ইতিহাসের নির্মাণ থেকে বিনির্মাণে ফণীশ্বরনাথ ‘রেণু’

পেস্নটো অনুকরণকে Eikastika ও Phanatastika – এই দুভাগে ভাগ করে সত্য অনুকরণকে নীতির দিক থেকে গ্রহণীয় বলে ঘোষণা করলেন। তিনি শিল্পকে ‘অনুকরণ’ বললেও শিল্পের প্রেরণা অবশ্যই খুঁজেছিলেন দৈব ইচ্ছা বা কৃপার মধ্যে। তাঁর মতে, কবিরা কাব্য রচনা করেন (in a state of divine insanity)
দৈব-উন্মাদনায় বা দৈব-প্রেরণায়। মূর্খ কবিরাও যে সুন্দর সুন্দর কাব্য সৃষ্টি করেন তার কারণ –

They do not compose according to any art which they have acquired, but from the impulse of the divinity within them.

‘শিল্পকে অনুকরণ’ বলে সত্যের তিন ধাপ দূরে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছেন এবং যুক্তিহীন অন্ধ আবেগের ব্যাপার বলে নৈতিক মর্যাদার দিক দিয়ে হীন প্রতিপন্ন করতে চেষ্টা করেছেন। দৈবপ্রেরণাবাদী পেস্নটো হয়তো কিছুটা অজ্ঞাতসারে শিল্পকে দৈবপ্রেরণার ফল বলে খানিকটা মর্যাদা দিয়ে ফেলেছেন।

‘Art is more philosophical than History.’ এই উক্তিটির মাধ্যমে অ্যারিস্টটল শিল্পের সংজ্ঞা নির্ণয় করতে চাইলেন। তিনি বলেছিলেন –

Poetry, therefore, is a more philosophical and a higher thing than History; for poetry tends to express the universal, History the particular.

তিনি বললেন, ইতিহাস রূপ দেয় ‘বিশেষ’কে আর শিল্প রূপ দেয় বিশেষ আকারে ‘সামান্য’কে। ইতিহাস শুধু যা ঘটেছে তারই বর্ণনা করে। কোনো ‘idea’-কে ব্যক্ত করার জন্য ঘটনার পরিবর্তন ও পুনর্বিন্যাস করে না। অন্যপক্ষে শিল্প – যে বিশেষকে রূপ দেয় তার ভিতর দিয়ে একটি ‘idea’-কে ব্যক্ত করতে চেষ্টা করে অর্থাৎ শিল্প বিষয়গুলোকে আদর্শায়িত করে আর এটি শিল্পের বিলক্ষণ বৈশিষ্ট্য এবং এখানেই শিল্পের সঙ্গে ইতিহাসের পার্থক্য। শিল্প বিশেষের সামান্যীকরণ এবং শিল্প ইতিহাসের থেকে অধিকতর দার্শনিকতাপূর্ণ রচনা। যা ঘটে বা ঘটেছে তাকে রূপ দেওয়া কাব্যের উদ্দেশ্য নয়, যা ঘটতে পারে তাকে রূপ দেওয়াই কবির কাজ। ঐতিহাসিকরা relates what has happened এবং কবিরা করেন what may happen. অর্থাৎ – ‘what may happen, what is possible according to the laws of probability or necessity.’ কবি তত্ত্বের সাহায্যে সত্যের মূর্তি গড়েন – Poetry transforms its facts into truths. ইতিহাসে ঘটনার মধ্যে তথ্যের কালানুক্রমিক সমাবেশ বা বিন্যাস থাকে আর কাব্যে তথ্য বা ঘটনার বিন্যাসের মধ্যে কার্যকারণ সূত্রে দৃঢ় বন্ধন থাকে।

