ছায়াবাজি

বলা নেই কওয়া নেই দুম করে অনন্তপ্রসাদ মরে গেল।

ভোরবেলায় একে নিয়ে হাওয়া খেতে বেরোয় শিবু। খোলা হাওয়া পেলে বেশ তাগড়া দেখতে অনন্তপ্রসাদ দুরন্ত ঘোড়ার মতো ছুটে চলতে চায়। পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে শিবু ক্লান্ত হয়ে পড়ে। হাঁপ ধরে যায় রীতিমতো; তবু কোনোদিন নিয়মের ব্যত্যয় হয় না ওর।

যদিও এর বাহারি নাম অনন্তপ্রসাদ, আদতে এটি একটি নেড়িকুকুর। গ্রামেগঞ্জের রাস্তাঘাটে এখনো সবাই এসব কুকুর-বিড়াল থেকে নিজের গা বাঁচিয়ে আড়চোখে তাকাতেই অভ্যস্ত। কোনো কারণে এদের সংস্পর্শে এলে কেউ কেউ তো রীতিমতো বিরক্ত হয়। কারো কারো নাকি গা পর্যন্ত ঘিনঘিন করে। কোনো কোনো হিন্দু-পরিবারে এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে স্নান সেরে তারপর ঘরে ঢুকতে দেওয়া হয়, এমনই শুচিবাই অনেকের।

কিন্তু শিবুর বেলায় ব্যাপারটা অন্যরকম। ওর ভাষ্য অনুযায়ী, কুকুরটা হলো বছরচারেক আগে ওর মৃত পিতার জন্মান্তরের রূপ। একদিন সকালে ওদের উঠোনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা জামগাছের তলায় জবুথবু হয়ে বসে ছিল ওটা। শিবুকে দেখে ঠ্যাং উঁচু করে জামগাছের গুঁড়ি বরাবর হিসু ঝেড়ে দৌড়ে পালাতে চেয়েছিল। তখন কুকুরটার বয়স কম। চনমনে অস্থিরতা চলনে-বলনে। শিবু কুকুরটার চোখের দিকে তাকাল বারকয়। ভোরবেলার হিমেল হাওয়া আর কুয়াশার ভেতর ওর স্পষ্ট মনে হলো, কেউ ওকে ফিসফিস করে বলছে, ‘কী রে, অহনতরি আমারে চিনছ নাই? আমি অনন্ত, অনন্তপ্রসাদ।’ সঙ্গে সঙ্গে লোমগুলো সজারুর কাঁটা হয়ে গেল শিবুর। বুকের ভেতরে শুকনো খরখরে একটা পাতা উড়তে উড়তে যেন কুকুরটার পিঠে গিয়ে পড়ল। সে ছুটে গিয়ে দুহাতে সেটিকে বুকের সঙ্গে আগলে ধরে ঝরাপাতার সেই ব্যথা অনুভব করতে থাকে; মুখে বলে, ‘বাবা, বাবা আমার। বাবা গো।’

একই উঠোনের দক্ষিণ পাশটায় সাইফুলদের দোচালা বাড়ি। উঠোনে কোনো সীমানাপ্রাচীর নেই। শুধু একটা জামগাছ অকথিত সীমানা হয়ে আছে দুই বাড়ির মাঝখানে।

দাওয়ায় বসে সাইফুল নিমের দাঁতন দিয়ে দাঁত মাজছিল আয়েশ করে। ওর দৃষ্টি শিবুর ওপর। শিবু ওর সময়বয়সী। কেউই এখনো তিরিশ পেরোয়নি। অকালে লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়ার পর দুজনই বাপ-দাদার গুড়-চিড়ার আদি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। বাজারে যায়-আসে নিয়মিত। যেহেতু শিবুর বাবা নেই, বড় ছেলে হিসেবে সংসারের পুরো দায়িত্ব ওর ওপর। মা ও দুই ভাইবোন নিয়ে ওদের সংসার। অপরদিকে, সাইফুলের আববা শক্তসমর্থ পুরুষ। একটাই ছেলে, তিন কন্যার পর। কম বয়সে মেয়েদের ভালো ঘর দেখে বিয়ে হয়ে গেলেও একমাত্র ছেলে সাইফুল পিতার চোখে এক অকর্মণ্য-অপদার্থ সন্তান। ছেলের ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই – তার ধারণা এমনই। এজন্য ওর কোনো দায়দায়িত্ব নেই সংসারে। ইচ্ছে হলে সে দোকানে বসে; নইলে এখানে-সেখানে বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কিছুটা বাউন্ডুলে টাইপ।

শিবুর কাছে এসে সে বলল, ‘কী রে, কী অইছে?’

