মাজহারুল ইসলাম ও বাংলাদেশের স্থাপত্যে চেতনা আন্দোলন

সাইফ উল হক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে সদ্যপ্রয়াত স্থপতি মাজহারুল ইসলামের জানাজা পড়ে সামনের পাকা চত্বরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছি। স্থপতির প্রাণহীন দেহ চত্বর-মাঝখানে। উপস্থিত সুধীবৃন্দের মধ্যে কিছু আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, সম্ভবত মরদেহ কোথায় নেওয়া হবে কিংবা কোথায় দাফন করা হবে এসব বিষয় নিয়ে। এর মধ্যে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদের এক ছাত্র আমার কাছে এসে আমাকে হঠাৎ একটা প্রশ্ন করলো। প্রশ্নটি  ছিল, স্থপতি  মাজহারুল  ইসলাম এত বড়মাপের স্থপতি এবং পাকিস্তান আমলে এত কাজ করেছেন, তিনি কেন স্বাধীন বাংলাদেশে তেমন কোনো কাজ করেননি?  ঠিক সে-মুহূর্তে উত্তর দেওয়াটা ছিল কিছুটা কঠিন। কিন্তু তবু ছাত্রটিকে বললাম, এটা অবশ্যই ভাবার একটা বিষয়, এর উত্তর আমাদের বের করতে হবে।
মাজহারুল ইসলাম ১৯৫২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি স্থাপত্য ডিগ্রি লাভ করার আগে বিজ্ঞানে স্নাতক এবং প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে সরকারের কনস্ট্রাকশন বিল্ডিং ও ইরিগেশন (সিবিআই) মন্ত্রণালয়ে সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগ দেন এবং এর কিছু পরই যুক্তরাষ্ট্রে স্থাপত্য বিষয়ে পড়তে যান। মাজহারুল ইসলাম উপনিবেশ-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম পাশ্চাত্যে শিক্ষিত স্থপতি এবং সে-সময়ে সরকারে কর্মরত অন্য স্থপতিরা ছিলেন ভিনদেশি। মাজহারুল ইসলাম বাংলাদেশের স্থাপত্য অঙ্গনে আবির্ভূত হন এমনই এক পটভূমিতে যখন আধুনিক স্থাপত্যের ধ্যান-ধারণা ছিল অনুপস্থিত। ১৯৫৩ সালে রমনা রেসকোর্সের পশ্চিম পাশে সরকারি আর্ট কলেজ ও ঢাকার গণগ্রন্থাগার নির্মাণের মধ্যে দিয়ে তাঁর হাত ধরে বাংলাদেশের স্থাপত্যে সূচনা ঘটে আধুনিক যুগের। দেশের স্থাপত্য সংস্কৃতিকে আধুনিক এক দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য উপহার দিয়ে সৃজনশীলতার এক উৎকৃষ্ট স্বাক্ষর রাখলেন তিনি। এটা একটি বিস্ময়কর ব্যাপার যে, এরকম স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী একজন কর্মব্যস্ত স্থপতি স্বাধীনতা-উত্তরকালে মোটামুটি কর্মহীন হয়ে পড়লেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য স্থাপত্যচর্চায় ব্যাঘাত ঘটেছিল; কিন্তু ১৯৭২ থেকে তাঁর মৃত্যুর সময় পর্যন্ত (২০১২) – এই ৪০ বছর বলতে গেলে এর আগের ২০ বছরের তুলনায় কর্মহীন। স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে পূর্ণাঙ্গভাবে জানতে হলে ৮৯ বছরের জীবনের এই ৪০ বছরের জীবনকে জানার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি, কারণ এর সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের মন-মানসিকতার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
১৯৫২ থেকে ১৯৭১ – প্রায় দুদশক স্থপতি মাজহারুল ইসলাম অতিক্রান্ত  করেন একটি অত্যন্ত ব্যস্ত ও ঘটনাবহুল সময়। এই সময়ে দুবার দেশের বাইরে পড়তে যান। সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে নিয়ে ‘বাস্তুকলাবিদ’ গঠন করেন। লুই কান, পল রুডলফ ও স্ট্যানলি টাইগারম্যানের মতো বিশ্বখ্যাত স্থপতিদের বাংলাদেশে কাজ করার ক্ষেত্র তৈরি করেন এবং একই সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যকর্ম সম্পাদন করেন, যেগুলোর মধ্যে ইতিপূর্বে উল্লেখ করা সরকারি চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়, ঢাকা