রায়বাবুর কিংবা সেই বিশ্বনাথ নামের ছেলেটি যে চুরি করে পালিয়েছিল। চুরি করেছিল বলেই না সেই ঘরটি আর পেল না পালান। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। বিশ্বনাথ চুরি করে পালাল কেন, পালানকে ওর বাবা কাজে দিলো কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। খারিজ উপন্যাস এক আয়না। তার ভেতরে নিজেদের মুখ দেখে লুকোতে ইচ্ছে করে। আসলে বার্তাহীন কাহিনি আর ঘটনাপুঞ্জের বিবরণের বাইরে এই উপন্যাস আমাদের টলিয়ে দিয়েছিল। আমাদের এমনি টলিয়ে দিয়েছিল তাঁর অনেক ছোটগল্প। উপন্যাসে অনেক বছর কলকাতা শহরে বিচরণ করলেও রমাপদ চৌধুরী তাঁর আরম্ভের দিনে গোটা ভারতই পরিক্রমা করেছেন যেন। বিখ্যাত গল্প ‘ভারতবর্ষ’ নিয়েই শুধু কথা হয়, কিন্তু ‘উদয়াস্ত’, ‘রেবেকা সোরেনের কবর’, ‘বিবি ক’রজ’, ‘দরবারী’, ‘তিতির কান্নার মাঠ’, ‘তালাক’ … কত গল্প দিয়ে তিনি স্বাধীনতার আগের দেশটিকে ধরতে চেয়েছেন, তার কথা বিশেষ শুনি না। কয়লা খাদান, রেলকলোনি, ছোট রেলস্টেশনের মাস্টারবাবু, খাদানের সায়েব সুপারভাইজর, আদিবাসী সমাজ তিনি যে এত চিনতেন, এত গভীরভাবে চিনতেন তা প্রায় অনুল্লিখিত হয়ে রয়েছে। ‘দরবারী’ গল্পে উত্তর বিহারের সামান্য এক রেলস্টেশন,

আদিবাসী-অধ্যুষিত জনপদ লাপরা কীভাবে হয়ে ওঠে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বসতি ম্যাক্লাস্কিগঞ্জ, সেই কাহিনি লিখেছেন তিনি। ‘দরবারী’ পড়ার মুগ্ধতা এখনো যায়নি। সেই প্রকৃতি আর সময় রমাপদবাবুর কলমে যেন গোপাল ঘোষের নিসর্গচিত্র। বিপুলতা ছিল সেই সময়ের সব গল্পেই। পটভূমি আলাদা ছিল। মানুষজন আলাদা ছিল। তিনি তাঁর কলমের আঁচড়ে সেই পুরনো ভারতটিকে এঁকেছিলেন যেভাবে তা কিছুটা সুবোধ ঘোষে পাই। ‘দরবারী’ গল্পের জোনাথন ম্যাক্লাস্কি, ‘রেবেকা সোরেনের কবর’ গল্পে আদিবাসী কন্যা রূপমতীর রেবেকা সোরেন হয়ে যাওয়া, ‘উদয়াস্ত’ গল্পের প্রবীণ স্টেশনমাস্টার বিষ্ণুরাম, ‘তিতির কান্নার মাঠ’ গল্পের অরুণিমা সান্যাল, ‘তালাক’ গল্পের চাঁদবানু এবং ‘কাসেম বা ভারতবর্ষ’ গল্পের মাহাতো বুড়ো আমাদের সাহিত্যে অনন্তকাল বেঁচে থাকবে। ‘রেবেকা সোরেনের কবর’, ‘বিবি ক’রজ’, ‘তালাক’ ও ‘ভারতবর্ষে’র মতো গল্প যে-কোনো ভাষার সম্পদ। তাঁর সব গল্পেই ভারতবর্ষ। সেই গল্প মাহাতো বুড়োর গ্রামের মতো ভিখিরি হয়ে যাওয়া ভারতবর্ষ যেমন, নিরুপায় মানুষের ভারতবর্ষ। বৈচিত্র্যের ভারতবর্ষ। এখনো রমাপদ চৌধুরীর গল্প পড়ার পর চুপ করে বসে থাকতে হয়।

রমাপদবাবু প্রথম জীবনে ‘লালবাঈ’, ‘দ্বীপের নাম টিয়ারং’ এবং ‘বনপলাসীর পদাবলী’ লিখে সুখ্যাত হয়েছিলেন। চলচ্চিত্রকাররা তাঁর কাহিনি নিয়ে ছবি করেছেন অনেক। তপন সিংহ, মৃণাল সেন, ইন্দর সেন প্রমুখ তাঁর কাহিনি ছবিতে এনেছেন। কিন্তু তাঁর আরম্ভের গল্পগুলোকে, যে-গল্প আমাদের এখনো বিব্রত করে, তা আমি ভুলতে পারি না। রমাপদবাবু সেই পৃথিবী ছেড়ে এসেছিলেন। আমরা যেন বঞ্চিত হয়েছি সেই ছেড়ে আসায়। পরে চমৎকার সব শারদীয় উপন্যাস লিখেছেন। আমি অপেক্ষা করে থাকতাম সেই উপন্যাসের জন্য, কিন্তু তা কখনো সেই ভারতবর্ষ, যা আছে ‘দরবারী’, ‘তালাক’, ‘রেবেকা সোরেনের কবর’ ইত্যাদি গল্পে, হয়ে ওঠেনি। তাঁকে আমার বিনম্র প্রণাম। যা পেয়েছি তা কম কিসের? তাঁকে বহুদিন মনে রাখবে বাঙালি পাঠক। বহুদিন।