অফিসের পোশাক পরে মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে যাওয়ার আগে তমোহরের রুমে উঁকি দিলো সেঁজুতি। বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে, নতুন কেনা গিবসনের গিটারটার টিউনিং করছিল সে। ওদের উপস্থিতিতেও সে-কর্মের কোনো ছেদ ঘটে না। সে আপনমনে টিউনিং করতে থাকে। সেঁজুতি জানত, ও এক পলকের জন্যও চোখ মেলে তাকাবে না। তাই বেশ উঁচু কণ্ঠে বলে, ‘আমরা যাচ্ছি।’ তমোহর এবারো তাকিয়ে দেখার তাগিদ বোধ না করেই বলে, ‘আচ্ছা’। ওটুকুই। ওরা চলে যায়। সে তার হলুদ রঙের পিকটা দিয়ে বেশ ঘনঘন তারে ঘষে যেতে থাকে। নিস্তব্ধ ঘরে ঝনঝনে শব্দের ঝড় ওঠে। যেন নিজের মনের কথাগুলোও সে-শব্দে ঢাকা পড়ে যায়। যদিও তমোহর জানে, এই সকালে পৌষিকে নিয়ে সেঁজুতির বেরিয়ে যাওয়াটা সবসময়ই ওর কাছে শঙ্কার। ওরা নিরাপদে পৌঁছল কি না সেই চিন্তার অবকাশকে সে পাত্তা দিতে চায় না কোনোদিনই। কিন্তু ভাবনায় থাকে নিজস্ব একাকিত্বের যন্ত্রণা। অথচ ওরা সবাই জানে, তমোহর একাকিত্বই চায়। তার সৃষ্টিতে ডুবে থাকতে, ও কেবল এই অবকাশই খোঁজে। কিন্তু তমোহর সবাইকে নিজস্ব সত্যকে জানান দিতে কোনো প্রকাশ চায় না। তাই কোনোদিন বলা হয়ে ওঠে  না – ‘তোমরা বেরিয়ে গেলে আমার খুব শঙ্কা হয়।’

সহজিয়া এক জীবন চেয়েছিল তমোহর। বাড়ির সবাই তাকে হিসাবের বাইরের মানুষ করে নিয়েছে; সেও বহুদিন। তাদের মতে, এত মেধাবী তমোহর! অথচ সে কি না বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় বসে কেবল গিটারের সুর খুঁজে ফেরে! বিসিএস দিয়ে কোনো এক ক্যাডারের দলভুক্ত হবে না সে! এ-কথা আর সকলের মতো সেঁজুতিও বুঝে ছিল। তবু তমোহরের প্রতি মুগ্ধতা ছাড়তে পারেনি। দিনে দিনে বরং আরো জড়িয়ে গিয়েছে তাদের জীবন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ডিগ্রি ছাড়াই তমোহরকে ডেকে নেয় ছোট ছোট গানের আসর। কিন্তু সেখানেও নিয়মিত নয়, যেন নিয়মকে অবজ্ঞা করাই তার সুখ। যথেষ্ট কথা আর সুরের খোঁজে অনবরত জীবনের সব দায়কে এড়িয়ে চলাই যেন তার একমাত্র উদ্দেশ্য। সেঁজুতিও আর সবার মতো তমোহরকে মাঝে মাঝেই অলস আর ফাঁকিবাজের অবজ্ঞায় দেখত না, তা নয়। তবে কোথায় যেন ভালোবাসা রয়ে গেছে। শুধু তমোহরের প্রতি নয়, ওই গিটারটার জন্যও অবশিষ্ট ভালোবাসা রয়ে যায়। যখন নতুন নতুন কথার সুরে মেতে ওঠে তমোহর, তখন বড় মায়া জাগে তার। যদিও ছোটবেলা থেকে চর্চা করা সেঁজুতির আর গান গাওয়া হয় না।

পড়াশোনাশেষে চাকরি নেয়। বাউন্ডুলে তমোহরকে বেঁধে রাখার ঝুঁকি বা বেঁধে ফেলার দুঃসাহস দেখাতে গিয়ে নিজের সুরসাধনায় ইতিও টানে। হয়তো-বা তার কখনো গাইয়ে হওয়ার প্রেম ততটা জমে ওঠেনি, যতটা তমোহরের জন্য জমা ছিল। যদিও তমোহরের ভীষণ আপত্তি সেঁজুতির এই সারাদিনের হিসাবের খাতার কাজ, খুঁটে খুঁটে ঘর সাজানোর, শিশু জন্ম দেওয়ার। যেন বোষ্টমীর জীবন নিয়ে তারা ভিগ মাগবে ঘরে ঘরে। এ-কথায় জ্বলে উঠেছিল সেঁজুতি। আর দশটি দৃশ্যত সুখী দম্পতির জীবনের খাতা খুলে বসে হিসাব কষেছে কতবার! তখন প্রকা- অপ্রাপ্তির পাহাড় তার সামনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু কাকেই বা বলবে সে-সব। তমোহরকে তো খুঁজে পেতে তাকে একসময় অমাবস্যা-পূর্ণিমার খোঁজ করতে হতো। তমোহরও বুঝতে পেরেছিল, তাই আর সেজুতির গানের প্রসঙ্গ তোলে না। বরং বন্ধু বা তারই মতো গানপাগলদের আড্ডাখানায় যে সকল সুর তৈরি হয় না, সে-কথাও বুঝে যায়। তাই অনিয়মিত হলেও তার জন্য সেঁজুতির এই সংসারই প্রকৃত আশ্রয়। সারাদিনের নৈঃশব্দ্যে নিজের জগতে ভেসে বেড়ানোর এত ভালো আস্তানা তো আর নেই তার। এমন ডুব মেরে নিজের জগতে ভেসে বেড়ানোর সুখটুকু তো সেঁজুতিই তাকে দিয়েছে। মাত্র হাজার স্কয়ার ফিটের একখানা ঘরে। কিন্তু সেও এই পৌষের জন্মের আগের নিস্তব্ধতা। এখন মেয়ের জন্য যে একাকিত্বকে খুঁজে পেতে বেশ কষ্ট করতে হয় তাকে। সংসার আর সেঁজুতিকে জুড়ে