সাহিত্যকার যখন ঐতিহাসিক উপাদান নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করবেন তখন তাঁকে সমসাময়িক চরিত্রের ওপর ধারণাকে অবিকৃত রাখতে হবে। ঐতিহাসিক চরিত্রগুলো সত্য – তাদের নাম-পরিচয় বড় কথা নয়, তাদের যে মানবিক, অনুভূতিগুলি সাহিত্যে রূপায়িত হয় সেটি বড় কথা। শাজাহান একটি ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব কিন্তু তাঁর বাৎসল্যই নাট্যমধ্যে রূপায়িত এবং অতিরিক্ত সমন্তানস্নেহ tragedy ঘনীভূত করতে পারে সেটিই সাহিত্যের বিষয়। চরিত্রের emotion বা sentiment-কে প্রাধান্য দেবেন স্রষ্টা। বাস্তবের তথ্য মাত্রই সাহিত্যের সত্য নয়।

কাব্যের সামগ্রী ঐতিহাসিক হতে পারবে না এমন নয়। যা ঘটেছে তাতে সম্ভাব্যের বিকাশ দেখানোর অবকাশ অবশ্যই থাকতে পারে। গ্রিক tragedy-গুলির কাহিনি ঐতিহাসিক বটে কিন্তু নাট্যকারেরা সেই কাহিনিগুলিকে আদর্শায়িত করে কাব্যরূপ দান করেছেন। অ্যারিস্টটল সম্ভাব্যতার প্রসঙ্গে বলেছেন যে, কবি তথ্যপুঞ্জের মধ্যে ফাঁকটুকু পান তা সম্ভাব্য ঘটনাবলি দিয়ে পূরণ করে দেন – এ-স্বাধীনতা কবির আছে কিন্তু কোনো ঐতিহাসিকের নেই। Imagination শব্দটি অ্যারিস্টটল প্রত্যক্ষভাবে ব্যবহার না করে তিনি Probability-র ওপর সেই আস্থা রেখেছেন। মহাকাব্যে অনেক irrational ঘটনা সন্নিবেশিত হতে পারে কিন্তু Tragedy-তে কখনো ঘটবে না। যেটি ঘটেছে শুধু তার অনুকরণ নয়, যেটি ঘটতে পারে তার অনুকরণের রূপই সাহিত্য। আসল পার্থক্য হলো এই যে, একজন বলেন যা ঘটে গেছে তার কথা, অপরজন বলেন, তার কথা যা ঘটা সম্ভব। যা সম্ভাব্য তাই বিশ্বাসযোগ্য, যা ঘটেনি তার সম্ভাব্যতায় আমরা বিশ্বাস নাও করতে পারি। কিন্তু যা ঘটেছে তা অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য, কারণ সম্ভব না হলে ঘটল কী করে। স্রষ্টার পরিচয় অনুকরণ ক্ষমতার ক্রিয়ার অনুকরণে। ঘটে যাওয়া ঘটনার অনুকরণ করলেও তিনি স্রষ্টা, কারণ একটি ঐতিহাসিক ঘটনার ঘটনা হিসেবে সম্ভাব্যতার অনিবার্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই আর সে-কারণে তিনি স্রষ্টা। মনে রাখা দরকার কবি সৃষ্টি করেন আর ঐতিহাসিক নির্মাণ করেন। কবি Particular-কে Universal করেন আপন সৃষ্টিপ্রতিভায়। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন – ‘By the universal I mean how a person of certain type will on occasion speak or act according to the law of Probability or necessity.’

‘Poetics’ অবতারণার কারণ বিষয়টির গ্রন্থিমূলকে উপভোগ করা। কাব্যিক সত্যের অন্তরালে যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন ফণীশ্বরনাথ রেণু তা আমি তাঁর প্রখ্যাত উপন্যাস
ময়লা-আঁচলকে কেন্দ্র করে উদ্ঘাটিত করতে চাই।

 

কাব্যিক সত্যের অন্তরালে ইতিহাসস্রষ্টা ফণীশ্বরনাথ ‘রেণু’

রেণু ছিলেন চরম বিদ্রোহী, শুধু দেশ নয়, দেশের বাইরে নেপাল রাষ্ট্রের সমস্যা নিয়ে তিনি ভাবিত ছিলেন। ‘মুক্তিসংগ্রাম’ সমাজবাদের ভবিষ্যৎ, ভারতীয় রাজনৈতিক আন্দোলন এবং পরিশেষে নিজের মধ্যে জন্ম নেওয়া দেশকেন্দ্রিক আত্মসংগ্রাম – সবটাই তাঁর জীবনকে প্রভাবিত করেছিল। নেপালি আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর রেণু উপলব্ধি করলেন, ব্যর্থতাই আগামী দিনের সাফল্যের পথ উন্মোচন করে। এই সম্ভাব্যতার আলোক বিচ্ছুরণ দেখা যায় ময়লা আঁচলের চরিত্রগুলির মধ্যে। সম্ভাব্যতাই জীবন এবং কালপ্রবাহ।

