এগারশ’ বাহাত্তর নম্বর সীমান্ত পিলার

আষাঢ়ের টানা বৃষ্টিতে স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে গোটা পরিবেশ। গতরাতেও গুমোট ছিল আকাশ। সারাদিন সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। রাতে ভালো ঘুম হয়েছে। ভোরে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যাই। মনে মনে বলি, আকাশ জুড়ে বিসত্মার নেওয়া ঘনকালো মেঘের বিশাল চাঁদোয়াটা এক রাতের মাঝে কে সরিয়ে নিয়েছে! এমন ফুরফুরে ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠেই শিশু-সূর্যটা পুবদিগন্ত থেকে চরাচরে ঝলমলে একটা হাসি ছড়িয়ে দিয়েছে। ভাবলাম, এমন একটা সুন্দর সকালই আজ বড় প্রয়োজন।

ময়মনসিংহ জেলা শহরের সাহিত্য অঙ্গনে জাহিদ আলমের প্রবল পদচারণা বেশ আগে থেকেই। শহরের অনেকের সঙ্গেই তার জানাশোনা। তাকে সাথি করে সকালে যাই শহরের গুলকিবাড়ি এলাকায়। কলেজ রোড থেকে গুলকিবাড়ির রাসত্মায় সামান্য এগিয়েই একটি বাসা। জাহিদ আলম গেটে কড়া নাড়ে। অল্পক্ষণের মধ্যেই ভেতর থেকে ছেলেবয়সী একজন লোক এগিয়ে আসে। জাহিদ বলে, তারাভাই বাসায় আছেন?

– জি আছেন। আসুন, ভেতরে এসে বসুন।

এই বলে লোকটা গেট খুলে দেয়। আমরা ভেতরে ঢুকি। বসার ঘরের সোফায় আমাদের বসতে দেওয়া হয়। লোকটা ভেতরে ঢুকে যায়। তারপর মাত্র ক-মিনিট। ভেতর থেকে বসার ঘরের পর্দা সরিয়ে প্রবেশ করেন আমাদের কাঙ্ক্ষিত মানুষটি। জাহিদ দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে হাত মেলায়। আমিও জাহিদকে অনুসরণ করলাম। লোকটা জাহিদের পূর্বপরিচিত। তাই তাকে প্রশ্ন করে বলে, কী ব্যাপার! হঠাৎ করে এমন সকালবেলায় …?

জাহিদ আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বলে, তিনি আমার বন্ধুমানুষ। তার একটা প্রয়োজনে কোনো ধরনের যোগাযোগ না করেই সোজা আপনার বাসায় চলে এলাম।

তখন পরিচয় দিয়ে বললাম, নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা থানা থেকে এসেছি। ওই থানার সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত লেঙ্গুরা হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক আমি। নাম আহমেদ শাহাবুদ্দিন। আগামী ২৬ জুলাই নাজিরপুর যুদ্ধদিবস এবং সাতজন শহিদ মুক্তিযোদ্ধার স্মরণ সমাবেশ-সংক্রান্ত যে-অনুষ্ঠান লেঙ্গুরা হাইস্কুলে হবে, সে-উপলক্ষে আমাদের স্কুল থেকে একটা স্মরণিকা প্রকাশ করতে চাই।

– বেশ তো, ভালো উদ্যোগ আপনাদের। শুনে খুশি হলাম।

– প্রতিবছরই তো আমাদের স্কুলচত্বরে স্মরণ-সমাবেশ হয়। আলোচনা অনুষ্ঠানে শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ করা হয়। জাতীয় প্রচারমাধ্যমগুলোতেও প্রচার করা হয়। এমনকি আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমগুলোতে কখনো এ-সংক্রান্ত সংবাদ প্রচার করা হয়ে থাকে।

– জি।

– জেলার মূল প্রশাসনের ব্যক্তিবর্গসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে একাত্তরের ওই যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত লোকজনও এ-অনুষ্ঠানে আসেন। আসেন জেলা ও থানা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গও। সেসব কথা আমার চেয়ে আপনি আরো ভালো জানেন।

– হ্যাঁ। আমিও তো আমাদের লোকজনসহ প্রতিবছর সে- অনুষ্ঠানে যাই।

– জি। আমি জানি। তবে নানা কারণে আপনার সঙ্গে এতদিন আমার পরিচয় হয়ে ওঠেনি বলে আমি দুঃখিত। প্রতিবছর অনুষ্ঠানের আলোচনা থেকে শুনে আমাদের স্কুলের ছেলেমেয়েরা জানে যে, নাজিরপুরে একটা ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছিল। সে-যুদ্ধে সাতজন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হয়েছিলেন। ছেলেমেয়েরা বিচ্ছিন্নভাবে এসব তথ্য জানলেও প্রকৃত যুদ্ধটা কীভাবে হয়েছিল তা কিন্তু কারো জানা নেই। এলাকার কারো প্রকৃত ধারণা না থাকায় আমরা ছেলেমেয়েদের এ- সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানাতে পারি না। যতটুকু শুনেছি, আপনিই তো ওই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

– হ্যাঁ দিয়েছিলাম।

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলেন। তখন আগ্রহভরে বলি, প্রকৃত ঘটনাটা আপনার কাছ থেকে জেনে স্মরণিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে চাচ্ছি আমরা। যে-রচনাটা ওই এলাকায় একটা লিখিত দলিল হিসেবে থাকবে। পরবর্তী প্রজন্ম যেন এ-স্মরণিকার মাধ্যমে ওই মহৎ ঘটনার সঠিক ইতিহাস জানতে পারে। আপনিও নাকি ওই যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন?

– হ্যাঁ। এই – এই যে দেখুন, এখানে আমার কণ্ঠার কাছেই গলায় বিদ্ধ হয়ে গুলিটা পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়।

সেদিনের সেই ভয়াবহ যুদ্ধের নায়ক কোম্পানি কমান্ডার তাঁর গায়ের জামাটা সরিয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থানটা আমাদের দেখালেন। ভয়ানক দাগটা দেখে চমকে উঠলাম আমি। মনে হলো যুদ্ধাহতের এ-ক্ষতচিহ্নটা যেন এদেশের বিমূর্ত এক মানচিত্র। এই মুক্তিযোদ্ধাও যেন সর্বক্ষণ এই মানচিত্রটি বয়ে বেড়ান। লোকটার প্রতি শ্রদ্ধায় আপনা-আপনিই আমার মাথা নত হয়ে আসে। তাই সবিনয়ে বললাম, এবার ওই যুদ্ধের প্রকৃত ঘটনাটা দয়া করে বলবেন কি!

