আফসার আমেদ : অনেক কথা বলা হলো না

‘কবি ও লেখকরা তো সৌন্দর্যতত্ত্বের কাজ করেন, তাঁর স্বাধীনতা তিনি চান। তাঁরা সাধারণত মানুষকে মানুষ দেখতে ভালোবাসেন। সমাজ, রাষ্ট্রযন্ত্র হয়তো তাঁকে স্বাধীনতা দিতে পারে না। তখন লেখক-সাহিত্যিকরা জীবনদর্শন তৈরি করে নেন। সেই কাজে আপামর মানুষের হয়ে কথা বলবার জন্য সব শিল্পমাধ্যমে তাঁর প্রতিফলন ঘটিয়ে থাকেন। সাহিত্যশিল্পের কাজ সমাজজীবনে অন্তঃসলিলা স্রোতের মতো তাঁর সৃষ্টিকে প্রবাহিত করা। সবসময় মানুষের হয়ে কাজ করাটা তাঁদের জীবনদর্শন। তাঁদের

চিন্তা-চৈতন্য সমাজের চৈতন্যে মিশে যায়। আমার জীবনদর্শন মানবিক ও আশাবাদী।’

আফসার আমেদের এই আত্মবিশ্বাস কখনো আপসে মেশেনি। ২০১৭। মার্চ। এক সাক্ষাৎকারে তিনি ছিলেন অকপট। একটা মুগ্ধতা অনেক আগে থেকে ছিলই। তাঁর গল্পের সঙ্গে ছিল প্রথম পরিচয়। তারপর ‘সানু আলির নিজের জমি’ থেকে ‘ধানজ্যোৎস্না’ পেরিয়ে কিস্সায় কিস্সায় ঘনিষ্ঠতা। পাশাপাশি পড়ছি ‘প্রেমে অপ্রেমে একটি বছর’, ‘আমার সময় আমার গল্প’, ‘খুনের অন্দরমহল’ ইত্যাদি। এ-পর্যন্ত ঠিকই ছিল। অনেক লেখকের অনেক লেখাই তো ভালো লাগে। পাঠ-আবেশের ঘোর কোনো কোনো সময় দীর্ঘদিন সঞ্চারিতও হয়। এতে আশ্চর্য হওয়ার তেমন কারণ আছে বলে মনে হয় না; কিন্তু আফসার আমেদের ক্ষেত্রে আরো কিছু ঘটল। পাঠক-লেখকের সমীকরণ বদলে গেল আরো গভীর গভীরতর সম্পর্কে।

২০১৫। নভেম্বর। বাংলাদেশের রাজশাহী। কবিকুঞ্জের জীবনানন্দ মেলা। আফসারদা ও আমরা কয়েকজন আমন্ত্রিত। কয়েকদিন একসঙ্গে থাকার সুবর্ণসুযোগ। একসঙ্গে থাকা, একসঙ্গে খাওয়া, ঘোরাফেরা, অনুষ্ঠান। একজন অসামান্য লেখককে এত কাছ থেকে দেখা। ফেলে আসা পাঠগুলো মেলানোর ক্রম-চেষ্টা। একজন লেখক এত সাধারণ – এত সাদাসিধে! তিনিই লিখেছেন ‘সঙ্গ নিঃসঙ্গ’, ‘হত্যার প্রমোদ জানি’! তাঁর লেখাতেই পাই ওপেন এন্ডেড ভাবনার প্রকাশ – বিষয়ে, আঙ্গিকে, বাক্যগঠনে! কী আশ্চর্য! লেখক আফসার আমেদ কখন যে আফসারদা হয়ে গেলেন ধরতে পারিনি। কত সহজে আফসারদার কাছাকাছি পৌঁছানো গেল। সে-কদিনেই আপনি হয়ে গেল তুমি। আলংকারিক পরিচয় পেছনে ফেলে কত দ্রুত আপন হয়ে উঠলেন – উঠে এলো পরিবার-যাপন, কত কত গল্প।

