বিজ্ঞানভাবনা ও জীবন

সুব্রত বড়ূয়া

তিনটি অংশে বিন্যস্ত মোট চৌত্রিশটি রচনার সংকলনগ্রন্থ এটি। গ্রন্থের নামেই বিবৃত সে-তিনটি অংশের পরিচয় – বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও পরিবেশ। এ-কালে প্রযুক্তি ও পরিবেশ-সম্পর্কিত ভাবনাচিন্তা আমাদের গণমাধ্যমগুলোতে আলোচ্য বিষয় হিসেবে যথেষ্ট প্রাধান্য পেলেও রচনার বিষয় হিসেবে এককভাবে বিজ্ঞানের উপস্থাপন তেমন গুরুত্ব অর্জন করতে পারেনি, সে-কথা অস্বীকার করা যায় না। বইটির ভূমিকাস্বরূপ-রচিত ‘শংসাকথন’-এ অধ্যাপক ও যশস্বী বিজ্ঞানলেখক দ্বিজেন শর্মা লিখেছেন, ‘স্বাধীনতার দশককাল পরেই আমরা দেখেছি শিক্ষকরা স্কুল-কলেজে বিবর্তনবাদ পড়াতে অনীহা প্রকাশ করছেন এবং ছাত্রছাত্রীরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ফারাক ভুলতে বসেছে। যাহোক, স্বাধীন বাংলাদেশে শিল্প ও কৃষিতে বিস্তর উন্নতি সাধিত হয়েছে। প্রযুক্তি ও বাণিজ্যবিদ্যায় একদিকে যেমন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে একইসঙ্গে বিজ্ঞানে তাদের আগ্রহ কমছে। আমাদের বিজ্ঞানলেখকরা এখন কল্পবিজ্ঞানে যতটা আকৃষ্ট, জনবোধ্য বিজ্ঞানে ততটা নন এবং প্রথমোক্তদের জনপ্রিয়তাও বর্ধমান।’

দ্বিজেন শর্মার এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণের সুযোগ খুব বেশি আছে বলে আমার মনে হয় না এবং একইসঙ্গে যোগ করা চলে যে, সরাসরি বিজ্ঞানবিষয়ক জনবোধ্য রচনা এখন নিতান্তই কম, কালেভদ্রে তা চোখে পড়ে। সম্ভবত পাঠকের চাহিদাও এসব রচনার ক্ষেত্রে তেমন জোরালো কিছু নয়। সেক্ষেত্রে ‘ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাই’ তথা চাহিদা ও সরবরাহের প্রসঙ্গটি বিচার্য কি না সেটিও বিবেচ্য। তবে আরো একটি বিষয় গভীরভাবে বিবেচনার যোগ্য হয়ে ওঠে – সমাজের তথা শিক্ষিতজনের কিংবা বিদ্যায়তনিক জগতের মনোযোগটা কি নিরম্বু বিজ্ঞানচর্চার প্রতি তেমন প্রবল হয়ে উঠছে না কিংবা উঠতে পারছে না! এসব প্রশ্ন ভাবনার বিষয় হতে পারে এবং তা আমাদের চিন্তার জগৎ কিংবা মানসগঠনের প্রক্রিয়াকে কতখানি প্রভাবিত করে সেটিও বিবেচনাযোগ্য। কানন পুরকায়স্থের বইটি এসব ভাবনামনকে স্পন্দিত করে, পুরোপুরি আলোড়িত না করলেও।

আলোচ্য বইয়ের চৌত্রিশটি রচনার মধ্যে সাতটি রচনা বিজ্ঞান-প্রসঙ্গ নিয়ে। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানভাবনার বিষয়টি আলাদা করে ধরলে অপর দুটি প্রবন্ধ সরাসরি বিজ্ঞানের ধারণা ও বিজ্ঞান সম্পর্কে বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রচিত। সে-আলোচনায় ‘বিজ্ঞান কী’ এই প্রশ্নটি যেমন স্থান পেয়েছে, তেমনি আইনস্টাইন এবং ফাইনম্যানের চিন্তাভাবনার দিকটিও বিবৃত হয়েছে, যা সমভাবে আকর্ষণীয়। এই বক্তব্যও সেখানে চিন্তাকে উদ্বুদ্ধ করে যে, ‘বিজ্ঞানের একটি ধর্ম হচ্ছে, এটি যুক্তিবাদী চিন্তা করা শেখায়।’ এবং ‘বিজ্ঞানের কোনো বিষয় যদি একজনকে উজ্জীবিত করে, তাহলেই প্রকৃত বিজ্ঞান শেখা হয়। বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞানের প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান শিক্ষা দুইয়ের মূল কাজ।’ কানন পুরকায়স্থ স্বল্প-কলেবর রচনার মাধ্যমেও এসব ভাবনা তাঁর পাঠকদের মনে উসকে দিতে চেয়েছেন বলে মনে হয়।