– হ্যাঁ বলছি।

এই বলে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার খুলে বলতে শুরু করেন। তিনি বলেন, চৈতন্যের প্রগাঢ় শৈলীতে আজো দীপ্যমান হয়ে ওঠে সেই ছাবিবশে জুলাইয়ের কথা। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে যখন দাঁড়াই, তখনই চোখে পড়ে কণ্ঠনালির কাছে দিয়ে গলা বিদীর্ণ করে যে-গুলিটা আমাকে বিদ্ধ করেছিল, সে-চিহ্নটা। আর ওই চিহ্নটা চোখে পড়লেই যাপিত জীবনের রূঢ় বাস্তবতার মধ্যেও আমি আমার বিশ্বাস ফিরে পাই। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠে অতীত-স্মৃতি-কথামালা।

হ্যাঁ, সেটা আমার জীবনে এক অবিনাশী স্মৃতি হয়ে আছে। সেই স্মৃতি শুধু আমার জীবনের অংশই নয়, ক্রমে তা সর্বজনীনতা লাভ করে এখন কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। যার জন্য ভেতরের তাগিদ অনুভব করে আপনিও সুদূর কলমাকান্দা থেকে প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য ছুটে এসেছেন।

তারপর সেদিনের সেই কোম্পানি কমান্ডার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের যে-লোমহর্ষক কাহিনিটা বললেন তা হলো এই –

একাত্তরের পঁচিশ জুলাই নির্ভরযোগ্য সূত্রে শত্রম্নপক্ষের একটা সংবাদ জানতে পারেন। সংবাদটা হলো  – দুর্গাপুর থানা থেকে পাকিসত্মানি হানাদার বাহিনীর রসদবাহী একটা দল নাজিরপুর বাজার হয়ে পাশের কলমাকান্দা থানায় যাবে। শত্রম্নবাহিনীর এ-রসদবাহী দলটাকে মাঝপথে অর্থাৎ নাজিরপুর বাজারে বাধা দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযাযী তাঁর নেতৃত্বাধীন দল যুদ্ধের প্রস্ত্ততি নেয়। কোম্পানিরই কিছু লোক তখন বিভিন্ন লক্ষ্যে আঘাত হানার জন্য চলে গেছেন নানা স্থানে। ফলে স্বল্পসংখ্যক লোকবল নিয়েই শত্রম্নসেনার মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নেন কোম্পানি কমান্ডার। স্বল্পসংখ্যক লোকবলই আবার তিনটি দলে ভাগ হয়ে যায়। প্রথম দলটি পস্ন­vটুন কমান্ডার আবদুল গনির নেতৃত্বে নাজিরপুর বাজারের পশ্চিমদিকে অবস্থান নেয়। তাঁদের ওপর দায়িত্ব হলো, পশ্চিমদিকের দুর্গাপুর থেকে অগ্রসরমান শত্রম্নসেনাদের বাধা দেওয়া। পুবদিকের কলমাকান্দা থেকে শত্রম্নসেনা এলে তাদের বাধা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় সেকশন কমান্ডার রহমত উলস্ন­vহর ওপর। রহমত উল্লাহ তাঁর দল নিয়ে রামপুর বাজারের পুবদিকে অবস্থান নেন।

 

দুই

স্ট্রাইকিং গ্রম্নপের নেতৃত্ব নেন কোম্পানি কমান্ডার নিজেই। তিনি তাঁর দল নিয়ে অবস্থান নেন নাজিরপুর বাজারের উত্তরে কাছারি মসজিদ- সংলগ্ন পুকুরপাড়ে। সঙ্গে ছিলেন বেপরোয়া একদল টগবগে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা। সামনাসামনি যুদ্ধের অভিজ্ঞতা এসব নব্য তরুণের তেমন একটা ছিল না। অল্প কদিনের গেরিলা ট্রেনিং নিয়েছে কেবল এরা। স্বল্প সময়ের ওই ট্রেনিং সম্বল করেই ওরা শত্রম্নর মোকাবিলা করতে এসেছে। দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য দামাল ছেলেগুলোর প্রত্যয়ী মনে তখন সে কী অনিরুদ্ধ উদ্যমের উচ্ছ্বাস!

পঁচিশ জুলাই মধ্যরাত থেকেই অ্যামবুশে যায় অদম্য মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি ক্ষুদে দল। কিন্তু না, গভীর রাত থেকে ভোর অবধি শত্রম্নসেনাদের কোনো উপস্থিতি লক্ষ করা যায়নি। কাটে একটি বিনিদ্র রাত। ফলে ভোরবেলায় কোম্পানি কমান্ডার অ্যামবুশ তুলে নেন। অনিদ্রায় ক্ষুধা পায় বেশি। সঙ্গেই নাজিরপুর বাজার। দলের সদস্যরা সবাই নাজিরপুর বাজারে গিয়ে নিশ্চিন্তে চিড়া-মুড়ির নাশতা করছে। বাজারে পুব ও পশ্চিম দিকে অবস্থান নেওয়া দুটি দলও কোম্পানি কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ না করেই অ্যামবুশ তুলে ভোরবেলাতেই চলে যায়। ফলে নাজিরপুর বাজারের দলটি সংগত কারণেই অরক্ষিত হয়ে পড়ে।