‘আমার বাবা আইছে।’

‘দূর বেক্কল। কুত্তা আবার কারো বাপ অয়নি?’ হাসতে হাসতে সে মাটিতে বসে পড়ে। মুখে দেওয়া নিমের দাঁতন ছিটকে পড়ে মাটির ওপর।

রাগ করে শিবু উত্তর দেয়, ‘তরা বিশ্বাস করছ না, আমরা করি। পরজন্মে আমরা বিশ্বাস করি। এইডা আর কেউ না, আমার বাবা অনন্তপ্রসাদ। বাবা, আমার বাবা গো।’ বলতে বলতে কুকুরটাকে কোলে করে সে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে।

পেছনে সাইফুলের হাসি আর থামে না। বিদ্রূপ হয়ে খোঁচাতে থাকে শিবুকে।

বাড়ির ভেতর ঢুকে সে পাকা দাওয়ার ওপর ছেড়ে দেয় কুকুরটিকে। মুখে আদর করে চুকচুক শব্দ তোলে।

সারদা তখনো মশারির তলায়। ঘরের ভেতর একটা ভাদাইমা কুত্তাকে এদিক-সেদিক কুঁইকুঁই করতে দেখে আঁতকে ওঠে। সন্ত্রস্ত স্বরে বলে ওঠে, ‘হায় ভগবান, এই সক্কালে কুত্তাডা ক্যামনে ঢুকল ঘরের ভিতরে? যাহ্। ভাগ।’ মশারির ভেতর থেকে পশুটিকে যুগপৎ হাত ও কণ্ঠস্বর দিয়ে ভাগাতে চাইছে সারদা।

মায়ের মুখে এ-কথা শুনে দৌড়ে আসে শিবু। কুকুর আর মশারির মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘মা, কারে কিতা কও? জানো চোহের সামনে যে ঘুরতাছে হেইডা কেডা?’

ঘুমজড়ানো সারদার চোখে অপার বিস্ময়। ঘুরঘুর করা কুকুরটার ওপর অপলক দৃষ্টি। আপনমনেই উত্তর দেয়, ‘কেডা আবার? ভাদাইমা একটা কুত্তা, সুযোগ পাইয়া ঢুইকা পড়ছে ঘরের ভিতরে। কিতা কছ তুই?’ মায়ের দেখাদেখি ছোটো ভাইবোনগুলো সজাগ হয়ে বিছানার ওপর উঠে বসে। ওদের চোখে-মুখেও জিগা গাছের আঠার মতো লেগে থাকে কৌতূহল ও অফুরান বিস্ময়।

‘মা, এইডা কুত্তা না। অনন্তপ্রসাদ। আমরার বাবা। বাবা, বাবা গো। চিনবার পারতাছ না কেরে?’ বলে সে অতিযত্নে কুকুরটাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে থাকে। একটু পরে রান্নাঘর থেকে থালায় ভাত-তরকারি বেড়ে জলভরা কাঁসরের গেলাসসহ খেতে দেয়।

খাবার পেয়ে কদিনের ক্ষুধার্ত কুকুররূপী অনন্তপ্রসাদ পরম আনন্দে কুঁইকুঁই শব্দ তুলে খেতে শুরু করে দেয়। তা দেখে আবেগের বলক ওঠে অনন্তপ্রসাদের বড় ছেলে শিবপ্রসাদের বুকের তলায়।

মশারির ভেতর শিবুর মায়ের মুখে কোনো রা নেই। কিছুতেই নোংরা এই কুকুরটার সঙ্গে নিজের স্বামীকে সে মেলাতে পারছে না। বারবার হোঁচট খাচ্ছে ওর কল্পনাশক্তি। লোকটা জীবদ্দশায় নোংরা ছিল। শীতের সময় চার-পাঁচদিন স্নান না করে কাটিয়ে দিত। দাদ-পাঁচড়াও ছিল হাতের তলায় আর কুঁচকির চিপায়। কোনো কারণে লুঙ্গি ঢিলা হলেই একটা উটকো দুর্গন্ধ সারদার নাকে যেত। এ নিয়ে হাজারবার ঝগড়া বেধেছে স্বামী-স্ত্রীতে। তাই বলে একটা কুকুর সারদার স্বামীত্বের অধিকার নিয়ে ওর দিকে পিটপিট করা চোখে এগিয়ে এলে কীভাবে তা মানে? ছিঃ।

পরক্ষণে সাদা-সরল মনের সারদার মনে হয়, স্বামী চিনতে স্ত্রীর ভুল হলেও বাবাকে ঠিকই তার সন্তান চিনতে ভুল করবে না – এ-বিশ্বাস থেকে ধীরে ধীরে সারদা আত্মসমর্পণ করে ছেলের কাছে।

একসময় শিবুর দেখাদেখি সারদাও কুকুরটাকে নিয়ে আদিখ্যেতায় মেতে ওঠে। ভাবতে শুরু করে, ওর অকালমৃত পতিদেবতা অনন্তপ্রসাদ ফিরে এসেছে কুকুরের রূপ ধরে; প্রথম-প্রথম কিঞ্চিৎ সংকোচ ও লজ্জাবোধ পেয়ে বসলেও কদিন বাদে টের পায়, কুকুররূপী পতিদেবতা অনন্তপ্রসাদকে ভালো-মন্দ খাওয়াতে বেশ ভালোই লাগে ওর। আগের মতোই একরাশ আনন্দ ও তৃপ্তি খুঁজে পায় এসব কাজে। শুধু স্বামীর সঙ্গে ঝগড়াটা মন দিয়ে করতে পারে না পূর্বেকার মতো। যার কাছে কোনোকিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই, তার সঙ্গে অকারণ ঝগড়া বাধাবে কী দিয়ে?