থাকতে গেলে পৌষের জন্মকেও অস্বীকার করতে পারে না তমোহর। তা সে বেবি সিটিংয়ের দায় নিতে হলেও। এর মাঝে ফাঁক পেলেই সে যে পালিয়ে কোথাও চলে যায় সুর খুঁজতে, তাতে সেঁজুতি আর বাধা দেয় না। ঘরে তখন নতুন কাকতাড়–য়ার মতো পৌষকে নিয়েই সুখ। সে জানে, তমোহর সারাজীবন পালিয়ে বেড়াত, নিজের মা-ভাই-বোনদের কাছ থেকেও পালিয়েছে, সব জেনেই তাকে যতটুকু বেঁধে রাখা তাতেই খুশি সেঁজুতি।

মাকে দূরে রাখা বা মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকা বিষয়টা তমোহরের কাছে অত গুরুতর হয়ে ওঠেনি কখনো। লেখাপড়াসূত্রে সেই যে বাড়িছাড়া হয়েছিল, প্রথম প্রথম ঈদ পার্বণে এক-আধবার অনুরোধ বা বড় ভাইবোনদের তাড়ায় গিয়েছিল। তাও তো কত বছর আগের কথা। তমোহরকে মায়ের হয়তো বেশি খোঁজার প্রয়োজন পড়েনি, কিংবা বলা যায় সুস্থ একজন মা কবেই বা তার কাঁধে হাত রেখেছিল? কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পাঁচ-পাঁচটি ছেলেমেয়ে রেখে বাবা মারা গেলে, ওই মাকে ঘিরেই তো তারা বেড়ে উঠেছিল। প্রায়ই অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যেতেন তিনি। আবার ফিরে আসতেন তার পিতৃহীন সন্তানদের কাছেই।

বাবা যখন মারা যায় তখন তমোহরের বয়স মাত্র সাত। মায়ের নাড়িপোছা সন্তান সে, তার জন্য মমতার গভীরতা লেগে থাকত মনিরা বেগমের জঠরে। কিন্তু তা প্রকাশের আদিখ্যেতার ভাষা তিনি হারিয়েছিলেন। আর অমন ছিন্ন-ছিন্ন ভঙ্গিতে এক উঠোনের গল্প যখন; তখন তা তমোহরের কাছে দূরেরই হয়ে যায়। যখন মায়ের চারটি সন্তান সাফল্যের সঙ্গে দাঁড়িয়ে যায় যার যার জীবনে, তখন ছন্নছাড়া তমোহরের দায়মুক্তি যেন খানিকটা বেশিই জোটে। কেউ কখনো হয়তো অভিযোগের সুর তুলে থাকবে,

– তমোহরটা কী-সব গান-বাজনা নিয়ে মেতে আছে। ওর কি বুদ্ধি হবে নাহ …

তখনো মায়ের তো স্নেহকণ্ঠই জেগে থাকে, যেন সেই সাত বছরের তমোহর। বাবা হারানো তমোহর, তার জন্য মায়ের ভালোবাসা জেগে থাকা কণ্ঠ

– ছেলেমানুষ … কেবল খেলে-বেড়াইতে চায়।

– মা, তুমি জানো না। এবার ওর অনার্স ফাইনাল দেওয়ার কথা, ও নাকি পরীক্ষার হলেই বসেনি!

স্বামীহারা মনিরা বেগম, পাঁচটি সন্তানের চিন্তায় দিশেহারা মনিরা বেগম। খানিকটা অপ্রকৃতিস্থ মনিরা বেগম। ছেলের বেড়ে ওঠার বয়স ভেবে দেখেন না, তার মুখে জেগে থাকে নিজের ছেলেবেলায় শেখা হেঁয়ালি শ্লোক। তিনি বলে ওঠেন – ‘অতি বড় হয়ো না, ঝড়ে ভেঙে যাবে। অতি ছোট থেকো না, ছাগলে মুড়ে খাবে।’

এভাবে কথা বললে, কথা আর আগায় না। ক্রমশ বাড়ির হিসাবের খাতা থেকে তমোহর দূরে সরে যায়। বাকি চার সন্তান আর

নাতি-নাতনিদের নিয়ে মনিরা বেগমও হয়তো অবচেতনে ভুলেই ছিলেন তমোহরকে। কিংবা কে জানে, ভুলে কি আর থাকা যায়! বরং অনুচ্চারিত রেখে দেওয়া কথা, অস্পর্শ প্রেমের খাঁচায় আটকে থাকা কোনো এক ভ্রƒণ। কিন্তু অনেক বছর পর, বাড়ি থেকে ক্রমাগত খবর আসে, তমোহর যেন একবার বাড়িতে ফেরে।

