বেদনার নীলমণিলতা

আমার কাকা দ্বিজেন শর্মা প্রয়াত হয়েছেন গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর। তাঁর তরফ থেকে শেষ উপহার পেয়েছিলাম এক নীলমণিলতা।

সে-নীলমণিলতাটি আজ টিনের চালের অর্ধেকটার দখল নিয়েছে। লতাটি হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘লাগিয়ে দিস বাড়ির সামনের বারান্দার টিনের চালে। যখন টিনের চালটি নীলমণিলতায় নীল হয়ে যাবে আমাকে ফোন দিবি আমি ঠিক চলে আসব। বাড়ি ঢোকার প্রথম ফটক যেখানে শ্বেতপাথরে ‘নিসর্গ’

কথাটি লেখা আছে সেখানে দাঁড়িয়ে নীলমণিলতার ফুল দেখব। সেখানে আমার জন্য একটা ইজি চেয়ার রাখবি। জানিস? ইজিচেয়ারে শুয়ে ফুলের সৌন্দর্য দেখতে খুবই ভালো লাগে।’ বললাম, ‘হ্যাঁ, সবই করব; কিন্তু তুমি আসবে তো?’ কারণ আজ ক-বছর ধরে বাড়ি আসার জন্য তাঁর মন খুব উতলা; কিন্তু শারীরিক কারণে সাহস পান না। বললেন, ‘দেখিস সত্যি সত্যি আসব, কথা দিলাম।’ ‘কথা দিলাম’ কথাটি শুনে মন আমার আনন্দে নেচে উঠল। ‘শোন, তুই আমার নীলমণিলতাটির যতœ নিবি তো?’ ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, অনেক যতœ নেব।’ ‘গত ২৯ মে ৮৬তম জন্মদিনে আমার প্রিয় ববি এটা আমাকে উপহার দিয়েছিল। চিনিস তাকে? ওই যে মশিউল আলম ববি।’ ‘হ্যাঁ, চিনি তো।’ ‘ছেলেটি আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। ওর দেওয়া উপহারটি তোকে দিলাম, এর যতœ নিস।’

দিনটি ছিল শুক্রবার। ২৯ জুন, ২০১৭। সকাল দশটা। তাঁর ফোন পেয়ে সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় এলাম। এসে দেখি তাঁর মুখটি মলিন, বিষণœ। কোনো এক গভীর বেদনা যেন তাঁর বুক ভরে রেখেছে। ড্রয়িংরুমে বসে আছেন বিশিষ্ট রবীন্দ্র-গবেষক অধ্যাপক নুরুল আনোয়ার। আমার প্রিয় নুরুকাকা, বলা যায় তাঁর ওপর স্বয়ং রবিঠাকুর ভর করে আছেন। তাঁর চিন্তাচেতনা, ধ্যানজ্ঞান, ঘুম-জাগরণ সবকিছুতেই শুধু রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রসংগীত। এমন মানুষ সংসারে বিরল। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রিটায়ার করে স্থায়ীভাবে ঢাকায় বাস করেন। ব্যস্ত না থাকলে প্রতি শুক্রবার তাঁর কাটে সিদ্ধেশ্বরীর বাসায়। কাকুকে গান শোনানোর জন্য চলে আসেন। কাকুও তাঁর গান শোনার জন্য ব্যস্ত হয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন।

নুরু কাকু গান গাইলেন, ‘এই আসনতলে মাটির পরে লুটিয়ে রব’, ‘সমুখে শান্তিপারাবার -/ ভাসাও তরণী হে কর্ণধার’, ‘ভরা

থাক্ স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি’। সবশেষে গাইলেন ‘আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ’।

ঘরে বিরাজ করছে একধরনের নিস্তব্ধতা, এর মধ্যে এমন রবীন্দ্রসংগীত যেন এক মোহনীয়-মায়াময় পরিবেশ তৈরি করল। কেমন যেন এক উৎসব উৎসব ভাব, তার মধ্যে বেদনাও। আসলে প্রতিটি উৎসবের দিনই প্রকৃতপক্ষে খুব বেদনার, কেমন যেন এক নস্টালজিক অনুভূতি তৈরি হয় তখন। উৎসবের দিনে কাছে না থাকা প্রিয়জনের জন্য আমরা ব্যাকুল হয়ে পড়ি।