একসময় সারদার ওপর অনন্তপ্রসাদের ছিল প্রচণ্ড আধিপত্য; তা মানা কিংবা না-মানা নিয়ে ঝগড়া বাধত দুজনার মাঝে। এখন এক অবলা-অবোধ কুকুর ওর স্বামী হয়ে ঘুরঘুর করছে চোখের সামনে। কেবল বিশ্বাসের জোরে এই উৎকট প্রাণীটিকে স্বামী বলে মেনে নিচ্ছে সে; খাওয়া দিলে ওটা খাবে; ঘুমাতে দিলে ঘুমাবে। নিয়মিত অভ্যাসের মতো সমস্ত কাজ হচ্ছে-ঘটছে। অথচ এর সঙ্গে কোনোরূপ সংযোগ নেই সারদার; না মানসিক, না বাক্যালাপের। তবু একদা জীবিত অনন্তপ্রসাদের ছায়া কুকুরটাকে সম্মান করতে ওদের বাধ্য করছে। এর অস্তিত্ব যেন ঘরে রাখা শালগ্রাম শিলার মতো; মানলে, নইলে কিছু নয়।

এভাবেই ধীরে ধীরে কুকুর অনন্তপ্রসাদ হয়ে ওঠে এ-পরিবারের নিঃশব্দ এক অভিভাবক। এখন থেকে পরিবারের যতসব মাঙ্গলিক কাজকর্ম, সব শুরু হয় অনন্তপ্রসাদের পা ছুঁয়ে প্রণাম সারার পর। কদিনের ভেতর কুকুরটির রোমশ শরীরে লাল-নীল পোশাক চমকায়; বাজারের ভালো খলিফা দিয়ে দুই সেট পোশাক বানানো হয়েছে। পূজা-আচ্চার দিন ধুতি-পাঞ্জাবিও বাদ যায় না। মাঝে মাঝে শিবুর বাবার চশমাটা পরিয়ে দেওয়া হয় কুকুরটার চোখে। দেখতে না পেয়ে ঝাড়া মেরে চশমাটা অনন্তপ্রসাদ ফেলে দিলে শিবু আদুরে গলায় বলে ওঠে, ‘বাবা, তুমি আগেও চশমাডা চোহে দিতা চাইতা না। একটু পইরা থাহ, বাবা আমার। চোহের জন্য ভালা।’

ছেলের মুখে আদর-মাখানো বাবা ডাক শুনে সারদা আঁচল দিয়ে চোখের জল মোছে অভ্যাসবশে। যেন চেখের সামনে কোনো কুকুর নয়, নিজের কাঠখোট্টা স্বামীকেই দেখতে পাচ্ছে সে।

কদিন পর পাড়া-প্রতিবেশী সবাই দেখতে পেল, সারদা সধবাদের মতো লালপাড় শাড়ি চড়িয়েছে গায়ে। বিধবাদের মতো বছরের পর বছর আর শাক-পাতা চিবোতে হচ্ছে না। তাতে সারদার বেশ ভালোই লাগছে। নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাচ্ছে সে, ঠিক আগের মতো ।

এই আচানক কা- দেখতে ওদের বাড়িতে প্রায়ই ভিড় জমাচ্ছে লোকজন। স্বধর্মাচারী গ্রাম্য মানুষগুলোর চোখেমুখে এক অদ্ভুত সরল বিশ্বাস দ্যুতি হয়ে ঝিলিক মারছে। সংক্রামক রোগের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে মন থেকে মনে; মগজ থেকে মগজে। হয়তো বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় কেউ কেউ এখনো দুলছে, কিন্তু এর সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। বলার মতো কিছু নয়।

শিবুর বাবার বয়সী এক জ্ঞাতিভাই কুকুরটার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলছে, ‘চিনছ নিও? আমি তুমার জ্ঞাতিভাই। কত খেলছি একলগে। হুট কইরা গেলা মইরা। আবার ফিইরা আইলা কুত্তা অইয়া। ভাই, কুত্তা জীবনডা ক্যামন? রক্ষা, তুমার ফুতে তুমারে চিন্যা ফালছে। ভালা থাক রে ভাই।’ বলে আকাশের দিকে ঘোলা চোখ স্থির করে জোড়হাতে প্রণাম ঠোকে কপালে।

আরো এক বয়স্ক জ্ঞাতিভাই বলল, ‘আমারও যাওনের সময় অইছে। তুই তো তবু কুত্তা অওনে জানডা বাঁচছে। আমার কপালে না জানি কী আছে। আর যাই হউক, তেইল্যাচুরা য্যান না অই।’ বলে এবার আকাশের দিকে তাকিয়ে নয়, সোজাসুজি প্রণাম সারে কুকুরের পা ছুঁয়ে। সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটা ঘেউ করে শব্দ করে ওঠে। উত্তরে জ্ঞাতিভাই বলে, ‘রাগিছ নারে ভাই। রাগিছ না। তর মুহের ভাষা বুঝনের সাধ্য আমার নাই। মাফ করিছ।’