সেদিন একাত্তরের ছাবিবশ জুলাই। সময় অনুমান সকাল নয়টা। যদিও বর্ষাকাল, তবু সেদিন শ্রাবণের আকাশে তেমন মেঘ ছিল না। দর্পিত সূর্যটা মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে আকাশের সিঁড়ি বেয়ে ক্রমশ ওপরে উঠছে। চিড়া-মুড়ির নাশতাপর্ব শেষ হয়েছে মাত্র। কমান্ডার ভাবছেন, সত্বর সবাইকে ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেবেন। কিন্তু না, সে-নির্দেশ দেওয়ার সময় আর পাওয়া যায়নি। ততক্ষণে পুব-পশ্চিম দুদিক থেকেই শত্রম্নবাহিনীর দুটি দল একযোগে হামলা চালিয়ে তাদের ঘিরে ফেলে। ভয়াবহ কাউন্টার অ্যাটাকে পড়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওই খুদে দলটি। দুদিক থেকেই শুরু হয় দুর্ধর্ষ আক্রমণ। একেবারে কাছে থেকে শত্রম্নদের ভয়ানক গোলাবর্ষণের মোকাবেলায় অপ্রস্ত্তত মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমটায় হকচকিত হয়ে যান। অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা মুক্তিযোদ্ধারা শত্রম্নবাহিনীর দিক চিহ্নিত করতে না পেরে বড় বেকায়দায় পড়ে যান। তবু শেষবিন্দু রক্তের প্রতিশ্রম্নতি নিয়ে কোম্পানি কমান্ডার তাঁর পনেরো সদস্যের দলকে তাৎক্ষণিক কাউন্টার অ্যাটাক মোকাবেলা করার নির্দেশ দেন। অমনি দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার অমিত চেতনায় জ্বলে ওঠেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্য, হঠাৎ সেস্ন­vগান তোলেন – ‘জয় বাংলা।’ সঙ্গে সঙ্গে সহযোদ্ধারা সমস্বরে নাজিরপুরের মাটি প্রকম্পিত করে জবাব দেন, ‘জয় বাংলা।’

ঘটনার আকস্মিকতায় একপর্যায়ে অগ্রসরমান সেই বেপরোয়া শত্রম্নসেনারা হাতের নাগালে এসে মুক্তিবাহিনীর দুজন সদস্য রহিম খান ও শিশির রক্ষিতকে ধরে ফেলার দূরত্বে পৌঁছে যায়। রহিম খান দেখতে পান, তাঁর সামনের সহযোদ্ধা শিশির রক্ষিতকে পাকিসত্মানি সেনারা ধরে ফেলছে প্রায়। অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত অবস্থায় কালবিলম্ব না করে রহিম খান তাঁর স্টেনগান তাক করে ব্রাশফায়ার করেন। আকস্মিক বুদ্ধিদীপ্ত সে-ঘটনায় শত্রম্নদের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ার কবল থেকে অল্পের জন্য ওরা বেঁচে যায়। আর তখনই দুঃসাহসী জামাল তাঁর এলএমজি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রম্নসেনাদের ওপর। শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ। কাউন্টার অ্যাটাকে পড়ে সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটার কোনো সুযোগ ছিল না। তাই শেষ বিন্দু রক্তের অঙ্গীকার নিয়ে সবাই প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছিলেন। জামালের দুঃসাহসিক এলএমজি পরিচালনায় ল-ভ- হয়ে যাচ্ছিল শত্রম্নসেনাদের সব পরিকল্পনা। তাই জামাল তাদের টার্গেটে পড়ে যান। হঠাৎ শত্রম্নদের একটি গুলি এসে এলএমজিম্যান জামালকে বিদ্ধ করে। শুধুমাত্র ‘আহ্’ করে দু-অক্ষরের ছোট্ট একটা শব্দের প্রগাঢ় আর্তনাদে জামাল জানান দিয়ে যান পনেরো সদস্যের গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য ঝরে গেছেন। জামাল ঝরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্ভাগ্যের দরজা এক ঝটকায় খুলে যায়।

এলএমজিটা নিষ্ক্রিয় হওয়ার পরপরই শত্রম্নসেনারা তাদের আক্রমণ প্রচণ্ড থেকে প্রচণ্ডতর করে তোলে। সুযোগ বুঝে দুই ইঞ্চি মর্টারের ভয়াবহ শেল নিক্ষেপ শুরু করে। প্রচণ্ড শেলের নির্মম আঘাত আর বিস্ফোরণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধার তরতাজা বুক। এমনিভাবে সেদিন এক-এক করে ঝরে যেতে থাকেন পনেরো সদস্যের মুক্তিযোদ্ধাদলের দামাল ছেলেরা। তাঁদের দৃঢ় আত্মবল আর অমিত চেতনায় পণ ছিল যে, দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে জীবন দেবেন, তবু পিছু হটবেন না কিংবা করবেন না আত্মসমর্পণ।

এদিকে শত্রম্নসেনাদের অত্যাধুনিক ও ভারী আগ্নেয়াস্ত্রের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ আর মাটি-কাঁপানো লাগাতার মর্টার শেলের আঘাতে তছনছ হয়ে যাচ্ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধব্যূহ। অবস্থা বেগতিক দেখে জীবন বাজি রেখেই ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্যে একজন সদস্য রিইনফোর্সমেন্টের জন্য খবর নিয়ে চলে যান মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে। দুপুর গড়ায়, তবু হালকা অস্ত্র দিয়েই যুদ্ধ চালিয়ে যান ওঁরা। দুপুরের তীব্র রোদের মধ্যে বীরদর্পে তখনো লড়ে যাচ্ছেন অবশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু কতক্ষণ আর টেকা যায়! দুদিক থেকে প্রচণ্ড আক্রমণে বিপর্যন্ত ও কোণঠাসা হয়ে পড়েন ওঁরা। তার ওপর ভয়াবহ শেলের আঘাতে একপর্যায়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের পরস্পরের যোগাযোগ। কে কোথায় শহিদ হয়ে পড়ে আছেন কিংবা মারাত্মক আহত হয়ে কাতরাচ্ছেন অথবা কজনই বা তখন পর্যন্ত বেঁচে আছেন – সেসব তথ্য জানার কোনো জো রইল না কারো। কিংবা কারো পক্ষে খোঁজ নেওয়ারও অবকাশ ছিল না। তবু বিক্ষিপ্তভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে কদাচিৎ রাইফেল কিংবা স্টেনগানের গোলার আওয়াজ জানান দিচ্ছিল যে, শত্রম্নবাহিনীর প্রচণ্ডতম আক্রমণের মুখে তখনো ওঁরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাননি।