বইটির আলোচ্য বিষয়ের অপর দুটি অংশ হচ্ছে প্রযুক্তি ও পরিবেশ। প্রযুক্তিবিষয়ক রচনার সংখ্যা ছয় এবং পরিবেশবিষয়ক রচনার সংখ্যা একুশ। পরিবেশ-সম্পর্কিত নানাবিধ তথ্য ও প্রতিবেদন প্রতিনিয়ত আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যমে পেয়ে থাকি এবং তাতে বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের সাধারণ চিন্তামূলক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের অনেকের মধ্যে অন্তত সাময়িকভাবে হলেও তৈরি হয়। এর ফলে পরিবেশ ভাবনা বিষয় হিসেবে আমাদের চিন্তার জগতেও একটি স্থান করে নিয়েছে, যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাধারণ অভিজ্ঞতার বাইরে তার বিস্তার ঘটেনি।

এই বইয়ের লেখকের পরিবেশ-সম্পর্কিত একুশটি রচনা নিঃসন্দেহে পরিবেশ বিষয়ে আমাদের ধারণাগুলোকে আরো গভীর রূপ দেবে এবং অনেক ক্ষেত্রে জানার জগৎটিকেও আরো প্রসারিত করবে, সে-কথা নিঃসংশয়ে বলা যায়। পৃথিবীর নানা দেশে সাম্প্রতিক পরিবেশচিন্তা কী ধরনের সচেতনতামূলক পদক্ষেপ দাবি করছে তাও জানা যায়। সবচেয়ে বড় কথা –  সাম্প্রতিককালে পরিবেশ-বিপর্যয়ের অশনিসংকেত হিসেবে যেসব ঘটনা তাবৎ বিশ্বকে ভাবিত করে চলেছে সেসব বিষয় বা ঘটনা সম্পর্কে নতুনতর ও বিস্তৃততর তথ্য আমরা তাঁর এই রচনাগুলোর মধ্যে কিছুটা পেতে পারি, যা সহজে অধিগত করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়ে উঠবে না।

এ-প্রসঙ্গে বলা যায়, বইটি ধারাবাহিকভাবে ও এক নিশ্বাসে পড়ার মতো নয়। এটি পড়তে হবে বিভিন্নভাবে বিরতি দিয়ে, বিভিন্ন প্রসঙ্গের আলোকে। এবং সম্ভব হলে বারবার। কেবল তা হলেই বোধহয় পরিবেশ প্রসঙ্গের বিভিন্ন বিবেচনা সম্পর্কে আমাদের সাধারণ ধারণাগত ভিত্তির গভীরতা ক্রমশ আরো দৃঢ়মূল হবে এবং সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াসও তাতে ব্যাপকতা লাভ করবে।

বইটির অপর যে-অংশ প্রযুক্তি, তার আওতাধীন ছয়টি রচনাও বেশ আকর্ষণীয় সে-কথা বলতেই হবে। এসব রচনায় সংক্ষিপ্ত পরিসরে হলেও প্রযুক্তিভাবনার তাৎপর্য তুলে ধরার প্রয়াস রয়েছে, যার আবেদন মোটেই  উপেক্ষণীয় নয়। বিশেষত চিন্তাকে সংহত করার ক্ষেত্রেও। ‘আইনস্টাইনের দৃষ্টিতে প্রযুক্তি’ ও ‘ফাইনম্যানের দৃষ্টিতে প্রযুক্তি’ রচনাদ্বয় নতুন দৃষ্টি যোগ করবে বলেও মনে হয়। সার্বিকভাবে বলা যেতে পারে, বিজ্ঞান প্রযুক্তি পরিবেশ বইটি আগ্রহী পাঠকের জানার ও চিন্তার জগৎকে প্রসারিত করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।