একদিন অনন্তপ্রসাদের এক দূরসম্পর্কের মামা এসে উপস্থিত। বয়সের ভারে জবুথবু মানুষটা প্রথমেই এসে দুশোটি টাকা কুকুরটার পায়ের কাছে রেখে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে, ‘তর দোকান থেইক্যা চুরি করছিলাম একবার। আমারে দোকানে বসাইয়া মুততে গেছিলি গাঙের ফাড়ে। এই ফাঁকে ট্যাকাটা হাতাইয়া নিছিলাম। অভাবে সওআব নষ্ট। আমারে মাফ করিস ভাগিনা।’ কুকুরটা আঁচড় বসায় টাকার নোটে। শিবু – ‘কী করো বাবা, দাদু তার ভুল বুঝতে পারছে। গ্রহণ করো।’ বলে সে নিজেই টাকাটা সবার সামনে পকেটে পুরে নেয়।

এভাবেই চলতে থাকে। শিবু তার সদ্য পাওয়া বাবাকে ছাড়া চোখে পথ দেখে না। মাঝে মাঝে বাবাকে নিয়ে সে দোকানে যায়। একপাশে একে শিকল দিয়ে বেঁধে নির্বিঘ্নে দোকানদারি করে সে; খুশিমনে বিড়বিড় করে বলে, ‘দোকানদারিডা তুমার মতো অয় তো, বাবা?’

‘ঘেউ।’

‘বুজলাম না।’

‘ঘেউ, ঘেউ।’

শিবু হাসে। ওর হাসির ভেতর তৃপ্তি লুকিয়ে থাকে। মনে হয় মাথার ওপর বিশাল একটা গাছ হয়ে ছায়া জোগাচ্ছে এই অনন্তপ্রসাদ। বাবার মুখের ঘেউ-ঘেউ ধ্বনি যেন কঠিন সেই অভিভাবকত্বেরই প্রতিধ্বনি।

কিন্তু মাঝে মাঝে শিবুর মেজাজটা যায় বিগড়ে। সাইফুলের মতো ফাজিল টাইপের অজানা-অচেনা ছেলে-ছোকরা এসে ওকে জ্বালায় খুব।

দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে প্রশ্ন করে, ‘এ্যাইডা নি আফনের আববা? আমরার সামনে একটু আববা ডাহেন না, ভাইজান?’ শিবু বুঝতে পারে, ওরা ওকে নিয়ে বিটলামি করছে। মুখ ফিরিয়ে সে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। কোনো উত্তর দেয় না। তবু গায়ে পড়ে কেউ কেউ বলে ওঠে, ‘আফনের বাফ কুত্তা? হি-হি-হি।’

এসব যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে এখন আর অনন্তপ্রসাদকে নিয়ে শিবু খুব একটা বাইরে বেরোতে চায় না। তবে বেঁচে থাকতে অনন্তপ্রসাদের প্রাতঃভ্রমণের অভ্যেস ছিল নিয়মিত। সব যেমন-তেমন, সকালে নিয়মমতো হাঁটা আর পেট পরিষ্কার না থাকলে তার নিত্য মাথা গরম; কাকে কী বলবে তার ঠিক-ঠিকানা নেই।

সেই সূত্র ধরে ভোরবেলায় সবার অগোচরে বাবাকে নিয়ে গাঙপাড় থেকে হেঁটে আসে শিবু। এ-সময় অনন্তপ্রসাদের আনন্দ আর ধরে না। তরতর করে ছুটে বেড়াতে চায় এদিক-সেদিক। মুক্তপ্রান্তর আর মুক্তবায়ু পেয়ে সে কেবল ছুটতেই চায়। শিকল ধরে টানতে গিয়ে হাতে ব্যথা ধরে যায় ওর। তবু অনন্তপ্রসাদের ছোটাছুটি থামে না। ফেরার পথে মলত্যাগের ব্যাপারটাও সেরে নেয়। শিবু তখন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে; যথাযথভাবে বাবার প্রাতঃকৃত্যাদি সম্পন্ন হওয়ায় মনে মনে একধরনের তৃপ্তি বোধ করে। নিজের ভেতর যোগ্য সন্তানের অস্তিত্ব বারবার করে সুড়সুড়ি দেয়।

এভাবে সবই ঠিকঠাক চলছিল। আগের মতো আর চাপ নেই। অযথা শোরগোল নেই কোথাও। সব কেমন থিতিয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে, সব এখন গা-সওয়া সবার।

শিবুরা হাঁপ ছেড়ে যেন বাঁচল। অনন্তপ্রসাদকে নিয়ে কোনো হুজ্জোতি হোক – তা মোটেই কাম্য নয় ওদের; নিজেদের বিশ্বাস নিয়ে নিজেরা বাঁচবে – তাতে কার কী বলার আছে? শিবু ভাবে।