ভারতবর্ষে তখন ঘটে চলেছিল নানা ঘটনা এবং তারই মধ্যে বামপন্থী শক্তি একে অপরের কাছাকাছি আসতে শুরু করে। কংগ্রেসিদের একাধিপত্যের ফাটল সূচিত হলো সারাদেশে।
এ-উপন্যাস শুরুতে মনে করায় ১৯৪২-এর ভারতবর্ষকে। বুর্জোয়া নেতৃত্বের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা বিভাজনজনিত সংকট। পরবর্তী সময়ে কংগ্রেস এক সংকটাপন্ন অবস্থায় দাঁড়াল। রেণু প্রত্যক্ষ করছেন সবটাই এবং মনের গহনে তিনি সৃষ্টি করছেন এক ভাবনার জগৎ। তিনি একেবারেই গ্রন্থলব্ধ জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন না। তিনি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঘটনাবলির দ্বারা সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি আশা করতেন, দেশবাসীর দ্বারাই পরিবর্তন আনা সম্ভব। কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আসক্তি থাকলেও তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন না। সমাজবাদী মানসিকতায় তাঁর মনন-চিন্তন ছিল সম্পৃক্ত। জয়প্রকাশ নারায়ণের প্রতি তিনি ছিলেন মাত্রাতিরিক্ত আস্থাভাজন। এ-সময় রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতি তিনি নির্ভরশীল হচ্ছিলেন, যার প্রভাব পড়েছে এ-উপন্যাসটিতে। কালীচরণ আমাদের সেই হদিস দেয়। জয়প্রকাশ নারায়ণের হাজারীবাগ জেল থেকে নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনা তাঁর সৃষ্টিশীল মনকে প্রভাবিত করেছিল। ময়লা আঁচলে সোশ্যালিস্ট পার্টির সমর্থক কালীচরণ জেল থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কাহিনি কোথাও যেন মনে করিয়ে দেয়।

রেণু গ্রামকে কোনো সময় উপেক্ষা করেননি। পাটনায় বসে তিনি লিখেছেন ময়লা আঁচল। আপাত নিরীহ আশাভঙ্গ গ্রামীণ সমাজকে তিনি ভুলে যাননি। শহরের মধ্যে থাকে গ্রামের আভাস – মার্কসীয় ভাষায় ‘নদী-মধ্যবর্তী দ্বীপ’। বামপন্থীদের কাছে তাঁর ভাষা নিন্দনীয় হতে পারে কিন্তু রেণু জানেন ভাষা কল্পনাহীন বা স্মৃতিহীন হতে পারে না, কারণ তাহলে ইতিহাস সৃষ্টি করা যায় না। তাঁর ভাষা ইতিহাস সৃষ্টিকে উসকে দেয়। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সামাজিক ন্যায় একই সঙ্গে প্রোথিত হলে উন্নয়ন সম্ভব, যার প্রকাশ আমরা দেখি প্রশান্ত ডাক্তারের ভাবনা-চিমন্তায়। ভারতীয় সামন্তপ্রথা-জর্জরিত গ্রামগুলিকে নিয়ে তিনি আগামীদিনের ইতিহাস সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। সুরেন্দ্র চৌধুরী তাঁর আলোচনায় বলেছেন –

অসুস্থতা তাঁর নৈরাশ্যকে কতখানি লুকিয়ে রেখেছিল সে কথা বলা তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। … এই প্রসঙ্গটিকে তাঁর এক অন্তর্কথা হিসেবে গ্রহণ করার পিছনে আমার নিজের সীমাবদ্ধতাটুকু রয়ে গেছে। … তবুও এটাকে কিন্তু স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া যেতে পারে। … রেণু সম্পর্কে বলা বাকি আছে এখনও অনেক কিছু কথা।