রাজশাহীর পদ্মা প্রায় মজেই গেছে। তবু পদ্মা তো দেখতেই হবে। আফসারদা তখন পারকিনসন্সে ভুগছেন। হাঁটতে কষ্ট হয়। ডায়াবেটিসের জন্য ইনজেকশন নিতে হয় রোজ। এত শারীরিক প্রতিকূলতা, তবু মনের জোর অসম্ভব। দেশ ছেড়ে এতদূর এসেছেন, পদ্মা দেখবেন না-হয়! একদিন বিকেলে পদ্মা দেখতে গেছি। আফসারদা টলে টলে হাঁটছেন, একটু পিছিয়ে পড়ছেন, আবার এগোচ্ছেন। পদ্মার পারে এসে ছবি তোলার জন্য বিভিন্ন ভঙ্গিতে দাঁড়াচ্ছেন। ছবি তুলছি – আফসারদাকে দেখাচ্ছি – তুলছি, দেখাচ্ছি। একজন সিরিয়াস কথাসাহিত্যিক এত আবেগপ্রবণ হতে পারেন জানা ছিল না। কী দারুণ ছেলেমানুষ ছিলেন আফসারদা। পদ্মার তীরে দাঁড়িয়ে আমার মোবাইল থেকে ভাবিকে ধরলেন। কথা বলার মধ্যে কোনো আড়াল বা অভিনয় নেই। হাসতে হাসতে দু-চারটে মজার কথা – আমাদের একসঙ্গে বেড়ানো, খাওয়া, অনুষ্ঠান এসব। যখন ফিরে আসছি, সূর্য তখন অনেকখানি মøান। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন আফসারদা – ‘শোনো, তুমি তো কবিতা লেখো, এখন আমি তোমায় একটা কবিতা শোনাবো।’ মানিব্যাগের ভেতর ভাঁজ করা কাগজ। আফসার আমেদ কবিতা লেখেন, এ-খবর তো জানা ছিল না। তাও আবার মানিব্যাগে করে তা বয়ে বেড়ানো! কাঁপা-কাঁপা গলায় থেমে থেমে কবিতাটা পড়লেন। ছুটির দিনে অসম্ভব ভিড় তখন পদ্মার তীর জুড়ে। সেই ভিড়েও অস্তমিত সূর্যের আলোয় এক ব্যক্তিগত নির্জনতা নেমে আসে। কথাসাহিত্যিক আফসার আমেদ কবিতায় ভেসে যাচ্ছেন …

৪ আগস্ট। ২০১৮। পুরোপুরি তিনটি বছরও কাটল না। একটা ফোন এলো। ভারি হয়ে আসা গলা। সন্ধেবেলা। অন্ধকার আরো গাঢ় হলো। ৫ আগস্ট আফসারদাকে কবরস্থ করা হয়। জন্মস্থান বাইনানে। সেদিন তুমুল বৃষ্টি। আগের রাতেই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। কবরস্থ করার পর ফিরে আসছি মলয় সরকারের বাইকে। গাধা পত্রিকার সম্পাদক। আমি আর মলয়দা মিলে এই তো সেদিন আফসারদাকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা বের করলাম। এপ্রিল ২০১৭। ফিরে আসছি বাইনান থেকে। মাঝরাস্তায় বৃষ্টি এত প্রবল আকার নেয়, এক দোকানের শেডের নিচে দাঁড়িয়ে পড়ি। দুজনেই ভাবতে পারছি না, আফসারদা নেই। কত স্মৃতি। কত টুকরো টুকরো কথা। আমরা ছিলাম অসময়বয়সী বন্ধু। এত তাড়াতাড়ি যাওয়ার কথা ছিল না। এই তো কয়েকদিন আগেই বাগনানের বাড়িতে এসে দিয়ে গেলাম ভারতবর্ষের ইতিহাস নিয়ে কয়েকটা বই। মনে মনে ইতিহাস নিয়ে বড় আকারে কিছু লিখবেন এমন শলা করছিলেন। ইচ্ছে ছিল নিজেকে নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার। বৃষ্টির ছাঁট এসে বারবার ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। চোখও ভিজে যায় আনমনে। অনেক কান্না জমে আছে আফসারদা। চরম অসুস্থতার সময়ে তুমিও তো কাঁদতে। কাঁদতে পুরনো অনেক কথার অনুষঙ্গে। মায়ের প্রসঙ্গে। প্রায়ই বলতে মায়ের কথা। তোমার লেখার প্রেরণা তোমার মা। বাইনান থেকে বাগনানে এসে ট্রেন ধরব। এর আগে যতবার বাগনান থেকে ট্রেন ধরেছি, তুমি এগিয়ে দিতে। চরম অসুস্থতার সময়েও হেঁটে আসতে, যতটা পারো। বৃষ্টি বাড়ছে। বৃষ্টি কমছে। এভাবে একা রেখে আসা। একটা জলজ্যান্ত মানুষ এভাবে নিখোঁজ হয়ে যাবে। এক ঝড়-জলের রাতে ‘সেই নিখোঁজ মানুষটা’র আবিদ বাগনানে ফিরে এসেছিল। আর এক ঝড়-জলের রাতে …