ভয়াবহ সে-যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে একপর্যায়ে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন যে-কজন মুক্তিযোদ্ধা তখনো বেঁচে আছেন, পৃথকভাবে প্রত্যেকের চোখে-মুখে নেমে আসে বিপন্নতা আর অসহায়ত্বের ছাপ। যদিও সেকশন কমান্ডার রহমতউলস্ন­vহ এবং আবদুল গনির নেতৃত্বে ততক্ষণে দূর থেকে গুলি ছুড়ে রিইনফোর্সমেন্টের সমর্থন দিচ্ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি দল। কিন্তু তখন নাজিরপুরে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধা দলের প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার পর্যায়ে। এমন বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে হঠাৎ করে শত্রম্নসেনার একটি গুলি এসে কোম্পানি কমান্ডারের কণ্ঠনালি বিদীর্ণ করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ফিনকি দিয়ে ছোটে রক্ত। ছোপ ছোপ রক্তে রঞ্জিত হয় সবুজ ঘাস ও মাটি।

এদিকে সপক্ষের গুলির জবাবও একেবারে কমে আসে। যুদ্ধাহত কমান্ডার তখন ধরে নেন যে, তিনিই বুঝি তাদের দলের সর্বশেষ আহত ব্যক্তি। বাকি সাথি-যোদ্ধারা সবাই হয়তো শহিদ হয়েছেন, নতুবা কেউ কেউ তাঁর মতো আহত হয়ে জীবনযন্ত্রণায় মৃত্যুর প্রহর গুনে চলেছেন। তখন নাজিরপুরের যুদ্ধক্ষেত্র যেন তাঁদের জন্য সাক্ষাৎ মৃত্যুপুরী। তাই জীবন বাঁচানোর শেষ চেষ্টায় কোম্পানি কমান্ডার পাশের একটা ধানক্ষেতে আত্মগোপন করেন। বাওয়া ধানক্ষেতে তখন একহাঁটু পানি। পানির সঙ্গে পালস্ন­v দিয়ে বেড়ে উঠছিল বাওয়া ধানের গাছগুলো। নাজিরপুরের মুক্তিযোদ্ধারা নীরব হয়ে গেলেও তাঁদের সাহায্যে অগ্রসরমান মুক্তিযোদ্ধারা তখন বেশ সরবে এগোচ্ছেন। এভাবে যুদ্ধে যুদ্ধেই দুপুর গড়িয়ে যায়। বিকেলের আঙিনায় ঢলে পড়েও স্পর্ধিত সূর্যটা বেশ দাপট দেখিয়ে চলেছে। দুপুরের প্রচণ্ড রোদে ধানক্ষেতের পানি বেশ গরম হয়ে উঠেছে। যুদ্ধাহত কোম্পানি কমান্ডারের ঘাড় থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে তখনো। প্রাণ রক্ষায় ধানক্ষেতের হাঁটুপানিতে শরীর ডুবিয়ে ধীরে ধীরে এগোন কমান্ডার। গরম পানিতে আকণ্ঠ ডুবে হামাগুড়ি দিয়ে এগোনোর সময় তেতে-ওঠা পানি ক্ষতস্থানে যেন গরম সেক বা দাওয়াইয়ের কাজ করছিল। যখমের তীব্র যন্ত্রণায় গরম পানিটাকে তাই বেশ আরামদায়ক মনে হচ্ছিল।

শত্রম্নসেনার চোখ ফাঁকি দিয়ে সেদিন জলাপূর্ণ সেই বিসত্মৃত ধানক্ষেতে বিলি কেটে সরীসৃপের মতো ধীরে ধীরে এগোন কমান্ডার। নাজিরপুর বাজারের সোজা উত্তরদিকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে লেঙ্গুরা বাজার। নাজিরপুর-লেঙ্গুরা বাজার সংযোগকারী রাসত্মার পশ্চিমপাশে বাওয়া ধানের বিশাল মাঠ। কাঁচা সড়কটির পুবপাশেই অদূরে শত্রম্নসেনাদের অবস্থান। যুদ্ধাহত কমান্ডার দুরুদুরু বুকে বাওয়া ধানক্ষেত পার হয়ে একটা কান্দাজমিতে পৌঁছেন। পতিত কান্দাজমিতে রোপা আমন ধানের চারা লাগানোর জন্য তখনো চাষাবাদ করা হয়নি। চ্যাপচেপা পানি জমিটায়। হালকা ঘাসপূর্ণ কান্দা ভূমিখ-টি দিয়ে খুব সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছেন কমান্ডার। বাওয়া ধানক্ষেতের আড়ালে হওয়ায় দূর থেকে সহজে চোখে পড়ার কথা নয়। তবু সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে স্টেনগান হাতে নিয়ে ক্রলিং করে কান্দাজমিটি পার হচ্ছেন যখন, একটি সরু অথচ উঁচু আইল তখন বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আইলটি টপকাতে গেলে শত্রম্নসেনার নজরে পড়ার ভয়। বর্ষার বৃষ্টিভেজা আইলের নরম মাটি। কখনো দুহাতের আঙুলে, আবার কখনো স্টেনগানের গোড়ার আঘাতে নরম মাটি খুঁড়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে আইলটা ভাঙেন। তারপর সামনে এগিয়ে যান। মারাত্মকভাবে গুলিবিদ্ধ হয়েও তিনি দেড় কিংবা দুই কিলোমিটার পথ হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছেন।

ওদিকে সবেমাত্র কোম্পানি কমান্ডার মাহবুবের নেতৃত্বাধীন এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা পুব এলাকায় যুদ্ধে যাওয়ার পথে কমান্ডার তারার ক্যাম্পে রাতযাপনের জন্য অবস্থান নিয়েছেন। তখন ছাবিবশে জুলাইয়ের শেষ বিকেল। মিত্র বাহিনীর এক ক্যাপ্টেন তৎক্ষণাৎ ওয়াকিটকিতে সংবাদ পেয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসে মাহবুব কোম্পানির লোকদের তারা কোম্পানির লোকদের উদ্ধার অভিযানে যাওয়ার নির্দেশ দেন। নির্দেশ দিতে গিয়ে হিন্দি ভাষায় তিনি যা বলেন, তার অর্থ দাঁড়ায় এই – তোমরা যে মুক্তিযোদ্ধা যেখানে যেভাবে আছো এ-মুহূর্তে তৈরি হয়ে নাও! তোমাদের ভাইয়ের রক্ত বাংলার মাটিতে ঢেলে দিয়েছে।