রঘুবীর সহায় যথার্থই বলেছেন –

রেণু একই সঙ্গে বাহির এবং ভিতর – দুটি দিককেই দেখতে পারেন। সেটাই তাঁর রচনাগুলিকে অর্থবহ করে তোলে।

এই সমস্ত অর্থবহ বিবরণ এ-উপন্যাসে ফুটে উঠেছে সার্থকভাবে। স্বাধীনতার ভাবনা ঔপন্যাসিককে ভাবিত করেছিল। তিনি সেই ইতিহাস নির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর প্রতিবেদনেও সে ভাবনার প্রতিফলন আমরা দেখতে পারি। তাঁর কাছে স্বাধীনতার অর্থ ছিল সম্পূর্ণ মুক্তি কিন্তু রাজনৈতিক দিক থেকে এটি একটি বুনিয়াদি ব্যাপার। রেণুর কাছে সৌন্দর্যের বিষয় ছিল – লোকজীবন এবং তাদের জীবনে সম্পৃক্ত নানান ঘটনা। এ-সমস্ত সমস্যা ব্যাপক এবং বাস্তব তথ্যের অপেক্ষা রাখে। স্রষ্টার মনে যদি এই সমস্যার রূপ ফুটে ওঠে তবে তাঁদের সৃজনশীল সম্ভাবনারও প্রসার ঘটে। এসব বস্ত্তগত তথ্য থেকেই রেণুর সৃজনশীল মনটি প্রেরণা লাভ করে। স্বাধীনতার পর বাস্তব
চিমন্তা-চেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে, যাকে ঐতিহাসিক ঘটনানির্ভর করলে ভালো হয়। এটি একজন ঐতিহাসিকের পক্ষে যেমন জরুরি ছিল, তেমনি একজন ইতিহাস ও সমাজচেতন ঔপন্যাসিকের পক্ষেও জরুরি ছিল। এখানে সমকালীন সিস্টেমের অন্তর্বিরোধ এবং সমসাময়িক জনতার অন্তর্বিরোধ – দুটিই প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। এই দুই অন্তর্বিরোধের কোনো সমাধানই ঘটেনি। নির্মল বর্মা এই সমকালীন বাস্তবতাবাদকে বলতে চাইলেন যে, সম্ভবত রেণুই হলেন সেই হিন্দি ঔপন্যাসিক যিনি প্রেমচন্দ্রীয় উপন্যাসের narrative বা বর্ণনামূলক ঘটনা-পরম্পরাকে এমন নাটকীয়, নমনীয় এবং কাব্যাত্মক রূপে গড়ে তুললেন। রেণু যে শিল্পসম্মত বাস্তবতাবাদকে নিয়ে এলেন তা ছিল অবশ্যই অতীত প্রবহমানতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। বৃদ্ধ অতীতের প্রবহমানতা এবং বর্তমান অন্তর্বিরোধের ইতিহাসের মধ্যে রয়ে গিয়েছে তৃতীয় বিশ্বের জন্মের নাটকীয়তা।

ময়লা আঁচল জনজীবনের মাঝখান থেকে বেরিয়ে আসা নতুন অন্তর্বিরোধের সঙ্গে নানা শক্তিসমূহের পুনর্গঠন এবং সংঘটনের
মর্মকথা। শুধু নাটকীয়তার জন্য এ-উপন্যাস শক্তিশালী নয়। উপন্যাসটির মধ্যে ইতিহাস এবং জনতার নবজীবনের উত্থান-পতনের এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া আছে, আছে এক নতুন জগৎ সৃষ্টির উন্মাদনা – যে-উন্মাদনা প্রকাশ পায় জেলফেরত ডাক্তারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মধ্যে। রেণু কোনো রূপক সৃষ্টি করেননি, ঐতিহাসিক সত্যের ক্ষেত্রে রূপকের প্রয়োজন নেই। সমগ্র উপন্যাসে আছে সৃষ্টির গতিশীলতা যার সঙ্গে ঔপন্যাসিক সমকালীন বাস্তবতাকে মিলিত করে দিয়েছেন। বালদেও দ্বারা জাতির জনকের প্রতি যে মিথ নির্মিত হয়েছিল তাকে অশ্রম্নবন্যা দিয়ে পস্নাবিত করে দেওয়া হয়েছে, যার চরম নিদর্শন বামনদাস বালদেওর অবস্থান।