গণগ্রন্থাগার, জাতীয় জনপ্রশাসন ইনস্টিটিউট, বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি ভবন, সড়ক গবেষণাগার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও পলিটেকনিক ছাড়াও অনেক বসতবাড়ি, ইসলামাবাদে মন্ত্রীদের বাসভবন এবং বেইজিংয়ে পাকিস্তান দূতাবাসের নকশার জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হন। পাকিস্তান স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি হন, পাকিস্তানের স্থপতি নিবন্ধন আইনের খসড়ার মুখ্য রূপকার, ইসলামাবাদের বাদশাহ ফয়সাল মসজিদের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার একজন বিচারক এবং পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ‘ভৌত পরিকল্পনা, গৃহায়ন ও স্থাপত্য’ বিষয়ের পরিকল্পনার পর্যালোচনা এবং চূড়ান্তকরণ কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার আগে পর্যন্ত মাজহারুল ইসলাম সচেষ্ট ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থাপত্য পেশাকে সংগঠিত করায় এবং স্বাধীন দেশের ভৌত পরিকল্পনা ও গৃহায়নের ব্যাপারে একটি কর্মপরিকল্পনা রচনার কথা তাঁর কাছ থেকে শুনেছি। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সময় মাজহারুল ইসলাম ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে এবং এই জঘন্য ঘটনার সংবাদটি তাঁকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দেওয়া হয়। এটাও তাঁর মুখ থেকে শোনা। এটা বোঝা যায় যে, বাংলাদেশের মতো একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ভৌত অবকাঠামো, গৃহায়ন ও নগরায়নের পরিকল্পনার জন্য সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের উদাহরণগুলো দেখার উদ্দেশ্যে তাঁর সেখানে যাওয়া। যখন তিনি দেশে ফিরলেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পালটে গেছে। এ সময় তিনি বেশ কিছুদিন গৃহবন্দি ও গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলেন। প্রতিদিন গোয়েন্দা দফতরে হাজিরা দেওয়ার কথা তাঁর কাছে শুনেছি। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতি তাঁর জন্য নিশ্চয় বেশ পীড়াদায়ক এবং হতাশাব্যঞ্জক ছিল। সেই সময়, যতদূর মনে পড়ে সম্ভবত সৈয়দ আলী আহসান, যিনি সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন, তিনি মাজহারুল ইসলামকে একটি প্রকল্প ডিজাইনের দায়িত্ব দেন এবং প্রকল্পটি ছিল শেরেবাংলা নগরের আগারগাঁওয়ে অবস্থিত জাতীয় গ্রন্থাগার ও আর্কাইভস ভবনদ্বয়ের ডিজাইন। সম্ভবত এর পরপরই তাঁর দুই অনুজ এবং ¯েœহভাজন স্থপতি আলমগীর কবির ও স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের প্রতিষ্ঠান ‘স্থাপত্য শিল্পে’র সঙ্গে যৌথভাবে লাভ করেন জয়পুরহাট চুনাপাথর প্রকল্পের গৃহায়ন অংশটি। এই কাজ দুটো সেই সময়ে তাঁকে কিছুটা ব্যস্ত রাখে এবং আমার জানামতে এরপর তিনি আর কোনো সরকারি প্রকল্পের কাজ পাননি, শুধু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া। সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ এবং চারু ও কারুকলা অনুষদের মাঝে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিপ্রাঙ্গণের পুনরায় ডিজাইন, যেটা পরবর্তীকালে অন্য স্থপতির কাছে হস্তান্তর করেন তিনি। কাজ পাওয়ার জন্য যে তিনি আগ্রহী ছিলেন না, সেটা জোর দিয়ে বলা যাবে না। কারণ তিনি চেষ্টা করেছেন কাজ পাওয়ার এবং আমার জানামতে চট্টগ্রামে একটি সার কারখানার গৃহায়ন প্রকল্পের জন্য আবেদন করলে তিনি এই কাজের জন্য যোগ্য নন – এই বলে তাঁর আবেদন কর্তৃপক্ষ প্রত্যাখ্যান