কাকু তাঁর প্রিয় ইজিচেয়ারে চোখ বন্ধ করে আছেন, নুরুকাকা একটার পর একটা গান গেয়েই চলেছেন। নুরুকাকার গান শেষ হলে বললেন, ‘যবে থেকে রবীন্দ্রসংগীত আমার মনে দোলা দিতে শুরু করল সেদিন থেকে আমার হৃদয়ের একূল-ওকূল দুকূল ছাপিয়ে শুধু রবীন্দ্রসংগীত আর রবীন্দ্রসংগীত। জীবনের সকল কাজে সকল ক্ষেত্রে রবীন্দ্রসংগীতই আমার প্রেরণা।’ তাঁর চোখের কোণে ছোট্ট একবিন্দু জল। আমাকে বললেন, ‘বস, গান কর, তোর বাবার লেখা সেই বিখ্যাত গানটি ‘আমি যে এক পল্লীকবি, আঁকি যদি তোমার ছবি’ গা না। তোর লেখা সেই ‘এক অখ- ভারতভূমি’র গানটি কর না।’ কোনো গানই গাইতে পারলাম না। কারণ আমার ছিল বিরক্তিকর ট্রেনের তাড়া। এই তাড়া জিনিসটা বড়ই নির্মম, বড়ই আবেগগ্রাসী। হাতে সময় বড় কম ছিল। কখনো বুঝতে পারিনি, তাঁর হাতেও সময় বড় কম। দুপুর বারোটার ট্রেনে চলে আসব শুনে তাঁর মুখটি একেবারে বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি ভেবেছিলেন আমার ট্রেন রাত বারোটায়।

যদি বুঝতে পারতাম এটাই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা, শেষ কথা বলা হবে, তাহলে ওই ট্রেন মিস করতাম, মিস করতাম পরদিনের ট্রেনিং, মিস করতাম ছেলের স্কুল, মিস করতাম প্রবল বন্যায় মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফেরার অভিজ্ঞতা। তাঁর সঙ্গে আরো কটা দিন কাটাতাম। তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতাম, তাঁর ফোলা ফোলা পায়ে হাত বুলিয়ে দিতাম। পছন্দের গান শোনাতাম। আমার সমস্ত আয়ুর্বেদের জ্ঞান হাতড়ে তাঁর জন্য খুঁজে আনতাম কোনো ভেষজ, যা তাঁর শ্বাসকষ্টে হয়তো একটু আরাম দিত। না, কিছুই করা হলো না ট্রেন ধরার তাগিদে। পিছুটান রেখে চলে এলাম কমলাপুর। আসলে এক গোলকধাঁধার চক্করে ঘুরছি তো, কোনো কিছুই করা হলো না ঠিকমতো।

বিদায়বেলা কেন জানি আমার মন বারবার বলতে লাগল, তাঁর সঙ্গে এটাই বোধহয় শেষ দেখা। কোনোদিনই আর তাঁর সঙ্গে দেখা হবে না। তাঁর বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। আমার চোখ জলে ভেসে যেতে থাকল। তাঁকে বললাম, ‘মাত্র এক সপ্তাহ পরে আবার আসছি।’ মনে মনে বললাম, যে আমাকে বাবার মতো অথবা বাবার চেয়ে বেশি আগলে রাখত সেই মহীরুহের সঙ্গে আবার দেখা হবে তো?

গত বছর মে-জুন মাসে প্রচ- বন্যায় ভেসে গিয়েছিল মৌলভীবাজার জেলা। কুলাউড়া থেকে বড়লেখা আসতে পথে পাঁচবার গাড়ি বদল করলাম, অবশেষে বেশি পানি অতিক্রম করার জন্য যখন টাটা ট্রাকে উঠলাম, তখন ট্রাকটি পানির মধ্যে গর্তে পড়ে গিয়ে যখন উলটে যাওয়ার উপক্রম হলো, সে-সময় আমি সবকিছু উপেক্ষা করে নীলমণিলতাটিকে শক্ত করে বুকে আগলে রাখলাম। কারণ তোমাকে কথা দিয়েছিলাম এটি যতেœ রাখব।

বাড়ি এসে দেখি পথঘাট, পুকুর সবই পানিতে থইথই করছে। পরদিন কাকাতো ভাই বাগানবিশারদ বনফুল দাদাকে দিয়ে নীলমণিলতাটি ঠিক জায়গামতো লাগালাম, যেন ফটক থেকে ঠিকভাবে দেখা যায়।

এমনভাবে কথা দিয়ে চলে গেলেন গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর। তাঁর অতি আদরের নীলমণিলতাটি আজ যৌবনবতী, লতাগুলো ডগমগে, যেন কোনো কিশোরীর পেলব বাহু। কদিন পরই এর ফুলে নীল হয়ে উঠবে টিনের চাল। বুকের ভেতর কেমন যেন হাহাকার করে উঠছে, শুধু মনে হচ্ছে, বেদনার রং নীল আর তোমার

চলে-যাওয়ার বেদনা আমাকে নীল করবে বলে কি এ-নীলমণিলতাটি উপহার দিয়েছিলে? এটিই তোমার দেওয়া শেষ উপহার। কথা দিয়েছিলে নীলমণির ফুল ফোটা দেখবে, কথা রাখবে তো? তোমার প্রতীক্ষায় রইলাম বেদনায় নীল হয়ে।