মাহমুদ দারবিশ
ভূমিকা : আনোয়ারা সৈয়দ হক
কবি-সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক বিভিন্ন ভাষার বিপুল পরিমাণ কবিতা অনুবাদ করেছেন, যা তাঁর বিম্বিত কবিতাগুলো এবং অনুবাদ কবিতাসমগ্র বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে সম্প্রতি এর বাইরেও তাঁর কিছু অনুবাদ-কবিতার সন্ধান পাওয়া গেছে, যা এখন পর্যন্ত অগ্রন্থিত। বর্তমান কবিতাটি আবুল হাসনাত ও মফিদুল হক-সম্পাদিত হৃদয়ে আমার প্যালেস্টাইন সংকলন থেকে সংগৃহীত। সংকলনটি ২১ নভেম্বর ১৯৮২ সালে আন্তর্জাতিক প্যালেস্টাইন সংহতি দিবস উপলক্ষে
বাংলাদেশ আফ্রো-এশীয় লেখক ইউনিয়ন কর্তৃক প্রকাশিত হয়। প্রায় চার দশক আগে অনূদিত এই কবিতাটিতে সৈয়দ হকের নিজস্ব কাব্যভঙ্গি ও ভাষার ছাপ আর মুক্তিকামী প্যালেস্টাইনি জনতার প্রতি তাঁর সংহতি খুঁজে পাওয়া যাবে।
হৃৎপি–র কাঁটা –
সে তোমার দুটি চোখ,
ক্ষত করেছে করুক তবু কতোটা মোহনীয়;
আড়াল রাখি ঝড়ের থাবা থেকে,
রাত্রি এবং ব্যথার গভীরেই
ক্ষত আমার ক্ষত
জ্বালিয়ে দেয় লক্ষ তারার চোখ;
বদলে দেয় বর্তমান এমন ভবিষ্যতে
আমার চেয়েও ভালোবাসতে পারব আমি যাকে।
রাখি যখন তোমার চোখে চোখ
ভুলে যাই
একদিন তো যুগল হয়েছিলাম বটে দরজার ঐ পারে।
তোমার কথা ছিল আমার গান।
আবার আমি গাইতে গিয়ে
কোমল ঠোঁটে তুষার দেখলাম।
এবং উড়াল দিলো পাখি;
উধাও হলো আমার ঘরের দরজাগুলো,
উধাও হলো আমার চৌকাঠ,
গুঁড়িয়ে গেল আয়না আমাদের
দুঃখগুলো করল আলিঙ্গন।
আমরা তুলে নিয়েছি এই শব্দগুলোর আছড়ে পড়া কণা,
শিখেছি এই জন্মভূমির বিলাপ রচনা।
আমরা যাকে যুগল হাতে রোপণ করে দেব এই গীটারের
বুকে;
বাজাবো এই গীটারখানি কান্নাভেজা বাড়িগুলোর ছাদে,
নষ্ট চাঁদের নিচে এবং পাথরগুলোর পাশে
হায় একাকী তুমি,
আমি ভুলেই গিয়েছিলাম –
গীটার জুড়ে জং ধরেছে যে।
তোমার বিদায় কিংবা আমার স্বরভঙ্গের দায় –
জং ধরেছে তাই?
দেখেছিলাম জাহাজঘাটে শেষ তোমাকে সেই;
যাত্রী তুমি ভীষণ একা, রসদ কিছু নেই;
দৌড়ে কাছে গিয়েছিলাম এতিম যেন এক –
জবাব খোঁজে ইতিহাসের কাছে;
বাগান মরে গেলেও মাটি সবুজ কেন থাকে?
সেদিন আমি লিখেছিলাম –
জাহাজঘাটে দাঁড়িয়েছিলাম
বাতাস বড় বইছিল
কমলালেবুর খোসা কেবল –
আর আমাদের কী ছিল?