করে। এছাড়া অন্যান্য স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে যমুনা সার কারখানার গৃহায়ন প্রকল্প ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাপরিকল্পনার জন্যও প্রস্তাবনা জমা দেন এবং সেগুলোও গৃহীত হয়নি। সরকারি কাজের যখন এই দশা সে সময় বেসরকারি কাজও তেমন পাননি তিনি। একপর্যায়ে তাঁর পরীবাগের বাসভবনের দক্ষিণ দিকে স্বউদ্যোগে একটি মিশ্র ব্যবহার বাড়ির ডিজাইনের কাজ শুরু করেন, যেটা পরবর্তীকালে অফিসভবন হিসেবে ডিজাইন ও নির্মিত হয় এবং বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশের আবাসিক মিশন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বেসরকারি কর্ণফুলী গ্র“প তাঁকে একটি বহুতলবিশিষ্ট মিশ্র ব্যবহারের বাড়ি ডিজাইন করতে দেয়; কিন্তু ডিজাইন কিছুদূর এগোনোর পর কাজটি অন্য স্থপতিকে দেয় নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। এমনকি সরকারি জাতীয় গ্রন্থাগার ও আর্কাইভসের জোড়া ভবনের সম্পূর্ণ ডিজাইন করা সত্ত্বেও শুধু গ্রন্থাগার ভবনটি নির্মাণ করা হয় এবং পরবর্তীকালে আর্কাইভস ভবনটি অন্য স্থপতি দ্বারা পুনরায় ডিজাইন ও নির্মাণ করা হয়। এমনই এক পরিস্থিতিতে চলছিল মাজহারুল ইসলামের ১৯৭৫-পরবর্তী দিনগুলো। স্থাপত্যশিক্ষার একমাত্র প্রতিষ্ঠান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদের সঙ্গেও এই সময়ে তাঁর জড়িত থাকার কোনো উল্লেখ পাইনি। মাজহারুল ইসলাম ছিলেন স্থাপত্যের সরকারি অথবা আধাসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে একজন উপেক্ষিত ব্যক্তি।
এ-পটভূমিতে ১৯৮২ সালে ঘটে গেল ব্যতিক্রমী একটি ঘটনা। মাসটি সম্ভবত জুন কিংবা জুলাইয়ের শুরু। আমি স্থাপত্য অনুষদের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। সেই সময়ের কোনো এক দুপুরে ধানমণ্ডির মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের গ্রন্থাগারে আমার এবং বন্ধু কাজী খালিদ আশরাফ, সঙ্গে আমাদের অগ্রজ, স্থপতি নাজমুল লতিফ সুহাইলের দেখা। তাঁর কাছ থেকে জানলাম, স্থপতি মাজহারুল ইসলামের অফিসে তাঁরা সবাই একটি অধ্যয়ন চক্র শুরু করেছেন। সপ্তাহে দুদিন সোম এবং শুক্র তারা বসেন। তিনি কাজী খালিদ আশরাফকে আমন্ত্রণ জানালেন যোগ  দেওয়ার  জন্য। তবে  যেহেতু  ইসলাম  সাহেব এ-অধ্যয়ন চক্রে ছাত্রদের এই মুহূর্তে অংশগ্রহণের ব্যপারে উৎসাহী নন, তাঁরা শুধু একজনের অংশগ্রহণের সম্মতি পেয়েছেন। যা-ই হোক কিছুটা মন খারাপ হলো। কিন্তু একই সঙ্গে একটা পণ করলাম যে, আমিও খালিদের সঙ্গে সন্ধ্যায় যাব এবং যদি অংশগ্রহণ করতে না পারি তাহলে চলে আসবো। সন্ধ্যায় আমি ও খালিদ একসঙ্গে ৩নং পরীবাগে উপস্থিত হলাম এবং দেখলাম যে, ইসলাম সাহেবের অফিসকক্ষে কয়েকজন অগ্রজ স্থপতি বসে আছেন তাঁর আসার অপেক্ষায়। ৩নং পরীবাগ একই সঙ্গে তাঁর অফিস ও বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। অগ্রজ স্থপতিদের দলে রাজিউল আহসান খোকন, নাজমুল লতিফ সুহাইল, সৈয়দ এজাজ রসুল ছাড়াও সম্ভবত উত্তম কুমার সাহা, আলমগীর কবির, রাশিদুল হাসান ছবি, নাহাস খলিল এবং সেরাজুল হক ছিলেন। কিছুক্ষণ পর ইসলাম সাহেব এসে আসন গ্রহণের পরই আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আমরা কারা। আমরা পরিচয় দেওয়ার আগেই সম্ভবত নাজমুল লতিফ সুহাইল অথবা রাজিউল আহসান খোকন ইসলাম সাহেবকে জানালেন, আমরা স্থাপত্য অনুষদের ছাত্র, আমাদের কথাই তাঁরা আগে বলেছিলেন। কিছুটা উৎসুক ও কিছুটা সন্দেহের চোখে ইসলাম সাহেব জানতে চাইলেন, কোন বর্ষে অধ্যয়ন করছি এবং এখনকার আলোচনা যে ছাত্রছাত্রীদের জন্য উপযোগী