মনিরা বেগম কেমন ছিলেন? খুব বেশি তলিয়ে দেখেইনি তার এই কনিষ্ঠ পুত্র। হেঁয়ালি শ্লোক বলা, নিয়মিত রান্নাবান্নার ফাঁকে নতুন কাঁথা বা সোয়েটারের কাঁটায় নতুন ঘর কাটা ছাড়া আর কি? আরো একটা বিষয় অবশ্য ছিল, যে-কারণে তমোহর মাকে ভয় করত। মাঝেমধ্যে আনমনা হয়ে হেসে উঠতেন তিনি। কখনো বা ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতেন অতি আদরের সব সন্তানের প্রতি। হয়তো ভাবতেন, এই পাঁচটি সন্তানের বোঝা চাপিয়ে লিয়াকত হোসেন কেমন করে পালিয়ে যেতে পারলেন! মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত মাকে সামলে বড় বোন তমাই ঘুম পাড়াত তমোহরকে। এই রোদ্দুর, এই মেঘের আচ্ছাদনে ডুবে যাওয়া মাকে খুব একটা বুঝে উঠতে পারেনি তমোহর। এই ঘনঘন রূপ পালটে যাওয়ার বিষয়টি কি আর মনিরা বেগমেরও মনে থাকত। খানিক বাদে তার আর সে-কথা মনেই থাকত না। এই আনমনে ঘটে যাওয়া ঘটনার সময় তার হাতের কাজটিতে ফিরে গেলে তিনি বরং সবার ওপর ভীষণ রাগ করতেন। কোনো এক গড়বড় চোখে পড়তই তার। সেটা যে নিজের হাতেই করা, তাও ভুলে যেতেন। আর তাতেই ক্ষণিক চিল্লাবিল্লাহ হতো। কেউ আর তাকে মনে করিয়ে দিত না সেই গড়বড়ে সময়ের কথা। তখন তমোহরের আরো অচেনা আর দূরের লোকই মনে হতো মাকে। মা থেকে পালিয়ে থাকাটা তার পুরনো স্বভাব। কিন্তু কোনো কোনো গ্রীষ্মের দুপুরে, স্কুলশেষে মায়ের খুব কাছে আসত সে। যখন দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে বারান্দায় পাটি পেতে বসতেন মা। তখন নিজের পিঠ খুলে বসে বলতেন, দে তো বাপ, একটু ঘামাচি গেলে দে। তমোহর তখন খুশিতে মায়ের পিঠ ঘেঁষে বসত! চারকোনা পাঁচ পয়সা দিয়ে টলটলে ঘামাচি গেলে দিত। জলেভরা ছোট ছোট লাল লাল ঘামাচি! মায়ের পিঠের তিনটি বড় আঁচিল। ঘাড়ের ঠিক নিচে, বেশ বড় সাইজের মাংসের দলার মতো বা গোল আলুর মতো আঁচিলগুলো ছিল তমোহরের পছন্দের। কিছুটা ঘামাচি গেলে দিলেই সে ওই আঁচিলগুলো নেড়েচেড়ে দেখার সুযোগ পেত। তখনই কেবল মা তাকে কাছে ঘেঁষতে দিত। ওই ঘামাচির জন্যই, আর তমোহর ওই আঁচিলের লোভে মায়ের গ্রীষ্মদুপুর খুঁজে ফিরত। আর একসময় ক্লান্ত হয়ে মায়ের পিঠ জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েও যেত। এখনো কোনো কোনো দুপুর তমোহর কাটিয়ে দেয় পৌষের গায়ে পাউডার মেখে, ঘুমন্ত শিশুটির পাশে বসে নতুন সুর খুঁজতে খুঁজতে। এই দুপুরগুলোতে কেন জানি তমোহরের কেবল মায়ের কথা মনে পড়ে।

মাকে নিয়ে তাকে নতুন করে ভাবতে দিয়েছেন মনিরা বেগমই। তার একপাশ অবশ হয়ে যাওয়া শরীর! একজন সুস্থ মা যেমন তার খুব অদেখা ছিল, তেমনি এমন স্থবির মাকেও সে ভাবতে পারেনি। গত সপ্তাহে খুলনা থেকে ফেরার পথে বাড়ি গিয়েছিল তমোহর।

বিছানার সঙ্গে লেপ্টে থাকা মা, শীর্ণদেহের, কংকালসার মা। তমোহরের বড় অচেনা লাগে। মায়ের খাটের পাশে একটা বুকশেল্ফ ছিল। এখন নেই। কাঠের রেহালের ওপর রঙিন কাপড়ে বাঁধা কোরান শরিফ, কাবা শরিফের ছবিআঁকা বেহেস্তি জিউর আর বিষাদ সিন্ধু। তমোহরের চোখ খুঁজে ফেরে; পেল না। হয়তো নিজে উঠে বসতে পারে না বলেই সবাই সরিয়ে দিয়েছে শেল্ফ। ঘরটাকে বড় অন্ধকার আর গুমোট মনে হয় তার। বেটসোর থেকে রেহাই দিতে বাতাসে ফোলানো বিছানা; খানিকটা চাদর সরে গিয়ে উঁচু ডিবি বের হয়ে আছে কোথাও কোথাও। আধখোলা মশারির ভেতরে এমন মৃত মানুষের মতো পড়ে আছেন তিনি! বুকের খাঁচাগুলোতে ওঠানামা চলছে কেবল।