কিন্তু হঠাৎ করেই স্থানীয় হিন্দু পরিষদের নেতৃবৃন্দ ক্ষেপে ওঠে ওর ওপর। প্রথম কথা, সে ঠিকঠাক নিয়মিত মন্দিরের চাঁদা দিতে চায় না। কর্তাব্যক্তিরা যা দাবি করছে, শিবু তা মানছে না। আগে অনন্তপ্রসাদের দোকান থেকে চিড়া-গুড় পর্যন্ত মন্দিরে পৌঁছে যেত। নগদ টাকাকড়ি তো আছেই; কিন্তু শিবপ্রসাদের আমলে তা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এখন চেয়েচিন্তেও কিছু আর মিলছে না। এই নিয়ে তীব্র অসমেত্মাষ আর ক্ষোভ জমা হয়ে রয়েছে নেতাদের ভেতর। তা-ই ভাষা পায় কুকুররূপী অনন্তপ্রসাদের ঘটনায়।

তারা কজন একজোট হয়ে শিবুকে ডেকে পাঠায় মন্দির-চত্বরে। বেসরকারি এক কলেজের জোড়া ভ্রম্নওয়ালা অধ্যাপক কপালে লম্বা তিলক কেটে মন্দিরের প্রধান হয়ে সেখানে বসে রয়েছেন। তাকে ঘিরে রয়েছেন স্থানীয় গণ্যমান্য বেশ কজন গম্ভীরমুখো বয়স্ক মানুষ। শিবুর কাছে এদের কাঁসর-পিতলের পুরনো তৈজসপত্রের মতো লাগছে; বিশেষ পার্বণ বা দিন ছাড়া তেমন কাজে লাগে না।

শিবুকে পেয়ে বেসরকারি কলেজের অধ্যাপক নিতাইবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এইডা কী শুরু করছ, শিবু?’

‘কুনডা?’

‘এই যে কুত্তারে বাপ বানাইয়া নাডাগুডা করতাছ? এগুলান কি? অনন্তপ্রসাদ আছিল মন্দিরের একনিষ্ঠ ভক্ত। যহন যেডা চাইছি, মুক্তহস্তে তিনি তা দিছেন মন্দিরের নামে। তার নামে তার পোলা অইয়া তুমি কুত্তা পুষতেছ, ছিঃ।’ নাকের ওপর চশমা তুলে তীক্ষন কণ্ঠে প্রশ্ন করেন তিনি।

‘সমইস্যা কী? আমি আমার মরা বাপেরে যদি অবলা পশুর মাঝে দরশন করি তো কার কী? পরজন্মে আমরা বিশ্বাস করি, করি না কন? গঙ্গা নদীরে আমরা মা কই, অসুবিধা?’ এসএসসি ফেল শিবু জ্ঞান ঝরায় সবার সামনে।

‘বিষয়টারে তুমি খেলো করে ফেলেছ। ঢি-ঢি পড়ে গেছে চাইরপাশে। তুমি এইসব থামাও।’ কঠিন হয় অধিপতির গলা।

‘সম্ভব না।’

‘তাইলে পুলিশে খবর দিমু।’ ভয় দেখায় ওরা।

‘দ্যান গা। আমি কারো অনিষ্ট করতাছি না। আমার বাপেরে আপনেরার কতায় ছাড়তে পারুম না।’

‘তুই একঘরে হইবি। পাঁচশো ট্যাকা জরিমানা অইব কইলাম।’ মুরবিব এক সভ্য চেঁচিয়ে ওঠে।

‘অইলে অইব।’ ঠোঁট ওলটায় শিবু।

‘বুইজা দ্যাখ। তর বয়স কম।’ অন্য একজন কিছুটা নরম গলায় ওকে বোঝাতে চায়।

‘বয়স কম অইলেও আপন বাপরে ছাড়তে পারুম না। আপনেরা ছাড়বেন?’

‘এইডা তর বাপ না। নেড়িকুত্তা।’ আরেকজন চেঁচায়।

‘অপনেরার কাছে কুত্তা। আমার কাছে অনন্তপ্রসাদ।’ শিবু উত্তর দেয়।

‘চুপ বেয়াদব। একজন ধার্মিক মানুষরে কুত্তা বানাইয়া অফমান করতে পারছ না তুই। সন্তান নামের কলঙ্ক তুই। নরকেও তর জাগা অইব না।’ ধমকে ওঠেন অধ্যাপক নিতাই চক্রবর্তী। তার চোখ লাল করমচা।

‘আপনেরা আমারে খাওয়ান-পরান না। অত লাল চোখ দেহায়েন না।’ বলতে বলতে সে সভা ছেড়ে বেরিয়ে আসে। রাগে গা রি-রি করছে ওর। এমনিতে না খেয়ে থাকলে খবর নেয় না। পারিবারিক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ জানালে পর্যন্ত নাক উঁচু সওদাগরগণ আসতে চায় না। আর এখন এসেছে ধর্ম ফলাতে। গত বছর ইলেকশনের সময় ওদের দোকানে লুটপাট চলল। হাউমাউ করে ধর্মীয় নেতাদের জানানো হলো। ওমা, কোনো কথা নেই মুখে। ফিসফিস করে কী যে বলল শিবু বুঝতেও পারল না। আর এখন একেবারে জজসাব – কথা না শুনলে যেন শূলে চড়াবে – এরকম ভাবগতিক। সে এসব পাত্তা না দিয়ে মুখ দিয়ে কেবল একটা শব্দ করল, থুঃ।