হবে না সেটাও জানিয়ে দিলেন। কিন্তু আমরা দমবার পাত্র নই এবং সেদিন থেকে স্থপতি মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে এক দীর্ঘ পথচলার ইতিহাসের শুরু হলো। পরে আমরা জানতে পারলাম, অধ্যয়ন চক্রের উদ্যোগটি বেশ কিছুদিন ধরে সক্রিয় এবং সেটা ১৯৮১ সালের শীতকাল থেকে। সদ্য পাশ করা স্থপতিদের এ-দলটি বেশ কিছুদিন ধরে ইসলাম সাহেবকে রাজি করানোর একটি প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন এবং সেটা ১৯৮২ সালের মাঝামাঝি এসে যাত্রা শুরু হয় এবং যাত্রাটি শুরু হলো স্থপতি মাজহারুল ইসলাম দ্বারা ডিজাইন প্রক্রিয়ার ওপর একটি ধারাবাহিক বক্তৃতার মাধ্যমে। মাজহারুল ইসলামের বক্তৃতা শেষ না হতেই শুরু হলো রাজিউল আহসান কর্তৃক Paul Klee The Thinking Eye-এর ওপর আলোচনা, এরপর সৈয়দ এজাজ রসুলের Moholy Nagy-র Vision in Motion, এরপর নাজমুল লতিফের Modern Art Movement in the West, রাশিদুল হাসান ছবির Walter Gropius and the BAUHAUS এবং আরো। তিন থেকে চার ঘণ্টা শোনা ও আলাপ করা। ক্রমশই একটা উপলব্ধি হচ্ছিল যে, আমাদের জ্ঞানের পরিধি অনেক সীমিত এবং এ-ধরনের অনানুষ্ঠানিক অধ্যয়নের ধারাটি চালিয়ে যেতে হবে। বছরের শেষ নাগাদ প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের পরিচালক নাজিমুদ্দিন আহমেদকে আমন্ত্রণ জানানো হলো বাংলাদেশের স্থাপত্য ও প্রতœতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের ওপর একটি উপস্থাপনা করার জন্য এবং সেই উপস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্থাপত্যের একটি দীর্ঘ ঐশ্বর্যমণ্ডিত এক ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হলাম এবং ভাবলাম যে, নিজের দেশ এবং তার ঐতিহ্য সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। এই সীমাবদ্ধতা প্রধানত আমাদের স্থাপত্য-অধ্যয়নের পাঠ্যসূচির কারণে হয়তো, যেহেতু মার্কিন শিক্ষকদের দ্বারা এই পাঠ্যসূচি তৈরি করা সেজন্যে হয়তো এই দশা আমাদের; কিন্তু একই সঙ্গে এই প্রশ্ন আমাদের মনে দানা বাঁধলো যে, এখন তো শিক্ষাব্যবস্থা নিজেদের হাতে, তবু কেন এটি উপেক্ষিত।
১৯৮২ সালের শরতে চেতনা নামটি চূড়ান্ত হয়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে এটিও ঠিক হয় যে, চেতনার সঙ্গে শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস প্রতœতত্ত্ব এবং বিভিন্ন বিষয়কে সংযুক্ত করতে হবে। অধ্যয়ন চক্রের একটি আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের আয়োজন করার কথাও আলোচিত হওয়া শুরু হলো এবং সেইসঙ্গে একটি ঘোষণাপত্র রচনার কাজ শুরু করা হলো। মাজহারুল ইসলামের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এ-ঘোষণাপত্র মুসাবিদার কাজ সম্পন্ন করা হয়। ঘোষণাপত্র প্রকাশের দিন-ক্ষণ-তারিখ ঠিক হলো এবং এর সঙ্গে জড়িত হওয়ার জন্য কবি শামসুর রাহমান, কবি বেলাল চৌধুরী, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী এবং আরো অনেককে আমন্ত্রণ জানানো হলো এবং তাঁরাও আমন্ত্রণ গ্রহণ করে এই অধ্যায়ন চক্রের সঙ্গে জড়িত হলেন।
১৯৮৩-এর গ্রীষ্মের শুরুতে মাজহারুল ইসলামের বাসভবন ও অফিসের দক্ষিণ দিকের উদ্যানে আয়োজন করা হলো ঘোষণাপত্র প্রকাশ অনুষ্ঠান। ঘোষণাপত্র পাঠ, শুভেচ্ছা বক্তব্য এবং সবশেষে প্রতœতত্ত্ববিদ নাজিমুদ্দিন আহমেদের বাংলাদেশের প্রতœ ও স্থাপত্য ঐতিহ্যের ওপর স্লাইড  উপস্থাপনা ছিল এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। স্বাধীন দেশের স্থপতিদের স্বদেশ ও বৈশ্বিক ভাবনায় পথচলার একটি দৃঢ় পদক্ষেপ।