এ-কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রংরা ক্যাম্পে বিশ্রামরত মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের রক্তে যেন আগুন ধরে যায়। প্রজ্বলিত উত্তেজনাপ্রবাহ ছড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে। মুহূর্তের মধ্যে সবাই রণসাজে সজ্জিত হয়ে এগোতে থাকেন যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে। ইতোমধ্যে নাজিরপুর রণাঙ্গন থেকে যে-দুঃসংবাদ আসে, তা শুনে বিষাদের ছায়া নামে সীমান্ত এলাকাজুড়ে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, শত্রম্নসেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে শহিদ হয়েছেন – জামাল, নুরুজ্জামান, দ্বিজেন্দ্র, ইয়ার মাহমুদ, ভবতোষ, আজিজ, ফজলুসহ সাত মুক্তিযোদ্ধা। কালামিয়া নামে একজন স্থানীয় যুবকও নাকি এ-যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। তার ওপর কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল হক তারার নিখোঁজ হওয়ার খবর শোকাকুল পরিবেশকে আরো উৎকণ্ঠাময় করে তোলে। বিপর্যস্ত যুদ্ধক্ষেত্রে শহিদ ভাইদের লাশ পড়ে আছে, অথচ তাঁদের লাশ এখনো উদ্ধার করা যায়নি – তা কি মেনে নেওয়া যায়? এ-খবর শোনার পর মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা কি নীরব থাকতে পারেন? তাই শহিদ ভাইদের লাশ উদ্ধারের জন্য তাঁদের জোর তৎপরতা চলতে থাকে। তাঁদের দ্বিতীয় তৎপরতা হলো – কামান্ডার তারাকে খুঁজে বের করা। তাঁকে ঘিরে কত রকম প্রশ্ন নানাজনের মনে দানা বাঁধতে থাকে। কেউ কেউ ভাবেন, শত্রম্নসেনার হাতে ধরা পড়েননি তো কোম্পানি কমান্ডার!

ওদিকে যখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে, তখন ঘাড়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়েও যুদ্ধাহত কোম্পানি কমান্ডার দীর্ঘ ফসলি মাঠ পাড়ি দিয়ে একটি পোড়াবাড়িতে গিয়ে পৌঁছেন। আঙিনায় এসেই বুঝতে পারেন জমিদারবাড়ির আদলে যেন তৈরি বাড়িটি। মনে হচ্ছিল মাত্র কদিন আগে শত্রম্নসেনা এবং তাদের দোসররা পুড়িয়ে দিয়েছে এটি। পোড়াবাড়িতে আসার পর তাঁর প্রচণ্ড পিপাসা পায়। তাই চারদিকে তাকিয়ে পানির উৎস  খোঁজেন। আশপাশে চাপকল খুঁজে না পেয়ে তাকান পুকুরের দিকে। নির্জন বাড়ির আঙিনায় শান-বাঁধানো পুকুরঘাটটি পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে তখন। বহুকষ্টে কঁকিয়ে কঁকিয়ে ঘাটে নামেন কোম্পানি কমান্ডার। অতঃপর প্রাণভরে পানি পান করেন। পিপাসা মিটলে শ্রান্তি নেমে আসে আহত শরীরে। তাই ঘাটে বসেই খানিকটা বিশ্রাম নেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, পানি পান করে জীবন ফিরে পেয়েছেন। তারপর যতটুকু জীবনীশক্তি অবশিষ্ট ছিল তা দিয়েই ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকেন। ধীরে ধীরে তাঁর মাথাটা সমতলভূমি উপচে যখন ওপরে ওঠে, তখন সতর্কতার সঙ্গে স্টেনগানটা শক্ত করে ধরে চারদিকে একপলক দেখে নেন। না, কোথাও কোনো জনমানুষের সাড়াশব্দ নেই। পতিত বাড়িতে একটি ভুতুড়ে আবহ। শত্রম্ন-এলাকায় এমন একটা পরিবেশই তাঁর কাম্য। জোছনাগলা সন্ধে থেকেই বাড়িটিতে সুনসান নীরবতা। পুকুরপাড় থেকে যখন ক্রমশ বাড়িটির ভেতরের দিকে এগোচ্ছেন, তখনই চোখে পড়ে একটি ঘরের দরজা খোলা। খোলা ওই দরজাপথে ঘরে ঢুকে দেখতে পান পায়া কোন্দানো একটা তক্তপোশ বা চৌকি পাতা ঘরে। তবে ওপরে চাল নেই। চালহীন পরিত্যক্ত বৈঠকঘরের ওই চৌকিতে কোনো বিছানা নেই। ওই ঘরে ঢোকার আগেই লক্ষ করেছিলেন, পুকুরপাড়ে একটা খড়ের পালা অবহেলায় দাঁড়িয়ে আছে। উপস্থিতবুদ্ধি জাগে মনে। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে তিনি খড়ের পালার কাছে যান। ঘাড়টাকে কাত করে খড়ের পালা থেকে মুঠি মুঠি খড় খসান কমান্ডার। তারপর দু-হাতে জাপটে ধরে একগাদা খড় নিয়ে আবার ঘরে প্রবেশ করেন। চৌকির ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়ে খড়ের বিছানায় শুয়ে পড়েন। তাতেও বিপত্তি দেখা দেয় ঘাড়ের ওই ভয়ানক জখমটায়। ক্ষত স্থানের তীব্র ব্যথা নিয়ে বালিশের মতো নরম কিছু একটা ছাড়া শুয়েও স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। চালহীন ঘরে অবাধে প্রবেশাধিকার ছিল চাঁদের আলোর। অসহনীয় যন্ত্রণায় ভুগেও ওই আলোয় ঘরের ভেতরে চারদিক তাকিয়ে নিরীক্ষণ করেন তিনি। হঠাৎ চোখে পড়ে আগুনে পোড়া বালিশ ও তোশকের ছেঁড়া কাপড় এবং সেগুলোর ভেতর থেকে নির্গত তুলা ঘরের এখানে-সেখানে নাড়িভুঁড়ির মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। সেগুলো মাটি থেকে তুলে এনে দলা পাকিয়ে বালিশের মতো করে নিয়ে ফের শুয়ে পড়েন। এমন বিপন্নাবস্থায় যুদ্ধাহত তারা মনে মনে বলেন, হায় – হায় রে দুর্ভাগ্য! যে-সময় প্রয়োজন চিকিৎসা আর সেবা, সে-সময় কি না নিজেকেই নিজের সেবায় ব্রতী হতে হয়! এভাবে শোবার পর সারাদিনের রক্তক্ষরণ আর দীর্ঘক্ষণ পানিতে অবস্থান করায় শরীরে নেমে আসে রাজ্যের ক্লান্তি। কিছুক্ষণের মধ্যেই কেমন যেন শীত শীত অনুভূত হতে থাকে। তাই আগুনে আধা পোড়ানো তোশকের অংশটিই কষ্ট করে তুলে এনে গায়ে জড়ান।