আপাতদৃষ্টিতে উপন্যাসের গ্রামকেন্দ্রিক চঞ্চল মেরীগঞ্জ নিরীহ বলেই প্রতিপন্ন হয়; কিন্তু এই আপাতনিরীহ, শান্ত গ্রামের কেন্দ্র থেকেই জন্ম নেয় নতুন শক্তিপ্রবাহের ইতিহাস – এ-ভাবনা আগেও দেখা গিয়েছে। সামন্তবাদী চিমন্তা-চেতনার পরিবর্তে সমাজবাদী চিমন্তা-চেতনার প্রতিষ্ঠা করেছে এই আপাতনিরীহ শান্ত গ্রামগুলি। এখানেই সৃষ্টি হয়েছে গণতন্ত্রের নতুন ইতিহাস। বালদেও আর  বামনদাস কেমন করে যেন ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছিল। সোশ্যালিস্ট পার্টির উদীয়মান নেতা কালীচরণ তাদের বোঝায় –

সুস্লিংগ পার্টি! এই হল আসল পার্টি, গরম পার্টি বুঝলি? কিরান্তি দলের নাম শুনিস্ নি? … ওই পার্টি। এই পার্টিতে কোন লীডর্, নেই। সবাই, সববাই হল এই পার্টির লীডর্। শুনিস্ নি। হিংসা বাত তো বলে বুরজুয়া লোকেরা। বালদেওজি তো হল বুরজুয়া, পুঁজিবাদী।

১৯৩০-এর আশপাশে গ্রামগুলিতে বামপন্থী শক্তিগুলির প্রবেশ। এর আগে হয়েছে কৃষক-আন্দোলন। ১৯৩৯-এ অখিল ভারতীয় কিষান সভার রাষ্ট্রীয় অধিবেশন হয়। ১৯৪৬-এ সোশ্যালিস্ট পার্টির অগ্রগতিপূর্ণ ভূমিকা লক্ষণীয়। অর্থাৎ কংগ্রেস ছাড়াও অন্যরাও যে আছে – তারই ইতিহাস যেন নির্মিত হতে লাগল। সোশ্যালিস্ট পার্টির আহবানে গ্রামে সাঁওতালপল্লি উন্মত্ত হয়ে উঠল – এই উন্মত্ততা গ্রামে হাসপাতাল তৈরিতে দেখা যায়নি। ফণীশ্বরনাথ রেণু তাঁর উপন্যাসে পরিবর্তনের ইতিহাসকে বিশেষভাবে নির্মাণ করেছেন। বাস্তব রাজনীতি তো আছেই  – কিন্তু তারই অন্তরালে কাব্যিক সত্যের এক মানবিক ইতিহাস গড়ে তোলেন তিনি। নতুন বাস্তব ইতিহাসের স্রষ্টা তিনি। গ্রাম-শহরের বিভাজন দূরীভূত করে সমন্বয়ধর্মী প্রতিবেশের উপস্থাপন।

শুধুই যে নাটকীয়তা – তা বা বলি কেমন করে? উপন্যাসটির মধ্যে ইতিহাস এবং জনতার নতুন জীবন সম্পর্কের ভাঙাগড়ার এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া আছে।

বালদেওজি ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসে। এ এমন এক চরিত্র যে ভাঙে না বা বিচ্ছিন্ন হয় না; কিন্তু বিষণ্ণ হয় আর বামনদাস – সে কোথায় যেন একাকী হয়ে যায়। বামনদাস নিঃসঙ্গ তবুও সে মাঝে মাঝে উঠে দাঁড়ায়। ভারত মায়ের কান্নার শব্দ যেন ছড়িয়ে পড়ে। বালদেওজি মাঝে মাঝেই আক্ষরিকই ইতিহাসে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে আবার উদাস হয়ে যায়, বামনদাসের এক অপরাজিত কণ্ঠস্বর, যে ১৯৩২-এর সক্রিয় কর্মী। ১৯৪২-এর অপরাজেয় নায়ক পরিশেষে হয়ে যায় নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন।