ভাবি বলল, ‘তোমাকে খুব খোঁজে আজকাল। খানিক সময় মায়ের বিছানায় বসো।’

তমোহর বসতে পারে না। খাটের পাশে বসার কিছু খুঁজেও পায় না। একটু দূরে কেবল একটা প্লাস্টিকের লাল চেয়ার! কমোড বসানো। অব্যবহারে এখনো নতুন আর চকচকে। তারও ওইপাশে শূন্য এক হুইলচেয়ার; যেন কোনো মৃতের মতো দেহকে টেনে নেওয়ার অপেক্ষায়। বড় আড়ষ্ট লাগে, অচেনা মনে হয় সবকিছু। এমন অচল মা কি তারই? মাকে কখনো স্থির থাকতে দেখেনি। শেষবারও বাইরের দরজার সিঁড়ি জুড়ে বসেছিল। হাতের তসবিদানাকে কত দ্রুত গুনতে পারত! তখনো মা এই দরজা জুড়েই থাকতেন। না হলে সামনের একচিলতে উঠোনে হেঁটে বেড়াতেন। একবার তমোহর জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বাইরে এত কী খোঁজেন?’

তখন বলেছিল, ‘তোমরা আসো যদি, তাই পথে চেয়ে থাকি।’

চার-চারটি সন্তান দূরে থাকলে মায়েরা এমন পথ চেয়ে বসে থাকেন, রাস্তা থেকে হেঁটে হেঁটে সদর রাস্তার গাড়ি গোনেন। তাও ভালো ছিল। এমন স্থির মা! এ কি তারই মা!

ভাবি মায়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে, ‘দেখেন কে আইসে?’

মা শোয়া থেকে মাথাটা একটু কাত করে দেখার চেষ্টা করে। তমোহর তখন আরো একটু এগিয়ে যায়। মায়ের বিছানা থেকে কেমন গন্ধ বেড়োয়। আজকাল পেছাব-পায়খানা সব এখানেই। ইদানীং নাকি ডায়পার পরিয়ে রাখে। তমোহরের ভেতর থেকে তীব্র গন্ধে একটা ধাক্কা আসে। বিছানায় লেগে থাকা মা, ঘোলা চোখে তাকিয়ে; শুকনো ঠোঁটজোড়া নাড়িয়ে বলে – ‘কে? তমো?’

অচেনা দেহ থেকে এই স্নেহময় ‘তমো’ শব্দটা শুনে, গু-মুতের গন্ধ হজম করে; তমোহর আরো নিচু হয়ে মায়ের কাছাকাছি গিয়ে বলে, ‘মা!’

মনিরা বেগম যেন আগের মতোই। এমন ভঙ্গিতে বলে, ‘কই থেকে আসলি?’

– খুলনা।

– সেখানে কে কে থাকে?

তমোহর বুঝতে পারে; অতটা স্বাভাবিক মা আর নেই।

বলে, ‘কেউ না। একটা শো ছিল। গান গাইতে গিয়েছিলাম।’

– তুই কই থাকিস?

– ঢাকায়।

– কার সঙ্গে থাকিস?

মা সেঁজুতিকেও চেনে, এমনকি পৌষকেও দেখেছে দু-তিনবার। অথচ এখন কেমন অচেনা মানুষের মতো কথা বলছে!

তমোহর বলে, ‘সেঁজুতি আর পৌষ।’

– ও, তোর বউ-বাচ্চারে আনলি না।

তমোহর কিছু বলে না। মা নিজেই আবার বলেন, ‘আমি তো এখন কোথাও যাইতে পারি না। তোমাদের দেখতে ইচ্ছা করে।’

ভাবি বলে, ‘তুমি একটু বসো। আমি চট করে তোমার জন্য শরবত নিয়ে আসি।’

তমোহরের মনে হয় সে অচেনা কোনো এক জায়গায় চলে এসেছে! মুখে তার কথা বলে না। অল্প আলোয়, অন্ধকারের হাতছানিতে বসে থাকে। মা থামেন না, তিনি আবার বলেন, ‘বাড়ি বেড়াডাঙ্গা।’ হঠাৎ বেড়াডাঙ্গার কথা? তমোহর কিছু ভেবে পায় না। সে বলে, ‘কার বাড়ি?’

– ডাক্তার সাহেবের।

এবার তমোহরের বেশ মজা লাগে। মা এসব কী বলছে। বেড়াডাঙ্গা তো মায়ের বাপের বাড়ি। নিজের বাপকে চিনতে পারছে না! তমোহর বলে, ‘কোন ডাক্তার সাহেব?’

– ডা. নাজিম উদ্দিন।

– সে আপনার কী হয়?

– আমার বাবা।

তমোহর এবার কিছু বলতে পারে না। মুহূর্তে তার পালিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। এমন কেন মানুষের জীবন! ওকে চুপ থাকতে দেখে মনিরা বেগম আবার বলেন, ‘ওখানে দারোগার বউ থাকত, রুলি থাকত, রুবি থাকতো, হাশেম থাকত। বাড়িতে ঘোষদের দোকান থেকে মিষ্টি আসত!’

তমোহর বলে, ‘দারোগার বউ কে?’

– রুমি।

– সে আপনার কী হয়?

