কাজী হাসান হাবিব, প্রিয়বন্ধু

নির্জন প্রান্তরের একাকী বৃক্ষের মাথায় ফুলের মতো ফুটে আছে একটুখানি চাঁদ। আর বৃক্ষতলে শুয়ে আছে একাকী এক নারী। প্রকৃতির এই তিন অপার সৌন্দর্য ছোট্ট ক্যানভাসে ধরেছিল কাজী হাসান হাবিব। আমার বন্ধু। ছবিটি আমার ঘরের এমন জায়গায় রাখা আছে, ঘুম ভাঙার পর প্রথম চোখ মেলে হাবিবের সঙ্গে দেখা হয় আমার। ঘুম ভাঙার পর প্রথমেই যে প্রিয় মানুষটির কথা মনে পড়ে সে হাবিব। আমার বন্ধু।

কোনো কোনো বন্ধু স্নেহময় পিতার মতো। জীবনের যাবতীয় জটিলতায় মাথার ওপর ছায়ার মতো হাত রাখে। হাবিব ছিল তেমন। আমার তুচ্ছাতিতুচ্ছ কত বাজে বইয়ের প্রচ্ছদ কী যে মায়ায়, কী যে ভালোবাসায় এঁকে দিয়েছে হাবিব! সেইসব প্রচ্ছদের দিকে তাকালে হাবিবের ভালোবাসার মুখখানি দেখতে পাই। জলে চোখ ভরে আসে। বুকের অনেক ভেতর দিয়ে ফাগুনের উদাসী হাওয়া হা-হা করে বয়ে যায়।

হাবিব ছিল। হাবিব নেই।

কোনো কোনো মানুষ একা পৃথিবীর বেশ অনেকখানি জায়গা দখল করে রাখে। সেই মানুষ চলে গেলে বেশ অনেকখানি জায়গা খালি হয়ে যায়। শূন্যতা এতো প্রকট হয়, সহ্য করা যায় না, হাবিব ছিল তেমন।

হাবিবের সঙ্গে বয়সের বেশ ব্যবধান ছিল আমার। বয়সের ব্যবধানে বন্ধুত্ব আটকায়নি।

আমি ওয়েস্ট জার্মানিতে গেলাম। ফিরে এলাম। ফেরার দিন এয়ারপোর্টে হাবিব আমাকে ঘুসি মেরে বলল, আর যাবেন?

পিঠে হাত দিলে এখনো হাবিবের সেই ঘুসির স্পর্শ পাই। ভালোবেসে এমন করে ঘুসি হাবিব ছাড়া কে মারতে পারে!

হাবিব ছিল। হাবিব নেই।

চোখ বন্ধ করে চোখ খুলে যখন-তখন দেখতে পাই বাইরে চুয়াত্তর-পঁচাত্তর সালের সন্ধ্যা। দৈনিক সংবাদ অফিস। টেবিলে মাথা নিচু করে সাহিত্যপাতার গল্প-কবিতার ইলাস্ট্রেশন করছে হাবিব। আমরা চার বন্ধু – সিরাজুল ইসলাম, ফিরোজ সারোয়ার, মুহাম্মদ জুবায়ের আর আমি হাবিবের টেবিলের সামনে বসে আড্ডা দিচ্ছি। চা আসছে, সিগ্রেট আসছে। কখনো কখনো আসছেন সাহিত্যপাতার সম্পাদক আবুল হাসনাত। হাবিবের কাজ কতদূর এগুলো একঝলক দেখে গেলেন।

হাবিব কবিতা লিখত। আমাদের চাপে ‘পরিস্থিতি’ নামে একটি গল্পও লিখেছিল একবার। হাবিবের প্রথম একজিবিশনের স্যুভেনিরে নিজের সম্পর্কে ছোট্ট একটি লেখা লিখেছিল হাবিব। সেই লেখায় এক অসাধারণ সকালের বর্ণনা ছিল। অনেক বড় শিল্পী না হলে অমন বর্ণনা দেওয়া যায় না।

হাবিবের কথা ভেবে আমার মন চলে যায় সেই সকালে।

হাবিব ছিল। হাবিব নেই।

আমাদের কত সোনালি দিন, রুপোলি উদ্দাম রাত কেটেছে ভালোবাসায়, বন্ধুত্বে। হাবিবের ভালোবাসার সেই সুসময় কে আমায় ফিরিয়ে দেবে।

হাবিব কেন চলে গেল। হাবিব কোথায় চলে গেল। মৃত্যুর মতো নিষ্ঠুর আর কী আছে পৃথিবীতে!

বেশিরভাগ লেখক তাঁর প্রথম বই মা-বাবাকে উৎসর্গ করেন। আমি করেছিলাম চার বন্ধুকে। শীর্ষে ছিল হাবিব।

প্রতিভার বিচারে বন্ধুদের মধ্যে আমি ছিলাম অতিশয় নগণ্য। কতকাল ভালো লেখা মন্দ লেখা বুঝতে পারিনি। চা খেতে খেতে,  সিগ্রেট খেতে খেতে হাবিব আমায় বুঝিয়েছিল, কেন পুতুলনাচের ইতিকথা মহৎ উপন্যাস।

হাবিবের মতো এমন করে কে আমায় সাহিত্য বোঝাবে!

মনে আছে হাবিব একবার মজা করে বলেছিল, ক্যান্সার কিন্তু বেশ অসুখ। কী রকম গালভরা নাম। শুনলে মন ভালো হয়ে যায়। কাউকে বলতেও বেশ লাগে, ভাই আমার ক্যান্সার হয়েছে।

হায় সেই মুহূর্তে কে জানত হাবিবের পছন্দের অসুখটি নিভৃতে এসে বাসা বেঁধেছে হাবিবের শরীরে। যন্ত্রণায় ছিন্নভিন্ন করে হাবিবকে সে ছিনিয়ে নেবে!

হাবিবের সেই মুহূর্তের মুখ আমি মনে করতে চাই না।

এক মনোরম বিকেলে আর্ট কলেজের সামনের নির্জন রাসত্মায় হাবিব আমায় চিৎকার করে ডেকেছিল। সে-পথে গেলে এখনো হাবিবের সেই ডাক ভেসে আসে। ভালোবেসে এমন ডাক হাবিব ছাড়া কে ডাকতে পারে!

হাবিবের মৃত্যুর এতোকাল পর কেন হাবিবকে নিয়ে লিখছি এ-কথা কারো কারো মনে হতে পারে। কিন্তু আমি জানি, প্রতিদিন নিভৃত যতনে কত লেখা হাবিবকে নিয়ে আমি লিখি। সে-লেখা রয়ে যায় মনের ভেতর। মন ছাড়া কেউ তা জানে না।

কোনো কোনো গভীর রাতে ঘুম ভেঙে মনে পড়ে হাবিবের কথা। একবার দিনাজপুরে গিয়েছিলাম আমরা। বাসে হাবিব আর আমি পাশাপাশি বসে আছি। অচেনা প্রান্তর দিয়ে ছুটছে বাস। বহুদূরে প্রান্তরের কাছে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল এক বৃক্ষ। সেই বৃক্ষের দিকে তাকিয়ে হাবিব বলেছিল, নির্জন প্রান্তরের একাকী বৃক্ষ, তুমি কার অপেক্ষায় থাক! আমার মন চলে যায় সেই বৃক্ষের কাছে।

হাবিব, বন্ধু আমার, নির্জন প্রান্তরে একাকী কোন বৃক্ষতলে শুয়ে আছ তুমি!