মেরীগঞ্জ এবং তার সন্নিহিত অঞ্চলের পরিবর্তনকে ইতিহাসের একটি পর্বের মতোই গ্রহণ করা যেতে পারে। মেরীগঞ্জের সাঁওতালদের সশস্ত্র সংগ্রাম মাঠে মারা যায় কারণ তাদের কোনো সাংগঠনিক ভিত্তি নেই। তবে এক্ষেত্রে এটিই শুভ লক্ষণ যে, সে সামন্ততান্ত্রিক। পুঁজিবাদী শক্তির বিরোধী সত্তার জাগরণে গ্রামে হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। বহু পুরনো অথচ প্রতিনিয়ত যে দুটি রোগে সর্বস্বান্ত গ্রাম্যজীবন – ক্যান্সার, ম্যালেরিয়া – তা রোধ করার জন্যই এই হাসপাতাল স্থাপন। গ্রাম যে বদলে যাচ্ছে তা এরই মধ্য দিয়ে প্রমাণিত। বাস্তব ইতিহাসের পরতে পরতে কল্পনায় বেড়ে ওঠা ইতিহাস কোথায় যেন নির্মিত হতে থাকে।

আর এ নতুন ইতিহাস নির্মাণ করেন ডাক্তার, যিনি সম্ভ্রান্ত, শিষ্ট এবং বহিরাগত যুবক। রেণু চাইলেন অচলায়তন গ্রাম্যজীবনে বাইরের হাওয়া আনতে। ডাক্তার নিঃসঙ্গ এক মানুষ। জাত-বিচার সে করে না, প্যারুদোসাদের হাতের ছোঁয়া নিতে তার কোনো আপত্তি নেই। গ্রামে এসে সে অন্দরমহলে নিজের স্থান করে নিতে পারে অনায়াসে। গ্রাম্য প্রতিবেশ দর্শন করে সে উদ্বেলিত হয়। এই মূক, নিরন্ন মানুষগুলির মুখে দিতে চায় ভাষা, মনে জাগাতে চায় নতুন দিনের আশা। তাঁর জাত? সে ডাক্তার। গ্রামের তহশিলদারের মেয়ের সঙ্গে তাঁর প্রেম হয়। রেণু বোঝাতে চাইলেন, ডাক্তার মিথ্যা কল্পনায় বিলাসী নয়। তাঁর দায় যেমন আছে, তেমনি আছে দায়বদ্ধতা। মমতাকে লেখে –

এখানকার মাটিতে ছড়িয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ মানবজীবনের সুন্দর স্বপ্নগুলিকে জড়ো করে, তাদের অপূর্ণ ইচ্ছাগুলিকে একত্রিত করে এখানকার প্রাণীদের জীনকোষ ভরে দেবার স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমি কল্পনা করেছিলাম যে হাজার হাজার স্বাস্থ্যবান মানুষ হিমালয়ের তরাই অঞ্চলের গিরিকন্দরে, ত্রিবেণীসঙ্গমে, শোন-কোসীর সঙ্গমে একটি বিশাল বাঁধ তৈরি করার জন্য পাহাড় ফাটিয়ে পরিশ্রম করছে। লক্ষ লক্ষ একর বন্ধাভূমি, কোসী কবলিত অনাবাদী মৃত্তিকা শস্য শ্যামলা হয়ে উঠবে। কাফনের মতো সাদা বালিতে ভরা প্রান্তর ধানীরঙা জীবনের পাতাগুলিতে ভরে যাবে। মকাইয়ের ক্ষক্ষতে ঘাস তুলতে থাকা মেয়েরা অকারণে হেসে উঠবে। তাদের মুক্তোর মতো সাদা দাঁতের ঝিলিক … ইত্যাদি।