– বড় বোন।

একি, মা-কি তার সঙ্গে ধাঁধা খেলছে! তমোহরের বড় অস্বস্তি লাগে। ও মায়ের কাছ থেকে সরে আসে।

ভাবি জানায়, ‘তোমাকে খুব খোঁজেন আজকাল। পরশুদিন তো রবিনকে ডেকেছে তোমার নাম ধরে। তারপর ডেকে নিয়ে বলে আমার গলা জড়িয়ে শুয়ে থাক তো বাপ!’

অনেক আগেই তমোহরের পালানো স্বভাব হয়ে গিয়েছিল। এই অচেনা, অসহায় মাকে সে আর নিতে পারছে না। সে দুপুরের বাসেই ঢাকায় ফিরতে চাইলে, ভাবি বাধা দেন। বাড়িতে মা থাকেন এই মেজো ভাই আর ভাবির সঙ্গে। ভাবি জানান, ‘বড় ভাইজান আইসে, বাইরে গেছে। বড় আপা আর রাজিবও আইসে। সন্ধ্যায় তোমার ছোট আপাও আসবে। আজ তোমাকে থেকে যেতে বলেছে।’ তমোহরের খুব অস্বস্তি লাগে। মনে হয় অচেনা জায়গায় আটকা পড়েছে! সে খানিকটা খোলা হাওয়া পেতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। কৈশোরের কুমার নদের পাড়ে জমে থাকা কচুরিপানার দিকে চেয়ে থেকে সারাটা বিকেল পার করে।

রাতে অনেকদিন বাদে সব ভাইবোন একসঙ্গে খেতে বসে। মনিরা বেগম নিজের ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলেন, ‘তোরা সবাই আইছিস দেখে আমার কত ভালো লাগে।’ সবাই খেতে খেতে পাশের ঘর থেকে মায়ের সে-কথা শোনে কিন্তু কোনো উত্তর দেয় না। মেজোভাই আর ভাবি যখন মায়ের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা শুরু করে, তখন অন্য সবাই কোনো অস্বস্তি বোধ ছাড়াই নতুন সবজিটা তুলে নেয়। মা নাকি সেদিন বালিশের কোনা ছিঁড়ে তুলো বের করে ফেলেছে। ভাইয়ের মেয়ে রুহির মালাটা টেনে ধরেছিল, তসবি ভেবে। শুধু তাই নয়, সেই মালা ছিঁড়ে গেলে একটা পুঁতি মুখে দিয়ে গিলেও ফেলেছে! সবাই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সেসব কিচ্ছা-কাহিনি শোনে। তারপর তমোহরকে অবাক করে দিয়ে ছোট আপা বলেই বসে, মেজোভাবি আরো কতটা যত্ন নিতে পারত! সে মোটেও গোছানো সংসার করতে শেখেনি বলেই সমস্যা বেশি হচ্ছে!

বড়ভাই বলে, ‘মায়ের বয়স হইছে এখন আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে, য্যান তার তেমন কষ্ট না হয়। আল্লাহ তাকে মুক্তি দেয়।’ কথার মানে বোঝার জন্য তমোহর ভাইয়ের দিকে তাকায়। ভাইয়েরও বয়স হয়েছে, দাড়িভর্তি মুখে ভাবলেশহীন চোখ, নিখুঁতভাবে রুই মাছের কাঁটা বেছে খায়।

মনিরা বেগম বিছানায় শুয়ে শুয়েই আবার উঁচু গলায় বলে চলেন, ‘তোরা আইছিস, আমার কি যে ভালো লাগতেছে!’ তারপর তিনি ছড়া কাটেন, ‘এক পোলার মা কুকুরনি, পাঁচ পোলার মা ঠাকুরনি।’

বড় আপা এঁটো হাতে উঠে যায়। বলে, ‘মা আপনি একটু থামেন। আল্লাহ আল্লাহ করেন।’ বড় আপা ফিরে এসে একটা সজনেডাঁটা দাঁতের দুই মাঢ়ি দিয়ে চিবুতে চিবুতে বলে, ‘আমি একটা মহিলার খোঁজ পাইছি। সামনের মাসে আনার ব্যবস্থা করব। মার তো এখন দেখাশোনার জন্য চব্বিশ ঘণ্টার লোক দরকার।’ সে-কথার কেউ কোনো উত্তর দেয় না। মুখের ভেতরের খাদ্যকণিকার উথালপাথাল শব্দ ছাড়া সারাঘর ক্ষণিকের জন্য চুপচাপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ বাদে আবার মনিরা বেগমের গলা ভেসে আসে, ‘ওই একটু পানি দে …’

মেজোভাবি দ্রুত ছুটে যান। একটু পরে আবারো মনিরা বেগমের গলা ভেসে আসে, ‘শাকাহুন রাব্বাহুন … শারাবান তুহুরা।’

বহুদিন বাদে এই দোয়াটি মনিরা বেগমের কণ্ঠে শুনে তমোহর কেমন চমকে যায়। সেই ছোটবেলা মা বলত, ‘বসে পানি খা। পানি খেয়ে এই দোয়াটা পড়।’ কেউ না পড়লেও মনিরা বেগম সবসময় পানি পানের পর দোয়াটা পড়তেন। খাবার রুমে এতজন একসঙ্গে খেতে বসেছে। অথচ তমোহরের কেমন যেন একা একা লাগে। হঠাৎই ছেলেবেলার কথা মনে হতেই মনে পড়ে, প্রায় বত্রিশ বছর হলো বাবাকে ছাড়া মা একা একা কাটিয়ে দিলেন! সন্তানরা কি আর স্বামীর অভাব মেটাতে পারে? বা কোনো সঙ্গী বা নিত্যসহচর হয়ে উঠতে পারে? মনিরা বেগম কত ভুলভাল কথা বলে উঠছেন, অথচ এই দোয়াটা পড়তে ভোলেন নাই! তমোহরের কাছে জীবনটা বড় অদ্ভুত লাগে। তার ভাবনায় ছেদ ঘটায় সেজোভাই রাজীব।