এ-ঘটনার কদিনের মাথায় শিবু বিয়ে করে ফেলে। অনন্তপ্রসাদের মৃত্যুর পর থেকে আত্মীয়-পরিজন উঠেপড়ে লেগেছে ঘরে বউ তোলার জন্যে; শিবু নিজেই মত দিচ্ছিল না। বাবাকে কাছে পাওয়ার পর কেন যেন মনে হতে থাকে, এবার সময় হয়েছে সংসারী হওয়ার।

সদ্য বিয়ে করা বউয়ের নাম সুপর্ণা। তাকেও সে বোঝাতে সমর্থ হয়, এ-কুকুরটাই ওর ছদ্মবেশী বাবা। সারদাও সায় দেয় ছেলের
কথায়। ভাইবোন সবাই এখন অনন্তপ্রসাদকে মান্য করে চলে।

পাড়াবাসীদের কেউ শিবুদের বাড়ি বেড়াতে এলে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করে, ‘জেডা ক্যামুন আছে?’

‘ঘুমাইতাছে।’ উত্তর সারদার।

‘শরীলডা ক্যামুন?’

‘আছে একরহম। কদিন ধইরা পেটটা খারাপ আর কী।’ কাজ করতে করতে সারদা উত্তর দেয়। মোদ্দাকথা, অনন্তপ্রসাদ এখন আর কোনো কুকুর নয়, এ-বাড়ির প্রধান অভিভাবক। যার সঙ্গে কোনো প্রতিযোগিতার খেলা নেই, তাকে শ্রদ্ধা-সম্মানের উঁচু বেদিতে বসাতে কেন আপত্তি থাকবে কারো – সারদারও নেই।

এমনকি সবার সবকিছু মাফ করা না গেলেও অনন্তপ্রসাদের যে-কোনো বিটকেলে আচরণ এ-পরিবারের সবাই ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখতে অভ্যস্ত।

একদিন কীর্তনের আসরে হেগে দিলো অনন্তপ্রসাদ। সঙ্গে সঙ্গে সারদা সেগুলো নিজ হাতে কুড়িয়ে পুকুরপাড়ে ফেলে দিয়ে হাত ধুয়ে তারপর আসরে এসে বসল। তবু একটিও বিরূপ মন্তব্য করেনি সে।

এসব দেখেশুনে সুপর্ণারও বিশ্বাস জন্মেছে, এ-কুকুরটিই ওর অদেখা শ্বশুরমশাই অনন্তপ্রসাদ। উঠতে-বসতে সে একে প্রণাম করে। ভালোমন্দ কিছু রান্না হলে সবার আগে এর মুখের সামনে বেড়ে দেয়। কিছু খায়; আবার কিছু ফেলে রাখে।

অনন্তপ্রসাদের শোয়ার জায়গাটাও জাজিম আর ধোয়া চাদরে মোড়ানো। একদিনেই নোংরা হয়ে যায়; তবু সবাই তা মেনে নেয়। মুখে একটাও খারাপ কথা বলে না কেউ। নৈমিত্তিক আচরণের জন্যে জীবিত থাকা অবস্থায় যে-সম্মান পায়নি অনন্তপ্রসাদ, মনে হচ্ছে, কুকুর অনন্তপ্রসাদ এ-বাড়িতে প্রবেশ করার পর তার প্রতি যত্ন-আত্তি ও শ্রদ্ধা-সম্মান অনেকগুণ বেড়ে গেছে পরিবারের মানুষগুলোর।

অথচ পরম শ্রদ্ধেয় এই অনন্তপ্রসাদ আর জীবিত নেই। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর প্রাতঃভ্রমণের জন্যে শিবু তার ঘরে ঢুকেই আঁতকে ওঠে। বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছে নিস্পন্দ অনন্তপ্রসাদ। চারটি পা আকাশের দিকে তাক করা; চোখ স্থির। একঝলক তাকিয়েই চিৎকার দিলো শিবু, ‘মা, বাবা নাই।’

ছুটে আসে সবাই। আশপাশের অনেকেই কান্নার সুর শুনে উঠোনে জমায়েত হতে শুরু করে। এলাকা ছোট – দশ কান হতে সময় লাগে না।

সবার আগে ছুটে আসে সাইফুল। বেশ কবছর ধরে কুকুরটা এ-বাড়িতেই আস্তানা গেড়ে রয়েছে অনন্তপ্রসাদ হয়ে। সেই হিসেবে ওর একধরনের মায়া পড়ে গেছে পশুটার ওপর। এ-ঘটনার তীক্ষন  সমালোচনাকারী হওয়া সত্ত্বেও কেন এখন ওর বুকের ভেতরটা এমন খালি-খালি লাগছে তা সে বুঝতে পারে না। মনে হচ্ছে, চোখের সামনে একজন ছিল, এখন নেই। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কেন হারিয়ে যায় আপনজন? ভাবতেই মনটা ভারি হয়ে ওঠে ওর। নিজের অজান্তে চোখ ভিজে ওঠে।