শুরুটা অত্যন্ত সাদামাটাভাবে হলেও ঘটনাটি পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্থাপত্য-অঙ্গনকে বেশ আলোড়িত করে এবং একটা স্থাপত্য-আন্দোলনের রূপ নেয়। আমি সে-ঘটনাটিকে বাংলাদেশের স্থাপত্যে ‘চেতনা আন্দোলন’ হিসেবে অভিহিত করছি।
ঘোষণাপত্রটি শুরু হয় এভাবে – ‘আমরা ক’জন স্থপতি একত্রিত হয়ে অনুধাবন করি যে, জ্ঞানের অসম্পূর্ণতার জন্যই আমাদের স্থাপত্য অনুশীলনে আজ এত বিশৃঙ্খলা এবং এই অসম্পূর্ণতার বৃত্তকে হ্রাস করে আনার জন্য প্রয়োজন জ্ঞানানুশীলনের। এই অনুভূতি থেকেই আমাদের অধ্যয়ন চক্রের সূচনা। অধ্যয়ন ও প্রাসঙ্গিক আলোচনার পাশাপাশি আমরা গত দেড় বছরে পরিচালনা করি স্থাপত্য নিদর্শন পরিদর্শন ও আমন্ত্রিত ব্যক্তিত্বদের বক্তব্য শ্রবণ। ক্রমেই আমাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন শিল্পকলা, ভাষা ও সাহিত্য, ইতিহাস ও বিভিন্ন বিষয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
ক্রমশ আমরা অনুভব করি যে, স্থাপত্য কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। স্থাপত্য সৃষ্টির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বিভিন্ন বিষয়, বিভিন্ন পেশা ও বিভিন্ন মানব তৎপরতা। এসব উপাদানের পরিপ্রেক্ষিতে সুষ্ঠুভাবে হƒদয়ঙ্গম করেই নন্দিত স্থাপত্য সৃষ্টি করা সম্ভব। তাই দেশীয় প্রেক্ষাপটের আলোকে সঠিক স্থাপত্যচিন্তা ও স্থাপত্য-অনুশীলনের জন্য প্রয়োজন দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্বন্ধে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও সচেতনতা। প্রয়োজন অতীত ও বর্তমানের বিশ্লেষণের ওপর ভবিষ্যতের ভিত্তি স্থাপন। প্রয়োজন বর্তমান নির্জীবতার অবসান ঘটিয়ে সৃজনশীলতার নবচেতন।
এই উদ্দেশ্যে প্রয়োজন এসেছে অধ্যয়ন চক্রের সীমানাকে প্রসারিত করার এবং সেই লক্ষ্যে প্রণীত আমাদের এই ঘোষণা – ‘ভবিষ্যতের জন্য আমাদের কর্মপন্থা, আমাদের কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য, আমাদের চেতনার ইশতেহার।’
এবং শেষ হয় এভাবে ‘সামগ্রিক স্থাপত্য পরিস্থিতি  আজ এক মারাত্মক শূন্যতার সম্মুখীন। স্থাপত্যাঙ্গনে বিরাজ করছে সম্পূর্ণ নেতিবাচক অবস্থা :
আজ স্থাপত্য জ্ঞান আহরণের প্রক্রিয়ায় বিরাট অসম্পূর্ণতা। তার উপর রয়েছে যথোপযোগ্য ডিজাইন প্রক্রিয়ার অভাব এবং সুষ্ঠু নিয়মের অবহেলা।
স্থাপত্য পেশায় আজ নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতি। সুষ্ঠু নীতিমালার অনুপস্থিতিতে ঘটছে সীমাহীন দুর্নীতি। স্থাপত্য সৃষ্টিতে চলছে এক লক্ষ্যভ্রষ্ট প্রয়াস। স্থাপত্যের নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে কুরুচিসম্পন্ন কাজ। স্থাপত্যের অনুশীলন একটি সৃজনশীল এবং মানুষের কল্যাণকারী পেশা থেকে ক্রমেই রূপান্তরিত হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে ব্যবসায়।
জনমনেও সৃষ্টি হয়েছে স্থাপত্য সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে স্থাপত্য সম্বন্ধে অপর্যাপ্ত ধারণা এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য বিঘিœত হচ্ছে স্থাপত্য এবং পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়াস।
আমাদের নগর ও গ্রামীণ পরিবেশ ও পরিস্থিতি সম্বন্ধে রয়েছে সচেতন পরিকল্পনার অভাব। নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনায় স্থাপত্যগত ধ্যান-ধারণার অনুপস্থিতিতে গড়ে উঠছে অপরিকল্পিত জনপদ অথবা সমস্যা ও দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশ মানুষের সাথে সম্পর্কহীন অপ্রাসঙ্গিক ‘পরিকল্পনার’ বোঝা।