এক-দুদিন অন্তর মোবাইলে আফসারদার সঙ্গে কথা হতো। খবর পেতাম নতুন লেখার। আশপাশের চেনা চরিত্রেরা কীভাবে গল্পে ঢুকে পড়ত শুনতাম সেসব গল্প। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমি থেকে অবসর নেওয়ার আগে পর্যন্ত প্রায়ই দেখা করতাম অকাদেমি চত্বরে। তিনতলার অফিস ঘর থেকে নেমে এসে ‘আমন্ত্রণে’ চা খেতেন। চলত আড্ডা। শোনাতেন অনেক লেখক-সাহিত্যিকের মজার মজার ঘটনা। এরই মধ্যে ছুঁয়ে যেত ব্যক্তিক জীবন, অর্থনৈতিক সংকটের কথা। বাংলাবাজারে লিখে উপার্জন করে সংসার চালানো চাট্টিখানি কথা নয়। স্ত্রী-কন্যা-পুত্র নিয়ে সে-লড়াই যথেষ্ট কঠিন। হিসাব করতে বসলে অসম্ভব মনে হয়। অথচ কখনো কোথাও আফসার আমেদ অর্থ উপার্জনের জন্য লেখাকে বিকিয়ে দিয়েছেন, এ-কথা চরম নিন্দুকও বলবেন না। আদপে আফসার আমেদের নিন্দুকই প্রায় নেই। বরং তাঁর আছে সুনির্দিষ্ট এক পাঠকগোষ্ঠী। আছে বাংলাদেশে, দিল্লিতে, কোচবিহারে, মালদহে। যেখানেই তাঁর সঙ্গে গেছি, দেখেছি সত্যকার পাঠকের আকুতি। একসময় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমির চাকরি জোটে। কিন্তু অনিয়মিত কর্মী হিসেবে। মাইনে বলার মতো কিছু নয়। চাকরিও অনিশ্চিত। রিটায়ারমেন্ট আসন্ন। পেনশন নেই। দুশ্চিন্তা আফসারদাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো বয়সের ক্ষেত্রেও আছে সালবিভ্রাট। খাতায়-কলমে জন্ম ১৯৫৭ সালের ৫ এপ্রিল। আদপে জন্ম ১৯৫৯। শংসাপত্র অনুসারে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির সময় সালবিভ্রাটে বয়স দুবছর বেড়ে যায়। না হলে আরো দুবছর চাকরি করতে পারতেন। অর্থনৈতিক চিন্তা তাঁকে জীবনের শেষদিন পর্যন্তও ভাবিয়েছে।

গত তিন-তিনটে বছর আফসারদা দূরে যেখানেই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেয়েছেন প্রায় সব জায়গাতেই আমি ছিলাম তাঁর সঙ্গী। যতটা ছিল প্রয়োজনের, তার চেয়েও বেশি ছিল বন্ধুতার দাবি। সে-সূত্রেই দিল্লি, কোচবিহার, মালদহ বারবার যাওয়া।

শ্রদ্ধার সাহিত্যিক কেমন করে যেন পরিবারের অংশ হয়ে ওঠেন। সব সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়া যায়। সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পাচ্ছেন এই খবর জেনেই সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেন। আবার দিল্লি। শরীর একটুও ভালো নেই। গত তিন বছরে শরীর বারবার খারাপ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দিল্লিতে গিয়ে তা বেশিমাত্রায় ধরা পড়ে। তবু কয়েকজন বন্ধু – অনিশ্চয়দা, মলয়দা, সন্দীপদা, সাকির সবার সঙ্গে একসঙ্গে থাকার আনন্দে আফসারদা ছিলেন মশগুল। অসুস্থতা দূরে ঠেলে ঘুরলেন ইন্ডিয়া গেট, জামা মসজিদ, হুমায়ুনের সমাধি, নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগা। ফিরে এসে গেলেন মালদহে। এবার আমার যাওয়া হলো না। শুনলাম আফসারদা মালদহ থেকে ফিরে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। একদিন জানলাম, যাদবপুরে কেপিসি হসপিটালে ভর্তি। ভর্তির দু-একদিন পরে দেখতে গেলাম। ভালো নেই আফসারদা। অনেক ধরনের শারীরিক সমস্যা। নাসিমা ভাবির সঙ্গে কথা হলো। ছেলে শতাব্দ, মেয়ে হিয়া দেখাশোনা করছে। কিন্তু ওদেরই বা কতটুকু বয়স। কতটুকু পারবে ওরা। অসুস্থতার সময়ে কিছু আত্মীয়স্বজন ছাড়া আর কারো দেখা নেই। আমিই-বা বারবার যেতে পারলাম কই! যেদিন প্রথম দেখতে গেলাম, সেদিন যখন কেপিসি হসপিটাল থেকে বের হচ্ছি, তখন সন্ধেবেলা। ২ মার্চ। ২০১৮। একটা ফোন এলো। চলে গেছেন সাহিত্যিক সোহারাব হোসেন। বাহান্ন বছরও পূর্ণ হয়নি। ছুটলাম আর এন টেগোর হসপিটাল মুকুন্দপুরে। মন বড্ড খারাপ। আফসারদা অসুস্থ। সোহারাব কাকু চলে গেলেন। অনেকদিন এ-খবর আফসারদাকে বলিনি। ভাবিকেও বারণ করেছিলাম বলতে। আফসারদা কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে বাগনানে গিয়ে একদিন সোহারাব কাকুর খবরটা দিয়েছিলাম। চুপ করে শুনেছিলেন আফসারদা। একটাও কথা বলেননি।