ওর আববা জুলহাস উদ্দিন অনন্তপ্রসাদের চেয়ে দুই-চার বছরের ছোট হলেও ওদের বন্ধুত্ব শেষদিন পর্যন্ত অটুট ছিল। দুজনে মিলে একই জমি কিনেছে; কিন্তু কখনো সীমানা-পাঁচিল তোলার ইচ্ছে হয়নি কারো। একই ব্যবসা দুজনার – সমস্যা হলে দুজন শলাপরামর্শ করে সমাধান খুঁজে বের করত। জুলহাস নিজে একরোখা মানুষ; মাথায় কোনোকিছু একবার ঢুকে গেলে তা থেকে সহজে বেরোতে পারে না। যেমনটি পারেনি ছেলে সাইফুলের বেলায়; কিছু হলেই একশ আটটা দোষ খুঁজে বের করে ওকে নাজেহাল করতে চাইবে। এজন্য সাইফুলের অন্তরে কষ্টের সীমা-পরিসীমা নেই। তবু মানুষটার প্রতি কখনো শ্রদ্ধা হারায়নি সে।

প্রায় নিরক্ষর এই মানুষটা শুরুর দিকে স্পষ্ট করে একদিন সাইফুলকে বলল, ‘আমরাও তো কতকিছুর ভিতরে শয়তান-ফেরেশতার ছায়া দেহি, দেহি না, ক? শিবু হের হারাইন্যা বাপরে পাইছে অবোধ কুত্তার মইদ্যে। ইডা লইয়া অত উতলা অওনের কি আছে? হারাজীবন মাইনষে ত ছায়ার লগেই থাহে। কুনসময় ছায়াডারে মাথাত তুইলা সেজদা করে। কুনসময় ছায়াডারে পাও দিয়া মাড়াইয়া যায়। যার যেমন মন।’

কথাগুলো সব না বুঝলেও সেই থেকে অনন্তপ্রসাদরূপী কুকরটিকে নিয়ে সাইফুল আর অকারণ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে মেতে ওঠে না। বরং সে কুকুরটাকে একা পেলে প্রায়ই এর ভেতর মানুষের অস্তিত্ব খুঁজতে শুরু করে। নিজেকে এর সঙ্গে মেলাতে গিয়ে কখনো হোঁচট খায়। কখনো বা বিস্মিত হয়। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। তবু একটা টান পড়ে গেছে এর ওপর। একবেলা না দেখলেই সে অস্থির হয়ে ওঠে। সময়-সুযোগ পেলে একা-একা অনেক কথা বলার চেষ্টা করে কুকুরটার সঙ্গে। নিজের কষ্টের কথা সে আর কাউকে না বলতে পারলেও অনন্তপ্রসাদকে বলে আরাম পায়। কেন – তা সে বলতে পারবে না। তবে একটা কিছু যে কুকুরটার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে, তা সে দ্রুত টের পেতে থাকে। সাইফুলের এ বদ্ধমূল বিশ্বাস শিবুর বাবার অস্তিত্বের মতোই পাকাপোক্ত – তাতে ওর মনে কোনোরূপ সন্দেহের অবকাশ নেই।

সেই অনন্তপ্রসাদ আর নেই। শিবুদের পরিবারের সবাই যখন মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে তখন সাইফুল দূরে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। মনে হচ্ছে ওর কোনো এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মারা গেছে। আর ফিরবে না সে। যত ভাবছে তত কষ্ট পাচ্ছে। ভেতর থেকে উথলে উঠতে চাইছে কান্নার রোল।

ভেজা মন আর চোখ নিয়ে উঠোনের মাঝখানে দাঁড়ায় সে। এসময় হিন্দু সম্প্রদায়ের মাথা অধ্যাপক নিতাই চক্রবর্তী এসে দাঁড়ালেন শিবুর সামনে। তার সঙ্গে রয়েছে আরো কজন সঙ্গী-সাথি।

কুকুরটির নিষ্প্রাণ দেহখানি তখন উঠোনের মাঝখানে রাখা। এর ছুঁচালো মুখের সামনে কটি মাছি অবিরাম ভনভন করছে। একে ঘিরে রয়েছে শিবু, ওর ভাইবোন আর মা; মাটিতে আছড়ে পড়ে কেবলি বিলাপ করে কাঁদছে। পরিবেশ বেশ ভারি। চারপাশে গিজগিজ করছে পাড়াবাসী। পুরো এলাকা ভেঙে পড়ছে ওদের আঙিনায়। কৌতূহলের সীমা-পরিসীমা নেই এদের।

এরই ভেতর শিবুদের আত্মীয়-স্বজন মিলে একটি খাটিয়া নিয়ে এসেছে কোত্থেকে যেন। শীতের গাঁদাফুল দিয়ে খাটিয়াটি সাজানো। বাবা অনন্তপ্রসাদকে অন্তিম সাজে সাজানো হচ্ছে। তার অন্তিম যাত্রাটি যাতে জমকালো হয়, সেজন্যে এই আয়োজন।

এর ভেতর ভিড় ঠেলে অধ্যাপক মহোদয় শিবুর কাছে গিয়ে ফিসফিস করে কড়া গলায় বলে উঠল, ‘আমাদের পবিত্র শ্মশানে একে নেওয়া যাবে না। এইডা আমাদের সিদ্ধান্ত।’