রাত যত বাড়ে, তার সঙ্গে পালস্ন­v দিয়ে শুরু হয় ঘাড়ের অসহ্য ব্যথা। চিড়িক দিয়ে হামলা করা তীব্র ব্যথায় দিশেহারা হয়ে যান, তবু নিরাপত্তার জন্য ব্যথা প্রকাশক ‘আহ্’ শব্দটুকুও সাধ্যমতো কষ্ট করে অবদমন করে রাখতে হচ্ছে। তাতেও কি শরীর মানে! শরীরে শুরু হয় প্রচণ্ড কাঁপুনি। সেই কাঁপুনির চোটে দাঁতে দাঁত ঠেকছিল বারবার। অসহনীয় যন্ত্রণায় দাঁত কামড়ে সহ্য করে জেগেছিলেন অনেক রাত অবধি। এত ব্যথার কবলে পড়লে কি দুচোখে ঘুম আসে! প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে কখন যে চেতনা হারিয়ে ফেলেন কিংবা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন, সে-খেয়াল ছিল না তাঁর।

ওদিকে কোম্পানি কমান্ডার মাহবুবের নেতৃত্বাধীন বাহিনী যখন মাঠে নামে, তখন সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল চাপে শেষ পর্যন্ত রাতেই লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হয় পাকিসত্মানি হানাদার বাহিনীর দল। ছাবিবশ জুলাই রাত পর্যন্ত দীর্ঘক্ষণের যুদ্ধে শত্রম্নসেনাদেরও কম মূল্য দিতে হয়নি। কারণ, ওদের পক্ষেও হতাহতের সংখ্যা একেবারে কম ছিল না।

 

তিন

পরদিন সাতাশ জুলাই ভোরবেলা। মারাত্মক আহত কোম্পানি কমান্ডার পোড়াবাড়ির উদোম বৈঠকঘরে মড়ার মতো পড়ে আছেন। ভাগ্যিস রাতে বৃষ্টি হয়নি। যুদ্ধে আহত হওয়ার পর দীর্ঘক্ষণ চলে যায়। বিনা চিকিৎসায় লোকটা কি বেঁচে আছে, না মরে গেছে, নাকি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, অথবা গভীর ঘুমের ঘোরে কি আচ্ছন্ন হয়ে আছে; তা বোঝার উপায় নেই। তবে বাস্তবতা হলো, তিনি অত্যন্ত করুণভাবে পড়ে আছেন পোড়াবাড়িতে।

ভোরবেলায় ওই গাঁয়ের এক বৃদ্ধ দম্পতি এ-বাড়িতে এসে আবিষ্কার করেন যে, গতকালের যুদ্ধে কে যেন একজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বৈঠকঘরে মরে পড়ে আছেন। টগবগে তরুণ লোকটিকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে বৃদ্ধ দম্পতি আহাজারি শুরু করেন। বৃদ্ধা একটি দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলেন, আহা রে, না জানি কোন মায়ের বুক খালি কইরা পোলাডা এইহানে পইড়া মইরা আছে। তার মা-বাপ এ-খবরটা পর্যন্ত জানতে পারল না!

এ-কথা বলে সহমর্মিতায় বৃদ্ধা কেঁদেই ফেলেন। তাঁকে সমর্থন করে বৃদ্ধ বলেন, হ গো জবেদার মা, তুমি ঠিকই কইছ। আমি তো অহন আর একটা চিন্তায় পইড়া গেলাম।

– অত কী চিন্তা আবার আপনের?

– দেখতাছ না, সারা গেরামে একটা মানুষও নাই। কওছেন দেহি, কারে লইয়া আমি অহন এই লাশ টানাটানি করি। কারে লইয়া বা দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করি!

বৃদ্ধ দম্পতির এসব আলাপচারিতা শুনে কোম্পানি কমান্ডার তারার চেতনা ফিরে আসে। খানিকক্ষণ তাঁদের আলাপ-আলোচনা শুনে বুঝতে পারেন যে তাঁকে ঘিরেই ওঁরা আহাজারি করছেন। চেতনা ফেরার সঙ্গে সঙ্গে ঘাড়ের ব্যথাটা চিড়িক দিয়ে অসহনীয় অবস্থায় পৌঁছে। তবু বাঁচার একটা আশা তাঁর চোখেমুখে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। তাই তো স্টেনগানটা শক্ত হাতে ধরে বৃদ্ধ দম্পতির উদ্দেশে আর্তস্বরে বলেন, এখানে কে আছেন বাবা! একটু এদিকে আসবেন!

মৃতভাবাপন্ন লোকটার গলায় স্বর শুনে অবাক বিস্ময়ে তাঁর কাছে এগিয়ে যান ওঁরা। বেশ উৎফুলস্ন­ হয়ে বৃদ্ধ বলেন, তাইলে আপনি বাঁইচা আছেন বাবা!

– হ্যাঁ বাবা। আলস্ন­vহ এখনো আমাকে বাঁচায়া রাখছেন। আমার প্রতি যদি আপনাদের এতটুকু দয়া হয়ে থাকে, তাহলে আমাকে বাঁচানোর জন্য একটু চেষ্টা করেন বাবা!

– কন কী বাজান! আপনেরে বাঁচানোর চেষ্টা করবাম মানে, আগে কন দেহি কী করণ লাগব?