স্থাপত্য অনুশীলনে  আমরা  আন্তর্জাতিকভাবেও  বিচ্ছিন্ন। আন্তর্জাতিক স্থাপত্যের বিভিন্ন আন্দোলন, উদ্যোগ, সেমিনার, প্রতিযোগিতা ও নিত্যনতুন চিন্তাভাবনার সারি হতে আমরা সম্পর্কচ্যুত। আমরা বঞ্চিত বিভিন্ন দেশের স্থপতি ও স্থাপত্য সংগঠনের সাথে ভাবের আদান-প্রদানের সুযোগ থেকে। সামগ্রিক পরিস্থিতি শ্বাসরুদ্ধকর। আমাদের বর্তমান সাংস্কৃতিক চেতনা নির্জীব। আমাদের সৃজনশীল শক্তি অসাড়। আমাদের স্থাপত্য সৃষ্টি পঙ্গুপ্রায়।
এ অবস্থায় স্বাধীন দেশের স্থপতি হিসেবে সময় এসেছে নতুন করে চিন্তা করার, আমাদের শক্তি নতুন প্রয়োজন ও ডাকে নিয়োগ করার।
সময় এসেছে সৃজনশীলতার পুনরুজ্জীবনের।
সময় এসেছে আত্মমোচনের।
সময় এসেছে নতুন চেতনার।
ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরকারী স্থপতিরা ছিলেন – আনোয়ার হোসেন, আবদুর রশীদ, উত্তম কুমার সাহা, এ জেড এম আলমগীর, আবদুল মোহাইমেন, কাজী খালিদ আশরাফ, খালেদ নোমান, জালাল আহমেদ, নাহাস আহমেদ খলিল, বোরহানুল হুদা, মাজহারুল  ইসলাম, মাসুদুর রহমান, রবিউল হুসাইন, রাজিউল আহসান, রাশিদুল হাসান, সামসুল ওয়ারেস, সৈয়দ এজাজ রাসুল, সাইফ উল হক, সৈয়দ সিরাজুল হক ও মোস্তফা হারুন কুদ্দুস এবং তাঁদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন বিশিষ্ট নাট্যশিল্পী, পরিকল্পনাবিদ, কবি, সাহিত্যিক, অধ্যাপক প্রমুখ বিদগ্ধজন।
১৯৮৩ সালে ¯œাতক পাঠ শেষ করে আমরা কয়েকজন (খালিদ আশরাফ, জালাল আহমেদ, খালেদ নোমান) আরো গভীরভাবে সম্পৃক্ত হলাম চেতনার কার্যক্রমের সঙ্গে। এরই মধ্যে আরো কয়েকজন জ্যেষ্ঠ স্থপতি, নবীন স্থপতি ও স্থাপত্যের ছাত্র জড়িত হতে শুরু করলেন এই অধ্যয়ন চক্রে। এমনই এক উদ্দীপ্ত পরিবেশে স্থপতি মাজহারুল ইসলাম আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারের প্রথমপর্বের একজন বিচারক হওয়ার সুবাদে ভারতীয় স্থপতি চার্লস কোরিয়ার সঙ্গে আলাপচারিতায় ঢাকায় একটি আঞ্চলিক সম্মেলনের  প্রস্তাব দিলেন। চেতনার পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হলো পাকিস্তানি স্থপতি কামিল খান মুমতাজ এবং মিমার পত্রিকার সম্পাদক হাসান উদ্দিন খানকে। কিন্তু এরই মধ্যে চার্লস কোরিয়া আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারের সাধারণ সম্পাদক সুহা ওজকানের সঙ্গে আলাপ করে ঢাকায় আগা খানের পৃষ্ঠপোষকতায় আরও একটি বড় সম্মেলন আয়োজনের ব্যাপারে রাজি করান। পরে ১৯৮৫ সালে অনেক বড় কলেবরে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদ, বাংলাদেশ আগা খান ফাউন্ডেশন এবং জেনেভায় অবস্থিত আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার সচিবালয়ের  উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় স্থাপত্যে আঞ্চলিকতাবাদ (Regionalism in Architecture) শীর্ষক এক সেমিনার, যা দক্ষিণ এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বিখ্যাত স্থপতি, স্থাপত্য ও শিল্প ইতিহাসবিদ এবং সমালোচকদের অংশগ্রহণে বাংলাদেশের স্থাপত্য ইতিহাসের একটি মাইলফলক ঘটনা। এই সেমিনারে মাজহারুল ইসলাম এবং আমি ও কাজী খালিদ আশরাফ যৌথভাবে দুটি প্রবন্ধ পাঠ করি যেগুলো যথাক্রমে Architecture in Bangladesh – A Case for Regionalism এবং Government vis-a-vis Architecture। আমার ও খালিদ আশরাফের বয়স ২৫ বছর এবং মাজহারুল ইসলামের বয়স ৬০ এবং এই যৌথ উদ্যোগটি আামাদের জন্য ছিল এক অকল্পনীয় সৌভাগ্য। এ সময় স্থপতি ইসলামের বাসায় স্থপতি চার্লস কোরিয়া, স্থপতি রোমি খোসলা, স্থপতি উত্তম জৈন, স্থপতি কামিল খান মুমতাজ, স্থপতি সুহা ওজকান, সাইদ জুলফিকার প্রমুখ মিলিত হন চেতনার সদস্যদের সঙ্গে। তাঁরা উপমহাদেশের স্থপতিদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে একটি আঞ্চলিক ফোরাম গঠন নিয়ে আলোচনা করেন। এ-উদ্যোগটি পরবর্তীকালে দক্ষিণ এশিয়া স্থাপত্য কনফারেন্সে রূপান্তরিত হয়।