সে বড়ভাইকে উদ্দেশ করে বলে, ‘আমি একটা ডেভেলপারের সঙ্গে কথা বলছি। আমাদের এই বাড়িটা তারা নিবে। কিন্তু ৩৫ পার্সেন্টের বেশি দেবে না। মফস্বলের এই জমিতে তাদের লাভ হবে না।’ কথাটা শুনে তমোহর খানিকটা চমকে যায়। এই বাড়ি ডেভেলপারের কাছে যাবে! এর মধ্যে ছোট আপা বলে ওঠে, ‘তন্দ্রার বাবা এক ডেভেলপারের খোঁজ পাইছে। সে ৪০ পার্সেন্ট দিতে চাইছে।’

তার মানে এ-বিষয়ে আলাপ অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে! তমোহর জানে না। অবশ্য ও তো বাড়ির কারো সম্পর্কে বহুদিন হলো কিছুই জানে না।

সবাই তখন ফ্ল্যাটবাড়ির ইউনিট, কয় ফ্লোর, কয় রুম নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। তমোহরের খাওয়া শেষ। সে উঠে যায়। অনেকক্ষণ যাবত মনিরা বেগমের সাড়া না পেয়ে তমোহর ভাবে, মা ঘুমিয়ে গেছে। পাশের রুমে যেতেই ডিম লাইটের অল্প আলোয়, মশারির ভেতর থেকে মনিরা বেগম হঠাৎ ডেকে ওঠেন, ‘কে? তমো নাকি?’

তমোহর এগিয়ে যায়, ‘হ্যাঁ মা।’

– আয় বাবা বস।

তমোহর মায়ের বিছানার ধার ঘেঁষে দাঁড়ায়। মনিরা বেগম বলে, ‘তোরা সবাই আইছিস, আমার কত ভালো লাগতেছে। কিন্তু আল্লাহ কি করছে! উইঠা বইসা তোদের সঙ্গে গল্প করব। তাইলে না শান্তি।’

বহুদিন পর তমোহরের চোখ ভিজে ওঠে। মনিরা বেগম তা দেখেন না, তিনি গলাটা খানিক ফিসফিসিয়ে বলে, ‘এই বাড়িটা ওরা ভাইঙ্গা ফেলবো।’ খানিক দম নিয়ে বলে, ‘আমি কইসি কইস না। ওরা রাগ হবো।’ মায়ের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে সে পালাতে চায়। বলে, ‘মা আমি একটু বাথরুমে যাব।’

বাথরুম থেকে বেরিয়ে মায়ের ঘরটায় আর যায় না। বসার ঘরে সবাই ফ্ল্যাটবাড়ির যেন এক অদৃশ্য স্ট্রাকচার দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। মায়ের মৃত্যু হলে তা দৃশ্যত হবে।

 

সেঁজুতি বিষয়টি লক্ষ করেছে, বাড়ি থেকে ফিরে তমোহরের কিছু একটা হয়েছে। রাতদিন কেমন চুপচাপ বসে থাকে। কোলের মধ্যে গিটারটা নিয়ে তারগুলোতে আনমনে হাত বুলিয়ে যায়। কোনো সুর ওঠে না যেন! পৌষিকে নিয়ে কী-সব অদ্ভুত প্রশ্নে খেলা করে। জিজ্ঞেস করলেই বলে, ‘কই? কিছু না তো।’

অবশেষে নিজেই একদিন সেঁজুতিকে বলে, ‘আচ্ছা সেঁজু দেশে কোথায় ভালো বৃদ্ধাশ্রম আছে?’

– কেন? মাকে পাঠাবে …

– ধরো তাই।

– ভাইয়ারা রাজি হবেন না। তাছাড়া তুমি তো মাকে দ্যাখো না, তুমি কেন এ-চিন্তা করছ?

– এজন্যই কখনো কোনো চিন্তা করতে চাই না। তোমাদের সমাজ আঙুল তুলে দেখাবে তুমি তো নিষ্ঠুর, মায়ের সেবা করো না …।