পেছনদিকে যোজনজুড়ে বালিয়াড়িই ভাঙছিল।
দেখেছিলাম কাঁটালতায় টিলা,
তুমি মেষচারিণী খুঁজছ তোমার মেষ;
এবং ভাঙা ধ্বংসাবশেষ –
একদিন তো সবুজ লতার মতো যাকে জড়িয়ে
ছিলে তুমি –
আমি সেই ধ্বংসাবশেষ ’পরে
হলাম হঠাৎ উপস্থিত
যেন বা এক আগন্তুক
নাড়ছি কড়া, উঠছে কেঁপে প্রতিধ্বনিতে দরজাগুলো
শার্সিগুলো
পাথুরে প্রাঙ্গণ।
সেই তোমাকে দেখেছিলাম গভীর ইঁদারায়,
সেই তোমাকে দেখেছিলাম গন্দমের গোলায়
সেই তোমাকে দেখেছিলাম নষ্ট চেহারায়
বাসন ধুয়ে রাখছ মাঝরাতের রেসেন্তারাঁয়
সেই তোমাকে দেখেছিলাম গুহার মুখে একা
তোমার এতিম শিশু ছেঁড়া কাঁথা মেলছ তুমি
দেখেছিলাম নর্দমাতে
দেখেছিলাম রক্তপাতে
দেখেছিলাম নীল সাগরের নুনে,
বালির প্রতি কণায় দেখেছি যে,
আমি এও দেখেছি
কী রূপসী তুমি
মাটির মতো প্রিয় আমার তুমি।
কথা দিলাম আমি
স্বপ্ন দিয়ে রুমাল বুনে দেব
তোমার জন্যেই
শব্দ দিয়ে মধুর মৌচাক
গড়ব আমি তোমার জন্যেই
ফিলিস্তিন তুমি তো ছিলে
এবং থাকবেই।
ঝড়ের মুখে খুলে দিলাম দরজার এই খিল;
দেখতে পেলাম পোড়া চাঁদের মুখ,
চোখ ফিরিয়ে নিলাম আমি বস্তিগুলোর দিকে –
সেখানে চাঁদ উধাও বহুদিন।
ও কুমারী সঙ্গিনী, ও স্বাদু আমার গন্দম
গানের তীরে আমরা চিরে দেবো এবার হাওয়া,
ঘুমিয়ে পড়া বীজে আবার দেব উর্বরতা
এবং তুমি হবে আমার হৃদয়ে সেই গাছ
যার পাতাতে সবুজ সচ্ছলতা,
যে ঝড়ের মুখে সরল খাড়া
কাঠুরিয়ার কুড়ুল তবু খাড়া
নেকড়েগুলো কামড়ে ধরে
অটুট তবু খাড়া।
ফিলিস্তিনি তোমার দুটি চোখ,
ফিলিস্তিনি উলকি তোমার ওই,
তোমার নাম ফিলিস্তিনি
তোমার মন ফিলিস্তিনি
তোমার দেহ তোমার পদচিহ্ন এবং কামিজ ফিলিস্তিনি
ফিলিস্তিনি শব্দগুলো
ফিলিস্তিনি কণ্ঠগুলো
ফিলিস্তিনি হয়েই তুমি বেঁচে থাকবে আর
ফিলিস্তিনি বিদায় নেবে তুমি।
তুমি আমার গানের আগুন
জ্বলছো রচনায়
তোমার নামের উচ্চারণে
আমার কান্না শোনা যায়।
রোমের অশ্ব আমি একদিন দেখেছি,
বিশাল মূর্তি আমি একদিন ভেঙেছি –
অশ্বের খুর এবং পাথর সাবধান :
বজ্রে পাথর গুঁড়ো হয়ে গেছে আজ।
আমার মাংসে লাগুক না কৃমিকীট :
ফড়িং জন্ম দেয় না ঈগল পাখি,
সাপ থেকে শুধু সাপের ছানাই হয়।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.