– বুঝতেই পারছেন, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমার আহত হওয়ার সংবাদটা দয়া করে আপনি আমাদের রংরা
ক্যাম্পে পৌঁঝে দিবেন। ক্যাম্পে গিয়ে বলবেন, হাফপ্যান্ট পরা স্টেনগান-হাতে আপনাদের একজন লোক গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছেন।

– ঠিক আছে বাজান, আপনে কোনো চিন্তা কইরেন না। আমি এহনই খবর লইয়া যাইতাছি। তাছাড়া অন্য কোনো ডরও নাই। পাঞ্জাবিরা সব ভোররাইতের আগেই পলাইছে।

এ-কথা বলেই বৃদ্ধ রওনা হন। তখন তাঁকে ডেকে কমান্ডার তারা বলেন, সাবধান চাচা! আমার ব্যাপারে রাসত্মায় কারো কাছে মুখ খুলবেন না।

– জি, আইচ্ছা।

যাওয়ার আগে বৃদ্ধার উদ্দশে বৃদ্ধ বলেন, আমি তাইলে যাই। ফিইরা না আসা পর্যন্ত বাজানরে তুমি দেইখ্যা রাখবা জবেদার মা।

আকাশে তখন দুরন্ত মেঘের আনাগোনা। থেকে থেকে বইছে দমকা বাতাস। তাই সহসা বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। তখন নাজিরপুর বাজার থেকে উত্তরদিকের লেঙ্গুরা বাজারের রাসত্মা ধরে শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন শোকার্ত সহযোদ্ধারা। বাঁশের চাঙারিতে একটি করে লাশ দুজন মানুষ কাঁধে বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে এগোচ্ছে লাশের মিছিল। তাঁদের দুপাশে হেঁটে এগোচ্ছেন অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধারা। কারো মুখে কোনো রা নেই। থেকে থেকে কারো মুখে ডুকরে-ওঠা অবদমিত কান্নার খ-াংশ উচ্চারিত হয় কখনো।

এ-মিছিলে জনসাধারণের তেমন কোনো সদস্য নেই। কেবল একজন দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ নির্বিকার হেঁটে যাচ্ছেন। তাঁর হাঁটায় বেশ তাড়া। নির্ভয়ে লাশের পাশ দিয়ে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছেন লোকটি। বৃদ্ধকে সন্দেহ করে একজন মুক্তিযোদ্ধা বলে ওঠেন, এই চাচা! কোথায় যাচ্ছেন আপনি?

– সামনে, ওই লেঙ্গুরায় …

– আপনার বাড়ি কোথায়?

– এই গাঁয়েই।

লোকটার এসব কথা শুনে সেকশন কমান্ডার রহমতউল্লাহ জিজ্ঞেস করেন, লেঙ্গুরায় কোথায় যাবেন আপনি?

– এক্কেবারে পাহাড়ের কাছে, বলতে গেলে পাহাড়েই।

বৃদ্ধকে রাজাকার কিংবা শত্রম্নর চর বলে সন্দেহ হয়। তাই রুক্ষ মেজাজে ফের সেকশন কমান্ডার জিজ্ঞেস করেন, পাহাড়ে কোথায় কী জন্য যাবেন আপনি?

রাসত্মায় মুখ খুলতে নিষেধ করা হয়েছে। তাই আমতা আমতা করে বলেন, আমি মানে – আমি …

বৃদ্ধকে এভাবে আমতা আমতা করতে দেখে সেকশন কমান্ডারের সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। আর অমনি বৃদ্ধকে খপ করে ধরেই কাছে টেনে আনেন। অতঃপর ভয়ানক রাগে জ্বলে উঠে তার পিঠে আগ্নেয়াস্ত্রের গোড়া দিয়ে আঘাত করে বলেন, এ রাজাকারের বাচ্চা রাজাকার! সত্যি করে বল, কোথায় যাচ্ছিস তুই?

ধাতব অস্ত্রের মারাত্মক আঘাতে বৃদ্ধ হঠাৎ আর্তচিৎকার করে মাটিতে ঢলে পড়েন। আর মারমুখো সেকশন কমান্ডার আবার যখন মারতে উদ্যত হন, তখন ফের আঘাতের ভয়ে বৃদ্ধ কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমি কোনো রাজাকার না বাজান। এই গাঁয়েরই মানুষ। আপনেরা যদি মুক্তিবাহিনী হইয়া থাকেন, তাইলে আপনেরার একখান খবর নিয়া যাইবার চাইছিলাম; কিন্তু আর বুঝি যাওয়া হইল না।

– আমাদের খবর মানে!

– হাফপ্যান্ট পরা স্টেনগানওয়ালা একজন লোক গুলি খাইয়া পইড়া আছেন। মরে মরে অবস্থা …

– কোথায়, চলেন দেখি …

এই বলে কমান্ডার রহমতউলস্ন­vহ আরো কজন সহযোদ্ধাসহ আহত বৃদ্ধের দুই বাহুতে ধরে নিয়ে রওনা হন। বৃদ্ধ তাঁদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যান সেই পোড়াবাড়িতে। গুরুতর আহত কোম্পানি কমান্ডার তারার কাছেই তখনো বসে আছেন বৃদ্ধা। হঠাৎ চোখ পড়ে বাড়ির আঙিনায়। আহত বৃদ্ধকে দুই বাহু ধরে কজন অস্ত্রধারী লোককে পুকুরের পাড়ের পথে এদিকে নিয়ে আসতে দেখেন। দৃশ্যটা দেখেই বৃদ্ধা উদ্বেগে আঁতকে উঠে সামনে এগোন। অনেকটা কাছে গিয়ে বলেন, কী হইছে গো আপনের, এমনে কুঁহাইতেছেন কেরে?

– না-না, কিছুই অয় নাই আমার। বাজান ভালো আছে তো!