তমোহর রেগে যায়। সেঁজুতি ওকে একা থাকতে দিয়ে বেরিয়ে আসে। রাগ ক্রমশ নেমে এলে তমোহর ভাবনায় ডুবে যায়। পৃথিবীর নিয়মগুলো কত অদ্ভুত! এই যে ভাবি সংসারের যাবতীয় কাজের মধ্যে অমন বিছানায় পড়া শাশুড়িকে দেখছে, কতটুকুই বা সে পারবে? ওই তো দূরে থেকে বড় আপা, ছোট আপা নানা উপদেশ দেবে, যত্নের খুঁত ধরবে। ওদের কি সম্ভব মাকে দেখার? অথচ যেন ওদের চেয়ে কেউ মাকে বেশি ভালোবাসে না। মুহূর্তেই সবাই ভাবতে পারে, আল্লাহ তার মৃত্যু দিলে, সে কষ্ট কম পাবে! সে শান্তি পাবে। তমোহর জানে, ফ্ল্যাটবাড়িটা হলে সবার একটা আশ্রয় হয়, শান্তি হয়। ছেলেমেয়েদের আলাদা রুম হয়। সবাই আসলে শান্তি মানে কি বোঝে? সে তো পরিবারের অকাল কুষ্মা-! দুনিয়ার কাউকে নিয়ে ভাবনা নেই। অথচ তার কেন জানি মনে হতে থাকে, যদি বৃদ্ধাশ্রমে বা হাসপাতালে নিয়োজিত সিস্টার দেওয়া যেত মাকে! গল্প করার জন্য একটা লোক! তাদের পেশার দক্ষ যত্নে মায়ের কষ্ট কমতো। ভাবির কষ্ট কমত। বাড়ির সবাই কি নিশ্চিন্তে নিজেদের কাজে ডুবে থাকতে পারত না!

রাখতে অসুবিধা কোথায়? মমতায়? নিজেদের যার যার কাজের বিঘ্ন ঘটিয়ে তা করলেই কেবল ভালোবাসার দিব্যি প্রমাণিত হয়? এসব মিথ্যা। ওই সবাই আছে যার যার দোষ ঢাকার চেষ্টায়। এই ঢাকনা দিয়ে ভালোবাসা প্রকাশ একজন অসুস্থ রোগীর কতটা উপকারে আসবে? তার তো চাই প্রশিক্ষিত হাতের যত্ন। আমরা সোসাইটিতে সে নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে, চক্ষুলজ্জার খাতিরের প্রেম প্রদর্শন করে যাই। আহা, মূল্যবোধ। তুমি কাচের শোকেসবন্দি এক শোপিস। আমরা মমতার নামে অসুস্থতাকে পুঁজি করি। নির্দিষ্ট সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার উদ্যোগ নিতে চাই না। সাময়িক অন্যের জীবনকে অতিষ্ঠ করে কারো ঘাড়ে চাপিয়ে দিই কোনো এক বোঝা। সে তা নিতে না চাইলে, বয়ে যায় নিন্দার ঝড়। তোমরা সবাই কত বাস্তববাদী, আমি তো উড়োধুড়ো … তোমাদের বাস্তবতায় কবে সত্যিকারের বাস্তব জেগে উঠবে?

গতকাল পৌষিকে বাড়ি আনতে আনতে তমোহর পথেই কুড়িয়ে পেল কিছু কথা। বাড়ি ফিরে গিটারের টুংটাং আওয়াজে সে সুর ভেজে চলেছে। পৌষি বাবার আশপাশে ঘুরঘুর করে সেই কথাগুলো মাথায় গেঁথে নিয়েছিল। মেয়েটির খুশি যেন ধরে না। বাবা তাকে নিয়ে গান লিখেছে! পৌষি অপেক্ষায় থাকে মা বাড়ি ফিরলেই জানাতে হবে।

স্কুলশেষে নানা ভাবনার উচ্ছলৃতায় ক্লান্ত পৌষি ঘুমিয়েছিল। সেঁজুতি এসে তাকে ডেকে তুললে, শহরের অন্ধকার দূর করতে বাতিগুলো জেগে ওঠে। পৌষির ঘুমেও যে খুশি হারিয়ে যায়নি, তা তমোহরের নতুন লেখা গান। সে বলে, ‘জানো মা, বাপি আজ আমাকে নিয়ে কী সুন্দর একটা গান লিখেছে!’

– তাই নাকি? সোনাপাখি …

– তুমি জানলে কী করে? বাবা তোমাকে শুনিয়েছে?

– নাহ্, তুমি বলো …

– তুমি যে বললে সোনাপাখি … বাবা তো আমাকে …

পৌষি থেমে যায়। ওর ভীষণ খারাপ লাগে, মাকে বাবা আগেই শুনিয়ে ফেলেছে! সে আগে বলতে পারল না।

সেঁজুতি তাড়া দেয়, কী হলো মা … বল বাবা কী কী গান লিখেছে?

পৌষি ঠোঁট উলটে বলে, ‘তুমি তো জেনে গেছো … তুমি যে আমাকে পাখি বললে …’

‘ওরে সোনা। সত্যিই আমি জানি না।’

পৌষি দৌড়ে বাবার ঘরে যায়। তমোহর তখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। মেয়েটি দেখে বাবা খুব অসহায় ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে। সবসময় বাবার সচল হাতে গিটারের টিউন ঠিকঠাক করার কসরতে পক্ত হাত দুটো কেমন অসহায় আর নেতিয়ে পড়া জীবাশ্ম মনে হলো। বাবার কণ্ঠনালিটা হাঁ করে ঘুমোবার জন্যই বোধহয় ফুলে ফুলে শব্দযুক্ত বাতাস বের করছিল। পৌষের ভীষণ ভয় লাগছে। সে দ্রুত বাবার ঘর ছেড়ে চলে আসে। মেয়েটির মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেছে, চোখে অদ্ভুত করুণ তারার উপস্থিতি দেখে মা বলে, ‘কীরে? বাবা এলো নাহ?’

পৌষ এই মুহূর্তে নতুন শব্দ খুঁজে পায় না। সে মনের ভেতর জেগে থাকা শব্দটিই উচ্চারণ করে বসে। বলে, ‘ও মরে গেছে!’