১৯৮৭ সালের মার্চে চেতনার উদ্যোগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ‘স্থাপত্য ডিজাইন ও শিক্ষা’ (Architectural Design & Education)  শীর্ষক সেমিনার। বাংলাদেশের স্থাপত্যচর্চা ও চেতনার জন্য এটি ছিল একটি মাইলফলক ঘটনা। বাংলাদেশের স্থপতি মাজহারুল  ইসলাম এবং ভারতের স্থপতি বালকৃষ্ণ দোশির উপস্থিতিতে এই সেমিনারটি বাংলাদেশের স্থাপত্য অঙ্গনকে দারুণভাবে আলোড়িত করে এবং নবীন প্রজন্মের স্থপতিদের জন্য ছিল সাংঘাতিক অনুপ্রেরণামূলক। একই বছর আগস্টে চেতনার দুজন সক্রিয় সদস্য কাজী খালিদ আশরাফ ও শামিম জাভেদ সেই সময়ে এমআইটিতে অধ্যয়নরত, আগা খান ফাউন্ডেশনের একটি ক্ষুদ্র সহায়তার মাধ্যমে ঢাকায় একটি চমৎকার কর্মশালা ও ছাত্রদের জন্য ‘শ্যারেট’ (Charette) আয়োজন করে। অনুষ্ঠানটির শিরোনাম ছিল ‘নগর ও স্থাপত্য’ (Architecture and the City)। কর্মশালাটির লক্ষ্য ছিল বর্ধনশীল ঢাকা শহরের ভবিষ্যতের ওপর আলোকপাত করা। কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে বেশ কয়েকজন স্থপতি ঢাকার চারটি এলাকার ওপর তাঁদের প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন এবং সেগুলো নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা হয়। স্থপতি মাজহারুল ইসলাম সমগ্র ঢাকার পরিকল্পনার ওপর তাঁর ভাবনা  উপস্থাপন করেন। জল ও স্থলের যে-বৈশিষ্ট্য ঢাকা শহরে উপস্থিত সেটা ধরেই ঢাকার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রচিত হওয়া উচিত – এ-ব্যাপারে তিনি জোর দেন। ১৯৮৬ সালে কাজী খালিদ আশরাফের সম্পাদনায় বের হয় স্থাপত্য সাময়িকী চেতনার পত্র, যেটা পরবর্তীকালে চেতনা নামে আরো দুটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়, স্থাপত্যবিষয়ক  লেখালেখির  একটি  সংস্কৃতি চেতনার কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়। দেশের বাইরে সম্ভবত বাংলাদেশের সমকালীন স্থাপত্যের ওপর বিশদ উপস্থাপনার প্রথম ঘটনা ঘটে চেতনার সদস্যের দ্বারা এবং সেটা ছিল ১৯৮৮ সালে ভারতের স্থাপত্য সাময়িকী Architecture + Design বাংলাদেশের সমকালীন স্থাপত্যের ওপর প্রচ্ছদ কাহিনি এবং সাময়িকীর প্রচ্ছদটিতে ব্যবহৃত হয় মাজহারুল ইসলামের ডিজাইন করা ঢাকার চারুকলা মহাবিদ্যালয়ের ছবি। ১৯৮৯ সালে সিঙ্গাপুর থেকে প্রকাশিত স্থাপত্য সাময়িকী মিমারে (Mimar) ছাপা হয় মাজহারুল ইসলাম ও বাংলাদেশের সমকালীন স্থাপত্যের ওপর বিশদ রচনা। ১৯৮৭-এর শেষের দিকে চেতনার ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ড হিসেবে বাংলাদেশের স্থাপত্যের একটি প্রামাণিক দলিল রচনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা রচনা করা হয় এবং ১৯৮৯ সালের বসন্তে প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে সুধী সমাজের কাছে তুলে ধরা হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দাতা প্রতিষ্ঠান ফোর্ড ফাউন্ডেশন এগিয়ে আসে। নব্বইয়ের শুরুর দিকে চেতনাকে একটি সোসাইটি হিসেবে নিবন্ধিত করা হয় এবং একই সঙ্গে বিদেশি অনুদান গ্রহণের জন্য এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধন নেওয়া হয়। ১৯৯৩ থেকে মাঠ জরিপের কাজ শুরু হয় এবং ১৯৯৭ সালে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের  ভিত্তিতে ড্রইং ও আলোকচিত্রের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের স্থাপত্য ইতিহাসের প্রামাণিক প্রদর্শনী ‘পুন্ড্রনগর হতে শেরেবাংলা নগর : বাংলাদেশের স্থাপত্য’। প্রদর্শনীটি আয়োজিত হয় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে। প্রদর্শনীটি জনসাধারণের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে। প্রদর্শনী চলাকালে ঘটে যায় একটি বিয়োগান্ত ঘটনা এবং সেটি ছিল মাজহারুল ইসলামের পরই যে-ব্যক্তিটি ছিল চেতনার প্রাণপুরুষ সেই স্থপতি রাজিউল আহসানের সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়া।