– হ, আগের মতোই আছে।

ততক্ষণে হেঁটে হেঁটে ওঁরা যেই না বৈঠকঘরের খোলা দরজাপথে আসেন, অমনি সেকশন কমান্ডার রহমতউলস্ন­vহ কোম্পানি কমান্ডার তারাকে একনজর দেখেই ছুটে যান। তাঁকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, আমাদের ভুলের জন্যই আপনাদের এত চড়া মূল্য দিতে হলো। আমরা আপনার চিন্তায় অস্থির। অথচ আপনি এখানে …!  বাকি সদস্যরাও ততক্ষণে তারাকে জড়িয়ে ধরলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। কোম্পানি কমান্ডার তারা তখন বলেন, আহ্! আর পার-ছি-না, ব্যথায় মরে যাচ্ছি। তোমরা শিগগির আমাকে নিয়ে চলো।

রহমতউল্লাহ তখন সহযোদ্ধাদের নিয়ে চৌকির দুটো তক্তা মুহূর্তের মধ্যেই পৃথক করে ফেলেন। তারপর বৃদ্ধলোকটির সহযোগিতায় চাঙারি বেঁধে কোম্পানি কমান্ডারকে নিয়ে রওনা হন। কমান্ডার তারা তখন বৃদ্ধ দম্পতির কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে বলেন, দোয়া করবেন চাচা। চাচিও আমার জন্য দোয়া করবেন। বাঁচি না মরি, বলা তো যায় না। যদি বেঁচে থাকি আজীবন আপনাদের কথা মনে থাকবে।

সেকশন কমান্ডার রহমতউলস্ন­vহ তখন অনুতাপ আর অপরাধবোধের চাপে বৃদ্ধের হাত চেপে ধরে বলেন, চাচা! আপনি আমাদের এতো উপকার করলেন! অথচ আমি ভুল বুঝে আপনাকে এমন আঘাত করলাম! আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিয়েন চাচা! নতুবা আমি শান্তি পাব না।

জবাবে বৃদ্ধ বলে, না না; আ – আমি কিছু মনে করি নাই বাজান – আমি কিছুই মনে করি নাই। সবচাইতে বড় কথা হইল – এই বাজানরে বাঁচানোর চেষ্টাডা তো করতে পারলাম। এতেই আমরা খুশি। বাজানরা, তোমরা যাও – মালিক তোমরার সহায় …

শেষ কথাটা আর বলা হয়ে ওঠেনি। গলা জড়িয়ে আসে তাঁর। দুচোখ নোনা জলে ভিজে যায়। সন্তানতুল্য এসব দামাল ছেলেকে বিদায় দিতে গিয়ে তাঁর চোখে অঝোরে জল এসেছিল, নাকি পিঠে আগ্নেয়াস্ত্রের প্রচণ্ড আঘাতজনিত যন্ত্রণায় আপনা-আপনিই চোখে জল আসছিল, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। আহত কোম্পানি কমান্ডারকে চাঙারিতে বহন করে ওঁরা নিয়ে চললেন। পোড়াবাড়িতে তখনো দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ দম্পতি।

 

 

চার

সাত শহিদের লাশের বহরের পেছনে পেছনেই মুক্তিযোদ্ধারা কাঁধে বহন করে নিয়ে চললেন মারাত্মক আহত কোম্পানি কমান্ডারকে। সেদিন সাতাশে জুলাইয়ের বিকেলবেলা। ততক্ষণে সব লাশ এসে পৌঁছেছে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। আহত কোম্পানি কমান্ডারকে দ্রম্নত পাঠানো হয় চিকিৎসালয়ে। মুহূর্তের মধ্যেই শোকের ছায়া নেমে আসে পাহাড়ের ঢালু বুক, শরণার্থী শিবির এবং কাছের পাদদেশ এলাকায়।

লেঙ্গুরা সীমান্তফাঁড়ির উত্তরে গারো পাহাড়ের পদপ্রান্ত ছুঁয়ে রঘুনাথপুর নামক স্থান। সীমান্তঘেঁষা সে-স্থানেই কবর খননের কাজে লেগে যান অনেক মুক্তিযোদ্ধা। কবর খনন করেন হাফিজুর রহমান, জহিরুল হক হিরা, আজিজুল হক, আবদুর রহিম, তৌহিদ, সোনা মিয়াসহ বিশ-পঁচিশজন সদস্য। কোদাল-খন্তা-শাবল চালানো হয় বর্ষার নরম মাটির গভীরে। গণেশ্বরী নদীর কিনার বলে পানি ওঠেনি কবরে। শোক ও সন্ধ্যার আবহে পরিবেশ ক্রমশ ভারী হয়ে ওঠে। শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ বিদায়ের সময় জানাজা পড়তে এগিয়ে আসেন আবদুর জলিল ব্যানার্জি।

কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুরা ইউনিয়নের উত্তরে বড়ই মনোমুগ্ধকর স্থানে ১১৭২নং সীমান্ত পিলার। এ-পিলারের সঙ্গেই চিরনিদ্রায় পাশাপাশি শুয়ে আছেন সাতজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। সম্মুখযুদ্ধে মরণপণ লড়াই করে শহিদ হলেও ওঁরা কোনো মরণোত্তর পদক কিংবা খেতাব পাননি। তবে ওই এলাকার মানুষের কাছে চির অমস্নান হয়ে আছে তাঁদের বীরত্বগাথা। এখন প্রতিবছর ২৬ জুলাই সেখানে যুদ্ধদিবস এবং বীর শহিদদের স্মরণে স্মরণ-সমাবেশ হয়। সেদিনকার যুদ্ধাহত কোম্পানি কমান্ডারও সে-সমাবেশে যোগ দেন। স্মৃতিচারণ করেন অতীতের গৌরবগাথার। আজো তাঁর স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠে সেই বৃদ্ধ দম্পতি এবং সাত শহিদের বিবর্ণ চেনা মুখগুলো। সেসব কথা মনে হলে আজো তিনি আনমনা হয়ে যান। বিষণ্ণমনে একাকী কী যেন ভাবেন। কী যে দুঃখবোধে সন্ধ্যাবেলায় নির্মল আকাশের দিকে চেয়ে থাকেন। দূরের আকাশে লাখ লাখ তারার দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে কখনো হয়তোবা কল্পলোকে চলে যান। ভাবেন, স্বাধীনতাযুদ্ধে আত্মোৎসর্গ করা লাখ লাখ প্রাণ যেন দূরের আকাশে লাখ তারা হয়ে ফুটে আছে। সেই সাতটি তারাও যেন মিশে আছে অনেক তারার মাঝে।