‘ক্যান এই সিদ্ধান্ত?’ ভাঙা গলায় প্রশ্ন করে শিবু।

‘ওইখানে মানুষ অনন্তপ্রসাদকে পোড়ানো হয়েছে। জানোয়ার অনন্তকে না।’ বলে আর একটিও কথা না বলে ধর্মাধিপতিগণ শিবুদের বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন।

শিবু এবার আকাশের দিকে তাকিয়ে করুণ স্বরে আর্তনাদ করে ওঠে, ‘অ বাবা গো, দেইখা যাও তুমি। তুমার দেহডা শ্মশানে নিয়া সৎকার পর্যন্ত করতে দিব না হেরা। কারে অত চিড়া-গুড় দিছ; কারে হাজার ট্যাকা চান্দা দিছ। সব মিছা। দেইখা যাও বাবা, বাবা গো, বাবা আমার।’

ছেলের মুখে একথা শুনে কঁকিয়ে ওঠে সারদা। মনে হচ্ছে, মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়েছে। স্বামীর শেষ কাজটুকু
যথাযথভাবে হবে না ভেবে ওর বুক ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু চিৎকার করে কাঁদতেও পারছে না; অবিরাম চেঁচানোর ফলে গলা ভেঙে গেছে; বিলাপভরা কান্নার ভেতর কণ্ঠের সেই তাগদ আর নেই। তবু হাত-পা ছুড়ে নিজের অসহায় আবেগটুকু তীব্রভাবে প্রকাশ করতে চাইছে সারদা।

এ-সময় সাইফুলের কী মনে হলো, সে সোজা গিয়ে দাঁড়াল শিবুর সামনে। উচ্চৈঃস্বরে বলে ওঠে, ‘অনন্ত জেঠুরে এই বাড়িতেই দাহ করুম। এই উডানেই অইব তাইনের শ্রাদ্ধশান্তি। তুই চিন্তা করিছ না, ভাই।’

শিবু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সাইফুলের দিকে। যে ওকে দেখলেই অনন্তপ্রসাদকে নিয়ে কটাক্ষ করেছে সারাক্ষণ, তার কণ্ঠে এ কী সুর? বিশ্বাস করতে পারছে না নিজের কানকে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে; পুরো বিষয়টা নিয়ে পুনরায় ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে আসেনি তো? একসময় আবেগের আতিশয্যে শিবু বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। সাইফুলের চোখে চোখ রাখে। তারপর ওকে জড়িয়ে ধরে কান্নাভেজা গলায় বলে ওঠে, ‘ভাই, ভাইরে আমার।’ এ-সময় দূরে দাঁড়ানো জুলহাস কাকার সঙ্গে ওর চোখাচোখি হয়ে যায়। শিবু স্পষ্ট বুঝতে পারে, এ-সিদ্ধান্ত শুধু সাইফুলের নয়, অনন্তপ্রসাদের বন্ধু জুলহাসেরও। ওদের যৌথ উঠোনের যেখানটায় কুকুররূপী অনন্তপ্রসাদকে দাহ করা হলো, সেখানেই পনেরো দিন পর অপরিচিত এক ব্রাহ্মণকে দিয়ে শ্রাদ্ধশান্তির কাজ সম্পন্ন হলো। সারদার গায়ে ফের বৈধব্যের বেশ জায়গা করে নিল।

মানে মানে সব মিটে যাওয়ার পর পরিবারের সবাই এবার লক্ষ করল, এখন আর আগের মতো হন্তদন্ত কাজকর্ম নেই সংসারে। সবার আর সময় কাটে না। ভোরবেলায় শিবুর ঘুম থেকে ওঠার তাড়া নেই। সারাক্ষণ অনন্তপ্রসাদকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখারও তাগাদা নেই সুপর্ণা-সারদার। কেমন ঢিমেতালের জীবন ওদের। কোনো তাড়া নেই কোথাও।

তবু অভ্যাসবশে শিবু সকালে ঘুম ভাঙলে জামগাছতলায় গিয়ে দাঁড়ায়।

গাছটা ওদের দুই বাড়ির অকথিত সীমানা-পাঁচিল। এখানে দাঁড়ালে আশ্চর্যরকমভাবে ওর শরীরটা হালকা হয়ে যায়। কেমন এক ফুরফুরে অনুভব ভর করে। মাথার ওপর বাবা থাকলে যেরকম লাগে, সেরকম।

সে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই কলতলায় সুপর্ণাকে টিউবওয়েলের ডা-া ধরে উবু হয়ে বসে থাকতে দেখে। সে ছুটে যায় সেদিকে। মুখে বলে, ‘কী, কী অইছে সুপু?’

সুপর্ণা কথা বলতে পারে না। কেবল ওয়াক-ওয়াক শব্দ করছে।

ভেতর থেকে সারদা ছুটে এসে বউমার এ-অবস্থা দেখে মুখে বলে, ‘জয় গুরু।’

আর শিবু ওর স্ত্রীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বলে ওঠে, ‘বাবার সাধ মিটে নাই। আবার আইতাছে।