গরিবি আর নিরক্ষরতা ভরা গ্রাম্যজীবনে নতুন ইতিহাস সৃষ্টির দায়ভার রেণু দিলেন না গান্ধিবাদী বালদেওজি, বামনদাস অথবা সোশ্যালিস্ট পার্টির কালীচরণকে, দিলেন না লক্ষ্মীকে; কিন্তু তিনি সেই দায়ভার অর্পণ করলেন বহিরাগত, নিরপেক্ষ এক ডাক্তারকে, যার কথায় কোনো নাটকীয়তা নেই, আছে বৈজ্ঞানিক স্থৈর্য, মানবিকতার স্পর্শ এবং কখনো বা কবিত্বের ছোঁয়া। আগামীদিনের ইতিহাস তাঁকে নির্ভর করতে পারে। সে দায়িত্ব নিয়ে প্রেম করে। সমস্ত বিরোধ, সংশয়কে দূরে রেখে কমলীকে বিয়ে করে, তার সমন্তানের পিতৃত্ব স্বীকার করে।

সঙ্গী মমতাকে তাই সে নয়া ইতিহাসের গল্প শোনায়, যে-ইতিহাস কোনো দলতন্ত্রনির্ভর নয়, তা একান্তভাবেই মানবিক দায়বদ্ধতার নয়া ইতিহাস –

মমতা! আমি আবার কাজ শুরু করব – এইখানে, এই গ্রামে। আমি ভালোবাসার চাষ করব, মমতা। অশ্রম্নসিক্ত মাটির বুকে ভালোবাসার নতুন চারারা সতেজ, সজীব হয়ে উঠবে। আমার সাধনা শুরু হবে – পলস্নীমায়ের ময়লা আঁচলের ছায়ায়। মহৎ কিছু, বিরাট কিছু নাই হ’ল – অন্ততঃ একটা গ্রামের একমুঠো মানুষের রঙকরা মুখে হাসি ফিরিয়ে আনতে পারব, তাদের বুকে আশার আর বিশ্বাসের অঙ্কুর জাগিয়ে তুলতে পারব তো …।

– এখানেই কাব্যিক সত্যের অন্তরালে সৃষ্টি হয় নয়া ইতিহাস, যার স্রষ্টা ফণীশ্বরনাথ রেণু, যিনি মৃত্যুর আগে, শরীর যখন ভেঙে পড়েছে হাসপাতালে ভর্তি আছেন, দর্শনার্থীদের তিনি দয়াল সাক্সেনার একটি কবিতার দুটি পঙ্ক্তি শোনাতেন –

চট্টানো পর অঙ্গরাই লে রহা হ্যায় –

কালা তেন্দুয়া

চট্টানো কা রঙ বদল রহা হ্যায়।

 

অর্থাৎ –

প্রস্তরখ–র ওপর ঘুম ভেঙে জেগে

উঠছে কালো চিতা –

প্রস্তরখ–র রং বদলে যাচ্ছে।

বদলের ইতিহাসের ডাক শুনিয়েছিলেন ডাক্তার প্রশান্তর কণ্ঠে।

 

গ্রন্থসূচি

১.    কোরক, সাহিত্যপত্রিকা, সতীনাথ ভাদুড়ী সংখ্যা।

২.    সুরেন্দ্র চৌধুরী, ফণীশ্বরনাথ রেণু, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ২০১৫, সাহিত্য অকাদেমি, ভারত।

৩.   চিত্রিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দি সাহিত্যের রূপরেখা, বইমেলা ২০০৪, পুস্তক বিপণি, কলকাতা।

৪.    তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, হাঁসুলী বাঁকের উপকথা, তারাশঙ্কর রচনাবলী, সপ্তম খ-, ফাল্গুন ১৪১৫, মিত্র ঘোষ, কলকাতা।

৫.    সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়, হিন্দি সাহিত্যের পঞ্চরত্ন, পুনর্মুদ্রণ সেপ্টেম্বর ২০০৫, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা।

৬.   সতীনাথ ভাদুড়ী, ঢোঁড়াই চরিত মানস, নতুন সংস্করণ ২০০৪, বেঙ্গল পাবলিশার্স, কলকাতা।

৭.            ফণীশ্বরনাথ রেণু, ময়লা আঁচল, প্রসূণ মিত্র (অনুবাদ), পঞ্চম পুনর্মুদ্রণ, ২০১৪, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া।