কথাটা যেন সে নিশ্চিত হয়েই বলে। ভয়ে সে মৃত্যুতে মেয়ের কোনো দুঃখবোধের ছোঁয়া ফুটে ওঠে না। সেঁজুতি কী হয়েছে দেখতে তমোহরের রুমে ঢোকে। মেয়েটি ওর মায়ের পেছন পেছন আসে। সে-মুহূর্তে তমোহর বিছানায় নিজের শরীরটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে বাঁ-পাশ থেকে ডান পাশে ফিরে শোয়। এবং অস্ফুট কণ্ঠে বলে, ‘আমি ঈদে বাড়ি যাচ্ছি না।’

সেঁজুতি বুঝতে পারে, এলোমেলো স্বপ্নে তমোহরের শরীর এখন অচেনা ভুবনে যুদ্ধ করছে। দুদিন আগে তমোহর বলেছিল, ওর বোনেরা খুব চাপ দিচ্ছে, ঈদে বাড়ি যেতে। কিন্তু সে যেতে চায় না। আর এই যেতে না চাওয়ার পেছনে অদ্ভুত এক যুক্তি দাঁড় করিয়েছে সে। যেটা সেঁজুতিকে বলেছিল। তার মতে, ওই অসুস্থ, বিছানায় পড়ে থাকা মায়ের সঙ্গে ঈদ করে সে তার ছেলেবেলার ঈদের আনন্দকে মাটি করতে চায় না। কেননা ছেলেবেলায় ঈদ মানেই মায়ের হাতের লালমোরগের মিষ্টি কোরমা আর মচমচে বেরেস্তায় ঢাকা পোলাওয়ের স্বাদই সে ধরে রাখতে চায়। সে ভুলতে চায় না। এখন সেই মাকে বিছানায় শুয়ে ল্যাদলেদে লাচ্ছি সেমাইয়ের দলা মুখে তুলে দিতে দিতে কেউ বলবে, ‘মা খান, আজ তো ঈদ। একটু সেমাই খান।’ এ-দৃশ্য দেখতে সে বাড়ি ফিরে যেতে চায় না। এসব মুহূর্তেই মনে পড়লে সেঁজুতি কোনো শব্দ না করেই রুম থেকে বেরিয়ে আসে। তমোহরের নিজের যুদ্ধটাকে সে করতে দিতে চায়। মা, মেয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে। তারা কেউ কাউকে কোনো উত্তর দেয় না।

কিছুটা চুপচাপ কেটে যায় যেন দিনগুলো। আর শেষ পর্যন্ত ঈদের দিনটিও চলে আসে। পৌষি সকাল থেকেই নতুন জামা পরে ঘুরে বেড়ায়। সারাদিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয় তমোহর। সন্ধ্যার আগে উঠে পড়ল এবং বেশ সাজগোজ করে গিটার হাতে বেরিয়ে যাওয়ার আগে পৌষিকে কোলে তুলে চুমো খেতে খেতে বিদায় নেয়। বলে, ‘রাত দশটায় জীবন টিভিতে শো আছে রে মা। দেখিস।’ সেঁজুতি পেছনেই দাঁড়ানো ছিল। সে তাকে কেবল একটি হাসি দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে পড়ে।

ঈদের সারাদিনের আনন্দ জোগানোর ঝক্কিশেষে বাড়ির সবাই টিভিরুমে জড়ো হয়ে যায়। বাড়িটার নাম তখনো মনিরা মঞ্জিল। তমোহর ছাড়া সবাই বাড়িময় ঘুরে ফিরে। কেবল অসাড় হয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে মনিরা বেগম তার বিছানায় আধোঘুমে পড়ে থাকেন। মেজোবউ এসে না ডাকলে তিনি হয়তো ঘুমিয়ে যেতেন। মেজোবউ টিভির সাউন্ড বাড়িয়ে দিয়ে শাশুড়ির গায়ে হাত রাখেন। বলেন, ‘মা, ঘুমায়েন না। টিভিতে তমোহরের গান হবে। সাউন্ড বাড়িয়ে দিয়েছি। শুয়ে শুয়ে কান পেতে শুনেন।’

মনিরা বেগম জড়তা-মেশানো চোখ পিটপিট করে বলে, ‘আইচ্ছা।’

জীবন টিভিতে বেজে চলে –

ছোট পাখি ছোট পাখি

সর্বনাশ হয়ে গেছে

পৃথিবীর পরে আর

তোমার আমার

ভালোবাসার কেউ নেই

কিছু নেই।

ও ছোট পাখি ছোট পাখি

ভাংচুর হয়ে গেছে

শিশুদের খেলনা

আমাদের দোলনা

ডাকবাক্সের ঢাকনা

রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের

আলো নেই।

ও-পাখি ও-পাখি

গানটা থেমে গেছে

নদীটা ফিরে গেছে

পাহাড়টা সরে গেছে

সাগরটা মরে গেছে

আদিবাসী শামুকের

কোনো ঘর নেই। …

সে-রাতে মনিরা বেগম চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘তোরা দ্যাখছোস … তমোহরটা একটা পাগল! আমারে নিয়ে গান বানছে।’ সে-কথারও কোনো উত্তর আসে না। সবাই ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে থাকে।

(গল্পে ব্যবহৃত গানটি সহজিয়া ব্যান্ড-সংগৃহীত।)