১৯৯৭ সালের আগস্টে চেতনার সক্রিয় সদস্য কাজী খালিদ আশরাফের মাধ্যমে ঘটে যায় বাংলাদেশের স্থাপত্য ইতিহাসের আরো একটি বড় ঘটনা এবং সেটি হলো ‘An Architecture of Independence : The Making of Modern South Asia’ নামক একটি স্থাপত্য প্রদর্শনীর আয়োজন যুক্তরাষ্ট্রে। ভারতের তিন বিখ্যাত স্থপতি চার্লস কোরিয়া, বালকৃষ্ণ দোশি ও অছুত কানভিন্দের সঙ্গে বাংলাদেশের মাজহারুল ইসলামের কাজের প্রদর্শনী এবং একই সঙ্গে একটি বই প্রকাশনা। আমার জানামতে এর আগে একবার ভেনিস বিয়েনালে ইসলামি দেশসমূহের স্থাপত্যের ব্যাপারে স্থপতি ইসলামের সম্ভবত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় গ্রন্থাগার এই দুটি প্রকল্প প্রদর্শিত হয়। কিন্তু ১৯৯৭ সালে এই প্রদর্শনী স্থপতি ইসলামের জন্য বিরাট এক সম্মানের।
১৯৯৯ সালে কাজী খালিদ আশরাফের উদ্যোগে ‘সদরঘাট নদীর তীর’ শীর্ষক একটি কর্মশালা। ২০০০ সালে ‘স্থাপত্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে আলোকচিত্র’ কর্মশালা, সম্ভবত এটাই ছিল চেতনার সর্বশেষ আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। স্থাপত্য সংরক্ষণ ও নগর পরিকল্পনা সংক্রান্ত কিছু গবেষণামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেগুলো সফলভাবে সম্পাদন করা হয়নি।
মাজহারুল ইসলাম ও রাজিউল আহসানের নেতৃত্ব চেতনাকে একটি কর্মচঞ্চল সংগঠনে রূপান্তরে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। রাজিউল আহসানের প্রয়াণের পর চেতনা ধীরে ধীরে প্রাণচাঞ্চল্য হারাতে থাকে এবং ২০০২ সালের ভেতর মোটামুটি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ১৯৮২ থেকে ২০০২ – এই দুই দশকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঘটে নানা পরিবর্তন – স্বৈরাচারী শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের একটি কঠিন পথ পরিক্রমণ, অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মুক্ত অর্থনীতির লাগামহীন জোয়ার, সমাজে নানা বিভক্তি ইত্যাদি মিলিয়ে ঘটে নানা পরিবর্তন। সব মিলিয়েই চেতনার কর্মক্ষমতা ও আদর্র্শিক  অবস্থান বেশ ক্ষয়িষ্ণু পর্যায়ে পৌঁছে যায়। চেতনার আবির্ভাব ও হারিয়ে যাওয়া যেন ধূমকেতুর আবির্ভাব ও প্রস্থানের মতো একটি ঘটনা।
১৯৮২ সালে চেতনার যাত্রা শুরু হওয়ার সময় স্থপতি মাজহারুল ইসলামের বয়স ছিল ৫৮ এবং ২০০২ সালে ৭৮। অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে হলেও তিনি জীবনের একটি সময়ে একদল নবীন স্থপতিকে কাছে পেয়ে এবং তাঁদের মধ্যে কিছু করার অভিপ্রায় দেখে চেষ্টা করেছিলেন তাঁর জ্ঞান ও বিশ্বাসের বিষয়গুলো ছড়িয়ে দেওয়ার। মাজহারুল ইসলামের এই প্রচেষ্টা বাংলাদেশের স্থাপত্যকে কতখানি সমৃদ্ধ করেছে সেটা হয়তো ভবিষ্যতে বিশ্লেষিত হবে; কিন্তু যাঁরা ওই সময় তাঁর কাছে আসার এবং অনুপ্রাণিত হওয়ার  সুযোগ পেয়েছিলেন সেটা নিঃসন্দেহে একটি বিরাট ঘটনা। মাজহারুল ইসলাম বাংলাদেশের সমকালীন স্থাপত্যর গুরু এবং তাঁর জীবন ও স্থাপত্য বাংলাদেশের স্থপতিদের দীর্ঘদিন প্রেরণা জুগিয়ে যাবে।