এরপর ভালোই চলছিল। বেশ সুস্থই হয়ে উঠছিলেন। এবং এটা আশ্চর্য যে, আফসারদা পুরোপুরি ধূমপান ছেড়ে দিয়েছিলেন। মাঝেমধ্যে লুকিয়ে-চুরিয়ে দু-একটা খাওয়ার চেষ্টা করছিলেন না এমন নয়, ভাবি ধরেও ফেলেন। এই সময় তিনি প্রায় লিখতেই পারছিলেন না। তবে ইতিহাসে ছিলেন নিমজ্জিত। বাংলার ইতিহাস, ভারতবর্ষের ইতিহাস, বিশ্বের ইতিহাস। বড় কিছু লেখার মতলবে। শৌভিককে ডেকে এনে ছকে ফেলেছিলেন বড় র‌্যাক তৈরির পরিকল্পনা। আকাক্সক্ষা, লিখতে গেলে পড়তে হবে বিস্তর। ফোনে কথা হতো মাঝেমধ্যে। তবে আগের চেয়ে কমে আসছিল। নানা কারণে। আমার ব্যস্ততা বাড়ছিল, আফসারদার শরীর ভালো নেই – কথা বলতে যদি কষ্ট হয়, এই ভয়েও। হঠাৎ শুনলাম, আফসারদা আবার অসুস্থ। প্রথমে বেলভিউ, শেষে এসএসকেএম হসপিটাল। যেদিন দেখা করতে গেলাম সেদিন আইটিইউ থেকে কেবিনে দেওয়া হচ্ছে। ভালো লাগল আফসারদা সুস্থ হচ্ছেন। বেড চেঞ্জের মাঝের সময়টুকুতে কয়েকটি কথা হলো। চেহারা বদলে গেছে অনেকখানি। রোগা হয়ে গেছেন আফসারদা। আমায় চিনতে পারলেন ঠিকঠাক। বিচ্ছিন্ন দু-চারটে কথা। নেমে আসছি সিঁড়ি দিয়ে – ভাবি সামনে। কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে জানান, আফসারদার লিভারটা নষ্ট হয়ে গেছে।

শেষের দিকে আমাদের পরিকল্পনা চলছিল কিছু গল্প বেছে নিয়ে ননসেন্স স্টোরিজ নামে একটা সংকলন বের করার। দে’জ পাবলিশিংয়ের অপুর সঙ্গে কথা বলার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু বোকা বানিয়ে আফসারদাই চলে গেলেন। রয়ে গেল ত্রিশটির ওপর উপন্যাস, তিনশোর কাছাকাছি ছোটগল্প। আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নানা প্রবন্ধ, সমালোচনা, ফিচার, সাক্ষাৎকার, কবিতা। শুধু আক্ষেপ, তাঁর শেষ ভাবনারা ভাবনাই থেকে গেল – ‘আমার শৈশবের সময়গুলি নিয়ে আমি একটি উপন্যাস লিখতে চাই। আর একটি উপন্যাস নিজেকে নিয়েও লিখতে চাই। আমাকে তাড়া করে এই উপন্যাস। জানি না সে-উপন্যাসদুটি কেমন হবে। কীভাবে লিখব এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি।’